চৈতি বাঈয়ের মামলা – ২

দুই

লক্ষ্নৌ পুলিশের বড়কর্তা জ্যাকসন সাহেব সুমনকে দেখে হৃষ্ট হলেন। বললেন, আমাদের আলাপ না থাকলেও আমি তোমাকে জানি। তোমার বাবা লেট পাবলিক প্রসিকিউটার সদাশিব চৌধুরি আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। তুমি একজন বাডিং ব্যারিস্টার, সে খবরও আমি রাখি। হাসান মার্ডার কেসটায় তুমি জিতেছ বলে আমি কত খুশি হয়েছি জানো?

সবিনয়ে সুমন বললে, আপনার কথায় আমি গর্ব বোধ করছি। কিন্তু পুলিশ হেরে যাওয়ায় আপনি খুশি হলেন কেন বুঝতে পারছি না।

দরজা গলায় জ্যাকসন সাহেব হাসলেন। বললেন, মামলায় হেরে যাওয়াটা পুলিশের লজ্জা নয়। কোনো নির্দোষ যদি অযথা শাস্তি পায়, সেটাই লজ্জার কথা। হাসান মার্ডার কেসে আসামিকে নির্দোষ প্রমাণ করে পুলিশকে তুমি সেই লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছ।

আপনি মহৎ।

এটা মহত্বের কথা নয়, নীতির কথা।—যাকগে, তোমার জন্যে আমি কি করতে পারি ইয়ংম্যান?

এই লক্ষ্মৌ শহরে পুলিশ এক বাঈজিকে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করেছে আপনি জানেন নিশ্চয়?

জ্যাকসন সাহেব বললেন, তুমি কি চৈতি বাঈয়ের কথা বলছ?

সুমন ঘাড় নাড়লে।

জ্যাকসন আবার প্রশ্ন করলেন, এই মামলায় তুমি কি ইন্টাররেস্টেড? ডিফেন্ড করবে?

সুমন বললে, ইচ্ছে তাই, যদি আপনার সাহায্য পাই!

কিভাবে সাহায্য চাও বলো?

এই খুন সম্পর্কে পুলিশ যা রিপোর্ট দিয়েছে, তাই জানতে চাই।

তামাকের পাইপটা দাঁতে কামড়ে জ্যাকসন কয়েক মুহূর্ত গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, পুলিশের রিপোর্ট পুলিশ ছাড়া অন্য কাউকে জানানো নিয়মবিরুদ্ধ। হাউ এভার, বন্ধুর ছেলে হিসেবে তোমাকে বলতে আমার আপত্তি নেই।

সেটা আমার সৌভাগ্য।—সুমন বললে।

জ্যাকসন সাহেব চৈতি বাঈয়ের ফাইল আনালেন। সেটা দেখে যা বললেন, সংক্ষেপে তা এই:

গত ২১শে জুলাইয়ের রাতটা ছিল ঝড়—বৃষ্টির রাত। লক্ষ্নৌ শহরে এতখানি দুর্যোগ এ—বছরে আর হয়নি। বিকেল থেকেই ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছিল, সন্ধের পর নামল মুষলধারে বৃষ্টি। রাত সাড়ে দশটায় থানায় টেলিফোন বেজে উঠল ঝনঝন শব্দে। টেলিফোন ধরতেই শোনা গেল পুরুষের গলা। বললে, গোল—দরওয়াজায় সোহিনী বাঈয়ের বাড়িতে এইমাত্র একটা খুন হয়েছে। এখুনি আসুন।

থানার অফিসার জিজ্ঞেস করলে, আপনি কে? কোত্থেকে ফোন করছেন?

জবাবে শুধু লাইন কাটার আওয়াজ শোনা গেল।

গোল—দরওয়াজা হচ্ছে লক্ষ্নৌর বাঈজি—মহল্লা। সোহিনী বাঈ সেখানকার নাম—করা বাঈজী। পুলিশ যথারীতি সেখানে গেল সেই দুর্যোগ মাথায় করে। গিয়ে দেখে সারা বাড়ি অন্ধকার। মেনসুইচ কে যেন অফ করে দিয়েছে। পুলিশ আলো জ্বাললে। নিচের তলায় সিঁড়ির মুখে আধাবয়সী চাকর রামু হতভম্ব হয়ে বসেছিল! পুলিশের প্রশ্নে সে বললে, টেলিফোন সে করেনি, তবে এ বাড়িতে খুন হয়েছে সত্যি। বৃষ্টির রাত বলে সকাল—সকাল খাওয়া—দাওয়া সেরে নিচের তলায় নিজের ঘরে সে ঘুমোচ্ছিল, হঠাৎ দোতলা থেকে পিস্তলের আওয়াজে তার ঘুম ভেঙে যায়। তাড়াতাড়ি সে দোতলায় উঠে দেখে—

রামু শিউরে উঠে থেমে গেল।

রামুকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ দোতলায় উঠল। কেউ কোথাও নেই। বারান্দার মাঝামাঝি মাইফিল—ঘর। সেখানে পা দিতেই পুলিশ দেখল, দামি জাজিম—পাতা ফরাসের ওপর বছর তিরিশের এক সুদর্শন যুবা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। খোলা চোখ—দুটিতে তখনও আতঙ্কের ছায়া। গাঢ় রক্তে জাজিমটার অনেকখানি ভিজে গেছে। পুলিশ পরীক্ষা করে দেখলে, প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই যুবকটির দেহে।

পাশে পড়ে রয়েছে ছোট একটা রিভলভার। ছ’টা টোটার মধ্যে একটা নেই।

রামু এবং আশপাশের বাঈজি—বাড়ি থেকে জানা গেল যে, বছর খানেক হল সোহিনী বাঈ মারা গেছে। তার মেয়ে চৈতি বাঈয়ের আপনার লোক বলতে আর কেউ ছিল না। মায়ের মৃত্যুর পর পুরোনো চাকর রামু, দাঈ ঝুলনিয়া আর সারেঙ্গিওয়ালা রংলালকে নিয়ে সে—এ বাড়িতে বাস করছিল। মুজরো সে কালেভদ্রে করত, কিন্তু জয়প্রকাশ বলে একটি শৌখিন ছোকরার প্রায়ই আসা—যাওয়া ছিল এখানে। রামু এবং প্রতিবেশীরা মৃতদেহ জয়প্রকাশেরই বলে শনাক্ত করল।

ঘটনার দিন দুপুরবেলা দাঈ ঝুলনিয়া মকবুলগঞ্জে তার ননদিয়ার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। সম্ভবত ঝড়—বৃষ্টির জন্যেই সে ফিরতে পারেনি। বাড়িতে ছিল শুধু…একতলায় রামু, আর দোতলায় চৈতি বাঈ।

রংলাল?—সুমন প্রশ্ন করলে।

জ্যাকসন বললেন, রংলালের প্রশ্নই ওঠে না। ঘটনার হপ্তাখানেক আগে রংলাল এলাহাবাদ গিয়েছিল। গঙ্গা—যমুনার সঙ্গমের কাছে সে পাড় ভেঙে ডুবে মারা যায়। সুতরাং, খুনের সময় বাড়িতে ছিল কেবল রামু আর চৈতি বাঈ। রামুকে পাওয়া গেল, কিন্তু চৈতি বাঈ? সারা বাড়ি, সারা মহল্লা তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার পাত্তা পাওয়া গেল না।

সেই তুফানের মধ্যেও চৈতি বাঈ ফেরার!

জানা গেল, রিভলভারটা চৈতি বাঈয়ের। তাছাড়া, রিভলভারে পাওয়া গেল তারই আঙুলের ছাপ। পুলিশ সন্ধান শুরু করলে। লক্ষ্নৌ থেকে বেরিলি, বেরিলি থেকে চন্দনচৌকি। তারপরের ঘটনা তোমার জানা।

জ্যাকসন থামলেন। বন্ধ করলেন ফাইলটা।

সুমন বললে, দু—একটা প্রশ্ন করতে চাই, যদি অনুমতি দেন।

স্বচ্ছন্দে।

খুনের রাতে থানায় কে টেলিফোন করেছিল, পুলিশ জানতে পেরেছে কি?

না। শুধু জানতে পেরেছে যে একটা পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করা হয়েছিল।

গলার আওয়াজ থেকে অনেকসময় বয়স অনুমান করা যায়। তাই নয় কি?

রাইট। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি। কেননা, গলার আওয়াজটা ছিল ভাঙা ভাঙা।

ও! আচ্ছা, পুলিশ চৈতি বাঈয়ের ডেরা তল্লাশি করে রিভলভার ছাড়া আর কিছু পেয়েছে?

সন্দেহজনক একটা মাত্র জিনিস পেয়েছে।

সেটা কি?

কতকগুলো ছোঁড়া কাগজের টুকরো। ঝোড়ো—হাওয়ায় ঘরময় উড়ছিল। সেগুলো সংগ্রহ করে জোড়া লাগিয়ে দেখা গেছে, সেটা একখানা টাইপ—করা দানপত্র।

দানপত্র! কে কাকে দান করছে?

চৈতি বাঈ তার যাবতীয় সম্পত্তি জয়প্রকাশকে দিয়ে দিচ্ছে। তলায় চৈতির সই। সইটা অবশ্য সম্পূর্ণ হয়নি।—আর কোনো প্রশ্ন আছে?

না। আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম, মাপ করবেন।

দরজা গলায় আবার হেসে জ্যাকসন বললেন, নষ্ট কিছু নয়, তোমার কাজে লাগতে পেরে আমি খুশি হয়েছি ইয়ংম্যান। দরকার হলে আবার এসো।

ধন্যবাদ জানিয়ে সুমন উঠে পড়ল।

.

রাজু বললে, গিরিজায়ার সায়া—পরা কন্যা বেশ মায়া ছড়িয়েছে দেখছি! তা নইলে এমন কাঠখোট্টা মানুষ হয়ে একটা বাঈজির কেসে তুই ফেঁসে গেলি ইয়ার!

রাজু ওরফে রাজীব চাটুজ্যে সুমনের বাল্যবন্ধু। বংশানুক্রমে ওরা লক্ষ্নৌ শহরের বাঙালি রহিশ। রাজুর আমলে অবস্থা পড়তি। তবু বনেদি শৌখিনতাটুকু এখানে তার সাজপোশাকে বর্তমান। একটা লম্বা ঝুল—ঝাড়া বাঁশকে চুড়িদার পায়জামা, কল্কাদার পাঞ্জাবি আর ঝাঁকড়া মাথায় আদ্দির টুপি পরালে যেমন দেখতে হয়, রাজুকে দেখতে অবিকল তেমন।

সুমনের সঙ্গে সেও একসময় আইন পড়তে শুরু করেছিল, কিন্তু দেখা গেল আইন—চর্চার চেয়ে নাটক—চর্চার প্রতি তার ঝোঁক বেশি ফলে আইন পড়তে পড়তে রাজু নাট্যকার হয়ে উঠল। বাপের পয়সা দু—হাতে খরচ করে একটা শখের দলও বানিয়ে ফেলল। মহাসমারোহে একটা পাবলিক হল ভাড়া নিয়ে শুরু হয়ে গেল, দি গ্র্যান্ড মুনলাইট থিয়েটার। বলা বাহুল্য নাটকগুলি তার নিজের লেখা। কিন্তু বছর খানেক যেতে না যেতেই মুনলাইট থিয়েটার রেড লাইট জ্বালল।

রাজু কিন্তু দমল না। বললে, জিনিয়াসের লক্ষণই এই। পাবলিক আমার নাটক এখন বুঝল না, পরে বুঝবে।

সুমন বললে, খুব হয়েছে। বাপের পয়সা তো শেষ করে এনেছিস, এবার একটা চাকরি কি ব্যবসা কর।

রাজু শুধু বললে, চ্ছোঃ!

থিয়েটারের শ্বেতহস্তী পোষার খরচটা অতঃপর বাঁচল বটে, কিন্তু নাটক লেখা রাজু ছাড়ল না। আর, রাজুকে ছাড়ল না সুমন। রাজু লোকটা দিলদার, আমুদে আর রসিক। হয়তো সেই কারণেই সুমন তাকে পছন্দ করে।

হজরতগঞ্জে সুমনের বাড়ি। বিকেলবেলা কফির পেয়ালা নিয়ে দুই বন্ধুতে কথা হচ্ছিল। সুমনের লাইব্রেরিতে বসে।

রাজু বললে, শান্তিলতা ওরফে চৈতি বাঈয়ের কেস নিয়ে খাসা নাটক হয় ইয়ার! কিন্তু একটা তয়ফাউলির কেসে তুই ফেঁসে গেলি! তাজ্জব!

একটা ল—জার্নাল ঘাঁটতে ঘাঁটতে সুমন বললে, কেসই এখনো শুরু হয়নি, আর তুই বলছিল ফেঁসে গেলাম!

রাজু সুমনের টিন থেকে ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললে। তারপর গম্ভীর হয়ে বললে, ফেঁসে হয়তো এখনো যাসনি, কিন্তু যাবি।

যাব?

আলবাৎ।

সুমন কৌতুকবোধ করলে। বললে, কি করে বুঝলি?

আমি হলাম ঝানু নাট্যকার, আমি বুঝব না? ফুঃ করে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লে রাজু। ছেড়ে বললে, গোধূলিয়া পাহাড়ে যে নাটক শুরু হয়েছে, তার ফর্মুলা কি জানিস? তবে শোন। পয়লা অ্যাক্টে হিরোইন মরতে যাচ্ছিল, হিরো বাঁচাল। দোসরা অ্যাক্টে হিরো মরতে যাবে, হিরোইন বাঁচাবে। আর লাস্ট অ্যাক্টে দুজনে মরতে যাবে নাট্যকার বাঁচাবে।

উচ্চচকণ্ঠে হেসে উঠল সুমন। হাসতে হাসতেই বললে, শাবাশ নাট্যকার! কিন্তু তার আগে হিরোইনকে ফাঁসিকাঠ থেকে বাঁচাতে হবে যে!

বাঁচাতে হয়, তুই ব্যারিস্টার মানুষ, তুই বাঁচা।

বাঁচা বললেই কি বাঁচানো যায়? জটিয়াবাবা বিস্তর জট পাকিয়েছে, সে জট ছাড়াতে হবে।

ছাড়া।—রাজু এমনভাবে বলল, ব্যাপারটা যেন পায়জামার দড়ি খোলার মতো সহজ কাজ।

সুমন এবার গম্ভীর হয়ে বললে, তোকে আমার দরকার রাজু।

রাজু সোজা হয়ে বসল: আমাকে! বলিস কি!

থিয়েটারের দৌলতে লক্ষ্নৌ শহরের অনেক ঘাঁটিই তো তোর জানা?

তা জানা বইকি! বাপের ক্যাশ উড়িয়ে অনেক ঘাটের জলই টেস্ট করে দেখেছি ইয়ার!

গোল—দরওয়াজার খবর রাখিস?

এককালে রাখতাম। এখন চামেলি আতরের দর চাল্লিশ, আর হোয়াইট লেবেলের দর পঞ্চাশ! খবর রাখব কি করে ইয়ার?

আমাকে একদিন নিয়ে যাবি?

রাজু সোজা হয়ে বসেছিল, এবার সোজা দাঁড়িয়ে উঠল বললে, তুই যাবি! গোল—দরওয়াজায়! কেন মজাক ওড়াচ্ছিস ইয়ার?

মিটিমিটি হেসে সুমন বললে, কেন, আমার শখ হতে নেই? নিয়ে যেতে পারবি কিনা বল।

তা আর পারব না?—রাজু সোৎসাহে বলে উঠল, খুব পারব। গোল—দরওয়াজা কেন, জাহান্নমের দরওয়াজা অবধি এগিয়ে দিতে পারব। কবে যাবি বল?

সময় মতো বলব।

ঠিক আছে। চলি।

দু’পা এগিয়েই রাজু ব্যস্ত হয়ে ফিরে এল : ইস, বড্ড ভুল হয়ে গেছে! দশটা টাকা হবে?

হেসে ফেললে সুমন। তাকে দেখলে এই বিশেষ ভুলটা রাজুর প্রায়ই হয়। একটা দশ টাকার নোট বের করে বললে, সন্ধের খরচটা আজ শর্ট পড়েছে বুঝি? থিয়েটার ছাড়লি, আর ওটা ছাড়তে পারলি না?

পারতাম। কিন্তু পাছে সন্নেসি হয়ে যাই, সেই ভয়ে ছাড়িনি।

নোটখানা পকেটে পুরো রাজু চলে গেল।

আবার ফিরে এল তক্ষুনি। বললে, এক বিধবা বুড়ি তোকে খুঁজছে ইয়ার। গিরিজায়া না কি—

হতে পারে। পাঠিয়ে দে।

গিরিজায়া এলেন। উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলেন, শান্তি কেমন আছে বাবা?

যেমন দেখেছিলেন, তেমনই।—সুমন জবাব দিলে।

ও কি তাহলে পাগল হয়েই থাকবে?

সেটা ডাক্তারে বলতে পারে। আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি যে আপানার মেয়ে সেরে না উঠলে, মামলা শুরু হবে না।

গিরিজায়া আস্তে আস্তে তাঁর আঁচলের গেরো খুলতে লাগলেন। বেরোল সেকেলে একজোড়া মকরমুখো বালা। সুমনের সামনে বালাজোড়া রেখে গিরিজায়া কুণ্ঠিতভাবে বললেন, এছাড়া আমার আর কিছুই নেই বাবা। এ দু’গাছা রেখেছিলাম শান্তির বিয়ের জন্যে। মামলা যখন শুরু হবে, তখন কাজে লাগিও।

নরম গলায় সুমন বললে, এ দুটো এখন আপনার কাছেই থাক। দু’—একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপনাকে।

বলো।

আপনার সখী সোহিনী বাঈ বাঈজি ছিলেন, একথা আপনি জানতেন?

বাঈজি ছিল! সোহিনী! না, না।

পুলিশের রিপোর্ট তাই জানা গেছে। বড় হয়ে আপনার মেয়েও ওই পেশা নিয়েছিলেন, তাও জানা গেছে।

গিরিজায়া যেন মূর্ছা গেলেন। মূর্ছাহতের মতোই বিড়বিড় করে বললেন, আমি কিছুই জানিনে বাবা। সোহিনীও আমাকে কোনোদিন জানতে দেয়নি, শান্তিও না। কিন্তু—

গিরিজায়ার রেখাবহুল মুখখানা কঠোর হয়ে উঠল। যেন জ্বলে উঠল স্তিমিত চোখদুটো। কঠিন গলায় বললেন, তবে আর কেন? আমি ফিরেই যাই বাবা। শান্তির ফাঁসি হয়ে গেলে আমায় খবর দিও।

বালাজোড়া তুলে নিয়ে গিরিজায়া বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, সুমন ডাকলে, দাঁড়ান। গিরিজায়া থামলেন।

শান্ত গম্ভীর গলায় সুমন বললে, অপরাধটা কার বেশি বলতে পারেন? যে—মেয়ে অবস্থার ফেরে বাঈজি হয়ে যায়, না যে—মা টাকার বদলে বাঈজির ঘরে মেয়ে বেচে দেয়?

স্তব্ধ হয়ে রইলেন গিরিজায়া। একটু পরে বললেন, বয়সে আমি তোমার মায়ের মতো না হলে মাপ চাইতাম। হোক বাঈজী, তবু তো পেটের মেয়ে। কথা দাও বাবা, ওকে তুমি বাঁচাবার চেষ্টা করবে!

কথা দিলাম।

ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন গিরিজায়া।

.

কাঁটায় কাঁটায় দশটার সময় ডক্টর কেশকার এসে ঢুকলেন জ্যাকসন সাহেবের ঘরে।

সুমনও অপেক্ষা করছিল।

জ্যাকসন প্রশ্ন করলেন, আসামিকে কেমন দেখলে ডক্টর?

পুলিশ হাজতে রয়েছে চৈতি বাঈ। আজ দু—দিন দু—রাত খায়নি। কথাবার্তাও বলেনি কারো সঙ্গে। মাঝে মাঝে শুধু দুঃস্বপ্নের ঘোরে চিৎকার করে উঠেছে, ছোড় দো মুঝে—ম্যরণে দো! ডক্টর কেশকার এইমাত্র তাকে দেখে ফিরেছেন। বললেন, কেসটা সহজ বলে মনে হয় না। স্নায়ুতে আঘাত লেগে মস্তিষ্ক ঠিকমতো কাজ করছে না, ফলে পূর্বস্মৃতি লোপ পেয়েছে, আর বর্তমানের আতঙ্কটাই পেয়ে বসেছে। রীতিমতো চিকিৎসা দরকার।

জ্যাকসন চিন্তিত হলেন। বললেন, তাহলে আসামিকে মেন্টাল হসপিটালেই পাঠানো যাক, কি বলেন?

রাইট!—ডক্টর বললেন।

সুমন একটু নড়ে বসল। কাশল একটু। তারপর নম্রভাবে বললে, মাপ করবেন, আমি একটা কথা বলতে পারি?

ইয়েস।

ডক্টর ও জ্যাকসন উভয়েই তাকালেন সুমনের দিকে।

চৈতি বাঈকে হসপিটালের বদলে আর কোথাও রাখলে কেমন হয়?

কোথায়? জ্যাকসন প্রশ্ন করলেন।

ধরুন কোনো নির্জন জায়গায়, কোনো ফাঁকা বাড়িতে, যেখানে গিয়ে ডক্টর কেশকার চিকিৎসা করতে পারবেন।

তীক্ষ্ন চোখে তাকালেন জ্যাকসন। বললেন, তোমার এ প্রস্তাবের কারণ?

বিলেতে এ ধরনের একটা কেস দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। যে মানসিক রোগীকে হসপিটালে রেখে ফল পাওয়া যায়নি, তাকে লন্ডনের বাইরে একটা নিরিবিলি গ্রামে আলাদা রেখে খুব তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া গেল।

তাই নাকি?

এই ক’দিন হাজতে আসামিকে দেখতে গিয়ে আমি লক্ষ করেছি, লোকজন দেখলেই—বিশেষ করে পুলিশ দেখলেই ও ভয় পায়, ওর মনের বিকার বেড়ে যায়। তাই আমার মনে হয়, হসপিটালে আর পাঁচটা রোগীর সঙ্গে না রেখে, বাইরে কোনো শান্ত নির্জন পরিবেশে রাখলে ওর মনের সুস্থতা ফিরে আসতে পারে। আপনি কি বলেন ডক্টর?

কেশকার বার দুই—তিন নীরবে মাথা নাড়লেন। তারপর তাঁর ফরাসি ধাঁচের দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, রাইট! রাইট! পরিবেশের বদলই অসুস্থ মনের প্রথম এবং প্রধান চিকিৎসা। কেবলমাত্র পরিবেশ বদলের ফলে মন বদলে গেছে, এমন নজিরও দেখা যায়।

জ্যাকসন বললেন, ওয়েল ডক্টর, তোমারও যখন এই অভিমত, তখন রোগীকে লক্ষ্নৌ শহরের বাইরেই কোথাও রাখার ব্যবস্থা করা যাক। অবশ্য এমন দূরে নিশ্চয় নয়, যেখানে রোগী দেখতে যাওয়া তোমার পক্ষে অসুবিধাজনক।

সুমন বললে, কিন্তু চৈতি বাঈকে যেখানেই রাখা হোক না কেন, তার চোখের সামনে পুলিশ—পাহারা রাখা ঠিক হবে না।

হোয়াট! পুলিশ—পাহারা রাখা চলবে না! তা কেমন করে সম্ভব? (জ্যাকসন সাহেবের ঘন ভুরু কুঁচকে উঠল) ভুলে যেও না ইয়ংম্যান, রোগী হলেও সে একটা খুনের আসামি।

মৃদু হেসে সুমন বললে, আমি তো পুলিশ—পাহারা রাখা চলবে না বলিনি! বলেছি, তার চোখের সামনে রাখা চলবে না। আপনিও নিশ্চয় লক্ষ করেছেন যে পুলিশ দেখলেই চৈতি বাঈ শামুকের মতো নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেয়। ওকে জানতে দেওয়া দরকার পুলিশ ওকে ছেড়ে দিয়েছে, ভয়ের কোনো কারণ নেই, তবেই হয়তো ওর মুখ থেকে কোনোদিন সত্য কথাটা আদায় করা সম্ভব হবে।

তোমার কথায় যুক্তি আছে মনে হচ্ছে।—জ্যাকসন বললেন, আমি ভাবছি, আসামিকে বারাবাঁকিতেই কিছুদিনের জন্য পাঠিয়ে দেব। জায়গাটাও ভাল, লক্ষ্নৌ শহরের কাছাকাছিও বটে। বাড়ির বাইরে থাকবে পুলিশ, ভেতরে একজন আয়া ছাড়া আর কেউ না।

আয়া নতুন না হয়ে রোগীর জানাচেনা কেউ হলেই ভাল হয়। ধরুন, চৈতি বাঈয়ের পুরোনো দাঈ ঝুলনিয়া—পুলিশ—এনকোয়ারিতে তার বিষয়ে কোনো সন্দেহজনক রিপোর্ট যদি পাওয়া না যায়, তাকেই রাখা ভাল। কেননা চেনা মুখ দেখলে রোগীর খানিকটা ভয় ভেঙে যেতে পারে।

ঘাড় নেড়ে নেড়ে কেশকার বললেন, রাইট!

জ্যাকসন বললেন, বেশ, সম্ভব হলে আসামির পুরোনো আয়াকেই রাখা হবে।

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে সুমন বললে, ডিফেন্স কাউন্সেল হিসেবে আমার একটা আর্জি আছে মিস্টার জ্যাকসন।

পাইপ ধরাচ্ছিলেন সাহেব, মুখ তুলে বললেন, সেটা কি?

আসামি চৈতি বাঈকে বারাবাঁকিতে পাঠানোর পর মাঝে মাঝে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। প্রয়োজন হলে প্রত্যহ।

কেস তো এখনো কোর্টে যায়নি, এখন দেখা করতে চাও কেন?

সুমন বলতে লাগল, এই খুনের পিছনে যে রহস্য রয়েছে, পুলিশও তা ভেদ করতে পারেনি। আর তা না পারলে মামলার সুবিচার করাও সম্ভব হবে না।

কিন্তু চৈতি বাঈয়ের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

ধৃষ্টতা মাপ করবেন, প্রমাণটাই সব নয় মিস্টার জ্যাকসন। আপনিই সেদিন বলেছিলেন, কোনো নির্দোষ যদি শাস্তি পায় সেটাই পুলিশের লজ্জা, কিন্তু আসামি দোষী না নির্দোষ বোঝা যায় প্রমাণ থেকে নয়, আসামির মোটিভ থেকে। কেন খুন করেছে, (যদি সত্যিই করে থাকে) সেটাই বড় কথা। আর এই ‘কেন’ জানতে হলে আসামির মনের দরজা খুলে দেওয়া দরকার।

কিন্তু তার আগে দরকার ওর পূর্বস্মৃতি ফিরিয়ে আনা।

ঠিক। ডক্টর কেশকারের সাহায্যে আমি চৈতি বাঈয়ের স্মৃতির দরজা খুলতে চাই, তারপর মনের দরজা। হয়তো এ—কাজে সময় লাগবে। তবু আমি চেষ্টা করতে চাই। সে সুযোগ আপনি আমায় দিন, এই আমার আর্জি।

জ্যাকসন নীরবে পাইপ টানলেন কিছুক্ষণ। লাল মুখখানা গাম্ভীর্যে থমথম করতে লাগল। তারপর মুখ থেকে পাইলটা সরিয়ে হাসিমুখে বললেন, অলরাইট ইয়ংম্যান, তোমার আর্জি মঞ্জুর হল। এই খুনের রহস্যের ওপর সত্যিই যদি আলো ফেলতে পারো, সবচেয়ে বেশি খুশি হব আমি।