চৈতি বাঈয়ের মামলা – ১

এক

অনেকক্ষণ গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করার পরেও হিলম্যান—এর নড়বার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। আচ্ছা বজ্জাতি শুরু করেছে গাড়িটা!

না, কারবুরেটারে ময়লা জমবার কথা নয়। প্লাগগুলো পরিষ্কারই আছে। এঞ্জিন ভাল করে দেখেশুনেই বেরুনো হয়েছে। আর তেল? ট্যাঙ্ক—বোঝাই। অথচ, খামোকা গাড়িটার মেজাজ গেল বিগড়ে। আর গেল তো গেল একেবারে গোধূলিয়া পাহাড়ের গায়ে মাঝ—রাস্তায়।

অনেক লম্বা লম্বা পাড়ি দিয়েছে সুমন চৌধুরি। তার বড় আদরের এই হিলম্যান নিয়েই। কিন্তু এমন ফাঁপরে পড়েনি কখনো। উৎরাইয়ের মুখে হলে বিনা স্টার্টেই সে পাহাড় থেকে নেমে যেতে পারত। কিন্তু সুমন চলেছে চড়াইয়ের পথে। ব্যাক করে তো আর পাহাড়ি রাস্তায় নামা চলে না।

এদিকে সুয্যি ডোবে—ডোবে। গোধূলিয়া পাহাড়ে সত্যিই গোধূলি নেমে আসছে। তাহলে উপায়? পাহাড়ের চুড়োয় জটিয়াবাবার ভাঙা মন্দির দেখা না হয় নাই হল। অন্ধকার নামবার আগে মানে মানে হোটেলে ফিরলেই বাঁচা যায়। একগুঁয়ে জেদি হিলম্যান এক পা—ও নড়বে না পণ করেছে।

উপায়!

বুদ্ধির গোঁড়ায় ধোঁয়া দেওয়া যাক। খানিকটা জুট নিয়ে হাতের কালি মুছে ফেললে সুমন। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালে। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তাকাল পশ্চিম আকাশের দিকে। লাল, বেগুনি, জরদ, সোনালি রঙে আকাশটা যেন মাড়োয়ারি মেয়ের মতো সেজেছে। কিন্তু কতক্ষণই বা। একটু বাদেই সব রং মুছে কালোয় কালো হয়ে যাবে। হয়তো শোনা যাবে হায়েনার হাসি, চন্দ্রবোড়ার হিমসিম, আর অন্ধকারে দেখা যাবে পাহাড়ি চিতার জ্বলজ্বলে চোখ!

গাড়িখানা ফেলে রেখে হেঁটেই নেমে যাবে নাকি সুমন? আকাশ থেকে নিচের পাহাড়ি—পথের দিকে চোখ নামালে সে। আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল একটা অদ্ভুত ছবি। মাত্র আধ ফার্লং তফাতে, রাস্তাটা যেখানে বড় একটা পাথরখণ্ডের আড়ালে বাঁক নিয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মেয়ে!

বাবা আদমের বাঁ—দিকের পাঁজরা থেকে মা ইভের জন্ম যেদিন হয়েছিল, তারপর থেকেই দুনিয়ায় মেয়েরা আর আশ্চর্য নয়। মেয়ে কোন যুগে নেই? কোন দেশে নেই? কোন অবস্থায় নেই? সর্বত্রই আছে। অনিবার্যভাবেই আছে। সুতরাং গোধূলিয়া পাহাড়েও কোনো মেয়ের উপস্থিতি মোটেই আশ্চর্য নয়। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, মেয়েটির পোশাক—আশাক বাঙালির মতো। পরনে আধময়লা জাম—রঙের শাড়ি, শক্ত করে চুল টেনে খোঁপা বাঁধা। মেয়েটা সত্যিই নাকি? তাই যদি হয়, তবে উত্তরপ্রদেশের এই বুনো দেহাত অঞ্চলে বাঙালি মেয়ে শুধু আশ্চর্য নয়, অদ্ভুতও বটে!

সুমন তাকে দেখল তিন—চার সেকেন্ড মাত্র। তারপরেই মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে গেল বড় পাথরখণ্ডের আড়ালে। যেন বুনো হরিণী তাড়া খেয়েছে হঠাৎ।

কৌতূহল হল সুমনের। মেয়ে বলে নয়, বাঙালি মেয়ে বলে। গাড়ি ফেলে দ্রুত এগিয়ে গেল সে। পাথরখণ্ডের পাশ দিয়ে ঘুরতেই চোখ পড়ল, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মেয়েটা পালাচ্ছে, আর পালাতে পালাতে বারবার ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে।

ব্যাপারটা কি? সন্ধে হয়ে আসছে, এ—সময় পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে যাচ্ছে কোথায়? সঙ্গে তো লোকও নেই দেখছি! মেয়েটা এ—যুগের কপালকুণ্ডলা নাকি?

পিছু নিলে সুমন।

জঙ্গল পার হলেই পাহাড়ের প্রায়—সমতল খানিকটা অংশ। পাথর—বাঁধানো চত্বরের মতো। মেয়েটা তার ওপর এসে থমকে দাঁড়াল। তারপর এক—পা এক—পা করে সোজা এগিয়ে চলল কিনারার দিকে।

কিন্তু কেন? কোথা যাচ্ছে ও? আর কয়েক পা এগোলেই তো চত্বরটা ফুরিয়ে যাবে। তারপর অতল খাদ। সুমন জানে সি লেভেল থেকে গোধূলিয়া পাহাড়ের চুড়োর উচ্চচতা আঠারোশো ফিট। সুতরাং, এখন যেখানে তারা দাঁড়িয়ে আছে, সেখানকার উচ্চচতা হাজার ফুটের কম নয় নিশ্চয়।

সেই হাজার ফুট গভীর খাদের হাঁ—করা মুখের সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটা। পাথরের চত্বরের একেবারে শেষপ্রান্তে।

সুমনের রক্তের গতি দ্রুত হয়ে উঠল। দ্রুত হল পায়েরও গতি।

চত্বরের শেষ সীমায় এসে স্থির হয়ে দাঁড়াল মেয়েটা। পাকা সাঁতারু ডাইভ দেবার জন্যে যেমন করে প্ল্যাটফর্মের কিনারায় এসে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। হু—হু হাওয়ায় আঁচল উড়ছে, উড়ছে ভেঙে—পড়া খোঁপার রাশিকৃত চুল। জ্বলন্ত পশ্চিম আকাশের আভায় একটা অলৌকিক মূর্তির মতো দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।

নিশ্চয় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে। হাত দু’খানা বুকের কাছে জোড় করে ধরা। বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। পা টিপে টিপে তার পেছনে অতি নিকটে গিয়ে দাঁড়াল সুমন। শুনতে পেল, কিন্তু বুঝতে পারল না কিছুই।

একটা একটা করে মুহূর্ত মরে যাচ্ছে।

চারপাশে অস্বাভাবিক নির্জনতা। থেকে থেকে হাওয়ার কাতরানি, জঙ্গলের মর্মর।

সুমন নিশ্বাস রোধ করে তাকিয়ে আছে সামনে মেয়েটার দিকে।

আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে খাদের দিকে দেখল সে। প্রাগৈতিহাসিক অতিকায় জন্তুর মতো রাক্ষুসে হাঁ করে আছে খাদটা। এতটুকু ভয় পেল না মেয়েটা। একবারও কাঁপল না তার দেহ। হঠাৎ পাথরের কিনারা থেকে শূন্যে পা বাড়াতে গেল—

কিন্তু তার আগেই সুমনের শক্ত দুই বাহু তাকে ধরে ফেলেছে।

ছটফট করতে করতে পাগলের মতো মর্মান্তিক চিৎকার দিয়ে উঠল মেয়েটা, মরতে দাও—আমাকে মরতে দাও—

ভাষাটা হিন্দি। তারপরেই জ্ঞান হারাল।

সে—চিৎকারে পাহাড়ের নৈঃশব্দ্য খানখান হয়ে গেল। আর দিকে দিকে প্রতিধ্বনি সভয়ে কেঁদে উঠল, আমাকে মরতে দাও— দাও—দাও!

ততক্ষণে সুমন মেয়েটাকে নিরাপদ স্থানে এনে ফেলেছে। অচেতন দেহটা ঘন ঘন নিশ্বাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে। স্নায়ুর ওপর কম জুলুম হয়নি। হাঁপাচ্ছে সুমনও।

কিন্তু এখন? এখন কি করা যায়?

নির্জন পাহাড়, বাহুবন্ধনে অচেনা যুবতী। ব্যাপারটা শুনতে দিব্য রোম্যান্টিক। কিন্তু পাঠক যদি সত্যিই সুমনের অবস্থায় পড়তেন, তবে এই কথাই শুনে মনে হত, ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি!

সুমনও তাই ভাবছে। আফশোস করছে মনে মনে। কি দরকার ছিল গোধূলিয়া পাহাড়ের কপালকুণ্ডলার পেছনে ধাওয়া করার? এতক্ষণে ঘটনাটাকে মনে হয়েছিল পথচলতি একটা ছোট্ট নাটক। কিন্তু কে জানতো প্রথম দৃশ্যেই পতন ও মূর্ছা!

যাই হোক, এখন কি করা যায়? এই আসন্ন সন্ধ্যায় জঙ্গলের পাশে মেয়েটাকে ফেলেও তো যাওয়া যায় না! আগে মেয়েটার জ্ঞান ফেরানো দরকার। একটু জল পেলে হত! জলের সূত্র ধরে সুমনের খেয়াল হল তার গাড়িতে জলের বোতল রয়েছে এবং গাড়িটা অচল হয়ে মাঝরাস্তায় পড়ে আছে।

অচেতন দেহটাকে দু—হাতে বয়ে নিয়ে এল সুমন গাড়ির কাছে। জঙ্গল থেকে গাড়ি আর কতদূর! দেহটাও ভারী নয়। তবু পাথর ডিঙিয়ে আসতে সুমনের পরিশ্রম হল। কোনো রকমে পেছনের সিটে বসিয়ে দিলে মেয়েটাকে। তারপর জলের বোতল নিয়ে ঝাপটা দিতে লাগল তার মুখে—চোখে।

এতক্ষণে সুমন মেয়েটাকে ভাল করে দেখবার অবকাশ পৌল। মেয়েদের বয়সের চেয়ে শক্ত ধাঁধা দুনিয়ার আর নেই। তবু মনে হল পঁচিশের ভেতরে। দোহারা শরীর একটু রোগাই। রঙটা ফর্সা, কিন্তু অযত্নে অবহেলায় ময়লাটে। চুলে নেই তেল।

মুখের পানে লক্ষ করল সুমন।

সরু নাকের পাটা দুটো ফুলে ফুলে উঠছে। বোজা চোখের দীর্ঘ পলকগুলি জাল বিছিয়েছে গালের ওপর। মুখখানাও সুশ্রী। চিবুকের মাঝখানে ছোট্ট একটি তিল, কিন্তু সে যেন মানুষের মুখ নয়। পাথরের মুখের মতো অসম্ভব ফ্যাকাশে; ক্লান্ত, জমাট—বাঁধা কান্নার মতো করুণ! এ—মুখে কোনোদিন হাসি ফুটেছে মনে হয় না।

ঠাণ্ডা জলের ঝাপটায় ক্রমে নড়ে উঠল মেয়েটা! আস্তে আস্তে চোখ মেলল। বড় বড় ঘন কালো দুই চোখ। নিষ্প্রাণ, ভাবলেশহীন, যেন পটে আঁকা।

এক ঝাঁক প্রশ্ন করলে সুমন বাংলা আর হিন্দি মিশিয়ে, কেমন বোধ করছ এখন? দুর্বল লাগছে? এখানে এসেছ কেন? কে তুমি? থাকো কোথায়?

কোনো জবাব এল না।

নরম গলায় সুমন আবার বললে, তুমি কে? বলো আমায়—কোনো ভয় নেই।

এবারেও কোনো জবাব নেই। বড় বড় নিষ্প্রাণ চোখ দুটো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে আবার বুজে এল—যেন প্রগাঢ় ঘুমে।

সুমন বুঝল, প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে তার শরীরের সমস্ত স্নায়ুর তারগুলো অসাড় হয়ে গেছে।

কিন্তু মেয়েটার জবাবের জন্যে আর তো অপেক্ষা করা চলে না। অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। চারদিক কালো হওয়ার আগেই নিচে পৌঁছোনো চাই। অথচ হিলম্যান সেই যে গোঁ ধরে বসেছে, নড়বার নামটি নেই! গাড়ি এবং নারী কোনোটিকেই ফেলে যাওয়া সম্ভব নয়।

এমন বিপদেও মানুষ পড়ে!

মরিয়া হয়ে সুমন উঠে বসল স্টিয়ারিং—এর সামনে। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে স্টার্ট ছাড়াই ব্যাক করে নামা যায় কিনা। অন্তত খানিকটা রাস্তাও যদি নামা যায়। তারপর রেখে হেঁটে নিচের বস্তিতে গিয়ে যা হোক একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

 দিনের আলো নিভু—নিভু। সেই ক্ষীণ আলোয় পেছন দিকে তাকিয়ে অতি সাবধানে উৎরাইয়ের পথে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে সুমন। আর দশ সেকেন্ডের মধ্যেই একটা মিরাকল ঘটে গেল। আফিম খাওয়া সার্কাসের বাঘ যেন হঠাৎ ইলেকট্রিক রডের শক খেয়ে হাঁক ছাড়ল। গর্জন করে উঠল হিলম্যানের ঝিমিয়ে—পড়া এঞ্জিন সুমন যেন অকূলে কূল পেল।

শ’দেড়েক গজ নামতেই একটা চওড়া জায়গা। গাড়ি ঘুরিয়ে নিলে সে, তারপর হেড লাইটের ধারালো আলোয় অন্ধকারকে ছিন্ন—ভিন্ন করে গাড়িতে স্পিড দিলে।

পেছনে সিটে অজ্ঞাতপরিচয় মেয়েটা তখনও ঘুমে অঘোর।

.

পাহাড়ের নিচের বস্তিতে মেয়েটার সম্পর্কে বিশেষ কোনো হদিশ পাওয়া গেল না। কেবল ল্যাংড়া দুখিয়া ভাল করে দেখে বললে, দু—হপ্তা আগে সদর হাসপাতালে সে যখন তার জখমি পাঁও কাটাতে গিয়েছিল, তখন ঠিক এই মেয়েটার মতো দেখতে একজন কমসিন দাঈকে সেখানে দেখেছিল।

হাসাপাতালের দাঈ! যাব নাকি সেখানে খোঁজ করতে? সুমন ভাবলে। কিন্তু সদর হাসপাতাল তো সেই বেরিলিতে! এই চন্দনচৌকি থেকে বেরিলি, সে কি হেথা? আর বদমেজাজী হিলম্যান নিয়ে এই অন্ধকার রাতে—দরকার নেই আর ঝামেলায়, যথেষ্ট হয়েছে।

থানার রাস্তাটা জেনে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলে সুমন। পুলিশের জিম্মায় ফেলে দিয়ে আসা যাক মেয়েটাকে, খোঁজ—খবর যা করবার ওরাই করুক।

কিন্তু থানা অবধি যেতে হল না, বস্তি থেকে বেরোতেই আর একজোড়া হেড লাইটের সামনে পড়ে গেল সুমন! আর সঙ্গে সঙ্গে গুরুগম্ভীর গলায় হাঁক শোনা গেল, রুখ যাও!

রুখতেই হল গাড়ি। পাশে এসে থামল একখানা জিপ— পুলিশের। লাফ দিয়ে নামল দুজন উর্দি পরা অফিসার। এগিয়ে এল টর্চ হাতে। প্রথমে সুমনের, তারপরে পেছনের সিটে ঘুমে অচেতন মেয়েটার মুখে টর্চ লাইটের আলো পড়ল।

একজন আরেকজনকে হিন্দিতে বললে, এই তো সেই বলেই মালুম হচ্ছে!

অপরজন সায় দিলে, হুঁ। মুখের আইডেন্টিফিকেশন মার্কও মিলে যাচ্ছে।

টর্চের আলো আবার পড়ল সুমনের মুখে। প্রশ্ন হল, নাম?

নাম বললে সুমন।

ঘর?

লক্ষ্মৌ, হজরতগঞ্জ।

চন্দনচৌকিতে কেন?

বেড়াতে।

পেশা কি?

পুলিশের সঙ্গে লড়াই করা।

চমকে গেল অফিসার দুজন। গর্জন করে উঠল, মতলব? সোজা করে বলুন।

একটু হেসে সুমন তার কার্ড বের করে দিল।

টর্চের আলোয় একজন পড়লে, সুমন চৌধুরি, বার—অ্যাট—ল।

আরেকজন অবাক হয়ে বললে, লক্ষ্মৌয়ে হাসান আলি মার্ডার কেসটা আপনি ডিফেন্ড করেছিলেন?

সবিনয়ে সুমন বললে, আমিই।

ভারি সেনসেশনাল কেস! রাতকে আপনি দিন বানিয়ে দিয়েছিলেন।

পুলিশের ফাইল থেকে সত্যিটাকে টেনে বের করেছিলাম মাত্র, আর বিশেষ কিছু নয়।

আপনিই কি লেট পাবলিক প্রসিকিউটার সদাশিব চৌধুরির—

ছেলে।—সুমন পাদপূরণ করলে।

আলাপ করে খুশি হলাম চৌধুরিসাব।

আমিও।

কিন্তু চৌধুরিসাব, এ মেয়েটা কি আপনার চেনা?

একেবারেই না।

তবে আপনার গাড়িতে এল কি করে?

গিয়েছিলাম গোধূলিয়া পাহাড়ে। জটিয়াবাবার মন্দির দেখতে। এ মেয়েটি পাহাড় থেকে খাদে লাফিয়ে খুদখুশি করতে যাচ্ছিল, ধরে ফেলতেই বেহোশ হয়ে গেল। বেহোশ মানুষকে একা ফেলে আসা চলে না, তাই বাধ্য হয়ে গাড়িতে তুলেছি। আপনারা জানেন, এ কে?

জানি বৈকি। একেই তো আমরা খুঁজছি।

খুঁজছেন! কেন?

মেয়েটা ফেরারি খুনি আসামি।

আচমকা যেন একটা ধাক্কা খেল সুমন। লক্ষ্নৌ ক্রিমিন্যাল বারের নাম—করা ব্যারিস্টার হলেও এতটা সে ভাবতে পারেনি। এই মেয়েটা খুনি আসামি! এই নিতান্ত সাদাসিধে সাধারণ মেয়েটা! কিন্তু মাত্র তিন বছরের ব্যারিস্টারি অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে, দুনিয়ায় আশ্চর্য বলে কিছু নেই।

অফিসার দুজন ততক্ষণে মেয়েটাকে হিলম্যান থেকে জিপে তুলেছে।

কিছু মনে করবেন না চৌধুরিসাব, মেহেরবানি করে একবার থানায় আসতে হবে। আটকাব না—আপনার একটা স্টেটমেন্ট নিয়েই ছেড়ে দেব।

কিছু বললে না সুমন। একটা সিগারেট ধরিয়ে জিপের পিছু নিলে। থানাতেই তো যাচ্ছিল সে, কিন্তু খুনি আসামির সম্পর্কে জবানবন্দি দিতে হবে ভাবেনি। বাঘে ছুঁলে আঠারো যা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা! কোথা থেকে কী! আজ কার মুখ দেখে সে জটিয়াবাবার মন্দির দেখতে বেরিয়েছিল কে জানে! জটিয়াবাবা খুবই জট পাকালেন যা হোক!

.

থানা থেকে হোটেলে ফিরতে রাত বেশি হয়নি। কিন্তু ঘুম এল না অনেক রাত অবধি। না আসারই কথা।

বয়স্ক অফিসারটির মুখ থেকে মোটামুটি ব্যাপারটা জানা গেছে। সুমনের অনুমান ঠিক নয়। মেয়েটি অবাঙালি। নাম চৈতি বাঈ। পেশা নাচ—গানের মুজরো করা, অর্থাৎ বাঈজি। নিবাস লক্ষ্নৌ শহর, সুমন নিজে রহনেবালা যেখানকার। জয়প্রকাশ নামে এক কাপ্তেন যুবকের আনাগোনা ছিল চৈতি বাঈয়ের আসরে। মাস—খানেক আগে তাকে রিভলভারের গুলিতে খুন করে চৈতি ফেরার হয়। এরপর পুলিশ জানতে পারে সে বেরিলির সদর হাসপাতালে কাজ নিয়েছে। বাঈ থেকে দাঈ। দুখিয়া ঠিকই বলেছিল। কিন্তু বেরিলিতেও পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। যদিও পুলিশ শিকারি কুকুরের মতোই তাড়া করেছিল পলাতকা চৈতি বাঈকে—বেরিলি থেকে চন্দনচৌকি অবধি, তবুও ফেরারি আসামিকে তারা জীবনে ধরতে পারত না। কিন্তু গোধূলিয়া পাহাড়ে সুমন চৌধুরির সঙ্গে চৈতির দেখা হওয়ায় নাটকের মোড় ফিরে গেল।

বয়স্ক অফিসার ভদ্রতা করে বলল, পুলিশের তরফ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি চৌধুরিসাব। আপনি শুধু চৈতি বাঈকে বাঁচাননি, পুলিশকেও বাঁচিয়েছেন।

কিন্তু চৈতিকে সত্যিই কি বাঁচান সুমন? হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের গা থেকে খাদে ঝাঁপ দিয়ে সে মরতেই চেয়েছিল, কিন্তু সুমন তাকে বাঁচতে দিল কোথায়? অনন্তমুখ মৃত্যুর একটা মুখ থেকে ছিনিয়ে এনে তার আরেকটা হাঁ—করা মুখে ঠেলে দিল না কি? এখন কি হবে চৈতির? ৩০২ ধারার অপরাধে যে দণ্ড হয়, তাই হবে। ফাঁসি।

তাই যদি হয়, হোক না। আইনের চোখে যদি প্রমাণ হয়ে যায়, চৈতি বাঈ নিজের হাতে রিভলভার ধরে জয়প্রকাশকে গুলি করে মেরেছে? তবে ব্যারিস্টার সুমন বলবে, খুনির ফাঁসি হওয়াই উচিত।

কিন্তু এ তো হল ব্যারিস্টারের কথা। সুমনের মধে যে সাধারণ সহজ মানুষটা আছে, সে কি বলছে? সে বলছে, একটা মেয়ের ফাঁসির জন্যে নিমিত্তের ভাগি হয়ে রইলে তুমি! এটাই কি উচিত হল?

কিন্তু উচিত—অনুচিতের তর্কে আর লাভ কি? কি ফায়দা মানুষ সুমনের কথায় কান দিয়ে? হাতের পাশা পড়ে গেছে। চৈতি বাঈ এখন পুলিশের খপ্পরে ভাগ্যিস মহত্ব দেখিয়ে মেয়েটাকে হোটেলে এনে তোলেনি, তাহলে সে নিজেও এতক্ষণে পুলিশের খপ্পরে পড়ত! কে জানে তার স্টেটমেন্ট পুলিশ সত্যিই বিশ্বাস করছে কিনা! কিচ্ছু বলা যায় না। কাল সকালেই একবার থানায় যাওয়া দরকার।

মানুষ সুমন যাই বলুক, ব্যারিস্টার সুমন ভাল করেই জানে আজকের দুনিয়া বড় কড়া জায়গা, যেখানে—সেখানে মহত্ব দেখালে প্যাঁচে পড়তে হয়।

অনেক রাত অবধি এপাশ—ওপাশ করল সুমন। তারপর শেষ রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া তাকে একসময় ঘুম পাড়িয়ে দিল।

.

চেহারাটা দেখলে বুড়িকে গরির গাঁওয়ার বলেই মনে হয়। নুয়ে—পড়া দেহ আর মুখের বলিরেখা দেখলে বয়স মনে হয় ষাট পেরিয়েছে, কিন্তু লক্ষ করলে বোঝা যায় এত হয়নি। আধময়লা থানের ওপর অতিজীর্ণ একটা মটকার চাদর, মাথার চুলগুলি কদম ফুলের মতো ছাঁটা। বগলে একটা গামছায় বাঁধা পুঁটলি।

ডান হাতখানা কপালে ঠেকিয়ে বারবার সেলাম করছে বুড়ি, আর দেহাতি ভাষায় অনর্গল কি সব বলে যাচ্ছে। দরজায় মোতায়েন সেপাই তার পুরুষ্ট মোচে তা দিচ্ছে, আর সেপাইসুলভ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বুড়িকে ধমকে উঠছে মাঝে মাঝে। যেমন করে বেড়ালছানাকে লোকে তাড়া দেয়।

একটা গোলমেলে আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে এল না সুমনের। কাছে এগিয়ে আসতেই সেপাই অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল। সুমনকে সে চিনেছে, দেখেছে গতরাত্রে ‘অপসর লোগ’—দের সাথে। অমায়িক হেসে জানাল, বড়ে হজৌর তাঁর কামরাতেই আছেন, চলে যান।

কিন্তু ভেতরের দিকে সুমন পা বাড়াতেই বুড়ি একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে তার সামনে এসে দাঁড়াল। বারবার সেলাম করে বলতে লাগল, আধা ঘণ্টা ধরে এই সেপাইজীর কাছে আর্জি পেশ করছি, কিন্তু এই বুড়ির কথা সে গ্রাহ্যই করছে না। এত দূর থেকে এত আশা নিয়ে এসে আমি কি তবে ফিরেই যাব?

সেপাইকে সুমন প্রশ্ন করলে, ব্যাপার কি?

সেপাই বললে, এই বুডঢির নাকি থানার হাজতে রয়েছে, তাই ও দেখা করতে চায়। লেকিন থানার কানুন হচ্ছে, মা হোক আর যেই হোক, আসামির সঙ্গে দেখা করা নিষেধ। তো সেপাই কি করে বুড়িকে যেতে দেবে বলুন?

বুড়ি যেন রুখে উঠল, মা নিজের বেটিকে দেখতে পাবে না, এ কোন দেশি কানুন! এ হতে পারে না, সেপাইজী মিছে কথা বলছে।

সুমন বোঝাবার চেষ্টা করলে, না, সেপাইজী ঠিক কথাই বলেছে। কোনো আসামির সঙ্গে বাইরের কাউকে দেখা করতে দেওয়ার কানুন সত্যিই নেই।

লেকিন হুজুর, তুমি ‘অপসার’, তুমিই তো কানুন। তুমি এই বুডি—মাকে যেতে দিলে, সেপাইজীর সাধ্যি কি আটকায়? ওর নাকের তলা দিয়ে আমি চ লে যাব।

সুমন কৌতুক বোধ করলে। বললে, আপনি ভুল করেছেন, আমি পুলিশের আদমি নই।

খপ করে বুড়ি সুমনের একখানা হাত ধরে ফেললে; বললে, নাই বা পুলিশের আদমি হলে, আদমি তো বটে। তোমারও তো মা আছে। যেমন করে পারো তুমি একটা উপায় করে দাও বেটা। আমার বিটিয়াকে আমি একটিবার দেখতে চাই, আর কিছু না। শুধু চোখের দেখা—

চোয়াল—ওঠা রোগা গাল বেয়ে টসটস করে জলের ধারা নেমে এল। কাঁপতে লাগল কথা হারিয়ে যাওয়া শুকনো ঠোঁট দু’খানা।

সুমন বিব্রত বোধ করতে লাগল। একটু চুপ করে থেকে বললে, আচ্ছা, দাঁড়ান, দেখি কি করতে পারি।

গোবিনজী তোমার ভালো করুন বেটা!

হাসি—কান্নায় মেশা মুখে একটু আশা চিকচিক করে উঠল।

এক পা এগিয়ে সুমন আবার ফিরে বললে, কে আপনার মেয়ে? নাক কি?

আমার মেয়ের নাম শান্তিলতা।

সুমন খানার ভেতরে চলে গেল।

আইয়ে ভকিলসাব।

বড়ে হজৌর অর্থাৎ দারোগাসাহেব নমস্তে জানিয়ে একটা কুরসি দেখিয়ে দিলেন। সুমন। বসতে বসতে বললে, শান্তিলতা নামে কোনো মেয়ে—আসামি আপনার এখানে আছে?

কেন বলুন দেখি?

সুমন বুড়ির কথা খুলে বললে। আরো বললে, যদিও কানুন নেই, তবু মেহেরবানি করে আপনি যদি বুড়িকে তার মেয়ের সঙ্গে একবার মিলতে দেন বড় খুশি হব। হাজার হলেও মা তো! বুড়ি শুধু চোখের দেখা দেখবে, কোনো গোলমাল করবে না—আমি নিজে তার দায়িত্ব নিচ্ছি।

দারোগাসাহেব বললে, এ আর এমন কি! আপনার কথা আমি নিশ্চয় রাখতাম চৌধুরিসাব, কিন্তু শান্তিলতা নামে কোনো মেয়ে মুজরিম এখানে নেই।

নেই!

না, বুড়ি স্ত্রীলোকটিকে বলে দিন সে ভুল খবর পেয়েছে।

সুমন বললে, আমার কথায় হয়তো বিশ্বাস করবে না, কান্নাকাটি করবে। আপনি বরং তাকে ডেকে বলে দিন।

বুড়িকে ডাকতে পাঠাল দারোগাসাহেব।

সুমন জিজ্ঞেস করলে, আপনার কালকের আসামির খবর কি? সুস্থ হয়ে উঠেছে তো?

গম্ভীর মুখে দারোগাসাহেব বারদুয়েক মাথা নাড়লে। তারপর বললে, তাকে নিয়ে এক নতুন ঝামেলা হয়েছে চৌধুরিসাব।

নতুন ঝামেলা!

হ্যাঁ, হয় মেয়েটার দেমাগ সত্যিই বিগড়ে গেছে, নয় পাগল সেজেছে?

তাই নাকি!

আজ ভোর থেকে সে যেন কেমন হয়ে গেছে। চোখের চাউনিও পালটে গেছে। কথা বলে না, হাজার জেরা করলেও একদম চুপ! মাঝে মাঝে খালি তড়পে ওঠে, ‘ছোড় দো মুঝে—মুঝে ম্যরণে দো।’

সুমন বললে, ভারি অদ্ভুত তো! একবার দেখতে পারি?

বেশ তো, দেখুন না।

দারোয়াজার সঙ্গে বুড়ি এসে সেলাম করে দাঁড়াল। দারোগা সাহেব তাকে জানাল, শান্তিলতা নামে কোনো মেয়ে—মুজরিম এ থানার হাজতে নেই।

নেই! তবে কি সে ধরা পড়েনি!—বিড় বিড় করে বললে বুড়ি। তারপর কাঁপা হাতে পুঁটলি খুলে বেব করল একটা জিনিস। পুরোনো হিন্দি খবরের কাগাজের তৈরি একটা ঠোঙা। দারোগার হাতে সেটা দিয়ে বুড়ি আকুলি—বিকুলি করে বলে উঠল, দেখুন হুজুর—ভাল করে দেখুন—এ লেড়কি এখানে নেই?

ঠোঙার গায়ে খবরের সঙ্গে একটি মেয়ের ছবি ছাপা। সেদিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে গেল দারোগার, আর অবাক হয়ে গেল সুমন।

দারোগা বললে, এই তোমার বেটি?

জী, আমার পেটের মেয়ে।

কিন্তু এ যে চৈতি বাঈ!

না, না হুজুর, আপনাদের গলৎ হয়েছে। ওর নাম শান্তিলতা।

এমনি সময় পাশের কোনো একটা ঘর থেকে বড় করুণ ডুকরে—ওঠা একটা আওয়াজ ভেসে এল, ছোড় দো—মুঝে ম্যরণে দো!

সঙ্গে সঙ্গে নুয়ে—পড়া দেহটা সিধে হয়ে গেল। ঝাপসা চোখ দুটো হয়ে উঠল জ্বলজ্বলে। বুড়ি বললে, ও কার আওয়াজ? কে ও? বলুন হুজুর, বলুন! আমার শান্তিলতা নয় তো? আমায় যেতে দিন হুজুর—একটিবার ওর কাছে যেতে দিন!

সুমন তাকাল দারোগার পানে। কুরসি ছেড়ে উঠে দারোগা বুড়িকে বললে, এসো। আসুন ভকিলসাব।

সুমনের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতায় বুড়ির চোখ ছলছল করে উঠল।

.

করিডর থেকে হাজত—ঘরটা সোজা নজরে পড়ে।

লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, কম্বলের ওপর পা মুড়ে চুপটি করে বসে আছে চৈতি বাঈ বা শান্তিলতা। রুখু চুলগুলি এলো হয়ে কিছু পিঠে, কিছু মুখের পাশ ঝুলছে। মুখ নামিয়ে আঙুল দিয়ে কম্বলের ওপর আঁকিবুকি কাটছে আপনমনে। তিনটে মানুষের তিনজোড়া পায়ের আওয়াজেও তার খেয়াল হল না।

দরজার কাছে এসে বুড়ির চোখের পলক আর পড়ে না। গলায় অপূর্ব স্নেহের মধু ঢেলে আস্তে আস্তে ডাকলে, শাস্তি! আমি এসেছি মা!

চৈতি বাঈ এতটুকু চমকাল না, কিন্তু দারুণ চমকে উঠল সুমন। দেহাতের গাঁওয়ার বুড়ির মুখে একি শুনল সে! পরিষ্কার বাংলা কথা।

বুড়ি আবার ডাকলে, শান্তি! শুনছিস!

চৈতি বাঈ এবার মুখ তুললে। বোবা পশুর মতো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়েই রইল।

বুড়ি বললে, অমন করে চেয়ে রইলি কেন? আমায় চিনতে পারছিস না? আমি যে তোর মা—ফয়জাবাদের মা!

মা!

আস্তে আস্তে ভয়ের ছায়া ফুটে উঠল বোবা চোখে। কম্বল থেকে উঠে এক—পা এক—পা করে এগিয়ে এল চৈতি। ভীত গলায় বললে, পালাও মা পালাও—পুলিশে ধরবে—বিচার হবে—ফাঁসি দেবে!

আর একবার চমকাল সুমন। শহর লক্ষ্নৌর নামকরা বাঈজী চৈতি বাঈও সাফ বাংলা বলছে!

ওরে না, না, তুই তো খুন করিস না, তোর সাজা হবে না, হতে পারে না। ভয় নেই মা, কোনো ভয় করিস নে।

লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে মেয়ের একখানা হাত চেপে ধরল বুড়ি। নিমেষে চৈতি বাঈয়ের দৃষ্টি পালটে গেল। বড় বড় কালো চোখ আতঙ্কে হয়ে উঠল আরো বড়। জালে—পড়া পশুর মতো চিৎকার করে কাৎরে উঠল, ছোড় দো মুঝে—ম্যরণে দো!

হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল বুড়ি, তুই কি শেষটা পাগল হয়ে গেলি শান্তি! তবে আমি কার জন্যে এলুম! হা গোবিন্দ!

গণ্ডগোল দেখে দারোগা ইশারা করল সুমনকে। বুড়ির পিঠে একখানা হাত রেখে সুমন বললে, বাইরে চলুন। ওকে একা থাকতে দিন।

সুমনও এবার পরিষ্কার বাংলা বললে।

করিডর দিয়ে চলতে চলতে সুমন দারোগাকে প্রশ্ন করলে, আসামির জন্যে কোনো ডাগদার আনিয়েছিলেন নাকি?

দারোগা সংক্ষেপে জবাব দিল, না। যাদের আসামি, তাদেরই কাজ ওটা। আসামিকে আজই লক্ষ্নৌ পাঠিয়ে দিচ্ছি।

.

থানার বাইরে এসে সুমন বললে, আপনি বাঙালি?

ঘাড় নেড়ে বুড়ি বললে, হ্যাঁ বাবা। তুমিও তো তাই।

এখানে কোথায় উঠেছেন?

কোথাও উঠি নি বাবা, এস্টেশন থেকে সিধে থানায় এসেছি।

বিনা ভূমিকায় সুমন বললে, আমি আপনার ছেলের বয়সি, আমার হোটেলে চলুন। খানিকটা জিরিয়ে তারপর যেখানে হয় যাবেন।

সুমন তার হিলম্যান গাড়িতে বুড়িকে তুললে।

কেসটা ভারি ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে, বুড়িকে ছাড়লে চলবে না।

.

আমার নাম সুমন চৌধুরি। আমি লক্ষ্মৌ কোর্টের একজন ব্যারিস্টার।

বুড়ি প্রশ্ন করলে, ব্যারিস্টর কি বাবা? ম্যাজিস্টরের বড় ভাই না ছোট?

একটু হেসে সুমন বললে, ব্যারিস্টার হচ্ছে কি জানেন? এই উকিল আর কি! আপনার মেয়ের ব্যাপারটা আমায় খুলে বলুন, হয়তো সাহায্য করতে পারব।

তুমি উকিল!—বুড়ি যেন হঠাৎ হাজার টাকার একখানা নোট কুড়িয়ে পেল। এ বিপদে তুমি ছাড়া কাণ্ডারি আর কে আছে বাবা? গোবিন্দ তোমায় মিলিয়ে দিয়েছেন!

আচ্ছা, আপনি বলছেন, আপনার মেয়ের নাম শান্তিলতা, অথচ পুলিশ বলছে ওর নাম চৈতি বাঈ। এর কারণ কি?

কি জানি বাবা, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

শান্তিলতা আপনার পেটের মেয়ে, তাই না?

হ্যাঁ বাবা, তাই।

তবে থানায় শান্তির সঙ্গে দেখা করে আপনি নিজেকে শুধু মা না বলে, ফয়জাবাদের মা বললেন কেন?

এক মুহূর্ত চুপ করে রইল বুড়ি। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললে, কি জানো বাবা, ওর আরেকটা মা ছিল—বেনারসি মা।

আরেকটা মা ছিল! মানে আপনার সতীন?

না বাবা, সতীন নয়, মিতিন। সবই বলছি তোমায়।

বলুন। কোনো কিছু গোপন না করে সব কথা খুলে বলুন।

গোড়া থেকেই বলি তাহলে।—বুড়ি শুরু করলে, আমার নাম গিরিজায়া। বাপের বাড়ি ছিল মাদারিপুরে। পুরুত বামুনের মেয়ে, তাই বে হল গরিব ঘরেই। নাম করতে নেই, তবু বলছি (কপালে হাত ঠেকিয়ে) আমার স্বামীর নাম নীলকণ্ঠ মৈত্র। ফয়জাবাদে একটা কাপড়ের দোকানে মুন্সীর কাজ করতেন। বের পর মাদারিপুর থেকে এলুম ফায়জাবাদে স্বামীর ঘরে করতে। বের পর মাদারিপুরে মোটে বার দু—তিন গিয়েছিলুম, আর যাইনি। যাবার উপায়ও আর নেই। আজ তিরিশ বছর হল বাপের বাড়ির সবাই মরে—হেজে গেছে।

স্বামীর মাইনে অল্প, তবু তাই দিয়েই গুছিয়ে সংসার পাতলুম। কোলে দুটি ছেলে এল, কিন্তু কপাল আমার—রইল না। এর বছর আষ্টেক বাদে আবার দুটি মেয়ে পর পর এল আমার কোলে! আদর করে তাদের বাপ নাম রাখলে শান্তিলতা আর কান্তিলতা। শান্তি জন্মাবার পর তার বাপ কিছু টাকা কর্জ করে গাঁয়ের দিকে একটা কুঁড়ি তৈরি করলে। ইটের গাঁথানি, খাপরার চাল। তবু তো নিজের ঘর! দেনাটা আর বছর তিনেকের মধ্যেই শোধ হয়ে যেত, কিন্তু কপাল যে আমার পোড়া! কান্তি যখন আড়াই বছরের, তখন বলা নেই কওয়া নেই অমন সাজোয়ান জলজ্যান্ত মানুষটা একবেলার মধ্যেই শেষ হয়ে গেল!

দু—চোখে জল নিয়ে গিরিজায়া দেবী চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার বলতে লাগলেন, শান্তি তখন পাঁচ বছরের। অনাথ মেয়ে দুটোকে নিয়ে আমি অকূলে ভাসলুম। পাঁপর, বড়ি আর আচার তৈরি করে বাড়ি বাড়ি বেচে দু—বেলা যা হোক দুটো জুটছিল, কিন্তু বাড়ির দেনা? মহাজন কোর্ট—কাছারির ভয় দেখাতে লাগল। রাতে ঘুম হত না, ভাবতুম, কচি মেয়ে দুটোর হাত ধরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? এই সময় একদিন সোহিনীর সঙ্গে দেখা।

সোহিনী! তিনি কে?

আমার মিতিন। ফয়জাবাদের মিশিরদের মেয়ে। দেখতে ভারি সোন্দর, আমারই সমান—সমান বয়েস। আমাদেরই ভাড়া বাড়ির কাছেই ওদের বাড়ি ছিল। তাই নতুন বউ হয়ে যখন ফয়জাবাদে যাই, তখন ও এসে আমার সঙ্গে সহেলি পাতিয়েছিল। সে আজ কতকালের কথা! সোহিনী যখন—তখন আসে আমার ঘরে; হাসে, গল্প করে, গান শোনায়। কী গানই গাইতো! যেন মধু! বছর তিন—চার সোহিনী ফয়জাবাদে ছিল, তারপর একদিন চলে গেল। যাবার আগে আহ্লাদে ডগমগ হয়ে বলে গেল, দেশে গিয়ে তার বিয়ে হবে। বর নাকি খুব সোন্দর, বড়লোক আর মস্ত গাইয়ে—বাজিয়ে মানুষ। দেখা যদি আর না হয়, আমি যেন তাকে না ভুলি।

সেই সোহিনীর সঙ্গে আবার দেখা হল ক’বছর বাদে। আমি তখন বিধবা। শিবরাত্তিরের পুজো দিতে কাশী গিয়েছিলুম সেখানে অহল্যাবাঈ ঘাটে দেখি, চান সেরে সোহিনী উঠে আসছে। চেহারা আগের চেয়ে মোটাসোটা হয়েছে, আরো সোন্দর হয়েছে। গা ভর্তি গয়নাগাটি। শুনলুম, এই কাশীতেই নাকি ওর শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু আশ্চর্য, একবারও বললে না, চল। আমার দশা দেখে দুঃখু করলে অনেক, জিজ্ঞেস করলে দিন চলছে কি করে। দরদি পেয়ে আমিও সব কথা বললুম।

সঙ্গে আমার শান্তি কান্তি ছিল। সোহিনী তাদের আদর করলে খানিক, তারপর বললে, দেখ গিরি, আমি টাকা দিচ্ছি, বাড়ির দেনাটা তুই মিটিয়ে দে। মনে কর না আমি তোর সহেলি নই, তোর নিজের বোন।

বললুম, সে তো অল্প টাকা নয় সোহিনী।

সোহিনী বললে, নাই অল্প হোক, যা লাগে সবটাই আমি দেব, ভাবিস নে। আর, দুটো মেয়েকে মানুষ করা সহজ নয়, (শান্তিকে কাছে টেনে নিয়ে) তুই বরং এই মেয়েটাকে আমায় দিয়ে দে! আমার তো ছেলেপুলে হল না, আমি এটাকে মেয়ের মতো মানুষ করি।

চট করে কোনো জবাব দিতে পারলুম না। পেটের মেয়ে বিলিয়ে দেব কী।

সোহিনী আমার হাতখানা ধরে কেমন যেন কাঙালের মতো বলে উঠল, বল দিবি? একটা দিলে আরেকটা তোরই থাকবে।

মনে মনে ভাবলুম, তাই তো! শান্তিকে দিয়ে দিলে কান্তি তো আমারই রইল। সোহিনীর কাছে কত সুখ কত আদরে শান্তি মানুষ হবে, আমি কি সাতজন্মেও তা পারব? তাছাড়া মাথা গোঁজার আস্তানা বাড়িটুকু তো বাঁচবে! ভাবতে ভাবতে সেই তিত্থিস্থানে দাঁড়িয়ে মা গঙ্গার সামনে সোহিনীকে আমি কথা দিয়ে ফেললুম।

শান্তিলতা তখন সবে ছ’য়ে পা দিয়েছে।

এর দিন দশেক বাদেই সোহিনী ফয়জাবাদে গিয়ে হাজির। টাকা দিয়ে মেয়ে নিয়ে নিয়ে আবার কাশী চলে গেলে। শর্ত রইল মাঝে—মাঝে মেয়েটাকে সে পাঠিয়ে দেবে, কিন্তু আমি কোনোদিন দেখতে যেতে পাব না। সেদিন মা হয়ে মেয়ে বেচে যে পাপ করেছিলাম, আজ বোধ হয় তারই সাজা পাচ্ছি বাবা—জন্মের মতো মেয়েটাকে হারাতে বসে! আমার মেয়ে আজ খুনি আসামি!

দরদর করে জল গড়িয়ে এল গিরিজায়ার চোয়াল—ওঠা রোগা গালের ওপর।

শান্তি কতদিন আপনার কাছ—ছাড়া? সুমন প্রশ্ন করলে।

গিরিজায়া বললেন, তা ধরো গিয়ে আঠারো বছর হবে।

আপনার মেয়ে আপনার কাছে মাঝে মাঝে আসত?

আসত। তবে বচ্ছরে এক—আধবারের বেশি নয়। যেদিন আসত, তার পরদিনই সোহিনী লোক পাঠাত মেয়েকে নিতে। কতবার, ভেবেছি মেয়েকে আটকে রেখে দেব, কিন্তু পারিনি! বাবা বিশ্বনাথের পায়ের তলায় দাঁড়িয়ে গঙ্গা সাক্ষী করে বাক্যি দিয়েছি যে! তাছাড়া অতগুলো টাকা! যাই হোক, সোহিনী তবু পাঠাত, কিন্তু মেয়ে তার বেনারসি মাকে পেয়ে দিনে দিনে আমাকে পর করে দিতে লাগল। কিছু মনে কোরো না বা সন্তান এমনি বেইমান বটে! তা নইলে এই দেখো না, সোহিনী মারা গেল, আর শান্তিও ফয়জাবাদে আসা বন্ধ করে দিলে। কিন্তু বেচে দিই, বিলিয়ে দিই, তবু তো আমি মা! মেয়ের এত বড় সর্বনেশে খবর পেয়ে আমি কি চুপ করে থাকতে পারি? তাই তো ফয়জাবাদ থেকে ছুটে এলুম চন্দনচৌকি।

খুনের খবরটা আপনি পেলেন কোত্থেকে? প্রশ্ন করলে সুমন।

গিরিজায়া একটু দম নিলেন। নিয়ে বললেন, সন্তানের বিপদের খবর মায়ের কাছে বেশিদিন চাপা থাকে না বাবা। খবর কেউ দেয়নি, আপনিই পেলুম। পাঁপড় আর বড়ির জন্যে আমায় ডাল পাঠিয়ে দেয় রামভরোসা মুদি। দিন দশেক আগে কাগজের যে ঠোঙাটায় সে ডাল পাঠিয়েছিল, দেখি তারই পায়ে, ওমা, শান্তির ছবি ছাপা! আর হিন্দিতে কি সব লেখা। ফয়জাবাদে থেকে থেকে হিন্দি বলাটা আমার রপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু পড়তে পারি না বাবা। তাই আমাদের গাঁয়ের পিয়নকে বললুম, এতে কি লেখা আছে দেখো তো। পিয়ন পড়ে বললে, লক্ষ্নৌ শহরের চৈতি বাঈ একজনকে খুন করে পালিয়েছে। পুলিশ তাকে খুঁজছে। এ তারই ছবি। শুনে মন থেকে যেন পাহাড় নেমে গেল। যাক, এ ছবি তাহলে আমার শান্তিলতায় নয়।

সুমন বললে, তাহলে চন্দনচৌকিতে ছুটে এলেন কেন?

বলছি বাবা! কপালে দুঃখু লেখা থাকলে খণ্ডাবে কে? দিনকতক বাদেই একটা চিঠি এল আমার নামে। এই যে দেখো না!

পুঁটলি থেকে গিরিজায়া খামশুদ্ধ একখানা চিঠি বের করে সুমনের হাতে দিলেন। দ্রুত হাতের আঁকাবাঁকা বাংলা হরফে লেখা ছোট্ট চিঠি। সুমন পড়লে :

 সদর হাসপাতাল

 বেরিলি

মাগো,

হয়তো তুমিও জানতে পেরেছো আমি এখন ফেরারি খুনি আসামি। এখানে এসে দাঈ সেজে লুকিয়ে আছি। কতদিন তোমায় দেখিনি! বড় দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি জানি তুমি মুখ ফিরিয়ে নেবে না। যদি দেখা পাই, আর কিছু নয়, ছোটবেলার মতো তোমার কোলে মুখ লুকিয়ে একবার কাঁদব।

 হতভাগী

 শাস্তি

চিঠিখানা পড়া হলে সুমন বললে, বেরিলি হাসপাতালে শান্তির দেখা পেয়েছিলেন?

গিরিজায়া বললেন, না বাবা, গিয়ে শুনি শান্তি নেই। একজন আধাবয়সী দাঈ আমায় আড়ালে ডেকে চুপি চুপি বললে, পুলিশ এখানেও তাড়া করেছিল। তাই শাস্তি কাল চন্দনচৌকি পালিয়েছে। তুমি তো শান্তির মা? তোমাকে এ—কথা সে জানাতে বলে গেছে। মনটা ছাঁৎ করে উঠল। ভোর হতেই ছুটে এলুম চন্দনচৌকি। এসেই আগে থানায় খোঁজ করলুম, কোনো কমবয়সী মেয়েছেলে ধরা পড়েছে কিনা। তারপর যা হল সবই তো দেখলে বাবা। তুমি তো উকিল। এখন কি করব বলতে পারো? কি করলে মেয়েটাকে উদ্ধার করা যায়?

গিরিজায়ার চোখে—মুখে আকুলতার ছাপা। সেটা লক্ষ করে সুমন আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। খানিক চুপ করে থেকে বললে, কিন্তু আসল ব্যাপারটাই যে অন্ধকারে রয়ে গেল!

কোন ব্যাপারটা বাবা?

শান্তিলতা সত্যিই খুন করেছে কিনা।

গিরিজায়া বলে উঠলেন, সত্যি নয় বাবা, একটুও সত্যি নয়। খুন ও করেনি, করতে পারে না। বড় ওর মন। ছোটবেলায় একটা পোষা পাখি মরে গেলে যে কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল, সে করবে মানুষ খুন! না বাবা, আমার মন বলছে শান্তি খুন করেনি।

সুমন একটু ক্ষীণ হাসলে। হেসে বললে, এ তো নিজের ছেলেমেয়ের সম্পর্কে মায়েদের চিরকেলে ধারণা। কিন্তু ধারণা দিয়ে তো আইনের সঙ্গে লড়াই করা চলে না। তার জন্যে চাই দুটো হাতিয়ার—সাক্ষী আর প্রমাণ। তা না পেলে আইনের খপ্পর থেকে আপনার মেয়েকে উদ্ধার করব কেমন করে বলুন? খুন সম্পর্কে আপনি কি কিছুই জানতে পারেননি?

না বাবা, কিছুই জানতে পারিনি। কেমন করে জানব বলো? মেয়েটার তো দেখলে মাথা খারাপ। হ্যাঁ বাবা, ও কি ভয়ে ভাবনায় সত্যিই পাগল হয়ে গেল?

পাগল ঠিক নয়,—সুমন বললে, ওটা এক রকম মানসিক রোগ, স্নায়ুতে বেশি ঘা লাগলে অমন হয়। আপনাকে বলা হয়নি, গোধূলিয়া পাহাড়ের গা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আপনার মেয়ে মরতে যাচ্ছিল, আমি দেখতে পেয়ে ধরে ফেলি।

গিরিজায়া যেন পাথর হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর গভীর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, হতভাগী মরলে ভালই হত! সব জ্বালা জুড়িয়ে যেত! কিন্তু তুমি যখন একবার তাকে বাঁচিয়েছ, তখন ওকে বাঁচবার ভার তোমাকেই আবার নিতে হবে বাবা। গোবিন্দজীর তাই ইচ্ছে।

সুমন সোজাসুজি বললে, দেখুন, গোবিন্দজীর ইচ্ছে হলেও আমার কিছুই করবার নেই। কেননা গোবিন্দজীর আইন আর জজসাহেবের আইনে অনেক তফাত। আপনার মেয়েকে বাঁচাবার কোনো রাস্তাই আমি দেখতে পাচ্ছি না।

গিরিজায়া একেবারে ভেঙে পড়লেন। সুমনের হাত দুটো ধরে বলে উঠলেন, তবু চেষ্টা তোমাকে করতেই হবে বাবা। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। তুমিও তো কোনো মায়ের সন্তান, তুমি তো মায়ের অন্তর বুঝতে পারো! তোমার আমি ‘না’ বলতে দেব না।

গিরিজায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল সুমন। আশ্চর্য, তার মা সুনেত্রার সঙ্গে গিরিজায়ার কোনো দিক থেকেই কোনো মিল নেই, তবু মাকে মনে পড়ে গেল সুমনের। গিরিজায়া অশিক্ষিতা গ্রাম্য স্ত্রীলোক হলে কি হয়, প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধিতে ওস্তাদ! মানুষের সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে কি করে কাজ আদায় করতে হয় বুড়ির ভালো করেই জানা আছে দেখছি!

কেসটা অবশ্য ইন্টারেস্টিং বটে, কিন্তু সবটাই চিনে পুঁথির মতো দুর্বোধ্য।

সুমন বললে, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করি। শান্তিলতা থাকত তার বেনারসী মায়ের সঙ্গে কাশীতে। লক্ষ্মৌর খুনের ব্যাপারে সে জড়িয়ে পড়ল কি করে?

গিরিজায়া বললেন, সোহিনী মরবার বছরখানেক আগে কাশীবাস তুলে দিয়ে লক্ষ্নৌ শহরে বাড়ি কিনেছিল যে!

ও! সুমন বললে, আমার বাড়িও লক্ষ্নৌ শহরে, আমি আজই ফিরব। দিনকতক বাদে আপনি আমার সঙ্গে সেখানে দেখা করবেন, দেখি কতদূর কি করা যায়।

গিরিজায়াকে সুমন একখানা কার্ড দিলে।

একেই বলে সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়! চন্দনচৌকিতে সুমন এসেছিল অপরাধ আর আইন—আদালত থেকে পালিয়ে, কিন্তু স্বর্গে এসেও ঢেঁকির রেহাই নেই, বুড়ি গিরিজায়ার ধান ভানতেই হবে। নমস্কার তোমায় জটিয়াবাবা, ক’দিনের ছুটিটা তোমার জটার মতোই জটিল করে দিলে!