পরিশিষ্ট

চিড়িয়াখানা – ৪

চার

রাস্তাটি ভাল; পাশ দিয়া টেলিফোনের খুঁটি চলিয়াছে। যুদ্ধের সময় মার্কিন পথিকৃৎ এই পথ ও টেলিফোনের সংযোগ নিজেদের প্রয়োজনে তৈয়ার করিয়াছিল, যুদ্ধের শেষে ফেলিয়া চলিয়া গিয়াছে।

পথের শেষে আরও যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন চোখে পড়িল; একটা স্থানে অগণিত সামরিক মোটর গাড়ি। পাশাপাশি শ্রেণীবদ্ধভাবে গাড়িগুলি সাজানো; সর্বাঙ্গে মরিচা ধরিয়াছে, রঙ্ চটিয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহাদের শ্রেণীবিন্যাস ভগ্ন হয় নাই। হঠাৎ দেখিলে মনে হয় এ যেন যান্ত্রিক সভ্যতার গোরস্থান।

এই সমাধিক্ষেত্র যেখানে শেষ হইয়াছে সেখান হইতে গোলাপ কলোনীর সীমানা আরম্ভ। আন্দাজ পনরো-কুড়ি বিঘা জমি কাঁটা-তার দিয়া ঘেরা, কাঁটা-তারের ধারে ধারে ত্রিশিরা ফণিমনসার ঝাড়। ভিতরে বাগান, বাগানের ফাঁকে ফাঁকে লাল টালি ছাওয়া ছোট ছোট কুঠি। মালীরা রবারের নলে করিয়া বাগানে জল দিতেছে। চারিদিকের ঝলসানো পরিবেশের মাঝখানে গোলাপ কলোনী যেন একটি শ্যামল ওয়েসিস্।

ক্রমে কলোনীর ফটকের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। ফটকে দ্বার নাই, কেবল আগড় লাগাইবার ব্যবস্থা আছে। দুইদিকের স্তম্ভ হইতে মাধবীলতা উঠিয়া মাথার উপর তোরণমাল্য রচনা করিয়াছে। গাড়ি ফটকের ভিতর প্রবেশ করিল।

ফটকে প্রবেশ করিয়া সম্মুখেই একটি বাড়ি। টালির ছাদ, বাংলো ধরনের বাড়ি; নিশানাথবাবু এখানে থাকেন। আমরা গাড়ির মধ্যে বসিয়া দেখিলাম বাড়ির সদর দরজার পাশে দাঁড়াইয়া একটি মহিলা ঝারিতে করিয়া গাছে জল দিতেছেন। গাড়ির শব্দে তিনি মুখ ফিরাইয়া চাহিলেন; ক্ষণেকের জন্য একটি সুন্দরী যুবতীর মুখ দেখিতে পাইলাম। তারপর তিনি ঝারি রাখিয়া দ্রুত বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

আমরা তিনজনেই যুবতীকে দেখিয়াছিলাম। ব্যোমকেশ বক্রচক্ষে একবার রমেনবাবুর পানে চাহিল। রমেনবাবু অধরোষ্ঠ সঙ্কুচিত করিয়া অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িলেন, কথা বলিলেন না। লক্ষ্য করিয়াছিলাম, কলিকাতার বাহিরে পা দিয়া রমেনবাবু কেমন যেন নির্বাক হইয়া গিয়াছিলেন। কলিকাতার যাঁহারা খাস বাসিন্দা তাঁহারা কলিকাতার বাহিরে পদার্পণ করিলে ডাঙায় ভোলা মাছের মত একটু অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন।

গাড়ি আসিয়া দ্বারের সম্মুখে থামিলে আমরা একে একে অবতরণ করিলাম। নিশানাথবাবু দ্বারের কাছে আসিয়া আমাদের সম্ভাষণ করিলেন। পরিধানে ঢিলা পায়জামা ও লিনেনের কুর্তা। হাসিমুখে বলিলেন,—‘আসুন! রোদ্দুরে খুব কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়।’—এই পর্যন্ত বলিয়া রসিক দে’র প্রতি তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। রসিক দে আমাদের সঙ্গে গাড়ি হইতে নামিয়াছিল এবং অলক্ষিতে নিজের কুঠির দিকে চলিয়া যাইতেছিল। তাহাকে দেখিয়া নিশানাথবাবুর মুখের হাসি মিলাইয়া গেল, তিনি বলিলেন,—‘রসিক, তোমার হিসেব এনেছ?’

রসিক যেন কুঁচ্‌কাইয়া গেল, ঠোঁট চাটিয়া বলিল,—‘আজ্ঞে, আজ হয়ে উঠল না। কাল-পরশুর মধ্যেই—’

নিশানাথবাবু আর কিছু বলিলেন না, আমাদের লইয়া বসিবার ঘরে প্রবেশ করিলেন।

বসিবার ঘরটি মাঝারি আয়তনের; আসবাবের জাঁকজমক নাই কিন্তু পারিপাট্য আছে। মাঝখানে একটি নিচু গোল টেবিল, তাহাকে ঘিরিয়া কয়েকটা গদিযুক্ত চেয়ার। দেয়ালের গায়ে বইয়ের আলমারি। এক কোণে টিপাইয়ের উপর টেলিফোন, তাহার পাশে রোল্-টপ্ টেবিল। বাহিরের দিকের দেয়ালে দুটি জানালা, উপস্থিত রৌদ্রের ঝাঁঝ নিবারণের জন্য গাঢ় সবুজ রঙের পর্দা দিয়া ঢাকা।

রমেনবাবুর পরিচয় দিয়া আমরা উপবিষ্ট হইলাম। নিশানাথবাবু বলিলেন,—‘তেতে পুড়ে এসেছেন, একটু জিরিয়ে নিন। তারপর বাগান দেখাব। এখানে যাঁরা আছেন তাঁদের সঙ্গেও পরিচয় হবে।’ তিনি সুইচ টিপিয়া বৈদ্যুতিক পাখা চালাইয়া দিলেন।

ব্যোমকেশ ঊর্ধ্বে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল,—‘আপনার বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে দেখছি।’

নিশানাথবাবু বলিলেন,—‘হ্যাঁ, আমার নিজের ডায়নামো আছে। বাগানে জল দেবার জন্যে কুয়ো থেকে জল পাম্প করতে হয়। তাছাড়া আলো-বাতাসও পাওয়া যায়।’

আমিও ছাদের দিকে দৃষ্টি তুলিয়া দেখিলাম টালির নিচে সমতল করিয়া তক্তা বসানো, তক্তা ভেদ করিয়া মোটা লোহার ডাণ্ডা বাহির হইয়া আছে, ডাণ্ডার বাঁকা হুক হইতে পাখা ঝুলিতেছে। অনুরূপ আর একটা ডাণ্ডার প্রান্তে আলোর বাল্ব।

পাখা চালু হইলে তাহার উপর হইতে কয়েকটি শুষ্ক ঘাসের টুকরা ঝরিয়া টেবিলের উপর পড়িল। নিশানাথ বলিলেন,—‘চড়ুই পাখি। কেবলই পাখার ওপর বাসা বাঁধবার চেষ্টা করছে। ক্লান্তি নেই, নৈরাশ্য নেই, যতবার ভেঙে দেওয়া হচ্ছে ততবার বাঁধছে।’ তিনি ঘাসের টুকরাগুলি কুড়াইয়া জানালার বাহিরে ফেলিয়া দিয়া আসিলেন।

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল,—‘ভারি একগুঁয়ে পাখি।’

নিশানাথবাবুর মুখে একটু অম্লরসাক্ত হাসি দেখা দিল, তিনি বলিলেন,—‘এই একগুঁয়েমি যদি মানুষের থাকত!’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘মানুষের বুদ্ধি বেশি, তাই একগুঁয়েমি কম।’

নিশানাথ বলিলেন,—‘তাই কি? আমার তো মনে হয় মানুষের চরিত্র দুর্বল, তাই একগুঁয়েমি কম।’

ব্যোমকেশ তাঁহার পানে হাস্য-কুঞ্চিত চোখে চাহিয়া থাকিয়া বলিল,—‘আপনি দেখছি মানুষ জাতটাকে শ্রদ্ধা করেন না।’

নিশানাথ ক্ষণেক নীরব থাকিয়া হাল্কা সুরে বলিলেন,—‘বর্তমান সভ্যতা কি শ্রদ্ধা হারানোর সভ্যতা নয়? যারা নিজের ওপর শ্রদ্ধা হারিয়েছে তারা আর কাকে শ্রদ্ধা করবে?’

ব্যোমকেশ উত্তর দিবার জন্য মুখ খুলিয়াছিল এমন সময় ভিতর দিকের পর্দা নড়িয়া উঠিল। যে মহিলাটিকে পূর্বে গাছে জল দিতে দেখিয়াছিলাম তিনি বাহির হইয়া আসিলেন; তাঁহার হাতে একটি ট্রে’র উপর কয়েকটি সরবতের গেলাস।

মহিলাটিকে দূর হইতে দেখিয়া যতটা অল্পবয়স্কা মনে হইয়াছিল আসলে ততটা নয়। তবে বয়স ত্রিশ বছরের বেশিও নয়। সুগঠিত স্বাস্থ্যপূর্ণ দেহ, সুশ্রী মুখ, টক্‌টকে রঙ; যৌবনের অপরপ্রান্তে আসিয়াও দেহ যৌবনের লালিত্য হারায় নাই। সবার উপর একটি সংযত আভিজাত্যের ভাব।

তিনি কে তাহা জানি না, তবু আমরা তিনজনেই সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইলাম। নিশানাথবাবু নীরস কণ্ঠে পরিচয় দিলেন,—‘আমার স্ত্রী—দময়ন্তী।’

নিশানাথবাবুর স্ত্রী!

প্রস্তুত ছিলাম না। স্বভাবতই ধারণা জন্মিয়াছিল নিশানাথবাবুর স্ত্রী বয়স্থা মহিলা; দ্বিতীয় পক্ষের কথা একেবারেই মনে আসে নাই। আমাদের মুখের বোকাটে বিস্ময় বোধ করি অসভ্যতাই প্রকাশ করিল। তারপর আমরা নমস্কার করিলাম। দময়ন্তী দেবী সরবতের ট্রে টেবিলে নামাইয়া রাখিয়া বুকের কাছে দুই হাত যুক্ত করিয়া প্রতিনমস্কার করিলেন। নিশানাথ বলিলেন,—‘এঁরা আজ এখানেই খাওয়া-দাওয়া করবেন।’

দময়ন্তী দেবী একটু হাসিয়া ঘাড় ঝুঁকাইলেন, তারপর ধীরপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

আমরা আবার উপবেশন করিলাম। নিশানাথ আমাদের হাতে সরবতের গেলাস দিয়া কথাচ্ছলে বলিলেন,—‘এখানে চাকর-বাকর নেই, নিজেদের কাজ আমরা নিজেরাই করি।’

ব্যোমকেশ ঈষৎ উৎকণ্ঠিত স্বরে বলিল,—‘সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু আমরা এসে মিসেস সেনের কাজ বাড়িয়ে দিলাম না তো? আমাদের জন্যে আবার নতুন করে রান্নাবান্না—’

নিশানাথ বলিলেন,—‘আপনাদের আসার খবর আগেই দিয়েছি, কোনও অসুবিধা হবে না। মুকুল বলে একটি মেয়ে আছে, রান্নার ভার তারই; আমার স্ত্রী সাহায্য করেন। এখানে আলাদা রান্নাবান্নার ব্যবস্থা নেই; একটা রান্নাঘর আছে, সকলের রান্না একসঙ্গে হয়।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘আপনার এখানকার ব্যবস্থা দেখে সত্যিকার আশ্রম বলে মনে হয়।’

নিশানাথবাবু কেবল একটু অম্লরসাক্ত হাসিলেন। ব্যোমকেশ সরবতে চুমুক দিয়া বলিল,—‘বাঃ, চমৎকার ঠাণ্ডা সরবৎ, কিন্তু বরফ দেওয়া নয়। ফ্রিজিডেয়ার আছে!’

নিশানাথ বলিলেন,—‘তা আছে। —এবার মোটরের টুকরোগুলো আপনাকে দেখাই। ফ্রিজিডেয়ারের অস্তিত্ব যেমন চট্ করে বলে দিলেন আমার অজ্ঞাত উপহারদাতার নামটাও তেমনি বলে দিন তবে বুঝব।’

ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া বলিল,—‘নিশানাথবাবু, পৃথিবীর সব রহস্য যদি আপনার ফ্রিজিডেয়ারের মত স্বয়ংসিদ্ধ হত তাহলে আমার মত যারা বুদ্ধিজীবী তাদের অন্ন জুটত না। —ভাল কথা, কাল আপনি আমাকে পঞ্চাশ টাকা না দিয়ে ষাট টাকা দিয়ে এসেছিলেন।’

নিশানাথবাবু একটু অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন,—‘তাই নাকি? ভাগ্যে কম টাকা দিইনি। তা ও টাকা আপনার কাছেই থাক, পরে না হয় হিসেব দেবেন।’

হিসাব দেওয়া কিন্তু ঘটিয়া ওঠে নাই।

নিশানাথ রোল্-টপ টেবিল খুলিয়া কয়েকটা মোটরের ভাঙা টুকরা আমাদের সম্মুখে রাখিলেন। স্পার্কিং প্লাগ, ছেঁড়া রবারের মোটর-হর্ন, টিনের লাল রঙ্-করা খেলনা মোটর, সবই রহিয়াছে; ব্যোমকেশ সেগুলিকে দেখিল, কিন্তু বিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিল না। কেবল খেলনা মোটরটিকে সন্তর্পণে ধরিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া নিরীক্ষণ করিল। বলিল,—‘এতে কারুর আঙুলের টিপ দেখছি না, একেবারে ঝাড়া মোছা।’

নিশানাথ বলিলেন,—‘আঙুলের ছাপ আমিও খুঁজেছিলাম কিন্তু কিছু পাইনি। আমার উপহারদাতা খুব সাবধানী লোক।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘হুঁ। মোটরের টুকরোগুলো অবশ্য দাতা মহাশয় পাশের মোটর-ভাগাড় থেকে সংগ্রহ করেছেন। এ থেকে একটা কথা আন্দাজ করা যায়।’

‘কী আন্দাজ করা যায়?’

‘দাতা মহাশয় কাছেপিঠের লোক। এখানে আশেপাশে কোনও বসতি আছে নাকি?’

‘না। মাইলখানেক আরও এগিয়ে গেলে মোহনপুর গ্রাম পাওয়া যায়। আমার মালীরা সেখান থেকেই কাজ করতে আসে।’

‘মোহনপুরে ভদ্ৰশ্রেণীর কেউ থাকে?’

‘দু’ এক ঘর থাকতে পারে, কিন্তু বেশির ভাগই চাষাভূষো! তাদের কাউকে আমি চিনিও না। অবশ্য মালীদের ছাড়া।’

‘সুতরাং সেদিক থেকে উপহার পাবার কোনও সম্ভাবনা নেই, কারণ যিনি উপহার পাঠাচ্ছেন তিনি ভদ্ৰশ্রেণীর লোক। চলুন এবার আপনারা, কলোনী পরিদর্শন করা যাক।’

কলোনী পরিদর্শনের প্রকৃত উদ্দেশ্য যে কলোনীর মানুষগুলিকে, বিশেষ নারীগুলিকে চাক্ষুষ করা, একথা আমরা সকলে মনে মনে জানিলেও মুখে কেহই তাহা প্রকাশ করিল না। নিশানাথবাবু আমাদের জন্য তিনটি ছাতা সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন, আমরা ছাতা মাথায় দিয়া বাহির হইলাম। তিনি নিজে একটি সোলা-হ্যাট্ পরিয়া লইলেন। কালো কাচের চশমা তাঁহার চোখেই ছিল।

এইখানে, উদ্যান পরিক্রমা আরম্ভ করিবার আগে, গোলাপ কলোনীর একটি নক্সা পাঠকদের সম্মুখে স্থাপন করিতে চাই। নক্সা থাকিলে দীর্ঘ বর্ণনার প্রয়োজন হইবে না।—

নক্সা
নক্সা

১। নিশানাথ গৃহ; ২। বিজয়ের ঘর; ৩। বনলক্ষ্মীর ঘর; ৪। ভুজঙ্গধরের ঘর ও ঔষধালয়; ৫। ব্রজদাসের ঘর; ৬। রসিকের ঘর। ৭। কূপ; ৮। আস্তাবল ও মুস্কিলের ঘর; ৯। গোশালা ও পানুর ঘর; ১০। মুকুল ও নেপালের ঘর; ১১। ভোজনকক্ষ ও পাকশালা; ১২। অব্যবহৃত হট্-হাউস; ১৩। সামরিক মোটরের সমাধিক্ষেত্র।

বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আমরা বাঁ দিকের পথ ধরিলাম। সুরকি-ঢাকা পথ সঙ্কীর্ণ কিন্তু পরিচ্ছন্ন, আঁকিয়া বাঁকিয়া কলোনীর সমস্ত গৃহগুলিকে সংযুক্ত করিয়া রাখিয়াছে।

প্রথমেই পড়িল ফটকের পাশে লম্বা টানা একটা ঘর। মাথার উপর টালির ফাঁকে ফাঁকে কাচ বসানো, দেওয়ালেও বড় বড় কাচের জানালা। কিন্তু ঘরটি অনাদৃত, কাচগুলি অধিকাংশই ভাঙিয়া গিয়াছে; অন্ধের চক্ষুর মত ভাঙা ফোকরের ভিতর দিয়া কেবল অন্ধকার দেখা যায়।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,—‘এটা কি?’

নিশানাথ বলিলেন,—‘হট্-হাউস করেছিলাম, এখন পড়ে আছে। বেশি শীত বা গরম পড়লে কচি চারাগাছ এনে রাখা হয়।’

পাশ দিয়া যাইবার সময় ভাঙা দরজা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম, ভিতরে কয়েকটা ধূলিধূসর বেঞ্চি পড়িয়া আছে। মেঝের উপর কতকগুলি মাটিভরা চ্যাঙারি রহিয়াছে, তাহাতে নবাঙ্কুরিত গাছের চারা।

এখান হইতে সম্মুখের সীমানার সমান্তরাল খানিক দূর অগ্রসর হইবার পর গোহালের কাছে উপস্থিত হইলাম। চেঁচারির বেড়া দিয়া ঘেরা অনেকখানি জমি, তাহার পিছন দিকে লম্বা খড়ের চালা; চালার মধ্যে অনেকগুলি গরু-বাছুর বাঁধা রহিয়াছে। খোলা বাথানে খড়ের আঁটি ডাঁই করা।

গোহালের ঠিক গায়ে একটি ক্ষুদ্র টালি-ছাওয়া কুঠি। আমরা গোহালের সম্মুখে উপস্থিত হইলে একটি লম্বা-চওড়া যুবক কুঠির ভিতর হইতে তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া আসিল। গায়ে গেঞ্জি, হাঁটু পর্যন্ত কাপড়; দাঁত বাহির করিয়া হাসিতে হাসিতে আমাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল।

যুবকের দেহ বেশ বলিষ্ঠ কিন্তু মুখখানি বোকাটে ধরনের। আমাদের কাছে আসিয়া সে দুই কানের ভিতর হইতে খানিকটা তুলা বাহির করিয়া ফেলিল এবং আমাদের পানে চাহিয়া হাবলার মত হাসিতে লাগিল। হাসি কিন্তু সম্পূর্ণ নীরব হাসি, গলা হইতে কোনও আওয়াজ বাহির হইতে শুনিলাম না।

নিশানাথ বলিলেন,—‘এর নাম পানু। গো-পালন করে তাই ওকে পানুগোপাল বলা হয়। কানে কম শোনে।’

পানুগোপাল পূর্ববৎ হাসিতে লাগিল, সে নিশানাথবাবুর কথা শুনিতে পাইয়াছে বলিয়া মনে হইল না। নিশানাথবাবু একটু গলা চড়াইয়া বলিলেন,—‘পানুগোপাল, তোমার গরু-বাছুরের খবর কি? সব ভাল তো?’

প্রত্যুত্তরে পানুগোপালের কণ্ঠ হইতে ছাগলের মত কম্পিত মিহি আওয়াজ বাহির হইল। চমকিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া দেখিলাম সে প্রাণপণে কথা বলিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছে না। নিশানাথবাবু হাত তুলিয়া তাহাকে নিরস্ত করিলেন, খাটো গলায় বলিলেন,—‘পানু যে একেবারে কথা বলতে পারে না তা নয়, কিন্তু একটু উত্তেজিত হলেই কথা আটকে যায়। ছেলেটা ভাল, কিন্তু ভগবান মেরেছেন।’

অতঃপর আমরা আবার অগ্রসর হইলাম, পানুগোপাল দাঁড়াইয়া রহিল। কিছু দূর গিয়া ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম পানুগোপাল আবার কানে তুলা গুঁজিতেছে।

জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘পানুগোপাল কানে তুলো গোঁজে কেন?’

নিশানাথ বলিলেন,—‘কানে পুঁজ হয়।’

কিছুদুর চলিবার পর বাঁ দিকে রাস্তার একটা শাখা গিয়াছে দেখিলাম; রাস্তাটি নিশানাথবাবুর বাড়ির পিছন দিক দিয়া গিয়াছে, মাঝে পাতা-বাহার ক্রোটন গাছে ভরা জমির ব্যবধান। এই রাস্তার মাঝামাঝি একটি লম্বাটে গোছের বাড়ি। নিশানাথবাবু সেই দিকে মোড় লইয়া বলিলেন,—‘চলুন, আমাদের রান্নাঘর খাবারঘর দেখবেন।’

পূর্বে শুনিয়াছি মকুল নামে একটি মেয়ে কলোনীর রান্নাবান্না করে। অনুমান করিলাম মুকুলকে দেখাইবার জন্যই নিশানাথবাবু আমাদের এদিকে লইয়া যাইতেছেন।

ভোজনালয়ে উপস্থিত হইয়া দেখা গেল, একটি লম্বা ঘরকে তিন ভাগ করা হইয়াছে; একপাশে রান্নাঘর, মাঝখানে আহারের ঘর এবং অপর পাশে স্নানাদির ব্যবস্থা। রান্নাঘর হইতে ছ্যাক্‌ছোঁক শব্দ আসিতেছিল, নিশানাথবাবু সে দিকে চলিলেন।

আমাদের সাড়া পাইয়া দময়ন্তী দেবী রান্নাঘরের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইলেন; কোমরে আঁচল জড়ানো, হাতে খুন্তি। তাঁহাকে এই নূতন পরিবেশের মধ্যে দেখিয়া মনে হইল, আগে যাঁহাকে দেখিয়াছিলাম ইনি সে-মানুষ নন, সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। প্রথমে দূর হইতে দেখিয়া একরকম মনে হইয়াছিল, তারপর সরবতের ট্রে হাতে তাঁহার অন্যরূপ আকৃতি দেখিয়াছিলাম, এখন আবার আর এক রূপ। কিন্তু তিনটি রূপই প্রীতিকর।

দময়ন্তী দেবী একটু উৎকণ্ঠিতভাবে স্বামীর মুখের পানে চাহিলেন। নিশানাথ বলিলেন,—‘তুমি রান্না করছ? মুকুল কোথায়?’

দময়ন্তী দেবী বলিলেন,—‘মুকুলের বড় মাথা ধরেছে, সে রান্না করতে পারবে না। শুয়ে আছে।’

নিশানাথ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন,—‘তাহলে বনলক্ষ্মীকে ডেকে পাঠাওনি কেন? সে তোমাকে যোগান দিতে পারত।’

দময়ন্তী বলিলেন,—‘দরকার নেই, আমি একলাই সামলে নেব।’

নিশানাথের ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া রহিল, তিনি আর কিছু না বলিয়া ফিরিলেন। এই সময় স্নানঘরের ভিতর হইতে একটি যুবক তোয়ালে দিয়া মাথা মুছিতে মুছিতে বাহির হইয়া আসিল,—‘কাকিমা, শীগ্‌গির শীগ্‌গির—এখনি কলকাতা যেতে হবে—’ এই পর্যন্ত বলিবার পর সে তোয়ালে হইতে মুখ বাহির করিয়া আমাদের দেখিয়া থামিয়া গেল।

দময়ন্তী বলিলেন,—‘আসন পেতে বোসো, ভাত দিচ্ছি। সব রান্না কিন্তু হয়নি এখনও।’ তিনি রান্নাঘরের মধ্যে অদৃশ্য হইলেন।

আমাদের সম্মুখে যুবক স্নানসিক্ত নগ্নদেহে বিশেষ অপ্রস্তুত হইয়া পড়িয়াছিল, সে তোয়ালে গায়ে জড়াইয়া আসন পাতিতে প্রবৃত্ত হইল। তাহার বয়স আন্দাজ ছাব্বিশ-সাতাশ, বলবান সুদর্শন চেহারা। নিশানাথ অপ্রসন্নভাবে তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন,—‘বিজয়, তুমি এখনও কাজে যাওনি?’

বিজয় কাঁচুমাচু হইয়া বলিল,—‘আজ দেরি হয়ে গেছে কাকা। —হিসেবটা তৈরি করছিলাম—’

নিশানাথ জিজ্ঞাসা করিলেন,—‘হিসেব কতদূর?’

‘আর দু’তিন দিন লাগবে।’

ওষ্ঠাধর দৃঢ়বদ্ধ করিয়া নিশানাথ দ্বারের দিকে চলিলেন, আমরা অনুবর্তী হইলাম। হিসাব লইয়া গোলাপ কলোনীতে একটা গোলযোগ পাকাইয়া উঠিতেছে মনে হইল।

দ্বারের নিকট হইতে পিছন ফিরিয়া দেখি, বিজয় বিস্ময়-কুতূহলী চক্ষে আমাদের পানে তাকাইয়া আছে। আমার সহিত চোখাচোখি হইতে সে ঘাড় নিচু করিল।

বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশ নিশানাথবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল,—‘আপনার ভাইপো? উনিই বুঝি ফুলের দোকান দেখেন?’

‘হ্যাঁ।’