তিন
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিয়া শুনিতে পাইলাম, পাশের ঘরে ব্যোমকেশ কাহাকে ফোন করিতেছে। দুই চারিটা ছাড়াছাড়া কথা শুনিয়া বুঝিলাম সে নিশানাথবাবুকে সুনয়নার কাহিনী শুনাইতেছে।
নিশানাথবাবুর আগমনের পর হইতে আমাদের তাপদগ্ধ কর্মহীন জীবনে নূতন সজীবতার সঞ্চার হইয়াছিল। তাই ব্যোমকেশ যখন টেলিফোনের সংলাপ শেষ করিয়া আমার ঘরে আসিয়া ঢুকিল এবং বলিল,—‘ওহে ওঠো, মোহনপুর যেতে হবে’—তখন তিলমাত্র আলস্য না করিয়া সটান উঠিয়া বসিলাম।
‘কখন যেতে হবে?’
‘এখনি। রমেনবাবুকেও নিয়ে যেতে হবে। নিশানাথবাবুর কথার ভাবে মনে হল তাঁর সন্দেহ ভূতপূর্ব অভিনেত্রী সুনয়না দেবী কাছাকাছি কোথাও বিরাজ করছেন। তাঁর সন্দেহ যদি সত্যি হয়, রমেনবাবু গিয়ে আসামীকে সনাক্ত করতে পারেন।’
আটটার মধ্যেই রমেনবাবুর বাড়িতে পৌঁছিলাম। তিনি লুঙ্গি ও হাতকাটা গেঞ্জি পরিয়া বৈঠকখানায় ‘আনন্দবাজার’ পড়িতেছিলেন, আমাদের সহর্ষে স্বাগত করিলেন।
ব্যোমকেশের প্রস্তাব শুনিয়া তিনি উল্লাসভরে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন— ‘যাব না? আলবাৎ যাব। আপনারা দয়া করে পাঁচ মিনিট বসুন, আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।’ বলিয়া তিনি অন্দরের দিকে অন্তর্ধান করিলেন।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি তৈয়ার হইয়া বাহির হইয়া আসিলেন। একেবারে ফিট্ফাট বাবু; যেমনটি কাল সন্ধ্যায় দেখিয়াছিলাম।
শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছিয়া তিনি আমাদের টিকিট কিনিতে দিলেন না, নিজেই তিনখানা প্রথম শ্রেণীর টিকিট কিনিয়া ট্রেনে অধিষ্ঠিত হইলেন। দেখিলাম আমাদের চেয়ে তাঁরই ব্যগ্রতা ও উৎসাহ বেশি।
ঘন্টাখানেক পরে উদ্দিষ্ট স্টেশনে পৌঁছান গেল। লোকজন বেশি নাই; বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, পানের দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া একটি লোক পান চিবাইতে চিবাইতে দোকানির সহিত রসালাপ করিতেছে। ব্যোমকেশ নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল,—‘গোলাপ কলোনী কোন্ দিকে বলতে পারেন?’
লোকটি এক চক্ষু মুদিত করিয়া আমাদের ভাল করিয়া দেখিয়া লইল, তারপর এড়ো গলায় বলিল,—‘চিড়িয়াখানা দেখতে যাবেন?’
‘চিড়িয়াখানা!’
‘ঐ যার নাম চিড়িয়াখানা তারই নাম গোলাপ কলোনী। আজব জায়গা—আজব মানুষগুলি। অমন চিড়িয়াখানা আলিপুরেও নেই। তা—যাবার আর কষ্ট কি? ঐ যে চিড়িয়াখানার রথ রয়েছে ওতে চড়ে বসুন, গড়গড় করে চলে যাবেন।’
এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই, স্টেশন-প্রাঙ্গণের এক পাশে একটি জীর্ণকায় ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। মেয়েদের স্কুল-কলেজের গাড়ির মত লম্বা ধরনের গাড়ি। তাহার গায়ে এককালে সোনার জলে গোলাপ কলোনী লেখা ছিল, কিন্তু এখন তাহা প্রায় অবোধ্য হইয়া পড়িয়াছে। গাড়িতে লোকজন কেহ আছে বলিয়া বোধ হইল না, কেবল ঘোড়াটা একক দাঁড়াইয়া পা ছুঁড়িয়া মাছি তাড়াইতেছে।
কাছে গিয়া দেখিলাম গাড়ির পিছনের পা-দানে বসিয়া একটি লোক নিবিষ্টমনে বিড়ি টানিতেছে। লোকটি মুসলমান, বয়স হইয়াছে। দাড়ির প্রাচুর্য নাই, মুখময় ডুমো ডুমো ব্রণের ন্যায় মাংস উঁচু হইয়া আছে, চোখ দুটিতে ঘোলাটে অভিজ্ঞতা; পরনে ময়লা পায়জামার উপর ফতুয়া। আমাদের দেখিয়া সে বিড়ি ফেলিয়া উঠিয়া বলিল,—‘কলকাতা হতে আসতেছেন?’
‘হ্যাঁ। গোলাপ কলোনী যাব।’
‘আসেন। আপনাগোরে লইয়া যাইবার কথা বাবু কইছেন। কিন্তু মুস্কিল হইছে—’
বুঝিলাম ইনিই মুস্কিল মিঞা। ব্যোমকেশ বলিল,—‘মুস্কিল কিসের?’
মুস্কিল বলিল,—‘রসিকবাবুরও এই টেরেনে আওনের কথা। তা তিনি আইলেন না। পরের টেরনের জৈন্য সবুর করতি হইব। তা বাবু মশায়রা গাড়ির মধ্যে বসেন।’
জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘রসিকবাবুটি কে?’
মুস্কিল বলিল,—‘কলোনীর বাবু, রোজ দু’বেলা রেলে আয়েন যায়েন, আজ কি কারণে দেরি হইছে। বসেন না, পরের গাড়ি এখনই আইব।’
মুস্কিল গাড়ির দ্বার খুলিয়া দিল। ভিতরে মানুষ বসিবার স্থান তিন চারিটি আছে, কিন্তু অধিকাংশ স্থান স্তূপীকৃত শূন্য চ্যাঙারির দ্বারা পূর্ণ। অনুমান করা যায় প্রত্যহ প্রাতে এইসব চ্যাঙারিতে গোলাপ কলোনী হইতে ফুল শাকসব্জি স্টেশনে আসে এবং কলিকাতার অভিমুখে রওনা হইয়া যায়; ওদিকে কলিকাতা হইতে পূর্বদিনের শূন্য চ্যাঙারিগুলি ফিরিয়া আসে। কর্মী মানুষগুলিরও যাতায়াত এই ভ্যানের সাহায্যেই সাধিত হয়।
রৌদ্রের তাপ বাড়িতেছিল। বাহিরে দাঁড়াইয়া থাকার চেয়ে গাড়ির ছায়ান্তরালে প্রবেশ করাই শ্রেয় বিবেচনা করিয়া আমরা গাড়িতে উঠিয়া বসিলাম।
মুস্কিল মিঞা গাল্পিক লোক, মানুষ পাইলে গল্প করিতে ভালবাসে। সে বলিল,—‘বাবু মশায়রা দুই-চারিদিন হেথায় থাকবেন তো?’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘আজই ফিরব। —তুমি মুস্কিল মিঞা?’
মুস্কিল মুখ মচ্কাইয়া বলিল,—‘নাম তো কর্তা সৈয়দ নুরুদ্দিন। কিন্তু মুস্কিল হৈছে বাবুরা আদর কৈরা মুস্কিল মিঞা ডাকেন।’
‘এ আর মুস্কিল কি?—কতদিন আছো গোলাপ কলোনীতে?’
‘আন্দাজ সাত আট বছর হৈতে চলল। তখন বোষ্টম ঠাকুর ছাড়া আর কোনও কর্তাই দেখা দেন নাই। আমি পুরান লোক।’
‘হুঁ। তোমার গাড়ি আর ঘোড়াও ততো বেশ পুরান মনে হচ্ছে।’
মুস্কিল আক্ষেপ করিয়া বলিল,—‘আর কন্ কেন কর্তা। ঘোড়াডার মরবার বয়স হইছে, নেহাৎ আদত পড়ে গেছে তাই গাড়ি টানে। বড়বিবিরে কতবার কইছি, ও দুটো গাড়ি ঘোড়ারে বাতিল কৈরা নূতন মটর-ভ্যান খরিদ কর। তা মুস্কিল হৈছে, বড়বিবি কয় টাকা নাই।’
‘বড়বিবি কে? নিশানাথবাবুর স্ত্রী?’
‘হ। ভারি লক্ষ্মীমন্তর মেইয়া।’
‘তিনিই বুঝি কলোনী দেখাশোনা করেন?’
‘দেখাশুনা কর্তাবাবুও করে। কিন্তু টাকাকড়ি হিসাব-নিকাশ বড়বিবির হাতে।’
‘তা বড়বিবি টাকা নাই বলে কেন? কলোনীর ব্যবসা কি ভাল চলে না?’
মস্কিল মিঞার ঘোলাটে চোখে একটা গভীর অর্থপূৰ্ণ ইঙ্গিত ফুটিয়া উঠিল। সে বলিল,—‘চলে তো ভালই। এত ফুল ফল ঘি মাখন আণ্ডা যায় কোথায়? তবে কি জানেন কর্তা, লাভের গুড় পিপ্ড়া খাইয়া যায়।’ ইঙ্গিতপূর্ণ চক্ষে আমাদের তিনজনকে একে একে নিরীক্ষণ করিল।
মুস্কিল মিঞার নিকট হইতে ব্যোমকেশ হয়তো আরও আভ্যন্তরীণ তথ্য সংগ্রহ করিত, কিন্তু এই সময় দক্ষিণ হইতে একটি ট্রেন আসিয়া স্টেশনে থামিল। এবং অল্পকাল পরে একটি ক্ষিপ্রচারী ভদ্রলোক আসিয়া গাড়ির কাছে দাঁড়াইলেন। ইনি বোধ হয় রসিকবাবু।
ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ, কিন্তু আকৃতি ম্লান ও শুষ্ক। বৃষকাষ্ঠের মত দেহে লংক্লথের পাঞ্জাবি অত্যন্ত বেমানানভাবে ঝুলিয়া আছে, গাল-বসা খাপ্রা-ওঠা মুখ, জোড়া ভুরুর নিচে চোখদুটি ঘন-সন্নিবিষ্ট, মুখে খুঁৎখুঁতে অতৃপ্ত ভাব। গাড়ির মধ্যে আমাদের বসিয়া থাকিতে দেখিয়া তাঁহার মুখ আরও খুঁৎখুঁতে হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন,—‘আপনারা—?’
ব্যোমকেশ নিজের পরিচয় দিয়া বলিল,—‘নিশানাথবাবু আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন—।’
রসিকবাবুর ঘন-সন্নিবিষ্ট চোখে একটা ক্ষণস্থায়ী আশঙ্কা পলকের জন্য চমকিয়া উঠিল; মনে হইল তিনি ব্যোমকেশের নাম জানেন। তারপর তিনি চট্ করিয়া গাড়িতে উঠিয়া বলিলেন,—‘মুস্কিল, গাড়ি হাঁকাও। দেরি হয়ে গেছে।’
মুস্কিল ইতিমধ্যে সামনে উঠিয়া বসিয়াছিল, ঘোড়ার নিতম্বে দু’চার ঘা খেজুর ছড়ি বসাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল।
রসিকবাবু তখন আত্ম-পরিচয় দিলেন। তাঁহার নাম রসিকলাল দে, গোলাপ কলোনীর বাসিন্দা, হগ্ সাহেবের বাজারে তরিতরকারির দোকানের ইন্-চার্জ।
এই সময় তাঁহার ডান হাতের দিকে দৃষ্টি পড়িতে চমকিয়া উঠিলাম। হাতের অঙ্গুষ্ঠ ছাড়া বাকি আঙুলগুলা নাই, কে যেন ভোজালির এক কোপে কাটিয়া লইয়াছে।
ব্যোমকেশও হাত লক্ষ্য করিয়াছিল, সে শান্তস্বরে বলিল,—‘আপনি কি আগে কোনও কল-কারখানায় কাজ করতেন?’
রসিকবাবু হাতখানি পকেটের মধ্যে লুকাইলেন, ম্লানকণ্ঠে বলিলেন,—‘কটন মিলের কারখানায় মিস্ত্রি ছিলাম, ভাল মাইনে পেতাম। তারপর করাত-মেসিনে আঙুলগুলো গেল; কিছু খেসারৎ পেলাম বটে, নাকের বদলে নরুন! কিন্তু আর কাজ জুটল না। বছর দুই থেকে নিশানাথবাবুর পিঁজরাপোলে আছি।’ তাঁহার মুখ আরও শীর্ণ-ক্লিষ্ট হইয়া উঠিল।
আমরা নীরব রহিলাম। গাড়ি ক্ষুদ্র শহরের সঙ্কীর্ণ গণ্ডী পার হইয়া খোলা মাঠের রাস্তা ধরিল।
ভাবিতে লাগিলাম, গোলাপ কলোনীর দেখি অনেকগুলি নাম! কেহ বলে চিড়িয়াখানা, কেহ বলে পিঁজরাপোল। না জানি সেখানকার অন্য লোকগুলি কেমন! যে দুইটি নমুনা দেখিলাম তাহাতে মনে হয় চিড়িয়াখানা ও পিঁজরাপোল দুটি নামই সার্থক।