পরিশিষ্ট

চিড়িয়াখানা – ২৫

পঁচিশ

কলোনী হইতে আমরা সিধা থানায় ফিরিলাম। বরাটের ঘরে বসিয়া ব্যোমকেশ খাম দুটি সযত্নে পকেট হইতে বাহির করিল। বলিল,—‘এইবার প্রমাণ।’

খাম দুটির উপরে কিছু লেখা ছিল না, দেখিতেও সম্পূর্ণ একপ্রকার। তবু কোনও দুর্লক্ষ্য চিহ্ন দেখিয়া সে একটি খাম বাছিয়া লইল; খামের আঠা লাগানো স্থানটা ভাল করিয়া দেখিয়া বলিল,—‘খোলা হয়নি বলেই মনে হচ্ছে।’

অতঃপর খাম কাটিয়া সে ভিতর হইতে অতি সাবধানে ফটো বাহির করিল; ঝক্‌ঝকে পালিশ করা কাগজের উপর শ্যামা-ঝি’র ভূমিকায় সুনয়নার ছবি। বরাট এবং আমি ঝুঁকিয়া পড়িয়া ছবিটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখিলাম, তারপর বরাট নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল,—‘কৈ, কিছু তো দেখছি না।’

ছবিটি খামে পুরিয়া ব্যোমকেশ সরাইয়া রাখিল। দ্বিতীয় খামটি লইয়া আগের মতই সমীক্ষার পর খাম খুলিতে খুলিতে বলিল,—‘এটিও মনে হচ্ছে গোয়ালিনী মার্কা দুগ্ধের মত হস্তদ্বারা অস্পৃষ্ট।’

খামের ভিতর হইতে ছবি বাহির করিয়া সে আলগোছে ছবির দুই পাশ ধরিয়া তুলিয়া ধরিল। তারপর লাফাইয়া উঠিয়া বলিল,—‘আছে—আছে? বাঘ ফাঁদে পা দিয়েছে!’

বরাট ছবিখানা ব্যোমকেশের হাত হইতে প্রায় কাড়িয়া লইয়া একাগ্রচক্ষে নিরীক্ষণ করিল, তারপর দ্বিধাভরে বলিল,—‘আছে। কিন্তু—’

ব্যোমকেশের মুখে চোখে উত্তেজনা ফাটিয়া পড়িতেছিল, সে একটু শান্ত হইবার চেষ্টা করিয়া বলিল,—‘আপনার ‘কিন্তু’র জবাব আমি দিতে পারব না, কিন্তু আমার বিশ্বাস বাঘ এবং বাঘিনীকে এক জায়গাতেই পাওয়া যাবে।—চলুন আর দেরি নয়, খাতাপত্র নিয়ে নিন। আপনাদের বিশেষজ্ঞদের অফিস বোধহয় কলকাতায়?’

‘হ্যাঁ। চলুন।’

বিশেষজ্ঞ মহাশয়ের মন্তব্য লইয়া আমরা যখন বাহির হইলাম তখন বেলা দুটা বাজিয়া গিয়াছে। ক্ষুধাতৃষ্ণার কথা কাহারও মনে ছিল না; ব্যোমকেশ বরাটের পিঠ চাপড়াইয়া বলিল,—‘আসুন, আমাদের বাসাতেই শাক-ভাত খাবেন।’

বরাট বলিল,—‘কিন্তু—ও কাজটা যে এখনও বাকী—?’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘ও কাজটা পরে হবে। আগে খাওয়া, তারপর খানাতল্লাস—তারপর আবার গোলাপ কলোনী। গোলাপ কলোনীর বিয়োগাদ্য নাটকে আজই যবনিকা পতন হবে।’

গোলাপ কলোনীতে নিশানাথবাবুর বহিঃকক্ষে সভা বসিয়াছিল। ঘরের মধ্যে ছিলাম আমরা তিনজন এবং দময়ন্তী দেবী ছাড়া কলোনীর সকলে। রসিক দে’কেও হাজত হইতে আনা হইয়াছিল। দময়ন্তী দেবীর প্রবল মাথা ধরিয়াছিল বলিয়া তাঁহাকে সভার অধিবেশন হইতে নিষ্কৃতি দেওয়া হইয়াছিল। দুইজন সশস্ত্র পুলিস কর্মচারী দ্বারের কাছে পাহারা দিতেছিল।

রাত্রি প্রায় আটটা। মাথার উপর উজ্জ্বল আলো জ্বলিতেছিল। সামনের দেয়ালে নিশানাথবাবুর একটি বিশদীকৃত ফটোগ্রাফ টাঙানো হইয়াছিল। নিশানাথের ঠোঁটের কোণে একটু নৈর্ব্যক্তিক হাসি, তিনি যেন হাকিমের উচ্চ আসনে বসিয়া নিরাসক্তভাবে বিচার-সভার কার্যবিধি পরিচালনা করিতেছেন।

ব্যোমকেশের মুখে আতপ্ত চাপা উত্তেজনা। সে একে একে সকলের মুখের উপর চোখ বুলাইয়া ধীরকণ্ঠে বলিল,—‘আপনারা শুনে সুখী হবেন নিশানাথবাবু এবং পানুগোপালকে কারা হত্যা করেছিল তা আমরা জানতে পেরেছি।’

কেহ কথা কহিল না। নেপালবাবু ফস্‌ করিয়া দেশলাই জ্বালাইয়া নির্বাপিত চুরুট ধরাইলেন।

ব্যোমকেশ বলিল,—‘শুধু যে জানতে পেরেছি তা নয়, অকাট্য প্রমাণও পেয়েছি। অপরাধীরা এই ঘরেই আছে। অন্নদাতা নিশানাথবাবুকে যারা বীভৎসভাবে হত্যা করেছে, অসহায় নিরীহ পানুগোপালকে যারা বিষ দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে, আইন তাদের ক্ষমা করবে না। তাদের প্রাণদণ্ড নিশ্চিত। তাই আমি আহ্বান করছি, মনুষ্যত্বের কণামাত্র যদি অপরাধীদের প্রাণে থাকে তারা অপরাধ স্বীকার করুক।’

এবারও সকলে নীরব। ভুজঙ্গধরবাবুর মুখের মধ্যে যেন সুপারি-লবঙ্গের মত একটা কিছু ছিল, তিনি সেটা এ গাল হইতে ও গালে লইলেন। বিজয় একদৃষ্টে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিল। মুকুলকে দেখিয়া মনে হয়, সে যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হইয়াছে। আজ তাহার মুখে রুজ পাউডার নাই; রক্তহীন সুন্দর মুখে অজানিতের বিভীষিকা।

ঘরের অন্য কোণে বনলক্ষ্মী চুপ করিয়া বসিয়া আছে, কিন্তু তাহার মুখে প্রবল উদ্বেগের ব্যঞ্জনা নাই। সে কোলের উপর হাত রাখিয়া আঙুলগুলা লইয়া খেলা করিতেছে, যেন অদৃশ্য কাঁটা দিয়া অদৃশ্য পশমের জামা বুনিতেছে।

আধ মিনিট পরে ব্যোমকেশ বলিল,—‘বেশ, তাহলে আমিই বলছি।—নেপালবাবু, আপনি নিশানাথবাবুর সম্বন্ধে একটা গুপ্তকথা জানেন। আমি যখন জানতে চেয়েছিলাম তখন আপনি অস্বীকার করেছিলেন কেন?’

নেপালবাবুর চোখের মধ্যে চকিত আশঙ্কার ছায়া পড়িল, তিনি স্খলিতস্বরে বলিলেন,—‘আমি—আমি—’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘যাক, কেন অস্বীকার করেছিলেন তার কৈফিয়ৎ দরকার নেই। কিন্তু কার কাছে এই গুপ্তকথা শুনেছিলেন? কে আপনাকে বলেছিল?—আপনার মেয়ে মুকুল?’ ব্যোমকেশের তর্জনী মুকুলের দিকে নির্দিষ্ট হইল।

নেপালবাবু ঘোর শব্দ করিয়া গলা পরিষ্কার করিলেন। বলিলেন,—‘হ্যাঁ—মানে—মুকুল জানতে পেরেছিল—’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘কার কাছে জানতে পেরেছিল?—আপনার কাছে?’ ব্যোমকেশের তর্জনী দিগদর্শন যন্ত্রের কাঁটার মত বিজয়ের দিকে ফিরিল।

বিজয়ের মুখ সাদা হইয়া গেল, সে মুখ তুলিতে পারিল না। অধোমুখে বলিল,—‘হ্যাঁ—আমি বলেছিলাম। কিন্তু—’

ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করিল,—‘আর কাউকে বলেছিলেন?’

বিজয়ের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটিয়া উঠিল। সে ব্যাকুল চোখ তুলিয়া চারিদিকে চাহিল, তারপর আবার অধোবদন হইল। উত্তর দিল না।

ব্যোমকেশ বলিল,—‘যাক, আর একটা কথা বলুন। আপনি দোকান থেকে যে টাকা সরিয়েছিলেন সে টাকা কার কাছে রেখেছেন?’

বিজয় হেঁটমুখে নিরুত্তর রহিল।

‘বলবেন না?’ ব্যোমকেশ ঘরের অন্যদিকে যেখানে রসিক দে বৃষকাষ্ঠের মত শক্ত হইয়া বসিয়াছিল সেইদিকে ফিরিল,—‘রসিকবাবু, আপনিও দোকানের টাকা চুরি করে একজনের কাছে রেখেছিলেন, তার নাম বলবেন না?’

রসিকের কণ্ঠের হাড় একবার লাফাইয়া উঠিল, কিন্তু সে নীরব রহিল; আঙুলকাটা হাতটা একবার চোখের উপর বুলাইল।

ব্যোমকেশের অধরে শুষ্ক ব্যঙ্গ ফুটিয়া উঠিল। সে বলিল,—‘ধন্য আপনারা! ধন্য আপনাদের একনিষ্ঠা! কিন্তু একটা কথা বোধহয় আপনারা জানেন না। বিজয়বাবু, আপনি যার কাছে টাকা জমা রাখছেন, রসিকবাবুও ঠিক তার কাছেই টাকা গচ্ছিত রাখছিলেন। এবং দু’জনেই আশা করেছিলেন যে, একদিন শুভ মুহূর্তে বামাল সমেত গোলাপ কলোনী থেকে অদৃশ্য হয়ে কোথাও এক নিভৃত স্থানে রোমান্সের নন্দন-কানন রচনা করবেন! বলিহারি!’

রসিক এবং বিজয় দু’জনেই একদৃষ্টে একজনের দিকে তাকাইয়া একসঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইল।

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল,—‘বসুন, বসুন, আমি যা জানতে চাই তা জানতে পেরেছি, আর আপনাদের কিছু বলবার দরকার নেই।—ইন্সপেক্টর বরাট, আপনাকে একটা কাজ করতে হবে। আপনি বনলক্ষ্মী দেবীর বাঁ হাতের আঙুলগুলো একবার পরীক্ষা করে দেখুন।’

বরাট উঠিয়া গিয়া বনলক্ষ্মীর সম্মুখে দাঁড়াইল। বনলক্ষ্মী ক্ষণেক ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তাকাইয়া থাকিয়া বাঁ হাতখানা সম্মুখে বাড়াইয়া ধরিল।

ভুজঙ্গধরবাবু এইবার কথা কহিলেন। একটু জড়াইয়া জড়াইয়া বলিলেন,—‘কী ধরনের অভিনয় হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না—নাটক, না প্রহসন, না কমিক অপেরা!’

ব্যোমকেশ উত্তর দিবার পূর্বেই বরাট বলিল,—‘এঁর তর্জনীর আগায় কড়া পড়েছে, মনে হয় ইনি তারের যন্ত্র বাজাতে জানেন।’

বরাট স্বস্থানে ফিরিয়া আসিয়া বসিল। ভুজঙ্গধরবাবু অস্ফুটস্বরে বলিলেন,—‘তাহলে কমিক অপেরা!’

ব্যোমকেশ ভুজঙ্গধরবাবুকে হিম-কঠিন দৃষ্টি দ্বারা বিদ্ধ করিয়া বলিল,—‘এটা কমিক অপেরা নয় তা আপনি ভাল করেই জানেন; আপনি নিপুণ যন্ত্রী, সুদক্ষ অভিনেতা।—কিন্তু আপাতত আর্ট ছেড়ে বৈষয়িক প্রসঙ্গে আসা যাক। ভুজঙ্গধরবাবু, ১৯ নম্বর মির্জা লেনের বাড়িটা বোধহয় আপনার, কারণ আপনি ভাড়া আদায় করেন। কেমন?’

ভুজঙ্গধর স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার গলার একটা শির দপ্‌দপ করিতে লাগিল। ব্যোমকেশ পুনশ্চ বলিল,—‘কিন্তু কর্পোরেশের খাতায় দেখলাম বাড়িটা শ্ৰীমতী নৃত্যকালী দাসের নামে রয়েছে। নৃত্যকালী দাস কি আপনার স্ত্রীর নাম?’

ভুজঙ্গধরবাবুর মুখের উপর দিয়া যেন একটা রোমাঞ্চকর নাটকের অভিনয় হইয়া গেল; মানুষের অন্তরে যতপ্রকার আবেগ উৎপন্ন হইতে পারে, সবগুলি দ্রুত পরম্পরায় তাঁহার মুখে প্রতিফলিত হইল। তারপর তিনি আত্মস্থ হইলেন। সহজ স্বরে বলিলেন,—‘হ্যাঁ, নৃত্যকালী আমার স্ত্রীর নাম, ১৯ নম্বর বাড়িটা আমার স্ত্রীর নামে।’

‘কিন্তু—কয়েকদিন আগে আপনি বলেছিলেন, বিলেতে থাকা কালে আপনি এক ইংরেজ মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন!’

‘হ্যাঁ। তাঁরই স্বদেশী নাম নৃত্যকালী—বিলিতি নাম ছিল নিটা।’

‘ও। —নিটা-নৃত্যকালী-সুনয়না, আপনার স্ত্রীর দেখছি অনেক নাম। তা—তিনি এখন বিলেতে আছেন?’

‘হ্যাঁ।—যদি না জার্মান বোমায় মারা গিয়ে থাকেন।’

ব্যোমকেশ দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল,—‘তিনি মারা যাননি। তিনি বিলিতি মেয়ে নন, খাঁটি দেশী মেয়ে; যদিও আপনাদের বিয়ে বিলেতেই হয়েছিল। আপনার স্ত্রী এই দেশেই আছেন, এমনকি এই ঘরেই আছেন।’

‘ভারি আশ্চর্য কথা।’

‘ভুজঙ্গধরবাবু, আর অভিনয় করে লাভ কি? আপনারা দু’জনেই উঁচুদরের আর্টিস্ট, আপনাদের অভিনয়ে এতটুকু খুঁত নেই। কিন্তু অভিনয় যতই উচ্চাঙ্গের হোক, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। অসতর্ক মুহূর্তে আপনি ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন।’

‘ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি। বুঝলাম না।’

‘আপনি বুদ্ধিমান, কিন্তু ভয় পেয়ে একটু নির্বুদ্ধিতা করে ফেলেছেন। খামটা আপনার খোলা উচিত হয়নি। খামের মধ্যে যে ছবিটা ছিল, সেটা আপনি নিজে দেখেছেন, স্ত্রীকেও দেখিয়েছেন, ছবির ওপর আপনাদের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। নৃত্যকালী ওরফে সুনয়না ওরফে বনলক্ষ্মী যে আপনার সহধর্মিণী এবং সহকর্মিণী তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।’

ভুজঙ্গধর চকিত বিস্ফারিত চক্ষে বনলক্ষ্মীর পানে চাহিলেন, বনলক্ষ্মীও বিস্ময়ে তাঁহার দৃষ্টি ফিরাইয়া দিল। ভুজঙ্গধর মৃদুকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল,—‘আপনার হাসির অর্থ সুনয়নার সঙ্গে বনলক্ষ্মীর চেহারার একটুও মিল নেই, এই তো? কিন্তু যে-কথাটা সকলে ভুলে গেছে আমি তা ভুলিনি, ডাক্তার দাস। আপনি বিলেতে গিয়ে প্ল্যাস্টিক সার্জারি শিখেছিলেন। এবং বনলক্ষ্মীর মুখের ওপর শিল্পীর হাতের যে অস্ত্রোপচার হয়েছে একটু ভাল করে পরীক্ষা করলেই তা ধরা পড়বে। এবং তাঁর সব দাঁতগুলিও যে নিজস্ব নয়, তাও বেশি পরীক্ষার অপেক্ষা রাখে না।’

বনলক্ষ্মীর মুখ-ভাবের কোনও পরিবর্তন হইল না, বিস্ময়বিমূঢ় ফ্যাল্‌ফেলে মুখ লইয়া সে এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। ভুজঙ্গধর কয়েক মুহূর্ত নতনেত্রে চাহিয়া যখন চোখ তুলিলেন, তখন মনে হইল অপরিসীম ক্লান্তিতে তাঁহার মন ভরিয়া গিয়াছে। তবু তিনি শান্ত স্বরেই বলিলেন,—‘যদি ধরে নেওয়া যায় যে বনলক্ষ্মী আমার স্ত্রী, তাতে কী প্রমাণ হয়? আমি নিশানাথবাবুকে খুন করেছি প্রমাণ হয় কি? যে-সময় নিশানাথবাবুর মৃত্যু হয়, সে-সময় আমি নিজের বারান্দায় বসে সেতার বাজাচ্ছিলাম। তার সাক্ষী আছে।’

ব্যোমকেশ বলিল,—‘আপনি যে অ্যালিবাই তৈরি করেছিলেন, তা সত্যিই অদ্ভুত, কিন্তু ধোপে টিকলো না। সে-রাত্রে রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে আপনি মিনিট পাঁচেক সেতার বাজিয়েছিলেন বটে, কিন্তু বাকী সময়টা বাজিয়েছিলেন আপনার স্ত্রী। বনলক্ষ্মী দেবী অস্বীকার করলেও তিনি সেতার বাজাতে জানেন, তাঁর আঙুলে কড়া আছে।’

‘এটা কি প্রমাণ? না জোড়াতাড়া দেওয়া একটা থিওরি!’

‘বেশ, এটা থিওরি। আপনি নিশানাথবাবুকে খুন করেছেন এটা যদি আদালতে প্রমাণ নাও হয়, তবু আপনাদের নিষ্কৃতি নেই ডাক্তার। আপনার ১৯ নম্বর মির্জা লেনের বাড়ি আজ বিকেলে পুলিস খানাতল্লাস করেছে; আপনার বন্ধ ঘরটিতে কি কি আছে আমরা জানতে পেরেছি। আছে একটি অপারেটিং টেবিল এবং একটি স্টিলের আলমারি। আলমারিও আমরা খুলে দেখেছি। তার মধ্যে পাওয়া গেছে—অপারেশনের অস্ত্রশস্ত্র, আপনাদের বিয়ের সার্টিফিকেট, আন্দাজ বিশ হাজার টাকার নোট, তামাক থেকে নিকোটিন চোলাই করবার যন্ত্রপাতি, আর—’

‘আর—?’

‘মনে করতে পারছেন না? আলমারির চোরা-কুঠুরির মধ্যে যে হীরের নেকলেসটি রেখেছিলেন তার কথা ভুলে গেছেন? মুরারি দত্তর মৃত্যুর সময় ওই নেকলেসটা দোকান থেকে লোপাট হয়ে যায়।—নিশানাথ এবং পানুকে খুন করার অপরাধে যদি বা নিষ্কৃতি পান, মুরারি দত্তকে বিষ খাওয়াবার দায় থেকে উদ্ধার পাবেন কি করে?’

ভুজঙ্গধরবাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বরাট রিভলবার বাহির করিল। কিন্তু রিভলবার দরকার হইল না। ভুজঙ্গধর বনলক্ষ্মীর কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন। তারপর যে অভিনয় হইল তাহা বাংলা দেশের মঞ্চাভিনয় নয়, হলিউডের সিনেমা। বনলক্ষ্মী উঠিয়া ভুজঙ্গধরের কণ্ঠলগ্না হইল। ভুজঙ্গধর তাহাকে বিপুল আবেগে জড়াইয়া লইয়া তাহার উন্মুক্ত অধরে দীর্ঘ চুম্বন করিলেন। তারপর তাহার মুখখানি দুই হাতের মধ্যে লইয়া স্নেহক্ষরিত স্বরে বলিলেন,—‘চল, এবার যাওয়া যাক।’

মৃত্যু আসিল অকস্মাৎ, বজ্রপাতের মত। দু’জনের মুখের মধ্যে কাচ চিবানোর মত একটা শব্দ হইল; দু’জনে একসঙ্গে পড়িয়া গেল। যেখানে দেয়ালের গায়ে নিশানাথের ছবি ঝুলিতেছিল, তাহারই পদমূলে ভূ-লুণ্ঠিত হইল।

আমরা ছুটিয়া গিয়া যখন তাহাদের পাশে উপস্থিত হইলাম, তখন তাহাদের দেহে প্রাণ নাই, কেবল মুখের কাছে একটু মৃদু বাদাম-তেলের গন্ধ লাগিয়া আছে।

বিজয় দাঁড়াইয়া দুঃস্বপ্নভরা চোখে চাহিয়া ছিল। তাহার চোয়ালের হাড় রোমন্থনের ভঙ্গীতে ধীরে ধীরে নড়িতেছিল। মুকুল তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল, চাপা গলায় বলিল,—‘এস—চলে এস এখান থেকে—’

বিজয় দাঁড়াইয়া রহিল, বোধহয় শুনিতে পাইল না। মুকুল তখন তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া ভিতরে লইয়া গেল।