পরিশিষ্ট

চিড়িয়াখানা – ২৪

চব্বিশ

ভুজঙ্গধরবাবু চলিয়া যাইবার ঘণ্টাখানেক পরে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। প্রথমে রিম্‌ঝিম্ তারপর ঝম্‌ঝম্‌। দীর্ঘ আয়োজনের পর বেশ জুত করিয়া বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে, শীঘ্র থামিবে বলিয়া বোধ হয় না।

ব্যোমকেশের ভাবভঙ্গী হইতে অনুমান হইল, তাহার উদ্যোগ আয়োজনও চরম পরিণতির মুখোমুখি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে ছটফট করিয়া বেড়াইতেছে, ক্রমাগত সিগারেট টানিতেছে। এ সব লক্ষণ আমি চিনি। জাল গুটাইয়া আসিতেছে।

মেঘের অন্তরপথে দিন শেষ হইয়া রাত্রি আসিল। আটটার সময় ব্যোমকেশ প্রমোদ বরাটকে ফোন করিল; অনেকক্ষণ ধরিয়া ফোনের মধ্যে গুজগুজ করিল। তাহার সংলাপের ছিন্নাংশ হইতে এইটুকু শুধু বুঝিলাম যে, গোলাপ কলোনীর উপর কড়া পাহারা রাখা দরকার, কেহ না পালায়।

রাত্রে ঘুমের মধ্যেও অনুভব করিলাম, ব্যোমকেশ জাগিয়া আছে এবং বাড়িময় পায়চারি করিয়া বেড়াইতেছে।

সমস্ত রাত্রি বৃষ্টি হইল। সকালে দেখিলাম, মেঘগুলো ফ্যাকাসে হইয়া গিয়াছে; বৃষ্টির তেজ কমিয়াছে, কিন্তু থামে নাই। এগারোটার সময় বৃষ্টি বন্ধ হইয়া পাঙাস সূর্যালোক দেখা দিল।

ব্যোমকেশ ছাতা লইয়া গুটি গুটি বাহির হইতেছে দেখিয়া বলিলাম,—‘এ কি! চললে কোথায়?’

উত্তর না দিয়া সে বাহির হইয়া গেল। ফিরিল বিকাল সাড়ে তিনটার সময়। জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘আজও কি একাদশী?’

সে বলিল,—‘উহুঁ, কাফে সাজাহানে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছের ডিম দিয়ে দিব্যি চর্ব-চোষ্য হয়েছে।’

‘যদি নেপাল গুপ্ত কিম্বা ভুজঙ্গ ডাক্তার দেখে ফেলত!’

‘সে সম্ভাবনা কম। তাঁরা কেউ কলোনী থেকে বেরুবার চেষ্টা করলে গ্রেপ্তার হতেন।’

‘যাক, ওদিকে তাহলে পাকা বন্দোবস্ত করেছ। এদিকের খবর কি, গিছলে কোথায়?’

‘প্রথমত কর্পোরেশন অফিস। ১৯ নং মির্জা লেন বাড়িটির মালিক কে জানবার কৌতূহল হয়েছিল।’

‘মালিক কে—ভুজঙ্গধরবাবু?’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল,—‘না, একজন স্ত্রীলোক।’

‘আর কোথায় গিছলে?’

‘রমেনবাবুর কাছে। সুনয়নার আরও দুটো ফটো যোগাড় করেছি।’

‘আর কি করলে?’

‘আর, একবার চীনেপটিতে গিয়েছিলাম দাঁতের সন্ধানে।’

‘দাঁতের সন্ধানে?’

‘হ্যাঁ। চীনেরা খুব ভাল দাঁতের ডাক্তার হয় জানো?’ বলিয়া উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া সে স্নান-ঘরের দিকে চলিয়া গেল। আমি বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম—নাটকের পঞ্চম অঙ্কে যবনিকা পড়িতে আর দেরি নাই, অথচ নাটকের নায়ক-নায়িকাকে চিনিতে পারিতেছি না কেন?

পরদিন সকালে আকাশ একেবারে পরিষ্কার হইয়া ঝল্‌মলে রোদ উঠিয়াছে, ব্যোমকেশ খবরের কাগজ রাখিয়া বলিল,—‘আটটা বাজল। এস, এবার আমাকে কাটা সৈনিক সাজিয়ে দাও। কলোনীতে যেতে হবে।’

‘একলা যাবে?’

‘না, তুমিও যাবে। গুণ্ডা ধরা পড়েছে। কিন্তু তবু সাবধানের মার নেই। একজন সঙ্গী থাকা দরকার।’

‘গুণ্ডা কবে ধরা পড়ল?’

‘কাল রাত্তিরে।’

‘আজ কলোনীতে যাওয়ার উদ্দেশ্য কি?’

‘ছবির খাম ফেরত নিতে হবে। আজ এস্পার কি ওস্পার।’

তাহার ব্যান্ডেজ বাঁধিয়া দিলাম। বাহির হইবার পূর্বে সে প্রমোদ বরাটকে ফোন করিল। আমি একটা মোটা লাঠি হাতে লইলাম।

মোহনপুরের স্টেশনে বরাট উপস্থিত ছিল। ব্যোমকেশের রূপসজ্জা দেখিয়া মুচকি মুচকি হাসিতে লাগিল।

ব্যোমকেশ বলিল,—‘হাসছেন কি, ভেক না হলে ভিক পাওয়া যায় না। আমার গুন্ডার নাম জানেন তো? সজ্জনদাস মিরজাপুরী। যদি দরকার হয়, মনে রাখবেন। আজ কাগজে ঐ নামটা পেয়েছি, কাল রাত্রে বেলগাছিয়া পুলিস তাকে ধরেছে।’

‘বাঃ! জুতসই একটা গুণ্ডাও পেয়ে গেছেন।’

‘অমন একটা-আধটা গুণ্ডার খবর প্রায় রোজই কাগজে থাকে!’

কলোনীতে উপস্থিত হইলাম। ফটকের কাছে পুলিসের থানা বসিয়াছে, তাছাড়া তারের বেড়া ঘিরিয়া কয়েকজন পাহারাওয়ালা রোঁদ দিতেছে। বেশ একটা থমথমে ভাব।

ফটকের বাহিরে গাড়ি রাখিয়া আমরা প্রবেশ করিলাম। প্রথমেই চোখে পড়িল, নিশানাথবাবুর বারান্দায় বিজয় ও ভুজঙ্গধরবাবু বসিয়া আছেন। ভুজঙ্গধরবাবু খবরের কাগজ পড়িতেছিলেন, আমাদের দেখিয়া কাগজ মুড়িয়া রাখিলেন। বিজয় ভ্রূকুটি করিয়া চাহিল। আমরা নিকটস্থ হইলে সে রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিল,—‘এর মানে কি, ব্যোমকেশবাবু? অপরাধীকে ধরবার ক্ষমতা নেই, মাঝ থেকে কলোনীর ওপর চৌকি বসিয়ে দিয়েছেন। পরশু থেকে আমরা কলোনীর সীমানার মধ্যে বন্দী হয়ে আছি।’

ব্যোমকেশ তাহার রুক্ষতা গায়ে মাখিল না, হাসিমুখে বলিল,—‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। যেখানে খুন হয়েছে সেখানে একটু-আধটু অসুবিধে হবে বৈকি। দেখুন না আমার অবস্থা।’

ভুজঙ্গধরবাবু বলিলেন,—‘আজ তো আপনি চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। গুণ্ডা কি ধরা পড়েছে নাকি?’

‘হ্যাঁ, সজ্জনদাস ধরা পড়েছে।’

‘সজ্জনদাস! নামটা যেন কোথায় দেখেছি!—ও—আজকের কাগজে আছে। তা—এই সজ্জনদাসই আপনার দুর্জনদাস?’

‘হ্যাঁ, পুলিস কাল রাত্রে তাকে ধরেছে! তাই অনেকটা নির্ভয়ে বেরুতে পেরেছি।’

‘তাহলে—?’ ভুজঙ্গধরবাবু সপ্রশ্ন দৃষ্টিপাত করিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল,—‘হ্যাঁ। আসুন, আপনার সঙ্গে কাজ আছে।’

ভুজঙ্গধরবাবুকে লইয়া আমরা তাঁহার কুঠির দিকে চলিলাম। ব্যোমকেশ বলিল,—‘খামখানা ফেরত নিতে এসেছি।’

ভূজঙ্গধরবাবু বলিলেন,—‘বাঁচালেন মশাই, ঘাড় থেকে বোঝা নামল। ভয় হয়েছিল শেষ পর্যন্ত বুঝি আমাকেই গোয়েন্দাগিরি করতে হবে।—একটু দাঁড়ান।’

নিজের কুঠিতে প্রবেশ করিয়া তিনি মিনিটখানেক পরে খাম হাতে বাহির হইয়া আসিলেন। ব্যোমকেশ খাম লইয়া বলিল,—‘খোলেননি তো?’

‘না, খুলিনি। লোভ যে একেবারে হয়নি তা বলতে পারি না কিন্তু সামলে নিলাম। হাজার হোক, কথা দিয়েছি। —আচ্ছা ব্যোমকেশবাবু, সত্যি কি কিছু জানতে পেরেছেন?’

‘এইটুকু জানতে পেরেছি যে স্ত্রীলোকঘটিত ব্যাপার।’

‘তাই নাকি!’ কৌতুহলী চক্ষে ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিতে করিতে তিনি মস্তকের পশ্চাৎভাগ চুলকাইতে লাগিলেন।

‘ধন্যবাদ।—আবার বোধহয় ওবেলা আসব।’ বলিয়া ব্যোমকেশ নেপালবাবুর কুঠির দিকে পা বাড়াইল।

‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?’ ভুজঙ্গধরবাবু প্রশ্ন করিলেন।

ব্যোমকেশ মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল,—‘নেপালবাবুর সঙ্গে কিছু গোপনীয় কথা আছে।’

ভুজঙ্গধরবাবুর চোখে বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। কিন্তু তিনি কিছু বলিলেন না, মুখে অর্ধ-হাস্য লইয়া মস্তকের পশ্চাৎভাগে হাত বুলাইতে লাগিলেন।

নেপালবাবু নিজের ঘরে বসিয়া দাবার ধাঁধা ভাঙিতেছিলেন, ব্যোমকেশকে দেখিয়া এমন কঠোর দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন যে মনে হইল, জীবন্ত ব্যোমকেশকে চোখের সামনে দেখিয়া তিনি মোটেই প্রসন্ন হন নাই। তারপর যখন সে খামটি ফেরত চাহিল তখন তিনি নিঃশব্দে খাম আনিয়া ব্যোমকেশের সামনে ফেলিয়া দিয়া আবার দাবার ধাঁধায় মন দিলেন।

আমরা সুড়সুড় করিয়া বাহির হইয়া আসিলাম। নেপালবাবু আগে হইতেই পুলিসের উপর খড়্গহস্ত ছিলেন, তাহার উপর ব্যোমকেশের ব্যবহারে যে মর্মান্তিক চটিয়াছেন তাহাতে সন্দেহ রহিল না।