কুড়ি
গোলাপ কলোনীর ঘটনাবলী ধাবমান মোটরের মত হঠাৎ বানচাল হইয়া রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিল, তিন দিন পরে মেরামত হইয়া আবার প্রচণ্ড বেগে ছুটিতে আরম্ভ করিল।
পরদিন সকালে আন্দাজ সাড়ে আটটার সময় মোহনপুরের স্টেশনে অবতীর্ণ হইলাম। আকাশে শেষরাত্রি হইতে মেঘ জমিতেছিল, সূর্য ছাই-ঢাকা আগুনের মত কেবল অন্তর্দাহ বিকীর্ণ করিতেছিলেন। আমরা পদব্রজে থানার দিকে চলিলাম।
থানার কাছাকাছি পৌঁছিয়াছি এমন সময় নেপালবাবু বন্য বরাহের ন্যায় থানার ফটক দিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। আমাদের দিকে মোড় ঘুরিয়া ছুটিয়া আসিতে আসিতে হঠাৎ আমাদের দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন, তারপর আবার ঘোঁৎ ঘোঁৎ করিয়া ছুটিয়া চলিলেন।
ব্যোমকেশ ডাকিল,—‘নেপালবাবু, শুনুন—শুনুন।’
নেপালবাবু যুযুৎসু ভঙ্গীতে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া চক্ষু ঘূর্ণিত করিতে লাগিলেন। ব্যোমকেশ তাঁহার কাছে গিয়া বলিল,—‘এ কি, আপনি থানায় গিয়েছিলেন। কী হয়েছে?’
নেপালবাবু ফাটিয়া পড়িলেন,—‘ঝকমারি হয়েছে। পুলিসকে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম, আমার ঘাট হয়েছে। পুলিসের খুরে দণ্ডবৎ।’ বলিয়া আবার উল্টামুখে চলিতে আরম্ভ করিলেন।
ব্যোমকেশ আবার গিয়া তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিল,—‘কিন্তু ব্যাপারটা কি? পুলিসকে কোন্ বিষয়ে সাহায্য করতে গিয়েছিলেন?’
ঊর্ধ্বে হাত তুলিয়া নাড়িতে নাড়িতে নেপালবাবু বলিলেন,—‘না না, আর না, যথেষ্ট হয়েছে। কোন্ শালা আর পুলিসের কাজে মাথা গলায়। আমার দুর্বুদ্ধি হয়েছিল, তাই—।’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘কিন্তু আমাকে বলতে দোষ কি? আমি তো আর পুলিস নই।’
নেপালবাবু কিন্তু বাগ মানিতে চান না। অনেক কষ্টে পিঠে অনেক হাত বুলাইয়া ব্যোমকেশ তাঁহাকে কতকটা ঠাণ্ডা করিল। একটা গাছের তলায় দাঁড়াইয়া কথা হইল। নেপালবাবু বলিলেন,—‘কলোনীতে দুটো খুন হয়ে গেল, পুলিস চুপ করে বসে থাকতে পারে কিন্তু আমি চুপ করে থাকি কি করে? আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। আমি জানি কে খুন করেছে, তাই পুলিসকে বলতে গিয়েছিলাম। তা পুলিস উল্টে আমার ওপরই চাপ দিতে লাগল। ভাল রে ভাল—যেন আমিই খুন করেছি!’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘আপনি জানেন কে খুন করেছে?’
‘এর আর জানাজানি কি? কলোনীর সবাই জানে, কিন্তু মুখ ফুটে বলবার সাহস কারুর নেই।’
‘কে খুন করেছে?’
‘বিজয়! বিজয়! আর কে খুন করবে? খুড়ীর সঙ্গে ষড় করে আগে খুড়োকে সরিয়েছে, তারপর পানুকে সরিয়েছে। পানুটাও দলে ছিল কিনা।
‘কিন্তু—পানু কিসে মারা গেছে আপনি জানেন?’
‘নিকোটিন। আমি সব খবর রাখি।’
‘কিন্তু বিজয় নিকোটিন পাবে কোথায়? নিকোটিন কি বাজারে পাওয়া যায়?’
‘বাজারে সিগারেট তো পাওয়া যায়। যার ঘটে এতটুকু বুদ্ধি আছে সে এক প্যাকেট সিগারেট থেকে এত নিকোটিন বার করতে পারে যে কলোনী সুদ্ধ লোককে তা দিয়ে সাবাড় করা যায়।’
‘তাই নাকি? নিকোটিন তৈরি করা এত সহজ?’
‘সহজ নয় তো কী! একটা বকযন্ত্র যোগাড় করতে পারলেই হল।’ এই পর্যন্ত বলিয়া নেপালবাবু হঠাৎ সচকিত হইয়া উঠিলেন, তারপর আর বাক্যব্যয় না করিয়া স্টেশনের দিকে পা চালাইলেন।
আমরাও সঙ্গে চলিলাম। ব্যোমকেশ বলিল,—‘আপনি বৈজ্ঞানিক, আপনার কথাই ঠিক। আমি জানতাম না নিকোটিন তৈরি করা এত সোজা।—তা আপনি এদিকে কোথায় চলেছেন? কলোনীতে ফিরবেন না?’
‘কলকাতা যাচ্ছি একটা বাসা ঠিক করতে—কলোনীতে ভদ্দরলোক থাকে না—’ বলিয়া তিনি হন্হন্ করিয়া চলিয়া গেলেন।
আমরা থানার দিকে ফিরিলাম। ব্যোমকেশের ঠোঁটের কোণে একটা বিচিত্র হাসি খেলা করিতে লাগিল।
থানায় প্রমোদ বরাটের ঘরে আসন গ্রহণ করিয়া ব্যোমকেশ বলিল,—‘রাস্তায় নেপাল গুপ্তর সঙ্গে দেখা হল।’
বরাট বলিল,—‘আর বলবেন না, লোকটা বদ্ধ পাগল। সকাল থেকে আমার হাড় জ্বালিয়ে খেয়েছে। ওর বিশ্বাস বিজয় খুন করেছে, কিন্তু সাক্ষী প্রমাণ কিছু নেই, শুধু আক্রোশ। আমি বললাম, আপনি যদি বিজয়ের নামে পুলিসে ডায়েরি করতে চান আমার আপত্তি নেই, কিন্তু পরে যদি বিজয় মানহানির মামলা করে তখন আপনি কি করবেন? এই শুনে নেপাল গুপ্ত উঠে পালাল। আসল কথা বিজয় ওকে নোটিস দিয়েছে; বলেছে চুপটি করে কলোনীতে থাকতে পারেন তো থাকুন, নইলে রাস্তা দেখুন, সর্দারি করা এখানে চলবে না। তাই এত রাগ।’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘আমারও তাই আন্দাজ হয়েছিল।—যাক, এবার আপনার রসিককে বার করুন।’
রসিক আনীত হইল। হাজতে রাত্রিবাসের ফলে তাহার চেহারার শ্রীবৃদ্ধি হয় নাই। খুঁতখুঁতে মুখে নিপীড়িত একগুঁয়েমির ভাব। আমাদের দেখিয়া একবার ঢোক গিলিল, কণ্ঠার হাড় সবেগে নড়িয়া উঠিল।
কিন্তু তাহাকে জেরা করিয়া ব্যোমকেশ কোনও কথাই বাহির করিতে পারিল না। বস্তুত রসিক প্রায় সারাক্ষণই নির্বাক হইয়া রহিল। সে চুরি করিয়াছে কি না এ প্রশ্নের জবাব নাই, টাকা লইয়া কী করিল এ বিষয়েও নিরুত্তর। কেবল একবার সে কথা কহিল, তাহাও প্রায় অজ্ঞাতসারে।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,—‘যে-রাত্রে নিশানাথবাবু মারা যান সেদিন সন্ধ্যেবেলা তাঁর সঙ্গে আপনার ঝগড়া হয়েছিল?’
রসিক চোখ মেলিয়া কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল, বলিল,—‘নিশানাথবাবু মারা গেছেন?’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘হ্যাঁ। পানুগোপালও মারা গেছে। আপনি জানেন না?’
রসিক কেবল মাথা নাড়িল।
তারপর ব্যোমকেশ আরও প্রশ্ন করিল কিন্তু উত্তর পাইল না। শেষে বলিল,—‘দেখুন, আপনি চুরির টাকা নষ্ট করেননি, কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। আপনি যদি আমাদের জানিয়ে দেন কোথায় টাকা রেখেছেন তাহলে আমি বিজয়বাবুকে বলে আপনার বিরুদ্ধে মামলা তুলিয়ে নেব, আপনাকে জেলে যেতে হবে না।—কোথায় কার কাছে টাকা রেখেছেন বলবেন কি?’
রসিক পূর্ববৎ নির্বাক হইয়া রহিল।
আরও কিছুক্ষণ চেষ্টার পর ব্যোমকেশ হাল ছাড়িয়া দিল। বলিল,—‘আপনি ভাল করলেন না। আপনি যে-কথা লুকোবার চেষ্টা করছেন তা আমরা শেষ পর্যন্ত জানতে পারবই। মাঝ থেকে আপনি পাঁচ বছর জেল খাটবেন।’
রসিকের কণ্ঠার হাড় আর একবার নড়িয়া উঠিল, সে যেন কিছু বলিবার জন্য মুখ খুলিল। তারপর আবার দৃঢ়ভাবে ওষ্ঠাধর সম্বদ্ধ করিল।
রসিককে স্থানান্তরিত করিবার পর ব্যোমকেশ শুষ্কস্বরে বলিল,—‘এদিকে তো কিছু হল না—কিন্তু আর দেরি নয়, সব যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। একটা প্ল্যান আমার মাথায় এসেছে—’
বরাট বলিল,—‘কী প্ল্যান?’
প্ল্যান কিন্তু শোনা হইল না। এই সময় একটি বকাটে ছোকরা গোছের চেহারা দরজা দিয়া মুণ্ড বাড়াইয়া বলিল,—‘ব্রজদাস বোষ্টমকে পাক্ড়েছি স্যার।’
বরাট বলিল,—‘বিকাশ! এস। কোথায় পাক্ড়ালে বোষ্টমকে?’
বিকাশ ঘরে প্রবেশ করিয়া দন্তবিকাশ করিল,—‘নবদ্বীপের এক আখড়ায় বসে খঞ্জনি বাজাচ্ছিল। কোনও গোলমাল করেনি। যেই বললাম, আমার সঙ্গে ফিরে যেতে হবে, অমনি সুস্সুড় করে চলে এল।’
‘বাঃ বেশ। এই ঘরেই পাঠিয়ে দাও তাকে।’
ব্রজদাস বৈষ্ণব ঘরে প্রবেশ করিলেন। গায়ে নামাবলী, মুখে কয়েক দিনের অক্ষৌরিত দাড়ি-গোঁফ মুখখানিকে ধুতরা-ফলের মত কন্টকাকীর্ণ করিয়া তুলিয়াছে, চোখে লজ্জিত অপ্রস্তুত ভাব। তিনি বিনয়াবনত হইয়া জোড়হস্তে আমাদের নমস্কার করিলেন।
বরাট ব্যোমকেশকে চোখের ইশারা করিল, ব্যোমকেশ ব্রজদাসের দিকে মুচকি হাসিয়া বলিল,—‘বসুন।’
ব্রজদাস যেন আরও লজ্জিত হইয়া একটি টুলের উপর বসিলেন। ব্যোমকেশ বলিল,—‘আপনি হঠাৎ ডুব মেরেছিলেন কেন বলুন তো? যতদূর জানি কলোনীর টাকাকড়ি কিছু আপনার কাছে ছিল না।’
ব্রজদাস বলিলেন,—‘আজ্ঞে না।’
‘তবে পালালেন কেন?’
ব্রজদাস কাঁচুমাচু মুখে চুপ করিয়া রহিলেন। তাঁহার মুখের পানে চাহিয়া চাহিয়া আমার হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, নিশানাথ বলিয়াছিলেন ব্রজদাস মিথ্যা কথা বলে না। ইহাও কি সম্ভব? পাছে সত্য কথা বলিতে হয় এই ভয়ে তিনি পলায়ন করিয়াছিলেন। কিন্তু কী এমন মারাত্মক সত্য কথা?
ব্যোমকেশ বলিল,—‘আচ্ছা, ওকথা পরে হবে। এখন বলুন দেখি, নিশানাথবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে কিছু জানেন?’
ব্রজদাস বলিলেন,—‘না, কিছু জানি না।’
‘কাউকে সন্দেহ করেন?’
‘আজ্ঞে না।’
‘তবে—’ ব্যোমকেশ থামিয়া গিয়া বলিল,—‘নিশানাথবাবুর মৃত্যুর রাত্রে আপনি কলোনীতেই ছিলেন তো?’
‘আজ্ঞে কলোনীতেই ছিলাম।’
লক্ষ্য করিলাম ব্রজদাস এতক্ষণে যেন বেশ স্বচ্ছন্দ হইয়াছেন, কাঁচুমাচু ভাব আর নাই। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,—‘রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন?’
ব্রজদাস বলিলেন,—‘আমি আর ডাক্তারবাবু একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরে এলাম, উনি নিজের কুঠিতে গিয়ে সেতার বাজাতে লাগলেন, আমি নিজের দাওয়ায় শুয়ে তাঁর বাজনা শুনলাম!’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল,—‘ও!—ভুজঙ্গধরবাবু সেতার বাজাচ্ছিলেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, মালকোষের আলাপ করছিলেন।’
‘কতক্ষণ আলাপ করেছিলেন?’
‘তা প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। চমৎকার হাত ওঁর।’
‘হুঁ। একটানা আলাপ করেছিলেন? একবারও থামেননি?’
‘আজ্ঞে না, একবারও থামেননি।’
‘পাঁচ মিনিটের জন্যেও নয়?’
‘আজ্ঞে না। সেতারের কান মোচ্ড়াবার জন্য দু’একবার থেমেছিলেন, তা সে পাঁচ-দশ সেকেন্ডের জন্য, তার বেশি নয়।
‘কিন্তু আপনি তাঁকে বাজাতে দেখেননি?’
‘দেখব কি করে? উনি অন্ধকারে বসে বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি ওঁর আলাপ চিনি, উনি ছাড়া আর কেউ নয়।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ বিমনা হইয়া রহিল, তারপর নিশ্বাস ফেলিয়া অন্য প্রসঙ্গ আরম্ভ করিল।—
‘আপনি কলোনীতে আসবার আগে থেকেই নিশানাথবাবুকে চিনতেন?’
আবার ব্রজদাসের মুখ শুকাইল। তিনি উস্খুস করিয়া বলিলেন,—‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘আপনি ওঁর সেরেস্তায় কাজ করতেন, উনি সাক্ষী দিয়ে আপনাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি চুরি করেছিলাম।’
‘বিজয় তখন নিশানাথবাবুর কাছে থাকত?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘দময়ন্তী দেবীর তখন বিয়ে হয়েছিল?’
ব্রজদাসের মুখ কাঁদো কাঁদো হইয়া উঠিল, তিনি ঘাড় হেঁট করিয়া রহিলেন। ব্যোমকেশ বলিল,—‘উত্তর দিচ্ছেন না যে? দময়ন্তী দেবীকে তখন থেকেই চেনেন তো?’
ব্রজদাস অস্পষ্টভাবে হ্যাঁ বলিলেন। ব্যোমকেশ বলিল,—‘তার মানে নিশানাথ আর দময়ন্তীর বিয়ে তার আগেই হয়েছিল—কেমন?’
ব্রজদাস এবার ব্যাকুল স্বরে বলিয়া উঠিলেন,—‘এই জন্যেই আমি পালিয়েছিলাম। আমি জানতাম আপনারা এই কথা তুলবেন। দোহাই ব্যোমকেশবাবু, আমাকে ও প্রশ্ন করবেন না। আমি সাত বছর ওঁদের অন্ন খেয়েছি। আমাকে নিমকহারামি করতে বলবেন না।’ বলিয়া তিনি কাতরভাবে হাত জোড় করিলেন।
ব্যোমকেশ সোজা হইয়া বসিল, তাহার চোখের দৃষ্টি বিস্ময়ে প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল,—‘এ সব কী ব্যাপার?’
ব্রজদাস ভগ্নস্বরে বলিলেন,—‘আমি জীবনে অনেক মিথ্যে কথা বলেছি, আর মিথ্যে কথা বলব না। জেল থেকে বেরিয়ে আমি বৈষ্ণব হয়েছি, কণ্ঠি নিয়েছি; কিন্তু শুধু কণ্ঠি নিলেই তো হয় না, প্রাণে ভক্তি কোথায়, প্রেম কোথায়? তাই প্রতিজ্ঞা করেছি জীবনে আর মিথ্যে কথা বলব না, তাতে যদি ঠাকুরের কৃপা হয়।—আপনারা আমায় দয়া করুন, ওঁদের কথা জিগ্যেস করবেন না। ওঁরা আমার মা বাপ।’
ব্যোমকেশ ধীরস্বরে বলিল,—‘আপনার কথা শুনে এইটুকু বুঝলাম যে আপনি মিথ্যে কথা বলেন না, কিন্তু নিশানাথ সম্বন্ধে সত্যি কথা বলতেও আপনার সঙ্কোচ হচ্ছে। মিথ্যে কথা না বলা খুবই প্রশংসার কথা, কিন্তু সত্যি কথা গোপন করায় কোনও পুণ্য নেই। ভেবে দেখুন, সত্যি কথা না জানলে আমরা নিশানাথবাবুর খুনের কিনারা করব কি করে? আপনি কি চান না যে নিশানাথবাবুর খুনের কিনারা হয়?’
ব্রজদাস নতমুখে রহিলেন। তারপর আমরা সকলে মিলিয়া নির্বন্ধ করিলে তিনি অসহায়ভাবে বলিলেন,—‘কি জানতে চান বলুন।’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘নিশানাথ ও দময়ন্তীর বিয়ের ব্যাপারে কিছু গোলমাল আছে। কী গোলমাল?’
‘ওঁদের বিয়ে হয়নি।’
বোকার মত সকলে চাহিয়া রহিলাম।
ব্যোমকেশ প্রথমে সামলাইয়া লইল। তারপর ধীরে ধীরে একটি একটি প্রশ্ন করিয়া ব্রজদাস বাবাজীর নিকট হইতে যে কাহিনী উদ্ধার করিল তাহা এই—
নিশানাথবাবু পুণায় জজ ছিলেন, ব্রজদাস ছিলেন তাঁর সেরেস্তার কেরানি। লাল সিং নামে একজন পাঞ্জাবী খুনের অপরাধে দায়রা-সোপর্দ হইয়া নিশানাথবাবুর আদালতে বিচারার্থ আসে। দময়ন্তী এই লাল সিং-এর স্ত্রী।
নিশানাথের কোর্টে যখন দায়রা মোকদ্দমা চলিতেছে তখন দময়ন্তী নিশানাথের বাংলোতে আসিয়া সকাল-সন্ধ্যা বসিয়া থাকিত, কান্নাকাটি করিত। নিশানাথ তাহাকে তাড়াইয়া দিতেন, সে আবার আসিত। বলিত, আমি অনাথা, আমার স্বামীর সাজা হইলে আমি কোথায় যাইব?
দময়ন্তীর বয়স তখন উনিশ-কুড়ি; অপরূপ সুন্দরী। বিজয়ের বয়স তখন তেরো-চৌদ্দ, সে দময়ন্তীর অতিশয় অনুগত হইয়া পড়িল। কাকার কাছে দময়ন্তীর জন্য দরবার করিত। নিশানাথ কিন্তু প্রশ্রয় দিতেন না। বিজয় যে দময়ন্তীকে চুপি চুপি খাইতে দিতেছে এবং রাত্রে বাংলোতে লুকাইয়া রাখিতেছে তাহা তিনি জানিতে পারিতেন না।
লাল সিং-এর ফাঁসির হুকুম হইয়া যাইবার পর নিশানাথ জানিতে পারিলেন। খুব খানিকটা বকাবকি করিলেন এবং দময়ন্তীকে অনাথ আশ্রমে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিলেন। দময়ন্তী কিন্তু তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল, বালক বিজয়ও চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল। নিরুপায় হইয়া নিশানাথ দময়ন্তীকে বাংলোয় থাকিতে দিলেন। বাড়ির চাকর-বাকরের কাছে ব্রজদাস এই সকল সংবাদ পাইয়াছিলেন।
হাইকোর্টের আপীলে লাল সিং-এর ফাঁসির হুকুম রদ হইয়া যাবজ্জীবন কারাবাস হইল। দময়ন্তী নিশানাথের আশ্রয়ে রহিয়া গেল। হাকিম-হুকুম মহলে এই লইয়া একটু কানাঘুষা হইল। কিন্তু নিশানাথের চরিত্র-খ্যাতি এতই মজবুত ছিল যে, প্রকাশ্যে কেহ তাঁহাকে অপবাদ দিতে সাহস করিল না।
ইহার দু’এক মাস পরে ব্রজদাসের চুরি ধরা পড়িল; নিশানাথ সাক্ষী দিয়া তাঁহাকে জেলে পাঠাইলেন। তারপর কয়েক বৎসর কী হইল ব্রজদাস তাহা জানেন না।
ব্রজদাস জেল হইতে বাহির হইয়া শুনিলেন নিশানাথ কর্ম হইতে অবসর লইয়াছেন, তিনি নিশানাথের সন্ধান লইতে লাগিলেন। জেলে থাকাকালে ব্রজদাসের মতিগতি পরিবর্তিত হইয়াছিল, তিনি বৈষ্ণব হইয়াছিলেন। সন্ধান করিতে করিতে তিনি গোলাপ কলোনীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
এখানে আসিয়া ব্রজদাস দেখিলেন নিশানাথ ও দময়ন্তী স্বামী-স্ত্রীরূপে বাস করিতেছেন। নিশানাথ তাঁহাকে কলোনীতে থাকিতে দিলেন, কিন্তু সাবধান করিয়া দিলেন, দময়ন্তীঘটিত কোনও কথা যেন প্রকাশ না পায়। দময়ন্তী ও বিজয় পূর্বে ব্রজদাসকে এক-আধবার দেখিয়াছিল, এতদিন পরে তাঁহাকে চিনিতে পারিল না। তদবধি ব্রজদাস কলোনীতে আছেন। নিশানাথ ও দময়ন্তীর মত মানুষ সংসারে দেখা যায় না। তাঁহারা যদি কোনও পাপ করিয়া থাকেন ভগবান তাহার বিচার করিবেন।
ব্যোমকেশ সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল,—‘ইন্সপেক্টর বরাট, চলুন একবার কলোনীতে যাওয়া যাক। অন্ধকার অনেকটা পরিষ্কার হয়ে আসছে।’
ব্রজদাস করুণ স্বরে বলিলেন,—‘আমার এখন কী হবে?’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘আপনিও কলোনীতে চলুন। যেমন ছিলেন তেমনি থাকবেন।’