ষোল
নিশানাথ যে-কক্ষে শয়ন করিতেন সেই কক্ষে টেবিল পাতা হইয়াছে। টেবিলের দুই পাশে দুইটি চেয়ারে ব্যোমকেশ ও বরাট, মাঝে একটি খালি চেয়ার। আমি দ্বারের কাছে টুল লইয়া বসিয়াছি, দুই ঘরের দিকেই আমার দৃষ্টি আছে। মাথার উপর উজ্জ্বল বিদ্যুৎবাতি জ্বলিতেছে।
প্রথমে দময়ন্তী দেবীকে ডাকা হইল। বিজয় তাঁহার হাত ধরিয়া ভিতরের ঘর হইতে লইয়া আসিল, তিনি শূন্য চেয়ারটিতে বসিলেন। বিধবার বেশ, দেহে অলঙ্কার নাই, মাথায় সিঁদুর নাই, সুন্দর মুখখানিতে মোমের মত ঈষদচ্ছ পাণ্ডুরতা। তিনি নতনেত্রে স্থির হইয়া রহিলেন।
বিজয় চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়া তাঁহার দুই কাঁধের উপর হাত রাখিল, বলিল,—‘আমি যদি এখানে থাকি আপনাদের আপত্তি হবে কি?’
ব্যোমকেশ একটু অনিচ্ছাভরে বলিল,—‘থাকুন।’ তারপর কোমলকণ্ঠে দময়ন্তী দেবীকে দুই-চারিটি সহানুভূতির কথা বলিয়া শেষে বলিল,—‘আমরা আপনাকে বেশি কষ্ট দেব না, শুধু দু’চারটে প্রশ্ন করব যার আপনি ছাড়া আর কেউ উত্তর দিতে পারবে না—আপনাদের বিয়ে হয়েছিল কতদিন আগে?’
দময়ন্তী দেবীর নত চক্ষু ব্যোমকেশের মুখ পর্যন্ত উঠিয়া আবার নামিয়া পড়িল। করুণ মিনতিভরা দৃষ্টি, তবু যেন তাহার মধ্যে একটা সংকল্প রহিয়াছে। অতি মৃদুস্বরে বলিলেন,—‘দশ বছর আগে।’
অতঃপর নিম্নরূপ সওয়াল জবাব হইল। দময়ন্তী দেবী আর দ্বিতীয়বার চক্ষু তুলিলেন না, নিম্নস্বরে সকল প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
ব্যোমকেশ : আপনাদের যখন বিয়ে হয় নিশানাথবাবু তখন চাকরিতে ছিলেন?
দময়ন্তী : না, তার পরে।
ব্যোমকেশ : কিন্তু কলোনী তৈরি হবার আগে?
দময়ন্তী : হ্যাঁ।
ব্যোমকেশ : তাহলে বিয়ের সময় নিশানাথবাবুর বয়স ছিল সাতচল্লিশ বছর?
দময়ন্তী : হ্যাঁ।
ব্যোমকেশ : মাফ করবেন, আপনার এখন বয়স কত?
দময়ন্তী : উনত্রিশ।
ব্যোমকেশ : বিজয়বাবু কবে থেকে আপনাদের কাছে আছেন?
বিজয় এই প্রশ্নের জবাব দিল, বলিল,—‘আমার দশ বছর বয়সে মা-বাবা মারা যান, সেই থেকে আমি কাকার কাছে আছি।’
ব্যোমকেশ : আপনার এখন বয়স কত?
বিজয় : পঁচিশ।
লক্ষ্য করিলাম বিজয়ের চোয়ালের হাড় কঠিন হইয়া উঠিয়াছে, তাহার হাত দটাও দময়ন্তী দেবীর কাঁধের উপর আড়ষ্টভাবে শক্ত হইয়া আছে। সে যেন ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে এবং প্রাণপণে চাপিবার চেষ্টা করিতেছে। ব্যোমকেশ নিশ্চয় তাহা লক্ষ্য করিয়াছিল কিন্তু সে নির্লিপ্তভাবে আবার প্রশ্ন করিল।
ব্যোমকেশ : বছর দুই আগে আপনি কলকাতার একটি মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। কি নাম স্কুলটির?
দময়ন্তী : সেন্ট মার্থা গার্লস্ স্কুল।
ব্যোমকেশ : হঠাৎ স্কুলে ভর্তি হবার কি কারণ?
দময়ন্তী : ইংরেজি শেখবার ইচ্ছে হয়েছিল।
ব্যোমকেশ : মাস আষ্টেক পরে ছেড়ে দিয়েছিলেন?
দময়ন্তী : হ্যাঁ, আর ভালো লাগল না।
বরাট এতক্ষণ খাতা পেন্সিল লইয়া মাঝে মাঝে নোট করিতেছিল। ব্যোমকেশ আবার আরম্ভ করিল—
ব্যোমকেশ : পরশু রাত্রে আপনি খাওয়া সেরে রান্নাঘর থেকে কখন ফিরে এসেছিলেন?
দময়ন্তী : প্রায় দশটা।
ব্যোমকেশ : নিশানাথবাবু তখন কোথায় ছিলেন?
দময়ন্তী : (একটু নীরব থাকিয়া) শুয়ে পড়েছিলেন।
ব্যোমকেশ : ঘর অন্ধকার ছিল?
দময়ন্তী : হ্যাঁ।
ব্যোমকেশ : জানালা খোলা ছিল?
দময়ন্তী : বোধহয় ছিল। লক্ষ্য করিনি।
ব্যোমকেশ : সদর দরজা তখন নিশ্চয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?
দময়ন্তী : (বিলম্বে) হ্যাঁ।
ব্যোমকেশ : আপনি বাড়িতে এলেন কি করে?
দময়ন্তী : পিছনের দরজা দিয়ে।
ব্যোমকেশ : সে-রাত্রে—তারপর আপনি কি করলেন?
দময়ন্তী : শুয়ে পড়লাম।
ব্যোমকেশ : নিশানাথবাবু তখন ঘুমোচ্ছিলেন? অর্থাৎ বেঁচে ছিলেন?
দময়ন্তী : (বিলম্বে) হ্যাঁ।
ব্যোমকেশ : আপনি তাঁর গায়ে হাত দিয়ে দেখেননি? কি করে বুঝলেন?
দময়ন্তী : নিশ্বাস পড়ছিল।
ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ বলিল,—‘সুনয়না নামের কোনও মেয়েকে আপনি চেনেন?’
দময়ন্তী : না।
ব্যোমকেশ : কিছুদিন থেকে আপনার বাড়িতে কেউ মোটরের টুকরো ফেলে দিয়ে যায়—এ বিষয়ে কিছু জানেন?
দময়ন্তী : যা সকলে জানে তাই জানি।
ব্যোমকেশ : আপনার জীবনে কোনও গুপ্তকথা আছে?
দময়ন্তী : না।
ব্যোমকেশ : নিশানাথবাবুর জীবনে কোনও গুপ্তকথা ছিল?
দময়ন্তী : জানি না।
ব্যোমকেশ একটু হাসিয়া বলিল,—‘উপস্থিত আর কোনও প্রশ্ন নেই। বিজয়বাবু, এবার ওঁকে নিয়ে যান।’
বিজয় সশব্দে একটি নিশ্বাস ফেলিল, তারপর দময়ন্তী দেবীর হাত ধরিয়া তুলিয়া পাশের ঘরে লইয়া গেল। দেখিলাম তাঁহার পা কাঁপিতেছে। তাঁহার বর্তমান মানসিক অবস্থায় তীক্ষ্ণ প্রশ্নের আঘাত না করিলেই বোধহয় ভাল হইত।
ইতিমধ্যে বসিবার ঘরে জনসমাগম হইতেছিল, আমি দ্বারের কাছে বসিয়া দেখিতেছিলাম। প্রথমে আসিল পানুগোপাল, ঘরের এক কোণে গিয়া যথাসম্ভব অদৃশ্য হইয়া বসিল। তারপর আসিলেন সকন্যা নেপালবাবু; তাঁহারা সামনের চেয়ারে বসিলেন; নেপালবাবুর পোড়া মুখের দিকটা আমার দিকে রহিয়াছে তাই তাঁহার মুখভাব দেখিতে পাইলাম না, কিন্তু মুকুলের মুখে শঙ্কিত উদ্বেগ। সে একবার এদিক ওদিক চাহিল, তারপর নিম্নকণ্ঠে পিতাকে কিছু বলিল।
সর্বশেষে আসিল বনলক্ষ্মী। তাহার মুখ শুষ্ক, যেন চুপসিয়া গিয়াছে; রান্নার কাজ সম্ভবত তাহাকেই চালাইতে হইতেছে। তাহাকে দেখিয়া মুকুল গভীর বিতৃষ্ণাভরে ভ্রূকুটি করিয়া মুখ ফিরাইয়া লইল। বনলক্ষ্মী একবার একটু দ্বিধা করিল, তারপর ধীরপদে খোলা জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল, গরাদের উপর হাত রাখিয়া বাহিরের অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিল।
এদিকে বিজয় ফিরিয়া আসিয়া দময়ন্তী দেবীর পরিত্যক্ত চেয়ারে বসিয়াছিল, চাদরে কপালের ঘাম মুছিয়া বলিল,—‘এবার আমার এজেহারও না হয় সেরে নিন।’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘বেশ তো। আপনাকে সামান্যই জিজ্ঞাসা করবার আছে।’
লক্ষ্য করিলাম, দময়ন্তী দেবীকে জেরা করার সময় বিজয় যতটা তটস্থ হইয়াছিল, তাহার তুলনায় এখন অনেকটা সুস্থ। কিন্তু ব্যোমকেশের প্রথম প্রশ্নেই সে থতমত খাইয়া গেল।
ব্যোমকেশ : কিছুদিন আগে নেপালবাবুর মেয়ে মুকুলের সঙ্গে আপনার বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল। আপনি প্রথমে রাজী ছিলেন। তারপর হঠাৎ মত বদলালেন কেন?
বিজয় : আমি—আমার—ওটা আমার ব্যক্তিগত কথা। ওর সঙ্গে কাকার মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক নেই।
ব্যোমকেশ তাহাকে একটি নাতিদীর্ঘ নেত্রপাতে অভিষিক্ত করিয়া অন্য প্রশ্ন করিল। বলিল,—‘পরশু বিকেলবেলা আপনি কলকাতা থেকে ফিরে এসে রাত্রে আবার কলকাতা গিয়েছিলেন কেন?’
বিজয় : আমার দরকার ছিল।
ব্যোমকেশ : কী দরকার বলতে চান না?
বিজয় : এটাও আমার ব্যক্তিগত কথা।
ব্যোমকেশ : বিজয়বাবু, আপনার ব্যক্তিগত কথা জানবার কৌতূহল আমার নেই। আপনার কাকার মৃত্যু সম্বন্ধে অনুসন্ধান করবার জন্যে আপনি আমাদের ডেকেছেন। এখন আপনিই যদি আমাদের কাছে কথা গোপন করেন তাহলে আমাদের অনুসন্ধান করে লাভ কি?
বিজয় : আমি বলছি এর সঙ্গে কাকার মৃত্যুর কোনও সম্বন্ধ নেই।
ব্যোমকেশ : সে বিচার আমাদের হাতে ছেড়ে দিলে ভাল হয় না?
দেখিলাম বিজয়ের মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব চলিতেছে। তারপর সে পরাভব স্বীকার করিল। অপ্রসন্ন স্বরে বলিল,—‘বেশ শুনুন। পরশু বিকেলে কলকাতা থেকে ফিরে এসে একটা চিঠি পেলাম। বেনামী চিঠি। তাতে লেখা ছিল—আপনি ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন। যদি বিপদে পড়তে না চান আজ রাত্রি দশটার সময় হগ্ সাহেবের বাজারে চায়ের দোকানে থাকবেন, একজনের সম্বন্ধে অনেক কথা জানতে পারবেন। —এই চিঠি পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যে চিঠি লিখেছিল সে এল না। এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফিরে এলাম।’
ব্যোমকেশ : চিঠি আপনার কাছে আছে?
বিজয় : না, ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।
ব্যোমকেশ : আপনি যে পরশু রাত্রে কলকাতায় গিয়েছিলেন তার কোনও সাক্ষী আছে?
বিজয় : না, সাক্ষী রেখে যাইনি, চুপি চুপি গিয়েছিলাম।
ব্যোমকেশ : স্টেশনে গেলেন কিসে—পায়ে হেঁটে?
বিজয় : না, কলোনীর একটা সাইকেল আছে, তাইতে।
ব্যোমকেশ : যাক। —আপনি ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন, তার মানে কি?
বিজয় : জানি না।
ব্যোমকেশ : বেনামী চিঠিতে ছিল, একজনের সম্বন্ধে অনেক কথা জানতে পারবেন। এই একজনটি কে? কারুর নাম ছিল না?
বিজয় : (ঢোক গিলিয়া) নাম ছিল না। একজনটি কে তা জানি না।
ব্যোমকেশ : তবে গেলেন কেন?
বিজয় : কে বেনামী চিঠি লিখেছে দেখবার জন্যে।
ব্যোমকেশ : ও। —কিছু মনে করবেন না, আপনি যে-দোকান দেখাশুনা করেন তার টাকার হিসেব কি গরমিল হয়েছে?
বিজয় : (একটু উদ্ধতভাবে) হ্যাঁ হয়েছে। আমার কাকার টাকা আমার টাকা। আমি নিয়েছি।
ব্যোমকেশ : কত টাকা?
বিজয় : হিসেব করে নিইনি। দু’তিন হাজার হবে।
ব্যোমকেশ : টাকা নিয়ে কি করলেন?
বিজয় : টাকা নিয়ে মানুষ কী করে? মনে করুন রেস্ খেলে উড়িয়েছি।
ব্যোমকেশ তির্যক হাসিল, বলিল,—‘রেস্ খেলে ওড়াননি। যা হোক, আর কিছু জানবার নেই—অজিত, বনলক্ষ্মীকে আসতে বল। আর যদি ভুজঙ্গধরবাবু এসে থাকেন তাঁকেও।’
ভুজঙ্গধরবাবু আসিয়াছেন কিনা দেখি নাই। আমি উঠিয়া বাহিরের ঘরে গেলাম। সকলে উচ্চকিত হইয়া চাহিল। দেখিলাম, ভুজঙ্গধরবাবু আসিয়াছেন, দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহার মুখের ভাব স্বপ্নালু, আমাকে দেখিয়া ফিক করিয়া হাসিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিলেন,—‘দন্তরুচি কৌমুদী!’
অবাক হইয়া বলিলাম,—‘সে আবার কি?’
ভুজঙ্গধরবাবুর স্বপ্নালুতা কাটিয়া গেল, তিনি বলিলেন,—‘ওটা মোহমুদগরের অ্যান্টিডোট। আমার ডাক পড়েছে? চলুন।’
‘আসুন’ বলিয়া আমি বনলক্ষ্মীর দিকে ফিরিয়াছি এমন সময় একটা ব্যাপার ঘটিল। বনলক্ষ্মী জানালার গরাদ ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, হঠাৎ চীৎকার করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। আমি ছুটিয়া গেলাম, পাশের ঘর হইতে ব্যোমকেশ, বরাট ও বিজয় বাহির হইয়া আসিল।
বনলক্ষ্মীর কপালের ডানদিকে কাটিয়া গিয়া রক্ত পড়িতেছে। ব্যোমকেশ তাহাকে তুলিতে গিয়া ঘাড় তুলিয়া চাহিল।
‘ডাক্তার, আপনি আসুন। মূর্ছা গিয়েছে।’
ভুজঙ্গধরবাবু আসিয়া পরীক্ষা করিলেন। তাঁহার মুখে বিরক্তি ফুটিয়া উঠিল। বলিলেন,—‘সামান্য জখম, মূর্ছা যাবার মত নয়।’
‘কিন্তু জখম হল কি করে?’
‘তা কি করে জানব? বোধহয় জানালার বাইরে থেকে কেউ ইট পাটকেল ছুঁড়েছিল, তাই লেগেছে।’
বরাট পকেট হইতে টর্চ লইয়া দ্রুত বাহির হইয়া গেল। ব্যোমকেশ ভুজঙ্গধরবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল,—‘এখন একে নিয়ে কি করা যায়?’
ভুজঙ্গধরবাবু একটা মুখভঙ্গী করিলেন, তারপর বনলক্ষ্মীকে দুই বাহুর দ্বারা তুলিয়া লইয়া বলিলেন,—‘আমি ওকে ওর কুঠিতে নিয়ে যাচ্ছি, বিছানায় শুইয়ে মুখে জলের ঝাপ্টা দিলেই জ্ঞান হবে। যেখানটা কেটে গেছে সেখানে টিঞ্চার আয়োডিন দিয়ে বেঁধে দিলেই চলবে। আপনারা কাজ চালান, আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’
বিজয় এতক্ষণ যেন মোহাচ্ছন্ন হইয়া ছিল, বলিল—‘চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে যাই।’
‘আসুন’ বলিয়া ভুজঙ্গধরবাবু বনলক্ষ্মীকে লইয়া অগ্রসর হইলেন। দ্বার দিয়া বাহির হইতে হইতে তিনি বিজয়কে বলিতেছেন শুনিতে পাইলাম—‘আপনি বরং এক কাজ করুন, আমার কুঠি থেকে টিঞ্চার আয়োডিনের শিশি আর ব্যাণ্ডেজ নিয়ে আসুন—’
ব্যোমকেশ আর পাশের ঘরে ফিরিয়া না গিয়া এই ঘরেই বসিল, বলিল,—‘কি বিপত্তি! অজিত, তুমি তো উপস্থিত ছিলে, কি হয়েছিল বল দেখি?’
যাহা যাহা ঘটিয়াছিল বলিলাম, দন্তরুচি কৌমুদীও বাদ দিলাম না। শুনিয়া ব্যোমকেশ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া রহিল।
বরাট ফিরিয়া আসিয়া বলিল,—‘কাউকে দেখতে পেলাম না। জানালার বাইরে মানুষের পায়ের দাগ রয়েছে কিন্তু কাঁচা দাগ বলে মনে হল না। ইট পাটকেল অবশ্য অনেক পড়ে রয়েছে।’
যেখানে বনলক্ষ্মী অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিল সেখানে একটা বাঁকা কালো জিনিস আলোয় চিকমিক করিতেছিল। ব্যোমকেশ উঠিয়া গিয়া সেটা তুলিয়া লইল, আলোয় ধরিয়া বলিল,—‘ভাঙা কাচের চুড়ি। বোধহয় বনলক্ষ্মী পড়ে যাবার সময় চুড়ি ভেঙেছে।’
চুড়ির টুকরো বরাটকে দিয়া ব্যোমকেশ আবার আসিয়া বসিল, নেপালবাবুকে লক্ষ্য করিয়া বলিল,—‘আপনারা বোধহয় জানেন, পুলিসের সন্দেহ নিশানাথবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তাই একটু খোঁজ খবর নিতে হচ্ছে। —নেপালবাবু, যে-রাত্রে নিশানাথবাবু মারা যান সে-রাত্রে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?’
সোজাসুজি প্রশ্ন, প্রশ্নের অন্তর্নিহিত সন্দেহটিও খুব অস্পষ্ট নয়। নেপালবাবুর গলার শির উঁচু হইয়া উঠিল, কিন্তু তিনি বরাটের দিকে বক্র দৃষ্টিপাত করিয়া কষ্ট-সংযত কণ্ঠে বলিলেন,—‘দাবা খেলছিলাম।’
এই সময় ঘরের কোণে পানুগোপালের উপর চোখ পড়িল। সে কানের তুলা খুলিয়া ফেলিয়া ঘাড় বাঁকাইয়া একাগ্রভাবে শুনিবার চেষ্টা করিতেছে।
ব্যোমকেশ : দাবা খেলছিলেন? কার সঙ্গে?
নেপাল : মুকুলের সঙ্গে।
ব্যোমকেশ : উনি দাবা খেলতে জানেন?
নেপাল : জানে কিনা একবার খেলে দেখুন না!
ব্যোমকেশ : না না, তার দরকার নেই। তা আপনারা যখন খেলছিলেন, সেখানে কেউ উপস্থিত ছিল?
নেপাল : কেউ না। নিশানাথ যে সেই সময় মারা যাবে তা জানতাম না, জানলে সাক্ষী যোগাড় করে রাখতাম।
ব্যোমকেশ : সে-রাত্রে আপনারা এদিকে আসেননি?
নেপাল : এদিকে আসব কি জন্যে? গরমে রাত্রে ঘুম আসে না তাই দাবা খেলছিলাম।
ব্যোমকেশ : তাহলে—সে রাত্রে এ বাড়িতে কেউ এসেছিল কিনা তা আপনারা বলতে পারেন না?
নেপাল : না।
এই সময় ঘরের কোণে পানুগোপাল হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ লাল হইয়া উঠিয়াছে, চোখ দুটা জ্বলজ্বল করিতেছে। সে প্রাণপণে একটা কিছু বলিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু মুখ দিয়া শব্দ বাহির হইল না। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,—‘আপনি কি কিছু বলবেন?’ পানু সবেগে ঘাড় নাড়িয়া আবার কথা বলিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু এবারও কৃতকার্য হইল না।
নেপালবাবু মুখ বিকৃত করিয়া বলিলেন,—‘যত সব হাবা কালার কাণ্ড।’
দ্বারের কাছে একটা শব্দ শুনিয়া ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম ভুজঙ্গধরবাবু ফিরিয়া আসিয়াছেন এবং তীক্ষ্ণচক্ষে পানুগোপালকে দেখিতেছেন। তিনি অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিলেন,—‘পানু বোধহয় কিছু বলবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ও এখন উত্তেজিত হয়েছে, কিছু বলতে পারবে না। পরে ঠাণ্ডা হলে হয়তো—’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,—‘ওদিকের খবর কি?’
‘বনলক্ষ্মীর জ্ঞান হয়েছে। কপাল ড্রেস করে দিয়েছি।’
‘বিজয়বাবু কোথায়?’
‘তিনি বনলক্ষ্মীর কাছে আছেন।’ ভুজঙ্গধরবাবুর অধরপ্রান্ত একটু প্রসারিত হইল।
নেপালবাবু উঠিয়া দাঁড়াইলেন, কর্কশস্বরে বলিলেন,—‘আপনাদের জেরা আশা করি শেষ হয়েছে। আমরা এবার যেতে পারি?’
ব্যোমকেশ : একটু দাঁড়ান। (মুকুলকে) আপনি কখনও সিনেমায় অভিনয় করেছেন?
মুকুলের মুখ শুকাইয়া গেল, সে ত্রস্ত-চোখে চারিদিকে চাহিয়া স্খলিতস্বরে বলিল,—‘আমি—না, আমি কখনও সিনেমায় অভিনয় করিনি।’
নেপালবাবু গর্জন করিয়া উঠিলেন,—‘মিথ্যে কথা! কে বলে আমার মেয়ে সিনেমা করে! যত সব মিথ্যুক ছোটলোকের দল।’
ব্যোমকেশ শান্তস্বরে বলিল,—‘আপনার মেয়েকে সিনেমা স্টুডিওতে যাতায়াত করতে দেখেছে এমন সাক্ষীর অভাব নেই।’
নেপাল আবার গর্জন ছাড়িতে উদ্যত হইয়াছিলেন, মুকুল পিতাকে থামাইয়া দিয়া বলিল,—‘সিনেমা স্টুডিওতে আমি কয়েকবার গিয়েছি সত্যি, কিন্তু অভিনয় করিনি। চল বাবা।’ বলিয়া মুকুল ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। নেপালবাবু বাঘের মত এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে তাহার পশ্চাদ্বর্তী হইলেন।
ব্যোমকেশ বলিল,—‘রমেনবাবু ঠিকই ধরেছিলেন। যাক, ভুজঙ্গধরবাবু, আপনাকেও একটি মাত্র প্রশ্ন করব। সে-রাত্রে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?’
ভুজঙ্গধরবাবু একপেশে হাসি হাসিয়া বলিলেন,—‘সে-রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর আমি নিজের ঘরে আলো নিভিয়ে বসে অনেকক্ষণ সেতার বাজিয়েছিলাম। সাক্ষী সাবুদ আছে কিনা জানি না।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ নীরবে নতমুখে বসিয়া রহিল, তারপর উঠিয়া বরাটকে বলিল,—‘চলুন, বনলক্ষ্মীকে দেখে আসি।’