তেরো
এগারোটার সময় পুলিস ভ্যান আসিল। তাহাতে কয়েকজন কনস্টেবল ও স্থানীয় থানার দারোগা প্রমোদ বরাট।
প্রমোদ বরাটের বয়স বেশি নয়। কালো রঙ, কাটালো মুখ, শালপ্রাংশু দেহ। পুলিসের ছাঁচে পড়িয়াও তাহার মনটা এখনও শক্ত হইয়া ওঠে নাই; মুখে একটু ছেলেমানুষী ভাব এখনও লাগিয়া আছে। করজোড়ে ব্যোমকেশকে নমস্কার করিয়া তদ্গত মুখে বলিল,—‘আপনিই ব্যোমকেশবাবু?’
বুঝিলাম পুলিসের লোক হইলেও সে ব্যোমকেশের ভক্ত। ব্যোমকেশ হাসিমুখে তাহাকে একটু তফাতে লইয়া গিয়া নিশানাথবাবুর মৃত্যুর সন্দেহজনক হাল বয়ান করিল। প্রমোদ বরাট একাগ্রমনে শুনিল। তারপর ব্যোমকেশ তাহাকে লইয়া মৃতের কক্ষে প্রবেশ করিল। বিজয় ও আমি সঙ্গে গেলাম।
ঘরে প্রবেশ করিয়া বরাট দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া পড়িল এবং চারিদিকে চক্ষু ফিরাইয়া দেখিতে লাগিল। এই সময় মেঝের উপর একটা লঘু গোলক বাতাসে গড়াইতে গড়াইতে যাইতেছে দেখিয়া বরাট নত হইয়া সেটা কুড়াইয়া লইল। খড়, শুকনা ঘাস, শণের সুতো মিশ্রিত একটি গুচ্ছ। বরাট বলিল,—‘এটা কি? কোত্থেকে এল?’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘চড়াই পাখির বাসা। ঐ দেখুন, ওখান থেকে খসে পড়েছে।’ বলিয়া ঊর্ধ্বে পাখা ঝুলাইবার আংটার দিকে দেখাইল। দেখা গেল চড়াই পাখিরা নির্বিকার, শূন্য আংটায় আবার বাসা বাঁধিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে।
খড়ের গোলাটা ফেলিয়া দিয়া বরাট মৃতদেহের কাছে গিয়া দাঁড়াইল এবং চাদর সরাইয়া মৃতদেহের উপর চোখ বুলাইল। ব্যোমকেশ বলিল,—‘পায়ে মোজা দেখছেন? ঐটেই সন্দেহের মূল কারণ। আমি মৃতদেহ ছুঁইনি, পুলিসের আগে মৃতদেহ স্পর্শ করা অনুচিত হত। কিন্তু মোজার তলায় কী আছে, পায়ে কোনও চিহ্ন আছে কি না জানা দরকার।’
‘বেশ তো, এখনই দেখা যেতে পারে’ বলিয়া বরাট মোজা খুলিয়া লইল। ব্যোমকেশ ঝুঁকিয়া পায়ের গোছ পর্যবেক্ষণ করিল। আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায় না, কিন্তু ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলে দেখা যায় পায়ের গোছের কাছে অল্প দাগ রহিয়াছে; মোজার উপর ইল্যাস্টিক গার্টার পরিলে যে-রকম দাগ হয় সেই রকম।
দাগ দেখিয়া ব্যোমকেশের চোখ জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়াছিল; সে বরাটকে বলিল,—‘দেখলেন?’
বরাট বলিল,—‘হ্যাঁ। বাঁধনের দাগ মনে হয়। কিন্তু এ থেকে কী অনুমান করা যেতে পারে?’
ব্যোমকেশ বলিল,—‘অন্তত এটুকু অনুমান করা যেতে পারে যে, নিশানাথবাবু মৃত্যুর পূর্বে নিজে মোজা পরেননি, আর কেউ পরিয়েছে।’
বরাট বলিল,—‘কিন্তু কেন? এর থেকে কি মনে হয়? আপনি বুঝতে পেরেছেন?’
‘বোধহয় পেরেছি। কিন্তু যতক্ষণ শব পরীক্ষা না হচ্ছে ততক্ষণ কিছু না বলাই ভাল। আপনি মৃতদেহ নিয়ে যান। ডাক্তারকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করতে বলবেন গায়ে কোথাও হাইপোডারমিক সিরিঞ্জের চিহ্ন আছে কি না।’
‘বেশ।’
আমরা আবার বাহিরের ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। বরাট কনস্টেবলদের ডাকিয়া মৃতদেহ ভ্যানে তুলিবার হুকুম দিল। বিজয় এতক্ষণ কোনও মতে নিজেকে শক্ত করিয়া রাখিয়াছিল, এখন মুখে হাত চাপা দিয়া কাঁদিতে লাগিল।
ব্যোমকেশ কোমল স্বরে বলিল,—‘আপনার আজ আর সঙ্গে গিয়ে কাজ নেই, আমরা যাচ্ছি। আপনি বরং কাল সকালে যাবেন। —কি বলেন, ইন্সপেক্টর বরাট?
বরাট বলিল,—‘সেই ভাল। কাল সকালের আগে রিপোর্ট পাওয়া যাবে না। আমি কাল সকালে ওঁকে নিয়ে আপনার বাসায় যাব।’
‘বেশ। চলুন তাহলে। আপনার ভ্যানে আমাদের জায়গা হবে তো?’
‘হবে। আসুন।’
ব্যোমকেশ বিজয়ের পিঠে হাত রাখিয়া মৃদুস্বরে আশ্বাস দিল, তারপর আমরা দ্বারের দিকে পা বাড়াইলাম। এই সময় ভিতরের দরজার সম্মুখে বনলক্ষ্মী আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ শুষ্ক শ্রীহীন, পরনের ময়লা শাড়ির আঁচলে কালি ও হলুদের ছোপ। আমাদের সহিত চোখাচোখি হইতে সে বলিল,—‘রান্না হয়েছে। আপনারা খেয়ে যাবেন না?’
ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল,—‘রান্না! কে রাঁধলে?’
বনলক্ষ্মী চোখ নামাইয়া সঙ্কুচিত স্বরে বলিল,—‘আমি।’
তাহার আঁচলে কালি ও হলুদের দাগ, অনভ্যস্ত রন্ধনক্রিয়ার চিহ্ন। যাক, তবু কলোনীর একজন মাথা ঠাণ্ডা রাখিয়াছে, যত মর্মান্তিক ঘটনাই ঘটুক এতগুলো লোকের আহার চাই তাহা সে ভোলে নাই। দেখিলাম, বিজয় মুখ তুলিয়া একদৃষ্টে বনলক্ষ্মীর পানে চাহিয়া আছে, যেন তাহাকে এই নূতন দেখিল।
ব্যোমকেশ বলিল,—‘আমরা এখন ফিরে যাচ্ছি। খাওয়া থাক। এমনিতেই আপনাদের কষ্টের শেষ নেই, আমরা আর হাঙ্গামা বাড়াব না। আপনি বরং এঁদের ব্যবস্থা করুন।’ বলিয়া বিজয়ের দিকে ইঙ্গিত করিল।
বনলক্ষ্মী বিজয়ের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, ভারী গলায় বলিল,—‘চলুন, স্নান করে নেবেন।’
আমরা বাহির হইলাম।
পুলিস ভ্যান একটি শবদেহ ও কয়েকটি জীবন্ত মানুষ লইয়া কলিকাতার অভিমুখে চলিল।
পথে বেশি কথা হইল না। এক সময় ব্যোমকেশ বলিল,—‘রসিক দে নামে একটি লোক কলোনীতে থাকত, কাল থেকে সে নিরুদ্দেশ। খুব সম্ভব দোকানের টাকা চুরি করেছে। তার খোঁজ নেবেন। তার হাতের আঙুল কাটা। খুঁজে বার করা কঠিন হবে না।’
বরাট নোটবুকে লিখিয়া লইল।
ঘণ্টাখানেক পরে বাসার সম্মুখে আমাদের নামাইয়া দিয়া পুলিস ভ্যান চলিয়া গেল।
সমস্ত দিন মনটা বিভ্রান্ত হইয়া রহিল। নিশানাথবাবুর ছায়ামূর্তি মনের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।
বিকালবেলা তিনটার সময় দেখিলাম ব্যোমকেশ ছাতা লইয়া বাহির হইতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘কোথায়?’
সে বলিল,—‘একটু খোঁজ-খবর নিতে বেরুচ্ছি।’
‘কার খোঁজ-খবর?’
‘কারুর ওপর আমার পক্ষপাত নেই, কলোনীর অধিবাসীদের যার খবর পাব যোগাড় করব। আপাতত দেখি ডাক্তার ভুজঙ্গধর আর লাল সিং সম্বন্ধে কিছু সংগ্রহ করতে পারি কিনা।’
‘লাল সিংকে ভোলোনি?’
‘কাউকে ভুলিনি।’ বলিয়া ব্যোমকেশ নিষ্ক্রান্ত হইল।
সে বাহির হইবার আধ ঘন্টা পরে টেলিফোন আসিল। বিজয় কলোনী হইতে টেলিফোন করিতেছে। ওদিকের খবর ভালই, দময়ন্তী দেবী এখনও জাগেন নাই। অন্য খবরের মধ্যে ব্রজদাস গোঁসাইকে পাওয়া যাইতেছে না, দ্বিপ্রহরে আহারের পূর্বেই তিনি অন্তর্ধান করিয়াছেন।
অভিনব সংবাদ। প্রথম রসিক দে, তারপর বৈষ্ণব বাবাজী! ইনিও কি কলোনীর টাকা হাত সাফাই করিতেছিলেন?
ব্যোমকেশ ফিরিলে সংবাদ দিব বলিয়া টেলিফোন ছাড়িয়া দিলাম।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি নামিল। যেন অনেকদিন একজ্বরী ভোগ করিবার পর ঘাম দিয়া জ্বর ছাড়িল। ব্যোমকেশ রৌদ্রের জন্য ছাতা লইয়া বাহির হইয়াছে, বৃষ্টিতেও ছাতা কাজে আসিবে।
রাত্রি সাড়ে আটটার সময় ব্যোমকেশ ফিরিল। জামা ভিজিয়া গোবর হইয়াছে, ছাতাটার অবস্থা ঝোড়ো কাকের মত; সেই অবস্থায় চেয়ারে বসিয়া পরম তৃপ্তির একটি নিশ্বাস ফেলিল। তারপর গলা চড়াইয়া হাঁকিল,—‘পুঁটিরাম, চা নিয়ে এস।’
তাহাকে বিজয়ের বার্তা শুনাইলাম। সে কিছুক্ষণ অন্যমনে রহিল, শেষে বলিল,—‘একে একে নিভিছে দেউটি। এইভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত মুস্কিল মিঞা ছাড়া আর কেউ থাকবে না। কিন্তু বাবাজী এত দেরিতে পালালেন কেন? পোস্ট-মর্টেমের নাম শুনে ঘাবড়ে গেছেন?’
জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘তারপর তোমার কি হল? ভুজঙ্গধরবাবুর খবর পেলে?’
‘নতুন খবর বড় কিছু নেই। তিনি যা যা বলেছিলেন সবই সত্যি। চীনেপটিতে তাঁর ডিসপেন্সারি আর নার্সিং হোম ছিল। অনেক রোজগার করতেন! তারপরই দুর্মতি হল।’
‘আর লাল সিং?’
ব্যোমকেশ ভিজা জামা খুলিয়া মাটিতে ফেলিল,—‘লাল সিং বছর দুই আগে জেলে মারা গেছে। তার স্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু চিঠি ফিরে এসেছে। স্ত্রীর পাত্তা কেউ জানে না।’
বাহিরে বৃষ্টি চলিতেছে; চারিদিক ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে। পুঁটিরাম চা আনিয়া দিল। ব্যোমকেশ চায়ে একটি ক্ষুদ্র চুমুক দিয়া বলিল,—‘এই বৃষ্টিটা যদি কাল রাত্তিরে হত তাহলে নিশানাথবাবুর মোজা পরার একটা মানে পাওয়া যেত, মনে হত উনি নিজেই মোজা পরেছেন। অন্তত সম্ভাবনাটা বাদ দেওয়া যেত না। ভাগ্যিস কাল বৃষ্টি হয়নি!’