চার অধ্যায়


বাল্যকাল এখন বিশ্রাম করে কার করতলে
পক্ষী শাবকের মতো? নাড়ী-ছেঁড়া তাজা কান্না, দোলনা অথবা
ঘুম পাড়ানিয়া গান, স্তন্যপান, টবে গোসলের
স্মৃতি নেই; সহজ পাঠের রাঙা পথ,
গণিতের কাঁকর ছড়ানো পথ, ছড়ার মায়াবী ঘাট, কিছু
টক ফল, বৃষ্টির বিকেলে খোলা মাঠে
ছোটাছুটি, জ্বরোভাব নিয়ে দেখা চিলের চক্কর,
হাজ্জামের চকচকে খুরস্পৃষ্ট শিশ্ন থেকে রক্ত ঝরা হলুদ কাপড়ে-
মনে পড়ে বেলা অবেলায়।
মেলায় হারিয়ে-যাওয়া বালকের মতো গোধূলিতে
আমার বিহবল চোখে অশ্রুজল, জিভে লোনা স্বাদ, কতিপয়
অচেনা জিজ্ঞাসু লোক দাঁড়ানো আমাকে ঘিরে আর
ক্ষুৎপিপাসায় নিত্যসঙ্গী পরম নির্ভরশীল মরমিয়া একটি গর্দভ।


আজ নয়, রৌদ্রময় দুপুরপ্রতিম দূর যুবা
বয়সে সুগন্ধি ঘুমে স্বপ্নের নগরে হেঁটে হেঁটে,
সরোবরে ডুব দিয়ে, চুমো খেয়ে পাষাণ পুরীর
কোনও বিলাসিনী কিংবা অরণ্যবাসিনী যুবতীকে
জেগে উঠে দেখি, স্বপ্নচ্যুত শরীর জ্বলছে দাউ
দাউ-এই অগ্নি কোনও দেবদূত নাকি ইবলিস
দিয়েছে ছড়িয়ে শিরা উপশিরা জুড়ে? প্রশ্ন আজও
প্রশ্ন রয়ে গেছে ধু ধু, অপরূপ সাগ্নিক প্রহর
আমাকে প্রতিভাবান বানায় এবং পায়ে পায়ে
কে যেন নিঃশব্দে ঘোরে খাদ্যন্বেষী কুকুরের মতো।
নিয়ত অর্চনা করি রঙিন কুয়াশামোড়া কাকে?
ভয়ে ভয়ে থাকি, যদি নিভে যায় স্বপ্নাদ্য আগুন।


এখনও কল্পনা করি, সে ভালই আছে; থাক। কেন থাকবে না?
‘না, সে ভাল নেই,’ ব’লে যায়
দুপুরের রোদপোড়া পাখি। পাখি আমার কল্পনা
ডানায় জড়িয়ে নিয়ে মেঘ পাড়ি দেয়
জগৎ সংসার
বিষয়ে নিঃস্পৃহ, উদাসীন। দোতলার ঘর থেকে তার মুখ
ভেসে ভেসে চলে আসে আমার নিবাসে,
বলে ঠোঁট নেড়ে,
‘কেন বৃথা আমাকে তোমার কল্পনার
চোর-কুঠুরিতে বন্দী ক’রে
‘রেখে দিতে চাও? শোনো, আমাকে আমার
হালে ছেড়ে দাও; সন্তদের বুক-ছেঁড়া গান আসমান ফুঁড়ে
জল হ’য়ে ঝরে খরাক্লিষ্ট দীর্ণ মাঠে। তার মুখ
সিনেমার অন্তিম দৃশ্যের মতো শূন্যতায় মেশে।


তুমিতো আসো না, তবু তোমাকেই মন্ত্র জ’পে জ’পে
ডেকে আনি খাতার পাতায়;
আমার ধূসরতায় আমি আছি, তোমাকে সাজাই
নানা রঙে সারা বেলা, বস্তুত পাঠিয়ে দিই সুখের দিঘিতে,
সেখানে সাঁতার কাটো, জল ঝরে চুল,
বাহু, গ্রীবা, স্তনচূড়া থেকে অবিরল,
হঠাৎ কোত্থেকে এসে কেড়ে নাও খাতা, বাক্যময় সে কাগজ
কুটি কুটি ছিঁড়ে ফেলো। তোমার চুলের
ঝাপটে বিমূঢ় আমি সুরদাস হই। তবু প্রস্তরিত চোখ
তোমার ভেতরকার অদৃশ্যকে দেখে নিতে চায়।
১০।১০।৯১