উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

চার। দিগবিজয়ের পথে

চার । দিগবিজয়ের পথে

সৈন্যদলকে সম্বোধন করে নেপোলিয়ন প্রথমেই উদ্দীপনা পূর্ণ ভাষায় এই বক্তৃতা দিলেন :

‘সৈন্যগণ,

অর্ধনগ্ন হয়ে তোমরা অর্ধাহার আছ। গভর্মেন্ট তোমাদের অনেক দোষ দিচ্ছেন, কিন্তু তোমাদের জন্যে কিছু করতে অক্ষম। ধৈর্য ও সাহস তোমাদের মান বাড়িয়েছে বটে, কিন্তু দিতে পারছে না তোমাদের কোনও পুরস্কার, কোনও গৌরব। আমি তোমাদের নিয়ে যাব পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুজল সুফল শস্যশ্যামল ক্ষেত্রে। সেখানে গেলে দেখতে পাবে তোমরা শ্রীসম্পন্ন নগরের পর নগর, জনবহুল ও ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ প্রদেশের পর প্রদেশ। সেখানে গেলে তোমরা লাভ করবে মান, যশ এবং ঐশ্বর্য। ইতালি যাত্রী সৈন্যগণ, তোমাদের কি সাহস ও দৃঢ়তার অভাব হবে?’

কোনও সেনাপতির মুখে সৈন্যরা এ-রকম আশ্চর্য ভাষা শোনেনি। তারা উৎসাহিত হয়ে তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিলে।

কিন্তু আসলে উৎসাহিত হওয়ার বিশেষ কিছুই ছিল না। শত্রুদের সৈন্যসংখ্যা ষাট হাজার, ফরাসিদের সংখ্যা মাত্র আটত্রিশ হাজার। নেপোলিয়নের সঙ্গতির মধ্যে চব্বিশটি শৈল-কামান, চার হাজার অল্প-ভোজনে কৃশ ঘোড়া, তিন লক্ষ রৌপ্যমুদ্রা এবং সৈন্যদের জন্যে পনেরো দিনের পূর্ণাহার! এই নিয়ে তিনি চলেছেন মহাশক্তিমান অস্ট্রিয়ার সম্রাট ও সার্দিনিয়ার রাজাকে হারিয়ে ইতালি দখল করতে। ফ্রান্সের শাসন-সভার ডিরেক্টররা তাঁকে অসাধ্য সাধন করতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তিনি দমলেন না, অসাধ্যসাধন করাই প্রতিভার ধর্ম।

আজ আমরা ইতালির যে রূপ দেখছি তখন তার কিছুই ছিল না। সমগ্র ইতালি তখন খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত ছিল; তার কোনও দেশ পোপের দখলে, কোনও দেশে প্রভুত্ব করেন সার্দিনিয়ার রাজা, কোনও দেশ ছিল অস্ট্রিয়ার অধীন এবং কোনও দেশ বুর্বন বা ফ্রান্সের সিংহাসনচ্যুত রাজার আত্মীয়রা শাসন করেন। ইংরেজ নৌ-বীর নেলসন তাই বলেছিলেন : ‘ইতালি হচ্ছে সোনার খনি। একবার এদেশে ঢুকতে পারলে কেউ বাধা দিতে পারবে না।’ নেলসন এই সোনার খনিতে ছোঁ মারবার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু ফরাসিদের কাছে হেরে পালিয়ে যান।

নেপোলিয়ন দ্রুতগতিতে ইতালির উপরে গিয়ে পড়লেন। আত্মশক্তির উপরে তাঁর অটল বিশ্বাস। তিনি জানতেন কেউ তাঁকে হারাতে পারবে না—প্রবল যৌবন ও অটুট স্বাস্থ্য তাঁর সহায়। দিন-রাত ঘোড়ায় চড়ে থেকেও তাঁর শ্রান্তি আসে না। যে-কোনও মুহূর্তে তিনি পারেন ঘুমোতে ও জাগতে (বড় বড় রণক্ষেত্রে যখন বিষম লড়াই চলছে, শ্রান্ত নেপোলিয়ন তারই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে পারতেন)! এবং যে-কোনও তুচ্ছ খাবারও তাঁর পক্ষে যথেষ্ট। তাঁর তীক্ষ্ণদৃষ্টি কোনও-কিছুই দেখতে ভোলে না। ফৌজের সর্বত্রই তিনি সশরীরে আবির্ভূত হন।

 নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যে সব সেনাপতি দাঁড়ালেন, তাঁর সঙ্গে তাঁদের তুলনাই হয় না। অস্ট্রিয়ার রাজবংশীয় আর্কডিউক চার্লস—অভিজ্ঞতায় ও সহ্যক্ষমতায় কেমন করে তিনি নেপোলিয়নের উপরে যাবেন? বিউলিউ—সত্তর বছর তাঁর বয়স। জেনারেল কোল্যি—বাতে পঙ্গু, কেউ তাঁকে বহন করে নিয়ে না গেলে তিনি চলতেই পারেন না! আলভিনটজি ও সার্দিনিয়ার রাজাও বুড়ো। জেনারেল উর্মজারও তাই, তার উপরে কালাও দীর্ঘসূত্রী।

নেপোলিয়ন যখন প্রধান হয়ে এলেন, ফৌজের মধ্যে তখন মেসেনা, অগেরু, লাহার্প, সেরুরিয়ার ও বার্দিয়ার প্রভৃতি প্রবীণ ও বিখ্যাত সেনাপতি ছিলেন। তাঁরা এই অতি-খুদে, ছোকরা ও রণক্ষেত্রে নবাগত কর্তাটিকে ভালো চোখে দেখলেন না, কারণ তাঁরা নেপোলিয়নের চেয়ে অনেক বড় বড় যুদ্ধ জয় করেছেন।

নেপোলিয়ন তাঁদের পরামর্শ সভায় আহ্বান করলেন। তারপর তাঁদের কাছে প্রকাশ করলেন, কোন কৌশলে তিনি শত্রুদের আক্রমণ করতে চান।

নবীন সেনাপতির ‘প্ল্যান’ অপূর্ব! রণপ্রবীণ সেনানীরা বিস্ময়চকিত। পরামর্শ-সভা থেকে বেরিয়ে অগেরুকে ডেকে মেসেনা বললেন, ‘এতদিন পরে আমাদের গুরুর দেখা পেলুম!’

মিত্রপক্ষের প্রাচীন সেনাপতি বিউলিউ সার্দিনিয়ার রাজাকে বললেন, ‘এই আমি যুদ্ধে চললুম। ফরাসিদের এইবার দেখে নেব। রাজা, আমি প্রতিজ্ঞা করছি, শত্রুদের একেবারে ফ্রান্স পর্যন্ত তাড়িয়ে না গিয়ে আমি পায়ের জুতো খুলব না!’

ষাট হাজার শত্রুর বিরুদ্ধে আটত্রিশ হাজার ফরাসি সৈন্য!

তবু নেপোলিয়ন বললেন, ‘শত্রুদের আগে আক্রমণ করব আমিই!’

তাঁর মূলমন্ত্র : সময় ও দ্রুতগতিই হচ্ছে সব!

শত্রুদের সব দল এক জায়গায় এসে মিলেমিশে বলবান ও সাবধান হওয়ার আগেই একে একে তাদের আক্রমণ ও পরাস্ত করো!

তিন জায়গায় তিনজন শত্রু-সেনাপতি ফৌজ নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন।

নেপোলিয়ন তাদের একজায়গায় মিলতে দিলেন না। প্রথমে ঝড়ের বেগে আল্পস পর্বত প্রদক্ষিণ করে মন্টিনোট নামক স্থানে গিয়ে মধ্যবর্তী শত্রু-ফৌজের উপরে পড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। তারপরেই তিনি টিউরিন নগরে সার্দিনিয়ার রাজার কাছে গিয়ে হাজির! সার্দিনিয়ার ভীত হতভম্ব রাজা নেপোলিয়নের হাতে কেল্লা ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি তাঁর সঙ্গে সন্ধি করে ফেললেন। তারপর অস্ট্রিয়ান সেনাপতি বিউলিউয়ের পালা।

বিউলিউ তখন সমস্ত সৈন্য নিয়ে মিলান শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু লোদি সেতুর কাছে নেপোলিয়ন এমন অদ্ভুত কৌশলে তাঁকে আক্রমণ করলেন যে তিনি পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন মান্টুয়া নগরে। এই লোদি-সেতুর যুদ্ধ আজও বিখ্যাত হয়ে আছে। তারপর নেপোলিয়ন ব্রেসকিয়া, লেগহর্ন ও বোলোগ্না প্রভৃতি দখল করে বসলেন।

ওদিকে জার্মানিতে ফরাসি সেনাপতি জোর্দান, অস্ট্রিয়ার রাজকুমার আর্কডিউক চার্লসের কাছে হেরে পালিয়ে গেলেন। চার্লস তখন হাত খালি পেয়ে তাড়াতাড়ি মান্টুয়া নগরে অবরুদ্ধ বিউলিউকে সাহায্য করবার জন্যে অগ্রসর হলেন। শুনেই নেপোলিয়ন নিজের কতক সৈন্য নিয়ে আর্কোলা ও রাইভলি ক্ষেত্রের দুই যুদ্ধে আর্কডিউককে শোচনীয় রূপে হারিয়ে দিলেন। মান্টুয়ার পতন হল। পোপ তাড়াতাড়ি নেপোলিয়নের সঙ্গে সন্ধি করে তাঁর হাতে বেলোগ্না ও ফেরারা দেশ ছেড়ে দিলেন। সমস্ত উত্তর ইতালি হল নেপোলিয়নের হস্তগত!

নেপোলিয়নের এই আশ্চর্য সাফল্যের মূলে ছিল তাঁর বিদ্যুৎ-গতি! অস্ট্রিয়ার একজন সেনানী বন্দি হয়ে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘নেপোলিয়নকে কখনও দেখি আমাদের পিছনে, কখনও পাশে, আবার হঠাৎ কখনও সামনের দিকে! আরে ছোঃ, লোকটা যুদ্ধরীতির কিছুই জানে না!’

ফ্রান্সের শাসনসভার ডিরেক্টররা লিখে পাঠালেন, সার্দিনিয়ার রাজার সঙ্গে কোন শর্তে সন্ধি করতে হবে।

নেপোলিয়নের কাছ থেকে জবাব এল : ‘আপনাদের সন্ধি-শর্ত আমার হস্তগত হয়েছে। সেনাদল তা মঞ্জুর করেছে।’

নেপোলিয়ন হচ্ছেন শাসনসভার দ্বারা নিযুক্ত ভৃত্য মাত্র। তাঁর মুখে এমন গর্বিত উক্তি শুনে ডিরেক্টররা বিস্মিত হলেন। কেউ কেউ বললেন, এমন উদ্ধত উক্তির জন্যে তাঁর প্রাণদণ্ড হওয়া উচিত।

কিন্তু তিনি এখন সমস্ত ফ্রান্সের আদরের দুলাল—বিজয়ী ফ্রান্সের জনসাধারণ আজ নেপোলিয়নের পক্ষে। তাঁকে শাস্তি দেওয়ার সাধ্য কারুর নেই। বুদ্ধিমান নেপোলিয়নও তা জানতেন।

ডিরেক্টররা তখন নেপোলিয়নকে বাগে রাখবার জন্যে ভিন্ন উপায় অবলম্বন করলেন। তাঁর যশের উপরে ভাগ বসাবার জন্যে জেনারেল কেলারম্যানকে তাঁর সহযোগী রূপে পাঠানো হল।

নেপোলিয়ন এ চালাকি বুঝতে পারলেন। ক্রুদ্ধ হয়ে বলে পাঠালেন—’না!’

ডিরেক্টররা আরও ভয় পেয়ে গেলেন। ভাবলেন, সৈন্যরা হচ্ছে নেপোলিয়নের পক্ষে। তিনি যদি ক্ষেপে গিয়ে বিদ্রোহী হয়ে ফ্রান্সে ছুটে আসেন, তখন তাঁকে ঠেকাবে কে? কাজ নেই বাপু, লোকটাকে ঘাঁটিয়ে! তাঁরা তাড়াতাড়ি নিজেদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করলেন!

এদিকে বিজিত উত্তর-ইতালি থেকে নেপোলিয়ন কোটি কোটি টাকা ও অন্যান্য অসংখ্য ঐশ্বর্য ভারে ভারে স্বদেশে পাঠাতে ত্রুটি করলেন না। বিদ্রোহ ও ধারাবাহিক যুদ্ধের ফলে ফ্রান্সের অর্থভাণ্ডার একেবারে খালি হয়ে গিয়েছিল। ঐশ্বর্যের স্তূপ দেখে ডিরেক্টরদেরও মুখ বন্ধ হল। নেপোলিয়ন আরও সৈন্য চেয়ে পাঠালেন। আরও বেশি লাভের আশায় ডিরেক্টররাও তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন।

ডিরেক্টরদের মতামতের অপেক্ষা না রেখেই নেপোলিয়ন নিজের ইচ্ছানুসারে অস্ট্রিয়ার দিকে অগ্রসর হলেন। আর্কডিউক চার্লস আবার তাঁকে বাধা দিতে এলেন, কিন্তু আবার তিনি হলেন পরাজিত। তারপর নেপোলিয়ন যখন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার অনতিদূরে এসে পড়েছেন, তখন ভীত সম্রাটের দূত নিয়ে এল সন্ধির প্রস্তাব।

নেপোলিয়নের নিজের শর্তানুসারেই সন্ধি হল। অস্ট্রিয়া বাধ্য হয়ে হল্যান্ড, মিলান ও আংশিক ভাবে ভিনিস ছেড়ে দিলে ফ্রান্সের হাতে। অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ছয়বৎসরব্যাপী যুদ্ধ শেষ হল (১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দ)।

ইতিমধ্যে নেপোলিয়নের জীবনের আর এক বাসনা সফল হয়েছে। ইতালির উপরে তাঁর প্রভুত্ব দেখে ভীত হয়ে অদূরবর্তী কর্সিকা থেকে ইংরেজরা নিজেদের দেশে সরে পড়ল।

বিজয়ী বীর নেপোলিয়ন স্বদেশে ফিরে এলেন অপূর্ব গৌরবের মুকুট পরে। বিপ্লবের পর ফ্রান্স নেমে গিয়েছিল অধঃপতনের অন্ধকারে, চারিদিক থেকে আক্রমণ করে বিদেশি শত্রুরা তার অস্তিত্ব প্রায় লোপ করতে বসেছিল, নেপোলিয়নের অসাধারণ যুদ্ধপ্রতিভার মহিমায় আজ সে আবার হয়েছে ইউরোপের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ! তার শত্রুরা পলাতক, পরাজিত! যারা এখনও তার মিত্র নয়, নির্বিষ সর্পের মতন তারাও আজ নত করেছে মাথা!

সমস্ত ফরাসি জাতি বিপুল আনন্দে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে! পুষ্পে পত্রে পতাকায় দীপমালায় রাজধানী সুসজ্জিত করে বিজয়ী বীরকে তারা অভিনন্দন দান করলে।

এ-সময়ে নেপোলিয়নের মনে কোন ভাবের উদয় হচ্ছিল, আমরা হয়তো সেটা কল্পনা করতে পারি। ইতালির যুদ্ধক্ষেত্রেই যে নেপোলিয়নের মনের ভিতরে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার একটা ইঙ্গিত জাগ্রত হয়েছিল, তাঁর নিজের মুখেই সে কথা প্রকাশ পেয়েছে।

লোদি-সেতুর যুদ্ধের পর নেপোলিয়ন তাঁর বন্ধু মার্মন্টকে বলেছিলেন : ‘আমি অনুভব করছি, আমার জন্যে এমন সব কীর্তি অপেক্ষা করছে, বর্তমান কালের লোকেরা যার কোনও ইঙ্গিতই পায়নি।’

বহুকাল পরে নিজের জীবনস্মৃতির প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন : ‘লোদি-সেতুর যুদ্ধের পরে সেই সন্ধ্যায় সর্বপ্রথমে জানতে পেরেছিলুম যে, আমি হচ্ছি একজন অসাধারণ মানুষ! সেইদিন থেকেই অপূর্ব সব কীর্তিকলাপের জন্যে আমার মনে জাগ্রত হয়ে উঠেছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষা! তার আগে সেসব ছিল আমার স্বপ্নজগতের উদ্ভট কল্পনা।’

আজ লোদী-সেতুর যুদ্ধের পরে খ্যাতির পথে তিনি আরও অনেক দূর অগ্রসর হয়েছেন এবং নিজের প্রতিভা ও বিপুল শক্তির সম্বন্ধে তাঁর মনে আর কোনওই সন্দেহ নেই। আজ নেপোলিয়ন নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন যে ইচ্ছা করলে অনায়াসেই তিনি হতে পারেন দেশের সর্বেসর্বা!

কিন্তু জনসাধারণের কাছে দেবতার মতন পূজা পেয়েও নেপোলিয়ন তেমন কোনও ইচ্ছা প্রকাশ করলেন না। এখনও সময় হয়নি—মাহেন্দ্রক্ষণ আসেনি। তিনি বুদ্ধিমানের মতন অতি বিনীত ভাবে জনসাধারণের অভিনন্দন গ্রহণ করলেন!

ফরাসি জাতি বুঝেছিল, নেপোলিয়নই হচ্ছেন এখন দেশের মাথা! তাঁর চেষ্টাতেই আজ ফরাসিরাজ্য পরিণত হয়েছে সাম্রাজ্যে। পুরাতন শত্রু অস্ট্রিয়া লাঞ্ছিত ও পরাজিত। স্পেন আজ ফরাসিদের হাতে কলের পুতুল মাত্র। একমাত্র শত্রু হচ্ছে ইংল্যান্ড—কিন্তু সেও হয়েছে অসহায় ও কোণঠাসা।

নেপোলিয়নের মাথার ভিতরে ঘুরছে তখন কতরকম আকাশছোঁয়া কল্পনা। কিন্তু সে-সব কল্পনা কার্যে পরিণত করবার আগে তিনি স্থির করলেন, সর্বপ্রথমে ফরাসিদের মহাশত্রু ইংল্যান্ডের বিষ-দাঁত ভাঙতে হবে। ভারত-সাম্রাজ্য নিয়েই ইংরেজদের যত জারিজুরি ও বড়মানুষী। ইংল্যান্ডের হাত ছিনিয়ে ভারতবর্ষ কেড়ে নিলে কেমন হয়? ভালোই হয়, কিন্তু ওদিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে আগে দখল করতে হবে মিশর ও সিরিয়া।

এদিকে ডিরেক্টররা নেপোলিয়নের অতিবাড় দেখে ভয়ে সারা হচ্ছেন। নেপোলিয়ন এখন খালি সামরিক ব্যাপারে নয়, রাজনৈতিক ব্যাপারেও হাত দিতে আরম্ভ করেছেন! অথচ তাঁকে আর কর্মচ্যুত করবারও উপায় নেই, কারণ নামে ভৃত্য হয়েও আসলে তিনি এখন প্রভুর মতো। তাঁকে অপদস্থ বা নির্বাসিত করতে গেলে সমস্ত ফরাসিজাতি মারমুখো হয়ে উঠবে! নেপোলিয়নকে নিয়ে কী করা যায়—কী করা যায়?

ঠিক এই সময়ে নেপোলিয়ন নিজেই প্রস্তাব করে বসলেন, ‘আমি মিশর অধিকার করতে যাব।’

ডিরেক্টররা হাতে যেন স্বর্গ পেলেন! মিশর হচ্ছে বহুদূরে। দেশ থেকে নেপোলিয়ন যত দূরে থাকেন ততই ভালো। তারপর মিশরের রণক্ষেত্রেই হতে পারে নেপোলিয়নের সমাধি। সেটা হচ্ছে আরও ভালো!

ডিরেক্টররা রাজি হয়ে গেলেন সাগ্রহে। তাঁদের অতি আগ্রহ দেখে নেপোলিয়ন মনে মনে হেসেছিলেন কিনা জানি না।