চার । কালোদেড়ের বিদায়ী সেলাম
আরও কয়েকদিন যেতে না যেতেই কাপ্তেনের ভয় আরও বদ্ধমূল হয়ে উঠল।
একদিন সমুদ্রে আবির্ভূত হল দুই-দুইখানা জাহাজ—তারা আসছে যথাক্রমে হাভানা ও বারমুডা থেকে।
হর্নিগোল্ডের জাহাজে অমনি উড়িয়ে দেওয়া হল হাড় ও মড়ার মাথা আঁকা কালো ‘জলি রোজার’ পতাকা।
আগন্তুক দুই জাহাজই সেই অশুভ পতাকা দেখে শিউরে উঠে আত্মসমর্পণ করলে বিনা-বাক্যব্যয়ে।
হর্নিগোল্ড জাহাজ দুখানা নিঃশেষে লুণ্ঠন করলেন বটে, কিন্তু তাদের লোকজনদের অক্ষত দেহেই মুক্তি দিলেন। অকারণে তিনি রক্তপাতের পক্ষপাতী ছিলেন না।
কিন্তু কালোদেড়ে দারুণ ক্রোধে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে গর্জন করে উঠল, ‘ওদের সবাইকে ফেলে দাও সমুদ্রে, ওরা মাছেদের খোরাক হোক!’
হর্নিগোল্ড দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘এ জাহাজের কাপ্তেন হচ্ছি আমি, তুমি হুকুম দেওয়ার কেউ নও!’
কালোদেড়ে বললে, মরা মানুষ কথা কয় না, সাক্ষ্য দিতে পারে না। আমি কাপ্তেন হলে কখনও ওদের ছেড়ে দিতুম না।’
হর্নিগোল্ড বললেন, ‘ভয় নেই, ভয় নেই। তুমি যাতে কাপ্তেন হতে পারো, শীঘ্রই আমি সে ব্যবস্থা করে দেব।’
কালোদেড়ের মুখে হাসি ফুটল বটে, কিন্তু সে হাসি হচ্ছে দস্তুরমতো বিষাক্ত।
বাসনা পূর্ণ হল না বলে মনের দুঃখ ভুলবার জন্যে সে সদ্যলুণ্ঠিত জাহাজ থেকে একটা মদের পিপে টেনে এনে নিজের দলের সবাইকে ডাক দিয়ে বললে, ‘চলে আয় সব তৃষ্ণার্তের দল। পেট ভরে মদ খা আর প্রাণ-ভরে ফুর্তি কর!’
জাহাজের উপরে বইল যেন মদের ঢেউ! কালোদেড়ের টুপি থেকে লম্বমান জ্বলন্ত পলিতাগুলোও দেখাতে লাগল যেন অভিনব দেওয়ালির বাঁধা-রোশনাই! মদে চুমুকের পর চুমুক দিতে দিতে বলতে লাগল, ‘জানিস তোরা আমার বাহাদুরি? এ অঞ্চলের বারোটা বন্দরে আছে আমার এক ডজন বউ—আমি কি যে-সে লোক রে? দু-দিন সবুর করলেই দেখবি আমি হয়েছি নিজস্ব জাহাজের মালিক আর তার নাবিকরা হয়েছে পুরোপুরি আমারই তাঁবেদার!’
তার সাধ পূর্ণ হল দিন কয়েক পরেই।
সমুদ্রে ঢেউ কেটে এগিয়ে আসছে একখানা বাণিজ্যপোত।
বোম্বেটে জাহাজের কৃষ্ণপতাকা দেখেও তার লোকজনরা দমল না, লড়াই করবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল।
কালোদেড়েও তো তাই চায়—মারামারি, রক্তারক্তি, খুনোখুনি! কাপ্তেন হর্নিগোল্ডকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও সায় দিতে হল।
বোম্বেটে জাহাজ থেকে হুঙ্কার দিয়ে উঠল কামানের সারি এবং সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়ে তপ্ত বুলেট প্রেরণ করতে লাগল বন্দুকগুলোও! মড় মড় করে ভেঙে পড়ল বাণিজ্যপোতের কয়েকখানা তক্তা এবং শোনা গেল আহতদের সকরুণ আর্তনাদ!
দুই জাহাজ পাশাপাশি হতেই কান-ফাটানো ভৈরব গর্জন করে মহাকায় কালোদেড়ে মূর্তিমান অভিশাপের মতো লাফ দিয়ে পড়ল বাণিজ্যপোতের উপরে এবং শূন্যে বনবন করে ঘুরতে লাগল তার রক্তলোভী, শাণিত ও বৃহৎ তরবারি! যারা বাধা দিতে এল তাদের কেউ প্রাণে বাঁচল না।
নিজের জাহাজে দাঁড়িয়ে কাপ্তেন হর্নিগোল্ড আশা করেছিলেন শত্রুবেষ্টিত কালোদেড়ে এ যাত্রা আর আত্মরক্ষা করতে পারবে না। একথাও ভেবেছিলেন, নিজেই পিস্তল ছুড়ে পথের কাঁটা দূর করবেন—কিন্তু হায়, পিস্তলের গুলি অতদূরে পৌঁছোবে বলে মনে হল না।
ব্যর্থ হল হর্নিগোল্ডের আশা! শোনা গেল কালোদেড়ের ষণ্ড-কণ্ঠের সঙ্গে অমান্য বোম্বেটেদের হই-হুল্লোড়, জয়ধ্বনি। বাণিজ্যপোত অধিকৃত এবং তার লোক-লশকর হত আহত বা বন্দি!
বন্দি যাত্রীদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে কালোদেড়ে নির্দয় হুকুম দিলে, ‘ওদের সমুদ্রে ফেলে দে, ওরা মাছেদের উপবাস ভঙ্গ করুক!’
যাত্রীদের কণ্ঠে কণ্ঠে জাগল গগনভেদী ক্রন্দনধ্বনি, কিন্তু সেদিকে কর্ণপাত না করে কালোদেড়ে বললে, ‘এইবারে বন্দি নাবিকদের ব্যবস্থা কর! যারা আমাদের দলে যোগ দিতে না চাইবে, তারাও হবে মাছেদের খোরাক! আহত শত্রুগুলোকেও ওই সঙ্গে জলে ফেলে দে!’
চিৎকার ও হাহাকার কোনও-কিছুতেই কান না পেতে বোম্বেটেরা কালোদেড়ের হুকুম তামিল করতে লাগল।
কালোদেড়ে চেঁচিয়ে হর্নিগোল্ডকে ডেকে বললে, ‘শুনুন কাপ্তেন! এ জাহাজখানা এখন আমাদের!’
হর্নিগোল্ড বললেন, ‘আমাদের নয় বাপু, খালি তোমার! আজ থেকে তুমি হলে কাপ্তেন টিচ!’
‘কাপ্তেনে’র পদে উন্নীত হয়ে কালোদেড়ের ওষ্ঠাধরের উপর দিয়ে হাসির ঝিলিক খেলে গেল বটে, কিন্তু মনে মনে সে সন্তুষ্ট হল না। এখানা হচ্ছে মাত্র ‘স্লুপ’ (এক মাস্তুলের ছোট জাহাজ), সে চায় বহু বড় বড় জাহাজের বহর চালনা করতে। হর্নিগোল্ডের জাহাজখানাও ‘স্লুপ’ শ্রেণিভুক্ত।
কয়েকদিনের বিশ্রাম। তারপর আবার নতুন শিকারের সন্ধানে সমুদ্রযাত্রা।
দুই দিনের মধ্যেই জুটল এক পরম লোভনীয় শিকার—একখানা মস্ত বড় ফরাসি জাহাজ!
চোখে-কানে ভালো করে কিছু দেখবার ও শোনবার আগেই বোম্বেটেদের জাহাজ দুখানা তিরবেগে তার দুই পাশে গিয়ে একসঙ্গে প্রচণ্ড গোলাগুলি বৃষ্টি করতে লাগল—ফরাসি জাহাজখানার অবস্থা হল টলোমলো, দলে দলে মাল্লা মৃত ও জখম হয়ে লুটিয়ে পড়ল এবং তারপরই দেখা গেল, এক রোমশ নরদানবের পিছনে পিছনে বোম্বেটেরা দলে দলে উঠছে আক্রান্ত জাহাজের পাটাতনের উপরে। তখনও যে-সব হতভাগ্য জীবন্ত ছিল তারাও জাহাজের পাটাতন থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে সশরীরে করলে পাতালপ্রবেশ!
কালোদেড়ে তৎক্ষণাৎ সেই নতুন ও প্রকাণ্ড জাহাজের নাম রাখলে—’প্রতিহিংসা!’
তারপর জলের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললে, ‘ওহে নরকের খোকা হর্নিগোল্ড! তোমার ওই পুঁচকে খেলো জাহাজকে আমি এইখান থেকেই বিদায়ী সেলাম ঠুকছি! আমি নিজের পছন্দমাফিক জাহাজ পেয়েছি, তোমাকে এর মালপত্তরেরও ভাগ দেওয়া হবে না—হে হে হে হে, বুঝলে বাপু?’
কাপ্তেন হর্নিগোল্ড কোনও জবাব দিলেন না, নিজের জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে আবার ফিরে চললেন নিউ প্রভিডেন্সের দিকে। বোম্বেটেগিরিতে তাঁর ঘৃণা ধরে গিয়েছে, তিনি এই নিষ্ঠুর ও নিকৃষ্ট ব্যবসায় ছেড়ে দেবেন।