চাপরাশি ও কেরানি

চাপরাশি ও কেরানি

কিছুদিন পূর্বে বক্তৃতা দেবার সময় পণ্ডিতজি বলেন, চাপরাসিদের মাইনে মাস্টারদের চেয়ে বেশি কিংবা ওই ধরনের আমার ঠিক মনে নেই। তার জন্য ‘পণ্ডিত’ সম্প্রদায় আমার অপরাধ নেবেন না। বিবেচনা করে দেখলে তাঁরা বুঝতে পারবেন, আমি তাঁদের উপকারই করেছি। কারণ পণ্ডিতজির সব কথা বিশেষ করে তাঁর শপথ এবং প্রতিজ্ঞা সর্বসাধারণ স্মরণ রাখলে বড় বিপদ হত। আমার মতো কোনও কোনও আহাম্মক এখনও ভুলতে পারেনি, পণ্ডিতজি স্বরাজলাভের ঊষাকালে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি কালোবাজারিদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাবেন। কেউ যদি কাউকে ওইভাবে ঝুলে থাকতে দেখে থাকেন, তবে দয়া করে জানাবেন, দৃশ্যটি নয়নাভিরাম না হলেও প্রাণাভিরাম। একটু তাড়াতাড়ি জানাবেন কারণ আমার জীবন-সায়াহ্ন আসন্ন।

অতএব, পণ্ডিতজি প্রাতঃস্মরণীয় বটে, কিন্তু তাঁর বচনামৃত প্রাতঃস্মরণীয় নয়।

খয়ের। বাংলা ‘খয়ের’ নয়, উর্দু ‘খয়ের’। তার অর্থ ‘তা সে যাকগে।’ এই উর্দু ‘খয়ের’টি এই বেলাই একটু ভালো করে শিখে নিন। বিস্তর ‘ফায়দা ওঠাতে’ পারবেন। বুঝিয়ে বলি।

উর্দুওয়ালারা দেশ সম্বন্ধে বক্তৃতার আরম্ভেই শুরু করেন তার দুঃখকাহিনীর বর্ণনা দিয়ে। ‘আমরা খেতে পাইনে, পরবার কিছু নেই, আশ্রয় জোটে না, শিক্ষার ব্যবস্থা হয়নি, মেয়েরা গর্ভর্যন্ত্রণায় মারা যায়; ডাক্তারবদ্যির ব্যবস্থা হল না, ইত্যাদি ইত্যাদি।’ আমরা তখন উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করি, এইবারে বুঝি দেশের কর্ণধাররা বাতলে দেবেন, তাঁরা এসব বালাই-আপদ দূর করবার জন্য কী সব পরিপাটি ব্যবস্থা করেছেন, দেশের কোন্ কোন্ জায়গায় এ-সব অভাব-অনটন তাঁদের সম্মার্জনী-সঞ্চালনে দূরীভূত হয়েছে, এইবারে আমাদের সবুরের মেওয়া ফলবে কবে, এই ধরনের কোনওকিছু।

বারমাস্যা শেষ হওয়ার পর বক্তা দম নেবেন। চতুর্দিকে সূচিভেদ্য নৈস্তব্ধ্য। আমরা কান পেতে আছি, এইবার শুনতে পাব, ‘চাপানে’র ‘ওতর’, এইবার শুরু হবে উল্টো ‘বারমাস্যা’, এইবারে আরম্ভ হবে আমাদের আশার বাণী, ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন।

ও হরি! কোথায় কী?

শুনতে পাবেন, বক্তা গুরুগম্ভীর নিনাদে একটি কথা বললেন, সেটি ‘খ য়ে র।’

মানে? এর অর্থটা তো তা হলে বুঝতে হয়। কারণ ইতোমধ্যে বক্তা ‘জাপানের ড্রাই ফার্মিং’ কিংবা ‘জানজিবারের কো-অপারেটিভ সিস্টেমে’ চলে গিয়েছেন। তা হলে নিশ্চয়ই ও ‘খয়ের’ শব্দে তাবৎ সমস্যার সমাধান ঘাপটি মেরে বসে আছে। ওঁ-তে যেরকম হিন্দুর ব্রহ্মা লাভ, ক্রুশে যেরকম ক্রিশ্চানের গড লাভ। ‘সকলং হস্ততলং শব্দ মাত্রেণ যদি অর্থধনং কোহপি লভেং।’

এইবারে ‘খয়ের’-কলমার গুহ্য অর্থ শোনার পূর্বে ভালো ডাক্তারকে দিয়ে হার্টটি দেখিয়ে নিন। শটি মারাত্মক রকমের হবে। ছাপাখানায় সন্দ্রাহ্মণও আছেন। আর কেউ না পড়লেও তাঁরা বাধ্য হয়ে আমার লেখা কম্পোজ করেন, প্রুফ দেখেন। অকালে ব্রহ্মহত্যা করলে লোকসভায়ও আমার ঠাঁই হবে না।

‘খয়ের’ কথার সাদামাটা প্লেন ‘নির্ভেজাল’ অর্থ, ‘তা সে যাকগে– অন্য কথা পাড়ি।’ অর্থাৎ এতক্ষণ আপনি যেসব দুঃখ-কাহিনীর ফরিয়াদ-প্রতিবাদ আগড়ম-বাগড়ম্ যা কিছু বলেছেন, তার উত্তর দেবার দায় আর আপনার রইল না। আপনি এখন কালীঘাট, মৌলা আলী সর্বত্রই লম্ভ-ঝম্ফ দিতে পারেন, কারণ, ‘খয়ের’ শব্দের প্রসাদাৎ আপনি আপনার পুচ্ছটি ইতোমধ্যে কপাত করে কর্তন করে ফেলেছেন।

‘খয়ের’ বাক্যের শব্দার্থ আরবি ডিকশনারি ঘেঁটে বের করেও পুলি-পিঠের ন্যাজ গজাবে না। এতে পাবেন ‘খয়ের’ অর্থ ‘উত্তম’, ‘শিব’, মঙ্গল’। তবে কি বক্তা যে গোড়ার দিকে ফুল্লরার বারমাস্যা গেয়েছিলেন সেটা ‘ভালো’?

না। আমরা অর্থাৎ বাঙালিরাও এরকম জায়গায় ‘উত্তম’ বলে থাকি, কিন্তু বিপরীত অর্থে। আমাদের পণ্ডিতগণ কোনও কিছুর সুদীর্ঘ অবতারণা করার পর সর্বশেষে বলেন, উত্তম প্রস্তাব। তার অর্থ এই নয় ‘এতক্ষণ যা বললুম সে সব খুব ভালো জিনিস’;– তার সরল অর্থ, ‘এ দিককার কথা বলা হল, এবার অন্য পক্ষের বক্তব্য নিবেদন করছি এবং সেইটেই আমার বক্তব্য এবং তাতেই পাবেন প্রশ্নের সমাধান, রহস্যের মীমাংসা।’

‘খয়ের’-এর এরূপ ব্যবহারকে ফার্সিতে বলা হয়, তাকিয়া-ই-কালাম’—’কথার’ (কালামের) ‘বালিশ’ (তাকিয়া)? অর্থাৎ যে কথার উপর ভর করে নিশ্চিন্ত মনে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়তে পারেন! বিপক্ষ রা’টি কাড়তে পারবে না। আপনি কেল্লা ফতেই করে দিয়েছেন, ভাগ্যিস, আপনি, মোকামাফিক ‘খয়ের’ শব্দটি প্রয়োগ করতে জানতেন, ‘রাখে খয়ের মারে কে?’

মুসলমানরা নাকি এদেশের মন্দির ভেঙেছে, পার্ক সার্কাসে শিককাবাব চালিয়েছে, ইদানীং নতুন শুনছি, খামখেয়ালিতে খেয়াল আমদানি করে ধ্রুপদ-ধামার বরবাদ করেছে। করেছে তো করেছে, তাই বলে কি উভরে গোসসা-ঘরে এখনও খিল দিয়ে বসে রইবেন? গড়ের মাঠে গিয়ে রাষ্ট্রভাষায় (কটকে আমার বৃদ্ধ বাঙালি কেরানি সরকারি ইশতিহার পড়ে ভীত কণ্ঠে আমাকে শুধিয়েছিল ‘আমাকেও লোষ্ট্রভাষা শিখতে হবে নাকি, স্যার?’) কীভাবে ‘খয়ের’ শব্দের সুষ্ঠু প্রয়োগ করতে হয় সেটি শিখবেন না? ওইটে ঠিকমতো, তাগমাফিক, বাংলায় ‘এসতেমাল’ করতে পারলে পাড়ার তর্কবাগিশ, তকিয়া (ই-কালামের)-রকল্যাণে তর্কবালিশ হতে কতক্ষণ?

চিন্তা করে দেখুন, ‘খয়ের’ শব্দের কত গুণ! রাষ্ট্রভাষা হিন্দি তাঁর শব্দভাণ্ডার থেকে লাথি আঁটা মেরে তাবৎ আরবি-ফার্সি শব্দ বের করে দিচ্ছেন–কারণ হিন্দি বাংলার তুলনায় অনেক ধনী (!) কি না– কিন্তু কই ‘খয়ের’ শব্দটি তাড়াবার প্রস্তাব তো কেউ করে না। কট্টর কান-ফাটা হিন্দিতে ‘ভারতওয়ার্ষ কী উন্নতি ঔর সোওয়াধীন্তা, গড়তন্ত্রর উর সামওয়াদ’ ইত্যাদি ‘কঠন কঠন’ (কঠিন কঠিন) সমস্যায়ে নির্মাণ করার পর সে-ইন্দ্রজাল তাঁরা ছিন্নভিন্ন করেন কোন মোহমুদগরে? সেই সনাতন-রাম! রাম! সেই যাবনিক, ম্লেচ্ছ খ-য়ে-র দ্বারা। এবং সেই ‘খয়ের’-এর ‘খ’ও উচ্চারণ করেন অ্যাসন ঘর্ষণ দ্বারা যে শুনে মনে হয় বড়ি মসজিদের সামনে জাকারিয়া স্ট্রিটের কাবলিওলা ‘খ’ উচ্চারণ করার ছলে গলা সাফ করছে। কোথায় লাগে তাঁর কাছে স্কচ ‘লখ’ শব্দের ‘খ’ জর্মন ‘বাখ’ শব্দের ওই একই ব্যঞ্জন?

মুসলমানরা মন্দির ভেঙে অতিশয় অপকর্ম করেছে, কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই রাগে ‘খয়ের’ শব্দের যে বিরাট বালাখানা তৈরি করে দিলে তার উপর বসে হাওয়া খাবেন না?

শুধু মন্দ দিকটাই দেখবেন, ভালো দিকটা দেখবেন না?

 তবে একটা গল্প শুনুন।

হয়তো অনেকেই শুনেছেন, তাঁরা অপরাধ নেবেন না। কারণ, বিবেচনা করে দেখুন, পুরনো গল্পের পুনরাবৃত্তি না করলে সেটি বেঁচে থাকবে কী করে? মহাভারতের গল্প সবাই জানে, তাই বলে কি আমরা মহাভারতের চর্চা বন্ধ করে দিয়েছি?

খয়ের।

 গল্পটা কমিয়ে-সমিয়ে বলছি।

কালীঘাটের মন্দিরের সামনে দিয়ে যেতে এক ভদ্রসন্তানের হৃদয়ে ধর্মভাবের উদয় হল। মন্দিরে ঢুকে পাণ্ডাকে ডেকে যথারীতি যাবতীয় পুজো-পাটা করালে এবং শেষটায় উত্তম দক্ষিণা পেয়ে পাণ্ডা ভদ্রসন্তানের কপালে ইয়া একখানা খাসা তিলক কেটে দিল। বহর আর চেহারা দেখে মনে হয় ওই দিয়ে লাইটনিং কন্ডাক্টরের কাজ অনায়াসে চালানো যায়। দেখলেই ভক্তি হয়। গড় হয়ে পেন্নাম করতে ইচ্ছে যায়। ভক্তিতে গদগদ হয়ে তারা ‘ব্রহ্মময়ী মা, বজ্রযোগিনী মা’ ইত্যাদি জপ করতে করতে ভদ্রসন্তান বাড়িমুখো হল।

কিন্তু হায়, সংসারের কত না সর্বজনীন অনাচার, রঙিন প্রলোভন। হবি ত হ, কিছুদূর যেতে না যেতে পড়ল বাহারে একখানা ‘বার’। সেদিন ছিল মঙ্গলবার, ড্রাই ডে, শরাব বারণ, তাই ভদ্রসন্তান প্রলোভনের ভয় নেই জেনে সে-পথ নিয়েছিল, কিন্তু বিধি বাম, বড়দিন না কিসের যেন জব্বর পর্ব ছিল বলে ‘ইস্পিশেল’ কেস হিসাবে ‘বার’ খোলা।

এখন এগোই কী প্রকারে? ভদ্রসন্তানের রাস্তায় এগোবার কথা হচ্ছে না। আমি গল্পটা নিয়ে এগোই কী প্রকারে? পাঠকরা জীবনে একটিমাত্র অপকর্ম করে থাকেন, সেটি আমার রচনাপঠন। তাঁদের আমি অধর্মের কাহিনী শোনাই কী করে। কিন্তু তারা যখন এতাবৎ এতখানি দয়া করেছেন তখন গোপাল ভাঁড়ের মা-কালীর মতো জোড়া মোষ থেকে নেমে নেমে শেষ পর্যন্ত দুটো বুনো ফড়িং নিজেই ধরে খেতে রাজি হবেন– এই আমার ভরসা।

পাঁট। ইংরেজিবাগীশ ছোঁড়ারা বলে ‘পাইন্ট’। তিন কোয়ার্টার খেতে না খেতেই হয়ে গেল। রঙিন পাখনায় ভর করে সে পুনরায় নামল রাস্তায়। কোয়ার্টারটুকু ফেলা যাবে বলে বোতলটা পকেটে– বোতলবাসিনীর সেবকরা বরঞ্চ জীবনের বেটার-হাফকে বিসর্জন দিতে রাজি আছে ওই ‘ব্যাড’ কোয়ার্টারকে নয়।

যেতে যেতে পথে পূর্ণিমা রাতে চাঁদ উদয় হয়েছিলেন কি না বলতে পারব না, কারণ আমি জ্যোতির্বিদ নই। তবে উদয় হলেন পাড়ার মৈত্রমশাই, নিষ্ঠাবান সদাচারী ব্রাহ্মণ, কালেভদ্রে বাড়ি থেকে বেরোন। এক মৈত্র মিনার্ভা থিয়েটার কোথায় জেনেও বলেননি। ইনি কিন্তু বোতল দেখে বললেন, ‘পাষণ্ড মাতাল।’

পকেটে বোতল থাকলেই, এমনকি সঙ্গে সঙ্গে টলটলায়মান হলেই মানুষ মাতাল হয় না। কিন্তু মৈত্রমশাই ন্যায়শাস্ত্রের চর্চা করতেন। তাতে আছে–

১। দেবদত্ত বিরাট লাশ।

২। দেবদত্তকে দিনের বেলায় কেউ কখনও ভোজন করতে দেখেনি। অতএব, দেবদত্ত রাত্রে খায়।

এটাকে বলে নলেজ বাই ইনফারেন্স।

 আমাদের ভদ্রসন্তান সচরাচর কথা কাটাকাটি করে না। কিন্তু দ্রব্যগুণ অনস্বীকার্য। বেদনাভরা কণ্ঠে, গদগদ ভাষে করুণ নয়নে শুধু বললে ‘মৈত্রমশাই, বোতলটাই শুধু দেখলেন, তিলকটা দেখলেন না।’

.

মন্দির ভাঙাটাই শুধু দেখলেন, ‘খয়ের’টা শুনলেন না।

আমার অনেক পাঠক আমাকে বাচনিক এবং পত্র দ্বারা মাঝে মাঝে জানান যে, আমার কোনও কোনও গল্প তারা বন্ধু-মিলনে ব্যবহার করে থাকেন। আমি শুনে বড় উল্লাস বোধ করি। কারণ পাণ্ডিত্য বিতরণ করার শক্তি মুর্শিদ আমাকে দেননি। আমি বিদুর, যা পারি তাই দিই। তাঁরা হয়তো বলবেন, এ গল্পটা সর্বত্র বলা যাবে না। তাই তাঁদের জন্য একটা গার্হস্থ্য সংস্করণ নিবেদন করছি। এটি অনায়াসে পুত্র-কন্যার হাতে দিতে পারবেন।

ঢাকার কুট্টি গাড়োয়ানের গল্প। কুট্টি বসে আছে ছ্যাকরা গাড়ির কোচবাক্সে। বাবু জামাকাপড় পরে উপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। পা গেল হড়কে। বহুতর ধাক্কা আর গোত্তা খেয়ে খেয়ে বাবু গড়িয়ে পৌঁছলেন নিচে। তিন লক্ষে কুট্টি কোচবাক্স থেকে নেমে কর্তাকে কোলে তুলে নিলে। সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে দরদভরা কণ্ঠে কয়, “অহো-হো, কত্তার বড় লাগছে। আহা-হা-হা, এইহানে লাগছে, এ হে-হে-হে, ওইহানে লাগছে।’ গা বুলোয় আর আদর করে, আদর করে আর গা বুলোয়। শেষটায় কিন্তু সান্ত্বনা দিয়ে বললে, কিন্তু কত্তা আইছেন জলদি।

জখম-চোটের কথাই শুধু ভাবছ, তাড়াতাড়ি যে এসেছে সেটা দেখছ না।

 কিন্তু কেরানি আর চাপরাশিদের কী হল?

খয়ের।

চাপরাশিদের মাইনে কোতওয়ালের মতো হোক সেই আমার প্রার্থনা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চাপরাশিদের কাছে নিবেদন, কোতওয়ালের মাইনে যেন কমে গিয়ে চাপরাশিদের আজকের মাইনেতে না দাঁড়ায়। আমার বাসনা সক্কলেরই যেন, কোটালের মাইনে হয়–অর্থাৎ আই-জি-র মাইনে হয়। আমি ধনী হব, তুমি ধনী হবে, সবাই ধনী হবে– এই হল সত্যিকার প্রার্থনা। ঋষি তখন বিশ্বজনকে আহ্বান করে জানিয়েছেন সকলেই অমৃতের পুত্র তখন ওই সত্যই ঘোষণা করেছেন। পাঁড় কমিউনিস্টও ওই আদর্শের জন্য লড়ে। পেঁতিরা বলে, ‘মজদুর ভাইরা শুধু সোনার খাটে বসে রুপার শানকি থেকে দু হাত ভরে গুড় খাবে এবং আর সবাই রাস্তায় পাথর ভাঙবে।’ এটা কোনও কাজের কথা নয়। আমাদের পণ, আমরা সবাই রাজা হব।

কিন্তু বেদান্তের এই অতি প্রাচীন সত্যটি পুনরায় জানবার জন্য আমি এ প্রবন্ধের অবতারণা করিনি। মূল কথায় ফিরে যাই।

মনে করুন, আপনি দিল্লির কোনও সরকারি দফতরে কাজ করেন। সেখানে গেলে না করেও উপায় নেই। কেন নেই, সে কথা পরে হবে। বিশ্বাস না হয়, ১৯৪৭ সালের একখানি টেলিফোন ডাইরেক্টরির সঙ্গে ১৯৫৭ সালের খানার তুলনা করে দেখুন, চাকুরের সংখ্যা কত গুণ বেড়েছে। ওখানে একদিন রুটিওলা, আণ্ডাওলা আর থাকবে না– এই আমার বিশ্বাস।

আপনার চাপরাশি চৈতরাম কিংবা ব্রিজমোহন ৯৫ টাকা মাইনে পায়। কেরানি বোধ হয়। ১১৫ টাকা পায়। আমি লেটেস্ট খবর দিতে পারব না– তবে অনুপাতটা মোটামুটি এই। অঙ্কশাস্ত্র এ স্থলে বলবে, ‘অতএব চাপরাশি কেরানির চেয়ে বিশ টাকা কম পায়!’ ওই করলেন ভুল। শুনুন।

আপনি চৈতরামকে ঘন্টি বাজিয়ে বললেন, ‘যাও তো চৈতরাম, এক পাকিট গোল্ডফ্লেক নিয়ে এস।’

সরকারি আইন অনুসারে চৈতরাম অনায়াসে বলতে পারে, ‘আমি যাব না। আমি মাইনে পাই সরকারি কাজের জন্য। আপনার জন্য সিগারেট আনা সরকারি কাজ নয়।’ আপনি কিচ্ছু বলতে পারবেন না। বলা উচিতও নয়।

কিন্তু চৈতরাম তা বলবে না। সে ভদ্রলোক। তদ্দণ্ডেই বলবে, ‘বহৎ (উচ্চারণ ‘বোহৎ’) আচ্ছা, হুজুর।’ এবং লম্ফ দিয়ে এমন তীরবেগে বেরিয়ে যাবে যে, আপনি মনে মনে শাবাশি দিয়ে বলবেন, ‘সোনার চাঁদ ছেলে, কী স্মার্ট!’

এক মিনিটের ভেতর চৈতরাম আপনার টেবিলের উপর প্যাকেটটা রাখবে। সিগারেটের দোকানে আসতে-যেতে পনের মিনিট লাগার কথা। কী করে হল?

চৈতরাম ডাইনের বুক পকেটে রাখে গোল্ডফ্লেক, বাঁয়ের পকেটে ক্যাপস্টান, পাতলুনের পকেটে রেড অ্যান্ড হোয়াইট, মেপোল ইত্যাদি। নিতান্ত কর্কশ ব্যবসায়ী হিসেবে সে পরিচয় দিতে চায় না বলে, বারান্দায় গিয়ে পকেট থেকে প্যাকেটটি বের করে এনেছে। আসলে সিগারেট বিক্রয় চৈতরামের উটকো ব্যবসা। ঠিকমতো নোটিস দিলে সে আপনাকে বলকান্ সবরনি সিগারেটও এনে দিতে পারে। ও-মাল শুধুমাত্র এম্বেসিগুলোর ক্যান্টিনে পাওয়া যায়।

আইন বলে, সরকারি চাকরির সঙ্গে সঙ্গে অন্য ব্যবসা করতে পারবে না। কিন্তু আপনি যখন পুরনো খবরের কাগজ বিক্রি করলে সরকার আপনাকে হুড়ো দেয় না, তখন চৈতরামের সিগারেট বিক্রিতে দোষ কী? কিছু না। আমি তাকে আশীর্বাদ জানাচ্ছি তার ব্যবসা বাড়ুক।

কিন্তু কেরানি এ ব্যবসা করতে পারে না। কে কত মাইনে পায়, একথা এখন আর তুলবেন না। সিগারেট বিক্রি করে এখন চৈতরাম কেরানির মাইনে ছাড়িয়ে গিয়েছে। এই হল আরম্ভ।

প্রায়ই আপনি লক্ষ করেন, দশটা থেকেই চৈতরাম টুলের উপর ঢোলে। তার মানে অবশ্য এ নয় যে, ডাকলে তার সাড়া পাবেন না। বরঞ্চ ঘন্টি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই সে দর্শন দেওয়াতে কখনও গাফিলতি করেনি। একদিন আমি তাকে শুধালুম, তার ইনসমনিয়া আছে কি না। সে মাথা নিচু করে ঘাড় নেড়ে শুধু জানালে, ‘না।’ হেড ক্লার্ক ওই সময় আমার ঘরে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর ঠোঁটের কোণে একটুখানি মৃদুহাস্যের রেখা দেখতে পেলুম। পরে তাঁকে শুধালুম, ‘ব্যাপারটা কী?’

নাহ্! চৈতরাম প্রতি রাত্রে অভিসারে বেরোয় না– যদিও তার যমুনা-পারে বাস এবং পিতৃপিতামহের সাবেক মোকাম বৃন্দাবন এবং মথুরার মাঝখানে। নাহ্! ‘বৃন্দাবনকে কুন্জ গলিয়ে শ্যামরিয়া কা দরসন’ ইত্যাদি যাবতীয় সমুদয় ব্যাপার সে মায়ের গব্ব থেকেই শুনে আসছে, ও-সব রোমানসে তার কোনও চিত্তদৌর্বল্য নেই।

সে করে অতিশয় গদ্যময়ী ব্যবসা। খবরের কাগজ বেচে। সাতটার ভেতর ওই কর্ম শেষ হয়ে যায় বলে সরকারি চাকরির সঙ্গে এতে ওতে কোনও দ্বন্দ্ব বাধে না। দুধের ব্যবসাও আটটার ভেতর শেষ হয়ে যায় বলে এককালে তা-ও করেছে। এখন নাকি ভাবছে, দুটোই কম্বাইন করা যায় কি না। চোর পালিয়ে যাওয়াতে বাবু তম্বি করে দরওয়ানকে পুছেছিলেন, ‘চোর ভাগা কিঁও?’ দরওয়ান বলল, “মেরা এক হাথ মে তলওয়ার, দুসরেমে ঢাল; পড়ে কৈসে?’ চৈতরাম তাকে ছাড়িয়ে যাবে। তার এক হাথমে দুধ, দুসরেমে পাইপর (পেপার) এবং সঙ্গে সঙ্গে সে নৌকরিকেও পাকড়ে ধরে থাকবে।

 এইবারে চিন্তা করুন, চৈতরামের আয় কতখানি বেড়ে গেল। কেরানি বেচারি তো আর সকালবেলা দুধ কিংবা খবরের কাগজ বিক্রি করতে পারে না। সমাজে মুখ দেখাবে কী করে? পারে টুইশানি করতে। কিন্তু সেখানকার কম্পিটিশন কীরকম মারাত্মক, সেকথা আপনারা না জানতে পারেন, আমি বিলক্ষণ জানি– বেকার হওয়ার পরের থেকে এই আট মাস ঘুরে ঘুরে একটাও যোগাড় করতে পারিনি। অধম কুলীন সন্তান– এর চেয়ে অনেক অল্পায়াসে পাঁচটি বিয়ে করতে পারতুম। চারটি আইনত ‘হিন্দু কোড-বিল’ আমার ওপর অর্সায় না।

হেড ক্লার্ক আপনাকে বললেন, ‘স্যার, আপনি যে চাপরাশিদের য়ুনিফর্মের জন্য দরদ নিয়ে পার্সনাল ইনট্রেস্ট নেন, সে বড় ভালো কথা। কিন্তু স্যার, এদের যুনিফর্ম ঘেঁড়ে সরকারি ফাইল এ-ঘর থেকে ও-ঘর নিয়ে যাবার সময় নয়, ছেড়ে বাইসাইকেলের সেডলে বসে দুধ বিক্রি করার ফলে। চাপরাশিদের পাতলুন দেখে বলে দেওয়া যায়, সকালবেলা কে কোন ব্যবসা করে।’

ভুলে গিয়েছিলুম, য়ুনিফর্মের সাফসুতরায়ের জন্য চৈতরাম সরকারের কাছ থেকে ‘ওয়াশিং অ্যালাওয়েস্’ পায়। অবশ্য একদিন ক্যাসওয়েল লিভ নিলে সেদিনের জন্য অ্যালাওয়েনসটি কাটা যায়। অ্যাকাউন্টেন্টের অর্ধেক সময় যায় পাঁচ টাকাকে একত্রিশ ভাগ করে দুই কিংবা তিন দিয়ে গুণ করার খেজালতি কর্মে– আপনাদের মোটা মাইনের হিসাব রাখতে নয়। এই ‘ওয়াশিং অ্যালাওয়ে’ শিটখানা ঠিকমতো টানতে পারেন ক’টি ঝানু। অ্যাকাউন্টেন্ট, তাই নিয়ে বিরাট বিরাট আলোচনা হয়ে গিয়েছে। একবার এক আনা, তিন কড়া, দুই ক্রান্তির গোলমালে আপিসসুদ্ধ সবাই অডিটার জেনারেলের কাছে কী হুড়োটাই না খেয়েছিলুম। শনিবার হাফ ডে অ্যাকাউন্টেন্ট হাফ ওয়াশিং চার্জ কেটেছিলেন বলে। কাগজের সম্পাদক যখন তাঁর স্তম্ভে বলেন, সরকারি পয়সার প্রতি আমাদের দরদ নেই তখন আমাদের প্রতি বড় অবিচার করেন। অবশ্য দামোদরে’ কত লক্ষ টাকা কোন দিকে ভেসে যায়, সেকথা আমি বলতে পারব না, তবে একথা আল্লার কসম খেয়ে বলব, বেহেস্তের দোহাই দিয়ে বলব, ‘তাঁবা-তুলসি-গঙ্গাজল’ স্পর্শ করে বলব, সরকারি নোকরি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পরও এই ‘ওয়াশিং শিটে’র দুঃস্বপ্ন দেখে এখনও মাঝে মাঝে ঘুম থেকে এক গা ঘেমে জেগে উঠি। গিন্নি জানেন। বুকে হাত বোলান আর শুরুদত্ত ‘ওয়াশিং-ওচাটন’ আওড়ান।

কেরানি ওয়াশিং অ্যালাওয়েনস পায় না। যুনিফর্ম যখন নেই তখন ওয়াশিং অ্যালাওয়েস্ হয় কী প্রকারে? শিশুবোধ ব্যাকরণ। অথচ তাকে ঠাট বজায় রেখে দফতরে আসতে হয়। বুশ শার্ট ইস্ত্রি না করা থাকলে বছরের শেষে তার কনফিডেনশিয়েল রিপোর্ট লিখি, শ্যাবি। আপনি হয়তো বলবেন, ‘ওই ওয়াশিং অ্যালাওয়েন্স আর ক পয়সা?’ বটে! ছ পয়সা হোক আর ছ গাই হোক– দেখুন না একবার রাস্তায় নেমে ছ পয়সা কামাতে কতক্ষণ লাগে।

ওই য-যা। ভুলে গিয়েছিলুম, বর্ষাকাল এসেছে–চৈতরাম বর্ষায় ছাতা আর বর্ষাতি পায়। মহামূল্যবান সরকারি সব ফাইল এ-দফতর থেকে ও-দফতরে নিয়ে যাবার সময় যদি ভিজে যায় তবেই তো চিত্তির– একদম অক্ষরার্থে।

কিন্তু কেরানি পায় না। যদিও সরকারি কাজেই তাকে এ-দফতর ও-দফতর করতে হয়– বগলে ফাইলও থাকে। কেরানিরা সচরাচর চাপরাশির ছাতা ধার চায়।

একবার এক কেরানি ছাতাখানা হারিয়ে ফেলে। চাপরাশি বলে ‘ছাতা কিনে দাও।’ সরকারি ফাইল বাঁচাবার প্রেমে নয়, দুধ বাঁচাবার জন্য। কেরানি বলে, সরকারি কাজে খোয়া গিয়েছে, ওটা রাইট অফ’ হবে। দুধের স্মরণে নাকি উপদেশ দিয়েছিল, ‘তা বেরোবার সময় দুধে জল দিসনি, বৃষ্টির জলে ওটা পুষিয়ে নিস।’ শেষটায় কী হয়েছিল, জানিনে। সি. সি. বিশ্বাস বলতে পারবেন! তখন আইনমন্ত্রী ছিলেন তিনি।

চৈতরাম শীতকালে কম্বল পায়। কেরানি পায় না। তার চামড়া বোধ করি গণ্ডার ব্র্যান্ড। সদাশয় সরকার বলতে পারবেন।

চৈতরাম কোয়ার্টারও পায়। একখান ঘর। একফালি বারান্দা। এক ডুমো উঠোন। ঘরখানা সে একজন রেফুজিকে পঁচিশ টাকায় ভাড়া দিয়ে তার প্রাণ বাঁচিয়েছে। সে চৈতরামের কাছে চিরকৃতজ্ঞ ও তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। চৈতরাম বারান্দায় শোয়, মাঝে-মধ্যে ওদের সঙ্গে নাশতা বখরায় খায়-টায়। চৈতরাম দু খানা ঘর পেলে বড় ভালো হত। একখানাতে সে মাথা গুজতে পারত বলে? উঁহু, দু খানাই ভাড়া দিতে পারত বলে। তাই চণ্ডীগড়ের নতুন ক্যাপিট্যালে তারা দু খানা ঘরের জন্য আবেদন-আন্দোলন চালিয়েছে। আমি সেই আবেদনে সানন্দে স্বাক্ষর নিয়েছি।

কোয়ার্টার কেরানিও পায়– যাদের সত্যকার মুরুব্বির জোর আছে। কিন্তু সেটা ভাড়া দিয়ে থাকবে কোথায়? মুশকিল।

এই তো গেল মোটামুটি জরিপ। তার ওপর পুজো-আর্চায় বখশিশটা-আসটা। কোনও জিনিস বড়সাহেবের জন্য কিনে আনলে তিনি কি আর চেঞ্জটা সবসময় ফেরত চান? কেরানি এসব রসে বঞ্চিত।

এই কাঁড়া কাঁড়া টাকা নিয়ে চৈতরাম করে কী?

ওই জানলেই তো পাগল সারে।

কেরানিদের সঙ্গে লগ্নির ব্যবসা করে। এটা সবিস্তার বর্ণনা করতে আমার বাবো-বাধো ঠেকছে। তবে এইটুকু বলতে পারি, কেরানিরা অসন্তুষ্ট নয়। এবং আপনি খুশি, মাসের পয়লা তারিখে কাবুলিওয়ালাদের দফতরের আনাচে-কানাচে ঘোরার কটু দৃশ্য দেখতে হয় না বলে। চাপরাশি ওদের ঠেকিয়ে রেখেছে!

জনৈক বন্ধু গল্পটি বলেছেন—

 আহম্মক জামাই শ্বশুরকে শোধাচ্ছে, ‘সসুরমশাই, সসুরমশাই, আপনার বিয়ে হয়েছে?’

 ‘হ্যাঁ।’ (মনে মনে, ‘ব্যাটা না হলে তুই বউ পেলি কোত্থেকে?’)

 ‘কার সঙ্গে, সসুরমশাই?’

 রাগত কণ্ঠে, ‘তোমার শাশুড়ির সঙ্গে।’

জামাই, গদ গদ কণ্ঠে, ‘আহাহা, ভালোই হয়েছে, ভালোই হয়েছে, ঘরে ঘরে বিয়ে হয়েছে।’

দফতরের ভেতর আপোসে এই ব্যবস্থা আপনার পছন্দসই হওয়ার কথা। চিন্তা করে দেখুন।

শুনেছি, একদম টপে উঠলে, অর্থাৎ মন্ত্রী-টন্ত্রী হয়ে গেলে নাকি অনেকরকম সুখ-সুবিধা আছে। অবশ্য চাপরাশিদের মতো টায় টায় এরকম নয়। তবে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। কোনও বিশেষজ্ঞ যদি সেটা বাতলে দেন তবে ঠিক আন্দাজ করতে পারব, দশ পার্সেন্ট উচ্ছুগগো করাতে তাঁরা কী পরিমাণ আত্মোৎসর্গ করেছেন।