চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ৯

নয়

দুপুরবেলা মধ্যাহ্ন আহারের আসরে এল একটা টেলিফোন। বিশে শুনে নিয়ে কর্ডলেস ফোনটা বাড়িয়ে ধরল বাসু-সাহেবের দিকে বললে, আপনের। ধরেন। নাম বুলছে না।

বাসু-সাহেব ছুরি ফর্ক প্লেটে নামিয়ে রেখে ‘নিস্তার’ টেলিফোনটা নিয়ে তার ‘কথামুখে’ শুধু বললেন, বাসু —?

ও-প্রান্তবাসী বলে, আপনার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইছি, স্যার, খুব জরুরি ব্যাপারে। আপনার চেম্বারে গিয়েই বলব। কখন আপনার সময় হবে বলুন?

—আপনার নাম? পরিচয়?

—সেটা সাক্ষাতেই বলব, স্যার। টেলিফোনে নয়।

—কেন? সেই যাঁরা ছুঁলে ছত্রিশ ঘা হয়, তেনারা কি আপনাকে খুঁজছেন?

–ঠিক তা নয়। তবে প্রায় সেই রকমই। একটা দুর্ঘটনায় মৃত…

—দুর্ঘটনায়! আর য়ু শ্যিওর? রেলওয়ে অ্যাকসিডেন্ট?

—ঠিক তাও নয়। তবে ঘটনাটা রেলগাড়ির কামরার ভিতরেই

—বুঝেছি। সেই যাকে বলে—’রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা, ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন…’

—আজ্ঞে?

—শুনুন মিস্টার মালহোত্রা, আপনি যদি আমাকে লিগ্যাল কাউন্সেলার হিসেবে রিটেইন করতে চান, তাহলে প্লিজ ডোন্ট কাম! আয়াম অলরেডি বুকড ফর দ্যা কেস।

—আই নো দ্যাট, স্যার। তা জেনেই আপনার সাক্ষাত চাইছি।

—এখন একটা কুড়ি। আপনি তিনটেয় আসতে পারবেন?

—পারব স্যার। আপনি দুপুরে…মানে, বিশ্রাম করেন না?

—করি। আপনারা অনুমতি দিলে। সো কাম অ্যাট থ্রি–লাইনটা কেটে দিলেন। রানু বলেন, রূপেশ মালহোত্রা? সে আবার কী চায়?

—সম্ভবত মোলাসেস্! আখের গুড়!

—আখের গুড়! তার মানে?

—’আখের’ গুছিয়ে নিতে যা প্রদেয়। ‘মধ্বাভাবে’! চাইছিল আমাকে রিটেইন করতে। যখন শুনল যে সে—মোল্যাসে-এ স্যান্ড’ তখন চাইছে প্রমাণ করতে ভাজা মাছের সে একটা পিঠই চেনে—ও পিঠটা ওর অচেনা!

কৌশিক বলে, সল্টলেক থেকে বলছিল। তাই না?

—কী জানি। জিজ্ঞেস করিনি। পুরীতে সৎকার করেছে পথের কাঁটাটাকে। সম্ভবত এখন প্রথামত পুলিসের গ্রেপ্তার এড়াতে চায়। দ্বিতীয়ত ধর্মপত্নীর উইলের প্রবেট।

রানু বলেন, ওভাবে বলছ কেন? হয়তো রূপেশ সম্পূর্ণ নির্দোষ!

বাসু বলেন, হতে পারে। কিন্তু ও যেভাবে টেলিফোনে আমাকে বোঝাতে চাইছিল যে এটা অ্যাকসিডেন্ট …

—তা নয়। টেলিফোনে হয়তো ও ‘মার্ডার’ শব্দটা ব্যবহার করতে চাইছিল না।

বাসু বললেন, তাও হতে পারে। তাই সে আমাকে ‘ডায়াল এম’ করছিল।

.

ঠিক কাঁটায়-কাঁটায় তিনটের সময় এল রূপেশ মালহোত্রা। বয়স চল্লিশের সামান্য কম বলেই মনে হয়। দীর্ঘ একহারা চেহারা মাথায় ব্র্যাকব্রাশ চুল। এখনো পাকতে শুরু করেনি। গোঁফ-দাড়ি কামানো। পরনে সাফারি স্যুট।

বিশে তাঁকে বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালো। বাসু ভিতরের দরজা দিয়ে চেম্বারে এসে বসলেন। তাঁর নির্দেশে বিশে ওঁকে এঘরে নিয়ে এল। বাসু বললেন, প্লিজ সিট ডাউন। বলুন এবার কী বলতে এসেছেন?

—আপনি আমাকে ‘তুমিই’ বলবেন, স্যার!

—অলরাইট। বল রূপেশ, কী বলতে চাও!

—আমি আজ জগন্নাথ এক্সপ্রেসে ফিরে এসেছি। এসেই শুনলাম, আপনাকে মিস্টার দস্তুর এনগেজ করে ফেলেছেন, না হলে…

—আই নো, আই নো! কিন্তু তোমাকে কি পুলিসে সন্দেহ করছে? এমন আশঙ্কা করার পিছনে কোনও যুক্তি আছে?

—আপনি তা ভালভাবেই জানেন, স্যার। কমলকলির মৃত্যুতে আনফরচুনেটলি আমিই সবচেয়ে লাভবান হচ্ছি…

বাসু ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘অ্যাডভার্ব’টা বেজায়গায় বসল না?

—আজ্ঞে?

—তুমি বোধহয় বলতে চাইছ, ‘কমলকলির আনফর্চুনেট মৃত্যুতে তুমিই সবচেয়ে লাভবান হচ্ছ’—তাই না?

—দুটোই সত্যি, স্যার! তাই পুলিশের চোখে আমি প্রাইম সাসপেক্ট। এ হত্যারহস্যে ডিফেন্স কাউন্সেল হিসাবে আমার প্রয়োজনটাই ছিল সবচেয়ে বেশি।

বাসু আবার হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, আর য়ু শ্যিওর? তোমার শ্বশুরের একান্ত সচিব পামেলা কাত্রোচ্চির নয়?

রূপেশ মুখ তুলে ওঁর চোখে চোখে তাকালো। পাঁচ সাত সেকেন্ড দেরি হল জবাবটা দিতে। তারপর অস্ফুটে বলল, আই ডোন্ট নো, স্যার।

—বাট য়ু ক্যান ভেরি ওয়েল গ্যেস্! কান্ট য়ু?

—আজ্ঞে, হ্যাঁ। সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমিও ভেবে দেখেছি। জে. ডি. সাহেব এবার হয়তো তাঁর মতটা বদলাবেন। হয়তো এখনই নয়, আঘাতটা সামলে ওঠার পর।

—’মত’ আর ‘পথটা বদল নাও করতে পারেন; কিন্তু উইলটা তাঁকে পালটাতেই হবে। নতুন ওয়ারিশ তাঁকে খুঁজে দেখতে হবে। কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে কেন? তুমি তো জানই, এ-’কেস’-এ তোমাকে ক্লায়েন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারব না।

রূপেশ মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর মুখ তুলে বললে, উড য়ু মাইন্ড, স্যার, ইফ আই স্মোক?

—সার্টেনলি নট! ফীল কাম্‌ফার্টেবল!

রূপেশ পকেট থেকে ইন্ডিয়াকিং সিগ্রেটের কার্টন বার করে একটা ধরালো তার লাইটারে। বললে, আপনি আমার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানেন না—আমি রেস খেলে বহু টাকা উড়িয়েছি, স্ত্রীর সঙ্গে আমার বনিবনাও হয়নি, আমরা ‘সেপারেশনে’ ছিলাম, এসব প্রাথমিক তথ্যগুলি ছাড়া আপনি আর কিছুই বিশেষ জানেন না। আমি কিন্তু আপনার সম্বন্ধে ‘থরলি’ ওয়াকিবহাল। আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, মক্কেলকে বাঁচাতে আপনি কায়দা করে কোনও নিরপরাধীকে ফাঁসির দড়ির দিকে ঠেলে দেবেন না। সেটা আপনার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ হবে। তাই আমি চাই : আপনি ‘কেসটা সভ্ করুন। আমি জানতে চাই—কে আমার স্ত্রীকে ট্রেনের কামরায় খুন করেছে। আমি জানতে চাই : কে আমার স্ত্রীকে প্রেমপত্র লিখে প্রলুব্ধ করত…

বাসু কথার মাঝখানেই বাধা দিয়ে বলেন, তার মানে? কমলকলিকে যে একজন প্রেমপত্র লিখত এ তথ্যটা তুমি আন্দাজ করলে কী করে?

—আন্দাজ নয়, স্যার। কংক্রিট প্রমাণ! ডকুমেন্টারি প্রুফ। সেগুলিই আপনার কাছে জমা দিতে এসেছি।

—অলরাইট। প্রসীড। কিন্তু সবার আগে বল, ঘটনার দিন—ওই ঊনত্রিশ তারিখ দুপুরে তুমি নিজে কোথায় ছিলে?

রূপেশ তৎক্ষণাৎ বলল, এ প্রশ্নটা কি প্রাসঙ্গিক, স্যার? অ্যাট-অল রেলিভেন্ট?

—নয়? হত্যামুহূর্তে তুমি কোথায় ছিলে এটা তো একটা মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সেটাই তোমার ‘অ্যালেবাই’।

—না, স্যার। সেটা পুলিসের মতে। আপনার তদন্ত অনুসারে নয়।

—কেন নয়?

—আপনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান! আপনি ভালভাবেই জানেন : রূপেশ মালহোত্রা যদি মূল আসামী হয়, তবে সে নিজে হাতে খুনটা করবে না। কারণ রূপেশ মালহোত্রার কাছে আট দশ লাখটাকার গহনা কিছুই নয়। তার স্থির লক্ষ্য : কমলকলির উইলবর্ণিত শেষপৃষ্ঠার : ‘শিডিউল অব প্রপার্টিজ’! যার মূল্যমান কয়েক কোটি টাকা। ফলে, রূপেশ মালহোত্রা যদি এ অপরাধের শীর্ষবিন্দুতে থাকে তবে সে প্রফেশনাল মার্ডারার নিয়োগ করবে। হত্যা মুহূর্তে থাকবে হত্যাস্থল থেকে বহু বহু দূরে। পাক্কা ‘অ্যালেবাই’ থাকবে তার। তাই নয়, স্যার?

বাসু বললেন, এ তো তোমার অ্যানালিসিস্। আমার প্রশ্নের জবাব তো দিলে না! ঊনত্রিশ দুপুরে তুমি বাস্তবে ছিলে কোথায়?

রূপেশ কিছুক্ষণ নীরব রইল। মাথা নিচু করে। তারপর হঠাৎ বাসু-সাহেবের চোখে চোখে তাকিয়ে বলল, এ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা কি আপনার উচিত হচ্ছে, স্যার?

বাসু বললেন, অলরাইট বল না তাহলে।

–ভেবে দেখুন, স্যার। আমি আপনার মক্কেল নই। আমি যা বলছি, যা বলব, তা কোনও ‘প্রিভিলেজড কম্যুনিকেশন’ নয়। মামলা আদালতে উঠলে আপনাকে প্রসিকিউশনের প্রশ্নের জবাবে বলতে হবে, আমি কী কী বলেছি। হত্যামুহূর্তে আমি কোথায় ছিলাম সে কথাও। আমি জানি, পুলিশ ইতিমধ্যে আমার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছে। তারা জানে, ঘটনার দিন ভোরবেলা আমি বাড়ি থেকে চলে যাই। ফিরে আসি রাত এগারোটায়। পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা করছে জানতে আমি ওই দুপুরে কোথায় ছিলাম। আমার কোনও পাক্কা ‘অ্যালেবাই’ আছে কি না। তাই নয়?

—অলরাইট! বোল না সে কথা। ঠিকই বলেছ তুমি। যেসব কথা তুমি এখন বলছ তা কোনো ‘প্রিভিলেজড কম্যুনিকেশন’ নয়। প্রয়োজনে তা আমাকে বলতে হবে পুলিসকে। সুতরাং ও প্রসঙ্গ থাক।

—না, স্যার! থাকবে না। সব জেনেবুঝেও আমি তা আপনাকে জানাব। আমি বিশ্বাস করব : আপনি তথ্যগুলি অযাচিতভাবে পুলিশকে জানাবেন না। প্রসিকিউশন যদি আপনাকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় তোলে তখন আপনি বলতে বাধ্য হবেন। সেটা জানি। তবু আমি বলব, ওই দিন ভোর পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত আমি কোথায় ছিলাম।

বাসু এবার নিজে থেকেই বাধা দিয়ে বলেন, থাক না? কী দরকার?

—দরকার আছে, স্যার! সবগুলো অ্যাভেইলে ডাটা আপনার হাতে পৌঁছানো দরকার। যাতে পর্যায়ক্রমে আপনি এ বিচিত্র সমস্যার সঠিক সমাধানে পৌঁছতে পারেন। আমি ঘটনার দিন ভোরবেলা বাড়ি থেকে বার হয়ে যাই। বেলা নয়টা পর্যন্ত কোথায় ছিলাম, কী করেছিলাম, তা আমি এখন বলছি না। তারপর আমি হাওড়া স্টেশনে চলে যাই, শুধুমাত্র একটা স্যুটকেশ নিয়ে। ফর য়োর ইনফরমেশন, স্যার আমি ওই ইস্ট কোর্স এক্সপ্রেস ট্রেনটা ধরে বালাসোর চলে যাই। আনরিসার্ভড সেকেন্ড ক্লাসে। আমি ওই ট্রেনেই ছিলাম।

রূপেশ যেন এক নিশ্বাসে কথাকটা বলে ফেলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। চুপ করে গেল একেবারে।

বাসু অবাক হলেন কি না, বোঝা গেল না। শান্তস্বরে প্রশ্ন করলেন, কেন রূপেশ? ওই ট্রেনে তুমি বালাসোর গেলে কেন?

রূপেশ বলে, আমারও নিমন্ত্রণ ছিল সেই ম্যারেজ-অ্যানিভার্সারিতে। প্রকাশ দস্তুর—মানে যার ম্যারেজ-অ্যানিভার্সারি ছিল—সে আমাকে পৃথকভাবে আমন্ত্রণ করেছিল। সামাজিক দৃষ্টিতে কমলকলির স্বামী আমি। প্রকাশ জানে যে, আমাদের সেপারেশন চলছে। কিন্তু প্রকাশের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বও হয়েছিল আমাদের বিয়ের পরে। ফলে, সে আমাকে ও সল্টলেকের ঠিকানায় নিমন্ত্রণপত্র পাঠায়। সম্ভবত সে আন্তরিকভাবে চাইছিল যাতে আমাদের দুজনের মনোমালিন্যের অবসান হয়। কলি বা জে.ডি জানতেন না আমার নিমন্ত্রিত হবার কথা গত মাস ছয়েক আমি লাউডন স্ট্রিটে দস্তুর প্যালেসে যাইনি। ভেবেছিলাম, বালাসোরে কলিকে কয়েকটা কথা বলব। সে জন্যই ওই সুযোগটা নিই। আমার ধারণা ছিল, ওঁরা দুজন ফার্স্ট ক্লাস ‘কূপে’তে যাচ্ছেন। তাই ভেবেছিলাম, বালেশ্বর স্টেশনে ওঁদের মীট করব। ট্রেনটা যখন বালাসোর স্টেশনে ‘ঈন’ করল তখন আমার কামরাটা পড়েছিল ঠিক এক্সিট ডোরের সামনে। আমি চট করে নেমে প্রস্থান পথের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। দেখতে পাই, প্রকাশ নিজেই এসেছে ওঁদের রিসিভ করতে। সে ছোটাছুটি করছে প্ল্যাটফর্মে। ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টগুলোয় সে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করল। জে. ডি বা কমলকলির দেখা পেল না। ট্রেনটা ছেড়ে দিল। প্রকাশ হতাশ হয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমি সবটাই দেখলাম। আত্মপ্রকাশ করলাম না।

বাসু জানতে চাইলেন, কেন?

—বেশ বুঝতে পারলাম, যেকোন কারণেই হোক ওঁরা এ ট্রেনে আসেননি। আমি কলকাতায় ফিরে আসতে চাইলাম। ইনফ্যাক্ট, পরের একটা প্যাসেঞ্জার ধরে আমি খড়গপুরে চলে আসি। সেখান থেকে এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে কলকাতায়। হাওড়া থেকে আমি দস্তুর প্যালেসে ফোন করেছিলাম। ফোন ধরেছিল কোনও একজন বেয়ারা। সে জানালো, জে. ডি. বাড়িতে নেই আর কলি বালাসোরে চলে গেছে। ওই সকালের ট্রেনেই। আমি তাকে নিজের পরিচয় দিইনি।

—বুঝলাম। কিন্তু প্রকাশের কাছে কেন তুমি আত্মপ্রকাশ করলে না?

—সহজবোধ্য হেতুতে। দেখতে পেলে সে আমাকে ওদের বাড়িতে জোর করে ধরে নিয়ে যেত। যেটা আমি অ্যাভয়েড করতে চাইছিলাম। কলির সঙ্গে দেখা করতেই আমি বালাসোরে গিয়েছিলাম। পার্টিতে যোগ দিতে নয়।

বাসু জানতে চান, তুমি কি তার আগেই জানতে যে, কমলকলিকে কেউ প্রেমপত্র লেখে বা তার সঙ্গে কারও একটা অবৈধ প্রণয়ের পর্যায় চলছিল?

—না, স্যার। সে কথা তখন আমি জানতাম না।

—তাহলে কখন জানলে এবং কেমন করে জানলে?

রূপেশ ব্যাখ্যা দেয়। কমলকলির মৃত্যু সংবাদ সে তার মোবাইল ফোনেই পেয়েছিল। পরদিন সে গাড়ি নিয়ে ভুবনেশ্বরে চলে যায়। যাবার আগে জে.ডি. কে একটা ফোন করে। তাঁকে ফোনে ধরতে পারে না। তিনি বাড়ি ছিলেন না। তবে পামেলার সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়। জানতে পারে যে, মর্মান্তিক দুঃসংবাদটা ও বাড়িতে সকলেই জানে। রূপেশ পামেলাকে জানায় যে, সে গাড়ি নিয়ে ভুবনেশ্বরে চলে যাচ্ছে দেহটা শনাক্ত করতে। সংবাদটা যেন জে. ডি. কে জানানো হয়।

রূপেশ বলে, আপনাকে স্যার আমি দুটি তথ্য দেব। যে কথা আপনাকে মিস্টার নিখিল দাশ জানাতে পারেননি। ইন ফ্যাক্ট, তা তিনি নিজেও জানেন না। আপনিও না। আমি আপনার মক্কেল নই। তবু এ দুটি তথ্য আপনাকে সরবরাহ করছি গোপনে। আমি চাই না, আপনি অপ্রয়োজনে তা জে. ডি. বা পুলিসকে জানান

—কী তথ্য?

—আপনি সেটা গোপন রাখবেন তো? প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন?

বাসু বললেন, লুক হিয়ার ইয়াংম্যান! এটা একটা মার্ডার কেস। কোনো এভিডেন্স – যা সমাধানের পথের ইঙ্গিত দিচ্ছে—তা আমি জেনে গোপন রাখতে পারি না। অ্যাজ অ্যান অফিসার অব দ্য হাইকোর্ট! তুমি আমাকে ওসব কথা তাহলে বোল না।

—না, স্যার! আমি আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না। আমি যে তথ্যগুলি দিচ্ছি তা জে. ডি. জানেন না। ক্যালকাটা পুলিসের নিখিল দাশও জানেন না। কিন্তু উড়িষ্যা পুলিস জানে। ইন ফ্যাক্ট, আমি তা জেনেছি এস. আর. পি. ভুবনেশ্বরের কাছে থেকে।

—য়ু মিন সুপারিন্টেডেন্ট অব রেলওয়ে পুলিস, ভুবনেশ্বর?

—ইয়েস স্যার! তিনিই আমার মোবাইল ফোনে আমাকে দুঃসংবাদটা জানান। তাঁর উপস্থিতিতেই আমি মর্গে গিয়ে মৃতদেহ শনাক্ত করি। তাঁর কাছ থেকে এ দুটি গোপন তথ্য আমি জেনেছি। প্রয়োজনে আপনি তাঁকে এস. টি. ডি করে জেনে নিতে পারেন আমি সত্যকথা বলছি কি না।

—তিনি জানেন, অথচ নিখিল দাশ জানে না? হাউ কাম?

—আমিই তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম তথ্য দুটি মৃত মহিলার স্বার্থে গোপন রাখতে। আমি তাঁকে বলেছিলাম, ক্যালকাটা পুলিস চলে পার্টির নির্দেশে। আর পার্টি চলে বিজনেস্ ম্যাগনেটদের নির্দেশে। ফলে, তথ্য দুটি গোপন থাকবে না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়ে যাবেই। তাতে লাভ হবে না কারও। শুধু শুধু একটি মৃতা মহিলার কেচ্ছাকাহিনীতে খবরের কাগজ মজা লুটবে। দুর্ভাগিনীর শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাবার আগেই এই মুখরোচক কেচ্ছাটা মুখে মুখে ফিরবে।

বাসু জানতে চান, এস. আর. পি, ভুবনেশ্বর রাজি হলেন?

—হলেন। বললেন, মৃতা মহিলাটি বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হয়েছে উড়িষ্যায়। এক্ষেত্রে কেসটা উড়িষ্যা হাইকোর্টের এক্তিয়ারভুক্ত। তিনি তাঁর রিপোর্টে তথ্য দুটি গোপন রাখবেন না; কিন্তু আমার অনুরোধে ক্যালকাটা পুলিসকেও অযাচিত জানাবেন না।

—আই সি। তথ্য দুটি কী?

—কলির হ্যান্ডব্যাগে একটা ছোট্ট নোট বই ছিল। টেলিফোন নম্বরের রেডি-রেকয়নার। তাতেই আমার মোবাইল নম্বরটা এস. আর. পি. খুঁজে পান ও আমাকে ফোন করেন। উনি আমাকে সেটি দেখান। আমি সেটা পকেটে পোরার উপক্রম করতেই ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বলেন, “নো, নো, স্যার! ওটা এভিডেন্স! আপনাকে দেখতে দিয়েছিলাম শুধু। প্রত্যর্পণ করছি না।” তখন আমি বললাম, “এই খাতায় আমার স্ত্রীর অনেক বান্ধবীর নাম-ঠিকানা ও টেলিফোন নাম্বার আছে। যা আমার জানা নেই। অথচ কলির শ্রাদ্ধে তাঁদের নিমন্ত্রণ করতে হবে। আমি কি নাম ঠিকানাগুলি টুকে নিতে পারি?” উনি তাতে আপত্তি করলেন না। আমি গোটা পঞ্চাশ নামের তালিকা বানিয়ে ফেললাম। নোট বইটা ফেরত দিলাম। এই নিন স্যার, সেই লিস্টের একটা জেরক্স কপি

বাসু তালিকাটি হাত বাড়িয়ে নিলেন। টেবিলের উপর কাগজচাপার তলায় রাখলেন। বললেন, দ্বিতীয়টা?

রূপেশ সে কথার জবাব না দিয়ে বলে, ওই লিস্টের প্রথম পাতাতেই একটি মুসলমানের নাম দেখতে পাচ্ছেন : ‘আলী’? লোকটাকে আমি চিনি না। তবে সেটা কিছু অবাক করা খবর নয়। আমার অনেক বন্ধু-বান্ধবীকেও কলি চিনতো না। কিন্তু আপনি লক্ষ্য করে দেখুন, স্যার ওই এন্ট্রিটি বেশ কিছু মিস্টিরিয়াস্! তাই নয়?

বাসু জবাব দিলেন না। কাগজটা তুলে নজর করলেন। প্রথম দিকেই ‘A’-এন্ট্রিতে লেখা আছে “Ali 0119734270”।

–কী মনে হয় স্যার? ‘আলী’ নামের কোনো ভদ্রলোকের মোবাইল নম্বর?

—হতে পারে। অথবা নিউ দিল্লির কোনো টেলিফোন নম্বরও হতে পারে, কারণ দিল্লির জোনাল কোড নম্বর ‘011’–হয়তো বাকি সাতটা নম্বর আলীসাহেবের টেলিফোনের।

রূপেশ বলল, আমারও তাই আন্দাজ হয়েছিল। তাই আজ খুব সকালেই ওই নম্বরে একটা এস. টি. ডি করেছিলাম। জবাব পেলাম : এ নম্বরটায় কেউ থাকে না। দ্য নম্বর ডাজ’ন্ট এগজিস্ট!

বাসু বলেন, বুঝলাম। কিন্তু এতে মিস্ট্রির কী দেখলে? হয়তো অনেক পুরানো নম্বর। আলী এ নম্বর ছেড়ে দিয়ে গেছে!

—না, স্যার। ‘আলী’ নয়। লোকটা মুসলমানই নয়। হিন্দু। ওর ছদ্মনাম ‘অলি’।

—কী করে জানলে?

রূপেশ নিঃশব্দে তার পকেট থেকে বার করে দিল একটা খাম। ইতিপূর্বে দৃষ্ট একই হস্তাক্ষরে লেখা ছোট্ট চিঠি :

284

কলি, আমার কলি,

প্লীজ, বালাসোরে তুমি যেও না। একেবারে শেষমুহূর্তে হঠাৎ (ভগবান না করুন) তোমার স্টম্যাক আপসেট তো হতেই পারে। পারে না? জে. ডি. তখন একাই যেতে বাধ্য হবেন। তিনি রওনা হয়ে গেলেই আমাকে হোটেলে ফোন কর। বাদবাকি আমার দায়িত্ব।…সকাল থেকে তোমাকে দুবার ফোন করি। প্রথমবার ধরেন জে. ডি স্বয়ং। তৎক্ষণাৎ লাইন কেটে দিই। দ্বিতীয়বার টেলিফোন ধরে তোমার সেই ভেটকিমুখো কম্পানিয়ান—কী যেন নাম, ভুলে গেছি। আমি যতবার জানতে চাই, ‘মিসেস মালহোত্রা আছেন?’ ততবারই সে জবাব দেয়, ‘আপনি কে বলছেন?’ বোঝ সেই ভেটকিমুখোর অবস্টিনেসি! আমি কি বলব যে, আমি তাঁর মালকিন কমলকলির চারপাশে ঘুরঘুর করা মুগ্ধ ভ্রমর? আমি টেলিফোন করতে পারছি না। তুমি কর। কেমন?

পাঠান্তে বাসু বললেন, এটা তো জেরক্স কপি। মূল কাগজখানা কি ছিল গোলাপী রঙের? আর কালীটা নীল?

রূপেশ অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?

বাসু সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করেন, আর নোট বইয়ে আলীর ওই নাম নম্বরটা? সেটা কি ছিল একই কালিতে লেখা?

রূপেশ স্বীকার করল তা ওর মনে নেই। সে লক্ষ্য করে দেখেনি।

বাসু জানতে চান, বালাসোর স্টেশনে তুমি সোমা হাজরাকে দেখতে পাওনি? মানে, কলির সেই ভেটকিমুখী কম্পানিয়ানকে?

—আজ্ঞে না! আমি অন্য কোনো যাত্রীর দিকে নজরই করিনি। স্টেশনে বেশ ভিড়ও ছিল। আমি প্রকাশকে নজরে রেখেছিলাম। জে. ডি. আর কমলকলিকেই খুঁজছিলাম।

বাসু জানতে চান, এই মুগ্ধভ্রমর ‘অলি’টি কে তা আন্দাজ করতে পার?

জবাবটা দিতে একটু দেরি হল রূপেশের। গুছিয়ে নিয়ে বলল, একটি মৃতব্যক্তির সম্বন্ধে কথাটা বলা বোধহয় শোভন হচ্ছে না। বাট ইট্স্ এ মার্ডার কেস! আপনাকে সব কথাই বলা উচিত। দেখুন, কলি কিছু ধোওয়া তুলসীপাতাটি ছিল না। প্রাকবিবাহ জীবনে তার একাধিক প্রেমিক ছিল। সুতরাং ‘অলি’ যে কে তা নিশ্চিত করে বলতে পারি না-

—নিশ্চিত করে তো বলতে বলছি না। এনি ওয়াইল্ড গ্যেস্?

—হ্যাঁ। সেক্ষেত্রে আমার সন্দেহ লোকটার নাম বিক্রমজিৎ সিং। আমাদের বিয়ের আগে বেশ কিছুদিন কলি ওই বিক্রমজিতের সঙ্গে স্টেডি ডেটিং করছিল। তারপর জে. ডি.-র হুড়ো খেয়ে লোকটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আমাদের বিয়েতে সে নিমন্ত্রিত হয়েছিল কি না জানি না—আমি কলিকে কোনদিন প্রশ্ন করিনি, কিন্তু সে আসেনি। না দিল্লিতে, না পরে কলকাতার তাজবেঙ্গলের পার্টিতে। তবে লোকটা সম্প্রতি আবার ঘুরঘুর করতে শুরু করেছিল। আমাদের সেপারেশনের পর থেকেই। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সে কলকাতার হোটেল ‘রাতদিনে’ সাতদিন ছিল। ঊনত্রিশ তারিখে—অর্থাৎ ঘটনার দিন সকালে আটটা নাগাদ হোটেল থেকে চেক আউট করে কোথাও চলে যায়। কোনো ফরওয়ার্ডিং অ্যাড্রেস না রেখে।

–এ তথ্য তুমি জানলে কেমন করে?

রূপেশের হাসিটা ম্লান দেখালো। বললে, আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদ প্রায় অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। ফলে, ওর গতিবিধির উপর নজর রাখতে আমি একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে নিযুক্ত করেছিলাম। কলি যদি বেমক্কা খুন হয়ে না যেত তাহলে ডিভোর্স-কেস-এ একটা মানি সেমেন্টের প্রশ্ন উঠতই। তখন এসব তথ্য আমার কাজে লাগত।

বাসু বলেন, বুঝলাম। তা তুমি আমার কাছে ঠিক কী চাইছ বল তো?

—আপনি খুঁজে বার করুন! কে; কেন কলিকে এভাবে খুন করল! শুধুই গহনার লোভে? না কি আরও বড় কোন লাভের আশায়? দ্বিতীয়ত, আমার পরলোকগতা স্ত্রীকে কে ‘সিডিউস্’ করছিল?

—আর আমার সমাধান যদি বলে : না! গহনার লোভে কেউ কলিকে খুন করেনি! করেছে আরও কোনও বড়জাতের প্রাপ্তির লোভে? আমার সমাধান যদি বলে : এসব চিঠি জাল! হত্যাকারী এগুলি সৃষ্টি করেছে হত্যাপরাধ ‘অলি’ নামের একজনের স্কন্ধে চাপিয়ে দিতে? সে ক্ষেত্রে?

–কে এমন লোক হতে পারে? একটা সম্ভাব্য নাম বলুন?

বাসু ওর চোখে চোখে তাকিয়ে বলেন : রূপেশ মালহোত্রা!

তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াল রূপেশ। বললে, গুড বাঈ স্যর! বেস্ট অব ল্যাক!