চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ৮

আট

ঠিক দুদিন পর ভোরবেলা এল নিখিলের টেলিফোন। বাসু-সাহেব তখনো প্রাতঃভ্রমণ থেকে ফিরে আসেননি। রানুই ফোনটা ধরলেন। নিখিল বলল, খড়্গাপুর থেকে বলছি, মামিমা। আমি ঘণ্টা-তিনেকের মধ্যে কলকাতায় ফিরব। সরাসরি আপনাদের বাড়িতে যাব। স্যার যেন আমার জন্য বাড়িতেই অপেক্ষা করেন। অ্যারাউন্ড বেলা দশটায়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্ৰহ করেছি। সাম ভেরি ভাইটাল ক্লুজ।

রানু বলেন, বলব। দশটার সময় উনি বাড়িতেই থাকবেন। কিন্তু তুমি বাপু কাকলিকে একটা ফোন করে জানিয়ে দিও। সে বেচারিও ব্যস্ত হয়ে আছে।

নিখিল হেসে ফেলে। টেলিফোনেই বলে, ঠিক আছে, মামিমা। তাকেও জানিয়ে রাখব। আমি বাড়ি না ফিরে সরাসরি নিউ আলিপুরে গেলে সে রাগ করবে না।

নিখিল এসে পৌঁছলো ঠিক দশটা দশে। বেচারি মুখ খুলবার আগেই রানু জানতে চান, ব্রেকফাস্ট হয়েছে? না কি নাওয়া-খাওয়া ভুলে দৌড়াদৌড়ি করছ?

নিখিল বলে হ্যাঁ, কিছু খাব মামিমা। খিদে পেয়ে গেছে। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি।

—তাহলে বাইরে গিয়ে তোমার ড্রাইভারকেও বলে এস। সে যেন দোকানপাটে না দৌড়ায়। সে বেচারির জলখাবারও বিশুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বাসু নিখিলকে আহ্বান করে বললেন, এস এস মিস্টার দাশ, অব খুনখারাপি বিভাগ।

নিখিল হাসতে হাসতে বলে, ‘খুন-খারাপি বিভাগটা কি ‘হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের বঙ্গি করণ?

বাসু বলেন, কী জানি বাপু। ঠিক মতো বঙ্গিকরণ হল কি না তা ওই কাঁটা-সিরিজ লেখক এঞ্জিনিয়ার-সাহিত্যিক বলতে পারে। কিন্তু তোমার মুখচোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তোমার অনুসন্ধান কার্য অনেকটাই সাফল্য লাভ করেছে।

—তা বেশ কিছুটা সফলতা লাভ করা গেছে, স্যার। সে সব বলছি, কিন্তু তার আগে বলুন এ দুদিনে আপনার তরফে কিছু খবর জমেছে?

—জমেছে! এ দুদিনে হাফ-এ বল শিভ্যাস্ রিগ্যাল খতম্ হয়েছে। বেশ কয়েক পাউচ তামাকও ধোঁয়া হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আমি তো ঘর ছেড়ে আদৌ বার হইনি। তবে চিন্তাভাবনা করেছি। একটা সলুশানের দিকে কিছু ইঙ্গিতও পেয়েছি।

ইতিমধ্যে বিশু একটা ট্রেতে খাবার আর এক পেয়ালা কফি এনে নামিয়ে দিয়েছে নিখিলের সামনে। কফির পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে নিখিল বললে, বেশ, তাহলে আমার সংগৃহীত তথ্যগুলিই শুনুন।

বাসু হাতটা তুলে ওকে থামতে বলেন, আরে অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? কফিটা শেষ কর। আমিই দেখি তোমার সংগৃহীত তথ্যগুলো গ্যেস করতে পারি কি না।

—আপনিই আন্দাজ করবেন? অল রাইট। করুন।

বাসু একটু চিন্তা করে বলেন, আমার মন বলছে—এক নম্বর, তুমি ওই মার্ডার ওয়েপানটা খুঁজে পেয়েছ। ছোরাটা। তাতে রক্তের দাগ কালো হয়ে গেছে। হোক কালো, তা কিন্তু হিউম্যান ব্লাড! অ্যাম আই রাইট?

কফির কাপটা নিখিল ধীরে ধীরে টেবিলে নামিয়ে রাখল। তার চোখে বিস্ময়। সে কিছু বলতে যেতেই বাসু বাধা দিয়ে বলেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও নিখিল। আমার বলা শেষ হয়নি। তুমি সেটা আবিষ্কার করেছ ভদ্রকের পরে এবং যাজপুর কেওনঝড় রোডের আগে। রেল লাইনের ধারে। তাই না?

সম্মোহিতের মতো বাসুর দিকে তাকিয়ে নিখিল বললো, সাতাশ কিলোমিটার ফ্রম ভদ্রক স্টেশন, কিন্তু …

—আরে দাঁড়াও না বাপু। অত তাড়াহুড়ো কর কেন। বুড়ো মানুষটাকে একটু দম ফেলতে দেবে না? ভাল কথা, ভদ্রক স্টেশনে সেই ভেন্ডারটাকে খুঁজে পেয়েছ?

—কিসের ভেন্ডার?

—তা তো বলতে পারব না। চা-কফি, স্ন্যাকস্, মেঠাইওয়ালা অথবা বুক সেলার। সেই যে গো, সেই লোকটা—যে, মিসেস মালহোত্রাকে জানলার ধারে বসে থাকতে দেখেছিল। তাকে তার সওদা বিক্রি করে। তার দেখা পাওনি? তাজ্জব!

নিখিল যেন প্রতিধ্বনি করে, তাজ্জব! আপনি এখানে বসে তা কেমন করে জানলেন?

—ইন মাই য়ুজুয়াল ওয়ে! মস্তিষ্কের গ্রে-সেলগুলোর সাহায্যে। এবার বল, লোকটা কী বেচেছিল কমলকলিকে? চা, কফি, পাকৌড়া না পুরী তরকারি?

নিখিলের হতভম্ব ভাবটা তখনো কাটেনি। সে শুধু বলল, আজ্ঞে না, সে লোকটা ছিল ম্যাগাজিন-ভেন্ডার। মিসেস মালহোত্রা তার কাছ থেকে একটা ‘ডেবনেয়ার’ আর একটা ‘স্টার ডাস্ট’ ম্যাগাজিন কিনেছিলেন।…

—আর তার হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোড়ানি তুম্ রাখ্ দো’। অ্যাম আই করেক্ট?

নিখিল কোনো জবাব দিল না। বজ্রাহতের মতো বাসু-সাহেবের দিকে তাকিয়ে স্থাণুর মতো বসে থাকে।

—কী হল? নিখিল?

সম্বিত ফিরে পায় নিখিল। বলে, প্লেন্ডিড! আপনি কী করে জানলেন?

সুজাতা ঝুঁকে পড়ে নিখিলকে প্রশ্ন করে, কী নিখিলদা? ভেন্ডারটা আপনাকে তাই বলেছিল? মিসেস্ মালহোত্রা তাই বলেছিল ভেন্ডারটাকে? ‘তোড়ানি তোম রাখ দো?”

একটিমাত্র শব্দে স্বীকার করল ইন্সপেক্টার নিখিল দাশ : ভাবাটিম!

সপ্তরথী একসঙ্গে আক্রমণ করে বাসু-সাহেবকে, বলুন? কেমন করে এখানে বসে এই ম্যাজিক দেখালেন?

বাসু মুচকি হেসে কৌশিকের দিকে ফিরে বললেন, এসব তো এলিমেন্টারি, না কি বল ভাগ্নে? চাঁপা রঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ি পরা একটি ভদ্রমহিলা এছাড়া আর কী বলতে পারেন?

ওরা কেউ কিছু বলতে পারে না।

রানু হাসতে হাসতে বলেন, নিখিল তোমার কফিটা একেবারে জুড়িয়ে যাচ্ছে যে?

নিখিল এদিকে ফিরে বলে, কী করব মামিমা? একপেট ঘোল খাবার পর কফি কি খাওয়া যায়?

বাসু প্রশ্ন করেন, পোস্ট-মর্টাম রিপোর্ট কি পাওয়া গেছে? ডাক্তার কি বলতে পারছেন খুনটা কখন হয়েছে?

নিখিল বলে, বলব না! কেন? সেটাও আপনি মন্ত্রবলে জানতে পারেননি?

একেবারে যে কোন আন্দাজ করতে পারিনি তা নয়! পোস্ট-মর্টাম রিপোর্ট অনুযায়ী মৃত্যুর সময় বেলা চারটে থেকে ছয়টা। মানে সায়েন্টিফিকালি তাই হবার কথা। সেফসাইডে থাকবার জন্য অটোপ্সিসার্জেন হয়তো চারটের বদলে বলেছেন তিনটে থেকে ছয়টা! মিলল সময়টা?

নিখিল জবাব দিল না। নিঃশব্দে খাবারের প্লেটটা টেনে নিয়ে আহারে মন দিল। সুজাতা তাগাদা দেয়, কী হল নিখিলদা? পোস্ট-মর্টাম রিপোর্ট অনুযায়ী সময়টা তাই?

নিখিল অমলেট চিবাতে চিবাতে বললে, স্যার শুধু ঘোল খাইয়েই আমাকে রেহাই দিলেন না। মাথায় গাধার টুপিটাও পরিয়ে ছাড়লেন। আশ্চর্য! কী করে হয়?

কৌশিক শুধু বললে, কী? ফোর টু সিক্স? না থ্রি টু সিক্স?

তার দিকে তাকিয়ে নিখিল বললে, বেলা সাড়ে তিনটে থেকে ছয়টা! মিরাকুলাস্!

কৌশিক এদিকে ফিরে কী বলতে গেল। শুধু ‘মামু’ বলামাত্রই তিনি বলে ওঠেন, কী আশ্চর্য! এতে অবাক হবার কী আছে? ভদ্রক স্টেশনে কমলকলি জীবিতা ছিল। কারণ স্টেশন-ভেন্ডার তাকে দেখেছে। রেলের খতিয়ান অনুযায়ী ইস্ট-কোস্ট এক্সপ্রেস তখনো অন-ডট চলেছে। তাহলে বেলা চারটে দশ পর্যন্ত কমলকলি জীবিত ছিল! কেমন? এটা ফ্যাক্ট! প্রুভড? এদিকে জগদ্বন্ধু পট্টনায়ক যখন ‘সি’-টাইপ কম্পার্টমেন্টে কুলি নিয়ে ঢোকে তখনো ট্রেন রাইট টাইম। তখন সন্ধ্যা ছয়টা সতের আঠারো। কারণ ছ’টা পনেরয় ট্রেনটা ইন করেছে। তার আগেই কমলকলি মারা গেছে। এই গ্লেয়ারিং এভিডেন্স হাতে থাকাতে পোস্ট মর্টাম রিপোর্টে তোমরা কী আশা করেছিলে? ডাক্তার বলবে—সকাল দশটা থেকে রাত আটটা?

নিখিল বলে, না স্যার। আপনার যুক্তিটা দাঁড়াচ্ছে না। যে ডাক্তার পোস্ট মর্টেম করেছেন তিনি আদৌ জানেন না, যে, ভদ্রক স্টেশনে একজন ভেন্ডার মিসেস্ মালহোত্রাকে জীবিত অবস্থায় দেখেছে। সেটা আপনি-আমি জানি। তিনি জানেন না।

বাসু বলেন, বটেই তো! ডাক্তারবাবু শবব্যবচ্ছেদ করে তা বিজ্ঞানসম্মত পথেই ‘সত্যের কাছাকাছি এসে পৌঁছবেন। তাই তিনি এসেছেন। আমরা জানি, মৃত্যুর সময় চারটে দশ থেকে ছয়টা-সতেরর ভিতর—ফ্রম আদার এভিডেন্স। ডাক্তারবাবু একই সত্যে উপনীত হয়েছেন নিহত মহিলার দেহ ব্যবচ্ছেদ করে ডাক্তারী বিজ্ঞানে।

নিখিল এ তথ্যটা মেনে নিল। সে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। ছোরাটা ঠিক কোথায় পাওয়া গেল অথবা ভেন্ডারের সঙ্গে কমলকলির কথোপকথনের বিষয়ে সে আর ফিরে গেল না। বললে, বেশ বোঝা যাচ্ছে খুনটা হয়েছে ট্রেনটা ভদ্রক ছাড়ার ঠিক পরেই। শুধু পোস্ট- মর্টাম রিপোর্ট নয়, মার্ডার ওয়েপনটার অবস্থানও সে কথা এস্ট্যাবলিশ্ করছে! অলমোস্ট হান্ড্রেড পার্সেন্ট চান্স, লোকটা নেমে যায় বাজপুর-কেওনঝড় স্টেশনে—বিকাল চারটে পঞ্চান্নে। আমরা সে স্টেশনেও খোঁজ করেছি। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারেনি। কী বলবে? লোকটা নিশ্চয় রক্তমাখা অবস্থায় ট্রেন থেকে নামেনি। হয়তো তার গায়ে একটা আলোয়ান জড়ানো ছিল—রক্তের দাগ যদি তাতে লেগে থাকে তবে তা ঝোলার ভিতর নিয়ে সে টুক করে ট্রেন থেকে নেমে পড়েছে।

কৌশিক বলে, তার মানে লোকটা যাজপুর-কেওনঝড় রোড থেকে ডাউন ট্রেন ধরে ফিরে আসে?

—যদি অ্যাট অল কলকাতায় ফিরতে চায়। চাক বা না চাক বর্তমানে যে ভারতবর্ষের প্রায় একশ কোটি লোকের মধ্যে এখন অচিহ্নিত একজন!

তারপর একটা নোটবই দেখে দেখে বলে, লোকটা যখন যাজপুর নামে সেই সময় ডাউন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল বৈদ্যনাথধাম এক্সপ্রেস। পুরী থেকে পাটনা যাচ্ছিল, খড়্গপুর হয়ে। সম্ভবত সে তাতেই চড়ে বসে—তাড়াতাড়ি যাজপুর স্টেশন ত্যাগ করার প্রেরণায়। মৃতদেহটা তো যে-কোন মুহূর্তে আবিষ্কৃত হতে পারে। তারপর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দু-দুটো লোকাল ডাউন ট্রেন পাস করে। সন্ধ্যা সাতটার কাছাকাছি এসে পড়ে তিরুপতি-হাওড়া এক্সপ্রেস। অবশ্য ইস্ট-কোস্ট যাজপুর স্টেশন ছেড়ে চলে যাবার পর লোকটার আর কোনো তাড়াহুড়া ছিল না।

সুজাতা বলে, কেন থাকবে না? সে তো শুধু একটা রক্তমাখা চাদরই লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল না, তার কাছে ছিল দশ লাখ টাকার অর্নামেন্টস্।

নিখিল বলে, তা বটে!