চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ৭

সাত

ফেরার পথে গাড়িতে সুজাতা প্রশ্ন করে, বিক্রমজিতের চিঠিখানার কথা আপনি জানলেন কী করে?

—সেটাই বা কী করে?

—জানতাম না তো। আন্দাজ করেছিলাম।

—হিউম্যান সাইকোলজি। হত্যাকাণ্ডের প্রাইম সাসপেক্ট রূপেশ মালহোত্রা। পুলিসও তাই ভাবছে। দস্তুরও। কলির সঙ্গে তার লিগ্যাল ডিভোর্স হয়নি। রূপেশ মৃত কমলকলির স্বামী। উইল মোতাবেক তার ওয়ারিশ। হত্যাপরাধে সে যদি সাজা না পায়, আর উইলের এক কপি যদি তার কাছে থেকে থাকে তাহলে কমলকলির যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি সে সহজেই দখল করবে। দস্তুর—উইথ অল হিজ হাফিং অ্যান্ড পাফিং কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু রূপেশকে ফাসাবার জন্য আমার সাহায্যের প্রয়োজন নেই। পুলিসই তা করছে এবং করবে। তাহলে দস্তুর তড়িঘড়ি আমাকে ডেকে পাঠালো কেন? তার কাছে এমন কিছু ক্লু নিশ্চয়ই আছে, যা সে পুলিসকে জানাতে পারছে না—স্ক্যান্ডালের ভয়ে। তাছাড়া তার অবচেতন মন চাইছে রূপেশই হত্যাকারীরূপে চিহ্নিত হক। একমাত্র তা হলেই সে তার কন্যাকে দান করা কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি উদ্ধার করতে পারবে। সেগুলো ওই লোফারটার মাধ্যমে রেসকোর্সে ঘোড়ার খুরে খুরে ধুলো হয়ে যাবে না। বিক্রমজিতের চিঠির কথা আমি জানতাম না। কিন্তু রূপেশ ছাড়া অন্য কোনো লোককে যে দস্তুর সন্দেহ করছে এটা নিশ্চিত। সেটার একটা জোরালো কারণ আছে—আর তার ব্লুটা যে দস্তুরের আস্তিনের তলায়, তা আশা করেছিলাম। দেখা গেল আমার অনুমান নির্ভুল। দস্তুর যে বলেছিল ওই গোলাপী চিঠিখানির আঘাত তার কন্যার মৃত্যুর সমতুল্য, তা সেটা বাগাড়ম্বর নয়। সে বিক্রমজিৎকে ও ব্যাপারে চিহ্নিত করেছে। তাকে মর্মান্তিক প্রত্যাঘাত করতে চায়—তাকে ফাঁসি দিয়ে। ওই ছোকরা যে তার বিবাহিতা কন্যার সঙ্গে প্রেম করছে এতে সে অপমানিত বোধ করেছে। বাট নট অ্যাট দ্য কস্ট অব অ্যাকুইটিং রূপেশ। এ জন্যই সে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। এই ভেবেই ওকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম।

এই সময় কৌশিক বলে ওঠে, আমার একটা প্রশ্ন ছিল, মামু—

বাসু তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলেন, সেটা বাড়ি গিয়ে। গাড়ি চালাতে চালাতে নয়। লুক অ্যাট দ্য রোড!

.

লাঞ্চ টেবিলে বাসু-সাহেব বলেন, হ্যাঁ, ‘অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’! এবার বল কৌশিক কী ছিল তোমার প্রশ্নটা?

কৌশিক বলে, না, প্রশ্ন ঠিক নয়, আমি সমস্ত ব্যাপারটা একবার ঝালিয়ে নিতে চাইছিলাম। জানতে চাইছিলাম আপনার মতামত।

–ঝালিয়ে নেও।

আমার প্রথম যুক্তি, কমলকলি হত্যামামলার অপরাধী আমাদের চেনা-জানা লোকের বাইরে কেউ নয়। কারণ অজানা অচেনা কোন অ্যান্টিসোশালের পক্ষে জানা সম্ভবপর নয় যে, ওর কাছে ট্রেনের কামরায় আট দশ লাখ টাকার গহনা আছে। ফলে খুনিকে আমরা চিনি। যদিও তাকে চিহ্নিত করতে পারছি না। আপনি একমত?

—না। আদৌ নয়। হয়তো হত্যাকারী আমাদের অপরিচিত। একজন পেশাদারী মার্ডারার। তবে আমাদের পরিচিত কোন লোকই তাকে এ কাজে লাগিয়েছে।

—তা যদি হয়, তাহলে ওই সঙ্গে মেনে নিতে হবে যে, তাকে নিয়োগ করতে পারে একমাত্র একজন লোকই—রূপেশ মালহোত্রা। হয়তো প্রফেশনাল মার্ডারারের প্রাপ্য সে মিটিয়েছে সেই গহনা দিয়ে। তাকে ওগুলো নিয়ে সরে পড়ার সুযোগ দিয়ে। ডু য়ু এগ্রি?

—না। আদৌ নয়। রূপেশ ছাড়াও অন্য কেউ প্রফেশনাল মার্ডারার নিয়োগ করে থাকতে পারে।

—আর কার স্বার্থ থাকতে পারে? কমলকলির উইলের তো একজনই ওয়ারিশ?

—উইল কি একা কমলকলিই বানাতে পারে? আর কেউ বানায় না?

—আবার কে? বানালেও এ কেসে তার রেলিভেন্স কী?

বাসু এবার তাঁর স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, তুমি ও-বেলা একটা প্রশ্ন করেছিলে, রানু আমি বলেছিলাম জবাবটা আমি জানি না। এখন তার, জবাবটা আমি জেনে গেছি। বলব?

রানু আর এক হাতা লাউ চিংড়ি উঠিয়ে নিয়ে বললেন, ও বেলার প্রশ্ন এ বেলা বাসি হয়ে গেছে। জবাবটা আমারও জানা।

বাসু-সাহেব—যাঁর চমক দেবার একচেটিয়া অধিকার—চমকে উঠে বলেন, কী প্রশ্ন? আর কী উত্তর বল তো?

ও বেলা আমি জানতে চেয়েছিলাম কমলকলি শৈশবে মাতৃহারা হবার পর দস্তুর আবার কেন বিয়ে করেনি। আর তুমি বলেছিলে যে, তুমি জান না। এবেলা ও প্রশ্নটা তামাদি হয়ে গেছে। কারণ আমি জানি : কেন।

বাসু রীতিমতো অবাক হয়ে বলে ওঠেন, ম্যাগনিফিক্! তা সে প্রশ্নের উত্তরটা তুমি কী করে জানলে তা বুঝে গেছি। সুজাতা নিশ্চয় সাতকাহন করে সকাল বেলাকার গল্প করেছে। কিন্তু কেমন করে বুঝলে যে, সেই প্রসঙ্গটাই আমি তুলছি?

রানু মিচকি হেসে বললেন, এলিমেন্টারি ওয়াটসন! তুমি দ্বিতীয় উইলের প্রসঙ্গ তুলতেই বোঝা গেল—এবার দস্তুরের উইলের কথা হচ্ছে। হয়তো পামেলা বুঝতে পেরেছে দস্তুরের দ্বিতীয়বার বিবাহের পথে একমাত্র কাঁটা ওই মেয়েটা—যে এখন দস্তুরের উইল মোতাবেক ওয়ারিশ। কারণ প্রসঙ্গটা উঠেছিল প্রফেশনাল মার্ডারার এনগেজ করা নিয়ে।

সুজাতা বললে, আমি মামিমার সঙ্গে একমত। প্রফেশনাল খুনি এনগেজ করা হয়েছে যদি প্রমাণিত হয় তবে তার পশ্চাৎপদে একজন নয়—দুজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি।

কৌশিক একটু অবাক হয়ে বলে, মিস পামেলা? আমার বিশ্বাস হয় না।

সুজাতা রুখে ওঠে, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠছে না। আমরা একটা অ্যাকাডেমিক ডিস্কাশান করছি। সম্ভাব্য আততায়ী কে? সেক্ষেত্রে মিস্ পামেলা কাত্রোচ্চিকে সন্দেহ তালিকার বাইরে রাখা যায় না। সকালবেলা দেখলাম দস্তুর সাহেবকে সে বরাবর ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে গেল। দস্তুর ওর এপ্লয়ার, ওর ‘বস’। তাকে ‘আপনি’ বলে কথা বলাই শোভন ও স্বাভাবিক—বিশেষ তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে।

কৌশিক বলে, তার অন্য কারণ থাকতে পারে। উনি বিদেশী। ভালো বাঙলা জানেন না। হয়তো ‘আপনি-তুমি’ গুলিয়ে যায়!

—ঘোড়ার ডিম! মামুকে, তোমাকে আমাকে তিনি বরাবর ‘আপনি’ সম্বোধন করে গেলেন। ভদ্রমহিলা বলেছিলেন, কোট ‘দস্তুর ওকে ডিভোর্স পিটিশন ফাইল করাতে রাজি করিয়েছিল। আমাদের অ্যাটর্নি তার কাজ শুরু করেও দিয়েছিলেন।,’ আনকোট। আসলে কী জানেন, মামু, মেমসাহেবের ‘চাঁপা কলি’রঙ দেখলেই এ দেশী ছেলেদের মাথা ঘুরে যায়।

বাসু বলে ওঠেন, নো নো নো। দিস ইজ নট দ্যা ভেনু! দাম্পত্যালাপ লাঞ্চ টেবিলে নয়। শয়নকক্ষে।

কৌশিক ব্যাপারটা সামলে নিতে বলে, কিন্তু মামু, চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কথাটা হঠাৎ আপনার মনে হল কেন? ও-কথা তো কেউ বলেনি।

ছুরি কাঁটা প্লেটে নামিয়ে দিয়ে বাসু চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। বলেন, সেটাই তো ট্র্যাজেডি মিস্টার ‘সুকৌশলী’! য়ু সী, বাট য়ু ডোন্ট অবজার্ভ।

কৌশিক রুখে ওঠে,—কী দেখি, আর লক্ষ্য করি না? ‘চাঁপা রঙের মুর্শিদাবাদী’র কথা কে কখন বলেছে? বলুন?

বাসু এবার পুডিঙের বৌলটা কাছে টেনে নিতে নিতে বলেন, ঠিক আছে বাপু, ঠিক আছে! ওটা না হয় তোমাদের মামুর একটা স্লিপ অব টাং হয়েছিল। তা এমন ভুল কি আর সবাই করে না? করেনি? হোম্‌স্‌? প্যয়রোঁ? ব্যোমকেশ অথবা তোমাদের ফেলুদা?

সুজাতা কৌশিক পরস্পরের দিকে তাকালো। হঠাৎ দুজনেই গম্ভীর হয়ে গেল। ওরা দুজনেই বুঝতে পারে চাঁপা-রঙের মুর্শিদাবাদী’ শাড়িটার একটা প্রাসঙ্গিকতা আছে! কী সেটা? বাসু-মামু তো এমন ভুল করেন না!

রানু বলেন, চাঁপা রঙের মুর্শিদাবাদীর ব্যাপারটা কী?

বাসু বলেন, বাদ দাও ওসব ফালতু কথা। কিন্তু একটা ভুল হয়ে গেছে। নিখিলকে খোঁজ নিয়ে দেখতে বলা হয়নি—মিস্‌ পামেলা কাত্রোচ্চির আদি নিবাসটা কোথায়। ইতালি না সিসিলি?

সুজাতা জানতে চায়, কেন? তাতে কী সুরাহা হবে?

কৌশিক প্রত্যাঘাতের এই সুযোগটা ছাড়ে না। স্ত্রীকে বলে, সেটা জানতে হলে কিছু পড়াশুনা করা প্রয়োজন। মারিয়া পুজোর ‘দ্য গডফাদার’, ‘দ্য লাস্ট ডন’, ‘দ্য সিসিলিয়ান’, এবং সর্বশেষ রচনা : ‘OMERTA’!

বাসু আবার বলে ওঠেন উহুহু। এখানে নয়—ওসব দাম্পত্যালাপ মশারি ফেলা জনান্তিকে প্লিজ!

রানু বলেন, সুজাতার কাছ থেকে গোটা কেসটা শুনেছি। এ কথা নিঃসন্দেহ যে রূপেশ মালহোত্রা হচ্ছে প্রাইম সাস্পেক্ট। এমন কি তার ‘অ্যালেবাই’ প্রতিষ্ঠিত হলেও ধরে নিতে হবে যে, সে ‘প্রফেশনাল’ ‘মার্ডারার’ নিয়োগ করেছিল। কারণ কমলকলির মৃত্যুতে সেই সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে। কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি। দ্বিতীয়ত, পামেলা কাত্রোচ্চি। সিসিলিয়ান ঘরানার হলে ওর রক্তের মধ্যেই এটা আছে। তার মোটিভও স্পষ্ট বোঝা যায়। সে বুঝেছে কমলকলি জীবিত থাকতে দস্তুর ওকে বিয়ে করবে না। ওদের সোসাইটিতে এমন বিয়ে হামেহাল হয়। ফলে দস্তুর কেন তার সেক্রেটারিকে বিয়ে করছে না বোঝা কঠিন। তবে এটা নিশ্চিত যে, কমলকলি জীবিত থাকতে দস্তুর তার উইলটা পালটাবে না। থার্ডলি : কুমার বিক্রমজিৎ! তার ক্ষেত্রে আট দশ লাখ টাকার ওই গহনার পুঁটুলি ছাড়া লাভের অঙ্কে আর কিছু পড়ছে না! তবে কৌশিকের সঙ্গে আমি একমত। অর্থাৎ নিজে হাতে খুন যেই করে থাক : ‘প্রাইম মুভার’ আমাদের অপরিচিত কেউ নয়।