চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ৫

পাঁচ

ওঁরা দুজনেই উঠে দাঁড়ালেন। ধীর পদে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন। ডোর ক্লোজারের অমোঘ আকর্ষণে ফ্লাসপাল্লাটা বন্ধ হয়ে গেল। সুজাতা তখন সেই নির্জন ঘরে মামুকে বলে, আমার মনে হয় …

—নট নাউ! আমাদের আলোচনাটা পরেও হতে পারে।

সুজাতার খেয়াল হল। দেওয়ালের নাকি কান থাকে! বিশেষ, অমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যাগনেটের বৈঠকখানায় : কনসিলভ্ টেপ-রেকর্ডার!

একটু পরেই এসে হাজির হল সোমা হাজরা। তারও বয়স ওই ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ। সেও রীতিমতো সুন্দরী। মুখাবয়ব খুব নয়নাভিরাম নয়। তবে অত্যন্ত ফর্সা এবং সুতনুকা। যুক্তকরে সবাইকে যৌথ-নমস্কার করে দাঁড়িয়ে রইল। বাসু-সাহেবের নির্দেশে আলতো করে বসল একটি সোফায়। আগে থেকে জানা না থাকলে কৌশিক বুঝতেই পারত না এই মেয়েটি ছিল কমলকলির মেইড-সার্ভেন্ট—গৌরবে : কম্প্যানিয়ান। ওর পরনে সাদামাঠা হাল্কা নীল রঙের তাঁতের শাড়ি। ব্লাউজ ম্যাচ করা নয়। প্রসাধনের চিহ্নমাত্র নেই। বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি। চোখ দুটি এখনো লাল। সেটা অস্বাভাবিক নয়। প্রথম কথা, মালকিনের আকস্মিক অপমৃত্যু, দ্বিতীয়ত ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার অভাব। কমলকলি ওর চাকরিটা ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে নিয়েই ওপার পানে রওনা দিয়েছে।

বাসু বলেন, তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি, মা। কিন্তু তবু তোমাকে একটু বিরক্ত করব। কয়েকটা প্রশ্ন করব। প্রথম কথা : পশুদিন সকালে তোমরা যখন স্টেশনে রওনা হও তখন কি মিসেস মালহোত্রা স্বাভাবিক ছিল? না কি কোনো অস্থিরতা বা নার্ভাসনেস্-এর লক্ষণ তোমার নজরে পড়েছিল?

—আজ্ঞে না। তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিকই ছিলেন। বরং কিছুটা খুশি-খুশি মুডে ছিলেন।

—কিন্তু বালাসোর স্টেশনে তাকে অন্যরকম দেখলে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, একেবারে আলাদা মুড। কেমন যেন একটা অস্থির ভাব। আমার সঙ্গে গুছিয়ে কথাও বলতে পারছিলেন না।

—বালাসোর স্টেশনে কমলকলি তোমাকে ঠিক কী বলেছিল বলতো? আই নো, ভার্বাটিম সব কথা মনে করে বলা সম্ভবপর নয়। তবু যতখানি তোমার মনে আছে—

একটু ভেবে নিয়ে মিস্ হাজরা বললে, আমি জানলার কাছে এসে দাঁড়াতে উনি কূপে থেকে বার হয়ে করিডোরে এলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে জানলায় ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘সোমা, আমার প্ল্যানটা একটু বদলাতে বাধ্য হচ্ছি…আই মিন…এখনই বালাসোরে আমি নামতে পারছি না।’

—জাস্ট এ মিনিট! তোমার ঠিক মনে আছে যে, ও বলেছিল ‘প্ল্যানটা বদলাতে বাধ্য হচ্ছি’ এবং ‘নামতে পারছি না’? অর্থাৎ সে বলে নি তো যে, ‘প্ল্যানটা বদলাচ্ছি’ এবং ‘নামছি না’?

সোমা হাজরা একটু চিন্তা করে বলল, না স্যার! আদালতে হলফ্ নিয়ে আমি ও কথা বলতে পারব না। তবে যদ্দূর আমার মনে পড়ে উনি বলেছিলেন ‘বাধ্য হচ্ছি’ এবং ‘নামতে পারছি’ না।’

—ও.কে! তারপর?

—উনি আমাকে নির্দেশ দিলেন, আমি যেন…

—নো, নো, নো! তুমি ডাইরেক্ট ন্যারেশানে ওর কথাগুলো বলে যাও, যতদূর তোমার মনে পড়ে—

সোমা আবার একটু চিন্তা করে নিল। তারপর বললে, উনি বললেন, ‘সোমা, তুমি লাগেজগুলো ক্লোকরুমে রেখে ফার্স্টক্লাস ওয়েটিং রুমে আমার জন্য অপেক্ষা কর। আমি রাতের মধ্যেই কোনো ডাউন ট্রেনে ফিরে এসে লেডিজ ওয়েটিং রুমে তোমার খোঁজ করব। তোমার কিছু টাকা লাগবে?’ তাতে আমি বললাম, ‘না। টাকা লাগবে না; কিন্তু কত রাত হবে আপনার?’ উনি জবাব দিলেন না। কূপের মধ্যে গিয়ে কাকে কী যেন জিজ্ঞেস করলেন। তখনই আমার নজর হল কূপের ভিতর একজন ভদ্রলোক আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখ না ঘুরিয়েই তিনি দিদিকে কী যেন বললেন। তৎক্ষণাৎ দিদি আবার জানলার ধারে ফিরে এসে বললেন, ‘ম্যাক্সিমাম রাত দশটা। ডাউন ট্রেন কখন আছে জানি না তো। তবে আজ রাত্রেই ফিরব। তুমি স্টেশন ছেড়ে কোথাও যেন যেও না।’ আমি কী একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম—সম্ভবত জানতে চাইছিলাম উনি কোথায় যাচ্ছেন। বা কেন যাচ্ছেন—ঠিক কী জানতে চাইছিলাম তা আমার এখন মনে নেই। কিন্তু ঠিক তখনই ট্রেনটা দুলে উঠল। দিদি জানলা থেকে সরে গেলেন। ট্রেনটাও ছাড়ল।

বাসু বললেন, আই সি! তার পরের কথা তো তুমি তোমার এজাহারেই দিয়েছ। তুমি রিটায়ারিং রুমের ‘বি’-কামরায় রাতটা ছিলে, সারা রাতে কমলকলি না ফেরায় তুমি বালাসোরের পুলিস স্টেশনে একটা ডায়েরি করে পরদিন ফিরে এলে। তার মধ্যে নতুন কথা কিছু নেই। কিন্তু গহনার কেসটা তাহলে তোমার দিদির কাছেই থাকল? মানে, ট্রেনটা যখন বালাসোর ছাড়ে?

—তাই তো থাকার কথা। আমাকে যখন দিদি সেটা দেননি।

—হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়ার পর বালাসোর পৌঁছানোর আগে তুমি কি ওই দিদির কামরায় গিয়েছিলে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। ট্রেন ধরতে আমরা নয়টা-নাগাদ বাড়ি থেকে বার হই। তাড়াহুড়ায় দিদির তখনো ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়নি। সেটা আমি একটা ক্যাসারোল হট-কেসে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম। খড়্গপুরে যখন গাড়ি দাঁড়ায়—বারোটা নাগাদ—তখন আমার কয়েকজন সহযাত্রীকে মালগুলো পাহারা দিতে বলে খাবারের কৌটোটা নিয়ে দিদির কামরায় চলে আসি। খড়্গাপুরে বিশ মিনিট স্টপেজ। দিদিকে খাবারের ক্যাসারোল হট-কেস আর কফি ভর্তি ফ্লাস্কটা দিয়ে আসি। দিদি আমার সামনেই খেতে শুরু করেছিলেন; কিন্তু শেষ করতে পারেননি। ট্রেন ছেড়ে দিতে পারে আশঙ্কা করে আমি সেই বাটি আর ফ্লাস্কটা রেখেই আমার কামরায় ফিরে আসি।

কৌশিক বলে, কিন্তু সেগুলো তো কূপেতে পাওয়া যায়নি?

—আমিও তাই শুনেছি। জানি না, সেগুলো কোথায় গেল।

বাসু জানতে চান, খড়্গপুরে কমলকলি কী খেয়েছিল?

—খান দুই আলুর পরোটা, চিকেন-মটর, সালাড, আর একপিস্ সন্দেশ ছিল কৌটায়। দিদি তার কতটা কী খেয়েছিলো আমি জানি না। কী করেই বা জানব?

বাসু মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, থ্যাঙ্কস সোমা। আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই। তুমি মিস্টার দস্তুরকে একবার এঘরে আসতে বল। যাও—

সোমা উঠল না। নিজে থেকেই বলে, আমার মনে হয় বালেশ্বরে যে ভদ্রলোককে আমি কূপের ভিতর দেখেছিলাম হয়তো তাঁরই প্ররোচনায় দিদি প্রোগ্রামটা বদলান।

বাসু একটু চমকে উঠে বলেন, ও হ্যাঁ! তার কথা তো তোমাকে এখনো জিজ্ঞেস করাই হয়নি। তোমার কী মনে হয়েছিল? সেই লোকটির সঙ্গে ট্রেনেই তোমার দিদির আলাপ হয়? না কি সে কমলকলির পূর্বপরিচিত?

—তা আমি কেমন করে জানব স্যার? আমি তো তাঁকে ভাল করে দেখতেই পাইনি। ট্রেন যতক্ষণ স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল তারমধ্যে তিনি একবারও এ পাশ ফেরেননি। তাঁর মুখটাও দেখতে পাইনি।

—মুখ নাই দেখ, তার একটা শারীরিক বর্ণনা দাও। হাইট, স্ট্রাকচার, পোশাক?

—মনে হল ভদ্রলোক বেশ লম্বা। স্লিম ফিগার। গ্রে রঙের ফুলপ্যান্ট। গায়ে হাফশার্ট অথবা টি-শার্ট। ঠিক মনে নেই। তাঁর মাথায় একটা ক্যাপ ছিল, হুড়ওয়ালা। তিনি দিদির সঙ্গে দু-একটা কথা বলেছিলেন, কিন্তু বরাবর ওপাশ ফিরে।

বাসু পাইপটায় আগুন ধরাতে ধরাতে ফস্ করে বলে বসেন, লোকটা তোমার দিদির হাজব্যান্ড মিস্টার রূপেশ মালহোত্রা নয় তো?

রীতিমতো চমকে ওঠে সোমা। সামলে নিয়ে বলে, তাঁকে আমি কয়েকবার দেখেছি। এ লোকটির হাইট এবং স্ট্রাকচার মিস্টার মালহোত্রার মতোই। তবে উনি বলে মনে হয় না।

—কেন হয় না? তুমি তো লোকটাকে শুধু পিছন থেকে দেখেছ। এদিকে আবার হাইট স্ট্রাকচার মালহোত্রার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে? তাহলে?

সোমা জবাব দিতে পারে না। বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।

—তার মানে লোকটা মিস্টার মালহোত্রা হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে! তাই না? এ-কথাই তো বলতে চাইছ?

শব্দ বার হল না মিস্ হাজরার মুখ থেকে। নীরব শিরশ্চালনে সে স্বীকৃতি জানালো।

—তুমি কুমার বিক্রমজিতের নাম শুনেছ? চেন তাঁকে?

এবারও সোমা চমকে ওঠে। বলে, কুমার বিক্রমজিৎ? দিদির বন্ধু? হ্যাঁ তাঁকে একবার দেখেছি। কেন বলুন তো?

—লোকটা কুমার বিক্রমজিৎ নয় তো?

—না, তা মনে হয় না।

—কেন?

—তাছাড়া কতটুকু সময় তাঁকে দেখেছি বলুন?

—তা তো বটেই! তবে পরে যদি প্রমাণিত হয় লোকটা কুমার বিক্রমজিৎ তাহলেও তুমি অবাক হবে না। তাই না?

—হ্যাঁ, সে কথা ঠিক। আমি তো তাঁকে খুঁটিয়ে দেখিনি।

—কেন? তোমার তো প্রচণ্ড কৌতূহল হবার কথা। কৌতূহল হয়নি তোমার?

—হ্যাঁ, তা হয়েছিল। কি জানি, আমি ঠিক জানি না।

বেশ বোঝা যায় এ জাতীয় প্রশ্নোত্তরের অভিজ্ঞতা তার নেই। সে বেশ ঘাবড়ে গেছে।

—ঠিক আছে এবার এস তুমি। মিস্টার দস্তুরকে পাঠিয়ে দাও।

সোমা উঠে দাঁড়ায়। চলতে গিয়েও কী ভেবে থেমে পড়ে। হঠাৎ প্রশ্ন করে, সেদিন দিদি কী রকম ড্রেস পরেছিলেন জানেন?

বাসু তৎক্ষণাৎ বলেন, হ্যাঁ শুনেছি। একটা চাঁপা-রঙের মুর্শিদাবাদী।

—চাপা রঙের মুর্শিদাবাদী? কে বলেছে?

—কার এজাহারে সে কথা আছে তা তো মনে পড়ছে না। বোধহয় সেই মেরিন এঞ্জিনিয়ারের স্টেটমেন্ট-এ। কেন বলতো?

সোমা দৃঢ়তার সঙ্গে বললে, তাহলে সে ভদ্রলোক কালার ব্লাইন্ড। দিদি পরেছিলেন ডীপ কালো একটা চাইনিজ শিফনের শাড়ি, সেই সঙ্গে স্লীভলেস কালো ম্যাচিং ব্লাউজ। অমন পোশাকে ফর্সা রঙের দিদিকে যে কী দারুণ দেখাচ্ছিল—

বাসু বললেন, না, এতক্ষণে মনে পড়েছে। চাঁপা রঙের মুর্শিদাবাদীর কথাটা বলেছিল সেই জি-আর-পির ইন্সপেক্টার—যে ডেডবডি কূপে থেকে স্টেশানে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করে।

সোমা প্রতিবাদ করে, তাহলে সেই পুলিশ অফিসারকেই চোখ দেখাতে বলুন। সে লোকটাই কালার-ব্লাইন্ড।

বাসু বলেন, তা কেন? তুমি তো তোমার দিদিকে দেখেছিলে বালাসোর স্টেশন পর্যন্ত আর বডিটা পাওয়া যায় ভুবনেশ্বরের কাছাকাছি। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে। কমলকলি হয়তো নির্জন কূপেতে ইতিমধ্যে শাড়িটা পাল্টে ছিল।

রুখে ওঠে সোমা—কী করে পালটাবেন? তাঁর স্যুটকেস তো আমার জিম্মায়? তাঁর কাছে তো ভ্যানিটি ব্যাগ ছাড়া কিছুই ছিল না।

বাসু মাথা নাড়লেন, তা বটে! তুমি যে আরও গুলিয়ে দিলে ব্যাপারটা! আর য়ু শ্যিওর বাড়ি থেকে সে কালো শিফনের শাড়ি পরেই বেরিয়েছিল।

–কী আশ্চর্য! আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি তাঁর কম্পানিয়ান। সকাল নয়টা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত তাঁকে বারে বারে দেখেছি। বাড়িতে, গাড়িতে, হাওড়া স্টেশনে, খড়্গপুরে, বালাসোরে…

সুজাতা আর থাকতে পারে না। বলে, আপনিই কিছু উল্টোপাল্টা করছেন, মামু! মেয়েরা কখন কী শাড়ি পরে আছে তা শুধু মেয়েরাই নজর করে! আমার কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে, দস্তুর- সাহেবের স্টেটমেন্টেও ‘কালো রঙে’র শাড়ির উল্লেখ ছিল। চাঁপারঙের নয়।

—দস্তুর? দস্তুর আবার শাড়ির রঙের উল্লেখ করল কখন?

—ওই যখন বর্ণনা করছিলেন যে, মিস্ হাজরা ফার্স্টক্লাস ওয়েটিং রুমের মহিলা ইনচার্জকে বলছে, “খুব ফর্সা একজন কালো রঙের শিফন শাড়িপরা মহিলা যদি ওর খোঁজ করেন…’

বাসু বিহ্বল হয়ে বলেন, ‘কালো’? আমার যদ্দুর মনে পড়ে উনি চাঁপা রঙ’ বলেছিলেন… কী জানি। বাট দ্যাটস্ নাইদার হিয়ার নর দেয়ার! শাড়ির রঙে কী আসে যায়?