চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ৪

চার

একটু পরে ঘরে এসে উপস্থিত হলেন, মিস্ পামেলা কাত্রোচ্চি। বছর পঁয়ত্রিশের একজন ইতালিয়ান মহিলা—দস্তুরের সেক্রেটারি। ভারতীয় পোশাকে। বাঙ্গালোর সিল্কের শাড়ি, স্লিভলেস ব্লাউজ। একহাতে রিস্টওয়াচ অপর হাত নিরাভরণ। দীর্ঘদেহী, মধ্যক্ষামা, বয়েজকাট চুল, নীল চোখ। ভারতীয় কায়দায় হাত তুলে সবাইকে যৌথ নমস্কার করে বসলেন বাসু- সাহেবের পাশে। নিক্কথায় তাঁর হাতে তুলে দিলেন দু কপি কাগজ। পরিষ্কার বাঙলায় বললেন, টাইম-টেব্‌ল্‌ থেকে কপি করা। তিন-চার কপি টাইপ করেছি। পুলিসকেও দিয়েছি।

বাসু কাগজখানা হাতে নিলেন বটে, তাকালেন না। এক কপি বাড়িয়ে ধরলেন সুজাতার দিকে। বললেন; খুব ভালো বাঙলা শিখেছেন তো! কতদিন আছেন বাঙলা দেশে?

—তা বছর কুড়ি হবে। তোমার বাড়িতেই তো এটা আমার ইলেভেন্থ ইয়ার। তাই না মিস্টার দস্তুর?

দস্তুর বোধকরি এটাকে ‘খেজুরে আলাপ’ পর্যায়ে ফেললেন। জবাব দিলেন না। পকেট থেকে পাইপ বার করে তামাক ঠেশতে থাকেন। সুজাতা ইতিমধ্যে টেবিলে পেতে ফেলেছে কাগজটা :

কাগজটা

মিস্ পামেলা কাত্রোচ্চি বললেন, ঘটনার দিন ইস্ট-কোস্ট এক্সপ্রেস অন ডট রাইট-টাইম ছিল; মানে যতক্ষণ না কলি-মার দেহটা আবিষ্কৃত হয়।

বাসু তাকে বললেন, আই সি! সোমা কী বলছে? গহনার বাক্সটা কূপেতেই ছিল, এবং তা মিসিং?

—হ্যাঁ তাই।

—দ্যাট মে বি দ্য রীজন!

—নিজের মনেই বললেন বাসু।

কয়েক মুহূর্ত সবাই নীরব। ডিসেম্বরেও শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের একটা মৃদু শব্দ। নীরবতা ভেঙে মিস্ পামেলা বলেন, কিন্তু বাইরের লোক কীভাবে জানবে যে ওতে কী আছে আপনারাই বলুন?

কৌশিক একটু চিন্তা করে বলে, কিন্তু বাইরের লোক যে হতেই হবে, তার কী অর্থ?

বাসু মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টি। দস্তুর আর তাঁর সেক্রেটারির মধ্যে চকিত দৃষ্টি-বিনিময় হল দুজনেই নির্বাক। বাসুই আবার বলেন, সোমা কতদিন এ বাড়িতে ওই কাজ করছে?

জবাবে দস্তুর বলেন, বাট শি ইজ হান্ড্রেড-পার্সেন্ট ফেইথফুল! অ্যান্ড বিয়ন্ড সাপিশন!

—বাট দ্যাট ওয়াজ নট মাই কোশ্চেন?

পামেলা বললেন, প্রায় দু বছর। দস্তুর বলতে চেয়েছিল, আমরা তাকে মেয়ের মতোই দেখি। তিনকূলে তার কেউ নেই। অর্ফানেজে মানুষ। নিজের চেষ্টায় গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। আর…তাছাড়া…দু-বছর ধরে তো দেখে আসছি—ওই যে-কথা দস্তুর বলল; শি ইজ হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফেইথফুল।

বাসু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তাছাড়া সে তো ছিল তিন বগি পিছনে। আর ছুরি চালানো মেয়েদের কাজ নয়। স্ত্রীলোক হত্যাকারী হলে দেখা যায় মেথডটা: বিষপ্রয়োগ! অলমোস্ট নাইন্টি পার্সেন্ট।

দস্তুর বিরক্ত হয়ে হঠাৎ বলে ওঠেন, প্লিজ ব্যারিস্টার-সাহেব। সন্দেহের তালিকা থেকে আপনি কয়েকজনকে বাদ দিন—আমাকে, পামেলা, সোমা বা আমার বাড়ির দারোয়ান-পাচক- বেয়ারা-ড্রাইভারদের। এ-কাজ সেই স্কাউভেলটার—সেই যাকে ট্রেনের কামরায় সোমা দেখেছিল বালাসোর স্টেশনে।

কৌশিক জানতে চায়, আপনার মেয়ের শেষকৃত্য কোথায় হবে?

দস্তুর জবাব দিলেন না। পকেট থেকে রুমাল বার করে চশমার কাচটা মুছতে থাকেন। পামেলা বলেন, আজ দুপুরেই আমরা বাই রোড ভুবনেশ্বর যাচ্ছি। কলি-মার হাজবেন্ড তো ওখানেই আছেন। কয়েকজন নিকট আত্মীয়ও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। পৃথক গাড়িতে। ‘ফিউনারাল’ পুরীর স্বর্গদ্বারেই হবে।

বাসু জানতে চান, কমলকলির ওয়ারিশ কে? তার স্বামী?

দস্তুর আবার আলোচনায় যোগ দেন। বলেন, বিয়ের তিনমাসের মধ্যে কাল তার সমস্ত স্থাবর সম্পত্তি—গোটা সাতেক ল্যান্ডেড প্রপার্টি, শেয়ারস্, অন্যান্য সিকিউরিটি একটা উইল করে তার হাজবেন্ড রূপেশ মালহোত্রাকে দিয়ে বসে। আমি যখন জানতে পারি ততদিনে ওদের সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করেছে। আমি উইলটা নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলাম। কারণ আমার মনে হয়েছিল, ওদের ডিভোর্স অনিবার্য! কিন্তু কলি রাজি হয়নি!

—রাজি হয়নি! কেন? সে কি ডিভোর্স চাইছিল না?

—সর্বান্তঃকরণে চাইছিল। ওরা তো গত সাত মাস সেপারেশনে আছে। একসঙ্গে একটা রাতও কাটায়নি। কলি চাইছিল মিউচুয়াল ডাইভোর্স। স্কাউন্ডেলটা গররাজি নয়। তবে তার ডিমান্ড ছিল আকাশচুম্বী!

—তাহলে কমলকলি তার উইলটা বলাতে রাজি হল না কেন?

দস্তুর নীরবে পাইপ টানতে থাকেন।

পামেলা বলেন, তুমি ভুল করছ মিস্টার দস্তুর। ডাক্তার আর লিগ্যাল অ্যাডভাইসারের কাছে কিছু লুকাবার চেষ্টা বোকামি!

দস্তুর তাঁর সেক্রেটারির দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, আমাকে কলি বলেছিল, উইলে একাধিকবার রূপেশকে বলা হয়েছে ‘মাই হাজবেন্ড’! সুতরাং ডিভোর্স হয়ে গেলে যদি আমার মৃত্যুই আগে হয় তাহলে রূপেশ কিছুতেই ওই উইলের প্রবেট পাবে না। তাছাড়া…আমার আশঙ্কা…রূপেশ এমন কিছু একটা তথ্য ওর সম্বন্ধে জানতে পেরেছিল যেজন্য ও উইলটা নষ্ট করতে পারেনি। সেটা যে কী, তা আমি জানি না!

বাসু জানতে চান, ওদের কোন জয়েন্ট ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্ট ছিল?

দস্তুর তাঁর সেক্রেটারির দিকে ফিরে বললেন, য়ু বেটার আনসার দ্যাট কোশ্চেন।

পামেলা বলেন, না, ছিল না। জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট সব ক্লোজ করে দিয়েছিল কলি। তবে আন্দাজ করা যায়, রূপেশ মাঝে মাঝেই কলির কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে যেত।

—ব্ল্যাকমেলিং?

—হতে পারে। আবার নাও পারে। হয়তো স্ক্যান্ডালের ভয়ে। মিস্টার দস্তুর ওকে ডিভোর্স পিটিশন ফাইল করাতে রাজি করিয়েছিল। আমাদের অ্যাটর্নি তার কাজ শুরু করেও দিয়েছিলেন।

—রূপেশ মালহোত্রা আজকাল কোথায় থাকে?

আবার কথোপকথনে যোগ দেন দস্তুর-সাহেব, সল্ট লেকে। ওর বাপের বানানো দু’ দুটি বাড়ি—আলিপুরে ও লেক গার্ডেন্সের দুটি বড় বাড়ি—ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।

—তার মানে, পশু কমলকলি যখন রওনা হয়, সেদিন সকালে রূপেশ কলকাতাতেই ছিল?

—তাই ছিল বলে আমার ধারণা। কংক্রিট প্রমাণ নেই। অন্তত রাত আটটায় সে সল্টলেকের বাড়িতে ছিল। কারণ সেই সময় ভুবনেশ্বর থেকে পুলিসের এস. টি. ডিটা সে রিসিভ করে।

—বাড়ির টেলিফোনে? আর য়ু শ্যিওর? মোবাইল নম্বরে নয়?

দস্তুর একটু চমকে ওঠেন। বলেন, ওদিক থেকে আমি চিন্তা করিনি। না, সে খবরটা আমার জানা নেই!

বাসু বললেন, আপনার ‘কেসটা আমরা অ্যাকসেপ্ট করলাম। এবার মিস্ হাজরার সঙ্গে একটু কথা বলব। জনান্তিকে। তাকে কাইন্ডলি পাঠিয়ে দিন।