চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ৩

তিন

নিউ আলিপুর থেকে লাউডন স্ট্রিটের ‘দস্তুর-প্যালেস’ পৌঁছাতে বেশি সময় লাগল না। অফিসযাত্রীদের ভিড় সবে শুরু হয়েছে। জমকালো কাস্ট-আয়রনের গেট থেকে পোর্টিকো পর্যন্ত লাল মুরাম-বিছানো পথ। পদচারীদের কিছু অসুবিধা হতে পারে। বিশেষ হাইহিল-ধারিণীদের। কিন্তু এ পথে পদাতিকের আবির্ভাব সেই যাকে বলে—নীলচন্দ্রিমার জমানায় বারেক!’ ওঁদের ফিয়াট গাড়িটা পোর্টিকোর আচ্ছাদনে এসে থামতেই ছুটে এল খাকি উর্দিপরা দারোয়ান। সেলাম করে খুলে দিল গাড়ির দরজা। ওঁরা তিনজন নামতে কৌশিকের হাত থেকে গাড়ির চাবিটা চেয়ে নিল। গাড়ি ঠিক মতো পার্ক করে সে চাবি নিয়ে ওখানে প্রতীক্ষা করবে। ততক্ষণে এগিয়ে এসেছেন ঝকমকে সাফারি স্যুট-পরা এক সুদর্শন ভদ্রলোক। সম্ভবত দস্তুর-সাহেবের সেক্রেটারি। কৌশিক পরে জানতে পারে, সে দস্তুর-সাহেবের দস্তুরমতো খাশ বেয়ারা! ওদের তিনজনকে সে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল বিশাল ড্রইংরুমে। সেখানে তখন সুরেলা স্বরে একটি চাইমিং ক্লক সকাল নয়টার সঙ্কেত দিচ্ছে।

হাতঘড়ির সবচেয়ে বড় কাঁটাটা পুরো একচক্কর মারার আগেই সে ঘরে প্রবেশ করলেন জগৎপতি দস্তুর। ছয় ফুটের উপর দীর্ঘ, সুঠাম চেহারা। গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, একটু বুঝিবা গোলাপি আমেজ। ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো পাতলা হয়ে আসা চুলের স্কোর বোর্ডে সাদা চকখড়ি দিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে ব্যাটসম্যানের হাফসেঞ্চুরি হয়ে গেছে। পরিধানে চাইনিজ সিল্কের পাজামা-পাঞ্জাবি। পায়ে চামড়ার বিদ্যাসাগরী চটি, চোখে রিমলেস সোনার চশমা, দশ আঙুলে গ্রহবারণ ছয়টি আঙটি। কে বলবে—ওঁর একমাত্র কন্যাটির মর্মান্তিক মৃত্যুর পর তিনটি সূর্যাস্তও হয়নি। লৌহকঠিন ব্যক্তিত্ব!

আগন্তুকদের বিপরীতে একটি সোফায় আসন গ্রহণ করে তিনি বিনা ভূমিকাতেই শুরু করলেন, মিস্টার বাসু, নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, কেন এভাবে আপনাদের কষ্ট দিচ্ছি। আঘাত আমি সইতে পারি, কিন্তু অপমান নয়। আমার কন্যার এই মর্মান্তিক পরিণতির একটা বিচার চাই। ওয়েস্ট-বেঙ্গল আর উড়িষ্যা দুটো স্টেটের পুলিসই জয়েন্টলি তাদের কর্তব্য করছে। অ্যান্ড দে আর ডুইং ইট এক্সিডিংলি ওয়েল। আ’হ্যাভ নাথিং টু কমপ্লেন অ্যাবাউট। তবু আমি চাই, একই সঙ্গে আপনি এবং আপনার সুকৌশলী পৃথকভাবে এ তদন্তের ভার নিন। সমান্তরাল তদন্ত।

বাসু গম্ভীরভাবে বললেন, কিন্তু কেন? আপনি কি পুলিসের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না?

—ঠিক তা নয়, ব্যারিস্টার-সাহেব। আমি চাই প্রকৃত অপরাধীকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে এবং…ইয়েস, হি অর শী শ্যাল বি হ্যাড্ড বাই দ্য নেক…ওসব যাবজ্জীবন টিবনে আমার তৃপ্তি হবে না। সেকেন্ডলি, আমি চাই না, লোকটাকে চিহ্নিত করার পর আপনি বেমক্কা তার ডিফেন্স কাউন্সেল হয়ে পড়েন।

—আপনার ধারণা ভুল। প্রকৃত অপরাধীকে আমি কখনো…

—আই নো, আই নো স্যার। এ নিয়ে এখন আলোচনার কোনো মানে হয় না। আপনি কি আমার লিগ্যাল কাউন্সেলার হতে স্বীকৃত।

—অস্বীকৃত হবার কোনো কারণ হয়নি। তবে কেসটা আগে বিস্তারিত শুনি। কাগজে যেটুকু প্রকাশিত হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে প্রথমে।

—বলুন?

—প্রথম প্রশ্ন : কমলকলিকে কে খুন করেছে তা কি আপনি জানেন?

এই প্রথম একটু বিচলিত মনে হল দস্তুর-সাহেবকে। ইতস্তত করে বললেন। সন্দেহভাজন দু’একজন যে নেই, তা বলব না…

বাধা দিয়ে বাসু-সাহেব বলে ওঠেন, সন্দেহের কথা হচ্ছে না। নিশ্চিতভাবে জানেন কি না, বলুন?

—না, জানি না। নিশ্চিতভাবে জানলে তো এতক্ষণে তাকে হাজতে পুরে ফেলার ব্যবস্থা করতাম।

—অল রাইট, স্যার! এবার আপনি একটু বিস্তারিতভাবে বলুন। মানে সংবাদপত্রে যা মুদ্রিত হয়নি। কমলকলি কেন ভুবনেশ্বরে যাচ্ছিল? সেখান থেকে শুরু করুন। Better be- gin at the beginning!

—না, কলি ভুবনেশ্বরে যাচ্ছিল না আদৌ। যাচ্ছিল বালাসোর। ওখান থেকে তার চাঁদিপুর যাবার কথা ছিল। ইনফ্যাক্ট, আমার এক ডিসট্যান্ট কাজিন-এর ছেলে থাকে বালাসোরে। তার ম্যারেজ অ্যানিভার্সারির একটা পার্টি ছিল—আজই ওরা সেখান থেকে সদলবলে চাঁদিপুরে বেড়াতে যাবার প্ল্যান করেছিল। আমার জন্যও রেলওয়ে টিকেট কাটা হয়েছিল; কিন্তু হঠাৎ একটা কাজে আমি যেতে পারলাম না। কলি—আই মিন কমলকলি একাই রওনা হল।

–একেবারে একা?

—না। ওর একজন কম্প্যানিয়ান সঙ্গে ছিল। সোমা হাজরা।

—ওই একই কম্পার্টমেন্টে? ‘সি’-কূপেতে?

—না না, সে ছিল সেকেন্ড-ক্লাসে। সেই তো ফিরে এসে প্রথম রিপোর্ট করে। তার কথা অবশ্য কাগজে কিছু বের হয়নি।

—অল রাইট। তার কাছ থেকেই তাহলে ফার্স্ট-হ্যান্ড রিপোর্ট শুনব। সে এ বাড়িতেই আছে তো?

—হ্যাঁ, তিন কুলে তার কেউ নেই, যাবে আর কোথায়? খুব ভেঙে পড়েছে। ন্যাচারালি!

–আপনি যা বলছিলেন, তাই বলে যান। আপনার যাওয়া হল না। যে কোনো কারণেই হোক। তা আপনি কি টিকিটটা রিফান্ড করেছিলেন?

—না। করিনি। দেখুন, আমরা এ. সি. টিকিট পাইনি। কিন্তু ফার্স্টক্লাস কূপে পেয়েছিলাম। আমি ইচ্ছে করেই টিকিটটা ফেরত দিইনি। যাতে দিনের বেলা কূপের নির্জনতায় কলির কোনো বেগানা যাত্রাসঙ্গী না জোটে। কিন্তু সেটা যে এমন ‘ফেটাল’ হয়ে যাবে তা কেমন করে জানব?

—বটেই তো! তারপর?

—যেহেতু কলি একটা ম্যারেজ-অ্যানিভার্সারিতে নিমন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছিল, তাই তার সঙ্গে সামান্য কিছু গহনা-গাটিও ছিল। মানে ধরুন, তার মার্কেট প্রাইস আট-দশ লাখ টাকার মতো হবে।

—জাস্ট আ-মিনিট! সে নিশ্চয় ট্রেনে সেগুলো পরে যাচ্ছিল না। তাহলে সেগুলো ছিল কোথায়? ওর ইউজুয়াল লাগেজের মধ্যে?

—না, না। জুয়েলারি আর অর্নামেন্টস্ ছিল একটা আলাদা ছোট কেস্-এ। বাইরে থেকে অবশ্য বোঝা যেত না যে, তার ভিতরে কী আছে। মনে হত কসম্যাটিক্স-প্যাক। সেটা কলির সঙ্গেই ওর ‘সি’ কূপেতে ছিল। সেটা সে হাতছাড়া করার মেয়ে নয়। তার বাকি লাগেজ ছিল ওই কম্প্যানিয়ানের সঙ্গে। সেকেন্ড ক্লাসে।

—বুঝলাম। বলে যান।

—বালাসোরে ট্রেন থামলে ওই কম্প্যানিয়ান, মানে মিস সোমা হাজরা ট্রেন থেকে নামে একটা কুলির মাথায় মালপত্র চাপিয়ে কলির কামরায় চলে আসে। কলি তখন তাকে বলে, সে ওই বালাসোরে নামবে না। আরো কিছুটা দূর যাবে। কেন, কী বৃত্তান্ত তা বুঝিয়ে বলেনি। সোমাকে নির্দেশ দিয়েছিল, বালাসোরের ফার্স্টক্লাস ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে। আরও বলেছিল সে কয়েকঘণ্টার মধ্যেই ডাউন ট্রেনে বালাসোরে ফিরে আসবে। সোমা অবাক হয়, কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারে না। একটু বিহ্বল হয়ে পড়ে। তখনই ট্রেনটা ছেড়ে দেয়। সোমা মালপত্র প্রথমে ক্লোকরুমে জমা দেয়। তার ছিল সেকেন্ড ক্লাস টিকিট। তাই সে ফার্স্টক্লাসের ওয়েটিং রুমে ঢুকতে পারে না। তার প্রবেশদ্বারে অপেক্ষা করতে থাকে। এরপর অনেকগুলি ডাউন ট্রেন আসে ও চলে যায়। বেলা তিনটে থেকে পাঁচটায়। কলি কিন্তু ফিরে আসে না। সোমা বাধ্য হয়ে একটা রিটায়ারিং রুম বুক করে। ফার্স্টক্লাস লেডিজ ওয়েটিং রুমের মহিলা কর্মচারীকে বলে রাখে যে, কালো রঙের শিফন শাড়ি পরা খুব ফর্সা এক মহিলা যদি সোমা হাজরার সন্ধান করেন তাহলে তাঁকে যেন ‘বি’ নম্বর রিটায়ারিং রুমে খোঁজ নিতে বলে। সারা রাতের মধ্যেও কলি ফিরে আসে না। শেষ পর্যন্ত গতকাল সকালে সোমা স্টেশনের জি. আর. পুলিস স্টেশনে একটা ডায়েরি করে। মালপত্র ক্লোকরুম থেকে খালাস করিয়ে দুপুরের কোন ডাউন ট্রেনে ফিরে আসে। সে সময় আমি অবশ্য বাড়িতে ছিলাম না। তবে ঘটনার রাত্রেই আমরা খবর পাই। কারণ কলির ব্যাগে দুটো টিকিট ছাড়াও ক্যালক্যাটা ক্লাবের কার্ডটা ছিল। কাল সকালেই আমার জামাই বাই রোড ভুবনেশ্বরে চলে যায়। বডি আইডেন্টিফাই করে

বাসু জানতে চান, আপনার মেয়ে কেন বালাসোরে নামলো না তার কারণ কিছু অনুমান করতে পারেন?

—অ্যাপারেন্টলি কোন কারণ তো খুঁজে পাচ্ছি না। তবে সোমা যা বলছে তাতে মনে হয়, বালাসোরে কলি তার কূপের মধ্যে একা ছিল না।

সুজাতা আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। বলে, সোমা কী বলছে, তা সরাসরি তার মুখ থেকে শুনলেই ভাল হয় না?

বাসু বললেন, সেটা তো শুনবই। কিন্তু সে ফিরে এসে মিস্টার দস্তুরকে কী বলেছিল—আই মীন যতদূর তাঁর স্মরণে আছে—সেটা প্রথম শুনে নিতে দোষ কী? আপনি বলুন, মিস্টার দস্তুর?

—সোমা কলিকে ডাকতে গিয়ে ভিতরে একজন পুরুষকে দেখে। সে কূপের ভিতর পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল। উল্টো দিকের জানলা দিয়ে বাইরে কিছু দেখছিল। সোমা তার মুখ দেখতে পায়নি।

কৌশিক জানতে চায়, সোমা কি কামরায় উঠেছিল?

—না, সে প্ল্যাটফর্ম থেকেই কথা বলছিল।

—প্ল্যাটফর্ম কি করিড়োরের দিকে পড়েছিল, না কি কূপের ভিতরের দিকে?

–করিডোরের দিকে। কলি করিডোরে দাঁড়িয়ে সোমার সঙ্গে কথা বলেছিল।

মুষ্টিবদ্ধ দু-হাতের উপর থুতনির ভার রেখে, মেঝেয় পা পাতা ডুবে যাওয়া নরম গালিচার দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন বাসু-সাহেব। হঠাৎ বলে বসেন, আপনার কী মনে হয়? ওই আগন্তুকের অকস্মাৎ আবির্ভাবেই কমলকলি বালাসোরে না নামার সিদ্ধান্তটা হঠাৎ নিয়ে বসেছিল?

—লোকটা আন-অ্যাপয়েন্টেড অকস্মাৎ এসেছিল কি না আমি জানি না, কলি সিদ্ধান্তটা হঠাৎ নিয়েছিল কি না তাও আমি জানি না। কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিই যে তার সিদ্ধান্ত বদলের হেতু এটা ধরে নেওয়ার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে।

—কারেক্ট। তা সেই লোকটি কে হতে পারে এ বিষয়ে আপনি কিছু অনুমান করতে পারেন না?

দস্তুর প্রত্যুত্তর করার আগেই তাঁর হাতে ধরা যন্ত্রটায় একটা ‘বিপ্ বিপ্’ শব্দ হল। বোতাম টিপে উনি যন্ত্রটা কর্ণমূলে ধরে কিছু শুনলেন। যন্ত্রের কথামুখে বললেন, “থ্যাঙ্কস্ ফর রিমাইন্ডিং মি… না জিজ্ঞেস করিনি, এখন করছি। করে তোমাকে জানাচ্ছি” তারপর ওঁদের দিকে ফিরে বললেন, আপনাদের জন্য চা-কফি বা ড্রিংক্স কিছু পাঠাতে বলব?

বাসু সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্রতিপ্রশ্ন করেন, কে জানতে চাইছেন? সোমা হাজরা?

—না, আমার সেক্রেটারি। ইন ফ্যাক্ট তিনিই আমার হাউস-কীপার। কলির মা মারা যাবার পর।

—আই সি! তাঁর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। যাবার আগে কথা বলে যাব। ওঁকে আপাতত জানিয়ে দিন, আমরা এইমাত্র ব্রেকফাস্ট করে এসেছি। আর কিছু চাই না।

যন্ত্রে সংবাদটা জানিয়ে বোতাম টেপার পর বাসু বললেন, আপনাকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম। সেটা আবার করব?

—না। মনে আছে আমার।…না, আমার কোনও নিশ্চিত ধারণা নেই।

—নিশ্চিত ধারণার কথা তো আমি জানতে চাইনি। অনুমান? এনি ওয়াইল্ড গ্যেস্?

দস্তুর কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ বসে রইলেন। মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টি। তারপর বললেন, সরি। আই হ্যাভ দ্য নেম আনসার। কোনকিছু অনুমান করতেও পারছি না আমি

—আই সি! পোস্টমর্টাম রিপোর্ট এখনো….

বাসুর প্রশ্ন না শেষ হবার আগেই উনি বললেন, না। এখনো পাওয়া যায়নি। আর পেলেই বা কী জানা যাবে? মৃত্যু তো হয়েছে একটা ছোরার আঘাতে।

বাসু বললেন, তা হোক। পোস্টমর্টাম রিপোর্ট পেলে ‘টাইম ফ্যাকটারটা’ হয়তো জানা যেত। ট্রেনটা বালাসোরে কখন পৌঁছায়?

দস্তুর সরাসরি জবাব দিলেন না। যন্ত্রটা তুলে নিয়ে তাঁর সেক্রেটারিকে বললেন, পামেলা, তুমি যে চার্টটা বানিয়েছ, তার দুটো কপি নিয়ে এঘরে চলে এস। ওঁরা তোমাকেও কিছু প্রশ্ন করতে চান।