চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ২

দুই

দু-দিন পরের কথা। একত্রিশে ডিসেম্বর। শুক্রবার, ঊনিশ শ’ নিরানব্বই। অর্থাৎ সহস্রাব্দির শেষ সূর্যোদয় হয়েছে ঘণ্টা-খানেক আগে।

নিউ-আলিপুরে ব্যারিস্টার পি. কে. বাসুর ‘ডাইনিং হল’। সকাল এখন সাতটা। পি. কে. বাসুর সঙ্গে যদি আপনাদের জান-পচান না থাকে তাহলে আমি নাচার। তবু সেইসব ভাগ্যবান-ভাগ্যবতী—যাঁরা ‘বাসু-সিরিজ’-এর কণ্টকে বিদীর্ণ হননি—তাঁদের খাতিরে ওঁর একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে রাখি :

প্রসন্নকুমার বাসু কলকাতা ‘বার’-এর প্রবীণতম আইনজীবী। ব্যবহারিক পরিচয়ে তিনি ক্রিমিনাল-সাইড ব্যারিস্টার। কিন্তু শুধু আদালত চৌহদ্দিতেই তিনি তাঁর কর্তব্য শেষ করেন না। অর্থাৎ অভিযুক্তকে খালাস করানোই যেন তাঁর মূল উদ্দেশ্য নয়; ওই সঙ্গে আসল অপরাধীকে চিহ্নিত না করা পর্যন্ত যেন তাঁর মুক্তি নেই। আগে নিজেই প্রচুর ছুটোছুটি করতেন এখন তাঁর বয়েস হয়েছে : আশি ছুঁই-ছুঁই। স্বামী-স্ত্রীর ছোট পরিবার; কিন্তু সুখী পরিবার বলতে পারি না। একটা মোটর অ্যাকসিডেন্টে ওঁদের একমাত্র কন্যাটির মৃত্যু হয়েছে। সে গাড়িতে মিসেস্ রানু বসুও ছিলেন। তিনি হাসপাতাল থেকে ফিরে এলেন, কিন্তু হুইলচেয়ার- নির্ভর প্রতিবন্ধীর জীবনে। অর্থের প্রয়োজন ছিল না। বাসু-সাহেব তাই প্র্যাকটিস্ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। রানু দেবীই রাজি হননি। জোর করে আবার তাঁকে গাউন পরালেন। আবার যাতায়াত শুরু হল আদালত-পাড়ায়।

এই সময়ে ওঁদের সংসারে এসে যোগদান করল একটি সদ্যোবিবাহিত দম্পতি: কৌশিক ও সুজাতা মিত্র। একই বাড়িতে ওঁরা থাকেন। একটি গোয়েন্দা সংস্থা খুলে বসেছিল ওরা স্বামীস্ত্রী : ‘সুকৌশলী’। গিন্নির ‘সু’ আর কর্তার ‘কৌ’। বাকি শলী’টা পাদপূরণার্থে ‘খলু’। নামকরণটা করেছেন বাসু-সাহেবই। ওদের আবির্ভাবে তাঁর দৌড়ঝাপটা কমেছে।

বাসু-সাহেবের জীবন ‘কাঁটায়-কাঁটায়’ বিজড়িত। উভয় অর্থেই। সমস্যার কাঁটা এবং ঘড়ির কাঁটা। সূর্যোদয়ের পূর্বেই তিনি প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। ফিরে আসেন পৌনে সাতটায়। না, ‘পৌনে-সাত’ মানে ‘সাতটা বাজতে মিনিট-পনের নয়; আই. এস. টি : ছয়টা পঁয়তাল্লিশ। শীতকালে। গ্রীষ্মে সময়টা একঘণ্টা এগিয়ে যায়।

সাড়ে ছয়টা নাগাদ প্রাতরাশপ্রত্যাশী কৌশিক এসে বসল ‘ডাইনিং-হল’-এ। আর কেউ তখনো আসেনি। তার আগেই ওদের বাড়ির কাজের লোক, বিশু খান দু-তিন দৈনিক পত্রিকা উঠিয়ে নিয়ে এসেছে সদর থেকে। কৌশিক খুলে বসেছে একটা পত্রিকা।

আজ কাগজের প্রথম পাতাতেই বেশ বড় করে ছাপা হয়েছে একটি হত্যাপরাধ। হেডলাইন নিউজ নয়, তবে প্রথম পৃষ্ঠার ডানদিকে বেশ বড় হরফে ছাপা। গত পরশু রাত্রির ঘটনা। গত কালকের কাগজে মুদ্রণের সময় পাওয়া যায়নি। মনে হয় খবরটা অনেক রাত্রে আসায় আজ সবিস্তারে তা প্রকাশিত হয়েছে। ইস্ট-কোস্ট এক্সপ্রেসের ফার্স্টক্লাস কামরায় আবিষ্কৃত হয়েছে একটি মৃতদেহ।

এ জাতীয় সংবাদ প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান পাওয়ার কথা নয়। পথে-ঘাটে আজকাল সকাল-সন্ধ্যা মৃতদেহ আবিষ্কৃত হচ্ছে। পার্টি-মস্তানদের ক্রমাগত : ‘খুনকা বদলা খুন’। এটা তা নয়। প্ৰথমত মৃতদেহটা একজন সুন্দরী মহিলার, দ্বিতীয় কথা সেটা পাওয়া গেছে ওই ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস ‘কূপের’ কূপে এবং সর্বোপরি মেয়েটি একজন ধনকুবেরের একমাত্র কন্যা তথা একমাত্র ওয়ারিশ!

সাংবাদিকের আন্দাজে মহিলাটির বয়স ত্রিশ। অত্যন্ত ফর্সা, সুন্দরী এবং সুসজ্জিতা। তাঁর বুকের উপত্যকায় সম্ভবত বিদ্ধ হয়েছিল একটি তীক্ষ্ণ ছুরিকা— আমূল। ছুরিটা পাওয়া যায়নি। মহিলার ভ্যানিটি ব্যাগটা কিন্তু সিটের নিচে পাওয়া গেছে। তাতে ছিল সামান্য কিছু টাকা, দশ হাজার টাকার ট্রাভলার্স চেক, প্রসাধন সামগ্রী, রেলওয়ে টিকিট আর ক্যালকাটা-ক্লাবের সদস্য- কার্ড। শেষোক্ত কার্ড থেকেই জানা গেছে তাঁর পরিচয়। নাম : কমলকলি মালহোত্রা। স্বামীর নাম রূপেশ। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর পিতা হচ্ছেন স্বনামধন্য ধনকুবের : জগৎপতি দস্তুর।

শেষোক্ত হেতুতেই সংবাদটা প্রথম পৃষ্ঠায় অনেকখানি জায়গা জুড়েই ক্ষান্ত হয়নি উপচে পড়েছে পঞ্চম পৃষ্ঠাতে। পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গে সংবাদটা পরিবেশন করেছেন। মৃতদেহটি প্রথম আবিষ্কার করেন একজন তরুণ মেরিন এঞ্জিনিয়ার। তিনি কটক থেকে বিশাখপত্তনম যাচ্ছিলেন। সেই ‘সি’-চিহ্নিত কৃপেতে যখন তিনি প্রবেশ করেন তখন সেটা ফাঁকাই ছিল। কিন্তু ট্রেনটা ছাড়ার পরে তাঁর নাকে একটা ক্লোরোফর্মের গন্ধ ভেসে আসে। চলন্ত ট্রেনে সেটা অপ্রত্যাশিত। পরক্ষণেই তাঁর নজরে পড়ে নিচে একটা রক্তের ধারা। নিচু হয়ে তিনি দেখতে যান—সিটের নিচে কী আছে। তৎক্ষণাৎ তিনি চেন টেনে দেন। ভুবনেশ্বর স্টেশনের অনতিদূরে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে পড়ে।

পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে মহিলার স্বামী রূপেশ মালহোত্রা তাঁর নিজস্ব গাড়িতে ভুবনেশ্বর চলে যান। তিনিই মৃতদেহ শনাক্ত করেন। তিনি জানাতে চাননি বা জানেন না, মিসেস মালহোত্রা কোথায় যাচ্ছিলেন বা তাঁর কোনো পুরুষসঙ্গী ছিল কি না। তবে রেলওয়ে পুলিসের সরবরাহ-করা তথ্য অনুসারে সেই সি-কূপেতে যাচ্ছিলেন স-কন্যা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট পদ্মশ্ৰী জগৎপতি দস্তুর। মৃতের ভ্যানিটি ব্যাগে তাঁর টিকিটও ছিল। কন্যা খুন হয়ে যাবার সময় তিনি কোথায় ছিলেন জানা যায় না। রেলওয়ে চেকার জানিয়েছেন তিনি তখনো ওই কামরায় টিকিট চেক করতে যাননি। মহিলার সঙ্গে ওই ভ্যানিটি-ব্যাগ ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো মালপত্র ছিল না। সংবাদপত্রের তরফ থেকে জগৎপতি দস্তুরকে তাঁর কলকাতার লাউডন-স্ট্রিটের বাড়িতে ফোন করা হলে তিনি জানান যে, কন্যার মৃত্যুসংবাদ তিনি ইতিপূর্বে জেনেছেন; তাঁর জামাই ভুবনেশ্বরে চলে গেছেন, তিনি নিজে ওই ট্রেনে আদৌ যাননি।

ইতিমধ্যে সুজাতা এসে বসেছে। সে আর একটি সংবাদপত্র তুলে নিয়ে ওই মর্মান্তিক হত্যাসংবাদটিই পড়ছিল। বললে, ব্যাপারটা অত্যন্ত মিস্টিরিয়াস, তাই নয়? ‘স্বামী-স্ত্রী’ যুগলে গেলেই সচরাচর কূপেতে রিজার্ভেশন পাওয়া যায়। কোনো একক মহিলাকে কূপেতে এভাবে একা যেতে দেওয়া হয় না। অথচ রূপেশ মালহোত্রা কলকাতায় ছিলেন। তিনি জানেন না, তাঁর স্ত্রী কার সঙ্গে কোথায় যাচ্ছিলেন! এটা বিশ্বাস্য?

কৌশিক বলে, অফকোর্স! ‘এন্তাই তো হোন্দাই রতা’—এমনটা তো হয়েই থাকে। আমি সঙ্গে না থাকলে তুমি কি একা-একা কোন পুরুষ-সঙ্গীর সঙ্গে কোথাও যেতে পার না? বা জীবনে কখনো যাওনি?

—না! কূপেতে নয়!

—কিন্তু কূপেতে রাত্রিবাসের কোনো পরিকল্পনা তো ওদের ছিল না। থাকলে ওই মেরিন এঞ্জিনিয়ার কটক থেকে সন্ধ্যারাত্রিতে ওই কূপেতে রিজার্ভেশন পেতেন না। মিসেস মালহোত্রার গন্তব্যস্থল ছিল নিশ্চয় কটকের আগের কোনো স্টেশন। তাছাড়া ‘পুরুষ’ কোনো সহযাত্রী যে ছিলই এমন কোনো এভিডেন্স এখনো তো আবিষ্কৃত হয়নি।

এই সময়েই বাসু-সাহেব ফিরে এলেন প্রাতভ্রমণ সমাপ্ত করে। ওভারকোটটা খুলে এসে বসলেন তাঁর নির্দিষ্ট চেয়ারে। বললেন, ‘কী লয়ে বিচার? শুনিলে বলিতে পারি কথা দুই-চার ও বুঝেছি! কমলকলি হত্যারহস্য। কাগজটা খুঁটিয়ে পড়েছ?

কৌশিক বলে, আপনি জানলেন কী করে? আপনি যখন বেড়াতে যান, তখনো তো সকালের কাগজ আসেনি?

ইতিমধ্যে চা-কফির সরঞ্জাম নিয়ে ফুটকি আর বিশু এসে উপস্থিত। ফুটকি হচ্ছে বিশুর সম্পর্কে দিদি। সে সম্প্রতি বহাল হয়েছে মিসেস বাসুর কম্পানিয়ান হিসাবে। তাছাড়া সুকৌশলী দম্পতির সদ্যোজাত কন্যার তদারকি করতে। রানীদেবীও তাঁর হুইল চেয়ারে পাক মেরে এসে উপস্থিত হলেন ভিতর বাড়ি থেকে।

বাসু কৌশিকের প্রশ্নের জবাবে বললেন, শুধু সংবাদপত্র-নির্ভর গোয়েন্দাগিরি শালক- হোমসের আমলে চলত মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ সুকৌশলী। এখন প্রচার মিডিয়া অনেক-অনেক অ্যাডভান্সড। তোমরা বোধহয় কাল অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলে—সান্ধ্য টি. ভি. নিউজ শুনবার সময় পাওনি।

রানু একটু পরে এসেছেন। তাই আলোচনার ধরতাইটা ধরতে পারেননি ঠিক। বললেন, কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে? কমলকলি হত্যারহস্য?

বাসু বলেন, ওই দেখ! তোমাদের মামীও খবরটার বিষয়ে ওয়াকিবহাল!

কৌশিক জানতে চায়, এটা কি আইনত রেলওয়ে পুলিসের এক্তিয়ারে, না উড়িষ্যা পুলিস- ফোর্সের?

বাসু বলেন, আইন-টাইন আমি ভাল বুঝি না বাপু। তবে আমার আন্দাজ : এটা বর্তমানে তোমার-আমার এক্তিয়ারে।

—আপনার-আমার? কোন সূত্রে?

বাসু নিঃশব্দে তাঁর পকেট থেকে একটি খাম বার করে ওদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, এটা কাল সন্ধ্যায় স্পেশাল মেসেঞ্জারে এসেছে। পড়ে দে’খ…

খামটা বেশ ভারী, দামী ওজনদার কাগজের জন্য। বাঁ-দিকের নিচে কায়দা করে মনোগ্রাম করা ইংরেজি বড় হরফে দুটি অক্ষরের জড়াজড়ি : ‘জে. ডি’। মাঝখানে কালো কালিতে—টাইপকরা নয়—বাসু-সাহেবের নাম ঠিকানা। প্রেরকের ঠিকানা খামের উপর নেই। ভিতরের চিঠিখানা কৌশিক খুলে বার করল। এটাও ইম্পোর্টেড দামী লেটার-হেডের কাগজ উপরে ছাপা অক্ষরে লেখা : ‘জগৎপতি দস্তুর’। ব্যস, আর কিছু না—না ঠিকানা, না কোন ফ্যাক্স-মোবাইল নম্বর—কিচ্ছু নেই। এই চিঠিখানিও টাইপ-করা নয়। জগৎপতির টানা হস্তাক্ষরে মোটা-মোটা ইংরেজিতে লেখা। বাঙলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় :

প্রিয় মিস্টার বাসু,

মিডিয়া-মাধ্যমে ইতিমধ্যে আমার দুর্ভাগ্যের কথা নিশ্চয় জানতে পেরেছেন। সাহায্যের প্রয়োজন। কাল, সকাল নয়টার সময় একবার অধমের গরিবখানায় পদার্পণ করলে একটু নিশ্চিন্ত হতে পারি।

ধন্যবাদান্তে ইতি
ভবদীয়
জগৎপতি দস্তুর।

কৌশিক চিঠিখানা ভাঁজ করতে করতে বললে, বুঝলাম। তা আপনার এক্তিয়ারটা বোঝা গেল, কিন্তু রহস্যের সঙ্গে ‘সুকৌশলী’র কী সম্পর্ক তা তো বোঝা যাচ্ছে না।

বাসু-সাহেব সে কথার জবাব না দিয়ে গৃহিণীর দিকে ফিরে বললেন, রানু, ‘অভিমান ‘ শব্দটার ইংরেজি কী গো?

রানু কর্তা-বাদে প্রত্যেকের প্লেটে কাঁটা-চামচ আর ডিম টোস্ট সাজাতে সাজাতেই জবাব দেন—ও শব্দটার ইংরেজি’ হয় না। যেমন বাঙলা হয় না সুজাতার মুখের বর্তমান অভিব্যক্তির। কর্তার কথায় she has blushed!

সত্যি কথা! সুজাতার মতে ‘সুকৌশলী’ ব্যারিস্টার বাসুর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাই কৌশিকের প্রশ্নটায় সে লজ্জা পেয়েছে।

বাসু তাঁর ফলে ভরা প্রাতরাশের ডিটা কাছে টেনে নিয়ে বললেন; তাহলে আমিই ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিই কৌশিককে। মাথার সঙ্গে কানের যে সম্পর্ক, মহাবীর কর্ণের যুগল কর্ণের সঙ্গে যুগল কুণ্ডলের যে সম্পর্ক অথবা মহাবীর পবননন্দনের সঙ্গে তাঁর লাঙ্গুলের যে সম্পর্ক!

কৌশিক হেসে ফেলে। বলে, আপনার শেষ উপমাটায় আমি কাৎ এবং মাৎ! মামু যখন স্বয়ং হুঁকোমুখো হ্যাংলা হতে স্বীকৃত তখন আমরা কেন হতে পারব না তাঁর যুগল লাঙ্গুল? কী বল সুজাতা?

সুজাতা কর্তাকে ধমক দেয়, সব সময় এমন বিশ্রি রসিকতা আমার ভাল লাগে না।

রানু বলেন, এবার কিন্তু তুমি অন্যায় রাগ করছ সুজাতা। তোমাদের মামু বাকপ্রয়োগের উত্তেজনায় নিজেই হুঁকোমুখোর উপমেয় হতে স্বীকৃত হয়েছেন। যুগল ল্যাজের কল্যাণে!

বাসু ফর্ক দিয়ে চেপে ধরে পেঁপের টুকরোটাকে কাটতে কাটতে বললেন, আমার ধারণা এটা ‘উপমা’ নয় আদৌ, ‘মেটাফার’। ফলে উপমান-উপ:মঘের প্রশ্নই ওঠে না।

প্রসঙ্গটা বদলে দেবার আগ্রহে সুজাতা বলে, আপনি কি এই মেয়েটিকে চিনতেন, মামু?

—কে? কমলকলি? হ্যাঁ, ওর বিয়েতেও নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম—যাওয়া হয়নি। দস্তুর- সাহেব আমার পুরানো ক্লায়েন্ট। ওই কমলকলি হচ্ছে জগৎপতির একমাত্র সন্তান। কম বয়সেই ওর মা মারা গেছেন। তখনো জগৎপতি যুবকই। কিন্তু সে আর বিয়ে করেনি।

রানু জানতে চাইলেন, কেন?

কেন, তা জানি না। তবে মা-হারা মেয়েটিকে দস্তুর দস্তুর মতো আদর দিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করে। পারে না।

সুজাতা বলে, ‘পারে না’ মানে? কী পারে না?

—’মানুষ’ হিসাবে গড়ে তুলতে। টোটালি স্পয়েল্ড চাইল্ড! তবে সুখের কথা, ড্রাগ্‌স্‌ ব মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের শিকার হয়ে পড়েনি। সোসাইটিতে মক্ষিরানীর ভূমিকাটাতেই তার সন্তুষ্টি। একাধিক তরুণ স্তাবকের স্তুতিতেই তার তৃপ্তি। ক্রমাগত সে বয়-ফ্রেন্ড পরিবর্তন করে ডেটিং করত। দস্তুরের এক কাজিনপুত্র একটা মার্ডার কেসে ফেঁসে যাওয়ায় আমি ওদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি। সেটা প্রায় বছর তিন-চার আগেকার কথা। ওই সময়ে কমলকলি একটি ক্লাস-ওয়ান লম্পটের প্রেমে পড়ে—যাকে বলে ‘হেড ওটার হীস্‌’। কী যেন নাম ছোকরার—হ্যাঁ, মনে পড়েছে, কুমার বিক্রমজিৎ সিং। নিজের পরিচয় দিতে সে নাকি বলত যে, সে হচ্ছে মধ্যপ্রদেশের কোন ভূতপূর্ব রাজপরিবারের সন্তান। সে আমলে ছেলেটিকে দেখেছিলাম। এক্সিডিংলি হ্যান্ডসম, স্মার্ট, টল। বলিউডে কেন যায়নি জানি না। তবে কানাঘুষায় শুনেছিলাম একটু ‘শেডী’ ক্যারাকটার। ব্যবসা করে, তবে কিসের বিজনেস্ কেউ জানে না। মাঝে মাঝেই মধ্যপ্রাচ্যের নানান জায়গায় উড়ে যায়—দুবাই, বেরুট, ওমান, কুয়েৎ। এদিকে মুম্বাই, হংকং, সিঙ্গাপুর! কলকাতায় এসে আশ্রয় নেয় খানদানী হোটেলে। তাজবেঙ্গল বা কেনিলওয়ার্থে। বিজনেটা কীসের জানা নেই, তবে অর্থাগমটা যে ভালই, তা আন্দাজ করা যায়। এ ছাড়া আর যা করে তা হল বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে বা বউয়ের সঙ্গে প্রেম। কমলকলির মতো অস্থিরমতি মেয়েকে সে আকর্ষণ করতেই পারে, কিন্তু এ ধরনের লোক যে মিস্ দস্তুরের মতো শিক্ষিতা বুদ্ধিমতীর মাথা ঘুরিয়ে দেবে এটা আশঙ্কা করা যায়নি। ছোকরা কিন্তু তাই দিয়েছিল। তবে জগৎপতিও পাকা খেলোয়াড়। দক্ষ হাতে সে ইন্টারফিয়ার করে আমার যতদূর আন্দাজ, সে সি. বি. আইয়ের কোন বড়কর্তাকে দিয়ে বিক্রমজিৎকে কড়কে দেয়। মিস্ দস্তুরের পিছনে ঘুরঘুর করলে তার ব্যবসার হাল-হকিকৎ নিয়ে টানা-পোড়েন শুরু হবে। তৎক্ষণাৎ বিক্রমজিৎ রণে ভঙ্গ দিয়ে হাওয়া। তারপর দস্তুর খুব তাড়াহুড়া করে রূপেশ মালহোত্রার সঙ্গে ওর বিয়েটা দিয়ে দেয়। দিল্লীতে। কলকাতাতেও একটা পার্টি থ্রো করেছিল। তাজবেঙ্গলে। কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি। যতদূর মনে পড়ে, তখন আমি চুঁচুড়ার সেই সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর ঘোষালের মার্ডার কেসটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

—সেই ‘ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটা’?

—হ্যাঁ, কৌশিক ওই রকমই কী একটা নামকরণ করেছিল মনে হচ্ছে।

রানী প্রশ্ন করেন, রূপেশ মালহোত্রার ব্যাকগ্রাউন্ড কী?

বাসু বলেন, আমি জানি না। রূপেশ ছোকরা দস্তুরের জামাই হবার আগেই আমার সেই কেস্টার ফয়সালা হয়ে যায়।

কৌশিক বলে, আমি কিন্তু তাকে ঘটনাচক্রে চিনি, মামু।

–কী রকম?

—একজন পসার-ওয়ালা অ্যাডভোকেটের একমাত্র মেয়ের সম্ভাব্য পাত্র ‘রেসুড়ে’ কি না সমঝে নিতে আমাকে একবার ঘোড়দৌড়ের মাঠে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করতে হয়েছিল। গতবছর। কলকাতার রেস-কোর্সে। সেখানেই আমার এক সহকারী চিনিয়ে দেয় রূপেশকে। ধনকুবের দস্তুর সাহেবের জামাইয়ের পরিচয়ে। তার মুখেই শুনেছিলাম, সিনিয়ার মালহোত্রা বেশ মালদার লোক ছিলেন। দস্তুর-সাহেবের সঙ্গে কী যেন ব্যবসায়িক-সূত্রে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও ছিল। রূপেশ ছেলেটি সুদর্শন, দীর্ঘকায়। গ্র্যাজুয়েট। বাপের ব্যবসা দেখত। ওর বিয়ের পরই সিনিয়ার মালহোত্রা প্রয়াত হলেন। বাপের সম্পত্তি সবকিছুই বর্তায় তাঁর একমাত্র পুত্রের হাতে। কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যে সে তার বেশিরভাগই উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে। ওই ঘোড়ার খুরে খুরে। কয়েকটি চালু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু ঘোড়া নয়, মদ্যপানে এবং আরও কিছু ‘ম’-কারান্ত ব্যাধিতে। পরে শুনেছি, ব্যবসাপত্র সবই লাটে উঠেছে। এখন শ্বশুরের সম্পত্তিই তার একমাত্র ভরসা! কারণ ব্যাঙ্কও নাকি ওকে কর্জ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। প্রচুর দেনায় আকণ্ঠ ডুবে সে শুধু প্রতীক্ষা করছে কবে পূজ্যপাদ শ্বশুরমশাই সাধনোচিতধামে প্রয়াণ করেন।

বাসু বললেন, পশ্চাৎপটটি পরিষ্কার বোঝা গেল।

ইতিমধ্যে সকলের প্রাতরাশ শেষ হয়েছিল।

রানু বললেন, মেয়েটির কপালটাই খারাপ! জন্মেছে রাজকন্যা হয়ে। বিয়ে হল এক মদো- মাতালের সঙ্গে। তার উপর রেসুড়ে।

বাসু বললেন, দোষ কি তার কপালেরই শুধু? পুরুষকারের নয়?

কৌশিক বলল, ‘পুরুষকার’?

—ওই হল রে বাপু! ‘নিয়তির’ বিপরীতার্থক স্ত্রীলিঙ্গে কী হবে আমি জানি না। ‘নারীবীর্য’ হবে কি? ‘উইমেন্স লিব’-এ ধ্বজাধারীরা কী বলেন? শব্দটা ব্যাকরণ সম্মত?

রানু বলেন, বৈয়াকরণিক কী বলবেন জানি না। প্রাণীবিজ্ঞানসম্মত নয়। তবে তোমার বক্তব্য আমরা বুঝেছি। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ তুমি। কমলকলি ডুবেছে স্বখাতসলিলে। ঈশ্বর তাকে একটা প্রকাণ্ড হ্যান্ডিকাপ দিয়ে দুনিয়াদারী করতে পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু নিজের দোষেই সে রেঘোরে প্রাণটা দিল।

কৌশিক বলে, শুনেছিলাম ওদের দুজনের মধ্যে নাকি মিউচুয়াল ডিভোর্স হতে চলেছিল। রূপেশ কাগজে সই করতে রাজি যদি শ্বশুরমশায়ের কাছ থেকে একটা অত্যন্ত মোটা অঙ্কের খেশারত পায়।

সুজাতা বলে, অর্থাৎ ‘নাকের বদলে সোনার নরুন’! রাজকন্যার বদলে অর্ধেক রাজত্ব! রানু প্রশ্ন করেন, কমলকলির নামে যেসব সম্পত্তি ছিল, তার ওয়ারিশ তো এখন রূপেশ? যেহেতু বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি।

বাসু বলেন, যদি না কমলকলি উইল করে সব সম্পত্তি অন্য কাউকে দিয়ে গিয়ে থাকে। প্রাতরাশ শেষ হয়েছিল। বাসু জানতে চান, কৌশিক কি তাহলে আমার সঙ্গে যাচ্ছ দস্তুরের ‘গরিবখানায়!’ না কি একাই যেতে হবে আমাকে?

কৌশিক জবাব দেবার আগে রানু বলে ওঠেন, তোমার যুগল লাঙ্গুলই সঙ্গে যাচ্ছে।

—যুগল-লাঙ্গুল?

—সরি। আই মীন দুটো কানই। মাথার টানে কান। কৌশিক আর সুজাতা।

সুজাতা বলে, কিন্তু মিঠু?

—সে থাকবে তার দিদার কাছে! চিন্তা কী?