চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ১৩

তেরো

আধঘণ্টা খানেক হল ওঁরা নিউ আলিপুরের ডেরায় ফিরে এসেছেন। নিখিল আসেনি। সে বাড়ি গেছে। তার স্ত্রী কাকলিকে নিয়ে আসতে।

বলে গেছে, আমাদের দুজনের আজ রাত্রে আপনার বাড়িতে নিমন্ত্ৰণ। মামিমাকে রান্নাবান্নার হাঙ্গামা করতে বারণ করবেন। আমি সাত-আট প্যাকেট চিকেন বিরিয়ানি আর মাংস নিয়ে আসব। ডিনার খেতে খেতে শুনব : কী করে আপনার জিস পালটার সমাধান হল। বাই দ্য ওয়ে স্যার—আপনি রাত্রে কী খাবেন?

—জানি না। তোমার মামিমা আজ আমার জন্য কী বরাদ্দ করেছেন। বোধকরি দুধ-সাবু!

—না, স্যার। আজ একটা ডে-অব-এক্সেপশান। আপনিও খাবেন চিকেন বিরিয়ানি। কিছু হবে না। আমি মামিমাকে বলব।

—দেখ, যদি পুলিসের হুম্‌কিতে সে রাজি হয়।

ও বাড়িতে মূল ঘটনার যবনিকা পড়ে গেছে। জাহানারা মেয়াদ খেটেছে, তার ফিঙ্গার-প্রিন্ট লালবাজারে সযত্নে সংরক্ষিত। তাছাড়া তার আলমারির ভিতরে সিক্রেট-ড্রয়ার থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে কমলকলির যাবতীয় গহনা—পান্নাবসানো নেকলেসটা বাদে অবশ্য। নেড়া কাসেম বোধহয় ভেবেছিল—পুলিশ কলকাতা শহরের হাজারটা বাড়িতে তল্লাসি করলেও শুধু ‘দস্তুর প্যালেসে’ করবে না। গোদরেজ আলমারির চাবিটা কমলকলি অনেকদিন আগেই দিয়েছিল সোমাকে—ওই আলমারিটা ব্যবহার করতে। নিখিলের ব্যবস্থাপনায় সোমা হাজরা ওরফে জাহানারা বেগমকে জেনানা হাজতে অপসারিত করা হয়েছে।

বাসু-সাহেব এ কেসে কোনও ফী নিতে অস্বীকার করেছেন। বলেছিলেন, আমি মূলত ডিফেন্স কাউন্সেলার। নিরপরাধ আসামীকে বাঁচানোই আমার ধর্ম। এ ক্ষেত্রে আমি স্বধর্মচ্যুত হয়েছি। প্রসিকিউশনের তরফে কাজ করেছি। কলি-মায়ের প্রাণটা তো ফেরত দিতে পারব না। সুতরাং…

দস্তুর জনান্তিকে বলেছিলেন, কিন্তু আপনি প্রকারান্তরে আমার মনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছেন। আমার মেয়েকে কলঙ্কমুক্তা করেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, কলির মৃত্যুর পর তার চাবির থোকাটা সোমার হেপাজতে এসে যায়। সন্দেহটা বিক্রমজিতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে সোমাই ওই চিঠিখানা কলির ড্রয়ারে রেখে দেয়।

—তা হোক! এক্ষেত্রে আমি কোন ফি নেব না।

কৌশিক সুজাতাও জোড়হস্তে বলেছিল, প্লিজ স্যার! আমরাও এক্ষেত্রে কিছু নিতে পারব না।

রাত সাড়ে-আটটা নাগাদ বিরিয়ানি পোলাওয়ের একগাদা প্যাকেট নিয়ে নিখিল সস্ত্রীক এসে উপস্থিত হল। সবাই জমিয়ে বসলেন ড্রইংরুমে। নিখিল বলে, এবার বলুন, স্যার, কী করে বুঝলেন? প্রথমে বলুন, সোমা হাজরাকে প্রথম কখন সন্দেহ করতে শুরু করেন?

—যখন সে বেমক্কা আমাকে প্রশ্ন করে বসল : “দিদি সেদিন. কীরকম ড্রেস পরেছিলেন জানেন?’ ফর আ সপ্লিট সেকেন্ড আমার মনে প্রশ্ন জাগল—এ কথা ও জানতে চাইল কেন? আমি সঙ্গে সঙ্গে বল্লাম, ‘হ্যাঁ, শুনেছি। একটা চাঁপা-রঙের বেনারসী।’ দেখলাম, ও দৃঢ় প্রতিবাদ করল। উইথ গাস্টো সে প্রমাণ করতে চাইল—না, চাঁপারঙের বেনারসী নয়, কালো শিফন শাড়ি। আমার মনে প্রশ্নটা বারবার উঠছিল—কেন? কেন? কেন? আমি ভেবে দেখলাম—আমাদের পরিচিত ট্রেনযাত্রীদের মধ্যে একমাত্র সোমা হাজরাই জানে যে, ‘সি’ কূপেতে কমলকলি একা যাচ্ছে দশ লাখ টাকার গহনা নিয়ে। সে নিজেই. যদি খুনটা করে তাহলে তার প্রথম কাজ হবে টাইম ফ্যাকটারটাকে গুলিয়ে দেওয়া। কিন্তু একা হাতে সে খুনটা করতে পারে না। যদি কেউ তার সহকারী থাকে তাহলে পারে। সুযোগমতো সে ক্লোরোফর্ম ভেজানো রুমালটা চেপে ধরবে কলির নাকে। ওর সহকারী ধরে থাকবে কলির হাত দুটো। কলি অজ্ঞান হয়ে গেলে দুজনে কাজ হাসিল করে লাসটাকে বেঞ্চির নিচে চালান করে দেবে। আমার মনে হল তা যদি ঘটে থাকে তাহলে ওরা সেটা করেছে খড়্গপুর বালাসোরের মাঝামাঝি—অ্যারাউন্ড বেলা সাড়ে বারোটা থেকে একটা নাগাদ। সেক্ষেত্রে বালাসোরে ওর সহকারী অর্থাৎ নেড়া করিম কলির মালপত্র নিয়ে নেমে যায়। ক্লোকরুমে জমা দেয়। সোমার কাছে ছিল ওই কালো শিফন শাড়ির ডুপলিকেট সেট। ইন ফ্যাক্ট সে নিজেই কমলকলিকে ওই স্ট্রাইকিং পোশাকটা বেছে দেয়। দুটি কারণে—যাতে ফর্সা কমলকলি একটা কন্সপিকুয়াস চটকদারী ফিগর হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, ওর নিজের কাছে একটা ডুপ্লিকেট শিফন শাড়ির সেট আছে।…ডেডবডি বেঞ্চির নিচে পাচার করে নেড়া করিম যখন বালাসোরে নেমে গেল তখন ‘সি’ কূপের দরজায় ছিটকিনি দিয়ে পোশাক বদলিয়ে সোমা বসল জানলায়। ভদ্রক স্টেশনে সে ম্যাগাজিন ভেন্ডারকে ডেকে টাকা-পঁচিশের পত্রিকা কিনে পঞ্চাশটাকা দিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য : ভেন্ডারটা যাতে ফার্স্টক্লাস কূপেতে একজন কালো শিফন পরা ফর্সা মহিলাকে মনে রাখতে পারে। তার রূপযৌবন, বা গা দেখানো কালো শিফন শাড়ির জন্য না হলেও ওই পঞ্চাশটাকার নোট দিয়ে ভাঙানি না চাওয়ায়। সোমাই গোলাপী কাগজে প্রেমপত্র দুটি লেখে। একটি রেখে দেয় কলির ড্রয়ারে—চাবি তার কাছেই ছিল কলির মৃত্যুর পর। দ্বিতীয়টা ট্রেনের কামরায় ওর ভ্যানিটি ব্যাগে। কলির টেলিফোন রেকনয়টারে ‘অলি’ এন্ট্রিটাও তারই করা।

নিখিল জানতে চায়, তাহলে সে নামল কখন? কোথায়?

—সম্ভবত ভদ্রকের পরের স্টেশনেই—যাজপুর কেওনঝড়ে। হত্যাকাণ্ডটা যে ভদ্রকের পরে হয়েছে—অর্থাৎ সোমার জবানবন্দি হিসাবে সে নিজে বালাসোরে নেমে যাবার পর—এটা এসট্যাবলিশ করতে মার্ডার ওয়েপনটা সে ছুঁড়ে ফেলেছিল বিটুইন ভদ্রক অ্যান্ড যাজপুর।

কৌশিক বলে, কিন্তু পোস্টমর্টেমে অটোপ্সি সার্জেন কেন বললেন মৃত্যুর সময় সাড়ে তিনটের আগে নয়? তিনি তো ভদ্রক স্টেশনে কমলকলিকে জীবিত দেখতে পাওয়ার কথা জানতেন না!

—কারেক্ট। কিন্তু তিনি কীভাবে টাইম ফ্যাক্টারটা স্থির করলেন? খুব সম্ভবত মৃতের পাকস্থলী এবং অন্ত্রে খাদ্যের জীর্ণতার সূত্র ধরে। পাকস্থলীতে তিনি যে খাদ্য পেয়েছেন তা থেকে বুঝেছেন : খাদ্যগ্রহণের তিন সাড়ে-তিন ঘণ্টা পরে পরিপাক যন্ত্র কাজ করা বন্ধ করেছে। কারণ লোকটা মারা গেছে। তিনি পুলিসের কাছ থেকে জেনেছেন যে কমলকলি লাস্ট মিল বা ব্রেকফাস্ট খেয়েছে খড়গপুরে। অর্থাৎ বারোটা সওয়া বারোটায়। সুতরাং তার তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে—বিটুইন ভদ্রক অ্যান্ড যাজপুর সে মারা গেছে। অটোপ্সি সার্জেনের বিচার নির্ভুল। কিন্তু বাস্তবে কমলকলি ব্রেকফাস্ট খেয়েছিল বেলা নয়টায়। বাড়িতে। ফলে তারপর তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা যোগ দিলে হয় বারোটা সাড়ে বারোটা।

সুজাতা প্রশ্ন করে, কিন্তু নেড়া করিম যে বেঁটে আর মোটা এটা আন্দাজ করলেন কেমন করে?

—খুব সহজে। হত্যাপরাধটা রূপেশ অথবা বিক্রমজিতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল সোমা। ও জানত না—কার কী জাতের ‘অ্যালেবাই’ আছে। তাই লোকটাকে খুব বেশি চিহ্নিত করেনি। তবে রূপেশ ও বিক্রমজিত দুজনেই রোগা ও লম্বা। আমার মনে হল যে, নেড়া করিমও যদি রোগা এবং লম্বা হয় তাহলে সোমা কিছুতেই ও কথা বলত না। সে বলত, ভদ্রলোক রোগা কি মোটা, লম্বা কি বেঁটে তা সে নজর করেনি। এ থেকেই আন্দাজ হল জাহানারা বেগমের সহকারী ছিল হয়তো মোটা আর বেঁটে!

এই সময়ে বিশে এসে জানালো দস্তুর-সাহেবের ড্রাইভার সাহেব এসেছেন। তিনি দেখা করতে চান।

বাসু বললেন আসতে বল তাকে।

লোকটা এসে স্যালুট করল। তার হাতে একটা বিগ শপার ব্যাগ। একটি খাম সে হস্তান্তরিত করল বাসু-সাহেবকে।

একই রকম খাম, একই রকম কাগজ। খামটা খুলে উনি পড়লেন :

“প্রিয় ব্যারিস্টার-সাহেব,

পত্রবাহকের হাতে কয়েকটি জিনিস পাঠালাম :

1.A. কলকাতা পুলিসের কাছ থেকে পান্না বসানো (বিষদ বিবরণ-সহ) একটি নেকলেস প্রাপ্তির রসিদ।

1.B. ইন্সপেক্টর দাশের মিসেসকে আমি সেটা উপহার দিচ্ছি—এই মর্মে একটা স্বীকারোক্তি। প্রসঙ্গত পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমি টেলিফোনে জানিয়ে তাঁর অনুমতি নিয়েছি।

2. কলির সেই কসম্যাটিক কম্প্যাক্টের বাকি গহনাগুলি। এগুলি আপনার নাতনির জন্যে আমার আশীর্বাদী। তার বিবাহের সময় আপনি-আমি হয়তো উপস্থিত থাকব না তার বিবাহে আমার অগ্রিম আশীর্বাদ ও যৌতুক। কী জানেন বাসু-সাহেব? ওই গহনাগুলো এ-বাড়িতে রাখতে মন সরছে না। মর্মান্তিক দুঃখ বিজড়িত স্মৃতিচিহ্ন। যদি নিখিলবাবু ও কৌশিকবাবু মনে করেন এই অলঙ্কারগুলি অশুভ ও অভিশপ্ত তাহলে তাঁরা যেন গহনা ভেঙে নতুন করে গড়ে নেন। আমাকে যেন প্রত্যর্পণ না করেন। বাকি রইলেন আপনি নিজে এবং মিসেস বাসু-আপনার জন্য এক বোতল ‘রয়্যাল স্যালিউট’ পাঠালাম। দুঃখ ভোলাতে এমন ওষুধ আর নেই। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি! সবচেয়ে বড় কথা : আপনি ‘কলি’কে মিথ্যা কলঙ্ক থেকে মুক্ত করেছেন। আমাকে শান্তি দিয়েছেন। কন্যার স্মৃতির সঙ্গে কোনো ক্লেদ যুক্ত হয়ে রইল না। মিসেস বাসুই একমাত্র ব্যতিক্রম। তাঁকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ব্যতীত আর কোন উপহার পাঠালাম না। সে ধৃষ্টতা দেখাবার স্পর্ধা আমার নেই। বিবাহসূত্রে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাঁকে যে রত্নটি উপহার দিয়েছেন, তার পর আর কোনো পার্থিব উপহার তাঁর কাছে অকিঞ্চিৎ!

ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন।

ইতি
ভাগ্যহীন
জগৎপতি দস্তুর।”