চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ১২

বারো

দিন দুই পরে ওরা ফিরে এল কলকাতায়। নেড়া করিম তার দলের লোকের নাম বলেনি। মানে বলেছে, কিন্তু ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ পদ্ধতিতে। হ্যাঁ, নেকলেস্টা ওকে বিক্রি করতে দিয়েছিল ওর সেই পুরনো দিনের দোস্ত—ব্রিজলাল কাহার। কিন্তু তার পাত্তা ও জানে না। কথা ছিল, ব্রিজলাল এসে ওর কান্দিভেলির কর্মস্থলে মাঝে মাঝে ফোনে খবর নেবে। মালটা ঝেড়ে দেওয়া হয়েছে জালে সে ওই দোকান থেকেই নগদে সওয়া লাখ টাকা নিয়ে যেত। মুম্বাইয়ে সে কোন ঠিকানায় থাকে তা নেড়া করিম জানে না। ব্যস! চ্যাপ্টার ক্লোজড্!

খবরে খুশি হতে পারলেন না দস্তুর-সাহেব। নেকলেস্টা উদ্ধার হয়েছে জেনে তিনি বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখালেন না। নিখিল দাশ নিজেও খুশি হতে পারেনি।

বাসু-সাহেব ওদের কাছ থেকে সব কিছু খুঁটিয়ে শুনলেন। বললেন, সমাধানের দিকে আমরা এখনো একপদও অগ্রসর হতে পারিনি। এমনকি দ্বিধারাটাও এখনো একমুখি হল না।

সুজাতা বলে, ‘দ্বিধারা’ মানে?

—হত্যার উদ্দেশ্যটা তো দুই ধারায় বইছে। প্রথম থেকেই। যদি সম্পত্তির লোভে প্রফেশনাল মার্ডারার এনগেজড করা হয়ে থাকে তাহলে প্রাইম সাস্পেক্ট রূপেশ মালহোত্রা। সেকেন্ডলি : পামেলা কাত্রোচ্চি। উভয় ক্ষেত্রেই খুনীকে সম্ভবত ওই আট দশ লাখ টাকায় পুরস্কৃত করা হয়েছে। আর যদি সম্পত্তির লোভে কমলকলিকে খুন করা না হয়ে থাকে তাহলে আমাদের জানতে হবে—কে, কে জানতো যে ফার্স্ট-ক্লাস কূপেতে কমলকলি অরক্ষিতা অবস্থায় দশ লক্ষ টাকার গহনা নিয়ে চলেছে!

সুজাতা বলে, আমরা জানি : অনেকেই সেটা জানত। আবার এমনও হতে পারে আরও অনেকে হয়তো জানতো, যে খবর আমরা জানি না।

নিখিল বলে, তা ঠিক। রূপেশ আর বিক্রমজিৎ জানত। দস্তুর সাহেব, পামেলা জানতেন, সোমা হাজরা জানত, হয়তো হেড বাবুর্চি ইসমাইল, বা ওঁর হেড বেহারাও জানত। এমনকি দস্তুর-সাহেবের কাজিনের পুত্র, পুত্রবধূ—মানে, যাদের বিয়ের অ্যানিভার্সারিতে কমলকলি চাঁদিপুর যাচ্ছিল, হয়তো তারাও তথ্যটা জানত। আমরা তা জানি না।

বাসু বললেন, আরও একজন জানত। তার নাম তুমি করলে না।

নিখিল বলে, আর কে?

—কমলকলি নিজে।

পরিবেশটা এতই ঘন হয়ে উঠেছে যে, এ রসিকতায় কেউ কিন্তু হাসল না। বাসু অতঃপর জানতে চান, নেড়া করিমের এমপ্লয়ার, মানে সেই কান্দিভিলির রিপেয়ার শপ ওনারের বয়স কত? দেখতে কেমন?

কৌশিক বলে, টিপিক্যাল বিহারী ব্রাহ্মণ। তবে স্বাস্থ্য ভালো। লম্বা-চওড়া। কপালে ত্রিপুণ্ড্রক, মাথায় কাঁচাপাকা চুলে লম্বা টিকি। চোখে বাইফোকাল। রঙ কালো। বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ।

বাসু চোখ বন্ধ করে শুনছিলেন। হঠাৎ বলেন, আর নেড়া করিম? বেঁটে আর মোটা?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। রীতিমতো বেঁটে আর মোটাও। কিন্তু আপনি কী ভাবে….

—ব্যস্ ব্যস্ ব্যস্। আর কিন্তু টিন্তু নয়। জিগ্‌ ধাঁধার ওই একটা পীস্ই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এখন নাইন্টি-এইট পার্সেন্ট চান্স আমার সলুশান হয়ে গেছে। বাকি দু-পার্সেন্ট লুকানো আছে লাউডন স্ট্রিটে। রানু, তুমি দস্তুরকে একবার টেলিফোনে ধর তো!

রানীদেবী তাঁর হুইল চেয়ারে পাক মেরে টেলিফোনের কাছে এগিয়ে গেলেন। বাসু বলেন, নিখিল, তোমারও একটা জরুরী কাজ আছে। এখনই সঞ্জয় সিংকে একটা ফ্যাক্স করে দাও—কান্দিভেলির রামবিলাস মিশিরকে যেন তিন শিফটে নজরবন্দি করে রাখে। জাস্ট ফর টু ডেজ। লোকটা যেন পালাতে না পারে।

কৌশিক বলে, রামবিলাস মিশির? কেন? তার কী অপরাধ?

—বাঃ! তুমিই তো বললে, কপালে ত্রিপুণ্ড্রক, মাথায় টিকি।

রানু টেলিফোনে দস্তুরকে ধরেছেন। বাসু বললেন, লুক হিয়ার মিস্টার দস্তুর! সেদিন সন্ধ্যায় আপনি অযাচিত আমার বাড়িতে এসেছিলেন। আজ আমি একটা রিটার্ন ভিজিট দিতে চাই। রাইট নাউ। ইন হাফ অ্যান আওয়ার! আপনার সময় হবে?

—হবে, নিশ্চয় হবে। কিন্তু ব্যাপারটা কী?

—আপনি টেপ-রেকর্ডারের বোতামটা টেপেননি তো?

—না, না! কী যে বলেন!

—তাহলে বলি, আপনি আমাকে যে কাজটা অ্যাসাইন করে ছিলেন তার সমাধান হয়ে গেছে-

—মানে? আপনি জানেন, কে ট্রেনের কামরার মধ্যে কলিকে…

উনি বাক্যটা শেষ করার আগেই বাসু-সাহেব বলেন, ইয়েস্ স্যার! শুধু তাই নয়, সেই গোলাপীখামে যে ভদ্রলোক চিঠি লিখেছিলেন তাঁর পরিচয়টাও। বাই দ্য ওয়ে মিস্ পামেলা কাত্রোচ্চি বাড়িতে আছেন তো?

—না নেই। আমরা পুরী থেকে ফিরে আসার সময় সে ওখানেই থেকে গেছে। ‘তোশলী স্যান্ডস বীচ’-এ। আজই তার ফেরার কথা।

—অন্তত মিস্ সোমা হাজরা তো আছে? তার কাছে দু-একটা কথা জানার আছে।

দস্তুর বলেন, সরি স্যার। সেও কলকাতায় নেই। দুদিনের ছুটি নিয়ে বর্ধমানে গেছে। তবে আজই তার ফেরার কথা। সন্ধ্যাবেলা।

—তা হলে আমরা এখনই আসব?

—বাই অল মীন্‌স্‌।

—আমার সঙ্গে নিখিল আর সুকৌশলী দম্পতি থাকবে—

—য়ু আর অল ওয়েলকাম!

দস্তুর-সাহেব দস্তুরমতো উত্তেজিত। বাড়ির বাইরে পায়চারি করছিলেন। পর পর দুখানি গাড়ি এসে ভিড়ল পোর্টেকোতে। পুলিসের জিপ আর কৌশিকের ফিয়াট। সেদিনকার সেই বেয়ারা এগিয়ে এসে খুলে দিল ফিয়াট গাড়ির দরজা। দস্তুর আপ্যায়ন করে নিয়ে গিয়ে বসালেন তাঁর বৈঠকখানায়।

বাসু সরাসরি কাজের কথায় এলেন, আমি কলি-মার ঘরটা একটু দেখব। আপনি আপনার সেই ডুপ্লিকেট চাবির থোকাটা নিয়ে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলুন।

কৌশিক, সুজাতা ও নিখিলকে বললেন, তোমরা এখানেই অপেক্ষা কর। আমরা পনেরো মিনিটের ভিতরেই ঘুরে আসছি।

ঘর থেকে নির্জন করিডোরে বার হয়েই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন দস্তুর। বাসুর হাত দুটি ধরে বললেন, টেল মি স্যার? ইজ ইট রূপেশ?

–নো! ইট ইজ নট! কিন্তু এভাবে মাঝপথে আমাকে রুখে দেবেন না প্লিজ। লোকটাকে আমি চিহ্নিত করেছি। তার পালাবার পথ নেই। কিন্তু নামটা জানানোর আগে আই মাস্ট সিকিওর দ্য মোস্ট ভাইটাল কনক্লুসিভ এভিডেন্স! সবার আগে দেখতে হবে, সেটা যেন বেহাত হয়ে না যায়। আসুন।

দস্তুর আর কথা বাড়ালেন না। দুজনে এসে দাঁড়ালেন কমলকলির তালাবন্ধ ঘরের সামনে। দস্তুর চাবির গোছা থেকে একটি চাবি বার করে গোদ্‌রেজের তালা খুলে দিলেন। ঘরে ঢুকেই তিন-চারটে সুইচ জ্বেলে দিলেন। ঘরটা আলোয় আলো হয়ে গেল। চালু হল এয়ার- কন্ডিশনারটা। বন্ধ করে দিলেন ফ্লাশ পাল্লাটা।

ঘরে একটা প্রকাণ্ড ডবলবেড খাট। একান্তে একটা টেবিলের উপর কমলকলির একটা এনলার্জড ফটো। মাল্যভূষিত। ঘরে ধুনোর গন্ধ। একান্তে সোফা সেটি, সেণ্টার টেবল। বাসু চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে একটা সোফায় বসে বললেন, বসুন। আমি আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আমার ধারণা : আমি সমাধানে উপনীত হয়েছি—কিন্তু একটু আগেই যে-কথা বললাম : মার্ডার কেস-এ একেবারে পাথুরে প্রমাণ দিতে না পারলে ডেথ্ সেন্টেন্স হয় না। সেই পাথুরে প্রমাণের সন্ধানেই আমি এখন এসেছি।

দস্তুর বললেন : সার্চ দ্য রুম, ইফ য়ু প্লিজ।

—দেখছি। তার আগে জানিয়ে দিই—আপনাকে টেনশনমুক্ত করতে—সেই গোলাপী রঙের খামে চিঠিখানা বিক্রমজিৎ লেখেনি। আপনার কন্যার সঙ্গে তার বিবাহোত্তর জীবনে কোনোও অসৎ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।

—তাহলে কে লিখেছে সেই চিঠিখানা? যেটা আমি তার প্রাইভেট ড্রয়ার থেকে আবিষ্কার করি? আর কে হতে পারে?

—বলছি। তার আগে আপনার হেড কুককে একবার এঘরে আসতে বলুন।

—হেডকুক? অফ্ অল পার্সেন্স, আমার হেডকুক? কেন? …ও আয়াম সরি।

ঘরের সুইচবোর্ডে একটা কলবেল ছিল। সেটা টিপে দিলেন। এল একজন খিদমদগার। তাকে বললেন, ইসমাইলকে ডেকে দে। বল জরুরী দরকার।

মিনিট-খানেকের ভিতরেই ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হল মহম্মদ ইসমাইল। দস্তুর প্যালেসের শেফ। খানদানী হোটেলে যেমন থাকে সফেদ চোঙামতো টুপি মাথায়। নত হয়ে সেলাম করে বললে, হুকুম ফরমাইয়ে সা’ব? ক্যা বানানা হ্যয়?

দস্তুর তাকে বুঝিয়ে বললেন ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন বাসু-সাহেব—ওঁর খানদানী মেমান। লোকটা পুনরায় সেলাম করে বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালো। বাসু হিন্দিতে বললেন, না, ইসমাইল কোন খাবার বানাবার ফরমায়েশ দেব বলে তোমাকে ডেকে পাঠাইনি। তোমার কাছে দু-একটা খবর জানতে এসেছি। তবে কথাটা তোমার ঠিক ঠাক মনে নাও থাকতে পারে। পাঁচ সাতদিন আগেকার কথা। তোমার যদি ঠিক মতো য়্যাদ না হয় তাহলে কিচেনের আর পাঁচজন বাবুর্চি খানসামার সঙ্গে শলাহ্ করেও আমাকে জানাতে পার। আমি অপেক্ষা করব।

—লেকিন সওয়াল ক্যাঁ হ্যয়, জনাব?

—মিসেস মালহোত্রা, মানে কমলকলি দিদিমণি যেদিন—মানে, বুধবার ঊনত্রিশ তারিখ সকালবেলা—ট্রেন ধরতে যান, সেদিন সকালে তিনি কি ব্রেকফাস্ট খেয়ে যান?

—জী হাঁ সা’ব! মেরা য়্যাদ হ্যায়।

—কী খেয়েছিলেন তা কি তোমার মনে আছে?

ইসমাইল লক্ষ্ণৌয়ী বিনয়ে বিগলিত হয়ে খানদানী উর্দুতে যা নিবেদন করল তা এইরকম :

—জী হাঁ সরকার! আমার সম্পূর্ণ স্মরণে আছে। কেও কি আমার হাতের রান্না দিদিমণি সেই শেষবার গ্রহণ করেন। তারপর আর কিছু তাঁকে রেঁধে খাওয়াতে পারিনি। সেদিন ব্রেকফাস্টে আমি তাঁকে পরিবেশন করেছিলাম চারখানি আলুর পরোটা, মুর্গ-মটর, একটা ওমলেট, সালাড, আর দু পিস সন্দেশ। লেকিন উনি মাত্র দু-পিস্ পরোটা নিলেন। ওমলেট ছুঁলেন না। সন্দেশও একটা মাত্র খেলেন।

–কোথায় বসে খেলেন? ‘ডাইনিং-হল’-এ?

—জী না। ওঁর ওয়াক্ত কম ছিল। উনি ট্রেন ধরার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলেন। আমি এঘরেই ওঁর খাবার এনে দিয়েছিলাম। ওই টেবিলে বসে উনি ঝট্‌পট ছোট-হারি খেয়ে নিলেন।

—ঘরে তখন আর কে ছিল? আর কে তাঁকে এঘরে বসে খেতে দেখেছে?

—আর কে থাকবে হুজুর? সোমা দিদিমণি শুধু ছিলেন। আর পরে রতন জুঠা বর্তন উঠিয়ে নিতে এসেছিল। সে দেখেছে। রতনের নিশ্চয় য়্যাদ হবে। কেও কি দিদি রতনকে বলেছিলেন, ‘রতন পরোটা আর ওমলেট জুঠা করিনি। তুই খেয়ে নিস্।’

বাসু জানতে চান, তখন দিদিমণি কি একটা কালো শিফন শাড়ি পরে ছিল?

—হুজৌর, ‘শিফন’ কাকে বলে আমি জানি না। তবে দিদিমণি ঘোর কালো রঙের মসলিন- তরিকা শাড়ি পরেছিলেন, ওই কাপড়ে তৈরি জ্যাকেট ভি পিনে হুয়ে ব্রেকফাস্ট খায়ী!

বাসু দস্তুরের দিকে ফিরে ইংরেজিতে বললেন, লোকটার মেমারি অ্যাপ্রিশিয়েট করতে আমি যদি ওকে একশ টাকা বক্‌শিস্ দিই আপনি কিছু মনে করবেন?

—অফকোর্স! বলে দস্তুর ঘুরে দাঁড়ালেন তাঁর হেডকুকের দিকে। পকেট থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বার করে তাকে দিয়ে বললেন, সাহেব তোমাকে এই ‘তোফা’ দিতে বলছেন, দিদিমণিকে তুমি ভালবাস, তাঁর কথা তোমার এত চমৎকার ভাবে মনে আছে। তারই জন্যে এই তোফা।

লোকটা লম্বা সেলাম দিয়ে বিদায় হল।

বাসু বললেন, এবার চলুন, মিস্ সোমা হাজার ঘরটা দেখব।

—আসুন।

কিন্তু সোমা হাজরার ঘরে ঢোকায় বাধা পড়ল। সে ঘরটা প্রাসাদের পশ্চিমপ্রান্তে, একান্তে। ঘরের দরজা দু-পাল্লার, সেগুনকাঠের রেইজড-প্যানেল পাল্লা। তাতে গোদরেজের তালা নেই। দুটি পিতলের কড়ায় ঝুলছে একটা মোক্ষম নবতাল। তদুপরি হ্যাপ্ বোল্ট-এ আর একটা মজবুত চাইনিজ লক! দস্তুর বললেন, এ তালার ডুপ্লিকেট চাবি আমার রিঙে নেই দেখছি। মনে হচ্ছে, সোমা নিজেই এই দুটি তালা কিনে এনে লাগিয়েছে।

বাসু বললেন, তাহলে আপনার ড্রাইভারকে ডাকুন। গাড়ি থেকে টুল-বক্সটা নিয়ে আসুক। তালা দুটো এখনি ভাঙতে হবে। তাছাড়া নিচে খবর পাঠান—ওরাও চলে আসুক। সর্বসমক্ষে তালা দুটি আমি ভাঙতে চাই।

দস্তুর বললেন, আজ বিকালেই কিন্তু মিস্ হাজরা ফিরে আসবে।

—আই ডোন্ট কেয়ার! আধঘণ্টার ভিতর তালা দুটি ভেঙে ফেলতে হবে।

.

তাই হল। ওঁরা বৈঠকখানায় গিয়ে আবার বসলেন। আধঘণ্টার মধ্যেই দস্তুরের সেক্রেটারি—পামেলা নন, ইনি পুরুষ—এসে খবর দিলেন তালা দুটি ভাঙা হয়েছে; কিন্তু হ্যাম্প-বোল্ট বা হুড়কো এখনো খোলা হয়নি।

ওঁরা উপরে উঠে এলেন। বাসু স্বহস্তে হুড়কো সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ছোট ঘর। দুটি জানলাই বন্ধ। একটা সিং বেড খাট। ড্রেসিং টেবিল। খান দুই চেয়ার। একটা ক্যানভাসের ইজিচেয়ার, ওপাশে দেওয়াল ঘেঁষে গোদরেজের স্টিল-আলমারি। খাটের উপর বিছানার চাদর মেঝে পর্যন্ত লুটানো

সেটা তুলে দেখা হল। নিচে খান-দুই স্যুটকেস। তালাবন্ধ

বাসু জানতে চান, ওই স্টিল-আলমারিটা কার? আপনার না সোমা হাজরার?

—আলমারিটা হাউস-প্রপার্টি। কিন্তু ভিতরে বোধহয় রাখা আছে সোমার কাপড় জামা। আমি ঠিক জানি না। কলি অথবা পামেলা থাকলে বলতে পারত।

—ওর চাবি আছে আপনার কাছে?

—ঠিক জানি না। চাবিটা ছিল ‘কলি’র কাছে। সে হয়তো সোমাকে দিয়েছে। তবে এর ডুপলিকেট হয়তো দীর্ঘদিন আমার কাছেই অব্যবহৃত পড়ে আছে।

—লেটস সি।

—কিন্তু কাজটা কি ঠিক হবে? সোমা তো আজ সন্ধ্যাতেই…

কথাটা শেষ হল না। বাসু এগিয়ে এসে ওঁর হাত থেকে চাবির গোছাটা কেড়ে নিয়ে দস্তুরের সেক্রেটারিকে দিলেন। বললেন, প্লিজ ট্রাই টু ওপন আপ্

দু-তিনটি থোকায় ত্রিশ-চল্লিশটা চাবি। ভদ্রলোক একটার পর একটা চাবি দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান। নিখিল অস্ফুটে প্রশ্ন করে, ওর ভিতরে আপনি কী খুঁজতে চাইছেন, স্যার? কী থাকতে পারে ওই আলমারির ভিতর?

—দ্য লাস্ট পীস্ অব দ্য জিগ্‌গ্স পাজল। সেই চাঁপা রঙের মুর্শিদাবাদী শাড়িখানা—যেটা পরে কলি এ বাড়ি ছেড়ে যায়।

নিখিল প্রতিবাদে কী একটা কথা বলতে যায়। তার আগেই দরজার কাছ থেকে শোনা যায় মহিলা কণ্ঠে একটা আর্তনাদ : একি? একী? আপনারা এখানে কী করছেন? তালা ভেঙে আমার ঘরে ঢুকে…

সবাই এপাশ ফিরে দেখেন দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে সোমা হাজরা। তার কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ। আর কী আশ্চর্য! তার পরিধানে চাঁপা রঙের একটা মুর্শিদাবাদী শাড়ি!

বাসু বলে ওঠেন, দেয়ার য়ু আর!

তারপর সুজাতা আর কৌশিকের দিকে ফিরে বলেন, কী হে ‘সুকৌশলী’? চাঁপা-রঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ি নাকি বাজারে বিক্রি হয় না।

ঠিক তখনি দস্তুরের সেক্রেটারির হাতের চাপে আলমারির হ্যান্ডেলটা ঘুরে যায়। তিনি বলে ওঠেন, খুলে গেছে, স্যার!

সোমা হাজরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাধা দিতে যায়। তাকে রুখে দেয় নিখিল। বলে, প্লিজ ডোন্ট অবস্ট্রাক্ট আস। আলমারির ভিতর কী আছে আমাদের দেখতে দিন। আপনার সামনেই আমরা তা দেখব।

—না, না, না! তা আপনারা পারেন না। আগে সার্চ ওয়ারেন্ট না করিয়ে আমার ঘরের ভিতরেই আসতে পারেন না।…

বাসু বলেন, কারেক্ট! আন্ডার সেকশান, 442 অব ইন্ডিয়ান পেনাল কোড অনধিকার প্রবেশ! তাছাড়া তালাভাঙা, আন্ডার সেকশান 445 অব I. P. C

সোমা ঘুরে দাঁড়ায় বাসু-সাহেবের মুখোমুখি। গলায় বিষ ঢেলে বলে, আপনি, আপনিই যত নষ্টের গোড়া। আপনি নিজেকে কী ভাবেন বলুন তো? শাহ-য়েন-শাহ্! বাদশাহ্? যা ইচ্ছে করবেন?

বাসু-সাহেব একটি ছদ্মকুর্নিশ করে বলেন, জী নেহী জাহানারা বেগম-সাহেবা। বান্দা তো হাঁয় হুজুরাইনকী নফর!

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো লাফিয়ে ওঠে ইন্সপেক্টার নিখিল দাশ।

–কী? কী বললেন? জাহানারা বেগম সাহেবা?

—ইয়েস ইন্সপেক্টার দাশ! নেড়া কাশেমের সাগরেদ জাহানারা বেগম কুয়েত, বা দুবাই চলে যাননি। দস্তুর-প্যালেসে চাকরি নিয়েছিল কলির কম্পানিয়নের পরিচয়ে! ঠিক দু-বছর আগে।

সোমা হাজরা চিৎকার করে ওঠে, কে? কে জাহানারা বেগম? আপনি…আপনারা….

বাসু ডান হাতটা তুলে তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেন। বলেন, একটি কথাও বল না সোমা! যতক্ষণ না তোমার পক্ষের সলিসিটার উপস্থিত হচ্ছেন। সে কন্সটিটিউশানাল রাইট তোমার আছে। কারণ নিখিল তোমাকে অ্যারেস্ট করছে একটা মারাত্মক চার্জে : এইডিং অ্যান্ড অ্যাবেটিং আ ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার!

নিখিল নিঃশব্দে এগিয়ে আসে। সোমা হাজরার হাতে পরিয়ে দেয় স্টেনলেস্ স্টিলের একজোড়া বালা। আলমারির হ্যান্ডেল ঘোরানো গিয়েছে আগেই। নিখিল কারও অনুমতির অপেক্ষায় থাকল না। টেনে খুলে দিল আলমারির পাল্লাটা। সামনেই জড়ো করে রাখা একটা কালো শিফনের শাড়ি-জ্যাকেট।

সোমা দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ে একটা চেয়ারে।