চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ১১

এগারো

পরদিন ভোরবেলাকার মুম্বাই ফ্লাইটে রওনা হয়ে গেল ওরা দুজন—নিখিল আর কৌশিক। মুম্বাই এয়ারপোর্টে পৌঁছে নিখিল বললে, মুম্বাইয়ে আমরা একত্রে থাকব না। আমি থাকব আমার এক সহকর্মীর বাড়িতে চার্চ গেটে। রাত সাড়ে আটটায় আমি থাকব বান্দ্রায়। কার্টার রোডে সমুদ্রের ধারে একটা ‘সি ফেয়ারার্স ক্লাব’ আছে। সেখানেই অপেক্ষা করব। সাড়ে আট থেকে সাড়ে নয়। তুমি একাই যাবে জনাব আবদুল লতিফের বাড়িতে। ওঁর বাড়ি থেকে ক্লাবটা ইষ্টক- ক্ষেপণ দূরত্বে। প্রয়োজনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ কর। লোকটা ধরা পড়লে তো নিশ্চয়ই।

কৌশিক রাজি হল। ওরা নির্গমনদ্বার দিয়ে বার হয়ে আসতেই নিখিল বলল, ওই প্ল্যাকার্ডটা দেখ। লোকটা তোমাকেই রিসিভ করতে এসেছে। ওর কাছে এগিয়ে যাও।

যারা যাত্রীদের নিতে এসেছে তাদের মধ্যে একজনের বোর্ডে লেখা ‘কে মিত্র’।

কৌশিক তার কাছে এগিয়ে আসতেই লোকটা বললে, গুডমর্নিং, স্যার, য়ু আর কৌশিক মিত্র? ফ্রম ব্যারিস্টার…

কৌশিক পাদপূরণ করল : পি. কে বি—

—আইয়ে স্যার, মেরা সাথ। সামান?

কৌশিক জানালো তার হাতে যে অ্যাটাচি কেস আছে এছাড়া তার আর কোন মালপত্র নেই। ওরা এগিয়ে এল পার্কিং লটের কাছে। লোকটা সবিনয়ে বলল, বুরা না মানিয়ে সাব, আপকো ড্রাইভিং লাইসেন্স?

–বুরা মাননেকা ক্যা সওয়াল? বলতে বলতে কৌশিক তার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা দেখিয়ে দিল। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি নেই। ফিয়াট গাড়ি। ঘুরতে ঘুরতে চলে এল বান্দ্রায়, কার্টার রোডের কাছাকাছি।

এয়ারপোর্ট থেকে বেশি দূরে নয়। এসে থামল একটা থ্রি-স্টার হোটেলের সামনে।

এই হোটেলেও কে. মিত্রের নামে একটা সিঙ্গল বেড ঘর আগে থেকেই বুক করা আছে। আবদুল মিঞার বাড়িতে স্থানাভাব নেই—বড় এ/সি গেস্টরুম আছে। তবু তিনি অগ্রিম এই ব্যবস্থাটি করে রেখেছেন। ড্রাইভার হিন্দিতে জানালো, আমার সাহেবকে বাড়িতে বা দোকানে ফোনটোন করবেন না। প্রয়োজনে তিনিই যোগাযোগ করবেন! আপনি যা যা অর্ডার দেবেন, শুধু ভাউচারে সই করে দেবেন। নগদ পেমেন্ট কিছু করবেন না। আমি রাত সাড়ে আটটায় আবার আসব।

কৌশিকের সঙ্গে একটা ক্রাইম থ্রিলার ছিল। সে সারাদিন বই পড়ল, টি.ভি দেখল, কর্মহীন একটা অলস দিন অতিবাহিত করে দিল হোটেলে। পশ্চিম দিকের জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। সেদিকে সূর্যাস্ত হল। শুভ্রপক্ষ গাংচিল দলের ক্রমাগত ওড়াউড়ি। কলকাতায় একটা ফোন করল। তার নিরাপদ পৌঁছানো সংবাদ আর হোটেলের টেলিফোন নম্বর জানিয়ে দিতে।

রাত সাড়ে-আট পার হয়ে গেল। লোকটা এল আরও আধঘণ্টা পরে। বিলম্ব হওয়ার জন্য মাফি চাইল। তারপর বলল, আসুন স্যর, এবার আমরা যাব-

—কোথায়? জনাব আবদুল লতিফের বাড়িতে?

—জি না। বান্দ্রা পুলিশ স্টেশন। ওখানেই ওঁরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

কৌশিক কথা বাড়ালো না। ‘ওঁরা’ বলতে কারা, তাও জানতে চাইল না। রওনা হল ফিয়াট গাড়িতে।

বান্দ্রা পুলিস স্টেশনে অপেক্ষা করছিল নিখিল দাশ। ধড়াচূড়া পরা। বলল, এস কৌশিক, আলাপ করিয়ে দিই—ইনি মিস্টার সঞ্জয় সিং, বান্দ্রা পি.এস্-ইনচার্জ। খবর ভাল। লোকটা হাতেনাতে ধরা পড়েছে। আবদুল মিঞার বাড়ির কাছাকাছি। তবে অনেকটা দূরে। কোন ‘ইয়ের ব্যাটা’ বলতে পারবে না : এই ধরিয়ে দেবার মধ্যে জহুরী আবদুল মিঞা-সাহেবের কোনো হাত আছে, নেকলেসটা রসিদ দিয়ে ক্যালকাটা পুলিসের তরফে আমি নিয়েছি। দেখবে?

কৌশিক ইংরেজিতে বলে, এমন জিনিস তো বাজারে খরিদ করে বউকে উপহার দিতে পারব না, কী বলেন সিংজী? একটু হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করি। তাতেই তৃপ্তি।

ও.সি. সাহেব তাঁর গোঁফ চুমড়িয়ে শুধু বললেন, সহী বাৎ!

নেকলেসটা বেশ বড় আর ভারী। তিন তিন ছয় আর মাঝখানে একটা বড় পান্নার লকেট। আবদুল মিঞা বাড়িয়ে বলেননি—লাখ্ দুয়েকের বেশি হওয়াও বিচিত্ৰ নয়।

নিখিল বলে, লোকটা একটা দাগী জুয়েল থিফ। বার্গলারি কেসে মেয়াদও খেটেছে বার- তিনেক। তবে আলমারি ভেঙে গহনা হাতানো ছাড়া আর কোন দিকে ঝোঁক নেই। খুন- খারাপির চার্জ কোনোদিন ওঠেনি খাতায়। ওর এলাকা মুম্বাই শহর। কলকাতা, দিল্লি, চেন্নাইতেও ওদের গ্যাঙটাকে কাজ করতে দেখা গেছে।

কৌশিক জানতে চায়, কী নাম লোকটার?

সঞ্জয় সিং আগ্ বাড়িয়ে হিন্দিতে জবাব দেন, দেখুন স্যার, এসব লোকের হরেক কিসিমের নাম থাকে। এরও আছে। পিতৃদত্ত নামটা কী জানি না। মিস্টার দাশ ওকে দেখে বলছেন, লালবাজারে, মানে ওর কলকাত্তাইয়া নাম : নেড়া করিম।

কৌশিক জানতে চায়, ‘নেড়া করিম’? কেন? এমন অদ্ভুত নাম কেন? লোকটা কি নেড়া? জবাব দিল সঞ্জয় : মূল ব্রেনারের মতো নিপাট কামানো মাথা। লোকটা অর্ডার দিয়ে গোটা কতক পরচুল বানিয়ে রেখেছে। হায়দরাবাদে ওর মাথায় বিরাট বাবুরি, এখানে ‘গুলিট’-এর মতো কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। কোলকাতায় নেড়া বোষ্টম। কোথাও ওর দাড়ি-গোঁফ দুইই আছে; কোথাও দাড়ি আছে, গোঁফ নেই; কোথাও গোঁফ আছে দাড়ি কামানো! কলকাতায় শুনেছি—

নিখিল ওঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, হ্যাঁ। গোঁফ-দাড়ি নিপাট কামানো। তবে বছর দুই-আড়াই ওকে দেখা যায়নি। অন্তত কলকাতার জুয়েলারি মার্কেটে অথবা ধনীর প্রাসাদে।

সঞ্জয় বললেন, এখানেও সে অনেকদিন লুকিয়ে লুকিয়ে ছিল। দেড় দু-বছরের মধ্যে ও অ্যারেস্ট হয়নি। কোনো জুয়েল লিফটিং বা বার্গলারি কেসে ওকে সন্দেহের তালিকাতেও পাওয়া যায়নি। ওদের গোটা গ্যাঙটাই বেশ কিছুদিন ইনঅপারেটিভ হয়ে গেছিল।

নিখিল জানতে চায়, গোটা গ্যাঙ বলতে?

—ওরা দলে ছিল তিন-চার জন। সম্ভবত নেড়া করিমই ছিল দলের পাণ্ডা। আর ছিল একজন বিহারী—সে লোকটাও ইদানীং না-পাত্তা। এছাড়া ছিল একজন গোয়ানিজ ইয়াং-ম্যান : আলফান্সা। সেও কর্পূরের মতো উপে গেছে। আমাদের রেকর্ডে দেখছি—নেড়া করিমের একটি মহিলা সহযোগীও এককালে ছিল। কেউ বলে, সে নেড়া করিমের জরু, কেউ বলে রক্ষিতা। মেয়েটি সুন্দরী। বছর পঁচিশ বয়স। কিন্তু তারও কোনো পাত্তা ইদানীং পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে একবার মাসছয়েকের জন্যে তার সাজাও হয়ে যায়। ধরা পড়ে ওদের সঙ্গে; কিন্তু গহনা চুরির কেস-এ সে ছাড়া পেয়ে যায়—

নিখিল বাধা দিয়ে বললে, এই যে বললেন, মাসছয়েক মেয়াদ খাটে?

—হ্যাঁ। মিথ্যে সাক্ষী দেবার অপরাধে। ‘আন্ডার ওথ’ সজ্ঞানে মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছিল বলে। সে মেয়েটিও এখন না-পাত্তা।

কৌশিক জানতে চায়, নেড়া করিম কী করে? থাকে কোথায়?

—বর্তমান নিবাস বোরিভেলি পাহাড়ের গায়ে একটা মুসলমান বস্তিতে। কাজ করে কান্দিভেলিতে। একটা মটোর রিপেয়ারিং শপে। গাড়ি রঙ করার কাজ। আমরা যাব ওর বাড়িতে এবং দোকানে। আপনাদের আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

নিখিল বলে, নেকলেসটা কীভাবে ওর ঝোলার ভিতর এল, সে বিষয়ে ও নিজে কী বলছে?

—বলছে : ও জানে না। ধরা পড়েই ওর তাৎক্ষণিক স্টেটমেন্ট : এটা কীভাবে তার বিগ-শপার ব্যাগে এসেছে তা ও জানে না। ওর কোনও ‘শ্যালিকাসুত্র’ ওকে ফাঁসাবার জন্য এভাবে ওর ঝোলার ভিতর একটা সোনার গহনা ফেলে দিয়ে পুলিশে খবর দিয়েছে।

—সেই ‘শ্যালকপুত্রে’র উদ্দেশ্যটা সম্বন্ধে ও কী বলছে?

সঞ্জয় বলে ‘দ্যা সেম কক্ অ্যান্ড বুল স্টোরি’। শেষবার মেয়াদ খেটে বেরিয়ে আসার পর ওদের গ্যাঙটা আবার ওকে দলে ফিরে যেতে ডাকছে। কিন্তু ও রাজি নয়, কারণ ইতিমধ্যে ও ‘ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির’ হয়ে গেছে। রঙ মিস্ত্রির জীবিকা ছেড়ে সে যেতে চাইল না। তাই এভাবে ওকে ফাঁসানো হল।

—দেড়-দুলাখ টাকার একটা নেকলেসের বিনিময়ে?

—তাই তো বলছি : কক অ্যান্ড বুল স্টোরি! গুছিয়ে একটা মিথ্যা গল্পও বলতে পারেনি লোকটা। নেড়াকে ডেকে পাঠাব? কথা বলবেন?

কৌশিক বললে, হ্যাঁ, লোকটাকে একবার চাক্ষুষ দেখে নেওয়া যাক। দু-চারটে প্রশ্নও করা যাবে, যাতে ওর বাড়ি বা দোকানের লোকের জবানবন্দির সঙ্গে ওর বক্তব্য কতটা মেলে যাচাই করে নেওয়া যায়।

ও.সির নির্দেশমতো নেড়া-করিমকে হাতকড়া পরানো অবস্থায় নিয়ে এল একজন সশস্ত্র পুলিস। নেড়া করিম খর্বকায় এবং স্থূলকায়। বয়স পঞ্চাশের এপারে নয়। ও.সি. বললেন, ওই টুলটাতে বস, করিম। তুমি নিজেই নিশ্চয় বুঝতে পারছ—ধরা পড়ার পরেই তুমি যে-কথা বলেছিলে তা দাঁড়ায় না। তোমাকে দলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টায় কোনো শালা তোমার ব্যাগে দু-লাখ টাকার একটা গহনা ঝেড়ে দেবে না! …না, না, কোনো কথা বল না। আগে শোন, আমি কী বলতে চাইছি। এক নম্বর কথা : তুমি ফেঁসে গেছ। হাতে-নাতে ধরা পড়েছ। তোমার আবার মেয়াদ হয়ে যাবেই। কোনো শালা ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু তুমি যদি আমাদের বলে দাও—সচ্ সচ্ বাতা দেও—কীভাবে তুমি ওটা পেলে, তাহলে তোমার বিরুদ্ধে গহনাচুরির কেসই আমরা আনব না। আনব চোরাই মাল পাচার করার অভিযোগ। চুরির দায়ে সাজা হলে দু-তিন বছর এই বুড়ো বয়সে ঘানি টানতে হবে। কিন্তু চোরাই মাল বেচার অপরাধ বড় জোর ছ-মাস জেল হবে। বাকি দলটা ধরা পড়লে, তুমি যদি রাজসাক্ষী হও তাহলে বেকসুর খালাসও হয়ে যেতে পার! দেখ ভেবে, সত্যি কথাটা বলবে কি না।

লোকটা মেদিনীনিবদ্ধ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবল। তার পর বললে, হুজুর ওরা আমাকে জানে মেরে দেবে।

—দেবে না। সবকটাকে জেলে ঢুকিয়ে দেব। তাছাড়া তুমি যদি চাও তাহলে তোমাকে রাজসাক্ষী করবই না আমরা। তুমি শুধু জানিয়ে দাও কে কোথায় তোমাকে এটা এনে দিয়েছিল। মুম্বাই বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করতে বলেছিল। আমরা জানি, তুমি ওই দল ছেড়ে দিয়েছ। সৎভাবে কান্দিভালিতে একটা মটোর রিপেয়ারিং শপে রঙ মিস্ত্রির কাজ করছ। আমরা আরও জানি, তোমাদের বাকি সবাই—সেই আলফান্স, আর সেই বিহারী বদমাশটার—কী যেন নাম মনে নেই…

নেড়া করিম হঠাৎ ধরতাইটা ধরিয়ে দেয়, ব্রিজলাল কাহার—হুজুর!

—হ্যাঁ, ব্রিজলাল! তাদের কারও সঙ্গে মুম্বাই জহুরী বাজারের জান পচান নেই। তুমিই এতদিন চোরাই মাল পাচার করেছ। মুম্বাই, হায়দরাবাদ, কলকাতার অনেক জহুরীর সঙ্গে তোমার জান্-পচান আছে। এ জন্যই ওরা তোমাকে দলে ফেরত নিতে চাইছে। এসবই আমাদের জানা। এখন বল, কে কখন তোমাকে এই নেকলেস্‌টা এনে দিয়েছে। তুমি বান্দ্ৰা অঞ্চলের ওই কার্টার রোডে ওটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলে? ওখানে তো কোনও জুয়েলারি দোকান নেই?

নেড়া করিম বললে, হ্যাঁ হুজুর, কবুল খাচ্ছি—এটা আমার ব্যাগে অজান্তে কেউ ফেলে দেয়নি। আমাকে বেচতেই দিয়েছিল। মালটার দাম স্যার, দু-লাখের কম হবে না। কিন্তু দেড়লাখে বেচতে পারলেই আমি এবার পঁচিশ হাজার টাকা মুনাফা করতাম। কারণ আমাকে ওরা জানিয়েছিল শওয়া লাখ্ পেলেই আমি যেন ওটা ঝেড়ে দিই

সঞ্জয় জানে—মূল প্রশ্নটা হচ্ছে : কে ওকে বেচতে দিয়েছিল। খুব সম্ভবত এ লোকটা জানে না, ওই অলঙ্কারটার সঙ্গে একটা মার্ডার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তা জানলে হয়তো পঁচিশ হাজার টাকা মুনাফার লোভে সে এতবড় দায়িত্বটা নিতই না। কিন্তু মূল প্রশ্নটা সরাসরি করার আগে লোকটাকে একটু সহজ হবার সুযোগ দিল। জানতে চাইল, তোমাকে হাজতে এরা ঠিকমতো দানাপানি দিচ্ছে তো?

নেড়া হাসি-হাসি মুখে বললে, ও-সব কথা ছেড়ে দিন স্যার। আমি তো এই প্রথমবার শশুরালে আসিনি। এখানকার আপ্যায়ন সম্বন্ধে আমার ঠিকঠাক অভিজ্ঞতা আছে।

সঞ্জয় শুনল না। একটা কন্সটেবলকে ডেকে অর্ডার দিল ওর হ্যান্ডকাফ খুলে নিতে। চার পেয়ালা চা আর বিস্কুট আনারও হুকুম দিল।

হাতকড়ি থেকে মুক্তি পেয়ে প্রৌঢ় মানুষটা একটু স্বস্তি পেল। সঞ্জয়ের অনুরোধে চা-বিস্কুট সেবনেও আপত্তি করল না। বলল, হুজুর, আমি বুড়ো মানুষ। পুরনো দিনের দোস্তটা এল। বলল, মালটা বাজারে ঝেড়ে দিতে পারলে, বিশ-পঁচিশ হাজার মুনাফা থাকবে। নেকলেসটা ওরা কোথায় হাতিয়েছে—দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, না কানপুর—আমি জানি না। জানতে চাইও না। কী দরকার আমার জেনে? আমি তো চিনির বলদ। চোরাই মালটা জান্-পহচান আদমির কাছে ঝেড়ে দেব। নগদ রুপেয়া গুনে নেব। ব্যস্। তারপর শালার গহনা বেরুট গেল না হংকং, তাতে আমার কী দরকার? কবুল খাচ্ছি হুজুর, লোভে পড়ে এটুকু পাপ আমি করেছি। এখন রাখলেও আপনি, মারলেও আপনি।

সঞ্জয় আক্রমণ করল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা দিক থেকে। ওর মনটা নরম করতে। বললে, বোরিভেলি বস্তিতে এখন কে, কে থাকে?

—আমার আব্বাজান, বিলকুল বুঢ়া। ঔর আম্মা। চোখে দেখে না। আমার ঘরওয়ালী আর দুটি মেয়ে।

–ছেলে নেই তোমার?

—ছিল হুজুর। ‘ছিল’ বলছি কেন? ‘আছে’। তবে আমার নাগালের বাইরে। জাহাজের খালাসী হয়ে গেছে সে। দরিয়ায় দরিয়ায় ঘুরে বেড়ায়। দু-পাঁচ বছর পরে মন চাইলে আসে। যখন ওদের জাহাজ মুম্বাই বন্দরে ভেড়ে।

—তোমার ঘরওয়ালীর নাম তো জাহানারা বেগম?

লোকটা চমকে ওঠে। চোখে চোখে তাকায়। পরক্ষণেই বোধহয় ওর পূর্বকথা মনে পড়ে যায়। বছর-তিনেক আগে শেষবার যখন সে ধরা পড়ে তখন ব্রিজলাল আর জাহানারাও ধরা পড়েছিল। ব্রিজলালের দু-বছর সশ্রম সাজা হয়, আর জাহানারার মাত্র ছয়মাসের। মাথা নেড়ে বলে, জী না হুজুর। আমার জরুর নাম ‘ফতিমা’। এ আমার প্রথমপক্ষের

—আর জাহানারা? যে গতবার তোমার সঙ্গে ধরা পড়েছিল। তারও তো ছয়মাসের মেয়াদ হয়ে যায়! সে কোথায়?

নেড়া উঠে গিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে ‘থুক’ ফেলে এল। গুছিয়ে নিয়ে বসে বললে : দোজখ্।

—দোজখ্? মতলব?

ধীরে ধীরে একটি বেদনার কাহিনী মেলে ধরল নেড়া। তার নিজের দু-বছরের মেয়াদ হয়েছিল। তার দ্বিতীয় পক্ষের বিবি জাহানারার হয়েছিল মাত্র ছয় মাসের কারাদণ্ড। নেড়া আশা করছিল মুক্তি পাবার পর জাহানারা আসবে তার খসমের সঙ্গে দেখা করতে। গরাদ দেওয়া খুপরির ভেতর থেকে অনেক অনেক দিন পর সে দেখবে তার সুন্দরী স্ত্রীকে। কিন্তু জাহানারা এল না। এক মাস দু’মাস তিনমাস। তারপর একদিন সাক্ষাত সময়ে দেখা করতে এল ওর প্রথমপক্ষের বিবি, ফতিমা। তার কাছেই পেল সংবাদ : পাখি উড়ে গেছে। ওরই হাতে গড়া সাগরেদ আলফানসোর সঙ্গে।

চরম বেইমানি! আলফানসোকে নেড়াই নিয়ে এসেছিল এ লাইনে। হাতে ধরে সব কিছু শিখিয়েছিল। গতবার সে ধরা পড়েনি। ফাঁক-ফোকর দিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। পুলিসে তার পাত্তা পায়নি। জাহানারা যেদিন জেনানা ফাটক থেকে ছাড়া পায় সেদিন ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল আলফন্স! জাহানারা জানত, সে নিজে অনিকেত। এতদিন সে ছিল একটা বস্তির ঘরে, নেড়া করিমের সঙ্গে। সে আশ্রয় হাতছাড়া হয়ে গেছে। ওর খসম্ এখনো মেয়াদ খাটছে। জেলখানা থেকে মুক্তি পেল জাহানারা বিলকুল খালি হাতে। তবে একেবারে নাঙ্গা ভিখারি নয়। তার ছিল দু-দুটি সম্পদ—জওয়ানি আর খুবসুরতি।

না, জাহানারাকে দোষ দেয় না নেড়া। মেয়েটার সঙ্গে তার নিজের বয়সের ফারাকটাও তো দেখতে হবে। জাহানারা পঁচিশ, ও তার ডবল : পঞ্চাশ। নেহাত দম্পতি—তাই এতদিন ব্রিজলাল বা আলফান্স জাহানারার দিকে হাত বাড়ায়নি। আর মাঝে মধ্যে বাড়াতো কি না তাই কি ছাই ও জানে? মোট কথা প্রথমা বিবির মুখে শুনল : আলফন্সের সঙ্গে জাহানারা নিকা করেছে। ওরা দুজনেই ভারত পুলিসের নাগালের বাইরে পালিয়ে গেছে। কে জাহানারার প্লেন ফেয়ার দিল নেড়া জানে না—আন্দাজ করতে পারে মাত্র। আলফান্স ওর সঙ্গে হয়তো যায়নি হয়তো বেচে দিয়েছে কোন আরব শেখকে। জাহানারার বিমানভাড়া হয়তো মিটিয়েছে তার সেই দুই সম্পদই : খুসুরতি আর জওয়ানি।

হয়তো সে এখন সেই মধ্য প্রাচ্যের আরব শেখের হারেমে আরামেই আছে। দুঃখ করে না নেড়া। এ তার বদনসিব্।

সঞ্জয় ওকে খোলাখুলি বললে, দেখ করিম! তুমি ওই নেকলেন্সটা চুরির ব্যাপারে জড়িত এটা আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু কে তোমাকে ওটা বিক্রি করতে দিয়েছে তার নামটা তুমি যদি না জানাও তাহলে বাধ্য হয়েই তোমার বিরুদ্ধে চুরির কেস সাজাতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি—নেকলেসটা চুরি গেছে কলকাতাবাসী এক শেঠ-এর বাড়ি থেকে। তাই কলকাতা থেকে এসেছেন এই অফিসার। উনি শনাক্ত করেছেন গহনাটা। এখন বল, তুমি কতদিন আগে কলকাতা গেছিলে?

নেড়া তার চিবুক চুলকিয়ে বললে, য়্যাদ নেই হুজুর। মেয়াদ খেটে বার হয়েছি আজ একবছরের উপর। জেলেও ছিলাম বছর দেড়েক। ফলে, কলকাতায় শেষবার গেছি অন্তত তিন-চার বছর আগে।

—তাহলে তুমি কী স্থির করলে বল? তুমি বুড়োমানুষ। কথা আদায় করতে ওসব ‘কচুয়া ধোলাই টোলাই’ তোমাকে দেব না। তোমার সামনে দুটি পথ খোলা আছে। এক : কে তোমাকে নেকলেস্টা এনে দিয়েছিল তার নাম এবং কোথায় তোমার কাছ থেকে দেড়লাখ টাকা সে নিতে আসত তা আমাদের গোপনে জানিয়ে দাও। আমরা যে তোমার মাধ্যমে জেনেছি এটা গোপন থাকবে—

—তাই কি কখনো থাকে, হুজুর?

—থাকে! পুলিস কোথা থেকে কীভাবে কোন্ খবর পায় তা কি জানাজানি হয়? এই যে আজ তোমাকে বান্দ্রা স্টেশনের বাইরে অটো রিকশায় ওঠার মুখে চোরাই মালসহ আমরা গ্রেপ্তার করলাম, এটা কীভাবে? বান্দ্রা এলাকায় তো কোন সোনারূপার দোকান নেই। তাহলে তোমাকে ধরলাম কীভাবে?

—সেটাই তো ভাবছি, হুজুর।

—সে ভাবনা ছেড়ে দাও। বরং ভেবে দেখ কোন সাজাটা তোমার মনপসন্দ। চোরাই মাল বিক্রির চেষ্টায় বড় জোর ছয় মাস? নাকি দু-লাখ টাকার গহনা চুরি—যার মেয়াদ না হোক দুটি বছর ঘানি টানা!…না, না, এখনি কিছু ফস্ করে বলে বস না। একটা রাত ভাল করে ভেবে দেখ। কাল সকালে জবাব দিও!

কান্দিভেলি বা বোরিভেলিতে সমস্যার কোনও সুরাহা হল না। কান্দিভেলিতে যে মটোর রিপেয়ারিং শপে ও রঙ মিস্ত্রির কাজ করে তার মালিক যুক্তপ্রদেশের লোক : রামবিলাস মিশির। প্রৌঢ় নির্বিরোধী ব্রাহ্মণ। দোকানটা মাত্র বছর দুই-তিন খুলে বসেছেন। কিন্তু প্রচুর কাজ পাচ্ছেন। আট-দশ জন লোক দিবারাত্র কাজ করে তাঁর গ্যারেজে। হ্যাঁ, মহম্মদ করিমকে তিনি চেনেন। বোরিভেলির একটা মুসলমান বস্তিতে থাকে। হ্যাঁ, উনি জানেন, লোকটা দাগী আসামী। বছর দুই আগে জেল থেকে বার হয়ে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। উনিই দয়া করে তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। রামজীর কৃপা হলে হয়তো তার জীবনযাত্রাই বদলে যাবে। না—গতমাস খানেকের মধ্যে মহম্মদ করিম একদিনও কামাই করেনি। গতকাল সে অবশ্য ‘উটি টাইমে’ ছুটি নিয়েছিল। আজ এত বেলাতেও সে কেন যে আসেনি তা উনি আন্দাজ করতে পারছেন না। জ্বরজ্বারি হয়ে থাকবে। অথবা তার আব্বাজান—তিনি খুব বুড়ো—তাঁরই কিছু হয়ে থাকবে।

অর্থাৎ নেড়া করিম যে নেকলেসচুরির দায়ে থানার হাজতে এ সংবাদটা তার অজানা।

বোরিভেলির বস্তিতেও একই হালৎ। বাড়ির লোক জানে না, কেন কাল রাত্রে মানুষটা ঘরে ফিরল না। ওরা আশঙ্কা করেছিল : পথ দুর্ঘটনা! বাস-অ্যাকসিডেন্ট! পুলিশ দেখে বেরিয়ে এল সবাই। জড়ো হল বস্তির আশপাশের মানুষ। কী হয়েছে, স্যার?

সঞ্জয় সিং অনর্গল মিথ্যার সাহায্যে বস্তিবাসীর কৌতূহলকে প্রশমিত করল। হ্যাঁ, মহম্মদ করিম কাল বান্দ্রা স্টেশনের কাছে একটা মটোর গাড়ির ধাক্কা খেয়েছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আঘাত মারাত্মক নয়। দু-চার দিনের মধ্যেই ওকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেবে। ওর জ্ঞান আছে। এই ঠিকানায় নাকি ওর জরু ‘ফতিমা বিবি’ থাকে। তার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ‘ফতিমা’ কার নাম?

ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে বছর চল্লিশের একটি মহিলা মাথায় ঘোমটা তুলে। জানতে চায়, হাত পা কাটা যায়নি তো হুজুর?

–না, না, তেমন কিছু নয়। দুদিনেই ছাড়া পেয়ে যাবে হাসপাতাল থেকে।

সঞ্জয়ের সঙ্গে এক মহিলা পুলিসও এসেছিল, সে বলল, ভিতরে চলুন দিদি, কথা আছে।

ভিতরে নিয়ে গিয়ে বলল, করিম ভাই ভালই আছে। ওর হাঁটুতে কিছুটা চোট লেগেছে। শরীরে আর কোনও ক্ষতি হয়নি। আপনি ওর জন্য একটা লুঙ্গি আর ফতুয়া একটা পোঁটলায় বেঁধে দিন। আর, টুথব্রাশ ব্যবহার করে কি করিম ভাই?

—জী না। দাঁতন।

—ও আচ্ছা। মেয়েরা বাড়িতেই থাক। বুড়ো দাদু দিদাকে দেখভাল করতে পারবে। আর আচ্ছা, ফতেমা দিদি, ‘জাহানারা’ কার নাম?

রীতিমতো চমকে উঠল ফতিমা, কেও?

—প্রথম দিকে, যখন ওঁর ভালো করে জ্ঞান হয়নি তখন উনি বার বার জাহানারার কথা বলছিলেন। আপনার মেয়ে দুটির মধ্যে কারও নাম কি-

কথার মাঝখানেই ফতিমা বলে ওঠে, জী নেহী! বহ্ ইহা নেহী রহতি!

—গুজর গয়ী?

—জী নহী! ভাগ গয়ী।

বুঝিয়ে বলে, সে ছিল মহম্মদ করিমের দ্বিতীয় পক্ষের বিবি। বড়ি বদমাইশ। পুলিশনে উকী পকড় লি। ছে মাহিনেকা লিয়ে সাজা ভি ছয়ী….

—তারপর? খালাস হবার পর?

—না জানে কোথায় ভেগেছে! তবে আমার ঘাড় থেকে তো নেমেছে! খোদার মেহেরবানি।

—সে কি এখানেই থাকত? এই বাড়িতে?

—জী নহী! অন্য বস্তিতে। কিন্তু তার খোঁজ এত নিচ্ছেন কেন? সে তো দু-বছর হল নাপাত্তা!

—না…মানে…অসুস্থ লোকটা তার নাম করে বার বার খোঁজ করছে—

—তবে বলুন দোজখে তার পাত্তা নিতে! সে দোজখেই আছে!

একটু ইতস্তত করে মহিলা পুলিস জানতে চাইল, তার কোন তসবির মানে ফটো টটো আছে?

ফতিমা রুখে ওঠে, জী নহী! বহ্ কবি কী নাম ইঁহা মৎ লিজিয়ে!