চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ১০

দশ

সেদিনই রাত আটটা নাগাদ আবার একটা টেলিফোন এল। জি.ডি.র কাছ থেকে। বাসু-সাহেব আত্মঘোষণা করা মাত্র দস্তুর বললেন, একটা অত্যন্ত গোপন এবং জরুরী সংবাদ জানাতে চাই। আপনাকে কষ্ট দেব না। আমি নিজেই এখনি আপনার বাড়িতে চলে আসতে চাই। আপনি কি

আধঘণ্টা সময় দিতে পারবেন?

—অফকোর্স! য়ু আর ওয়েলকাম।

—মিস্টার কৌশিক মিত্র কি আছেন? তাঁকে কি পাব?

—পাবেন। সে বাড়িতেই আছে।

—আমি যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, এ খবরটা কাউকে জানাবেন না। বিশেষত পুলিসকে।

—এগ্রিড। আসুন আপনি।

আধঘণ্টার মধ্যেই দস্তুর-সাহেবের গাড়ি এসে থামল বাসুসাহেবের বাড়ির পোর্টিকোর সামনে। গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া তিনি একা। কৌশিক বারান্দায় অপেক্ষা করছিল। আপ্যায়ন করে নিয়ে এসে বসালো তাঁকে বাসু-সাহেবের ঘরের সমুখে প্রতীক্ষাগারে। বাসু খবর পেয়ে নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, আসুন মিস্টার দস্তুর। এ ঘরে এসে বসুন।

দস্তুর এ ঘরে এসে বসলেন। ড্রিংস কোন কিছু নিতে রাজি হলেন না। জানালেন, পুরীর স্বর্গদ্বারে কমলকলির শেষকৃত্য করে উনি কলকাতায় ফিরে এসেছেন। তার পরেই উনি সরাসরি চলে এলেন জরুরি ব্যাপারটায়। ঘণ্টাখানেক আগে—রাত সাতটা নাগাদ উনি বোম্বাই থেকে একটা এস. টি. ডি. কল পান। যিনি ফোন করছিলেন তাঁর নাম আবদুল লতিফ। মুম্বাই ক্রফোড মার্কেটে তাঁর বিরাট সোনারূপার জুয়েলারি শপ এ. বি. জুয়েলার্স। ওঁরা দুজন পার্টনার। আবদুল লতিফ আর বীরেন্দ্রনাথ দত্ত। একজন মুসলমান একজন হিন্দু। একজন মুম্বাইওয়ালা একজন বাঙালী। তবু ওঁদের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। দস্তুর-সাহেবের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘদিনের পরিচয়। ব্যবসায়িক সূত্রে। সেই প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র পার্টনার জনাব আবদুল লতিফই ফোন করছিলেন।

বাসু জানতে চান, কী বলতে চান জনাব আবদুল লতিফ?

দস্তুর বলেন, আমার টেলিফোনে একটা গ্যাজেট আছে। বোতাম টিপলেই দুপক্ষের কথা একটা অডিও টেপ-এ রেকর্ড হয়ে যায়। আমি লতিফের ফোন পাওয়ামাত্র বোতামটা টিপে দিয়েছিলাম। আমাদের দুজনের কথাই টেপ-এ ধরা গেছে। সেটা আমি নিয়েও এসেছি। গাড়িতে আছে…

কৌশিক বলে, ঠিক আছে, আমি সেটা নিয়ে আসছি। তাহলে আপনাদের কথোপকথন ডাইরেক্ট ন্যারেশানে শোনা যাবে।

দস্তুর একটি টু-ইন ওয়ানে টেপটা ভরে নিয়ে এসেছেন। কৌশিক যন্ত্রটা চালিয়ে দিল। প্রথম দিককার কিছুটা কথা রেকর্ডেড হয়নি। সম্ভবত তখনো দস্তুর-সাহেব ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারেননি এবং বোতামটাও টিপে দেননি। কথাবার্তা আদ্যন্ত হিন্দিতে। অনুবাদে তা এই রকম :

দস্তুর : আপনি যখন বলছেন তখন পুলিসকে কিছু জানাব না। কিন্তু ব্যাপারটা কী?

লতিফ : আপনার মেয়ের সম্বন্ধে মর্মান্তিক সংবাদটা কাগজে পড়েছি। আমার গভীর সমবেদনা ইতিপূর্বেই ফ্যাক্স করে জানিয়েছি। সেই সংক্রান্ত একটা অত্যন্ত গোপন সংবাদ আপনাকে এখন জানাতে চাই। আপনি যদি সম্পূর্ণ গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি দেন।

দস্তুর : সে কথা তো আগেই বলেছি। বলুন আপনি?

লতিফ : কলি-মার অপহৃত অলঙ্কারের একটি পিস—পান্না বসানো নেকলেসটা এখন কোথায়, কার কাছে আছে, আমি জানি।

দস্তুর : আর য়ু শ্যিওর? ওটা সেই নেকলেসটাই?

লতিফ : দস্তুর সা’ব! আপনার য়্যাদ নেই। নেকলেসটা এই বান্দার কারিগরেই বানিয়েছিল। আমি সেন্ট্রাল লকেটের বড় পান্নাটি সরিয়ে দেখে নিয়েছি তার নিচে আমাদের কোম্পানির মনোগ্রাম আছে : ‘এ.বি’। যার কাছ থেকে নিয়ে দেখেছি, সে তা জানে না। পান্না যথাস্থানে সেট করে তাকে ফেরত দিয়েছি। বলেছি, কাল আসতে।

দস্তুর : অল-রাইট। আমি মেনে নিলাম এটা সেই একই নেকলেস। কিন্তু পুলিসের সাহায্য ছাড়া সেটা আমি কী করে উদ্ধার করব?

লতিফ : আপনি নিজে চলে আসুন। মুম্বাইয়ের নেক্সট ফ্লাইটে। কাল রাত নটার সময় লোকটা নেকলেস নিয়ে আমার বাড়িতে আসবে। নগদ টাকায় বেচতে। আমি তাকে হাতে নাতে ধরিয়ে দেব।

দস্তুর : অলরাইট! কিন্তু পুলিসের সাহায্য ছাড়া তাকে আমি ধরব কীভাবে? লতিফ : পুলিসই ধরবে। মুম্বাইয়ের পুলিস্! আমার চেনা পুলিস! আপনি শুধু আইডেন্টিফাই করবেন নেকলেসটা।

দস্তুর : বুঝলাম না! আপনি যদি পুলিসেই শেষ পর্যন্ত খবর দেন, তাহলে আমার পুলিশে খবর দেওয়ায় আপত্তি কী?

লতিফ : সে আলোচনা আমি টেলিফোনে করব না, স্যার। ইনফ্যাক্ট, এর সঙ্গে যদি কলি- মার দুর্ঘটনাটা—আপনি নিশ্চয় বুঝছেন, আমি কোন দুর্ঘটনার কথা বলতে চাইছি—জড়িত না থাকত তাহলে আমি হয়তো আপনাকে এতকথা বলতামই না। আপনি কি আসতে পারবেন? কাল রাত নয়টায়? আমার গরিবখানায়?

দস্তুর : না। আমি নিজে যেতে পারব না। কাল আমাকে কলকাতাতে থাকতেই হবে। তবে আমার তরফে একজন প্রতিনিধি যাবেন। নামটা লিখে নিন : মিস্টার কৌশিক মিত্র অব ‘সুকৌশলী’। উনি একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা। অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন।

লতিফ : অলরাইট স্যার। উনি যেন ওঁর পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে আসেন। আমার দোকানে নয়, বাড়িতে। অ্যাড্রেস তো আপনার জানা? বান্দ্রার কার্টার রোড…

দস্তুর : হ্যাঁ, অ্যাড্রেস আমার জানা। যদি মিস্টার কৌশিক মিত্র কোন কারণে না যেতে পারেন তাহলে আজ রাত্রেই আমি ফোনে জানাব। সে-ক্ষেত্রে অন্য কেউ যাবে।

লতিফ : থ্যাঙ্কু স্যার। ‘অন্য কেউ টা যেন পুলিসের লোক না হয়। গুড নাইট!

কৌশিক বলল, আমি রাজি। কাল মর্নিং ফ্লাইটেই মুম্বাই চলে যাব। এখন টিকিট পেলে হয়।

দস্তুর বললেন, সে চিন্তা করবেন না। আপনি যেতে পারেন ধরে নিয়ে আমি দুখানি টিকিটের ব্যবস্থা করেছি। ভি. আই. পি কোটায়। আপনি একা যাবেন না। মিস্টার দাশও যাবেন। কিন্তু তিনি আবদুল লতিফের বাড়িতে যাবেন না। মুম্বাই পুলিস লোকটাকে অ্যারেস্ট করার পর তিনি আত্মঘোষণা করবেন। লতিফকে আমি ওয়ার্ড অব অনার দিয়ে রেখেছি।

বাসু রললেন, নাইন্টি ফাইভ পার্সেন্ট চান্স, জনাব আবদুল লতিফ এ জাতীয় চোরাই মাল খরিদ করে থাকেন—আন্ডার ওয়ার্ল্ডের কাছে থেকে। কিন্তু এক্ষেত্রে আপনার প্রতি বন্ধুত্বের খাতিরে, এবং সম্ভবত কমলকলিকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন বলেই তিনি এই পদক্ষেপ করেছেন। অথবা হয়তো মার্ডার কেস জানার পর চুপ করে থাকতে তাঁর বিবেকে বেধেছে।

দস্তুর শুধু বললেন, না, ব্যারিস্টার সাহেব। নাইন্টি ফাইভ নয়, ওটা সেন্ট পার্সেন্ট। মুম্বাইয়ের যে পুলিস কর্তার মাধ্যমে তিনি জুয়েল থিফটাকে ধরিয়ে দেবেন তিনি ওঁর জানা লোক। তিনি এমনভাবে জুয়েল থিফকে ধরবেন যাতে আন্ডার ওয়ার্ল্ড বুঝতে না পারে যে, খবরটা পাচার হয়েছে আবদুল লতিফের মারফত! যা হোক, তাহলে ওই কথাই রইল। মিস্টার মিত্র, আপনি তাহলে মিস্টার দাশের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমার গাড়ি কাল সকালে আপনাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে। টিকিট আমার ড্রাইভারের হাতে থাকবে। ইন্সপেক্টার দাশ অবশ্য সরাসরি পুলিসের গাড়িতে এয়ারপোর্টে যাবেন! তাহলে চলি?

দস্তুর উঠে দাঁড়ালেন। যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন। বাসু ঠিক তখনই পিছন থেকে প্রশ্ন করেন, মিস্ পামেলা কাত্রোচ্চি কি এই নতুন পরিস্থিতির কথাটা জানেন?

দস্তুর দোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ান। একটু দেরি হল জবাবটা দিতে। তাঁর ভ্রূকুঞ্চিত হল। নতনেত্রেই বললেন : নো। গুডনাইট।