চাঁপারঙের মুর্শিদাবাদী শাড়ির কাঁটা – ১

এক

কাঁটায়-কাঁটায় সন্ধ্যা ছয়টার সময় ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়ায় কটক-স্টেশনের সামনে।

নেমে এল একক যাত্রী। বছর পঁচিশের একজন সুবেশী যুবক। পরনে গ্রে-রঙের সফরি- স্যুট। গলায় নীলচে রঙের স্ট্রাইপড্-টাই, হাতে রেক্সিনের ফোলিও ব্যাগ। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিতে দিতেই গাড়ির পিছনের ডিকিটা খুলে ওর স্যুটকেসটা রাস্তায় নামিয়ে ফেলেছে রেলওয়ে-পোর্টার। যুবকটি গাড়ির পিছনের দিকে এগিয়ে আসার অবকাশে কুলিটা মাথায় জড়িয়ে নিয়েছে তার লাল-শালুর ফেট্টি। প্রশ্ন করে, কৌন ট্রেনসে যানা হ্যায়, সা’ব?

—ইস্ট-কোস্ট এক্সপ্রেস।

—বহ্ তো আনেবালী হ্যায়। আজ বিকুল টাইম পর আ-রহী! সামান উঠায়ু?

—পুছনেকী কেয়া জরুরৎ হ্যায়?

স্যুটকেসটা মাথার উপর তুলবার উপক্রম করে লোকটা বলে—বিশ রোপেয়া লাগেগা সাব।

পট্টনায়ক খপ্ করে তার মণিবন্ধটা চেপে ধরে বলল, ব্যস! মৎ উঠাও!

কুলিটা নজর করেছে, স্যুটকেসের তলায় চাকা লাগানো আছে। অর্থাৎ সাহেব ইচ্ছে করলে সেটা টেনে টেনেও নিয়ে যেতে পারেন। খদ্দের ফসকে যাবার আশঙ্কায় কুণ্ঠিত হয়ে বলে, কেউ সা’ব? ক্যা কসুর ভৈল? জা’দা বোলা হ্যায় ম্যয়নে কেয়া? কসুর হুয়া কুছ?

—কসুর তো জরুর হুয়া, লেকিন জাদা নহী, কমি। শুনো ভাই। ম্যায়নে কিসী কুলী কো তিস্-সে কম কভি নেহী দিয়া। অগর তিস্মে খুশি হো তো উঠাও, নহী তো ম্যায় দুসরে কুলি কো বুলাউঙ্গা।

লোকটা ঘাবড়ে যায়। এ আবার কী জাতের দরাদরি?

ক্যা? ত্রিশ রোপেয়া মে মাল উঠানা হায়?

হাঁ-না কিছুই বলে না লোকটা। স্যুটকেসটা উঠিয়ে নিয়ে স্টেশন পানে হাঁটা ধরে। পিছন থেকে নির্দেশ ভেসে আসে—ফার্স্টক্লাস, ‘সি’ কূপে!

ইস্ট-কোস্ট এক্সপ্রেস আজ ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে আসছে। অ্যারাইভাল টাইম : ছয়টা পনের। ঠিক সেই সময়েই গড্রাতে গজ়াতে প্রবেশ করল ট্রেনটা। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। দশ মিনিট স্টপেজ। মালপত্র নিয়ে উঠল গাড়িতে। কূপেটা ফাঁকা। এতটা সৌভাগ্য হবে আশা করেনি জগদ্বন্ধু। সচরাচর যুগলযাত্রী হলেই কূপেতে ঠাঁই মেলে। ও একক যাত্রী, তবু কী জানি কেন এখানেই নির্দিষ্ট হয়েছে তার আসন। তুঙ্গে বৃহস্পতি থাকলে যা হয় আর কি। ট্রেনটা যাবে সেকেন্দ্রাবাদতক্। ওর গন্তব্য অবিশ্যি বিশাখাপত্নম্। এই ট্রেনে। সেখান থেকে ভেসে পড়বে নীল দরিয়ায়। ভাসতে ভাসতে পরবর্তী বন্দরে। সেটা ওডেসা, না পানামা, দুবাই না সিডনি জানা নেই। জানা যাবে, বিশাখাপত্তমে রিপোর্ট করলে।

বার্থ-সংলগ্ন হুকে কাঁধের ব্যাগটা কুলি টাঙিয়ে রাখল। জগদ্বন্ধু তার হাতে-ধরা ম্যাগাজিনগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রাখল সিটের উপর। তারপর হাত লাগালো কুলির মাথা থেকে স্যুটকেসটা নামাতে। কুলিটা চাইছিল সেটা সিটের নিচে ঠেলে দিতে। জগদ্বন্ধু বারণ করল : রানে দো!

হয়তো পরবর্তী স্টেশনেই উঠবে দ্বিতীয় যাত্রী। মহিলা হবে না নিশ্চয়, তবু তার উপস্থিতিতে ও নৈশ পোশাকটা পরতে চায় না। ট্রেন ছাড়লেই ও রাতের পোশাক পরে নেবে

কুলিটা পাগড়ি দিয়ে মুখটা মুছে হাত পাতল। জগদ্বন্ধু ওয়ালেট বার করে দু-খানা দশ টাকার নোট ওর প্রসারিত হাতে ধরিয়ে দিল। লোকটা নিক্কথায় সেলাম বাজিয়ে প্রস্থানোদ্যত হতেই পিছন থেকে ধমকে উঠল জগদ্বন্ধু পট্টনায়েক : এই…এই…কাঁহা ভাগ্‌তে হো তোম্? বাকি রূপেয়া?

লোকটা বেশ বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, সা’ব! ম্যয়নে পহিলেই তো বোলা থা কি বিশ রূপেয়া…

—ঠিক হ্যায়! লেকিন ম্যয়নে ক্যা বাতায়া থা? বোলা থা না কি ম্যয়নে তিস সে কম কিসি কুলিকে কভি নেহি দিয়া? বোলো, সমুচ্!

কুলিটা কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না।

জগদ্বন্ধু ওর হাতটা টেনে নিয়ে গুঁজে দেয় আরও একটা দশটাকার নোট! বলে, অব যা সেক্‌তে হো…

কুলিটা হেসে ফেলে। সকৃতজ্ঞচিত্তে বলে, সাব…

—নেহী নেহী! ঔর নেই! যাও ভাগো!

লম্বা সেলাম করে হাসতে হাসতেই বিদায় নেয় লোকটা। সে তো জানে না—জগদ্বন্ধু পট্টনায়েক এখন খুশিয়াল মুডে যাচ্ছে তার চাকরিতে জয়েন করতে। কাল সকালেই সে হাতে পেয়েছে প্রমোশন অর্ডারটা। কুরিয়ার সার্ভিসে।

এবার কামরার ভিতরটা নজর করল। জানলার কাচ ও শাটার বন্ধ থাকায় ঘরটা একটু গুমোট। শীতকাল বলে ফ্যানটাও চলছিল না। জগদ্বন্ধু জানলার কাচ ও শাটার তুলে দিল। খোলা জানলার ধার ঘেঁষে বসে পড়ে। বাইরের দিকে নজর দেয়। নানান জাতের যাত্রীর আনাগোনা ওদিকে প্ল্যাটফর্মে।

পেশায় মেরিন এঞ্জিনিয়ার জগদ্বন্ধু পট্টনায়ক। দু-মাসের ছুটি কাটিয়ে আজ আবার চলেছে কাজে যোগ দিতে। বয়স পঁচিশ, অকৃতদার। যাকে বলে, এলিজে ব্যাচিলার। মা জানতে চেয়েছিলেন, তুই বারণ করছিস্ কেন? বিদেশে তোর কি কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়েছে?

জগদ্বন্ধু বলেছিল, মা, আমি তো বিদেশে কোথাও দু-দশ দিনের বেশি থাকি না! জাহাজে- জাহাজেই কেটে যায় মাসের পর মাস! কার সঙ্গে আলাপ হবে বলো? তবে ব্যস্ত হয়ো না, যখন বিয়ে করতে চাইব তখন জানাব। তুমিই পছন্দ করে নিয়ে এস তোমার বহুরানী!

একটা গন্ধ প্রবেশ করল পট্টনায়কের নাকে। মিষ্টি অথচ ঈষৎ ঝাঁঝালো। কীসের গন্ধ? একেবারে অপরিচিতও নয় গন্ধটা। ফুলের নয়। পূর্ববর্তী যাত্রীর কোনো দীর্ঘস্থায়ী ফরাসি সুবাস?

হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছাড়ল ট্রেনটা। পট্টনায়কের হাতে সোনালী ব্যান্ডে রোলেক্স ঘড়িটায় তখন ছয়টা পঁচিশ। ইস্ট-কোস্ট-এক্সপ্রেস আজ টাইম-টে-এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে। ডিসট্যান্ট সিগন্যালের সীমানা ছাড়িয়ে ট্রেন তখন নির্দিষ্ট পথে দৌড় শুরু করেছে। আবার গন্ধটা এসে নাকে লাগল। এবার কিন্তু ওর মনে পড়ে যায়। ক্লোরোফর্ম! গতবার সমুদ্রযাত্রায় তাকে দু-তিনদিন সিক্ বেডে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তখন একবার ওকে ও. টি. তেও যেতে হয়, পরীক্ষা করাতে। সেখানেই ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিল। কিন্তু এখানে ও গন্ধটা আসছে কোথা থেকে? বসা অবস্থাতেই চারিদিকে তাকিয়ে দেখল সন্দেহজনক কিছু নজরে পড়ল না। হাত বাড়িয়ে ফ্যানটা খুলে দিল। হোক শীতকাল। গন্ধটাকে এ ঘর থেকে তাড়াতে হবে।

আবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো। শীতের সন্ধ্যা। দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে। একঝাঁক টিয়া পাখি উড়ে গেল দিগন্তের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। ট্যা—ট্যা—ট্যা-

হঠাৎ খেয়াল হল, পরের স্টেশন ভুবনেশ্বর খুব বেশি দূরে নয়। সেখানে হয়তো ওর এই একাধিপত্য ব্যাহত হবে। ওর নিজের আপার-বার্থ, হয়তো নিচের তলার মানুষ এসে উপস্থিত হবেন। সুতরাং এখনই নৈশ-পোশাকটা পরে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। স্যুটকেসটা খুলে পাজামা-পাঞ্জাবি, তোয়ালে আর খবরের কাগজে মোড়া চপ্পল বার করে নিল। স্যুটকেসটা বন্ধ করে এবার সিটের নিচে পাচার করতে চাইল।

কিন্তু কি জানি কেন স্যুটকেশটা অন্দরমহলে যেতে আপত্তি জানালো। সেটা যেন কিছুতে বাধা পাচ্ছে। পূর্ববর্তী যাত্রী কি একটা মাল নামাতে ভুলে গেল নাকি? স্যুটকেসটা সরিয়ে সিটের নিচেটা এবার দেখবার চেষ্টা করল জগদ্বন্ধু। বাইরেটায় এতক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। নিচু হয়ে মনে হল সিটের নিচে কালো কাপড়ে ঢাকা বেশ বড়-সড় একটা বস্তা রয়েছে; কিন্তু একী? সেই বস্তা থেকে চুঁইয়ে কী যেন একটা তরল পদার্থ—রক্ত না কি?

হাত বাড়িয়ে জ্বেলে দিল ফ্লুরেসেন্ট বাতিটা।

এ কী! হ্যাঁ, রক্তই তো!

নিচু হয়ে কালো কাপড়টা সরাতেই…

ফার্স্টক্লাস-সি কূপেতে পরমুহূর্তেই শোনা গেল একটা আর্তনাদ। যেন সেটা সবার আগে কর্ণগোচর হয়েছে রেলওয়ে এঞ্জিনটার। সেও ভয়ার্ত কণ্ঠে সাড়া দিয়ে উঠল পর-পর তিনটি হুইসিল-এ। উপায় নেই। তাকে থেমে পড়তে হল ভ্যাকুয়াম-ব্রেকের অমোঘ নির্দেশে। কোনো একটা কামরায় কেউ অ্যালার্ম-চেনটা টেনে দিয়েছে। ভুবনেশ্বর রেল-স্টেশনের ডিসট্যান্ট-

সিগন্যালের সবুজ বাতির আমন্ত্রণ সত্ত্বেও এঞ্জিনটাকে গজরাতে গজরাতে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। সকাল থেকে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটা, টাইম-টেব্‌ অনুসারী ইস্ট-কোস্ট এক্সপ্রেসটার লেট হওয়ার পালা শুরু হল।