চশমার আড়ালে – ৫

ঘুম আসতে-আসতে সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছিল। হঠাৎ যেন কার মৃদু ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার। বললুম, “কে?” 

“আমি।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের গলা। বললুম, “কী ব্যাপার? এত রাতে?” 

ভাদুড়িমশাই লাইট জ্বেলে দিলেন। বললেন, “রাত কোথায়, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখুন, সাড়ে চারটে বাজে। চটপট উঠে রেডি হয়ে নিন। পাঁচটা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়ব।” 

“সে কী, ব্রেকফাস্ট না-খেয়ে তো আমরা সাগরমহলের ওদিকে যাচ্ছি না, তা হলে এত তাড়া কীসের?” 

পাশ ফিরে ফের ঘুমোবার উপক্রম করছিলুম, ভাদুড়িমশাই একটানে আমার গায়ের চাদরটা উঠিয়ে নিয়ে বললেন, “সাগরমহলে যখন যাব তখন যাব, এখন উঠে পড়ুন দেখি। এমন সুন্দর একটা াকাল এইভাবে ঘুমিয়ে নষ্ট করবেন না। চলুন চিড়িয়াখানার ওদিকটা আপনাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি।” 

অগত্যা উঠতেই হল। 

না-উঠলে যে মস্ত লোকসান হত, সেটা বাইরে বেরিয়ে বুঝতে পারলুম। এমন চমৎকার একটা ভোর সত্যি অনেক কাল দেখা হয়নি। গোটা আকাশ স্লেট-রঙা, কিন্তু তারই মধ্যে পুবের আকাশে হঠাৎ লালচে রঙের ছোপ ধরল। অল্প-অল্প হাওয়া বইতে লাগল। গাছের পাতায় কোনও দৈব শিশু যেন ঝুমঝুমি বাজাতে থাকল। সামনে একটা পুকুর। তার জলেও দেখলুম শিরশিরে একটা কাঁপুনি ধরেছে। 

চিড়িয়াখানা এখান থেকে আরও মাইল খানেক দূরে। ওদিকটা সরকারি এলাকা। শুনলুম, চিড়িয়াখানার খুব কাছেই একটা মস্ত ঝিল রয়েছে, আর সেই ঝিলের ধারে রয়েছে সরকারি রেস্ট হাউস 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “পা চালিয়ে চলুন। এত সকালে তো চিড়িয়াখানায় ঢোকা যাবে না, তবে জায়গাটার একটা আন্দাজ পেয়ে যাবেন। সাতটার মধ্যেই ফিরে আসতে পারব।” 

এখানকার চিড়িয়াখানার মস্ত আকর্ষণ নাকি চশমা-পরা বাঁদর। শুনে বললুম, “তাও হয় নাকি? বাঁদরদের তো বই পড়বার বদ-খেয়াল নেই, তা হলে চশমা পরবার দরকার হল কেন?” 

ভাদুড়িমশাই হোহো করে হেসে বললেন, “চশমা পরাটা নেহাতই কথার কথা। বাঁদরগুলোর চোখের চারপাশ ঘিরে আসলে একটা সাদা রিঙের মতন থাকে, তাইতে মনে হয় যেন চশমা পরেছে। ভারী লাজুক বাঁদর, কেউ যদি ওদের দিকে তাকিয়েছে তো আর রক্ষে নেই, সঙ্গে-সঙ্গে দু-হাত তুলে মুখ ঢেকে ফ্লেবে।” 

চিড়িয়াখানা বন্ধ ছিল, তাই সে-সব আর দেখা হল না। পাশের ঝিলটা অবশ্য চমৎকার। এই ঝিলের জন্যেই গোটা এলাকার নাম দাঁড়িয়েছে সিপাহিজলা। জলার পাশে এককালে যে সিপাইদের একটা ডেরা ছিল, সেটাও আন্দাজ করা গেল। ঝিলের মধ্যে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে দেখলুম। 

সবচেয়ে ভাল লাগল ঝিলের ধারের সরকারি রেস্টহাউসটা দেখে। এটাও দোতলা কাঠের বাড়ি। দুটো তলাতেই বেশ কয়েকটা করে ফার্নিশড ঘর রয়েছে। বাড়ির চারপাশে বাগান। সামনের দিকে ধাপে-ধাপে ঝিলের মধ্যে নেমে গেছে বেশ চওড়া একটা সিঁড়ি। পরিবেশ এমন মনোরম যে, দেখলেই মনে হয় কয়েকটা দিন থেকে যাই। 

কিন্তু থাকার তো উপায় নেই। রেস্টহাউসের সামনের বারান্দায় খানিক সময় বসেই আবার আমাদের ফেরার পথ ধরতে হল। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলুম, “সাতটার মধ্যে ফিরতে পারব তো?” 

ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দাড়ি তো কামিয়ে আসেননি দেখছি।” 

“সময় পেলুম কোথায়। আপনি যা তাড়া লাগিয়ে দিলেন।” 

“তাড়া না-লাগালে কি এই সুন্দর সকালটা আপনার দেখা হত? কিন্তু সে-কথা থাক। ব্রেকফাস্ট তো আটটায়। দাড়ি-ফাড়ি কামিয়ে স্নান করে, পোশাক পালটে ব্রেকফাস্ট টেবিলে আসতে আপনার কতক্ষণ সময় লাগবে?” 

“আধ ঘন্টা।” 

“ঠিক আছে, তা হলে তাড়াহুড়ো করবার দরকার নেই, সাড়ে সাতটায় ফিরলেই চলবে। ফিরেই বাথরুমে ঢুকে পড়বেন।” 

বললুম, “তা নাহয় ঢুকে পড়ব, কিন্তু একটু আগে ফিরলে ক্ষতি কী?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “মস্ত ক্ষতি। মিসেস ঘোষ সম্ভবত তৈরি হয়ে বসে আছেন। যদি বোঝেন যে, আপনার হাতে কিঞ্চিৎ সময় রয়েছে, তা হলে নির্ঘাত তাঁর গল্পের প্লটটা আপনাকে শোনাতে চাইবেন।” 

“তা শোনান না।” 

‘অতি বিচ্ছিরি প্লট। শুনলে আপনার মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যদি বা আপনাকে এখানে আনতে পেরেছি, তখন হয়তো আপনি আগরতলা ছেড়ে পালাতে চাইবেন। না মশাই, এক্ষুনি ও-সব ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই, তার চেয়ে বরং সমস্যাটার কথা বলি।” 

বঙ্কুবাবুর সমস্যাটা যে পারিবারিক, এইটে শুনবার পরে আর ও নিয়ে আমি কোনও কৌতূহল দেখাইনি। রুচিতে বাধছিল। ভাবছিলুঃ যে, বলতে হয় তো ভাদুড়িমশাই নিজেই বলবেন, ও-সব ব্যাপারে আমার কোনও প্রশ্ন না-তোলাই ভাল। 

আমি চুপ করে আছি দেখে ভাড়মশাই বললেন, “কী ব্যাপার, কথা বলছেন না কেন?” 

“কী বলব?” 

“কিছুই বলবেন না? তা হলে একটা প্রশ্ন করি। শুধু টাকাপয়সা থাকলেই কি মানুষ সুখী হয়?”

বললুম, “এ তো অতি পুরনো প্রশ্ন। উত্তরটাও পুরনো। হয় না।” 

“বঙ্কুও হয়নি।” ভাদুড়িমশাই একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “হতে পারত, যদি ওর প্রথম বউ প্রভা বেঁচে থাকত। ডলি ওর দ্বিতীয় স্ত্রী।” 

“সে তো ওঁদের বয়েসের ফারাক দেখলেই বোঝা যায়।” 

“বলুন তো বঙ্কুর বয়েস এখন কত?” 

বললুম, “সেটা বলা শক্ত হবে কেন? কলেজে আপনার ক্লাস মেট ছিলেন, তাই বয়েসও মোটামুটি আপনার মতোই হবে। এক-আধ বছর কম কিংবা বেশি।” 

“না মশাই,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “উত্তরটা ঠিক হল না। বঙ্কু আমার চেয়ে পুরো পাঁচ বছরের বড়। আমার জন্ম নাইনটিন টুয়েন্টিওয়ানে, আর বঙ্কুর জন্ম নাইনটিন-সিক্সটিনে। আমার এখন সত্তর চলছে, আর ওর চলছে পঁচাত্তর। গরিব ঘরের ছেলে, দেরিতে পড়াশুনো আরম্ভ করেছিল। তবে. কিনা একসঙ্গে একই ক্লাসে পড়তুম তো, তাই নাম ধরে ডাকতে কি তুই-তোকারি করতে আটকায় না। বঙ্কুর প্রথম বিয়েটাও অবশ্য বেশ দেরিতেই হয়েছিল। আমরা আই. এ. পাশ করি থার্টি এইটে। আমার বয়েস তখন সতেরো, বঙ্কুর বাইশ। বি. এ. ক্লাসে অ্যাডমিশন না নিয়ে ও ব্যাবসা আরম্ভ করে। ছিটকাপড়ের ব্যাবসা। গরিবঘরের ছেলে, এ ছাড়া তখন ওর উপায় ছিল না। প্রথম-প্রথম খুব যে একটা সুবিধে করতে পারছিল তা নয়, তবে প্রত্যেকের জীবনেই একটা-না-একটা সুযোগ আসে তো, ওর সেই সুযোগটা এসে গেল একচল্লিশ সালে। ঊনচল্লিশে বাধল ওয়ার্লড ওয়ার। সে-সব দিনের কথা আপনি নিশ্চয় ভুলে যাননি?” 

“ভোলা কি সম্ভব?” 

“তবে তো এটাও আপনার মনে আছে যে, সেই সময়ে একদিকে যখন সর্বনাশের আগুন জ্বলছে, কাতারে কাতারে লোক মরছে, শহরের পর শহর ধ্বংস হচ্ছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে, সাজানো সব সংসারগুলো শ্মশান হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তখন দু’হাতে পয়সা লুঠছে কিছু মানুষ। ফর্টিওয়ানে বঙ্কু তার ছিট-কাপড়ের ব্যাবসা ছেড়ে যুদ্ধের অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ ধরে। ব্যস, তার পরে আর ওকে ফিরে তাকাতে হয়নি। দেখতে দেখতে বঙ্কু একেবারে লাল হয়ে গেল।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “বঙ্কু অবশ্য তখন বিয়ে করেনি। যুদ্ধ শেষ হল ফর্টিফাইভে। বঙ্কুর বয়েস তখন উনত্রিশ-তিরিশ। আমরা বলতুম, কী রে বঙ্কু, বিয়ে করছিস না কেন? উত্তরে ও বলত, সময় কোথায়? আসলে ও তখন টাকা রোজগারের ধান্ধায় পড়ে গেছে। আরও টাকা চাই, আরও টাকা। হাজারে হবে না, লাখ চাই। লাখে হবে না, কোটি চাই। যুদ্ধের অর্ডার বন্ধ? তা হোক, অন্য পথে টাকা খাটাতে হবে। এমন পথ, যাতে টাকা খাটালে রাতারাতি সে-টাকা ডবল হয়ে যায়। তা তেমন পথও আছে বই কী। বিস্তর আছে। তা নইলে নিশ্চয় বঙ্কু আজ এইখানে এসে পৌঁছত না।” 

বললুম, “বিয়েটা উনি কবে করলেন?” 

“প্রথম বিয়েটা করে নাইনটিন সিক্সটিসিক্সে। তখন ওর বয়েস পাক্কা পঞ্চাশ। অবাক হচ্ছেন?”

“না, অবাক হচ্ছি না। শুধু ভাবছি যে, বিয়ে না-করে পঞ্চাশ বছরই যখন কাটাতে পারলেন, তখন বাকি জীবনটা কাটাতেই বা আটকাচ্ছিল কোথায়?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “এ-কথা আমিও ওকে জিজ্ঞেস করেছিলুম। কিন্তু ও কোনও উত্তর দেয়নি। য়তবা জিজ্ঞেস করেছি, ততবারই একটু হেসে পাশ কাটিয়ে গেছে।” 

“হয়তো ভাবছিলেন, এত যে টাকা করলেন, খাবে কে? হয়তো এই রকমের একটা চিন্তা ওঁর মাথায় ঢুকেছিল। হয়তো মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছিল যে, একটা ছেলে কিংবা মেয়ে থাকলে মন্দ হত না।” 

“আমার ধারণা, একটা নিঃসঙ্গতা বোধ ক্রমে-ক্রমে বাড়ছিল ওর। বাপ-মা মারা গেছেন, ভাই নেই, থাকবার মধ্যে গুটিকয়েক বোন ছিল, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেপুলে নিয়ে মাঝেমধ্যে তারা আসে ঠিকই, এসে থেকেও যায় কিছুদিন, কিন্তু বঙ্কু বুঝতে পারে যে, সেই আসায় কোনও আন্তরিকতার কি মায়ামমতার টান নেই, যা আছে, তা নেহাতই কিছু টাকা হাতিয়ে নেবার ধান্ধা। মায়ের পেটের বোন, অথচ যা তারা বলে আর যেমনভাবে বলে, বঙ্কুর তাতে সন্দেহ হয় যে, এই সবই আসলে মন-রাখা কথা, সম্ভবত ভগ্নিপতিদের শেখানো। বঙ্কু ধীরে-ধীরে দূরে সরে আসতে থাকে।” 

“এ সব আপনি কার কাছে শুনলেন?” 

“বঙ্কুরই কাছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা ছাড়া আর কে আমাকে বলবে। তো যা বলছিলুম, পঞ্চাশে পৌঁছে ও তো বিয়ে করে ফেলল। সেই বিয়েতে আমি গিয়েছিলুমও। বউ দেখলুম। গরিব ঘরের মেয়ে, বয়েস মনে হল বছর-পঁচিশেক। সুন্দরী নয়, তবে মুখে খানিকটা বুদ্ধির ছাপ রয়েছে, এইটে দেখে ভাল লেগেছিল। তারপর আবার বছর দুয়েক ওর খোঁজ রাখিনি। হঠাৎ সিক্সটি এইটের নভেম্বরে ওর চিঠি পেলুম। ছেলের অন্নপ্রাশন। আমাকে আসতেই হবে। চিঠির সঙ্গে ব্যাঙ্গালোর ক্যালকাটা-ব্যাঙ্গালোরের রাউন্ড-ট্রিপ এয়ার-টিকেট। না এসে পারা যায়?” 

“ভুবনেশ্বরের বাড়ি তখনও হয়নি?” 

“বাড়ি হয়নি, তবে জমি কেনা হয়ে গিয়েছিল। কয়েক বিঘে জমি। কিন্তু বঙ্কু তখনও কলকাতা থেকে তার ব্যাবসা চালাচ্ছে। তো আসতে হল। এসে দেখি, ছেলে একটা নয়, এক জোড়া। যমজ ছেলে। শখ করে তাদের নাম রেখেছে রাম আর লক্ষ্মণ। যেটা মিনিট কয়েকের বড়, সেটা রাম, ছোটটা লক্ষ্মণ।” 

“কাল খাবার টেবিলে মিসেস ঘোষ ‘রামু’ বলে যায় উল্লেখ করলেন, সে-ই কি বঙ্কুবাবুর বড় ছেলে? ওই মানে মাথা ধরেছে বলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে কাল যে ঘুমিয়ে পড়েছিল?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ। তাকে আপনি এখনও দেখেননি। তবে আজ নিশ্চয় দেখতে পাবেন।” 

“আর লক্ষ্মণ? সে এখানে আসেনি?” 

“তার কথা একটু পরে বলছি। ইতিমধ্যে বঙ্কুর বউয়ের কথা, অর্থাৎ সেই প্রথম বউয়ের কথাটা আপনার জানা দরকার।” 

একটা সিগারেট ধরালেন ভাদুড়িমশাই। পোড়া-কাঠিটা ফেলতে গিয়েও ফেললেন না, সন্তর্পণে আবার দেশলাইয়ের বাক্সের মধ্যে গুঁজে রাখলেন। তারপর বললেন, “সেই বউটি বড় ভাল ছিল মশাই। বউভাতের দিন দেখে মনে হয়েছিল বুদ্ধিমতী মেয়ে। পরে দেখলুম, সত্যিই তা-ই। বঙ্কুর চরিত্রে অন্য কোনও দোষ না থাকলেও মদের নেশা ছিল মাত্রাতিরিক্ত। প্রভা সেটা ছাড়িয়ে দেয়। বঙ্কুর জীবনে শৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। প্রভা সেটা নিয়ে আসতে পেরেছিল। সবচেয়ে বড় কথা, বঙ্কুকে সে এটা বোঝাতে পেরেছিল যে, দু-হাতে টাকা রোজগার করা ছাড়াও একটা মানুষকে অন্য-কিছু কাজ করতে হয়। সংসার তার কাছে টাকা তো চায়ই, কিন্তু শুধু টাকাই চায় না, আরও কিছু চায়।”

আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “এসব কথাও আমি বঙ্কুর কাছেই শুনেছি। বঙ্কু সত্যি সুখী হয়েছিল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়েসের ফারাক পঁচিশ বছরের তবু যে প্রভা ওকে সুখী করতে পেরেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সুখ ওর কপালে বেশিদিন সইল না। হঠাৎ মাত্র তিন দিনের জ্বরে প্রভা মারা গেল। কী রকমের জ্বর, কীসের থেকে সেটা হয়েছে, তা বোঝা পর্যন্ত গেল না। এ হল সেভেনটিথ্রির কথা। প্রভার বয়েস তখন কতই বা হবে? এই ধরুন বত্রিশ-তেত্রিশ। আর তার যমজ ছেলে দুটোর বয়স মেরেকেটে পাঁচ বছর। এমনটা যে ঘটবে, বঙ্কু তা কল্পনাও করতে পারেনি। শোকে দুঃখে ও তখন প্রায় পাগল হয়ে যায়। তার বছর দুয়েক আগেই ওর ভুবনেশ্বরের বাড়ি কমপ্লিট হয়েছে। খবর পেয়ে আমি সেখানে ছুটে যাই। গিয়ে বুঝতে পারি যে, সেখানে থাকলে ও সত্যি-সত্যি পাগল হয়ে যাবে। হাউস কিপার তো একজন ছিলই, অন্যান্য সব কাজের লোকজনও সেখানে নেহাত কম ছিল না, তাদের হাতে বাড়ি দেখাশোনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বঙ্কু আর তার দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আমি ব্যাঙ্গালোরে চলে আসি।” 

“তারপর?” 

“তারপর আর কী, ভেবেছিলুম কয়েকটা মাস আমার কাছেই রেখে দেব, কিন্তু তা আর হল না।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আসলে কাজের লোক তো, কাজকর্ম ফেলে বসে থাকতে কদ্দিন তার ভাল লাগবে। মাস-খানেক যেতে-না-যেতেই বলল, “না রে, চারু ভুবনেশ্বরেই ফিরে যাই।’ তা ফিরে এসে ফের কাজের নেশায় মেতেও উঠল! চিঠি লিখেছিল। পড়ে জানা গেল, ছেলেদের দেখাশুনো করবার জন্যে বিস্তর মাইনে দিয়ে একজন গভর্নেস রেখে দিয়েছে। তার মাস কয়েক বাদে আমাকে একটা তদন্তের কাজে কটক যেতে হয়েছিল। গিয়ে ভাবলুম, ভুবনেশ্বর তো এখান থেকে মাত্র তিরিশ কিলোমিটার, একবার দেখে আসি, বঙ্কু কেমন আছে। তা দেখলুম, গভর্নেসই সেখানে এখন সর্বময়ী কর্ত্রী, বঙ্কু ফের সেই তার আগের জীবনে ফিরে গেছে, সংসারের কোনও ধারই আর সে ধারে না, টাকা রোজগার ছাড়া অন্য কোনও চিন্তাই তার নেই। আর হ্যাঁ, সে আবার মদও খাচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত।” 

“সেই গভর্নেসই কি মিসেস ঘোষ?” 

“কারেক্ট।” 

“প্রভার শোকে পাগল হয়ে গিয়ে তারপর বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই বঙ্কুবাবু এঁকে বিয়ে কে ফেললেন, কেমন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেখুন কিরণবাবু, ইংরেজিতে এই রকমের একটা কথা আছে যে, প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করাটাই হচ্ছে দ্য বেস্ট কমপ্লিমেন্টে দ্যাট এ ম্যান ক্যান পে টু হিজ ফার্স্ট ওয়াইফ। কেননা তার দ্বারা সে প্রমাণ করছে যে, প্রথম বারের দাম্পত্য জীবনে সে সুখী হয়েছিল, নইলে সে আবার নতুন করে ও-পথে পা বাড়াত না। কিন্তু না, বছর না ঘুরতেই বিয়ে করেনি, বিয়ে করেছিল আরও আট বছর বাদে, এইট্টিওয়ানে। বঙ্কুর বয়েস তখন পঁয়ষট্টি।” 

“বিয়েটা কি বঙ্কুবাবু করলেন, না করতে বাধ্য হলেন?” 

ইঙ্গিতটা ভাদুড়িমশাই ধরতে পেরেছিলেন। তীব্র চোখে আমার দিকে তাকালেন তিনি। যেন বুঝে নিতে চাইলেন আমাকে। তারপরেই তাঁর চাউনি আবার নরম হয়ে এল। বললেন, “ইউ রাইটারস আর এ হোল লট অব ডেঞ্জারাস পিপল। আরে না মশাই, সে-সব কিছু নয়। আর তা ছাড়া, ওকে আমি চিনি তো, ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করিয়ে নেবে, এমন মানুষ এখনও জন্মায়নি। তা নয়, আসলে একটা সময়ে মনে হয়েছিল যে, ডলি তো সবকিছু ছেড়েছুড়ে ওরই সংসার নিয়ে পড়ে রইল, অথচ মাসান্তে মাইনে আর চতুর্দিকে কুৎসা ছাড়া অন্য-কিছুই ওর জুটল না। কুৎসা বঙ্কুর বোনেরাও কিছু কম রটায়নি। বঙ্কুর বাড়িতে তারা মাঝেমধ্যে আসত, থেকেও যেত সপ্তাহের পর সপ্তাহ, কখনও কখনও মাসের পর মাস, কিন্তু ডলির সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলত না। এমন একটা ভাব দেখাত যেন লিঙ্গরাজ টেম্পলে পুজো দেবার যা-কিছু পুন্যি, ডলির সঙ্গে কথা বললেই সেটা অমনি উবে যাবে। অ্যাজ ফার অ্যাজ দে ওয়্যার কনসার্নড শি ডিড নট এগজিস্ট অ্যাট অল।” 

বললুম, “বঙ্কুবাবুর এটা ভাল লাগেনি নিশ্চয়?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “মোটেই না। ওর মনে হল, কিছু একটা করা দরকার। কী করবে? ওর যে আবার বিয়ে করবার ইচ্ছে ছিল, তা নয়। তাই এমনও ভেবেছিল যে, ডলিকে কিছু টাকা দিয়ে অন্য-কোথাও কাজ খুঁজে নিতে বলবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, তা হলে ওর সংসার সামলাবে কে? বাচ্চা দুটোকেই বা কে দেখবে? ব্যস, তারপরে আর ডিসিশন নিতে ওঁর দেরি হয়নি। ডলিকে ও বিয়ে করল। ডলির তরফে আপত্তি হতে পারত। কিন্তু হয়নি। তার কারণ ওরও দরকার ছিল একটা স্থায়ী আশ্রয়ের। ওর আগের জীবনে তো সুবিধে করতে পারেনি, দেয়ার শি ওয়জ আ মিজারেবল ফেইলিওর।’ 

“আগের জীবন মানে?”

“মানে আগে যে কাজ করত। শি ওয়জ অ্যান অ্যাকট্রেস। …না না, হিরোইন-টিরোইন নয়, নায়িকার বান্ধবী কি নায়কের বোন, কি এই রকমের অন্য কোনও আনইম্পর্ট্যান্ট রোল। গোটা দুই-তিন ছবিতে নেমেছিল, আপনি হয়তো দেখেও থাকবেন।” 

“তাই বলুম। তাই ওঁর চেহারাটা অমন চেনা-চেনা লাগছিল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যাক, আপনি তা হলে দেখেছেন। আমি দেখিনি। কিন্তু মজা কী জানেন, বিয়েটা হয়ে যাবার পরেই নাকি ডলির মাথায় সেই ফিলমের নেশা আবার চাগাড় দিয়ে ওঠে। বঙ্কুকে দিয়ে চার-চারটে ছবি করায়। চারটেতেই ও হিরোইন। শুধু তা-ই নয়, ওরই লেখা কাহিনী নিয়ে ছবি। ফলং মড়কম্। চারটেই ফ্লপ। এখন আবার নতুন একটা ছবি করাচ্ছে। তার দেখাশোনা করবার জন্যে কোত্থেকে একটা ভাইকেও এখানে জুটিয়ে এনেছে। ওই যে দীপক……হ্যাঁ, ওর কথা বলছি…. ছোকরার নিজেরও খুব অ্যাকটিং করার শখ। বলে যে, একবার চান্স পেলেই ও বাজার মাত করে দেবে।” 

“গল্প তো এবারও মিসেস ঘোষেরই।” 

“হ্যাঁ, তবে পাঞ্জাবের মেয়ে, বাংলাটা বলে ভালই, কিন্তু লিখতে তো পারে না। প্লটটা ও আপনাকে বলবে, সেই অনুয়ারী গল্পটা লিখে ফেলে আপনি তার স্ক্রিপট তৈরি করে দেবেন। কী ভাবে করবেন সেটা আপনার ভাবনা, আমার ভাবনাটা অন্যরকম।” 

“আপনার ভাবনা তো ডিরেকশন নিয়ে।” 

“আরে দুর মশাই,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ডিরেকশান তো একটা ছুতো। আসলে কয়েকটা দিন সঙ্গে-সঙ্গে থেকে সকলের উপরে আমি নজর রাখতে পারব, তাতে আমার কাজের সুবিধে হবে।” 

“কাজটা কী?” 

“বলছি, বলছি, অত অস্থির হবেন না। আমার কাজ রামুকে প্রোটেকশন দেওয়া।…..ও কী, অমন হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন কেন? যা বলছি, শুনে যান। বছর খানেক আগে লক্ষ্মণ হঠাৎ নিখোঁজ হয়। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল, তারা কোনও হদিশ করতে পারেনি। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। তাতেও কোনও সুরাহা হয়নি। বঙ্কু ধরে নিয়েছে, তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। এখন রামুকে নিয়ে ওর ভাবনা। ছোট ছেলেটা তো গেছেই, এখন এটাও না যায়। সেই জন্যেই ডাক পড়েছে আমার। কিন্তু মিসেস ঘোষ তা জানেন না। তাঁকে বলা হয়েছে, আমি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্র-পরিচালক, তবে কিনা বিদেশে কাজ করি তো, তাই এ-দেশে আমার নাম এখনও তেমন. ছড়ায়নি।” 

“মিসেস ঘোষ সেটা বিশ্বাসও করেছেন। 

“করেছেন। তার কারণ, বঙ্কু যখন ব্যাঙ্গালোরে যায়, ডলিকে সঙ্গে নিয়ে যায় না। আর আমিও বার কয়েক ভুবনেশ্বরে গিয়েছি বটে, কিন্তু ডলিকে তার মধ্যে একবারও ভুবনেশ্বরে দেখিনি। তার উপরে আবার গত পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে একবারও ভুবনেশ্বরে যাওয়া হয়নি আমার। 

বললুম, “এই ব্যাপার?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাড়িতে প্রায় পৌঁছে গেছি, এখন আর কোনও কথা নয়। …… কিন্তু কী ব্যাপার, বাড়ির দিক থেকে একটা চিৎকার শোনা গেল না?….আরে, অত হই-হল্লা কীসের?” 

প্রায় ছুটে গিয়ে আমরা বাড়ির মধ্যে ঢুকলুম। আশ্চর্য ব্যাপার, একতলাটা একেবারে খাঁ-খাঁ করছে। অথচ, একগাদা লোকের গলার আওয়াজ যে পাওয়া যাচ্ছে, তাও ঠিক। ভাদুড়িমশাই বললেন, “দোতলায় চলুন।” 

বলে আর তিনি দাঁড়ালেন না। এক-এক বারে সিঁড়ির দু-দুটো করে ধাপ টপকে দোতলায় উঠে গেলেন। 

আমি ওঁর চেয়ে বয়েসে বছর তিনেকের ছোট। কিন্তু খানিকটা পথ ছুটে আসায় আমার বুক ধড়ফড় করছিল। মনে হচ্ছিল যে, দম আটকে আসছে। ওইভাবে উঠতে গেলে আমার হার্ট-অ্যাটাক না হয়ে যায়। একতলাতেই একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তাই আস্তে-আস্তে উপরে উঠলুম। 

উঠে দেখি, আমারই ঘরটায় ভিড় জমে গেছে। বঙ্কুবাবু, মিসেস ঘোষ, দীপক, শঙ্কর—সবাইকে সেখানে দেখলুম। তা ছাড়া আরও পাঁচ-ছজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের আমি চিনি না। আন্দাজে বুঝে নিলুম যে, তারা এ-বাড়ির কাজের লোক। 

দীপক আর শঙ্কর ভিড়টা একটু সরিয়ে দিতে দেখলুম, ঘরের মেঝের উপরে দীপকেরই বয়সী একটি ছেলে চিত হয়ে শুয়ে আছে, আর ভাদুড়িমশাই ক্রমাগত তার মুখেচোখে জলের ঝাপটা দিচ্ছেন। 

শঙ্করকে জিজ্ঞেস করলুম, “কে এই ছেলেটি?” 

শঙ্কর বলল, “রামবাবু। ঘোষসাহেবের ছেলে। অজ্ঞান হয়ে গেছেন।” 

একটু বাদেই রামুর জ্ঞান ফিরল। তখন ঘটনার যে বিবরণ তার কাছে শোনা গেল, তাতে তো আমরা হতবাক। সকাল ছ’টায় সে ঘুম থেকে উঠেছিল। তারপর বেড-টি খেয়ে বাথরুমে যায়। দাড়ি কামিয়ে, মুখহাত ধুয়ে আধঘন্টা যোগব্যায়াম করে। তারপর বাগানে খানিক পায়চারি করে সওয়া সাতটা নাগাদ ঘরে ফিরে আসে। আগের দিনই নতুন-মা তাকে জানিয়ে রেখেছিলেন যে, সওয়া আটটার মধ্যে সাগরমহলে যাওয়া হবে, তাই চটপট সবাই যেন স্নান সেরে নেয়। কিন্তু স্নান করতে গিয়ে রামু দেখতে পায় যে, তার ঘরের অ্যাটাচড বাথরুমটা ভিতর থেকে বন্ধ। বাবা আর নতুন-মা’ও তখন স্নান করবার জন্যে যে-যার বাথরুমে ঢুকেছেন। ফলে, উপরতলার দুটো বাথরুমের অন্তত একটা খোলা পাবে ভেবে সে দোতলায় চলে যায়। দোতলায় সে আমাদের কাউকে দেখতে পায়নি। নিশ্চিন্ত মনে সে তাই আমার ঘরের বাথরুমটায় ঢুকতে গিয়েছিল। কিন্তু ঢুকবার উপক্রম করতেই ভিতর থেকে কেউ এমন জোরে তাকে ধাক্কা দেয় যে, সে মেঝের উপরে ছিটকে পড়ে। 

ভাদুড়িমশাই মেঝে থেকে তুলে রামুকে ইতিমধ্যে আমার বিছানার উপরে শুইয়ে দিয়েছিলেন। রামু উঠে বসবার চেষ্টা করছিল। ভাদুড়িমশাই তাকে উঠতে নিষেধ করে বললেন, “আর কিছুক্ষণ পরে উঠবে, এখন একটু বিশ্রাম নাও। আর হ্যাঁ, এখন তোমাকে বিশেষ কিছু জিজ্ঞেস করব না, শুধু কয়েকটা কথার জবাব দাও।” 

“বলুন।” 

“মেঝের উপরে পড়ে গিয়ে তোমার কোথায় চোট লেগেছে?” 

“মাথায়।” 

শুনে সস্নেহে রামুর মাথার হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আহা, খুব লেগেছে নিশ্চয়! এই এখানটা তো দেখছি বেশ ফুলেও গেছে।” 

“খুব ব্যথা করছে।” 

“আহা।…আচ্ছা রামু, বাথরুমের ভিতর থেকে কে তোমাকে অমন ধাক্কা মেরে ফেলে দিল, তা তুমি জানো?”

“না।” 

“তার মুখ দেখতে পেয়েছিলে?” 

“না। মুখটা একটা কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল।” 

“কিন্তু এতলায় তোমার নিজের বাথরুমটা কে আটকে রেখেছিল, সেটা নিশ্চয় জানো?”

“না, তাও জানি না।”

“বাইরে থেকে জিজ্ঞেসও করোনি?” 

“না। মনে হয়েছিল, মামাজি হয়ত ঢুকেছে। ও তো মাঝে-মাঝেই আমার বাথরুমটা ব্যবহার করে।” 

দীপক বলল, “না ভাঞ্জা, আমি আজ একবারও তোমার বাথরুমে যাইনি। আমি আর রাজেশ তো আউটহাউসে থাকি, সেখানকার বাথরুমেই আমরা আজ স্নান করে নিয়েছি।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “তা হলে? এ তো বড় মিস্টিরিয়াস ব্যাপার।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সবাইকে নিয়ে নীচে যাও, বঙ্কু। রামুর যা চোট লেগেছে দেখছি, তাতে মনে হয়, আজ আর আমাদের সাগরমহলে যাওয়া হবে না।” 

মৃদু গলায় রামু বলল, “না না, এখন আর আমার তেমন ব্যথা নেই। আমি যেতে পারব।” 

বলে সে আর দেরি করল না, বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে বলল, “এ কী, সবাই দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?” 

সবাই নীচে নেমে গেল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে আর আপনিই বা দেরি করছেন কেন? বাথরুমে ঢুকে তৈরি হয়ে নিন।” 

বললুম, “আপনি স্নান করবেন না?” 

“রাত চারটেতেই আমি স্নান সেরে নিয়েছি। তাবৎ কাজ না সেরে যে আমি ঘর ছেড়ে বেরুই না, তা আপনি খুব ভালই জানেন।” 

যাওয়ার সময়টা একটু পিছিয়ে না-দিয়ে উপায় ছিল না। ব্রেকফাস্ট খেয়ে সবাই যখন বাইরে এসে জমায়েত হলুম, তখন ন’টা বাজে। 

কথা ছিল, দীপক সাগরমহলে যাবে না। কলকাতায় অন্তত দুটো ফোন আজ করতেই হবে। একটা অরুণ সান্যালদের বেহালার বাড়িতে, আর একটা আমাদের বাড়িতে। দীপককে তাই যেতে হবে আগরতলায়। কিন্তু তার মুখ দেখে বুঝতে পারলুম যে, কাল রাত্তিরে সে যা-ই বলে থাকুক, এখন আর তার আগরতলায় যাবার বিশেষ ইচ্ছে নেই। 

মিসেস ঘোষও তাঁর ভাইয়ের বেজার ভাবটা লক্ষ করেছিলেন। বললেন, “কী রে, অত গম্ভীর কেন? সাগরমহলে তোর যাওয়া হচ্ছে না বলে বুঝি মন খারাপ?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা আগরতলায় তো আর কাউকেও পাঠানো যায়। দীপক তা হলে আমাদের সঙ্গে যেতে পারে।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “কে যাবে? ড্রাইভার দুজনকে তো ছাড়া যাবে না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোমার গাড়িটা কে চালাবে?” 

“বিজয়নারায়ণ…..মানে বিজু। গত তিরিশ বছর ধরে বিজু আমার গাড়ি চালাচ্ছে। যেখানেই যাই, ও আমার সঙ্গে থাকে। মানে….শুধু গাড়িই চালায় না, হরেক কাজে ওকে আমার দরকার হয়। ওকে তো ছাড়তে পারব না।” 

“তা হলে শঙ্কর যাক। কী হে শঙ্কর, আগরতলা থেকে কলকাতায় এই ফোন দুটো তুমি করে দিতে পারবে না?” 

শঙ্কর বলল, “খুব পারব।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “ওহে চারু, শঙ্করকে তো খুব আগরতলায় পাঠাচ্ছে, তা হলে তোমাদের গাড়িটা কে চালাবে? দীপক তো গাড়ি চালাতে পারে না।” 

এতক্ষণ আমি কোনও কথা বলিনি। এবারে আর না-বলে পারলুম না। হেসে বললুম, “সে কী দীপক, অমিতাভ বচ্চন তোমার গুরুজি, অথচ তুমি গাড়ি চালাতেও শেখোনি?” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “সত্যিই তো। তা হলে তুই সাগরমহলে যাবি কী করে দীপক?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নো প্রবলেম। গাড়ি আমিও চালাতে পারি, কিরণবাবুও পারেন। শঙ্করকে তাই অক্লেশে ছেড়ে দেওয়া যায়। শঙ্কর বাসে উঠে আগরতলায় চলে যাক। গাড়ি আমিই চালাব।” 

অন্য গাড়িটা অ্যাম্বাসাডার। সেটার পিছনে উঠলেন বঙ্কুবাবু, মিসেস ঘোষ আর রামু। বিজু গিয়ে ড্রাইভারের আসনে বসল। তার পাশের সিটে বসল পীতাম্বর। বঙ্কুবাবুর খাস-বেয়ারা। 

মারুতির পিছনে বসল দীপক আর রাজেশ। যেমন কাল রাত্তিরে, তেমন আজ সকালেও খাবার টেবিলে এই ছেলেটিকে আমি দেখেছি, কিন্তু ওর সঙ্গে পরিচয় হয়নি। দীপকই পরিচয় করিয়ে দিল। শুনলুম ও দীপকের বঙ্কু, ভাল ফোটোগ্রাফার। আউটহাউসে দীপক আর রাজেশ একই ঘরে থাকে। 

ভাদুড়িমশাই আর আমি বসলুম, সামানে। স্টিয়ারিং হুইল ধরে, জানলায় মুখ রেখে ভাদুড়িমশাই বললেন, “বঙ্কু, তোমরা এগিয়ে যাও, আমি তোমাদের ফলো করছি।” 

দুটো গাড়ি প্রায় একই “ঙ্গে স্টার্ট দিল। বিজু এগিয়ে গেল, মোটামুটি একটা দূরত্ব বজায় রেখে আমরা তার পিছন পিছন চললুম। 

রাস্তা যে একটানা একই রকমে: তা নয়। কখনও কখনও সমতল, আবার কখনও-কখনও ঢেউ খেলানো। কিন্তু খানাখন্দ কোথাও চোখে পড়ল না। ঝাঁকুনি নেই, গাড়ি বেশ মসৃণ গতিতে চলেছে, জানলায় চোখ রেখে আমি দু-দিকের বনজঙ্গল, ঘরবাড়ি খেতখামার আর মানুষজন দেখছি। মাঝে-মাঝে এক-একটা ঘন-বসতির জায়গা পেরিয়ে যাই। এক-আধ মিনিটের জন্যে দেখতে পাই যে, দু-পাশের দোকানপাটে কেনাবেচা চলেছে। তার পরেই আবার ফাঁকা রাস্তা। রাস্তার পাশে বাঁশঝাড়, পুকুর, ধানখেত। 

দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলুম, দীপকের কথায় আমার চমক ভাঙল।

“আচ্ছা মিঃ চ্যাটার্জি, ফিল্মে নামতে হলে কি গাড়ি চালানো শিখতেই হবে?”

হেসে বললুম, “সেটা নির্ভর করছে কোন ভূমিকায় তুমি নামবে, তার উপরে।” 

“গুরুজি যে-সব ভূমিকায় নামে, সেইরকম কোনও ভূমিকায় যদি নামতে চাই?” 

“ওরেব্বাপ রে বাপ,” শিউরে উঠে বললুম, “তা হলে শুধু ড্রাইভিং কেন, শিখতে হবে আরও অনেক কিছু। নাচ জানো?” 

“না।” 

“সেটা শিখতে হবে। বক্সিং জানো?” 

“না।” 

“সেটা শিখতে হবে। হ্যান্ডগ্রেনেড ছুড়তে আর বন্দুক চালাতে শিখতে হবে। ফেন্সিংটাও শেখা চাই। তা ছাড়া আরও অনেক কিছু শেখা দরকার। চোদ্দোতলা বাড়ির ছাতের উপর থেকে কীভাবে ঝাঁপ খেতে হয়, জানো?” 

“না।” 

“ওটাও না শিখলে নয়। ওইভাবে তোমাকে ঝাঁপ খেতে হবে। তারপর, ফুটপাথ থেকে উঠে, যেন কিছুই হয়নি এইভাবে একটা আলতো টোকা মেরে তোমার জামাকাপড়ের ধুলো ঝেড়ে ফের লাফিয়ে পড়তে হবে ভিলেনের উপরে। মেরে তাকে তক্তা বানিয়ে ফেলতে হবে। তা ছাড়া শুধু মারলেই তো চলবে না, মারটা প্রথমদিকে আচ্ছারকম খাওয়াও চাই। কী করে মার খেতে হয় জানো?” 

“না।” 

যে-রকম ক্ষীণ গলায় দীপক ‘না না’ বলছিল তাতে বুঝতে পারছিলুম যে, তার গলা ক্রমেই শুকিয়ে আসছে। বললুম, “জল খাবে দীপক?” 

“আছে আপনার সঙ্গে?” 

ওয়াটার-বটলটা পিছনে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললুম, “দীপক, তোমার ধারণা ফিল্মের নায়ককে শুধু নাচা-গানা করতে হয়। আর মিঠি-মিঠি কথা বলতে হয়। বাস, তা ছাড়া আর তার কোনও কাজ নেই। না রে বাপু, অত সহজ নয়। বিস্তর হ্যাপা।” 

“কিন্তু আপনি যে-সব কাজের কথা বললেন, ও-সব তো শুনেছি ডামিরা করে।”

বললুম, “তোমরা গুরুজি কিন্তু ডামি দিয়ে কাজ চালানো খুব একটা পছন্দ করেন না। অন্তত মারপিটের চোদ্দো আনা তিনি নিজেই করেন শুনেছি। তবে হ্যাঁ, চোদ্দোতলা বাড়ির ছাত থেকে তিনি লাফ মারেন না। ওটা ক্যামেরার কারসাজি।” 

ভাদুড়িমশাই কথা বললেন, অনেকক্ষণ বাদে। সামনের গাড়িটা ডাইনে বাঁক নিতে তিনি বললেন, “আমরা সাগরমহলে পৌঁছে গেছি।” 

সাগরমহলের সাগর আসলে একটা বিরাট জলা, আর মহল হচ্ছে একটা সরকারি টুরিস্ট লজ। দোতলা বাড়ি। দেখলে বোঝা যায় যে, সদ্য তৈরি হয়েছে। বিছানার চাদর থেকে বালিশের ওয়াড়, সবই একেবারে ধোপদুরস্ত। ওয়াশ-বেসিন থেকে চেয়ার-টেবিল, কোথাও একটা দাগ পর্যন্ত পড়েনি।

বঙ্কুবাবু আর ভাদুড়িমশাই কালও একবার সাগরমহলে এসেছিলেন। তখনই তাঁরা বুকিং করে যান। তিনটে ডাবল বেড আর একটা ট্রিপল-বেডের ঘর নেওয়া হয়েছে। ভাবা হয়েছিল, তিনটে ডাবল-বেডের ঘরের একটায় থাকবেন সস্ত্রীক বঙ্কুবাবু, একটায় ভাদুড়িমশাই আর আমি, একটায় রামু আর রাজেশ। ট্রিপল-বেডের ঘরটা নেওয়া হয়েছিল বিজু, পীতাম্বর আর শঙ্করের জন্য। শঙ্করের বদলে দীপক আসায় ব্যবস্থাটার একটু অদল বদল করতে হল। ডাবল-বেড ঘরটা বিজু আর পীতাম্বরকে ছেড়ে দিয়ে রামু, দীপক আর রাজেশ চলে গেল ট্রিপল-বেডের ঘরে। বঙ্কুবাবুর এই একটা ব্যাপার দেখে ভাল লাগল যে, ড্রাইভার আর বেয়ারার থাকার জন্যে তিনি আলাদা কোনও ব্যবস্থা করেননি। 

ঘরগুলো সবই দোতলায়। বঙ্কুবাবুর সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়। রেলিং ধরে আস্তে-আস্তে তিনি দোতলায় উঠলেন। দেখলুম, পীতাম্বর তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে রয়েছে। মিসেস ঘোষ একটু আগেই দোতলায় উঠে গিয়েছিলেন। কী একটা কাজে পীতাম্বরকে তিনি ডেকেছিলেনও। কিন্তু লক্ষ করলুম, বঙ্কুবাবু দোতলায় না ওঠা পর্যন্ত পীতাম্বর তাঁর পাশ থেকে নড়ল না। 

একতলার একপাশ থেকে শান-বাঁধানো খুব চওড়া একটা সিঁড়ি ধাপে-ধাপে যেখানে জলার মধ্যে নেমে গিয়েছে, সেখানে কয়েকটা নৌকো চোখে পড়ল। নৌকোগুলির খোলের দু’দিকে গদি-আঁটা বেঞ্চি পাত! 

বললুম, “ওগুলো নিশ্চয় জলার মধ্যে ঘুরে বেড়াবার জন্যে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঘুরে যদি বেড়াতে চান তো কেউ আপত্তি করবে না। কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার পাট না চুকিয়ে খামোখা এখন আপনি জলার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে যাবেন কেন? বরং দূরের ওই বাড়িটা ভাল করে দেখুন।” 

বাড়িটা অনেক আগেই আমার চোখে পড়েছিল। বেশ কিছুটা দূরে, জলার একেবারে অন্য প্রান্তে, জলের তলা থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল একটা বাড়ি। এতই বিশাল যে, বাড়ি না বলে রাজপ্রাসাদ বললেই ঠিক হয়। 

বললুম, “ও তো মনে হচ্ছে রাজবাড়ি মশাই।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কারেক্ট, ওটা একটা প্রাসাদই বটে। ওর নাম নীরমহল। শখ করে ওটা তিরিশের দশকে তৈরি করা হয়েছিল। খাওয়া-দাওয়ার পরে নৌকো করে আমরা ওখানে বেড়াতে যাচ্ছি। রাজপ্রাসাদের অবস্থা যে ইতিমধ্যে কী দাঁড়িয়েছে, তখন সেটা স্বচক্ষে দেখবেন।” 

দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলুম আমরা। হুহু করে বাতাস বইছে, কিন্তু বাতাসে দুপুরবেলার গরম ভাবটা নেই। তার উপরে আবার জলের উপর দিয়ে আসছে বলে ধুলো-ময়লাও নেই বিশেষ। জল অবশ্য কোনওখানেই খুব একটা গভীর বলে মনে হল না। জলার মধ্যে যেমন প্রচুর পাখি, তেমন কিছু-কি মানুষও চোখে পড়ল। বুক-সমান জল ঠেলে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রত্যেকের পাশেই একটা করে ডিঙি। ডিঙির মধ্যে কাঠি দিয়ে বানানো বাক্স। এক-একটা বাক্স নিয়ে তারা ডুব দিচ্ছে, তারপর জলের উপরে মাথা জাগিয়ে সেখানে পুঁতে রাখছে একটা করে নিশানা। 

জিজ্ঞেস করলুম, “ব্যাপারটা কী বলুন তো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বুঝলেন না? জলের তলার বাক্সগুলোকে রেখে আসছে, তারপর কাল কি পরশু ওই নিশানা দেখে জায়গা চিনে ওরা এক-এক করে বাক্সগুলোকে আবার জলের তলা থেকে তুলবে। তখন দেখা যাবে যে, বাক্সগুলো চিংড়িমাছে বোঝাই হয়ে আছে। জল তো মোটেই গভীর নয়, তাই চিংড়ির চাষের এখানে খুব সুবিধে।” 

বললুম, “লাঞ্চে তা হলে চিংড়ির মালাইকারি পাব?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কপালে থাকলে পাবেন।” 

কপালে যে নেই, সেটা খানিক বাদে ডাইনিং হলে গিয়ে বোঝা গেল। চিংড়ি নয়, নিত্য যা খাই, সেই কাটাপোনা। লজেব ম্যানেজার আমাদের আক্ষেপের কথা শুনে বললেন, “ঠিক আছে, রাত্তিরে যাতে চিংড়ি মাছ পান, তার ব্যবস্থা করছি।” 

খাওয়া শেষ হতে-হতে দেড়টা বাজল। বঙ্কুবাবু বললেন, “আধ-ঘন্টাটাক বিশ্রাম করে তারপর একটা নৌকো নিয়ে আপনারা নীরমহল থেকে ঘুরে আসুন। আমি অবশ্য যাচ্ছি না। বিজুও থাক। ও আমার দেখাশুনো করবে। মিঃ চ্যাটার্জি, জায়গাটা আপনি বেশ ভাল করে দেখুন। ডলি বলছিল, হিরো আর হিরোইন নৌকো করে ওখানে যাবে। নৌকো যখন চলছে, তখন একটা ডুয়েট গাইবে তারা। গান শেষ। নৌকো ওখানে পৌঁছে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে ওরা দুজন উপরে উঠছে। কাট। পরের দৃশ্যটা ভাইটাল। প্রাসাদের একেবারে হাইয়েস্ট পয়েন্ট, হঠাৎ মাথা ঘুরে গিয়ে হিরোইন সেখান থেকে পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু হিরো তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে তাকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিল। এই সময়ে একটা গান থাকলে ভাল হয়। লাভ-সং। ডলি বলছিল, গানটা যদি পল্লিগীতি হয়, আর যদি মাঝিকে দিয়ে সেটা গাওয়ানো যায়, দৃশ্যটা তা হলে দারুণ জমবে। চারু তো ডিরেক্টর। ও বলছিল, ইটস এ ভেরি ব্রাইট আইডিয়া।….না না, মাঝিকে গাইতে হবে না, সে লিপ দেবে, গাইবার জন্যে নাম-করা কোনও ফোক-আর্টিস্টকে ধরা যাবে তাখন। …..তো মিঃ চ্যাটার্জি, আপনি তো ডলির এই আইডিয়াটাকে স্ক্রিপটে ট্রান্সফার করবেন, তাই আপনার ওপিনিয়নটাও জানা দরকার। আপনি কী বলেন?” 

আমাকে কী বলতে হবে, সে তো ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে আমি জেনেই গিয়েছি। তাই উচ্ছ্বসিত গলায় বললুম, “দারুণ, দারুণ। এর আর কোনও জবাব নেই।” 

দীপক বলল, “ফোক-সং না-দিয়ে ওইখানে একটা ফাইট দেওয়া যায় না?” 

বঙ্কুবাবু তাঁর প্রায় নাতির বয়সী শ্যালকটির মন্তব্য শুনে বললেন, “ওটা একটা ডেজার্টেড রাজবাড়ি, ওখানে কে কার সঙ্গে লড়বে?” 

“কেন, এমন তো দেখানো যায় যে, ওটা স্মাগলারদের আড্ডা, হিরো যে তাদের আড্ডার হদিশ পেয়েছে এইটে বুঝে গিয়ে হিরোকে তারা খতম করতে চায়। আর ওই হিরোইন, ও আসলে স্মাগলার-গ্যাঙের লিডারের মেয়ে। দিদি, তুই বরং এইভাবে তোর স্টোরি-লাইনটাকে পালটে নে। দেখিয়ে দে যে, হিরোকে লটকে ওখানে নিয়ে আসার জন্যেই হিরোইনকে কাজে লাগানো হয়েছিল। কিন্তু তার ড্যাডি যেই হিরোকে অ্যাটাক করেছে, সেও অমনি হিরোর পাশে দাঁড়িয়ে তার ড্যাডির এগেনস্টে ফাইট করতে লাগল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন? হিরোইন হঠাৎ দুম করে তার ড্যাডির এগেনস্টে ফাইট করতে যাবে কেন?” 

“বুঝলেন না?” দীপক বলল, “হিরোর সঙ্গে তার মোহব্বত হয়ে গিয়েছে যে।” 

ভাদুড়িমশাই বলনে, “অ।” 

বঙ্কুবাবু তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকাতে গিয়ে রাজেশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী গো, তোমার কী মনে হয়? তোমার ভাইটাকে আমি একেবারে গবেট ভাবতুম, কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে কথাটা নেহাত খারাপ বলেনি।” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “একটু ভেবে দেখি। প্লটটাকে যেভাবে সাজিয়ে নিয়েছিলুম, ঠিক সেইভাবেই তো আর হবে না, এখানে-ওখানে মাইনর কিছু-কিছু চেঞ্জ তো করতেই হবে।” 

আমি বললুম, “এটা কিন্তু একটা মেজর চেঞ্জ। ছবি একেবারে অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে।’ 

রাজেশ এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিল। এবারে বলল, “দীপক যা বলছিল, তাতে কিন্তু আমার কাজের অনেক সুবিধে হবে।” 

গলা শুনতে পেয়েছিলেন, তাই বঙ্কুবাবু এবারে ভুল-লোকের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেন না। সরাসরি রাজশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার আবার কী সুবিধে?” 

“বিস্তর সুবিধে।” রাজেশ বলল, “নীরমহলে তো আমি আগেও এসেছি। ওখানে যদি ফাইট হয়, তো নানা অ্যাংগল থেবে আমি তার ছবি তুলতে পারব।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “অ্যাঁ, তুমি ছবি তুলবে মানে? তার জন্যে তো ক্যামেরাম্যানই রয়েছে।”

দীপকের দিকে ঘুরে দাঁড়াল রাজেণ। বলল, “সে কী, তুই তা হলে কলকাতা থেকে এখানে আমাকে আসতে বললি কেন? ক্যামেরাম্যানের কাজটা আমি পাব না?” 

দীপক জানলার দিকে তাকিয়ে জলার শোভা দেখতে লাগল। 

মিসেস ঘোষ বললেন, “আরে বাবা, এত ব্যস্ত হবার কী আছে। আগে লোকেশন ঠিক করি, স্ক্রিপট লেখা হোক, কাস্টের ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলি তা নয়, ক্যামেরার কাজ কে করবে, তাই নিয়ে ঝামেলা আরম্ভ হয়ে গেল।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “ঝামেলার তো কিছু নেই, ক্যামেরার কাজ অগের ছবিগুলোতে সুনীল গুপ্ত করেছেন, হি ইজ অ্যান এক্সেলেন্ট ক্যামেরাম্যান, এবারেও তিনিই কাজ করবেন। এ একেবারে পায়।” 

রাজেশ বলল, “তা হলে আর আমার নীরমহলে গিয়ে কী হবে? আমি যাচ্ছি না।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “সে তোমার যেতে ইচ্ছে হয় যাবে, ইচ্ছে না হলে যাবে না। …..ও হ্যাঁ, বিজু কাল নীরমহল দেখে এসেছে, পীতাম্বরের দেখা হয়নি, ও আমার কাছে ছিল। তা পীতাম্বর আজ তোমাদের সঙ্গে যাক্, বিজু আমার কাছে থাকবে।” 

কথাটা মিসেস ঘোষকে বলা। তিনি বললেন, “সে তো তুমি আগেই বলেছ।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “বলেছি বুঝি? মনে ছিল না। এখন আমি উপরে যাব। বিজু কোথায়?”

বিজু আর পীতাম্বর আড়ালে কোথাও অপেক্ষা করছিল। বঙ্কুবাবুর শেষ কথাটা শুনে সে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, “চলুন স্যার।” 

বঙ্কুবাবু দোতলায় চলে গেলেন। রামুকে কিছুক্ষণ ধরেই দেখা যাচ্ছিল না। মনে হল, খাওয়ার পাট চুকে যাবার পরেই সে দোতলায় উঠে গেছে। দীপক আর রাজেশও গম্ভীর মুখে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। 

একতলার ডাইনিং হলে এখন শুধু আমি, ভাদুড়িমশাই আর মিসেস ঘোষ। ডাইনিং হলের পাশেই লাউঞ্জ। মিসেস ঘোষ বললেন, “চলুন, লাউঞ্জে গিয়ে বসা যাক।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু বিশ্রাম করে নিলে হত না? একটু বাদেই তো ফের বেরুতে হবে।”

মিসেস ঘোষ বললেন, “আমি আর এখন উপরে যাব না। আপনারা বরং নিজেদের ঘরে গিয়ে একটু গড়িয়ে নিন।” 

ভাড়িনশাই হেসে বললেন, “আমাদের কথা ভেবে ও-কথা বলিনি। আমাদের এ-সব অভ্যেস আছে, আমি আপনার কথা ভাবছিলুম। সকাল থেকে আপনার উপর দিয়ে ঝড় তো নেহাত কম গেল না।” 

“ঝড় আবার কোথায় দেখান?” 

আমি বললুম, “সে কী, সক্কালবেলায় রামুকে নিয়ে ওই কাণ্ড। তারপরে এতটা পথ আসতে হল। তারপর এখন আবার রাজেশকে নিয়ে এই ঝামেলা। যা রেগে গেছে, সত্যি-সত্যি চলে না যায়!” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “এ-সব ঝামেলা নিত্যি আমাকে পোহাতে হয়। তবে হ্যাঁ, ক্যামেরাম্যানের ক’টা রাজেশকে দিলেও ক্ষতি হত না। সুনীল গুপ্ত সম্পর্কে আপনাদের বঙ্কু মোটেই ঠিক কথা বলেননি। ভদ্রলোকের নামডাক আছে ঠিকই, কিন্তু কাজ এমন কিছু আহামরি নয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে এত নামডাক হল কী করে?” 

মিসেস ঘোষ বললেন; “সে-সব আমার জানতে কিছু বাকি নেই। ফিল্ম-ম্যাগাজিনগুলো যারা চালায়, তাদের তো হাড়ে হাড়ে চিনি, কাকে কীভাবে তুষ্ট করতে হয়, সে-সব আমার জানা হয়ে গেছে। আপনাদের বঙ্কুর সঙ্গে পরিচয় হবার আগে যে আমি ফিল্মের লাইনেই ছিলুম সেটা ভুলে যাবেন না। লাইনটা কেন ছেড়ে দিয়েছিলুম জানেন?” 

বললুম, “কেন?” 

“স্রেফ ঘেন্নায়। দু-লাইন প্রশংসার জন্য কী দিতে হবে আর পাঁচ লাইন প্রশংসার জন্যে কী, তা কি জানি না ভেবেছেন? সব জানি। কাগজে-কাগজে সুনীল গুপ্তর অত প্রশংসা বেরোয় কেন, তাও জানি। সবই ওর শালির জন্যে। তাও তো সেটা দেখতে একটা কালপেঁচির মতো, কারও পাতে দেবার যুগ্যি নয়। বলব, সবই একদিন বলব।” 

কথাটাকে অন্য দিকে ঘোরাবার জন্যে বললুম, “একটু বাদেই কিন্তু আমাদের নৌকোয় উঠতে হবে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাও তো বটে। সওয়া দুটো বাজে। আমার খেয়ালই ছিল না। মিনিট পনেরোর মধ্যেই বেরোতে পারলে ভাল হয়। চলুন কিরণবাবু, জামাকাপড় পালটে আসা যাক।” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “চলুন, আমিও যাচ্ছি। ও হ্যাঁ, প্লটটা আমি আজই শোনাতে চাই। ওখানে নিয়েই শোনাব। মিঃ চ্যাটার্জি, কাল রাত্তির থেকে আজ এখন পর্যন্ত তো আপনি সময় করে উঠতে পারলেন না। নীরমহলে পৌঁছে আবার ‘পরে হবে’ বলবেন না যেন।” 

বললুম, “আরে ছিছি, এ আপনি কী বলছেন। স্ক্রিপট লিখতে এসেছি, আর আপনার প্লটটা শুনে নেবাব সময় হবে না? তবে কিনা, প্লটটা একটু মন দিয়ে শুনতে হবে তো, সেটা কি এত ডামাডোলের মধ্যে হয়! ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তা করতে হবে, আপনার সঙ্গে ডিটেলস নিয়ে আলোচনা করতে হবে, তার একটা উপযুক্ত পরিবেশ চাই না?”

মিসেস ঘোষের মুখে যে একটা বেজার-ভাব দেখতে পাচ্ছিলুম, সেটা তবু কাটল না। বললেন, “আশা করি নীরমহলে সেটা পাওয়া যাবে।” 

বললুম, “তবে তো খুবই ভাল। গল্পের আউটলাইনটা আপনি আমাকে বলবেন, তারপরে উই শ্যাল হ্যাভ এ থ্রেডবেয়ার ডিসকাশন, ভাদুড়িমশাইও যে তাতে যোগ দেবেন, সে-কথা বলাই বাহুল্য। তারপর যদি দেখা যায় যে, অধিকাংশ ব্যাপারেই আমরা একমত, তবে তো কথাই নেই, পরো কাহিনীর একটা খসড়া দাঁড় করাতে আমার তিন দিনের বেশি সময় লাগবে না। ব্যস, সেই াড়াটা যদি আপনাদের ভাল লাগে, তো পরদিন থেকেই আমি স্ক্রিপট লিখতে আরম্ভ করব।” 

মিসেস ঘোষের মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটল। বললেন, “চলুন তা হলে উপরে যাওয়া যাক।”

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আমি হাসতে-হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়লুম। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আস্তে, আস্তে। মিসেস ঘোষ বুঝতে পারলেই সর্বনাশ। আর যা-ই করুন, দয়া করে ওঁকে বোকা ভাববেন না।” 

বললুম, “যা অভিনয় করলুম, তাতে একটা পুরস্কার নিশ্চয়ই আশা করতে পারি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা পারেন। তবে বেস্ট-অ্যাক্টিংয়ের পুরস্কারটা কাকে দেব, ভাবছি। আপনাকে না বঙ্কুকে। 

টুরিস্ট লজ থেকে জলের উপর দিয়ে নীরমহলে পৌঁছতে আধঘন্টাও লাগল না। একটা নৌকোতেই হয়ে গেছে। দলে আমরা এখন সাতজন। আমি, ভাদুড়িমশাই, মিসেস ঘোষ, রামু, দীপক, পীতাম্বর আর রাজেশ। ভেবেছিলুম, রাজেশ বোধহয় আসবে না। কিন্তু সেও এসেছে দেখলুম। মুখে অবশ্য একটুও হাসি নেই। কথাও বিশেষ বলছে না। 

ভিতটা জলের তলায়। সেই ভিতের উপরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই রাজপ্রাসাদ। উদয়পুরের লেক-প্যালেস দেখে ত্রিপুরার মহারাদের এই বাড়ি বানাবার শখ হয়েছিল কি না জানি না, তবে এটাও যে একটা তাক-লাগানো ব্যাপার, তাতে আর তার সন্দেহ কী। সামনে আর পিছনে, দু-দিক দিয়েই ঢোকা যায় এই রাজবাড়িতে। রাজার নৌকো সামনের ঘাটে ভেড়ানো হত, আর রানিমা’র নৌকো একটু ঘুরে গিয়ে ভিড়ত অন্দরমহলের সিঁড়ির সামনে। নৌকো থেকে সরাসরি সিঁড়িতে পা রেখে রাজপরিবারের মেয়েরা উপরে উঠে যেতেন। 

এখন আর যান না। নীরমহল এখন আর শখের রাজবাড়ি নয়, ত্রিপুরার আর-পাঁচটা টুরিস্ট-স্পটের মতন এটাও একটা টুরিস্ট-স্পট। আজ অবশ্য পর্যটকদের ভিড় নেই। ঘুরে-ঘুরে আমরা সব দেখতে লাগলুম। 

দেখলে অবশ্য দুঃখই হয়। ভাদুড়িমশাই বলেছেন যে, এ-বাড়ি খুব বেশিদিনের পুরনো নয় তিরিশের দশকে তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ এর বয়েস কিছুতেই ষাটের বেশি হতে পারে না। অথচ তারই মধ্যে নীরমহলের অবস্থা একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেওয়ালের পলস্তারা এখানে-ওখানে খসে পড়েছে, পাঁচিলে ফাটল, কার্নিশে অশথগাছ, মেঝে ফুটিফাটা। মেঝের উপরে এককালে নিশ্চয় দামি টালি ছিল, এখন নেই। বাগান একটা আছে ঠিকই, কিন্তু তার অবস্থাও খুব একটা উৎসাহিত হবার মতো নয়। তবে হ্যাঁ, মেরামতির কাজ চলেছে। এখানে-ওখানে জনাকয় মিস্ত্রি আর মজুর আমাদের চোখে পড়ল। 

রামু রাজেশ আর দীপক নীরমহলের সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। আমি আর ভাদুড়িমশাইও সেদিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিলুম, মিসেস ঘোষ বললেন, “আপনারা অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? ওরা ছেলেমানুষ, ওরা ওদের মতো ঘুরে বেড়াক। চলুন, আমরা বরং সামনের ওই বাগানটাতে একটু বসি।” বুঝলুম, অনেকক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে, আর পারা যাবে না। প্লটটা এবারে শুনতেই হবে। বললুম, “বেশ তো।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমারও কি থাকা দরকার?” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “আপনি ডিরেক্টর, আপনার মতামতটাই সবচেয়ে জরুরি। তবে আপনাকে তো একবার বলেইছি। এখন উনি শুনুন। শোনানো হয়ে গেলে আমরা একটু আলোচনায় বসব। তখন কিন্তু আপনাকে থাকতেই হবে।” 

অর্থাৎ ‘এখন আপনার না থাকলেও চলে’। ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশ, আপনারা তা হলে কাজে লেগে যান, আমি একটু ওদিক থেকে ঘুরে আসি। খানিক বাদে এসে আপনাদের সঙ্গে যোগ দেব।” 

ভাদুড়িমশাই চলে যাবার পরে মিসেস ঘোষ আর কোনও ভণিতার মধ্যে গেলেন না। ভ্যানিটি ব্যাগের ভিতর থেকে ভাঁজ-করা এক শিট কাগজ বার করে বললেন, “গল্পের আউটলাইনটা আমি এখানে লিখে রেখেছি। বলি?” 

“নিশ্চয়।” 

বাংলাটা মিসেস ঘোষ বলতে পারেন ভালই, তবে লিখতে পারেন না। আউটলাইনটা তাই ইংরেজিতে লিখে রেখেছেন। সেটা বলতেও শুরু করেছিলেন ইংরেজিতেই। 

“দ্য হিরোইন ইজ আ ভিলেজ বেল….শি কামস অব আ ভেরি পুয়োর ফ্যামিলি…..ইন ফ্যাকট হার ফাদার ইজ আ ডেইলি ওয়েজ-আর্নার অ্যান্ড হ্যাজ টু ওয়ার্ক ফ্রম ডন টু ডাস্ক ইন দ্য হাউস অব আ ভেরি রিচ ম্যান……দেন ওয়ান ডে…….”

এই পর্যন্ত বলে মিসেস ঘোষ হঠাৎ কাগজ থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। সম্ভবত বুঝে নেবার চেষ্টা করলেন যে, ইংরেজিটা আমার বোধগম্য হচ্ছে কি না। কী বুঝলেন তিনিই জানেন, কিন্তু পরমুহূর্তে যখন আবার মুখ নামিয়ে পড়তে শুরু করলেন কাগজটা, তখন দেখলুম ইংরেজি নয়, বাংলা তর্জমা করে গল্পটা আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। 

“বাবা তো একদিন জ্বরে পড়ল….খুব জ্বর….কাজে যাবার তাগদ নেই…. অথচ না-গেলে সেদিনকার ওয়েজ মিলবে না….তো কী আর করবে….নিজে না গিয়ে মেয়েটাকে কাজে পাঠাল।…আপনি ফলো করছেন তো?”- 

একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলুম। মিসেস ঘোষের কথায় চমকে উঠে বললুম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফলো করছিল মেয়েটাকে। খারাপ লোকেদের ওই তো কাজ, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তারা ফলো করে।” 

“ও নো,” মিসেস ঘোষ প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, “মেয়েটাকে ফলো করার কথা হচ্ছে না। জিজ্ঞেস করছিলুম যে, যা বলছি, আপনি ফলো করতে পারছেন কি না।” 

লজ্জিত হয়ে বললুম, “আইম সরি। আপনি বলে যান।” 

মিসেস ঘোষ আবার তাঁর প্লটের খেই ধরলেন। “মেয়েটা তার বাপের বদলে সেই বড়লোকটার বাড়িতে কাজ করতে গেল…..কিন্তু বড়লোকটার ছেলের মতলব খুব খারাপ…..একা পেয়ে হি আউটরেজড দ্য মডেস্টি অব দ্যাট পুয়োর গার্ল!” 

এবারে আর অন্যমনস্ক হইনি। বললুম, “বড়লোকের ছেলেরা তো ওই করতেই আছে। তারপরে?” 

“মেয়েটা বাড়িতে ফিরল……বাবাকে সব বলল….বাবা গেল ভিলেজ-পঞ্চায়েতের কাছে…. কিন্তু পঞ্চায়েতের যে কর্তা, বড়লোকটা তো তাকে টাকা খাইয়ে রেখেছিল……সে তাই কোনও স্টেপ নিল না…..অ্যান্ড ইন আটার ডেসপেয়ার দ্য পুয়োর ফেলো লিভস দ্য ভিলেজ উইথ হিজ ডটার। গ্রাম থেকে ওরা শহরে গেল…… কাজ খুঁজতে লাগল…..তো একটা কাজ পেয়েও গেল। এক ইয়াং পুলিশ অফিসারের বাড়িতে নোকর আর নোকরানির কাজ। ….ব্যাপারটা ধরতে পারছেন তো?” 

আবারও একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলুম। কিন্তু এবারে আর সেটা বুঝতে দিলুম না। বললুম, “চমৎকার এগোচ্ছে। ওই লাস্ট সেনটেন্সটা আর একবার বলুন তো।” 

“ইয়াং এক পুলিশ অফিসারের বাড়িতে ওরা নোকর আর নোকরানির কাজ পেয়ে গেল। কিন্তু ওরা যে বাপ আর মেয়ে, পুলিশ অফিসারটিকে তা জানতে দিল না।” 

বললুম, “একটা কথা ভাবছি।” 

“বলুন।” 

“নোকর আর নোকরানির ব্যাপারটা আমার খুব জুতসই ঠেকছে না। তার চেয়ে বরং দীপক যা বলছিল, ওরা স্মাগলার কিংবা ডাকাত হয়ে যাক। 

মিসেস ঘোষ বললেন, “আপনিও তা-ই মনে করেন?” 

বললুম, “দীপক তো কিছু খারাপ বলেনি।” 

“না, তা বলেনি। ইন ফ্যাক্ট হি হ্যাজ আ পয়েন্ট দেয়ার। তবে আমি ভাবছিলুম যে, এটাকে বিগ ল্যান্ডহোল্ডার আর ল্যান্ডলেস অ্যাগ্রারিয়ান লেবারারদের একটা মুখোমুখি লড়াইয়ের দিকে নিয়ে যাব …মানে এটা তো আর একটা বি-গ্রেড হিন্দি ফিল্ম নয়, বাংলা ছবি। তো বাঙালি দর্শকদের জন্যে কিছু ফুড ফর থট তো দেওয়া চাই। নইলে তারা নেবে কেন? দেয়ার অ্যান এনটায়ারলি ডিফারেন্ট কাইন্ড তাব কাস্টমার্স।” 

ভদ্রমহিলা বঙ্কুবাবুকে বিয়ে করেছেন এইটি ওয়ানে। তার মানে দশ বছর হল উনি একজন টাকার কুমিরের ঘরণী। অথচ, বাঙালি দর্শকদের চিন্তার খোরাক জোগাবার জন্যে ওঁর ঘুম হচ্ছে না। এমন একটা ছবি করতে চাইছেন, যাতে গরিবের মেয়ে বড়লোকদের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে ধর্ষিত হবে, তারপর কিছুকাল কষ্টভোগ করে বড়লোকের বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াইয়ে নামবে। 

আমার হাসি পাচ্ছিল। বললুম, “ঠিক আছে। কিন্তু লড়াইটা হবে কীভাবে? মানে, খবর পেলেই তো পুলিশ ফোর্স এসে হাজির হবে সেখানে!”

“বাট দ্যাট ইয়াং পোলিস-অফিসার উইল বি অন হার সাইড। তার সঙ্গেই তো মেয়েটার মোহব্বত হয়ে গেছে।” 

মনের মধ্যে একটা সন্দেহ অনেকক্ষণ ধরেই দানা বাঁধছিল। প্রশ্ন করলুম, “সবই তো হল, কিন্তু ঘটনাগুলো ঘটবে কোথায়?” 

“কেন, ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল।” 

“যাচ্চলে, তা হলে ত্রিপুরায় এসে লোকেশান বাছাই করবার দরকার হল কেন?” 

“এত সুন্দর একটা জায়গা, এটাকে কাজে লাগাব না?” 

“কিন্তু নীরমহল? এটাকে দেখলেই তো লোকে ধরে ফেলবে যে, জায়গাটা পশ্চিমবঙ্গ নয়।”

মিসেস ঘোষ হাসলেন, “ওটা ম্যানেজ হয়ে যাবে। ডিটেলস তো আপনি লিখবেন। সেখানে দেখিয়ে দেবেন যে, দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে ওই পুলিশ-অফিসারটি ত্রিপুরায় বেড়াতে এসেছে।” 

“নোকরানিকে সঙ্গে নিয়ে?” 

“কেন, নোকরানিকে সঙ্গে নিয়ে কেউ বেড়াতে যায় না?” 

“তা হয়তো যায়, কিন্তু ফিল্ম-ক্রিটিকদের আমি চিনি তো, এটা তাদের খাওয়ানো একটু শক্ত হবে। কেন, নীরমহলকে বাদ দিলে কী হয়?” 

“না না,” মিসেস ঘোষ প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, “নীরমহলকে বাদ দেওয়া চলবে না। সেইসঙ্গে সিপাহিজলার সরকারি রেস্ট-হাউস আর উদয়পুরের ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরকেও এই ছবির মধ্যে রাখতে হবে।” 

“কেন?” 

“বা রে,” মিসেস ঘোষ সলজ্জ গলায় বললেন, “তিন জায়গায় আমি তিন রকমের ড্রেস পরব যে। সিপাহিজলায় বোটিং করবার সময় পরব সবুজ সালোয়ার আর হলুদ কামিজ, এখানে….. মানে এই নীরমহলে পরব স্টোন-ওয়াশ জিনসের ট্রাউজার্স আর ব্যাগি শার্ট, আর উদয়পুরে ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দিরে পুজো দিতে যাব তো, তাই সেখানে লালপেড়ে গরদের শাড়ি পরে নেব।” 

আমার মুখ দিয়ে কোনও কথাই সরছিল না। অনেক কষ্টে বললুম, “এ ছবির হিরোইনও কি তা হলে আপনিই হচ্ছেন?” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “তা ছাড়া আর কে হবে। সুটেবল কাউকেই তো খুঁজে পাচ্ছি না।”

ঢোক গিলে বললুম, “কিন্তু নায়িকার বয়েস তো যদ্দুর বুঝতে পারছি খুবই কম। ভিলেজ-গার্ল, বিয়ে হয়নি, বয়েস তা হলে কতই বা হতে পারে, এই ধরুন সতেরো আঠারো। কি মেরেকেটে কুড়ি। তার বেশি তো হতেই পারে না।” 

“ও নিয়ে ভাববেন না।” মিসেস ঘোষ বললেন, “হেমা মালিনী ‘সোলে’ ফিল্মে ভিলেজ-বেল হয়নি? বাট হেমা ইজ আ ক্লোজ ফ্রেন্ড, সো প্লিজ ডোন্ট আসক মি হেমার বয়েস তখন কত ছিল। না না, ও নিয়ে আপনার ভাববার কিছু নেই, ও আমি ম্যানেজ করে নেব। আপনি শুধু একটা অনুরোধ রাখুন।” 

“বলুন।” 

“আপনাদের বঙ্কু….মানে মিঃ ঘোষকে একটু বুঝিয়ে বলুন যে, গুচ্ছের টাকা ঢেলে বাইরে থেকে কাউকে নেবার দরকার নেই। হিরোইন এবারেও আমাকে করলেই ভাল হয়। তাতে শ্যুটিং নিয়ে যেমন ঝামেলা হবে না, তেমন ঘরের টাকা ঘরেই থাকবে।” 

বললুম, “ঠিক আছে। কিন্তু মিঃ ভাদুড়ি তো ডিরেক্টর, তাঁর সঙ্গেও একটু কথা বলে নিলে ভাল হয়।” 

উত্তরে মিসেস ঘোষ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বলা হল না। তার আগেই নীরমহলের সামনের দিক থেকে বিকট একটা চিৎকার ভেসে এল। 

মিসেস ঘোষ একেবারে থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার? কে চিৎকার করে উঠল? মনে হল যেন রামুর গলা?” 

চিৎকারটা শুনেই আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলুম। বললুম, “কিছুই তো বুঝতে পারছি না। দাঁড়ান, দেখে আসি।” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “চলুন, আমিও যাচ্ছি।” 

চিৎকারটা সামনের দিক থেকে এসেছিল। খানিকটা এগোতেই চোখে পড়ল, দীপক আর রাজেশ একটা বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়ে কিছু দেখছে। পরক্ষণেই তারা সিঁড়ির দিকে ছুটল। 

যেখান থেকে তারা নীচের দিকে ঝুঁকে কিছু দেখছিল, সেইখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমি নীচের দিকে তাকালুম। যা দেখলুম, তাতে বুকের মধ্যে ধড়ন করে উঠল আমার। নীচে, মাটির উপরে, একটা লোক সটান শুয়ে রয়েছে। পরক্ষণেই বুঝলুম যে, সে রামু। মিসেস ঘোষ কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন, বলে মনে হল না। বললুম, “তাড়াতাড়ি নীচে চলুন। রামুর কিছু একটা হয়েছে।’ 

সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে গিয়ে দেখলুম, পীতাম্বর আমার আগে-আগে নামছে। বললুম, “কোথায় যাচ্ছ পীতাম্বর?” 

পীতাম্বর বলল, “একটা চিৎকার শুনতে পেলুম। কার চিৎকার জানেন?” 

“সম্ভবত রামুর। চলো চলো, আর দাঁড়িয়ে থেকো না।” 

একতলায় সামনের দিকটায় গিয়ে যখন পৌঁছলুম, রামু তখন আর শুয়ে নেই, দাঁড়িয়ে উঠে দীপক আর রাজেশকে হাত-পা নেড়ে খুব উত্তেজিতভাবে কিছু বলছে। আমাদের মাঝিটিও সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখলুম। বুঝতে পারলুম, হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে সে আর নৌকোর মধ্যে বসে থাকতে পারেনি, নৌকো ছেড়ে সামনের খাড়াই পথটুকু পেরিয়ে নীরাহুলের ল গোয়া জমিতে উঠে এসেছে। ভাদুড়িমশাইকে কিন্তু সেখানেও দেখতে পেলুম না। 

দীপক আর রাজেশকে জিজ্ঞেস করলুম, “মিঃ ভাদুড়ি কোথায় জানো?” 

“এই তো আমি।” 

চমকে উঠে পিছন ফিরে দেখলুম, ভাদুড়িমশাই প্যালেস থেকে বেরিয়ে আসছেন। কাছে এসে বললেন, “একটা চিৎকার শুনতে পেলুম। কী হয়েছে?” 

দীপক বলল, “ভীষণ ব্যাপার। ভাঞ্জাকে কেউ ইট ছুড়ে মেরেছে!” 

রামুর পাশেই পড়ে রয়েছে একটা আস্ত ইট। সেইটে দেখিয়ে রাজেশ বলল, “ওটা যদি মাথায় লাগ্ত; তা হলে আর দেখতে হত না, মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যেত।” 

মিসেস ঘোষ ছুটে গিয়ে রামুকে জড়িয়ে ধরলেন। 

ভাদুড়ি মশাই বললেন, “কী হলে কী হত, সেটা পরে শুনব। কী হয়েছে, সেটা আগে শুনি। কী হয়েছিল রামু?” 

রামু বলল, “ভিতরে আমার ভাল লাগছিল না; তাই ভাবছিলুম যে, নৌকোয় বসে আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করব। প্যালেস থেকে তাই বেরিয়ে আসি। কিন্তু নৌকোর দিকে কয়েক পা এগিয়েছি কি এগোইনি, এমন সময় উপর থেকে হঠাৎ ওই ইটটা আমার পাশে এসে পড়ে। আমি হকচকিয়ে যাই। কিন্তু তারপরেই মনে হয়, কেউ নিশ্চয় আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে। তক্ষুনি দু’হাতে মাথা আড়াল করে আমি মাটিতে শুয়ে পড়ে চেঁচিয়ে উঠি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বুদ্ধির কাজ করেছ। উপরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেয়েছিলে?” 

“না।” রামু বলল, “ইটটা এসে আমার পাশে পড়বামাত্র আমি উপরের দিকে তাকিয়েছিলুম। মনে হল, ছাতের কার্নিস থেকে চট করে একটা ছায়া যেন সরে গেল। কিন্তু না, কাউকে দেখতে পাইনি।” 

৯ 

রাত্তিরের খাওয়ার পর্ব মিটেছে। চিংড়িমাছের মালাইকারি ছিল, ম্যানেজার বারবার অনুরোধ করছিলেন আর এক প্লেট করে গলদা চিংড়ি নেবার জন্যে, কিন্তু খাওয়ার দিকে আর কারও বিশেষ মনোযোগ ছিল না। কথাবার্তাও হচ্ছিল খুব কম। বলতে গেলে একরকম নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে আমরা যে যার নিজের ঘরে ফিরে এসেছি। 

বঙ্কুবাবু আদৌ তাঁর ঘর ছেড়ে নীচে নামলেন না। রামুর খবর শুনে তিনি যে উত্তেজিত হবেন, সেটা জানাই ছিল। কিন্তু এতটাই যে বিচলিত হয়ে পড়বেন, তা ভাবিনি। বারবার বলছিলেন, “লক্ষ্মণটা তো গেছেই, এবারে এটাও যাবে!” তখনই শুনলুম যে ভুবনেশ্বরেও নাকি রামুকে নিয়ে ারাত্মক একটা ব্যাপার হয়েছিল। ঘটনাটা এইরকম। সন্ধের সময় রামু তাদের বাড়ির ছাতে পায়চারি করছিল। ছাতের মাঝ বরাবর একদিকে তাদের ওভারহেড জলের ট্যাঙ্ক। পায়চারি করতে-করতে ট্যাঙ্কটা ছাড়িয়ে এক পা এগোনো মাত্র পিছন থেকে কেউ তার গলা টিপে ধরে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু না, সেবারেও সে কাউকে দেখতে পায়নি। এ হল গত অগস্ট মাসের ঘটনা। 

বললুম, “এই ক-মাসের মধ্যে তো আর-কিছু ঘটেনি, তাই না?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা ঘটেনি, তবে ওই ব্যাপারটা ঘটবার পরেই বঙ্কু সতর্ক হয়ে যায়। ভুবনেশ্বর ছেড়ে ওর বাইরে যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদি বা যেত, রামুকে সঙ্গে না নিয়ে যেত না। এই যে কলকাতা হয়ে আগরতলায় এল, এটা আসলে ওর ট্যুরের ব্যাপার। আপনাকে তো বলেইছি, পাওনা টাকা আদায়ের জন্য মাঝেমধ্যে ওকে এইরকম ট্যুরে বেরোতে হয়। কিন্তু লক্ষ করুন, এবারেও ও রামুকে সঙ্গে না নিয়ে আসেনি। রামুকে আর-সকলের সঙ্গে আগরতলায় পাঠিয়ে ওই যে একটা বাড়তি দিন ওকে কলকাতায় থাকতে হল, ওই দিনটা ওর ঘোর দুশ্চিন্তার মধ্যে কেটেছিল। আমাকে পেয়ে যেন বর্তে গেল। বলল, রামুর একটা প্রোটেকশন দরকার, তুমি আমার সঙ্গে চলো ভাই। একে পুরনো বঙ্কু, তায় দু-হাত জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করছে, না এসে কি পারা যায়?” 

বললুম, “তা তো হল, কিন্তু আপনিই বা কতদিন এদের সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরবেন? আপনার আরও হাজারটা কাজ পড়ে রয়েছে, খুব বেশি দিন তো আপনি থাকতে পারবেন না!” 

“তা তো পারবই না। যা বুঝতে পারছি, রামুর জন্যে একটা পার্মানেন্ট ব্যবস্থা করা দরকার। দু’চারদিন দেখি, তার মধ্যে যদি একটা ফয়সালা হয়ে যায় তো ভাল, নয়তো ব্যাঙ্গালোর ফিরে গিয়ে আমাদের ব্যুরো থেকে আর-কাউকে পাঠিয়ে দিতে হবে।…..কিন্তু ও-কথা থাক, এখন এই বিজ্ঞাপনটা একবার দেখুন দেখি।” 

স্যুটকেস খুলে ভাদুড়িমশাই একটা কাগজ বার করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। দিল্লির হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকার একটা পুরনো পৃষ্ঠা, তার একটা জায়গায় একটা বিজ্ঞাপনের চারপাশে ফেল্ট পেন দিয়ে একটা বৃত্ত আঁকা। নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপন। তাতে ইংরেজিতে যা জানানো হয়েছে, তার বাংলা মোটামুটি এই : ‘নিশাকর ঘোষ, ডাকনাম লক্ষ্মণ, বয়স ২২, দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি, ছিপছিপে, শ্যামবর্ণ, লম্বা চুল, ডান কাঁধে ছোট্ট জড়ুল, গত ২০ মে দুপুরবেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর ফেরেনি। সেই সময়ে তার পরনে ছিল বাদামি রঙের ট্রাউজার্স ও নীল ডোরাকাটা সাদা শার্ট। কেউ খোঁজ পেলে নিম্নোক্ত ঠিকানায় জানান। খবর নির্ভুল হলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার…’

বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ফোটোগ্রাফ। ফোটোগ্রাফটাই প্রথম আমার চোখে পড়েছিল, এবং তৎক্ষণাৎ আমি চমকে উঠেছিলুম। ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললুম, “এ তো রামুর ফোটো। শুধু চুলটা একটু অন্যরকম। এর চোখে অবশ্য চশমাও নেই।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না, ও লক্ষ্মণ। ওরই ভাল নাম নিশাকর। দিবাকর অর্থাৎ রামু ওর যমজ ভাই।” 

“যমজ সে তো জানি, তাই বলে এত মিল?” 

“অবাক হয়ে যাচ্ছেন তো?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “গোড়ায় গোড়ায় আমিও অবাক হয়ে যেতুম। এক রকম হাইট, গায়ের রংও একরকম, আর মুখচোখের মিল তো দেখতেই পাচ্ছেন। পরের দিকে অবশ্য দুজনের অমিলটাও ক্রমে-ক্রমে ফুটে উঠতে থাকে। চেহারার নয়, চরিত্রের অমিল। রামু একটু নিরীহ গোবেচারা গোছের, লক্ষ্মণটা ডাকাবুকো। রামু সারাক্ষণ পড়াশুনো নিয়ে থাকে, ছাত্র হিসেবে খুবই ভাল, খেলাধুলোর ধার ধারে না। লক্ষ্মণের উৎসাহ খেলাধুলোয়, বিশেষ করে ক্রিকেটে। পড়াশুনোয় ওর তেমন মন নেই। রামু একটু চাপা স্বভাবের, লক্ষ্মণ খোলামেলা। রামুকে তো দেখছেন, সারাটা দিন আপন মনে থাকে, বই পড়ে। এই যে দীপক আর রাজেশ, ওরা তো ওর সমবয়সী, কিন্তু ওদের সঙ্গেও খুব-একটা মেলামেশা করে না। লক্ষ্মণ এলে কিন্তু এখানকার চেহারাই পালটে যেত, গল্পগুজব আর হই-হল্লায় সবাইকে মাতিয়ে রাখত সারাক্ষণ।” 

“অর্থাৎ দু-ভাইয়ের চরিত্র একেবারেই আলাদা?” 

“একেবারেই আলাদা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “চেহারার ব্যাপারেও পার্থক্যটা ইদানীং স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। রামু চশমা পরে, লক্ষ্মণের চশমা নেওয়ার দরকার হয়নি। অন্তত আমি যখন বছর পাঁচ-সাত আগে ওকে শেষ দেখেছি, তখনও দরকার হয়নি। তা ছাড়া, রামু তো দেখতেই পাচ্ছেন ছোট করে চুল ছাঁটে, লক্ষ্মণ কিন্তু আজকালকার ছেলেদের কায়দায় বেশ লম্বা করে চুল রাখতে আরম্ভ করেছিল। তাতে একটা সুবিধে হয়ে গিয়েছিল এই যে, কে রামু আর কে লক্ষ্মণ চট করে আমি সেটা চিনতে পারতুম।” 

বললুম, “তা তো হল, কিন্তু রামুর উপরে হঠাৎ আবার এইভাবে হামলা শুরু হয়ে গেল কেন?”

“হামলা অনেক কারণেই শুরু হতে পারে, সেটা কোনও প্রশ্ন নয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “প্রশ্ন হচ্ছে, হামলাটা করছে কারা? কে না বলে ‘কারা’ বলছি সকালবেলার ঘটনার জন্যে। ওটা কারও একার কাজ হতে পারে না। ওর জন্যে অন্তত দু’জন লোক চাই।” 

“এ-কথা কেন বলছেন?” 

“কেন বলছি? একটু মাথা খাটালে আর এই প্রশ্নটা আপনি করতেন না। নিজেই ব্যাপারটা বুঝে নিতেন।” 

“অন্য ব্যাপারে মাথা খাটানো যাবে, আপাতত আপনি এটা বুঝিয়ে বলুন। রামু গিয়েছিল দোতলার বাথরুমে। সেখানে বাথরুমের ভিতর থেকে কেউ তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। এ-কাজ তো একজন লোক করতে পারে, দু’জনের কথা ভাবছেন কেন?” 

ভাবছি এইজন্যে যে, এমনিতে রামুর মোটেই উপরের বাথরুমে যাবার কথা নয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু সে উপরের বাথরুমে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কেন বাধ্য হয়েছিল? না বাগান থেকে ঘুরে এসে সে দেখেছিল যে, তার একতলার ঘরের অ্যাটাচড বাথরুমটা ভেতর থেকে বন্ধ। তা সেটা যে-ই বন্ধ করে থাক, সে জানত যে, একতলার অন্য দুটো বাথরুমও তখন খালি নেই, ফলে উপরের বাথরুমে না-গিয়ে রামুর উপায় থাকবে না। তা হলেই বুঝতে পারছেন যে, এ কাজ কারও একার নয়। রামুকে যাতে দোতলায় যেতে হয়, তার জন্য একজন বন্ধ করে রাখবে একতলার বাথরুমের দরজা, আর দ্বিতীয়জন তখন দোতলার বাথরুমে রামুর জন্য অপেক্ষা করবে।” 

বললুম, “তা নাহয় বোঝা গেল, কিন্তু দোতলাতেও তো দু-দুটো বাথরুম রয়েছে। রামু ঢুকতে গিয়েছিল আমার বাথরুমটায়। তার বদলে সে তো আপনার বাথরুমেও ঢুকতে পারত।” 

“তা পারত বই কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু আপনি বোধহয় লক্ষ করেননি যে, আপনার ঘরের লাগোয়া একটা ছাত রয়েছে বলে আপনার বাথরুমটাও অনেক বেশি খোলামেলা, অন্তত তাতে আমারটার তুলনায় আলো অনেক বেশি। সুতরাং এটা হয়তো ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে, দুটো বাথরুমের মধ্যে আপনারটাই রামু বেশি পছন্দ করবে।” 

একটুক্ষণ চুপ রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “কিংবা কে জানে, আমার বাথরুমটায় ঢুকতে গেলেও হয়তো এই একই ব্যাপার হত। অর্থাৎ সেটাতেও হয়ত লোক মোতায়েন ছিল। সেক্ষেত্রে অবশ্য ধরে নিতে হবে যে দুজন নয়, মোট তিনজন এ-ব্যাপারে ইনভলভড। কিন্তু আপাতত ওটাও আমি ভাবছি না।” 

“কী ভাবছেন?” 

“ভাবছি যে, ধাক্কা যদি মারলই তো এত আস্তে মারল কেন? তা হলে কি ধরে নিতে হবে যে, ধাক্কাটা যে মেরেছে, রামুকে সে একেবারে খতম করে দিতে চায়নি? স্রেফ ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিল?” 

“এমনও হতে পারে যে, খতম করতেই চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি।” 

দু-দিকে মাথা নাড়লেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “একবার নয়, দু-বার নয়, তিন-তিনবার হামলা হল রামুর উপরে। একবার ভুবনেশ্বরে ওদের বাড়ির ছাতে, আর আজ দু-বার। তিন-তিনটে অ্যাটেমট, অথচ একটাও সাকসেসফুল হল না। না মশাই, বিশ্বাস করা শক্ত। ও তো আর পেল্লাদ নয়। মার্ডার অ্যাটেম্‌টই যদি হত, তা হলে তাগটা বারবার ফশকাত না, একটা-না-একটা ঠিকই লেগে যেত। আমার ধারণা, ওকে ভয় দেখানো হচ্ছে।” 

“কে ভয় দেখাচ্ছে?” 

“সেটা পরে ভাবা যাবে, এখন নীরমহলের কথাটা ভাবুন। আপনি তখন কোথায় ছিলেন?”

বললুম, “হিরোইনের রোলটা কাকে দেওয়া হবে, তাই নিয়ে আমি তখন মিসেস ঘোষের সঙ্গে কথা বলছিলুম।” 

“চিৎকার শুনেই আপনারা ছুটে আসেন? 

“এক-আধ সেকেন্ড দেরি হয়ে থাকতে পারে। একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিলুন তো। তারপরেই সামনের দিকে ছুটে যাই।” 

“ছুটে আসবার সময় কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন?” 

“দীপক আর রাজেশকে দেখতে পেয়েছিলুম। বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়ে তারা নীচের দিকে কিছু দেখছিল।” 

“তাদের কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন?” 

“ভেবেছিলুম জিজ্ঞেস করব, কিন্তু সময় পাইনি। হঠাৎই সেখান থেকে সিঁড়ির দিকে ছুটে গিয়ে তারা নীচে নামতে থাকে। কী দেখে তারা ছুটল, সেটা বুঝবার জন্য আমি তখন অতক্ষণ তারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে গিয়ে নীচের দিকে তাকাই। দেখি, নীচে মাটির উপরে রামু পড়ে আছে। আমিও সঙ্গে-সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসি।” 

“মিসেস ঘোষ কী করছিলেন?” 

“তিনি আমার পিছন পিছন আসছিলেন।”

“সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় আর কাউকে দেখেছিলেন?” 

“পীতাম্বরকে দেখেছিলুম। দেখলুম, সে আমার ঠিক আগে আগে নামছে। তবে তার আগে পর্যন্ত সে কোথায় ছিল জানি না।” 

“পীতাম্বর আমার কাছাকাছিই ছিল।” একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “চিৎকারটা শুনে ও আর দেরি করেনি, নীচে নামতে থাকে। যা-ই হোক, আপনি যা বললেন, দ্যাট অ্যাবাউট কভারস এভরিওয়ান।” 

“আপনি কোথায় ছিলেন?” 

ভাদুড়িমশাই হাসলেন। বললেন, “ছাতে। তবে নজরটা আকাশের দিকে ছিল না, ওটা সারাক্ষণ মাটির দিকেই রেখেছিলুম।” 

“কাকে সন্দেহ হয়? দীপককে?” 

“না। অন্তত নীরমহলের ব্যাপারটায় না। সিপাহিজলার ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, তা আমার জানা নেই। তবে নীরমহলের ব্যাপারে যেমন দীপক, তেমন রাজেশকেও আমার সন্দেহের বাইরে রাখছি। আর পীতাম্বর যে সারাক্ষণ আমার কাছাকাছিই ছিল তা তো বললুমই।” 

“দীপক আর রাজেশকে আপনি সন্দেহ করছেন না কেন?”

“এইজন্যে করছি না যে, ছাত থেকে আমি ওদের দুজনের উপরেই নজর রেখেছিলুম। না, ওই ইট আর যে-ই ফেলে থাকুক, ওরা ফেলেনি।” 

“কিন্তু ইটটা তো ফেলা হয়েছিল। কে ফেলল? ভূতে?” 

ভাদুড়িমশাই আবার একগাল হাসলেন। তারপর সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে, সেটাকে অ্যাশট্রেতে পিষে ফেলে, গলগল করে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা। না মশাই, পুরনো অনেক রাজবাড়িতে ভূতের উপদ্রব আছে বলে শুনেছি, কিন্তু নীরমহল তো তেমন পুরনো রাজবাড়ি নয়, ভেঙেচুরে গেছে ঠিকই কিন্তু বয়েস এখনও ষাট হয়নি। এ-সব অর্বাচীন বাড়ি ভূতেরা বিশেষ পছন্দ করে না।” 

“তা হলে?” 

“তা হলে আর কী, ওখানে যা ঘটেছে, তা মানুষই ঘটিয়েছে। কিন্তু সে-কথা এবং থাক। মিসেস ঘোষের সঙ্গে সময়টা কী রকম কাটল বলুন।” 

“ওরে বাবা, উনি তো শুধু স্টোরির আউটলাইন লিখেই খুশি নন, হিরোইনের রোলটাও করতে চাইছেন। বলছেন যে, তাতে যেমন ঘরের টাকা ঘরেই থাকবে, তেমনি শ্যুটিংয়ের ডেট নিয়েও ঝামেলা পোহাতে হবে না।” 

“আপনি ডিসকারেজ করেননি তো?” 

অবাক হয়ে বললুম, “আপনিও কি পাগল হলেন নাকি? হিরোইন এক ভিলেজ বেল। সাদা বাংলায় গাঁয়ের এক সুন্দরী বালিকা। বয়েস কত? না মেরেকেটে কুড়ি। তা ওই রোলে ওঁকে মানাবে?” 

“তা একটু বেমানান হবে ঠিকই।” 

“একটু?” আমার চোখ প্রায় কপালে উঠবার জোগাড়। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে ললুম, “ওয়েল, দ্যাট টেকস দি কেক। আপনিই তো বলছিলেন যে, ওঁর বয়েস এখন পঁয়তাল্লিশ।”

“তা হয়তো বলেছি কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। কেউ কুড়িতেই বুড়িয়ে যায়, কেউ ষাটে সটান থাকে।” 

“ও-সব কথা ছাড়ুন, মিসেস ঘোষের এখন মা-মাসির রোলে নামা উচিত, অন্তত এই গল্পের নায়িকার যে বয়েস, তাতে ওঁকে মানাবে না।” 

“এই কথা আপনি ওঁকে বলেছেন?” 

“তা অবশ্য বলিনি।….মানে ঠিক ওইভাবে বলিনি।” 

“ঠিক কী হয়েছিল বলুন তো?” 

“বলছি। গল্পের ঘটনাস্থল নাকি ওয়েস্ট বেঙ্গল। তাই শুনে আমি বললুম, ত্রিপুরার এইসব জায়গাগুলো তা হলে ছবির মধ্যে ঢুকবে কী করে? তাতে উনি বললেন, সিপাহিজলা নীরমহল আর উদয়পুরের ত্রিপুরেশ্বরী দেবীর মন্দিরকে এ-ছবিতে ঢোকাতেই হবে, তার কারণ এই তিন জায়গায় হিরোইনের ভূমিকায় উনি তিন রকমের পোশাক পরবেন। শুনে আমি বলি, হিরোইনের বয়েস তো মাত্র সতেরো আঠারো। তাতে উনি ‘সোলে’ ছবিতে হেমা মালিনীর রোলের কথা তুলে বললেন যে, বয়েসটা কোনও ফ্যাক্টর নয়, ওটা নাকি মেক-আপে ম্যানেজ হয়ে যাবে।” 

ভাদুড়িমশাই হাসছিলেন। বললেন, “বাস বাস, যা বলেছেন ওই যথেষ্ট। সরাসরি ওঁকে ‘মানাবে না’ বলে দেননি তো?” 

“না না, তা কেন বলব? বলা কি যায়? কোনও ভদ্রমহিলাকে কেউ মুখের উপরে ওইভাবে কিছু বলতে পারে? না না, ওভাবে কিছু বলিনি।” 

“বুদ্ধির কাজ করেছেন। আর তা ছাড়া একটা কথা মনে রাখুন। পাঁটা যার, সে-ই ঠিক করবে যে, পাঁটার মাথার দিকে কোপ মারা হবে, না ন্যাজের দিকে। হিন্দিতেও এই রকমের একটা কথা আছে। যাঁর বাদর, সে-ই নাচাবে। এ-ব্যাপারে আর কারও কথা বলবার কোনও এক্তিয়ার নেই।” 

“তার মানে এ ছবিও ফ্লপ।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এর আগে চারটে ছবি ফ্লপ হয়েছে। আর-একটা হলে ক্ষতি নেই। মোট কথা, ‘এমন কিছু করবেন না যাতে ছবি তোলার এই তোড়জোড়টাই বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হলে মিসেস ঘোষের তো কোনও ক্ষতি নেই। উনি আর-একটা প্লট ঠিক করে আর-এক জায়গায় ছবি তুলবার বায়না ধরবেন। বঙ্কু হয়তো তাতে রাজি হবে না, কিন্তু আমাদের কাজটা যে পিছিয়ে যাবে, সেটা তো ঠিক।” 

“আমাদের কাজটা আপাতত কী?” 

“রামুকে কারা ভয় দেখাচ্ছে আর কেনই বা ভয় দেখাচ্ছে, সেটা বোঝা। যদি বুঝতে পারি, তা হলে…।”  

ভাদুড়িমশাই কথাটা শেষ করলেন না। বললুম, “তা হলে কী?” 

“এখন সেটা বলবার সময় আসেনি। তবে যদ্দুর মনে হয়, ‘আই’ম অন দ্য রাইট ট্র্যাক।”

“আমাকে কী করতে হবে?” 

“আপনাকে মাত্র একটাই কাজ করতে হবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মিসেস ঘোষ যা-ই বলুন প্রতিবাদ করবেন না। জাস্ট প্লে অ্যালং।…নিন, অনেক রাত হয়েছে, এবারে ঘুমিয়ে পড়ুন।”