চশমার আড়ালে – ২০

২০

পুবে-দক্ষিণে খোলা হলেও ঘরটায় যে আলো জ্বেলে রাখা হয়ছে, তার কারণ আর কিছুই নয়, পুব আর দক্ষিণ দিকের জানলায় ঝুলছে মোটা কাপড়ের পর্দা। পীতাম্বরও আমার সঙ্গে উপরে উঠে এসেছিল। বলল, “পর্দা সরিয়ে দেব স্যার? বাইরে কিন্তু হাওয়া এখন গরম।” 

বললুম, “এই মার্চ মাসে আর কত গরম হবে? পর্দা সরিয়ে অন্তত দক্ষিণের জানালা দুটো খুলেই দাও।” 

জানালা খুলে দিতেই দক্ষিণের হাওয়া যেন হুহু করে ছুটে এল। পীতাম্বর বলল, “আপনি বিশ্রাম করুন। যদি কিছু দরকার হয়, বিছানা থেকে আপনাকে উঠতে হবে না, খাটের শিয়রে সুইচ লাগানো আছে, ওটা টিপলেই কেউ-না কেউ এসে যাবে।” 

পীতাম্বর চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা কথা মনে হওয়ায় পিছন থেকে তাকে ডেকে বললুম, “সাধারণত এই ঘরটায় কে থাকেন পীতাম্বর?” 

“থাকবার কথা তো ছিল বড়দাদাবাবুর। কিন্তু এত হাওয়া তাঁর পছন্দ নয়। বলেন যে, বাতাস বইলেই খাতাপত্তর উড়ে যায়, তাতে তাঁর পড়াশুনোর ব্যাঘাত হয় বড্ড। প্রথম থেকেই তিনি তাই এই দোতলারই পিছন-দিককার একটা ঘরে থাকেন।” 

“বড়দাদাবাবু খুব পড়াশুনোর ভক্ত বুঝি?” 

“খুব।” পীতাম্বর বলল, “এতগুলো পাশ দিয়েছেন, তবু পড়াশুনোর কামাই নেই। এখনও দিনরাত্তির বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকেন। ছেলেবেলা থেকেই যে চোখ খারাপ, সে তো এইজন্যেই। চশমা ছাড়া এক দন্ড চলে না।” 

কথাটা অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছিল। তাই বললুম, “কিন্তু এ-ঘরে তা হলে থাকেন কে?” 

“আগে ছোটদাদাবাবু থাকতেন, এখন কেউ থাকে না। ওই মানে আপনাদের মতন কেউ যখন আসেন, তখন এ-ঘর খুলে দেওয়া হয়।” 

“বাবু আর গিন্নিমা থাকেন কোথায়?”

“তাঁরা নীচেই থাকেন।”

“এ-বাড়িতে আর কে-কে থাকে?” 

“আর যারা থাকে, তারা সবাই কাজের লোক। তা ধরুন, সব মিলিয়ে কাজের লোকও কম নয়, চোদ্দোজন। ড্রাইভারই তো তিনজন। তা ছাড়া মালি আছে, দরোয়ান আছে, রান্নার ঠাকুর আছে, বেয়ারা আছে, বাবুর্চি আছে, সেইসঙ্গে আমরাও আছি। তবে আমরা কেউই রাত্তিরে এই বড়বাড়িতে থাকি না, গেটের পাশে আমাদের আলাদা ঘর আছে। অনেকে আবার কাছেপিঠে থাকে, এখানকার কাজকর্ম সেরে তারা যে-যার বাড়িতে চলে যায়।” 

পীতাম্বর চলে গেল। জানালার সামনেই লন। তরপরে গেট। গেটের সামনে রাস্তা। রাস্তার ওদিকে কোনও ঘরবাড়ি কি দোকানপাট নেই। ধুধু মাঠ। এখান থেকে সব স্পষ্ট চোখে পড়ে। হুহু করে ঘরে এসে বাতাস ঢুকছিল। পীতাম্বর যা-ই বলুক, এমন-কিছু গরম বাতাস নয়। গরম হবার কথাও নয়। একে তো এখন বসন্ত কাল, তার উপরে পাশেই নদী, বাতাস তা হলে গরম হবে কেন। ঘরের দেওয়ালে একটা এয়ার কন্ডিশনার যন্ত্র বসানো রয়েছে দেখলুম, কিন্তু সুইচ টিপে সেটা চালাবার কোনও দরকার আছে বলে মনে হল না। জানালা খোলা রেখে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লুম। 

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম জানি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ফোন বাজছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম প্রায় ছটা বাজে। ফোন তুলে নিয়ে বললুম, “হ্যালো…” 

“মিঃ ভাদুড়ি?” 

“মিঃ ভাদুড়ি একটু বাইরে গেছেন, ফিরতে রাত হবে। আপনি কে কথা বলছেন?” 

ওদিক থেকে যিনি কথা বলছিলেন, প্রশ্নটার তিনি কোনও জবাব দিলেন না। শুধু বললেন, “ঠিক আছে, রাত দশটার পরে আমি আবার ফোন করব।” 

হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে, বোম্বাই থেকে ফোন আসবার কথা আছে। কোড নাম্বারটা মনে ছিল, তাই আর পকেট ডায়েরি খুলে সেটা দেখে নেবার দরকার হল না। বললুম, “কোড নাম্বার ফাইভ জিরো ডাব্‌ল এইট। কোনও মেসেজ আছে?” 

জবাব এল, “এইটুকু জানিয়ে দেবেন যে, দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি, কিন্তু ওই নামের কাউকে তাঁরা কোচ করেননি। অন্য কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা চলছে। খবর থাকলে জানাব। মেসেজ এন্ডস।” 

লাইন কেটে গেল। বুঝলুম, ওদিক থেকে যিনি কথা বলছিলেন, তিনি রিসিভার নামিয়ে রেখেছেন। 

খাটের মাথায় সুইচটা টিপতেই বাইরে থেকে দরজার পর্দা সরিয়ে যে ভিতরে এসে ঢুকল, সে পীতাম্বর নয়, অল্পবয়সী এক ছোকরা। বললুম, “চা খাব। চায়ে দুধ-চিনি থাকবে না। শুধু হালকা লিকার।” 

লোকটি কোনও কথা বলল না। ঘরে ঢুকে যেমন একবার মাথা নুইয়েছিল, তেমনই আবার মাথা নুইয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে জল দিয়ে আমি আবার ঘরে ফিরে এলুম। চা এল মিনিট পাঁচেক বাদে। খাটের পাশের টিপয়ের উপরে চায়ের ট্রে নামিয়ে রেখে লোকটি বলল, “বড়বাবু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। উপরে আসতে বলব?” 

বললুম, “ওঁকে উপরে আসতে হবে না। বলো যে, আমিই একটু বাদে নীচে নামছি।” 

এখানে এসে অবধি জামাকাপড় পালটানো হয়নি। চা খেয়ে ওয়ার্ডরোবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। পশ্চিমের দেওয়ালে জানালা নেই। দু’দিকে দুটো ওয়ার্ডরোব। মাঝখানের জায়গাটা জুড়ে বিশাল একটা কাচের আলমারি। তাতে বই বোঝাই। এতক্ষণ খেয়াল করিনি, এবারে নজর করে দেখলুম যে, প্রায় সবই খেলার বই। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, কোনও বিষয়েই বইয়ের কিছু কমতি দেখলুম না। উইজডেনের সঙ্কলনগুলোও একটা তাকে দেখলুম পরপর সাজানো রয়েছে। বইগুলোর প্রায় সবই যে খেলাধুলোর বিষয়ে, এইটে দেখে প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলুম। পরক্ষণেই বিস্ময়টা কেটে গেল। মনে পড়ে গেল যে, এ-ঘরে লক্ষ্মণ থাকত। যা খেলা-পাগল ছেলে, তাতে রাজ্যের খেলার বই দিয়ে আলমারি বোঝাই করবে, এটাই তো স্বাভাভিক। 

ওয়ার্ডরোব খুলে জামাকাপড় পালটে নীচে নামতে গিয়ে রামুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কাঁধ থেকে এখনও সেই স্লিং ঝোলানো। এক হাতে একটা বই ধরে সেটা পড়তে-পড়তে অন্যমনস্কভাবে একতলা থেকে দোতলায় উঠে আসছিল, প্রথমটায় আমাকে দেখতে পায়নি। আমিই বললুম, “কী খবর রামু?” 

রামু নিশ্চয় বইখানার মধ্যে একেবারে ডুবে গিয়েছিল। নইলে আমার গলা শুনে অমন চমকে উঠত না। পরক্ষণেই হেসে বলল, “আপনারা যে এসেছেন তা জানি। তবে পীতাম্বর বলল, আপনি বিশ্রাম করছেন। তাই আর বিরক্ত করিনি। চারুকাকা কোথায়?” 

“তিনি একটু ভুবনেশ্বরে গিয়েছেন। ফিরতে রাত হবে।” 

আমার পাশ দিয়ে রামু আবার উপরে উঠতে যাচ্ছিল, বললুম, “একটু দাঁড়াও তো।” 

“কিছু বলবেন?” 

“মাত্র একটা কথাই বলব। সিপাহিজলায় তুমি যে কেন সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলে, এখন সেটা বুঝতে পারছি। বই পড়তে-পড়তে কেউ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করে?”

রামু হাসল। তারপর উপরে উঠে গেল। পীতাম্বর মনে হল ঠিকই বলেছে। বঙ্কুবাবু তো বলতে গেলে চোখেই দেখেন না, এখন পড়তে-পড়তে রামুও না তার চোখের বারোটা বাজায়। বইখানার নাম দেখলুম, ‘মডার্ন মেথডস অব ডাটা প্রসেসিং’। বাবা রে বাবা, সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে-উঠতে ও-সব বই অত মগ্ন হয়ে পড়বার কোনও মানে হয়? 

ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি, বঙ্কুবাবু সেখানে সস্ত্রীক বসে আছেন। মিসেস ঘোষের ভুরুজোড়া আবার যথাস্থানে ফিরে এসেছে। ভদ্রমহিলা একটা ফিল্ম ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। আমাকে দেখে ম্যাগাজিনটা পাশে নামিয়ে রেখে বললেন, “একটা কথা ভাবছি।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “বলো।” 

“কথাটা আমি তোমাকে বলিনি, মিঃ চ্যাটার্জিকে বলছি।” 

“কিরণবাবু এসে গেছেন নাকি?” ভিতরের দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে বঙ্কুবাবু বললেন, “আরে, আসুন, আসুন। একটু ঘুমিয়ে নিতে পেরেছেন তো?” 

বললুম, “একটু কেন, বেশ কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছি।” 

“তা হলে জলখাবার দিতে বলি?” 

“কী যে বলেন! অত বেলায় খেয়েছি, তারপরে আর এখন কিছু খাওয়া সম্ভব? না না, এখন আর কুটোটিও দাঁতে কাটতে পারব না। তবে হ্যাঁ, একটু আগেই যদিও চা খেয়েছি, তবু আর এক কাপ হয়তো চলতে পারে।” 

পীতাম্বরকে ডেকে মিসেস ঘোষ চায়ের অর্ডার দিলেন। তারপর বঙ্কুবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার কি আর-কিছু বলার আছে?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “এখন আর-কিছু বলার নেই। আগে উনি চা খান, পরে বরং অন্য বিষয়ে কথা বলা যাবে।” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “তা হলে আমার কথাটা এবারে বলতে পারি, কেমন?” 

“বিলক্ষণ।” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “দেখুন কিরণবাবু, ভুবনেশ্বর ফিরে অবধি একটা কথা ভাবছি। এখানকার পাহাড়ে ওই যে জাপানি বুদ্ধ মন্দির রয়েছে, ওটাকে আমাদের স্টোরির মধ্যে কোনওভাবে ঢোকানো যায় না? মানে… কী জানেন… লিঙ্গরাজ টেম্পল আর জগন্নাথ টেম্পল তো সবাই দেখেছে, কিন্তু ওই বুদ্ধমন্দির অনেকেরই দেখা হয়নি। চমৎকার আর্কিটেকচার, ভিড়ভাট্টা নেই, শুটিংয়েরও তাই খুব সুবিধে, নানান অ্যাংগল থেকে ছবি তোলা যাবে, তাই ভাবছিলুম…” 

বললুম, “এ আর বেশি কথা কী, বলেন তো নীরমহল কি ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দিরের বদলে এখানকার ওই বুদ্ধমন্দিরকেই ঢুকিয়ে দেব।” 

মিসেস ঘোষ আমার কথা শুনে এমন আঁতকে উঠলেন যে, পরক্ষণেই নিজেকে শুধরে নিয়ে বললুম, “অবশ্য বদলাবদলিরই বা দরকার কী, সবই থাক না। দ্য মোর দ্য মেরিয়ার। …না না, ও নিয়ে আপনি ভাববেন না।” 

চা এসে গিয়েছিল। যতক্ষণ এখানে থাকব, ততক্ষণই যে মিসেস ঘোষের পাগলামির সঙ্গে আমাকে পাল্লা দিতে হবে, সেটা বুঝতে পেরে গিয়েছিলুম বলেই প্রায় জিভ পুড়িয়ে চা খেয়ে উঠে পড়লুম আমি। বললুম, “ ও বেলা স্নান করা হয়নি। আপনারা বসুন, আমি বরং স্নানটা সেরে নিই।”

উপরে চলে এলুম। বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছি, হঠাৎ আবার ফোন বেজে উঠল। ফিরে এসে রিসিভার তুলে বললুম, “হ্যালো?” 

“মিঃ ভাদুড়ি কি ফিরেছেন?” 

সেই গলা। বুঝতে পারলুম, বোম্বাই থেকে সেই মানুষটিই আবার কথা বলতে চাইছেন। এবারে আর কোড নাম্বার জানাতে একটুও দেরি হল না। বললুম, “কোড নাম্বার ফাইভ জিরো ডাবল এইট। কোনও মেসেজ আছে? থাকলে আমাকে দিতে পারেন।”

“দিস ইজ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট। মিঃ ভাদুড়ি ফিরবামাত্র তাঁকে মেসেজটা দেবেন। বলবেন যে, উনি যার খোঁজ চান, সে রমাকান্ত আচরেকরের কাছে কোচিং নিত। রেগুলারলি নিত না। ছ-মাস অন্তর অন্তর পনেরো দিনের জন্য বোম্বাইয়ে আসত। আচরেকর তখন তাকে কোচ করতেন। শুনলুম, হি ওয়াজ অ্যান এক্সেপশনালি ব্রাইট ট্রেনি অ্যান্ড ওয়াজ শিওর টু ফাইন্ড ও প্লেস ইন দ্য ইন্ডিয়ান ইলেভেন অ্যাজ অ্যান অলরাউন্ডার। কিন্তু গত মে মাসের গোড়ায় পনেরো দিনের কোচিং নিয়ে সেই যে চলে যায়, তারপরে আর গত ন-মাসের মধ্যে সে আসেনি। ….না, কোনও খবরও দেয়নি। মিঃ আচরেকর তাই নিয়ে খুব আক্ষেপ করছিলেন।….মেসেজ এন্ডস।” 

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, আটটা। আর দেরি করা ঠিক হবে না। চটপট বাথরুমে ঢুকে পড়া দরকার, নইলে আবার নীচতলা থেকে ডাক পড়তে পারে। বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলুম। বাথটাবে ঠাণ্ডাজল আর গরমজল মিশিয়ে নিয়েছি, তাই বড় আরাম লাগছিল। শুকনো তোয়ালে দিয়ে গা মুছে একেবারে পরিপার্টি হয়ে যখন বেরিয়ে এলুম, নটা বাজতে তখন আর বিশেষ বাকি নেই। 

বাথরুম থেকে বেরিয়েই কিন্তু চমকে উঠতে হল। ভাদুড়িমশাই আরামদারায় গা ঢেলে দিয়ে কাগজ পড়ছেন। আমাকে দেখে কাগজখানা সরিয়ে রেখে বললেন, “স্নান করতে এত সময় লাগে আপনার? বাবা রে, আমার তো ভয় হচ্ছিল যে, আপনি বোধহয় বাথরুমের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছেন!” 

বললুম, “সাধারণত এর অর্ধেক সময়ও লাগে না। আজ যে এত সময় লাগল, তার কারণ আর কিছুই নয়, মিসেস ঘোষ। ধৌলি পাহাড়কেও তিনি তাঁর ফিল্মের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু সে-কথা থাক, আপনি মনে হচ্ছে একটু তাড়াতাড়িই ফিরলেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাজ তো কমপ্লিট। তা হলে আর ভুবনেশ্বরে বসে থেকে কী করব?”

“বম্বে থেকে ফোন করেছিল। দুবার। একবার ছটার একটু আগে, একবার আটটা নাগাদ। প্রথম মেসেজটা জরুরি নয়, দ্বিতীয়টা জরুরি।’ 

“বলে ফেলুন।” 

“নিশাকর ঘোষ ছ-মাস অন্তর অন্তর বোম্বাইয়ে গিয়ে মিঃ আচরেকরের কাছে পনেরো দিনের জন্যে ক্রিকেটের কোচিং নিত। কিন্তু…. 

“গত ন-দশ মাসের মধ্যে আর যায়নি। তখন থেকেই সে ভ্যানিশ। কেমন?” 

আমি তো তাজ্জব। বললুম, “ কী করে জানলেন?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “এতে আর জানাজানির কী আছে। সেভেনটি নাইনের জানুয়ারিতে ওই যে একটা দুপুর আমরা কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে কাটাই, সে সম্পর্ক যতটা আপনার মনে আছে, তা আমি আপনাকে লিখে ফেলতে বলেছিলুম। তো আপনার লেখার মধ্যে দেখলুম অন্য নানা ঘটনার সঙ্গে একটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার আপনি উল্লেখ করেছেন। লক্ষ্মণকে দিলীপ বেঙ্গসরকর বলেছিল যে, বোম্বাই গেলে লক্ষ্মণের একটা কোচিংয়ের ব্যবস্থা সে করে দেবে। তো সেই কথাটা যে লক্ষ্মণের মনে থাকবে, আর বছর-কয়েক বাদেই সে যে বোম্বাই গিয়ে কোচিং নিতে শুরু করবে, এ তো খুবই স্বাভাবিক।” 

“কিন্তু কোচিং নিতে-নিতে সে নিখোঁজ হল কেন?” 

“আপনার ওই লেখার মধ্যে কিন্তু এরও একটা উত্তর রয়েছে। ঠিক উত্তর নয়, বরং বলতে পারেন একটা ভাইটাল ক্লু, যা কিনা ওর চরিত্রকে মোটামুটি চিনিয়ে দেয়। আর সেটা যদি চিনতে পারেন, উত্তরটা আন্দাজ করাও তা হলে খুব শক্ত হয় না।” 

“একটু বুঝিয়ে বলবেন?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বুঝতে পারছেন না? শুনুন তা হলে। সেই টেস্ট ম্যাচের ফোর্থ ডে-র শেষের দিকে এমন একটা সময় এসেছিল, ডাবল সেঞ্চুরি করতে গাভাসকরের যখন আর মাত্র আঠারো রান বাকি, অথচ তখনই যদি ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেওয়া হয়, ইন্ডিয়ার তা হলে জিতে যাবার একটা সম্ভাবনা থাকে। তো লক্ষ্মণ তখন আপনাকে যা বলেছিল, সে তো আপনি নিজেই লিখে রেখেছেন। ও বলেছিল, গাভাসকর আর বেঙ্গসরকর, দুজনেই টিম-ম্যান, দলের স্বার্থেই ইনিংসটা ওরা ডিক্লেয়ার করে দেবে।” 

“তা বলেছিল বটে, কিন্তু তাতে কী বোঝা গেল?” 

“এইটে বুঝলুম যে, টিম-ম্যানদের যারা শ্রদ্ধা করে, তারা নিজেরাও বড় একটা স্বার্থপর হয় না। আমার ধারণা, লক্ষ্মণ ইজ আ টিম-ম্যান হিমসেলফ, হি হেটস টু লেট দ্য টিম ডাউন।” 

ভাদুড়িমশাই খুব মিষ্টি করে হাসলেন। তারপর বললেন, “এবারে বুঝলেন তো?” 

কিছুই বুঝিনি। কিন্তু সেটা বলবার অবকাশ পাওয়া গেল না। পর্দা সরিয়ে পীতাম্বর এসে ঘরে ঢুকল। “খেতে দেওয়া হয়েছে। আপনারা আসুন বাবু।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সাড়ে নটা বাজে। চলুন, আর দেরি করা ঠিক হবে না।” 

আমরা নীচে নেমে ডাইনিং হলে ঢুলুম। 

খেতে-খেতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোমার অফিসটা কোথায় বঙ্কু?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “আউটহাউসের একতলাটাই তো অফিস। কেন, তোমরা দ্যাখোনি?”

“খেয়াল করিনি।” 

“না-করাই স্বাভাবিক। আজ তো রবিবার। অফিসে যারা কাজ করে, তারা কেউ আসেনি।”

“কজন কাজ করে ওখানে?” 

“ম্যানেজারকে নিয়ে পাঁচজন। ওতেই চলে যায়। কাজ তো আসলে এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। তারা যে-সব চিঠিপত্র লেখে, সেগুলো পড়তে হয়, তার জবাব দিতে হয়। তা ছাড়াও কিছু কাজ আছে অবশ্য। সেগুলো ওরা হ্যান্ডল করে না, তার জন্যে একজন সেক্রেটারি রয়েছে। ….তা তোমার কাজ কেমন চলছে? ভুবনেশ্বরে যেজন্যে গিয়েছিলে, সেটা হল?” 

“শুধু ভুবনেশ্বরে কেন, কটকেও গিয়েছিলুম।’ 

“কটকে কোথায়?” 

“র‍্যাভেনশ কলেজের এক অধ্যাপকের বাড়িতে। লক্ষ্মণ তো ওখানেই বি.এ. পড়ত তাই না?”

“হ্যাঁ।” বঙ্কুবাবু বললেন, “ওখানে গিয়ে হদিশ পেলে কিছুর?” 

“অধ্যাপক-ভদ্রলোকের কাছে পাইনি। তবে লক্ষ্মণের সঙ্গে কাদের বঙ্কুত্ব ছিল, ভদ্রলোকের কাছে সেটা জেনে নিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করেছিলুম। তো তাদের কাছে কিছু হদিশ পাওয়া গেল। এই যেমন কটকের কোন রেস্তোরাঁয় লক্ষ্মণ আড্ডা দিত, কি ধরো ভুবনেশ্বরের কোন সেলুনে সে চুল কাটত, এই ধরনের টুকিটাকি কিছু খবর।” 

খেতে-খেতে রামু একবার মুখ তুলে তাকাল ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে। কিন্তু কিছু বলল না।

মিসেস ঘোষ বললেন, “ফিল্মটার বিষয়ে কিছু ভাবছেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাঃ, ডিরেকশানের দায়িত্ব নিয়েছি, আর ফিল্মের কথাটাই ভাবব না? তাও হয় নাকি? তবে কিনা বঙ্কু তো আমার ছেলেবেলার বঙ্কু তাই তার জীবনে এই যে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে, এটার কথাই বা ভুলে যাই কী করে?” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “ভুলতে কি আমিই পারছি? আমি ওর মা নই, কিন্তু ছেলেবেলা থেকে নিজের হাতে মানুষ করেছি তো। কোথায় যে গেল ছেলেটা।” 

বঙ্কুবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এতগুলো কাগজে বিজ্ঞাপন দিলুম, অথচ কেউ একটা খবর পর্যন্ত দিল না। ও কি আর ফিরবে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেখা যাক।” 

খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমরা উঠে পড়লুম। 

দোতলায় এসে ভাদুড়িমশাইকে বললুম, “আগরতলা থেকে চলে আসবার আগের দিন রাত্তিরে বঙ্কুবাবু আপনাকে একটা অনুরোধ করেছিলেন, মনে আছে তো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “মনে থাকবে না কেন, পার্টনারশিপের দলিলে রামু যাতে সই করতে রাজি হয়, তার জন্যে তাকে বলতে হবে। তা বলব বই কী, নিশ্চয় বলব। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখুন কিরণবাবু। স্বয়ং ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর যদি একসঙ্গে এসে অনুরোধ করেন, তা হলেও রামু ওই দলিলে সই করতে রাজি হবে না। কটকে আর ভুবনেশ্বরে কি আর আমি বেড়াতে গিয়েছিলুম মশাই? যে কাজে গিয়েছিলুম সেটা হয়েছে। আর হ্যাঁ, একটু বাদেই আমরা রামুর ঘরে যাব।” 

ভাদুড়িমশাই হাসতে লাগলেন। 

আমার মনে হল, ব্যাপারটা যেন ক্রমেই আরও জট পাকিয়ে যাচ্ছে। 

২১ 

একবারের বেশি টোকা দিতে হল না, দরজা খুলে রামু বলল, “কী ব্যাপার আঙ্কল?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?” 

“মাত্র তো এগারোটা বাজে, এত তাড়াতাড়ি আমি ঘুমোই না, একটা বই পড়ছিলুম। কিন্তু আপনারা বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, ভিতরে আসুন।” 

ভিতরে ঢুকেই বুঝতে পারলুম যে, দক্ষিণখোলা যে-ঘরে আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে তার তুলনায় এই ঘরটা অনেক ছোট। একটু অগোছালোও বটে। আমাদের ঘরে দু’দুটো রাইটিং টেবিল আর চেয়ার ছাড়াও বসবার জন্য আলাদা একটা সোফা সেট রয়েছে। তার উপরে আর্মচেয়ারও রয়েছে একটা। রামুর ঘরে না আছে সোফা-সেট, না আছে আর্ম চেয়ার। একদিকের দেওয়াল ঘেঁষে একটা খাট, অন্যদিকের দেওয়ালে একটাই ওয়ার্ডরোব। তার পাশে কাচের বুক-কেস। তাতে মোটা মোটা বই ঠাসা। ঘরের মধ্যে ছোট একটা রাইটিং টেবিল আর তার সামনে একটা চেয়ারও রয়েছে, কিন্তু যেমন টেবিল তেমন চেয়ারের উপরেও ডাঁই করে রাখা হয়েছে একগাদা বই আর খাতা। 

ব্যাবসা-বাণিজ্য নিয়ে যে-সব ম্যাগাজিন বেরোয়, খাটের উপরে তারই খান-তিনেক ছড়িয়ে আছে। বসবার অন্য কোনও ব্যবস্থা না থাকায় ম্যাগাজিনগুলোকেই একপাশে সরিয়ে দিয়ে রামু বলল, “আপনারা বরং খাটেই বসুন।……কিন্তু ব্যাপার কী বলুন তো, কোনও কথা ছিল?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ইট’স নো ইউজ বিটিং অ্যাবাউট দ্য বুশ। হাতে আর সময় নেই, কাল ধৌলি এক্সপ্রেসে আমরা কলকাতা ফিরছি।” 

“কালই ফিরবেন? কেন? আরও দু-একটা দিন থেকে যান না। এবারে তো অনেকদিন বাদে এলেন?” 

“পরে আবার আসব। এ-যাত্রায় একটা কাজ নিয়ে এসেছিলুম। সেটা মিটে গেছে। কিন্তু যাবার আগে তোমাকে দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করা দরকার।” 

“কী জিজ্ঞেস করবেন, আমি জানি।” মৃদু হেসে রামু বলল, “পার্টনারশিপের দলিলে আমি কেন সই করছি না, এই তো?” 

এবারে ভাদুড়িমশাইও হাসলেন। তারপর রামুর চোখে চোখ রেখে বললেন, “না না, ও নিয়ে কোনও কথাই আমি বলব না। আই অ্যাম নো ফুল। কেন যে তুমি সই করছ না, তা তো আমি জানিই। তা হলে আর ও নিয়ে কোনও প্রশ্ন করতে যার কেন?”

রামু কি একটু চমকে উঠল? যদি বা চমকে উঠে থাকে, সেটা নেহাতই এক মুহূর্তের জন্য। কেননা, পরক্ষণেই দেখলুম, তার চোখ থেকে সেই মৃদু হাসির আলোটা আদৌ মিলিয়ে যায়নি। একই রকমের শান্ত গলায় সে বলল, “বেশ তো, জানেন যখন, তখন আপনিই বলুন যে, কেন আমি স‍ই করছি না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি তো কিছু বলতে আসিনি। আমি শুনতে এসেছি।” 

“কী শুনবেন?” 

“ভাই কোথায়?” 

রামু এবারে স্পষ্ট করে হাসল, “সে তো পুলিশের জানবার কথা, আমি কী করে জানব?”

“পুলিশ না জানুক, আমি জানি। তুমি জানো, আজ আমি কটকে গিয়েছিলুম। কেন গিয়েছিলুম? না লক্ষ্মণের কলেজের এক অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে। দেখা করে কী লাভ হল? না তাঁর কাছে পাওয়া গেল লক্ষ্মণের কয়েকটি ঘনিষ্ঠ বঙ্কুর ঠিকানা। আর-কিছু শুনতে চাও?” 

“বলুন।” 

“লক্ষ্মণের সেই বঙ্কুদের সঙ্গে আমি দেখা করি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন দেখা করেছিলুম? না কোন্ ব্যাপারে লক্ষ্মণ কোন্ দোকানকে পেট্রনাইজ করে, তাদের কাছে সেটা জেনে নেবার দরকার ছিল। সব রকমের দোকান নিয়ে অবশ্য আমার মাথাব্যথা ছিল না, আমি শুধু জানতে চাইছিলুম একটা বিশেষ ধরনের দোকানের খবর। তো বঙ্কুরা বলল যে, সে-দোকান তো কটকে নয়, ভুবনেশ্বরেই রয়েছে। ফলে তিরিশ মাইল উজিয়ে আমাকে আবার ভুবনেশ্বরেই ফিরতে হল।…..কী হল, কোনও কথা বলছ না যে?” 

রামু বলল, “আমি আর কী বলব?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আর-কিছু না বললেও এটা অন্তত বলতে পারো যে, রবিবারে তো দোকানপাট বন্ধ থাকে, তাই দোকানের খোঁজে আজ রবিবার আমার ভুবনেশ্বরে যাওয়া উচিত হয়নি। কেমন?….কিন্তু না, তা তুমি বলবে না। কেননা তুমি খুব ভাল করেই জানো যে, যে-দোকানের খোঁজে আমি গিয়েছিলুম, অন্য সব দোকান বন্ধ থাকলেও সে-দোকানের কাজ-কারবার রবিবারে বন্ধ থাকে না। বরং ছুটির দিনেই ও-সব দোকানে খদ্দের আরও বেশি জোটে।” 

দোকানের মালিক আপনাকে কিছু বলেছে?” 

“প্রথমে বলতে চায়নি,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু কতক্ষণ আর চুপ করে থাকবে বলো। কড়কড়ে একখানা একশো টাকার নোট যখন তার হাতের মধ্যে গুঁজে দিলুম, গড়গড় করে সবই তখন বলে ফেলল।” 

রামুর দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলুম। মনে হল, নিমেষে তার মুখ থেকে যেন সমস্ত রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে। স্খলিত গলায় সে বলল, “বাবাকে আপনি বলেছেন?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “খেপেছ? তোমার বাবা আমার বঙ্কু। আমি কি তাঁর হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারি? কলিকালের রাম আর লক্ষ্মণের মধ্যে একজনও যে পিতৃ-আজ্ঞা পালনে বিশেষ উৎসাহী নয়, বরং দুজনেই ঘোর পিতৃদ্রোহী, এটা জানলেই তো তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।” 

“আমি তা হলে কী করব?” 

“তোমাকে কিছু করতে হবে না,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যা করবার আমিই করব। তুমি শুধু বলো, নিখোঁজ ভাইটির খোঁজ আমরা কবে পাচ্ছি।” 

রামু বলল, “একেবারে এগজ্যাকট তারিখ কি বলা সম্ভব আঙ্কল?” 

“এগজ্যাকট তারিখ তো আমি জানতে চাইছি না, কিন্তু মাসটা এগজ্যাকট হওয়া চাই।”

“আই থিংক হি উইল সারফেস বাই দ্য এন্ড অব মে।” 

“বাঃ, লক্ষ্মী ছেলে। আজ হল গিয়ে মার্চ মাসের দশ তারিখ। মাঝখানে এপ্রিল, তারপরেই মে এসে যাচ্ছে। চমৎকার। তোমার বাবাকে তা হলে কথাটা জানিয়ে দিই, কেমন?….আরে না না, তোমাকে আর এর মধ্যে টানছি না, আই শ্যাল কিপ ইউ আউট অব ইট।” 

“ঠিক বলছেন তো আঙ্কল?” 

“শতকরা একশো ভাগ ঠিক বলছি।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আর হ্যাঁ, আমরা যখন চলেই যাচ্ছি, তখন কাঁধ থেকে ওই স্লিংটা ঝুলিয়ে রাখবার দরকার কী, ওটা খুলে ফ্যালো। ….চলুন কিরণবাবু, ঘরে যাওয়া যাক, আপনার নিশ্চয় ঘুম পেয়ে গেছে।” 

ঘরে ফিরে বললুম, “ব্যাপার কী বলুন তো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন কিছু বলব না। কাল সকালেও না। দুপুর দেড়টার ট্রেনে তো আমরা কলকাতা ফিরছি। যা বলবার তখন বলব। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।” 

২২ 

আজও সেই ধাক্কা খেয়েই ঘুম ভাঙল। 

চোখ মেলি দেখি খাটের পাশে ভাদুড়িমশাই দাঁড়িয়ে আছেন। বললুম “কটা বাজে?” 

“সাড়ে সাতটা।” 

ধড়মড় করে বিছানার উপরে উঠে বসলুম। গোটা ঘর রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে। বললুম, “আগেই ডেকে দেননি কেন?”

“ডাকতে গিয়ে মায়া হল। ভাবলুম, থাক, কাল থেকেই তো আবার অফিসে যাবে, লোকটা আজ একটু ঘুমিয়ে নিক।……তো আমি চায়ের কথা বলে দিয়েছি।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই পর্দা ঠেলে কালকের সেই লোকটি ঘরে ঢুকল। হাতে চায়ের ট্রে। ট্রেটা খাটের পাশের টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল, “ব্রেকফাস্ট কখন দেব?” 

“এ বাড়িতে সবাই কখন ব্রেকফাস্ট করেন?” 

“আটটায়।” 

“ঠিক আছে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোমাকে আর এ-ঘরে ব্রেকফাস্ট আনতে হবে না। আটটায় আমরা ডাইনিং হলে যাচ্ছি।” 

লোকটি চলে গেল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাড়াতাড়ি চা খেয়ে মুখহাত ধুয়ে নিন তো। ঠিক আটটাতেই আমরা নীচে নামব।” 

চায়ে চুমুক দিয়ে বললুম, “আজ তা হলে একাই মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছিলেন?”

“তাই তো সাধারণত বেরোই। কিন্তু না, সঙ্গে আজ লোক ছিল।” 

“কে? রামু নিশ্চয়?” 

“বাঃ বুদ্ধি বেশ খুলেছে দেখছি। কিন্তু না, এখন আর এ নিয়ে কোনও কথা নয়।” 

চা শেষ করে বাথরুমে ঢুকে পড়লুম। 

নীচে নামলুম ঠিক আটটাতেই। ব্রেকফাস্ট-পর্ব শেষ হবার পর যখন ঘর ফাঁকা হয়ে গেল, তখন বঙ্কুবাবুকে একা পেয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আজ তো সোমবার। তোমার অফিস ঠিক কটায় বসবে?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “অফিস তো সাড়ে দশটায় বসে, তবে আমি একটু আগে ….এই ধরো নটার মধ্যেই কাজে লেগে যাই। কয়েকটা ফোন করি, এজেন্টদের খোঁজখবর নিই। সেক্রেটারি আসে সাড়ে নটা নাগাদ, তাকে কিছু চিঠিপত্র ডিকটেট করতে হয়। এইসব করতে-করতে সাড়ে দশটা বেজে যায়, অন্য লোকজনেরা এসে পড়ে।” 

“এখন তো সাড়ে আটটা বাজে। এখন কী করবে?” 

“খবরের কাগজ পড়ব।….মানে আমি তো চোখে ভাল দেখি না, হেডলাইনগুলো পীতাম্বরই পড়ে শোনায়। পীতাম্বর অবশ্য ইংরিজি জানে না, তাই ওড়িয়া কাগজ পড়ে। তাতে অবশ্য আমার কোনও অসুবিধে হয় না। ওড়িয়া আমি ভালই বুঝি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আজ আর এখন তোমাকে কাগজ পড়তে হবে না। পরে পড়বে।” 

“এখন তা হলে কী করব?” 

“এখন তুমি অফিস ঘরে গিয়ে বসবে। বসে আমাদের সঙ্গে কথা বলবে। চলো। না না, পীতাম্বরকে ডাকবার দরকার নেই, আমরাই তো তোমার সঙ্গে আছি।” 

এ-বাড়িতে ঢুকবার মুখে বাঁ দিকে যে আউটহাউসটা পড়ে, বঙ্কুবাবুর অফিস তারই একতলায়। একটা বড় হলঘরের একদিকে বঙ্কুবাবুর নিজস্ব বসবার ঘর, বাদবাকি অংশ তাঁর স্টাফের জন্য। গোটা অফিসটাই এয়ার কন্ডিশন করা। বঙ্কুবাবুর ঘরের একদিকে তাঁর টেবিল-চেয়ার। অন্য দিকটা সোফা সেট দিয়ে সাজানো। বঙ্কুবাবু তাঁর চেম্বারে গিয়ে বসলেন না। আমাদের মতো তিনিও একটা সোফায় বসে বললেন, “কী ব্যাপার বলো তো চারু।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দুটো সুখবর আছে। কিন্তু দুটোর কোনওটা নিয়েই তোমার কোনও প্রশ্ন করা চলবে না। রাজি?” 

“তোমার কোনও কথাতেই আমি কখনও অরাজি হইনি। কিন্তু ব্যাপারটা কী, তা তো বুঝতে পারছি না।” 

“বোঝার কোনও দরকারও তোমার নেই। উই কেম হিয়ার টু ডেলিভার দ্য গুডস, অ্যান্ড উই আর ডেলিভারিং দেম। ব্যস, মিটে গেল। এখন খবর দুটো বলি। এক নম্বর খবর, তোমার নিখোঁজ ছেলেকে আগামী মে মাসের মধ্যেই তুমি ফিরে পাবে।….না না, একেবারেই উত্তেজিত হওয়া চলবে না। তোমার অবস্থা আমি বুঝতে পারছি, বঙ্কু, কিন্তু ভুলে যেয়ো না যে, তোমার স্বাস্থ্য মোটেই ভাল নয়, হঠাৎ যদি উত্তেজিত হও তো অসুস্থ হয়ে পড়তে পারো। সুতরাং শান্ত হও…শান্ত হও।” 

পকেট থেকে একটা কৌটো বার করে তার থেকে সাদামতন কী একটা ছোট্ট ট্যাবলেট বাঁ হাতের তালুতে ঢেলে নিলেন বঙ্কুবাবু। তারপর বললেন, “পীতাম্বরকে একবার ডাকো তো, ও বোধহয় বাইরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “জল চাই তো? তার জন্যে পীতাম্বরকে ডাকবার দরকার নেই। ওই তো, তোমার টেবিলের উপরেই তো এক বোতল মিনারেল ওয়াটার রয়েছে দেখছি।” 

বোতলের পাশে কাচের গেলাশও ছিল একটা। আমিই উঠে গিয়ে বোতল থেকে গেলাশে জল গড়িয়ে নিয়ে এলুম। বঙ্কুবাবু ট্যাবলেটটা মুখে ফেলে দিয়ে ঢকঢক করে জল খেলেন খানিকটা তারপর মস্ত একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “চারু, তুমি যা বলছ তা সত্যি তো?” 

“সত্যি না-হলে তোমাকে আমি বলতুম না। এখন দ্বিতীয় খবরটা শোনো। এর পরে আর সময় পাব না, আজই দুপুরের ট্রেনে আমরা কলকাতা ফিরে যাচ্ছি।” 

“সে কী!” চমকে উঠে বঙ্কুবাবু বললেন, “আজই তুমি ফিরে যাচ্ছ মানে? রামুর প্রোটেকশানের তা হলে কী হবে?” 

“সেটাই হচ্ছে দ্বিতীয় খবর।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওকে প্রোটেকশান দেবার আর কোনও দরকারই হচ্ছে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, বঙ্কু, হি ইজ কমপ্লিটলি সেফ নাউ, ওর উপর আর হামলা হবার কোনও সম্ভবনা নেই। সুতরাং আমরাও একেবারে ষোলো-আনা নিশ্চিন্ত চিত্তে এবারে যাত্রা করতে পারি।” 

বঙ্কুবাবু একেবারে চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “কিন্তু আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না চারু।” 

ভাদুড়িমশাই তাঁর বঙ্কুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “কোনটা বেশি দরকার, বঙ্কু? বোঝাটা বেশি দরকার, না হারানো-ছেলেকে ফিরে পাওয়াটা বেশি দরকার? বোঝাটা বেশি দরকার, না ছেলের উপরে ক্রমাগত যে হামলা চলছিল, সেটা বন্ধ হওয়া বেশি দরকার? তুমি তোমার হারানো-ছেলেকে ফিরে পাচ্ছ, সেইসঙ্গে আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি যে, যে-ছেলেটা তোমার কাছে রয়েছে, তার উপরেও আর হামলা হবে না। ব্যস, এটাই তো তুমি চাইছিলে। তোমার অত বোঝাবুঝির দরকার কী?”

বঙ্কুবাবুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে ধরা-গলায় তিনি বললেন, “কী করে যে তোমার ঋণ শোধ করব, জানি না….. 

“একটা উপায় আছে।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “হারানো ছেলেটা মে মাসের শেষেই ফিরে আসছে তো, তখন বরং দুই ছেলে আর মিসেস ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে দিন-পনরোর জন্যে ব্যাঙ্গালোরে এসে ছুটি কাটিয়ে যেয়ো। তাতেই তোমার তাবৎ ঋণ শোধ হয়ে যাবে।” 

“যাব। নিশ্চয়ই যাব।” বঙ্কুবাবু বললেন, “চোখে তো বলতে গেলে কিছুই দেখি না, তবু যাব।” ভাদুড়িমশাই বললেন, ও হ্যাঁ, একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি। ভুবনেশ্বরে কাল তোমার ডাক্তারের সঙ্গেও দেখা করেছিলুম। তিনি বললেন, তোমার ছানি পড়েছে, অপারেশন করা দরকার। তা তোমার নাকি অপারেশনের নামে বড্ড ভয়। ছিঃ বঙ্কু, আজকাল তো লেজারের ব্যবস্থা হয়েছে। ওটা কাটিয়ে নাও। যত দেরি করবে, তত ভোগান্তি হবে। একটুও দেরি করো না।……না না, এ নিয়ে আর একটা কথাও শুনতে চাইছি না আমি।” 

ঘর থেকে আমরা বেরিয়ে আসছিলুম, বঙ্কুবাবু বললেন, “দাঁড়াও চারু। আজ আর অফিস করব না। চলো, আমিও তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি।” 

অফিস থেকে নেমে আমরা মূল-বাড়িতে ফিরে এলুম। 

.

বঙ্কুবাবু স্টেশন পর্যন্ত আসতে চেয়েছিলেন। ভাদুড়িমশাই তাঁকে আসতে দেননি। বলেছিলেন, “ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আর হ্যাঁ, হারানো ছেলেটা তো মে মাসেই ফিরে আসছে, পার্টনারশিপের ব্যাপারে তখন যা করবার হয় কোরো, তার আগে আর ও-সব সই-টই নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না।” 

কথা ছিল, বিজু আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রামু বলল, “বিজুদার যাবার দরকার নেই। ভুবনেশ্বরে আমার একটু কাজ আছে, আমিই গিয়ে আঙ্কলদের ছেড়ে দিয়ে আসছি।” 

তো দেড়টা নাগাদ ধৌলি এক্সপ্রেস ভুবনেশ্বর থেকে ছাড়ল। রামু একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বসে ছিল আমাদের সঙ্গে। ট্রেনটা নড়ে উঠতে তবে প্ল্যাটফর্মে নামল সে। আমাদের প্রণাম করে যখন সে দরজার দিকে এগোচ্ছে, ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি কথা রেখেছি। এবারে তুমিও একটা কথা দাও। ভুবনেশ্বরের লিউয়িস রোডের কোন দোকান থেকে আমি আসল খবর পেয়েছি, তা তো তুমি জানোই, তার মালিককে যেন আবার ধমক-টমক দিয়ো না। ….আচ্ছা তা হলে ওই কথাই রইল। ভাল হয়ে থেকো, লক্ষ্মণ।” 

রামু ট্রেন থেকে নেমে যাবার পরে বললুম, “যাচ্চলে, আপনারও তা হলে ভুল হয়? ভাদুড়িমশাই অবাক হয়ে বললেন, “কেন ভুলটা আবার কী করলুম?” 

“রামুকে লক্ষ্মণ বললেন না?” 

“আরে মশাই,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ও কেন রামু হতে যাবে? ওই তো লক্ষ্মণ।”

“অ্যাঁ?” 

“অ্যাঁ নয়, হ্যাঁ।” 

“রামু তা হলে কোথায়?” 

ভাদুড়িমশাই এবারে একেবারে হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসির দমকটা একটু কমতে বললেন, “সেটা আমিও আজ সকাল পর্যন্ত জানতুম না। তো লক্ষ্মণই বলল যে, রামু এখন বিলেতে। অ্যাকাউনটেন্সির একটা শর্ট কোর্স করছে। আর ফিরবে যে মে মাসের শেষ নাগাদ, সে তো কাল রাত্তিরে যেমন আমিও শুনেছি, তেমন আপনিও শুনেছেন।” 

.

উপসংহার 

ভাদুড়িমশাই যা বললেন, শুনে এমন বোকা বনে গিয়েছিলুম যে, অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোনও কথাই বলতে পারিনি। ট্রেন কটক, ছাড়বার পর বললুম, “এবারে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?” 

ভুবনেশ্বর স্টেশন থেকে এক কপি ‘সান টাইম’ কিনেছিলেন ভাদুড়িমশাই। সেটাই পড়ছিলেন এতক্ষণ। আমার প্রশ্ন শুনে কাগজখানাকে ভাঁজ করে সরিয়ে রেখে বললেন, “স্বচ্ছন্দে।” 

“ও যে রামু নয়, এই সন্দেহটা আপনার কখন থেকে হল?” 

“সন্দেহটা প্রথম হয় সিপাহিজলাতে। নীরমহলে সেটা আরও জোর পেয়ে যায়। তখনও কিন্তু ওর আইডেনটিটি নিয়ে কোনও সন্দেহ আমার মনে দেখা দেয়নি।” 

“একটু বুঝিয়ে বলবেন?” 

“বলছি। সিপাহিজলার দোতলার ওই ঘটনাটার কথাই ধরুন। বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে ভিতরে থেকে জোর একটা ধাক্কা খেয়ে ও উলটে পড়ল। কোথায় চোট লেগেছে, জিজ্ঞেস করতে ও কী বলেছিল? না মাথায় চোট লেগেছে। তো মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে আমি বললুম, তাই তো, এই এখানটায় তো বেশ ফুলেও গেছে দেখছি। আসলে কিন্তু ওর মাথার কোনওখানেই কোনও ফোলা-টোলা ছিল না। ফলে, তখনই আমার মনে একটা সন্দেহ দেখা দেয়। এবারে নীরমহলের ঘটনাটায় আসুন। আমি তো ছাতে দাঁড়িয়ে ছিলুম, সেখানে থেকেই নজর রাখছিলুম নীচের দিকে। ফলে, কেউ যদি উপর থেকে ইট ছুড়ে মারত, তো আমি দেখতে পেতুম নিশ্চয়। কিন্তু না, কাউকেই আমি উপর থেকে সেদিন ইট ছুড়তে দেখিনি। তাও ভাবলুম, হয়তো আমারই চোখের দোষ। কিন্তু তখন আবার আর-একটা প্রশ্ন দেখা দিল আমার মনে। যেমন ভুবনেশ্বরে, তেমনি সিপাহিজলায় আর নীরমহলে সত্যিই যদি ওকে মারবার চেষ্টা করা হয়ে থাকে, তবে সেই চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে কেন? ও তো পেল্লাদ নয় যে, আগুনে ফেলে দিলেও ও পুড়বে না, গলায় পাথর বেঁধে সমুদ্রে ছুড়ে দিলেও ভেসেই থাকবে! আপনার সদানন্দবাবু বলেছেন, গুলিই যদি চালাচ্ছে, তো বারবার ফশকে যাচ্ছে কেন? আমারও সেই একই কথা। মারতেই যদি চাইছে, তো গায়ে একটা আঁচড়ও কেন লাগছে না? এর দুটো উত্তর হতে পারে। এক, এটা মারবার চেষ্টা নয়, স্রেফ ভয় দেখাবার চেষ্টা। আর দুই…….”

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করলেন ভাদুড়িমশাই। তারপরেই তার মনে পড়ে গেল যে, এটা এয়ার-কন্ডিশন্ড কামরা। বললেন, “ ওরেব্বাবা, এখানে তো সিগারেট খাওয়া চলবে না।” 

“বাইরে গিয়ে খেয়ে আসুন না।”

“থাক্,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এই বদভ্যাসটা ছেড়েই দেব ভাবছি। …ও হ্যাঁ, কী যেন বলছিলুম?” 

“দু-নম্বর উত্তরটা কী হতে পারে।” 

“সেটা আপনাকে এখনও বলিনি। দু-নম্বর উত্তর হল, এই যে বাড়ির ছাতে গলা টিপে ধরা, বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে উলটে পড়া, উপর থেকে ইট ছুড়ে মারা, এর কোনওটাই সত্যি নয়, সবটাই আসলে ওর সাজানো ব্যাপার। তখন আবার প্রশ্ন দেখা দিল যে, সাজানো ব্যাপারই যদি হবে, তবে এর উদ্দেশ্যটা কী? ও কি এই রকমের একটা ধারণা সৃষ্টি করতে চাইছে যে, ওর জীবন মোটেই নিরাপদ নয়? যে-কোনও সময়ে ওর প্রাণ বিপন্ন হতে পারে? কিন্তু তেমন একটা ধারণাই বা সৃষ্টি করতে চাইবে কেন? তারও তো একটা উদ্দেশ্য থাকা চাই। সেটা কী?” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “দেখুন মশাই, আপনি লক্ষ করেছেন কি না জানি না, কিন্তু ভুবনেশ্বরে, সিপাহিজলায় আর নীরমহলে এই যে তিন-তিনবার ওর উপরে হামলা হবার কথা আমরা শুনলুম, এর মধ্যে কিন্তু একটা কমন ফ্যাক্টর রয়েছে। সেটা কী? না যে-দিনই বঙ্কু ওকে ব্যাবসার দায়িত্ব বুঝে নিতে বলে, কিংবা বলে যে, ঠিক আছে বাবা, আমি আর আপত্তি করছি না, তুমি বিলেতেই যাও বরং, কিন্তু বেশিদিন সেখানে থেকো না, একটা শর্ট টার্ম করে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, ঠিক সেইদিনই ওর উপরে হামলা হয়। তা হলে কি ও ব্যাবসার দায়িত্ব বুঝে নিতে চায় না বলেই কিংবা বিলেতে যেতে অনিচ্ছুক বলেই এইভাবে সব হামলার ব্যাপার সাজিয়ে তুলছে? মানে… ও কি এর মধ্যে দিয়ে ওর বাবার মনটাকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে চায়?” 

বললুম, “ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া মানে?”

“মানে প্রায়োরিটি বলে একটা ব্যাপার আছে না? কোটা বেশি জরুরি? ছেলের হাতে ব্যাবসার দায়িত্ব তুলে দেওয়া কি তাকে বিলেত পাঠানোর চাইতে কি তার প্রাণরক্ষার ব্যবস্থা করাটাই একজন বাবার কাছে বেশি জরুরি ব্যাপার নয়? কিন্তু ছেলেটা যে রামু নয়, লক্ষণ, তা তো আমি তখনও পর্যন্ত জানতুম না। তাই সে-দিক থেকে আবার আর-একটা প্রশ্ন দেখা দিল আমার মনে। ক্রমাগত আমি ভাবতে লাগলুম যে, ব্যাবসার দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে বলেই তো রামু কমার্স নিয়ে পড়েছে। তা ছাড়া ওই বিষয়ে আরও পড়াশুনো করবে বলেই তো সে বিলেত যেতে চেয়েছিল। বাবার সঙ্গে ওর বিরোধও তো স্রেফ এইজন্য যে, বঙ্কু ওকে বিলেতে পাঠাতে তখন রাজি হয়নি। তা হলে?” 

“তা হলে কী?” 

“তা হলে ও ব্যাবসার দায়িত্বই বা বুঝে নিতে চাইছে না কেন, পার্টনারশিপের দলিলপত্রেই বা স‍ই করছে না কেন, আর আজ যখন বঙ্কু নিজেই ওকে বিলেত যেতে বলছে, তখন তাতেই বা ওর আপত্তি কীসের?” 

বললুম, “তাও তো বটে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ রাপের উপরে ছেলের রাগ-অভিমান তো হতেই পারে, কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে যতই ভাবি, ততই আমার মনে হতে থাকে যে, এটা এমন একটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছচ্ছে, যার কোনও ব্যাখ্যাই হয় না। আর তা হয় না বলেই উদয়পুরের সেই মাঝরাত্তিরের ঘটনাটার পরে আমার মনে একেবারে বিদ্যুচ্চমকের মতোই একটা সন্দেহ হঠাৎ উঁকি দিয়ে যায়।” 

“উদয়পুরে তো মাঝরাত্তিরে আমরা ওর ঘরে গিয়েছিলুম।” 

“ তা তো গিয়েছিলুমই। কিন্তু কেন গিয়েছিলুম, তা হয়তো আপনি জানেন না। এবারে সব খুলে বলি শুনুন। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন। আমার ঘুম আসছিল না। তাই ভেবেছিলুম, বাইরে গিয়ে একটু পায়চারি করব। কিন্তু বাইরে গিয়ে মনে হল, দিঘিতে কে যেন সাঁতার কাটছে। তৎক্ষণাৎ ঘরে ফিরে আপনাকে ডেকে তুলি। তার পরের ব্যাপার আপনি জানেন। দুজনে মিলে রামুর ঘরে যাই। রামু তখন ঘরে ছিল না। তা হলে কি দিঘিতে সে-ই সাঁতার কাটছে? কিন্তু তা-ই বা কী করে হয়? রামু তো শুনেছি সাঁতার কাটতেই জানে না। তবে? …অথচ, মজাটা কী জানেন? আমরা যে রামুর ঘরে গিয়েছিলুম, যেমন করেই হোক, দীপক সেটা টের পেয়ে থাকবে। তাই পরদিন সকালে নিজের থেকেই সে বলে বসল যে, আগের রাত্রে সে আর রাজেশ খুব সাঁতার কেটেছে, কিন্তু না, রামু সারাক্ষণ পাড়ে বসে ছিল, জলে নামেনি। এদিকে দীপকের কথা যদি সত্যি হয়, তাদের ঘরে তা হলে ভিজে সুইমিং ট্রাঙ্ক কি নিদেন একটা ভিজে তোয়ালে তো থাকবে। তা কিন্তু ছিল না। অর্থাৎ দীপক আর রাজেশ তা হলে মাঝরাত্তিরে দিঘিতে নামেনি। কে নেমেছিল তা হলে? রামুই নেমেছিল। এ আর কিছুই নয়, স্রেফ প্রসেস অব এলিমিনেশন।” 

“কিন্তু রামু কী করে দিঘিতে নামবে? সে তো সাঁতারই জানে না।”

“সেই হচ্ছে কথা। বঙ্কুর কাছে আমরা শুনেছি যে, রামু সাঁতার কাটতে জানে না। অথচ, যে সেদিন মাঝরাত্তিরে দিঘিতে নেমে সাঁতার কেটেছিল, সে দীপক নয়, সে রাজেশও নয়। সে রামুই। এর থেকে আমরা দুটো সিদ্ধান্ত করতে পারি। এক, রামু সাঁতার কাটতে পারে, কিন্তু তার বাবা অর্থাৎ বঙ্কু সে-কথা জানে না। কিংবা জেনেও বঙ্কু আমাদের উলটো-কথা বলেছে। কিন্তু না মশাই, এ-দুটো সম্ভাবনার কোনওটাই আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। অগত্যা আমাকে অন্য-একটা সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখতে হল। সেটা এই যে, যাকে আমরা সবাই রামু বলে মনে করছি, আসলে সে হয়তো রামু নয়, আর-কেউ। বাস্, ওর আইডেনটিটি নিয়ে এই প্রথম একটা সন্দেহ দেখা দিল আমার মনে। তার উপরে আবার রাত্তিরে ওর ঘরে ঢুকে যা আমরা দেখতে পেয়েছিলুম, সেই কথাটা যখন মনে পড়ল, সন্দেহটা তখন বাড়ল বই কমল না।” 

“ওর ঘরে ঢুকে তো বিশেষ কিছু আমরা দেখতে পাইনি।” 

সে কী মশাই, ওর টেবিলে যে একখানা বই আর একজোড়া চশমা ছিল, তা কি ভুলে গেলেন নাকি?” 

“ও হ্যাঁ, ও দুটো বস্তু ছিল বটে,” অবাক হয়ে আমি বললুম, “কিন্তু তাতে সন্দেহ করার মতো কী পেলেন?” 

“বা রে, ওই চশমাজোড়াই তো সন্দেহজনক। 

“কেন, কেন?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ যার চোখ খারাপ হয়েছে, ও চশমায় তার কাজ চলবার কথা নয়। ওর লেন্স দুটোয় কোনও পাওয়ারই নেই। স্রেফ কাচ।” 

“অর্থাৎ কিনা…” 

“অর্থাৎ কিনা ও যাকে ইমপার্সোনেট করতে চায়, সে হাই-পাওয়ার চশমা পরে। ওরও তাই চশমা পরা দরকার। কিন্তু সেটা পাওয়ারলেস চশমা হওয়া চাই, নইলে ও অসুবিধেয় পড়বে।” 

ব্যাপারটা ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল। আর যতই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল, ততই তাক লেগে যাচ্ছিল আমার। বললুম, “ওরেব্বাবা, এ তো তাজ্জব কাণ্ড!” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা কথা ভুলে যাবেন না, রামু আর লক্ষ্মণ যমজ-ভাই। দেখতেও একেবারে একইরকম। তফাত যে নেই, তা অবশ্য নয়। রামু ছোট করে চুল ছাঁটে, লক্ষ্মণের চুল লম্বা; রামু চশমা পরে, লক্ষ্মণের চশমার দরকার হয় না। তা ও দুটো পার্থক্য তো অনায়াসেই মুছে ফেলা যায়। লক্ষ্মণ যদি ছোট করে চুল ছাঁটে আর পাওয়ারলেস একজোড়া চশমা পরে নেয়, তা হলেই হল, কে রামু কে লক্ষ্মণ, অন্তত চেহারা দেখে সেটা বুঝবার কোনও উপায়ই তখন আর থাকে না।” 

বললুম, “কিন্তু শুধু চেহারা দেখেই কি আমরা মানুষ শনাক্ত করি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এতক্ষণে আপনি একটা প্রশ্নের মতো প্রশ্ন করলেন বটে। বুঝতে পারছি, আপনার বুদ্ধি এখনও পুরোপুরি তালগোল পাকিয়ে যায়নি। …না, শুধু চেহারা দেখে আমরা মানুষ শনাক্ত করি না। তা যদি করতুম, অন্ধকারে তা হলে কাউকে শনাক্ত করা একেবারে অসম্ভব হত। কিন্তু অন্ধকারেও আমরা মানুষ চিনি। স্রেফ গলা শুনে বলে দিই যে, এ হচ্ছে অমুক লোক আর সে হচ্ছে তমুক লোক। …এখন আপনি হয়তো জানতে চাইবেন যে, চেহারার ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু লক্ষ্মণ “তার গলার স্বরটা পর্যন্ত পালটে নিল কীভাবে? উত্তরে আমি বলব, সেটা পালটানো সম্ভব নয় বলেই পারতপক্ষে তার বাবা আর নতুন-মায়ের সামনে সে কথাই বলত না। এক-আধটা যে বলত না, তা নয়, কিন্তু খুবই নিচু গলায় বলত; তাও অধিকাংশ ব্যাপারেই কাজ চালাত স্রেফ ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ দিয়ে। বঙ্কুর ধারণা, বিলেত যেতে দেয়নি বলে ছেলের বড্ড অভিমান, তাই বুঝি সে কথা বলতে চায় না। ধারণাটা অস্বাভাবিকও নয়, কেননা ও যে রামু নয়, লক্ষ্মণ, সেটাই তো তার জানা নেই।” 

একটা কথা ভেবে আমার অবাক লাগছিল। ভাদুড়িমশাইকে সেটা না-জানিয়ে পারলুম না। বললুম, “বঙ্কুবাবুর ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। চোখে ছানি পড়েছে, তাই ও যে রামু নয়, সেটা আর তিনি কী করে ধরবেন? কিন্তু মিসেস ঘোষ? তিনি তো পাঁচ বছর বয়েস থেকে ছেলে দুটোকে মানুষ করেছেন, তিনি কেন এই ইমপার্সোনেশনের ব্যাপারটা ধরতে পারলেন না?” 

“প্রশ্নটা আমার মনেও দেখা দিয়েছিল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ কিন্তু পরে ভেবে দেখলুম, এরও একটা সহজ ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রথম কয়েকটা বছর তিনি ওঁদের দেখাশোনা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ওরা যখন বড় হয়ে উঠল, তখন সম্ভবত শি লস্ট ইন্টারেস্ট ইন দেম। তখন তিনি ফিল্ম নিয়ে ফের মত্ত হয়ে উঠলেন। তখন তাঁর মাথায় ঢুকেছে হিরোইন হবার নেশা। অন্য কোনও দিকেই মন দেবার মতো সময় আর নেই। সত্যি বলতে কী, আগ্রহও নেই।” 

“বিজু কি পীতাম্বর? কিংবা অন্য যারা ও-বাড়িতে কাজ করে? বঙ্কুবাবুর অফিসের লোকজনদের কথা ছেড়ে দিচ্ছি, তারা না হয় মূল-বাড়িতে আসতই না। কিন্তু মালি, দারোয়ান, রাঁধুনি? তারা তো ছিল। নাকি তারাও কেউ কিছু ধরতে পারেনি?”

“হয়তো পারেনি। কিংবা এমনও হতে পারে যে, সবাই না-পারুক, এক-আধজন ঠিকই পেরেছিল। কিন্তু ধরতে পারলেই যে মুখ ফুটে সেটা জানাতে হবে, তা আপনাকে কে বলল? বড়লোকদের বাড়িতে যারা কাজ করে, তাদের সম্পর্কে এই একটা কথা জেনে রাখুন কিরণবাবু, মালিকদের ব্যাপারে পারতপক্ষে তারা মাথা গলায় না। কেন গলায় না জানেন? মাথাটা তার ফলে কাটা যাবার একটা আশঙ্কা থাকে।” 

“কিন্তু দীপক? সে তো নেহাত কাজের লোক নয়। মিসেস ঘোষের ভাই, বঙ্কুবাবুর শালা। খুব তো ‘ভাঞ্জা ভাঞ্জা’ করত, তা এটা যে তার বড় ভাঞ্জা নয়, ছোট-ভাঞ্জা, সেও কি বুঝতে পারেনি?”

“গোড়া থেকেই পেরেছিল কি না, বলতে পারব না। হয়তো পেরেছিল, হয়তো পারেনি। হয়তো বা শেষের দিকেও সে জানতে পারত না, যদি না লক্ষ্মণই তাকে সব খুলে বলত। আবার এমনও হতে পারে যে, প্রথম থেকেই লক্ষ্মণ হ্যাড টেকন দীপক ইনটু হিজ কনফিডেন্স। তবে প্রথম থেকেই জানুক আর শেষের দিকেই জানুক, দীপক এটা জানত ঠিকই। তা নইলে আর উদয়পুরে সে অমন আগ বাড়িয়ে বলবে কেন যে, মাঝরাত্তিরে সে আর রাজেশ দিঘিতে সাঁতার কাটতে নেমেছিল, ভাঞ্জা নামেনি? আসলে লক্ষ্মণই যে সাঁতার কাটতে নেমেছিল, এই ব্যাপারটাকে ঢাকা দিতে চাইছিল সে। তো এই হচ্ছে মজা। বঙ্কু আমাকে ত্রিপুরায় নিয়ে গেল তার ছেলেকে প্রোটেকশান দিতে, আর উদয়পুরের ব্যাপার দেখে আমি বুঝি গেলুম যে, দীপকই সেই ছেলেকে আর-এক রকমের প্রোটেকশান দিচ্ছে। অর্থাৎ ডালমে কুছ কালা হ্যায়।” 

বললুম, “উদয়পুরে দীপকদের ঘরে যে পিস্তলটা দেখেছিলেন, সেটা কার?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বঙ্কুর। নিজে তো চালাতে পারে না, তাই দীপককে রাখতে দিয়েছিল। বলে দিয়েছিল, রামুর উপরে ফের হামলা হলে ওটা কাজে লাগতে পারে। এটা অবশ্য আমার সঙ্গে বঙ্কুর সেই যে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল, তার আগের ব্যাপার।” 

“ইমপার্সোনেশন নিয়ে কথা হচ্ছিল। সেইটে বলুন।” 

“ইমপার্সোনেশন ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেল, যখন বাবার ইচ্ছে সত্ত্বেও বিলেত যেতে রাজি না-হওয়া আর পার্টনারশিপের দলিলে ছেলের সই করতে অসম্মতির একট ব্যাখ্যা খুঁজে পেলুম। চট করে যে খুঁজে পেয়েছিলুম, তা অবশ্য বলব না। বিস্তর ভাবতে হয়েছিল। এত করে বঙ্কু বলছে, তবু কেন ও বিলেত যেতে চায় না? এত করে ও বলছে, তবু কেন পার্টনারশিপের দলিলে ও সই করে না? যত ভাবি, উত্তর মেলে না। শেষে হঠাৎই একসময় মনে হল যে, আসলে সই করতেই ওর আপত্তি। কেন আপত্তি? না এইজন্য আপত্তি যে, আসলে ও রামু নয়। অথচ পার্টনাশিপের দলিলে তো রামুর পরিচয়েই ওকে সই করতে হবে। সেই একই পরিচয়ে সই করতে হবে বিলেত যেতে হলেও। যেমন পাসপোর্টে, তেমন ট্রাভলারস চেকে। কিন্তু সে তো ঘোর জালিয়াতির ব্যাপার। বাস্‌, তখনই আমার সন্দেহ একেবারে চোদ্দো-আনা পাকা হয়ে গেল যে, ও রামু নয়, ও লক্ষ্মণ; যে-কোনও কারণেই হোক রামু সেজে সবাইকে ও ধোঁকা দিতে চাইছে, কিন্তু তাই বলে ও জাল-জোচ্চুরি করতে চায় না, বড়-ভাইকে বঞ্চিত করে সম্পত্তির মালিক হবার ইচ্ছেও ওর নেই। 

“সন্দেহটাকে চোদ্দো-আনা পাকা বলছেন কেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ তখনও দু-আনা বাকি ছিল যে! নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনটা তো দেখেছেন, আইডেনটিফিকেশন মার্কটার কথা আশা করি ভুলে যাননি। দরকার হলে লম্বা-চুল ছেঁটে ছোট করা যায়। কিন্তু মশাই, দরকার হলেই তো একটা জড়ুলকে ঘষে তুলে ফেলা যায় না। তো লক্ষ্মণের ডান কাঁধে একটা জড়ুল রয়েছে। তা, লক্ষ্মণের নিশ্চয় মনে হয়েছিল যে, সে যে রামু নয়, এই রকম একটা চিন্তা আমার মাথায় ঢুকেছে। অমনি সে কী করল? না ফিরতি পথে যেই আমরা সিপাহিজলা থেকে কসবার কালীবাড়ির পথে রওনা হয়েছি, অমনি সে সিঁড়ি থেকে পড়ে যাবার ভান করে বলল যে, তার বাঁ হাতটা মচকে গেছে; আর দীপক তক্ষুনি তার ডান কাঁধ ঢেকে চওড়া ব্যান্ডেজের কাপড় দিয়ে ঝুলিয়ে দিল একটা স্লিং, ওই জঙুলটা যাতে কোনওমতেই আর না আমার নজরে পড়ে। কিন্তু আমার যা বুঝবার, তা আমি ঠিকই বুঝে নিলুম। বাস্, আমি পনরো-আনা নিশ্চিন্ত।” 

“এখনও…..মানে এর পরেও এক-আনা বাকি ছিল?” 

“থাকবে না?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কিরণবাবু, ভুলে যাবেন না যে, ওরা যমজ-ভাই। তখনই যদি ওকে আমি বলতুম যে, তুমি রামু নও, তুমি লক্ষ্মণ, কেননা তোমার ডান কাঁধে একটা জড়ুল রয়েছে, স্লিং দিয়ে তুমি সেটা ঢেকে রেখেছ, আর তার উত্তরে ও যদি আমাকে বলত, আসলে দুই ভাইয়েরই ডান কাঁধে আছে জড়ুল, তা হলে আমার মুখটা কোথায় থাকত? আর তা ছাড়া, অন্য দিক থেকেও ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখুন। হাত মচকাবার ব্যাপারটা যদি মিথ্যে না হত, আর স্লিংটা খুলে ও যদি আমাকে দেখিয়ে দিত যে, না, ওর ডান-কাঁধে কোনও জঙুল নেই, তা হলে? তা হলে কি আমি ঘোর লজ্জায় পড়ে যেতুম না? না মশাই, আমি একেবারে ষোলো-আনা নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলুম। আমার দরকার ছিল একেবারে ফুল-প্রুফ এভিডেন্সের। আর সেইজন্যেই দরকার হল ভুবনেশ্বরে চলে আসবার।” 

“কাল আপনি সেই এভিডেন্সের খোঁজেই বেরিয়েছিলেন। কেমন?” 

“সে তো কাল রাত্তিরেই বললুম। ও তো কটক র‍্যাভেনশ কলেজের ছাত্র। তাই কটকে গিয়ে র‍্যাভেনশ কলেজের এক অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করি। ভদ্রলোক আমার চেনা। লক্ষ্মণকেও চেনেন। তো তাঁরই কাছে পাওয়া গেল লক্ষ্মণের কয়েকজন বঙ্কুর ঠিকানা। তাদের সঙ্গে দেখা করলুম। ভাগ্যিস তাদের কাছে লিউইস রোডের দোকানটার সন্ধান পাওয়া গেল, নইলে গোটা ভুবনেশ্বর শহর জুড়ে আমাকে হাতড়ে বেড়াতে হত।” 

“কীসের দোকান? ড্রাগ-ট্রাগের নয় তো?” 

প্রশ্ন শুনে ভাদুড়িমশাই হো হো করে হাসতে লাগলেন। বললুম, “ অত হাসছেন কেন?” 

“আরে মশাই, উত্তরটা শুনলে আপনিও না হেসে পারবেন না। ড্রাগ কি আর দোকান খুলে কেউ বিক্রি করে? ও-সব নেশার বস্তু চোরাই পথে হাতে-হাতে বিক্রি হয়। ও নো, সে-সব নয় কিরণবাবু, আমি খুঁজছিলুম একটা চুলদাড়ি কাটবার দোকান। ওই যাকে আপনারা সেলুন বলেন আর কি। বাস্, দোকানের খোঁজ পাবার পরে আর ওই এক-আনাও বাকি রইল না। দোকানের মালিকটি অবশ্য অতি ধুরন্ধর বক্তি। প্রথমে তো মুখই খুলতে চায় না। তারপর যেই না তার হাতে একখানা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়েছি, অমনি একেবারে তাজ্জব ব্যাপার। লক্-গেট খুলে দিলে বাঁধের জল কীভাবে বেরিয়ে আসে দেখেছেন তো? একেবারে সেইভাবে তার পেট থেকে হুড়হুড় করে সব কথা বেরিয়ে আসতে লাগল। আমার অবশ্য অত কথা জানবার কোনও দরকার ছিল না। দরকার ছিল মাত্র তিনটি প্রশ্নের উত্তর পাবার। এক, লক্ষ্মণবাবু তার দোকানেই চুল ছাঁটতে আসতেন কি না; দুই, আগে তিনি লম্বা-চুল রাখতেন কি না; তিন, মাস কয়েক আগে হঠাৎ একদিন তিনি লম্বা-চুল ছাঁটিয়ে একেবারে কদমছাঁট করে নেন কি না, আর সেই থেকেই তিনি ছোট করে চুল ছাঁটছেন কি না।” 

“সব প্রশ্নেরই উত্তরে শুনলেন যে, হ্যাঁ, তা-ই বটে?” 

“শুনলুম, এবং ষোলো-আনা নিশ্চিন্ত হয়ে কাল রাত এগারোটায় আপনাকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্মণের ঘরে গিয়ে হাজির হলুম। আসলে কিন্তু ওটা রামুর ঘর। লক্ষ্মণের যেটা ঘর, তাতে আমরা ছিলুম। কিন্তু লক্ষ্মণকে এখন রামু সাজতে হচ্ছে তো, তাই বাধ্য হয়ে রামুর ঘরে থাকতে হচ্ছে।” 

কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। ভাদুড়িমশাই ইতিমধ্যে কামরার বাইরে গিয়েছিলেন সিগারেট খাবার জন্যে। ফিরে এসে তিনি আবার সেই ‘সান টাইম’ খানা খুলে বসেছেন। 

আমার অস্বস্তি কিন্তু কাটছিল না। বললুম, “ একটা প্রশ্ন করতে পারি?” 

কাগজ থেকে চোখ তুলে ভাদুড়িমশাই বললেন, “ স্বচ্ছন্দে।” 

“লক্ষ্মণ যে রামুকে ইমপার্সোনেট করছে, সেটা নাহয় বুঝলুম, কিন্তু তার একটা কারণ থাকা চাই তো। সেই কারণটাই তো বুঝতে পারছি না। সেটা কী?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “খুব সঙ্গত প্রশ্ন। কারণটা আমি কালই আন্দাজ করতে পেরেছিলুম। আজ সকালে লক্ষ্মণ তো সবই খুলে বলেছে, তাতে দেখলুম, ভুল আন্দাজ করিনি। বি.কম. পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাবার পরে রামু বিলেত যেতে চায়। কিন্তু বঙ্কু তাতে রাজি হয় না। এ পর্যন্ত আপনিও জানেন। যা জানেন না, এবারে সেটা শুনুন। বাবা রাজি না-হওয়ায় রামু এতই মুষড়ে পড়ে যে, লক্ষ্মণ তাকে বলে, তুই গোপনে বিলেত চলে যা, এদিকটা আমি ঠিক সামলে নেব। প্ল্যানটা তখনই ঠিক হয়ে যায়। কী প্ল্যান? না বাবা জানবেন যে, লক্ষ্মণই নিরুদ্দেশ হয়েছে। তবে হ্যাঁ, লক্ষ্মণ এটাও রামুকে জানিয়ে দেয় যে, বাবাকে খুব বেশিদিন এভাবে ধোঁকা দেওয়া যাবে না, দেওয়া উচিতও হবে না, তাই একটা শর্ট টার্ম করে তাড়াতাড়ি তাকে দেশে ফিরতে হবে। রামু রাজি হয়। তার পাসপোর্ট তো করাই ছিল, নিজের নামে টাকাও ছিল বেশ কিছু। হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে সে বিদেশে পাড়ি দেয়। কবে যাবে, একমাত্র লক্ষ্মণই তা জানত।” 

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “এ হল গত মে মাসের কথা। লক্ষ্মণ তার কিছুদিন আগে বোম্বাই গিয়েছিল আচরেকবের কাছে কোচিং নিতে। কিন্তু রামু কবে ভুবনেশ্বর ছাড়বে, তা সে জানত তো, তাই ঠিক সেইদিনই সকালবেলায় সে একটা স্যুটকেস হাতে নিয়ে ভুবনেশ্বরের বাড়িতে এসে হাজির হয়। তারপর চটপট খাওয়া-দাওয়া সেরে রামুর ঘরে ঢুকে নিজের সুটকেসটা সেখানে রেখে রামুর সুটকেস হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এই যে সে বাড়িতে এল, আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, এই সময়টার মধ্যে রামুর সঙ্গে তার দেখা হয়নি। কেননা, রামু তখন বাড়িতে ছিল না, সে গিয়েছিল ভুবনেশ্বরে। আসলে সে ভুবনেশ্বর স্টেশনের ওয়েটিং রুমে লক্ষ্মণের জন্যে অপেক্ষা করছিল। লক্ষ্মণ সেখানে রামুর সঙ্গে দেখা করে তার হাতে সুটকেসটা তুলে দেয়। ওই সুটকেসের মধ্যে ছিল রামুরই গোটা দুই স্যুট, কিছু শার্ট, কিছু আন্ডারগারমেন্টস আর টুকিটাকি অন্য-কিছু জিনিস। রামু ধৌলি এক্সপ্রেসে উঠে কলকাতায় চলে আসে, আর পরের দিন কলকাতা থেকে ফ্লাইট নিয়ে বোম্বাই চলে যায়। সেখান থেকে সে লন্ডনের প্লেন ধরে। 

“আর লক্ষ্মণ?” 

“রামু গেল লন্ডনে, আর লক্ষ্মণ একটা সেলুনে ঢুকে তার লম্বা চুল ছাঁটিয়ে ছোট্ট করে ফেলল। পকেট থেকে চশমাটা বার করে পরে নিল। তারপর বাড়িতে ফিরে এল। সবাই ভাবল, রামুই ভুবনেশ্বর থেকে ফিরে এসেছে। সে যে রামু নয়, লক্ষ্মণ, কেউ তা টের পেল না।” 

বললুম, “দুই ভাইয়ে এত ভাব?” 

“শুধু ভাব?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “রামুর জন্য লক্ষ্মণ কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছে, দেখুন। যা ওর নেশা, সেই খেলাধুলোর ধারেকাছেও ওর যাবার উপায় নেই। না ফুটবল, না ক্রিকেট, কিচ্ছু না। এমনকী, রামু যেহেতু সাঁতার কাটতে জানে না, তাই একজন চ্যাম্পিয়ন-সাঁতারু হওয়া সত্ত্বেও লক্ষ্মণকে কী করতে হয়? না সাঁতার কাটবার কথা শুনলেই আঁতকে ওঠার ভান করতে হয়। শুধু ওই একদিনই ও লোভ সামলাতে পারেনি, মাঝরাত্তিরে উদয়পুরের দিঘিতে গিয়ে নেমে পড়েছিল। আহা, বেচারা জানত না যে, আমি সেটা দেখে ফেলব। তার উপর আবার দেখুন, ব্যাবসা-বাণিজ্যে ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, তবু যেহেতু রামু সেজেছে তাই রামুর মতো ওকেও সারাক্ষণ পাতা ওলটাতে হচ্ছে ব্যাবসা-বাণিজ্যের বইয়ের।” 

সেইসঙ্গে আর-একটা কথাও ভাবুন, গত মে মাসের পরে ও আর ক্রিকেটের কোচিংটা পর্যন্ত নিতে পারেনি। অথচ বোম্বাই থেকে আপনাকে যিনি ফোন করেছিলেন, তাঁর কথা শুনে তো মনে হল, অলরাউন্ডার হিসেবে ইন্ডিয়া ইলেভেনে ওর জায়গা ছিল একেবারে পাকা।” 

ভাদুড়িমশাই বিষণ্ণ হাসলেন। বললেন, “ভাইয়ের জন্য ও যা স্যাক্রিফাইস করল, সত্যি তার তুলনা হয় না। যমজ-ভাইদের যে জন্ম থেকেই পরস্পরের প্রতি একটা প্রবল টান থেকে যায়, সেটা অবশ্য শুনেছি, কিন্তু তাই বলে এতটা প্রবল সেই টান? ওরেব্বাবা, এ তো কল্পনাও করিনি।” 

বললুম, “লক্ষ্মণ-ভাই বলে একটা কথা আছে। এ একেবারে সেই ব্যাপার। ও নামেও লক্ষ্মণ, কাজেও লক্ষ্মণ।” 

লক্ষ্মণের কথা যতই ভাবছিলুম, মনটা ততই ভারী হয়ে উঠছিল। সম্ভবত সেটা বুঝতে পেরেছিলেন ভাদুড়িমশাই। বিষণ্ণ ভাবটাকে কাটিয়ে দেবার জন্যে তাই বললেন, “যা-ই হোক, সিপাহিজলায় আপনাকে তো চশমা পরা বাঁদর দেখাতে পারিনি। কিন্তু তার জন্যে আর এখন আক্ষেপ করছি না। চশমা-পরা একটা মানুষ তো অন্তত দেখতে পেলেন। চশমাটা নকল ঠিকই, কিন্তু মানুষটা একেবারে সাচ্চা।” 

বালেশ্বর এসে গিয়েছিল। ভাদুড়িমশাই তাঁর আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন। বললেন, “ যাই, দু-কাপ চায়ের ব্যবস্থা করে আসি।” 

রচনাকাল : ১৩৯৮ 

***