চশমার আড়ালে – ১৫

১৫ 

চিৎকার-চেঁচামেচি সমানে চলেছে। সেটা স্বাভাবিক। কেননা, নানান গেট দিয়ে একে তো পিলপিল করে তখনও লোক ঢুকছে, তার উপরে আবার আগেভাগেই যারা স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়েছিল, তাদেরও সবাই তখনও নিজের-নিজের জায়গা খুঁজে পায়নি। কিন্তু সেই হট্টগোলও হঠাৎ থেমে গেল। দেখলুম, ক্লাব হাউসের যেখানে আমরা বসে আছি, তার পাশের সিঁড়ি দিয়ে ব্যাট হাতে দুজন খেলোয়াড় মাঠের মধ্যে নেমে গিয়ে উইকেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথমজন বেঁটেখাটো, দ্বিতীয়জন অন্তত ছ-ফুট লম্বা। বেশ রোগাও বটে। 

যে-মাঠ মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, পরক্ষণেই তা আবার উত্তাল হয়ে উঠল। ‘গাভাসকর! গাভাসকর!’ 

মনে হল যেন গোটা মাঠ একসঙ্গে চেঁচাচ্ছে। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বড়বাবুকে তো চিনলুম, তা ওঁর সঙ্গের ওই রোগা ঢ্যাঙা ছোকরাটি কে মশাই?” 

আমাকে কিছু বলতে হল না। ভাদুড়িমশাই তাঁর যে বঙ্কুপুত্রটিকে সঙ্গে করে মাঠে এসেছেন, সে একেবারে ঝাঁঝিয়ে উঠল। “ও আঙ্কল, ইউ আর ইমপসিবল! উনি হচ্ছেন দিলীপ বেঙ্গসরকর। দারুণ খেলছেন! এটা নিয়ে সতেরোটা টেস্ট খেললেন, তবে কিনা এখনও পর্যন্ত একটাও সেঞ্চুরি করতে পারেননি।” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সতেরোটা টেস্ট, অথচ সেঞ্চুরি করেনি, তবু বলছিস দারুণ খেলোয়াড়! তোরা বটে বাড়িয়ে বলতে পারিস।” 

ছেলেটি একটুও দমে গেল না। বলল, “এটাতেও না করতে পারেন, তবু বলব, সুনীলের পরে এ-রকম ব্যাটসম্যান আর একজনও আসেননি। তবে আমার কী মনে হয় জানো আঙ্কল, ওঁর ব্যাড প্যাঁচটা কেটে গেছে, এবারে ঠিকই সেঞ্চুরিটা পেয়ে যাবেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “টাচ উড। কাগজ পড়ে তো যা বুঝলুম, গোটা চল্লিশ রানে এগিয়ে আছি, তাও এক উইকেট খুইয়ে।” 

তা ভাদুড়িমশাই কিছু মিথ্যে বলেননি। প্রথম ইনিংসে আমরা করেছিলুম তিনশো, আর ওরা তিনশো সাতাশ, দ্বিতীয় ইনিংসের সূত্রপাতেই গন্ডগোল, অংশুমান গায়কোয়াড় মাত্র পাঁচ রান করেই ক্লার্কের বলে ক্লিন বোল্ড হয়ে যায়। তার পরে অবশ্য আর-কেউ আউট হয়নি। সুনীল চৌত্রিশ রানে নট আউট রয়েছে, দিলীপ সাতাশ রানে। 

এ হল ১৯৭৯ সালের পয়লা জানুয়ারির কথা। সেদিন রাত্তিরেই ভাদুড়িমশাইয়ের ফোন পাই। কী একটা কাজে কলকাতায় এসেছিলেন। বললেন, “খেলাটা বড়ই ইন্টারেস্টিং একটা স্টেজে এসে পৌঁছেছে। দেখতে যাবে নাকি?” 

বললুম, “কী ব্যাপার? আপনার মাথায় আবার ক্রিকেটের ভূত চাপল কবে থেকে?” 

“আমার মাথায় নয়, আমার এক বঙ্কুপুত্রের মাথায়। ব্যাঙ্গালোর থেকেই ব্যাটা আমার সঙ্গ নিয়েছে। বলছে, এই টেস্টটা ওকে দেখাতেই হবে।” 

“টিকিট পেলেন? 

“তা পেয়েছি। ব্যাঙ্গালোর থেকেই লালবাজারের এক পুলিশ-অফিসারকে ফোন করে সব জানিয়ে রেখেছিলুম। তো আজ ফোর্থ ডে’র তিনটে টিকিট তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাবেন নাকি?”

বললুম, “কেন, কৌশিক যাবে না?” 

“ও তো অনেক আগেই টিকিট কেটে রেখেছে। বঙ্কুদের সঙ্গে রোজই যাচ্ছে, কালও যাবে। ওর জন্যে ভাববেন না, আপনি যাবেন তো বলুন।” 

“যদি যাই তো কোথায় মিট করব?” 

“আপনার অফিসে গাড়ি রেখে খানিকটা পথ হেঁটে আসুন। কার্জন পার্কে সুরেন বাঁড়ুজ্যের স্ট্যাচুর কাছে আমি ওয়েট করব। সাড়ে নটায় এলেই হবে।” 

না এলে সত্যি পস্তাতে হত। একে তো গাভাসকরের এইট্টিথ আর বেঙ্গসরকরের মেডেন সেঞ্চুরিটা তা হলে দেখা হত না, তার উপরে আবার সাক্ষী হতে পারতুম না নতুন একটা বিশ্ব রেকর্ডের। একই টেস্টের দু-ইনিংসে সেঞ্চুরি আছে অনেকেরই; কিন্তু একটা নয়, দুটো নয়, তিন-তিনটে টেস্টের দু-ইনিংসেই সেঞ্চুরি একমাত্র সুনীল ছাড়া আর কারও নেই। 

ভাদুড়িমশাইয়ের বঙ্কুপুত্রটি দেখলুম ক্রিকেটের বিশ্বকোষ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের নামজাদা খেলোয়াড়দের অনেকেই এবারে খেলতে আসেনি। যারা এসেছে, তাদের মধ্যে কালীচরণ ছাড়া অন্য দু-একজনের নাম শুনেছি মাত্র, বেশির ভাগকেই চিনি না। অথছ দশ-বারো বছর বয়েসের এই ছেলেটি দেখা গেল প্রত্যেককেই চেনে। যারা বল করছিল, তাদের মধ্যে একজনকে দেখিয়ে বলল, “উনি হচ্ছেন মার্শাল। উঠতি পেসারদের মধ্যে সেরা। কিন্তু লাইন আর লেংথ ঠিক রেখে বল করতে পারছেন না তো, তাই মারও খাচ্ছেন খুব। অথচ ওরই মধ্যে কীভাবে একটা ইয়র্কার দিলেন দেখুন। দিলীপ ব্যাট তোলেননি, তাই বেঁচে গেলেন। নইলে আর দেখতে হত না, ব্যাটের তলা দিয়ে ও বল নির্ঘাত উইকেট ভেঙে দিত।” 

আর-একজনকে দেখিয়ে বলল, “উনি হচ্ছেন হোল্ডার। এককালে খারাপ বল করতেন না, এখন একদম ফুরিয়ে গেছেন। বড্ড লুজ বল দেন। হোল্ডিং আসেননি, তাই ওঁকে আনা হয়েছে; কিন্তু দেখুন, বল যা করছেন, তাতে একটুও ধার নেই। আর তাই, সমানে পিটুনি খাচ্ছেন।” 

পিটুনি অবশ্য একা হোল্ডারই যে খাচ্ছিল, তা নয়। উইকেটের দুই প্রান্ত থেকে সুনীল আর দিলীপ একেবারে পক্ষপাতহীনভাবে সবাইকে পিটিয়ে যাচ্ছিল। প্রথম দিকের খানিকটা সময় ফিল্ডিং ছিল উইকেট-ঘেঁষা, কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই সেই আঁটোসাঁটো ব্যূহ একেবারে তছনছ হয়ে যায়। পরপর কয়েকটা বাউন্ডারি হতেই ফিল্ডিং নিমেষে বাউন্ডারি লাইনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তখন আবার শুরু হয়ে যায় প্রতিটি বলে আলতো করে ব্যাট ছুঁইয়ে সিঙ্গল রান তুলবার পালা। 

তারই মধ্যে একটা চিকি সিঙ্গল নিতে গিয়ে রান-আউট হতে-হতে বেঁচে গেল দিলীপ। ময়দান-এন্ড থেকে বল করা হচ্ছিল তখন। সুনীল নন্-স্ট্রাইকিং ব্যাটসম্যান। দিলীপ দেখলুম স্লিপের ভিতর দিয়ে একটা বল গলিয়ে দিয়েই কয়েক পা এগিয়ে এসেছে। সুনীল কিন্তু ঠিকই দেখে নিয়েছিল যে, বলটা বেশি দূরে যায়নি। তার ধমক খেয়ে দিলীপ তৎক্ষণাৎ ক্রিজে ফিরে যায়। না গেলে যে তাকে রান-আউট হতে হত, তাতে সন্দেহ নেই। 

ভাদুড়িমশাইয়ের বঙ্কুপুত্রটি বলল, “এত চমৎকার ব্যাট করেন, অথচ এইটেই ওঁর মস্ত দোষ। বড্ড ছট্‌ফটিয়া। একটু ঠান্ডা মাথায় খেলতে পারলে অ্যাদ্দিনে ওঁর তিন-চারটে সেঞ্চুরি হয়ে যেত। এটা ওঁর কত নম্বর ইনিংস জানেন?” 

“কত?” 

“থার্টিয়েথ। অর্থাৎ এর আগে ঊনতিরিশবার সেঞ্চুরি করবার সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু একটাও কাজে লাগতে পারেননি। অথচ কত বড় ব্যাটসম্যান!” 

ঠাট্টা করে বললুম, “উনি যত বড় ব্যাটসম্যান, তুমি দেখছি তার চাইতেও বড় ভক্ত!” 

শুনে ফ্যালফ্যাল করে ছেলেটি খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর বলল, “ওহ্ নো, আমি কারও ব্লাইন্ড সাপোর্টার নই। আমি জানি, ওঁরও কয়েকটা দোষ রয়েছে। একটা দোষ উনি কভার-ড্রাইভে খুব-একটা সুবিধে করতে পারেন না। তা আজ তো দেখছি, কভার দিয়েও কয়েকটা বল চমৎকার বাউন্ডারি-লাইনের দিকে পাঠিয়ে দিলেন। তার মানে কী জানেন, চিঠিতে কাজ হয়েছে।” 

“এই নিয়ে তুমি ওঁকে চিঠি লিখেছিলে?” 

“শুধু এই নিয়ে কেন, অনেক কিছু নিয়েই লিখি। উনি উত্তরও দেন। এমনও বলেন যে, আমি যদি বোম্বাই গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করি, তো ক্রিকেটের ব্যাপারে উনি আমার জন্যে কোচিংয়ের ব্যবস্থা করে দেবেন।” 

“যাও না কেন?” 

“বাবা যেতে দেন না যে।” বেজার মুখে ছেলেটি বলল, “যতবার বাবাকে বলি, তিনি কী উত্তর দেন জানেন?” 

“কী?” 

“বলেন যে, বি.এ.টা অন্তত পাশ করে নাও। তারপর যা খুশি কোরো। তা আমি তো এখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, কবে যে বি.এ. পাশ করব, কে জানে!” 

“এখন যদি তোমার ক্লাস সিক্স হয়, বি.এ. পাশ করতে তা হলে তোমার… আর মাত্র নটা বছর লাগবে। কী, হিসেবটা ঠিক হল তো?” 

উত্তরটা আর শোনা হল না, তার আগেই মাঠ জুড়ে একটা তুমুল চিৎকার উঠল। ভাদুড়িমশাই তাঁর বঙ্কুপুত্রটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেঙ্গসরকর নব্বইয়ের ঘরে পৌঁছে গেল। মনে হচ্ছে, তোর কথাই ঠিক, ছেলেটা আজ সেঞ্চুরি না করে ছাড়বে না। দিস টাইম ইট ওন্ট স্লিপ থ্র হিজ ফিঙ্গার্স।” 

সুনীলের সেঞ্চুরি একটু আগেই হয়েছে। এই নিয়ে ওর আঠারোটা টেস্ট-সেঞ্চুরি হল। ইডেনের মাঠে সুনীল এর আগে তেমন সুবিধে করতে পারেনি, কলকাতার দর্শকদের তাই নিয়ে বিস্তর ক্ষোভও ছিল, কিন্তু আজ ওর একেবারে অন্য চেহারা। সম্ভবত মাথায় একটু খাটো বলেই হুকটা সাধারণত মারতে চায় না, তবে কিনা ওটা বাদে আর যত রকমের মার একজন ব্যাটসম্যানের থাকতে পারে, ঝুলি উজার করে সে-সব ও আজ একটার পর একটা দেখিয়ে যাচ্ছে। 

অন্যদিকে দিলীপ দেখলুম ধীরস্থির। পরপর কয়েকটা বল স্রেফ ব্লক করে গেল, মারার কোনও চেষ্টাই করল না। 

বললুম, “এরকম করলে কিন্তু আমি ঘুমিয়ে পড়ব।” 

তা ভাদুড়িমশাইয়ের বঙ্কুপুত্রটি অতি তুখোড় ছেলে। আমার মন্তব্য শুনে হেসে বলল, “আপনাকে জাগিয়ে রাখবার জন্যে উইকেটটা ওদের হাতে তুলে দিয়ে উনি কি হাসতে-হাসতে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন নাকি? উনি এখন প্রতিটি বল দেখে-দেখে খেলবেন। যতক্ষণ না লুজ বল পাচ্ছেন, মারবেন না।” 

আমাদের সামনে যিনি বসে ছিলেন, মুখ ঘুরিয়ে তিনি বললেন, “হি ইজ রাইট। এখন কি আর ধুমধাড়াক্কা পেটাবার সময়? নব্বুই পেরিয়েছে, বুঝতে পারছে যে, বারবার বোলার পালটে একটা সাইকোলজিক্যাল প্রেশার ক্রিয়েট করবার চেষ্টা হচ্ছে ওর উপরে, এখন ওকে দারুণ হুঁশিয়ার থাকতে হবে। নব্বুইয়ের ধাক্কা বড় মারাত্মক ধাক্কা মশাই। পঙ্কজ তো একবার এই ইডেনেই নিরানব্বই করে আউট হয়ে গেল। ওফ, মাত্তর একটা রান, তারই জন্যে সেঞ্চুরিটা করতে পারল না!” 

বঙ্কুপুত্রটি ঝুঁকে পড়ে বলল, “ইউ মিন পঙ্কজ রায়? …মানে ভিনু মাকড়ের সঙ্গে এখনও যাঁর একটা ওয়ার্লড রেকর্ড রয়েছে?” 

“তবে আর বলছি কী! দিব্বি নিরানব্বইয়ে পৌঁছে গেল। আমরা ভাবছি, যাক্, ঘরের ছেলে তা হলে মান রাখল বটে, সেঞ্চুরি না হয়ে যায় না। কিন্তু কোথায় কী, যেই না একটু অন্যমনস্ক হয়েছে, অমনি আউট! আরে বাবা, এ হচ্ছে কনসেনট্রেশনের খেলা। হুম্দো-হুম্দো সব বোলার, কে কখন কী করে বসে, তার তো ঠিক নেই। তাদের উপরে নজর রাখো, গ্রিপটা খেয়াল করো, বলটা ছাড়বার সময় কবজি ঘুরল না আঙুল ঘুরল, সেটা দেখে নাও, বলটাকেও একেবারে শেষ অব্দি দেখতে হবে, তার আগেই যদি ব্যাট তুলেছ তো মরেছ। তো তা-ই হল। মাত্তর একটা রান দরকার ছিল রে ভাই, ওফ্…” 

“এটা কবে হয়েছিল বলব?” 

বলা আর হল না। কবজির মোচড়ে বেঙ্গসরকর ততক্ষণে বাউন্ডারিতে বল পাঠিয়েছে। বোঝা গেল, অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে আবার সে রান তুলবার দিকে মন দিয়েছে। তার দরকারও আছে বই কী। রানের ব্যাপারে ভারতকে এখন চটপট একটা ব্যবধান গড়ে তুলতে হবে, নয়তো এ-খেলা ড্রয়ের দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া মোটেই বিচিত্র নয়। 

সেঞ্চুরিটা এরপর তাড়াতড়িই এসে গেল, আর তারপরেই শুরু হল বেধড়ক পিটুনি। সুনীল সব সময়েই সতর্ক ব্যাটসম্যান, ওপেনারের ধর্ম আসলে সেটাই হওয়া উচিত, পারতপক্ষে সে ঝুঁকি নিয়ে ব্যাট চালায় না। সত্যি বলতে কী, এক বিজয় মর্চেন্ট ছাড়া আর কাউকেই আমি কখনও সুনীলের মতো এত ধীরস্থির ভঙ্গিতে বলের মোকাবিলা করতে দেখিনি। কিন্তু সেই সুনীলও যেন আজ হঠাৎ কেমন পালটে গেছে। মাঝে মাঝই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসছে সে, আর মধ্যপথেই সপাটে ব্যাট চালিয়ে বল পাঠিয়ে দিচ্ছে বাউন্ডারির সীমানায়। বেশ কিছুটা পালটে গেছে দিলীপও। ফলে রানও এখন একেবারে লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠেছে। 

হাততালির শব্দে কানে তালা লাগবার উপক্রম। যেমন হাততালি, তেমন চিৎকার। বাউন্ডারি হলে তো বটেই, খুচরো এক-একটা রান করলেও সবাই গলা ফাটিয়ে ব্যাটসম্যানকে শাবাশ দিচ্ছে। আমার যে বয়েস হয়েছে, এই বয়েসে চেঁচানো যে আমার মোটেই শোভা পায় না, তার উপরে আবার ক্লাব-হাউসে যেখানে জায়গা পেয়েছি, সেখানে বসে চিৎকার করা যে ঘোর অশোভন ব্যাপার, সে-সব কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আমিও একবার গাভাসকরের দুর্দান্ত একটা স্ট্রেট ড্রাইভ দেখে “শাবাশ সানি” বলে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েছিলুম, কিন্তু ‘শাবাশ’ বলে তারপর আর বলা হয় না, ভাদুড়িমশাইয়ের বঙ্কুপুত্রটির দিকে চোখ পড়তে দেখি, ছেলেটা একেবারে কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। 

ঢোক গিলে বললুম, “কী ব্যাপার?” 

“চেঁচাচ্ছেন কেন?”

“বা রে, ওইরকম একটা স্ট্রেট ড্রাইভ দেখলে না- চেঁচিয়ে পারা যায়? বোলারের পাশ দিয়ে মাঠের ঘাস পুড়িয়ে বলটা কীভাবে বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে গেল, দেখলে? ও-বল আটকাতে গেলে হাতে নিশ্চয় ছ্যাঁকা লেগে যেত। তা ছাড়া, রান ওঠাও তো দরকার।” 

“শুধু রান উঠলেই চলবে?” 

“সুনীল একশো আশির ঘরে পৌঁছে গেছে, দিলীপও দেড়শো পেরিয়ে গেল। হাত সেট হয়ে গেছে তো, তাই মনে হচ্ছে, ওরা দুজনেই আজ ডবল সেঞ্চুরি করবে।” 

“তা যদি ওঁরা করেন, ইন্ডিয়াকে তা হলে এ টেস্ট জিততে হচ্ছে না।” 

ওরেব্বাবা, সময় বলেও যে একটা ব্যাপার বয়েছে, সেটা তো এতক্ষণ খেয়ালই করিনি। এ-ছেলের দেখছি সবদিকেই সমান নজর। বললুম, “তা হলে এখন ডিক্লেয়ার করাই ভাল।” 

“নিশ্চয়। আজ ফোর্থ ডে। আর মাত্র একটা দিনের খেলা বাকি। অবশ্য কুড়িটা ম্যান্ডেটারি ওভার পাওয়া যাবে। কিন্তু তার মধ্যেই যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংসটা মুড়িয়ে দিতে হবে, সেটা ভুলে গেলেই তো মুশকিল।”

“তা তো বটেই। তা হলে?” 

ছেলেটি হেসে বলল, “অত ভাবনার কিছু নেই। গাভাসকর আর বেঙ্গসরকর খুব ভালই জানেন যে, এটা শুধু ওঁদের দুজনের খেলা নয়, গোটা দলের খেলা। দুজনেই টিম-ম্যান। দলের জন্যে ওঁরা যতটা করা যায় করেছেন, এখন দলের জন্যেই দানটা ওঁদের ছাড়তে হবে। তা ওঁরা ছেড়েও দেবেন।” 

এ সব কথা যখন হচ্ছিল, চা-বিরতির পরের পর্যায়ের খেলা তখন আধ ঘন্টাটাক গড়িয়ে গেছে। আস্তে আস্তে কমে আসছে দিনের আলো। স্টেডিয়াম হবার আগেও এ মাঠে বিস্তর খেলা দেখেছি। মাঠের চারদিকে তখন মস্ত মস্ত গাছ ছিল। সূর্য একটু পশ্চিমে গড়িয়ে গেলেই মাঠের উপরে তার ছায়া পড়তে শুরু করত। মাথার মধ্যে তার স্মৃতি একটু-একটু নড়াচড়া করতে শুরু করেছিল। মাঝে-মাঝেই মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই আমলের সব মহারথীদের কথা। সি. কে. নাইডু, মুস্তাক আলি, মার্চেন্ট, হাজারে, কাকে খেলতে দেখিনি এই মাঠে? 

একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলুম। ভাদুড়িমশাইয়ের বঙ্কুপুত্রের কথায় আমার চমক ভাঙল। “দেখুন, দেখুন, যা বলেছিলুম, তা-ই হল কি না। ইনংস ডিক্লেয়ার করে দেওয়া হল। খানিক বাদেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ মাঠে নামবে। এই শেষ বেলায় যদি কপিল ঝপাঝপ দুটো উইকেট নিয়ে নেন, তা হলে আর দেখতে হচ্ছে না, খেলাটা একেবারে হাতের মুঠোয় এসে গেল?” 

কিন্তু দুটো কেন, একটা উইকেটও নেওয়া গেল না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেকেন্ড ইনিংস যারা ওপেন করতে নেমেছিল, ছেলেটিই চিনিয়ে দিল তাদের। বাকাস আর মারে। এক উইকেটে তিনশো একষট্টি রান তুলে আমরা যখন আমাদের সেকেন্ড ইনিংস ডিক্লেয়ার করেছিলুম, গাভাসকরের রান তখন একশো বিরাশি, বেঙ্গসরকরের একশো সাতান্ন। দুজনেই নট আউট। কিন্তু বাকাস আর মারে সেই যে মাটি কামড়ে পড়ে রইল, কিছুতেই আর তাদের একজনকেও নড়ানো গেল না। 

খেলা ভাঙতে আমরা মাঠ থেকে আস্তে-আস্তে বেরিয়ে এলুম। ভাদুড়িমশাই বললেন, “চলুন, হাঁটতে-হাঁটতে এসপ্লানেড পর্যন্ত যাওয়া যাক। ওখান থেকে আপনি অফিসে ফিরবেন।” 

“আর আপনারা?” 

“আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে বালিগঞ্জে চলে যাব। কালই আমরা বাঙ্গালোরে ফিরছি। এ যাত্রায় আর আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না।” 

হাঁটতে-হাঁটতে অফিসে ফিরে এলুম। হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে, এতক্ষণ যে বাচ্চা ছেলেটির পাশে বসে খেলা দেখলুম, তার নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করা হয়নি। 

১৬ 

সিপাহিজলা থেকে আগরতলায় যাবার পথে বাঁ-দিকে টার্ন নিয়ে, যে রাস্তা দিয়ে কসবার কালীবাড়ি যেতে হয়, সেই রাস্তা পেরিয়ে কখন যে আবার বড় রাস্তায় ফিরে এসেছি, কিছুই জানি না। বারো বছর আগেকার এক শীতের দিনের স্মৃতির মধ্যেই আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম। গাড়িটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতেই আমার ভাবনার সুতোটাও সেইসঙ্গে ছিঁড়ে গেল। বললুম, “কী ব্যাপার, থেমে গেলেন যে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু চা খাবার ইচ্ছে হল।” 

রাস্তার পাশেই চায়ের দোকান। দোকানের সামনে বটগাছ। বটগাছের তলায় বেঞ্চি পাতা। বেঞ্চিতে বসে দু’ গেলাস চায়ের অর্ডার দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেই উদয়পুর থেকে বলতে গেলে একরকম নন্-স্টপ গাড়িটা দৌড়চ্ছে। এখন ওর একটু বিশ্রাম পাওয়া দরকার।” 

বললুম, “আপনিও তো নন-স্টপ গাড়ি চালাচ্ছেন। এবারে না হয় স্টিয়ারিং হুইলটা আমিই ধরি।”

“মাথা খারাপ?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “একটু বাদেই তো আগরতলার মধ্যে ঢুকব, সেখানকার পথঘাট আপনি কিছুই চেনেন না, ফলে পাশে বসে ক্রমাগত আমাকে বলতে হবে, এবারে ডাইনে ঘুরুন, এবারে বাঁয়ে। তার চেয়ে বরং এতটা যখন চালিয়ে এসেছি, তখন বাকি পথটুকুও আমিই চালাই।” 

বললুম, “অর্থাৎ কিনা সুখের চেয়ে সোয়াস্তি ভাল, এই তো?” 

“তা যা বলেছেন। কিন্তু এতক্ষণ কী ভাবছিলেন বলুন তো? সারাক্ষণ তো দেখলুম চুপ করে বসে রইলেন। কোনও জরুরি কথা?” 

চা দিয়ে গিয়েছিল। আমার গেলাসটার একটা চুমুক দিয়ে বললুম, “কী ভাবছিলুম, আপনি জানেন না? আচ্ছা লোক মশাই আপনি!” 

“আমি আপনাকে বিজ্ঞাপনের ছবিটা খুব ভাল করে দেখতে বলেছিলুম। সেইসঙ্গে বলেছিলুম ইন্ডিয়া ভার্সাস ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটা ক্রিকেট-টেস্টের কথা ভাবতে। খেলাটা বারো বছর আগেকার। হয়েছিল কলকাতায়। ক্লাব হাউসে বসে এই টেস্ট-ম্যাচের ফোর্থ ডে’র খেলাটা আমরা দেখেছিলুম। আপনি, আমি, আর…” 

বাধা দিয়ে বললুম, “থাক্, থাক্, আর বলতে হবে না। আরে মশাই, নাইনটিন সেভেনটি নাইনের সেই দিনটার কথাই তো ভাবছিলুম এতক্ষণ।” 

“কিছু মনে পড়ল? … মানে আমার সঙ্গে যে ছেলেটা ছিল, তার সম্পর্কে?” 

“বিস্তর কথা মনে পড়েছে। বলব?” 

“এখন বলতে হবে না। একটা কাজ করুন। একটু বাদেই তো আমরা হোটেলে পৌঁছে যাচ্ছি। সেখানে পৌঁছে আর সময় নষ্ট করবেন না, ছেলেটা সম্পর্কে যা-যা আপনার মনে পড়েছে, সব একটা কাগজে লিখে ফেলবেন। ঠিক আছে?” 

“ঠিক আছে। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করি।” 

“করুন।” 

“আপনার সঙ্গে ওই যে বাচ্চা ছেলেটি সেদিন ইডেনে গিয়েছিল, তার কথা যতই ভাবছি, ততই আমার চোখ চলে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ছাপা এই ছবিটার দিকে। দুজনের মুখের খুব মিল।” 

“তা হতেই পারে।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আপনার দশ-বারো বছর বয়েসের ছবির সঙ্গে আপনার একুশ-বাইশ বছরের ছবির মিল থাকবে না? পুরোপুরি মিল না থাক, একটা আদল… সেটা তো থাকবেই।” 

চমকে উঠে বললুম, “সে-ই তা হলে…. 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “লক্ষ্মণ। বঙ্কুর ছোট ছেলে। মানে যমজদের মধ্যে যেটা ছোট।” 

“কিন্তু যদ্দুর মনে করতে পারছি, আপনি তো সেদিন বলেছিলেন যে, বাঙ্গালোর থেকে আপনার বঙ্কুপুত্রটি আপনার সঙ্গে কলকাতায় এসেছে। তাই না?” 

“তা-ই তো এসেছিল। আসলে দুই ছেলেকে নিয়ে বঙ্কু গিয়েছিল ব্যাঙ্গালোরে। আমার বাড়িতেই উঠেছিল। তখন হঠাৎ আমার কলকাতায় আসবার দরকার হয়। শুনে লক্ষ্মণ বলল, কলকাতায় টেস্ট-ম্যাচ চলছে, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। তো কী আর করব। ব্যাটাকে নিয়ে আসতে হল। ….কিন্তু না, এখন আর কোনও কথা নয়, ওটা বোধহয় বঙ্কুর গাড়ি আসছে।” 

বলতে-না-বলতে দু’দুটো অ্যাম্বাসাডার গাড়ি আমাদের সামনে এসে ব্রেক কষে পরপর রাস্তার উপরে দাড়িয়ে গেল। প্রথম গাড়িটায় পিছনের সিটে বঙ্কুবাবু আর মিসেস ঘোষ, সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে পীতাম্বর। দ্বিতীয় গাড়িটার পিছনের সিটে দীপক আর রামু, সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে রাজেশ। প্রথম গাড়িটা বিজু চালাচ্ছে, দ্বিতীয় গাড়িটা শঙ্কর। 

কোনও গাড়িরই দরজা খুলবার লক্ষণ দেখা গেল না। আমরা এগিয়ে যেতে সামনের গাড়ির পিছনের সিটের জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে মিসেস ঘোষ বললেন, “আপনারা এখানে?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এই একটু চা খেয়ে নেবার ইচ্ছে হল।” 

মিসেস ঘোষের পাশ থেকে বঙ্কুবাবু বললেন, “তবু ভাল, তোমাদের গাড়িটা এখানে দাঁড়িয়ে আছে শুনে আমি ভাবলুম, কলকব্জা বিগড়ে গিয়ে থাকবে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আরে না না, ও-সব কিছু নয়, তোমরা এগোও, আমরা তোমাদের ফলো করছি।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “আমরাও তো এখানে এক কাপ করে চা খেয়ে নিতে পারি।” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “বলো কী, আবার চা? তা ছাড়া রাস্তার ধারের এ-সব দোকানে চা দেয়, না কীসের পাতা সেদ্ধ করে দেয় কে বলবে। চলো চলো, ঘেমে-নেয়ে তো সবাই একশা হয়ে আছি, এখন আর গাড়ি থামাবার দরকার নেই, একেবারে হোটেলে গিয়ে চা খাব।”

বঙ্কুবাবুর মুখ দেখে বুঝলুম, মিসেস ঘোষের কথায় তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন। একটু রেগে ও গেছেন হয়তো। কিন্তু কিছু বললেন না। 

গাড়ি দুটো চলে গেল। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিছু বুঝলেন?” 

হেসে বললুম, “একটা কথাই বুঝলুম। বৃদ্ধ বয়েসে দারপরিগ্রহ না করাই ভাল।” 

“কিছু দেখলেন?” 

“কী দেখব?” 

“তার মানে দেখেননি। দ্বিতীয় গাড়ির পিছনের সিটে রামুর গলায় একটা স্লিং বাঁধা রয়েছে দেখলুম। যে-দিক থেকে পৈতে গলায় দেওয়া হয়, তার উলটো-দিক থেকে স্লিংটা পরানো। অর্থাৎ কিনা গলার ডান দিকে থেকে। তার মানে বাঁ হাতে কিছু হয়েছে।” 

“তেমন সিরিয়াস কিছু নিশ্চয় নয়। একটা বই পড়ছিল দেখলুম।” 

“বইটা ডান-হাতে ধরা। গাড়িতে বসে যখন কেউ বই পড়ে, তখন বইটা সাধারণত কোলের উপরে না রেখে একটু উঁচু করে ধরতে হয়। গাড়িতে একটু-না-একটু ঝাঁকুনি থাকেই, তা ছাড়া বাতাসে বইয়ের পাতা উড়তে থাকে, সেটা সামলাবার জন্যে বইটাকে দু-হাতে না-ধরে উপায় থাকে না। ও কিন্তু একটা-হাতে বইটা ধরেছিল। ডান হাতে। বাঁ হাতটা জখম হয়েছে কি না, ভাবছি।” 

“ওর উপরে আবার কোনও অ্যাটেম্‌ট হল না তো?” 

“কী জানি।” চিন্তিতভাবে ভাদুড়িমশাই বলেলেন, “হতেও পারে। …কিন্তু আর নয়, চলুন এবারে রওনা হওয়া যাক।” 

চায়ের দাম মিটিয়ে আমরা গাড়িতে গিয়ে উঠলুম। 

গাড়ি স্টার্ট দেবার পরে কিছুক্ষণ কোনও কথা হল না। বুঝতে পারছিলুম, ভাদুড়িমশাই একটু অন্যমনস্ক। কিছু ভাবছেন। হঠাৎ এক সময়ে বললেন, “কেসটা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে, কিরণবাবু।” 

বললুম, “নতুন আবার কী হল? …ও হ্যাঁ, রামুর উপরে সম্ভবত আবার হামলা হয়েছে। কী জানেন, ওকে প্রোটেকশন দেবার জন্যেই তো আপনার এখানে আসা। সিপাহিজলায় ওকে ফেলে রেখে তাই আমাদের চলে আসা উচিত হয়নি। এ-যাত্রায় না হয় কমলাসাগর আর কসবার কালীবাড়ি না-ই দেখতুম। পরেও নিশ্চয় ত্রিপুরায় আসা হবে আবার। এখনকার মতো ব্যাপারটা মলতুবি রাখলেও কিছু ক্ষতি ছিল না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দূর মশাই, আপনার বড্ড ওয়ান-ট্রাক মাইন্ড। আমি রামুর কথা ভাবছি না। খালি অ্যাটেম্‌ট-অ্যাটেম্‌ফ্ট করছেন কেন? হঠাৎ কোথাও বেমক্কা পড়ে গিয়েও হাত ভেঙে থাকতে পারে। তা কি কেউ পড়ে না নাকি?” 

ঢোক গিলে বললুম, “তাও কিছু বিচিত্র নয়। যাই-ই হোক, ঠিক কী যে হয়েছে, হোটেলে না পৌঁছনো পর্যন্ত সেটা বোঝা যাচ্ছে না।” 

“এই এতক্ষণে আপনি একটা বুদ্ধিমানের মতো কথা বললেন। যতক্ষণ না হোটেলে পৌঁছচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত রামুকে নিয়ে ভেবে কোনও লাভ নেই।” 

“তা হলে কার কথা ভাবব?” 

পিছন থেকে একটা বাস ক্রমাগত হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার বাঁ দিকে সরে গিয়ে সেটাকে ‘পাস’ দিলেন ভাদুড়িমশাই, তারপর বললেন, “যে ছেলেটা নিখোঁজ হয়ে গেছে, তার কথাও তো একটু-আধটু ভাবতে হবে। আমি লক্ষ্মণের কথা ভাবছি। ও হ্যাঁ, লক্ষ্মণের সম্পর্কে আপনাকে যা বলেছি, মনে আছে তো?” 

“হ্যাঁ। হোটেলে পৌঁছেই সব লিখে ফেলব। সব কথা অবশ্য আমার মনে নেই।”

যেটুকু মনে আছে, সেটুকু অন্তত লিখে ফেলুন। কিছু বাদ দেবেন না।”

রাস্তার উপরে গাড়িঘোড়া আর মানুষজনের সংখ্যা ইতিমধ্যে বেশ বেড়ে গিয়েছিল। মনে হল, আগরতলার কাছাকাছি এসে পড়েছি। ভাদুড়িমশাইকে সে-কথা বলতে তিনি বললেন, “সামনে একটা নদী পড়বে। শুনে অবাক হবেন না, এখানে যেমন কসবা বলে একটা জায়গা আছে, তেমনি আবার হাওড়া বলে একটা নদী আছে। নদী পেরুলেই আগরতলা শহর।” 

খানিক বাদেই নদীর উপরকার ব্রিজ পেরিয়ে আমরা আগরতলায় ঢুকলুম। নদীর ধারে শ্মশানঘাট। শ্মশান ছাড়িয়ে বাজার। সেই ঘিঞ্জি এলাকাও পার হয়ে আসা গেল। পথ এখন আবার মোটামুটি ফাঁকা। হোটেলের নাম জানাই ছিল। নিশানাটাও বঙ্কুবাবু জানিয়ে দিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশের একটা ওষুধের দোকান থেকে জেনে নিলুম যে, ঠিক কোন রাস্তা ধরে আমাদের এগোতে হবে। 

হোটেলে এসে যখন পৌঁছলুম, তখন সাড়ে ছ’টা বাজে। 

রিসেপশান-কাউন্টারের সামনে প্রশস্ত জায়গাটা বেশ সাজানো-গোছানো। বঙ্কুবাবু সেখানে একটা সোফায় চুপচাপ বসে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে পীতাম্বর। আমাদের ঢুকতে দেখে পীতাম্বর তার মনিবকে বলল, “বাবুরা এসে গেছেন।” শুনে বঙ্কুবাবু তাঁর সোফা থেকে উঠে, সামনের দিকে তাকিয়ে, বললেন, “এসো চারু… আসুন কিরণবাবু।” আমরা যে ইতিমধ্যে তাঁর একবারে পাশে চলে এসেছি, সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “চেক-ইন করা হয়েছে?” 

“অনেকক্ষণ। ওরা যে যার ঘরে রয়েছে। …ও হ্যাঁ, পাঁচটা ঘরই তিনতলায়।”

পীতাম্বর একটা চাবি আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, “আপনাদের ঘরটা বাবুর ঘরের ঠিক পাশে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা বঙ্কু, তুমি আবার নীচে নেমে আসতে গেলে কেন? আবার তো কষ্ট করে উপরে উঠতে হবে।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “না হে, চিন্তা কোরো না, এখানে লিফ্ট রয়েছে।” 

সবাই মিলে লিফটে করে উপরে উঠে এলুম। বঙ্কুবাবু নিজের ঘরে না গিয়ে আমাদের ঘরে এসে ঢুকলেন। তরপর পীতাম্বরকে বললেন, “তুই একটু বাইরে যা, মিনিট পনেরো বাদে আসবি, বাবুদের সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।” 

পীতাম্বর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। 

বঙ্কুবাবু বললেন, “বলো কী বলবে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে-সব কথা তো পনেরো মিনিটে শেষ হবে না, অনেক সময় লাগবে। ওটা বরং রাত্তিরেই খাওয়ার পরে হবে। এখন একটা কথা জিজ্ঞেস করি। রামুর উপরে কি ইতিমধ্যে ফের হামলা হয়েছিল?” 

“না, না হামলা নয়। ছোট্ট একটা অ্যাকসিডেন্ট। কিন্তু তুমি সে-কথা জানলে কী করে?”

“গাড়িতে ওকে দেখলুম তো। মনে হল যেন গলায় একটা স্লিং বাঁধা।”

“আর বোলো না,” বঙ্কুবাবু বললেন, “এখানে আসা অবধি একটা-না-একটা লেগেই আছে। সিপাহিজলায় দুপুরের খাওয়ার খানিক বাদে একটু রেস্ট নেবার জন্যে দোতলায় যাচ্ছিল। তা সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ উঠতে-না-উঠতেই পা হড়কে পড়ে যায়।” 

“তাতে বাঁ-হাতটা জখম হয়েছে?” 

“ওই মানে ঠিক জখম নয়, একটু মচকে গিয়েছে আর কি।” 

“ও তো দেখছি একতলায় থাকে। রেস্ট নেবার জন্যে হঠাৎ দোতলায় উঠতে গেল কেন?”

“কথাটা যে আমি জিজ্ঞেস করিনি, তা নয়,” বঙ্কুবাবু বললেন, “তাতে বলল যে, দোতলাটা অনেক খোলামেলা, হাওয়াও অনেক বেশি। তা সেই হাওয়া খেতে গিয়ে কী কান্ড বাধিয়ে বসল দ্যাখো। আসল ব্যাপারটা কী জানো চারু, সেই যে ওর বিলেত যাওয়ায় বাধা দিয়েছিলুম, তার পর থেকেই ও যেন কেমন হয়ে গেছে। একে তো আমার সঙ্গে কথাই বলতে চায় না, তার উপরে দারুণ একগুঁয়ে। আমি যেটা বলব, তার বিরুদ্ধে ওর যাওয়াই চাই। যেন তাতেই ওর শান্তি।” 

কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ কাটল। তারপর ভাদুড়িমশাই বললেন, “হাতটা যে মচকে গেল, ডাক্তার ডেকেছিলে? …মানে ছড়ে-টড়ে যায়নি তো? তা হলে কিন্তু একটা অ্যান্টি-টিটেনাস সিরাম নিলে ভাল হত।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “আরে না না, ছড়ে-টড়ে যায়নি। আর তা গেলেই বা এখানে এ.টি.এস. ইঞ্জেকশন কে দিত? ধারে কাছে ডাক্তারই নেই। না না, ও-সব কিছু নয়, জাস্ট একটু মচকে গিয়েছে। হাতটা অবশ্য নাড়াতে পারছিল না, খুব ব্যথাও করছিল নাকি। তো ডলির সঙ্গে এক বান্ডিল ব্যান্ডেজের কাপড় ছিল তো, দীপক তাই দিয়ে তক্ষুনি-তক্ষুনি একটা স্লিংয়ের ব্যবস্থা করে দিল।” 

“ব্যথাটা কি এখনও আছে?” 

“কী ব্যাপার বলো তো?” বঙ্কুবাবু বললেন, “হাতটা সামান্য একটু মচকে গেছে বই তো নয়, আমরা তো ছেলেবেলায় স্রেফ চুন-হলুদ লাগিয়ে দিতুম। এখন অবশ্য সাতশো রকমের মলম হয়েছে। তার একটা লাগিয়েও দিয়েছে দীপক। তো তাই নিয়ে তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন?” 

“ব্যস্ত হবার কারণ আছে বলেই হচ্ছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “দ্যাখো বঙ্কু, ব্যথা যখন কমে না, তখন অনেক সময় দেখা যায় যে, একটা হাড় হয়তো ভেঙেছে। কিংবা না-ও যদি ভেঙে থাকে, তাতে চিড় ধরেছে। সত্যিই তেমন কিছু যে হয়েছে, তা কিন্তু আমি বলছি না। শুধু বলছি যে, ওকে একবার জিজ্ঞেস করা দরকার ব্যথাটা কমেছে কি না। যদি কমে গিয়ে থাকে, তো ল্যাঠা চুকে গেল। না কমে থাকলে কিন্তু আমি একটা এক্স-রে করিয়ে নিতে বলব। তা ব্যথাটা কমেছে কি না, এখানে এসে তা কি তুমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলে?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “আমি জিজ্ঞেস করব? আমার সঙ্গে তো ও কথাই বলতে চায় না। ঠিক আছে, ডলিকে দিয়ে বরং জিজ্ঞেস করাচ্ছি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “থাক, কাউকে দিয়ে জিজ্ঞেস করাতে হবে না। খানিক বাদে তো ডাইনিং হলে ওর সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তখন আমিই জিজ্ঞেস করব তখন।” 

“আর কিছু বলবে আমাকে?” 

“এখন নয়। রাত্তিরের খাওয়ার পাট চুকে যাবার পরে তো তুমি ঘন্টা-খানেকের জন্যে আমাদের ঘরে আসছ, তখন কথা হবে। এখন তুমি ঘরে যাও। … কিরণবাবু, পীতাম্বর সম্ভবত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ওকে ডেকে দিন।” 

পীতাম্বর সত্যি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এসে বঙ্কুবাবুকে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিল। দরজা বন্ধ করে ফিরে আসছি, ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু বাদেই খাওয়ার ডাক পড়বে। স্নান করে জামাকাপড় পালটে নিন। আপনি বেরুলে আমি বাথরুমে ঢুকব।” 

খাবার ডাক পড়ল সাড়ে আটটা নাগাদ। আমার একটু মাথা ধরেছিল, তাই ভাবছিলুম যে, রুম সার্ভিস যখন রয়েছে, ফোন করে খাবারটা ঘরে আনিয়ে নেব। ভাদুড়িমশাই বললেন, “আরে না, অত অল্পে কাতর হয়ে পড়বেন না তো, সবাই মিলে যখন একতলায় ডাইনিং হলে যাওয়া হচ্ছে, তখন আপনিও চলুন। আর তা ছাড়া, ঘরে বসে ডিনার খাবেন বলে আপনাকে এখানে আনানো হয়েছে নাকি? চারদিকে নজর রাখতে হবে না?” 

অগত্যা নীচে যেতেই হলে। ডাইনিং হলটা বেশ বড়। জানলার ধারে দুটো টেবিল জোড়া লাগিয়ে আমাদের বসবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলুম, মিসেস ঘোষ সদ্য তখন ওয়েটারকে খাবারের অর্ডার দিতে শুরু করেছেন। আমাদের দেখে বললেন, “এখানে সব রকমের খাবারই পাওয়া যায়। আমরা চাইনিজ নিচ্ছি। আপনারা কী নেবেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দ্য সেম অ্যাজ ইয়োর্স।” 

টেবিলের অন্য দিকে রামু বসে আছে। বাঁ হাতটা স্লিংয়ে ঝোলানো। বললুম, “হাতটা শুনলুম মচকে গেছে। এখন কেমন আছ?” 

রামু মৃদু হাসল। কিছু বলল না। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখনও ব্যথা করছে নাকি?”

রামু এবারেও মুখে কিছু বলল না। দু-দিকে মাথা নাড়ল শুধু। 

বঙ্কুবাবু মাথা-নাড়াটা দেখতে পাননি। উদ্বেগের গলায় বললনে, “কী রে, তোর আলের কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন?” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “দিয়েছে। বলছে, যে, এখন আর ব্যথা নেই।” 

সুপ এসে গিয়েছে। ভাদুড়িমশাই চামচ দিয়ে অল্প-একটু মুখে তুলে মিসেস ঘোষের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ক্র্যাব অ্যান্ড অ্যাসপ্যারাগাস। আমার প্রিয় সুপ। আপনার অবশ্য জানবার কথা নয়।” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “জানব না কেন, আপনার বঙ্কুই বলেছে। এটাও শুনেছি যে, কলেজে পড়বার সময় প্রায়ই নাকি নানকিংয়ে যেতেন আপনারা। সত্যি?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “আমার কি আর তখন নানকিংয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা? চারুই আমাকে ধরে নিয়ে যেত। তা চারুও কেন যেত জানো? স্রেফ ওই ক্র্যাব অ্যান্ড অ্যাসপ্যারাগাস সুপের জন্যে।” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আর-কিছু খাবার মতো পয়সা কি তখন আমারই ছিল? তবে একটা কথা বলব। কলকাতায় তো তখন আরও গোটাকয় চিনে রেস্তোরাঁ ছিল, পরে অবশ্য আরও অনেক হয়েছে, কিন্তু নানকিংয়ের মতন আর একটাও হল না। বঙ্কুর হয়তো মনে থাকতে পারে, পকেট-মানি জমিয়ে-জমিয়ে একদিন একটা ম্যান্ডারিন ফিশও ওখানে খেয়েছিলুম। উঃ, তার স্বাদ যেন এখনও মুখে লেগে আছে।” 

ডাইনিং হলে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্রেফ খাওয়া নিয়েই কথাবার্তা হতে লাগল। অন্য প্রসঙ্গে একটাও কথা হল না। খাওয়া শেষ হতে-হতে সাড়ে নটা। নীচে আর কোনও কাজ ছিল না। আমরা উপরে এসে যে যার ঘরে এসে ঢুকলুম। 

তারপর খানিক বাদে, রাত দশটা নাগাদ, আমাদের দরজায় টোকা পড়ল। 

১৭ 

ঘরের মধ্যে চেয়ার যদিও দুটো, আর্মচেয়ার মাত্র একটাই। ভাদুড়িমশাই এতক্ষণ সেটা দখল করে রেখেছিলেন। বঙ্কুবাবুকে সঙ্গে নিয়ে পীতাম্বর আমাদের ঘরে ঢুকতেই ভাদুড়িমশাই এগিয়ে গিয়ে বঙ্কুবাবুকে নিয়ে এসে সেই আর্মচেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললেন, “এবারে তুমি যেতে পারো, পীতাম্বর। তবে বাইরে দাঁড়িয়ে থেকো না, নিজের ঘরে চলে যাও।” 

পীতাম্বর চলে যাচ্ছিল। ভাদুড়িমশাই তাকে উদ্দেশ করে বললেন, “ও হ্যাঁ, ঘরে গিয়ে কিন্তু ঘুমিয়ে পোড়া না। ঘন্টাখানেক বাদে এসে তোমার বাবুকে আবার তাঁর ঘরে পৌঁছে দিতে হবে।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “দরকার হবে না। পাশের ঘরেই তো থাকি। ও আমি একাই ঠিক চলে যেতে পারব।” 

পীতাম্বর বেরিয়ে গেল। ভাদুড়িমশাই গিয়ে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়ে এলেন। তারপর ফিরে আসতে-আসতে বললেন, “তোমার গিন্নিকে ওই কথাই বলে এসেছ তো?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “হ্যাঁ, বললুম যে, ডিরেকশান আর স্ক্রিপ্‌ট-রাইটিংয়ের পেমেন্ট নিয়ে কথাবার্তাটা চুকিয়ে ফেলা দরকার। তা ছাড়া কিছু আগামও দিয়ে রাখতে হবে। ডলিও আসতে চাইছিল। তাতে বললুম, না না, খুবই ডেলিকেট ব্যাপার তো, তুমি থাকলে ওঁরা অস্বস্তি বোধ করতে পারেন, আমার তাই একা যাওয়াই ভাল। …তো তোমার কী সব জিজ্ঞেস করবার আছে বলছিলে না?”

“হ্যাঁ, কিন্তু তার আগে একটা কথা বলো তো। কাল যে আমরা কলকাতায় যাচ্ছি, এটা একেবারে পাক্কা?” 

“অ্যাবসলিউটলি।” বঙ্কুবাবু বললেন, “হোটেলে পৌঁছেই আমার লোককে… মানে আমার সেই এজেন্টকে ফোন করেছিলুম। সে বলল, ফ্লাইট কনফার্মড। কাল বিকেলের ফ্লাইটে। বিকেল মানে আড়াইটেয় টেক অফ্। দেড়টার মধ্যে আমাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হবে।” 

ভাদুড়িমশাই তক্ষুনি কিছু বললেন না। একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বললেন, “দ্যাখো বঙ্কু, তোমার সমস্যা আসলে একটা নয়, দুটো। এক নম্বর সমস্যা, গত বছর মে মাস থেকে তোমার ছোট ছেলে নিরুদ্দেশ। তার খোঁজ পাবার জন্যে যা যা করা দরকার, তুমি করেছ। পুলিশে যেমন রিপোর্ট করেছ, বড়-বড় প্রতিটি কাগজে তেমন বিজ্ঞাপনও দিয়েছ। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। অন্তত এখনও পর্যন্ত হয়নি। কী, ঠিক বলছি তো?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “ঠিকই বলছ। কোনও খবরই তো পাওয়া গেল না। এমন কী, কেউ যে ওকে টাকার লোভে কিডন্যাপ করেছে, তাও মনে হয় না। সেটা করলে তা অনেক আগেই তারা র‍্যানসম বাবদে যা-হোক একটা অ্যামাউন্ট চেয়ে চিঠি দিত। নাঃ, তাও কেউ দেয়নি।” 

“এবারে তোমার দু-নম্বর সমস্যাটার কথায় আসা যাক।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “দু-নম্বর সমস্যা তোমার বড় ছেলেকে নিয়ে। বি.কম. পাশ করে সে বিলেতে যেতে চেয়েছিল। তুমি যেতে দাওনি। তোমার ইচ্ছে সে ব্যাবসার কাজকর্ম বুঝে নিক। তা সে নেয়নি। তোমার কাছে আছে বটে, কিন্তু সেটা না-থাকারই মতো। এমনিতেই চাপা স্বভাবের ছেলে, কথাবার্তা বরাবরই কম বলত, এখন যে তাও বলছে না, সেটাও এই ক’দিন লক্ষ করেছি। তার উপরে আবার ওকে নিয়ে দেখছি মাঝে-মাঝেই একটা-না-একটা মিস্টিরিয়াস ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। ভুবনেশ্বরে তোমার বাড়ির ছাতে যা ঘটেছিল, সেটার কথা তোমার কাছে শুনেছি। তার পরে সিপাহিজলা আর নীরমহলে যা ঘটল, সে তো স্বচক্ষে দেখলুম। আজ আবার শুনছি সিঁড়ির থেকে পড়ে গিয়ে বাঁ হাতটা মচকে গেছে। এর মধ্যে শুধু এই সিঁড়ির থেকে পড়ে যাবার ব্যাপারটাকেই একটা অ্যাক্সিডেন্ট বলে ধরে নেওয়া যায়। অন্য ঘনটাগুলোকে কিন্তু অ্যাকসিডেন্ট বলা যাচ্ছে না।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “তা তো যাচ্ছেই না। ভুবনেশ্বরের বাড়ির ছাতে ওর গলা টিপে ধরা হয়েছিল। সিপাহিজলায় ওকে বাথরুমের ভিতর থেকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। নীরমহলেও কেউ উপর থেকে ওর মাথা তাক করে ইট ছুড়ে মেরেছিল। এ তো বোঝাই যাচ্ছে যে, কেউ ওকে খুন করতে চায়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “চায় হয়তো, কিন্তু পারছে না। আমি ভাবছি, পারছে না কেন?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “পারছে না সে ওর কপাল। কিন্তু কপাল ওকে কতদিন বাঁচাতে পারবে? সত্যি বলতে কী, এইজন্যেই এখন আমি চাইছি যে, বরং ও বিদেশেই যাক। গিয়ে একটা শর্ট কোর্স করে ফিরে আসুক। তাতে আর-কিছু না হোক, ছেলেটা প্রাণে তো বাঁচবে। কিন্তু তাতেও তো ও রাজি হচ্ছে না। এই অবস্থায় আমি কী করব?” 

রীতিমত বিচলিত দেখাচ্ছিল বঙ্কুবাবুকে। ভাদুড়িমশাই সেটা লক্ষও করেছিলেন। তিনি বললেন, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, অত ব্যস্ত হলে চলে? আমাকে আর-একটু সময় দাও।” 

“তুমি কিছু হদিস করতে পারলে?” 

“কিসের হদিস?” 

“এই মানে কে ওর উপরে হামলা করছে, কেনই বা করছে, সে-সবের কিছু আঁচ করতে পারছ?”

“এখনও পারিনি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু পারব নিশ্চয়। তবে একটা কথা এখনই বলতে পারি। লক্ষ্মণের নিরুদ্দেশ হওয়া আর রামুর উপরে এই হামলা হওয়া, এ দুটো ব্যাপারকে একেবারে আলাদা করে দেখাটা সম্ভবত ঠিক হচ্ছে না। আচ্ছা, লক্ষণ যে-দিন নিরুদ্দেশ হয়, তার আগের কয়েকটা দিনের কথা তোমার মনে আছে?” 

“মোটামুটি মনে আছে। অনেকদিন হয়ে গেল তো, খুঁটিনাটি সব কথা হয়তো বলতে পারব না, তবে বড়-বড় ঘটনাগুলোর কথা যদি জিজ্ঞেস করো, তা হলে ঠিকই বলতে পারব।” 

“খুটিনাটি ব্যাপারের কথা আমি জিজ্ঞেসও করছি না। আমি শুধু এমন ঘটনার কথাই জানতে চাইব, যা তোমার মনে থাকা সম্ভব।” 

“বেশ তো, কী জানতে চাও বলো।” 

ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। চুপচাপ সেটা টানলেন কিছুক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “লক্ষ্মণ নিখোঁজ হবার আগে কয়েকটা দিনের মধ্যে কি কোনও ব্যাপারে তাকে তুমি খুব বকাঝকা করেছিলে?” 

“কী ব্যাপারে বকব?”

“এই ধরো পড়াশুনোর ব্যাপারে। তোমারই কাছে শুনেছি যে, পড়াশুনোয় তার একটুও মন ছিল না। মানে বুদ্ধি ছিল না, তা নয়, কিন্তু মহা ফাঁকিবাজ। আজ যদি কটকে ফুটবল খেলতে যাচ্ছে, তো কাল যাচ্ছে ভদ্রকে। আর ক্রিকেট-সিজন এলে তো কথাই নেই, কখনও-কখনও টানা পাঁচ-সাত দিনের জন্যে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেত। এসব কথা তুমিই আমাকে বলেছ। তা এই নিয়ে তাকে বকাঝকা করোনি তো?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “দ্যাখো চারু, লক্ষ্মণ যে বুদ্ধিমান ছেলে, সেটা মিথ্যে নয়। হয়তো অনেকের চেয়েই বেশি বুদ্ধিমান। এদিকে পড়াশুনোয় যে ঘোর অমনোযোগী, সেটাও ঠিক। তার জন্যে বকুনিও আমার কাছে কিছু কম খেত না। কিন্তু বকুনি খেয়ে যে কখনও মুখ ভার করে বসে থাকত, তাও নয়। বকলে বলত, ‘পড়াশুনো করি না তো কী হয়েছে? পাশ তো ঠিকই করে যাচ্ছি।’ তা সেটা যে করত, তা-ই বা কী করে অস্বীকার করি? কিন্তু না, পড়াশুনো করে না বলে বকতুম বটে, কিন্তু ওকে নিয়ে আমার আসল ভয়টা ছিল তার জন্যে নয়। আমি দেখতে পাচ্ছিলুম যে, যতই বুদ্ধিমান হোক, দিনে-দিনে ও অস্থিরমতি, অবিবেচক হয়ে উঠছে। ছেলেবেলা থেকেই ও একটু চঞ্চল। কিন্তু বয়স বাড়লে তো চঞ্চলতা ধীরে-ধীরে কমে যায়। অথচ ওর ক্ষেত্রে দিনে-দিনে সেটা যেন আরও বেড়েই যাচ্ছে। তা ছাড়া যেমন উড়নচন্ডে স্বভাব, তেমনি খামখেয়ালি। ইদানীং আবার কখনও-কখনও তা ধরো পনেরো-বিশ দিনের জন্যে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছিল। যাবার আগে বলে যেত অবশ্য, তবে কোথায় যাচ্ছে, সেটা বলত না, কেমন যেন এড়িয়ে যেত। এটা নিয়ে প্রায়ই আমি ওকে বকাঝকা করতুম, কিন্তু ও তা গ্রাহ্যই করত না। এখন তুমিই বলো, এমন ছেলের হাতে কি একটা ব্যাবসার দায়িত্ব তুলে দেওয়া যায়?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও সব কথা পরে হবে। লেট্স কাম টু দ্য পয়েন্ট। আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করেছিলুম, তার স্পষ্ট জবাব দাও। আমার প্রশ্নটা ছিল, ও যে-দিন থেকে নিখোঁজ হয়, অর্থাৎ যে-দিন ভুবেনেশ্বরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি, সেই দিন কিংবা তার আগের কয়েক দিনের মধ্যে তোমার সঙ্গে ওর বড় রকমের কোনও বিরোধ হয়েছিল কি না, আর সেইজন্যেই তুমি ওকে একটু বেশি মাত্রায় বকাঝকা করেছিলে কি না।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “না, সেদিন কোনও বিরোধও ঘটেনি, বকাঝকাও করিনি।” 

“তার আগের কয়েক দিনের মধ্যে?” 

দু-দিকে মাথা নেড়ে বঙ্কুবাবু বললেন, “তার তো কোনও প্রশ্নই উঠছে না।”

“কেন?” 

“আগের কয়েক দিন কি ও ভুবনেশ্বরে ছিল যে, তার মধ্যে আমার সঙ্গে ওর বিরোধ ঘটবে, কি তাই নিয়ে আমি ওকে বকাঝকা করব?” 

“সে কী,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আগের কয়েকদিন ভুবনেশ্বরেই ছিল না লক্ষ্মণ? তা হলে কোথায় ছিল?” 

“তা তো জানি না। হয়তো ফুটবল কি হকি খেলবার ডাক পেয়ে কোথাও গিয়েছিল। এমন তো মাঝে-মাঝেই যেত। মোট কথা, যেখানেই গিয়ে থাক, সেইদিনই সকালবেলায় ও ভুবনেশ্বরে ফিরে আসে।” 

“সেইদিনই… মানে ২০ মে’র সকালবেলায়, এই তো?” 

“হ্যাঁ, ২০ মে’র সকালবেলায়।” বঙ্কুবাবু বললেন, “সকালে বাড়ি ফিরল। জলখাবার খেল। বাড়ির পাশেই নদী। সেখানে গিয়ে সাঁতার কেটে এল। তারপর বারোটার মধ্যে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়ে একা স্যুটকেস হাতে করে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, আর ফেরেনি।” 

“সেদিনও কোনও ব্যাপার নিয়ে তুমি বকোনি ওকে?” 

“দেখা হলে তো বকব, দেখাই হয়নি। আমি ছিলুম আমার অফিস ঘরে। আগ্রা থেকে একজন ব্যবসায়ী তার আগের দিন মানে ১৯ মে তারিখে ভুবনেশ্বরে এসেছিল। একটা লোনের ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলছিলুম। আমার বাড়িতে ছিল। সেইদিনই রাত্তিরে পুরী এক্সপ্রেস ধরে তার কলকাতা যাবার কথা। সেখান থেকে দিল্লির ফ্লাইট ধরবে। তো তারই সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কত পার্সেন্ট সুদ দেবে, কী কী মর্টগেজ রাখবে, সেই সব কথা। তা এর মধ্যে লক্ষ্মণ কখন বাড়ি ফিরেছে, তারপর কখন আবার বেরিয়ে গেছে, কিছুই আমি জানতুম না।” 

“কখন জানলে?” 

“বিকেলবেলায়। পীতাম্বর ওই সময় আমাকে নিয়ে একটু বেড়াতে বেরোয়। বেড়ানো মানে বাড়ির মধ্যে লনের চারপাশে একটু হাঁটি আর কি। তো হাঁটতে-হাঁটতে পীতাম্বরকে জিজ্ঞেস করেছিলুম যে, হ্যাঁ রে, তোদের ছোটদাদাবাবু কবে বাড়ি ফিরবে, কিছু জানিস? তাতে পীতাম্বর বলল, তিনি তো সকালবেলাতেই ফিরেছিলেন। ফিরে জলখাবার খেয়ে, নদীতে চান করে এসে, দুপুরের খাওয়া সেরে তারপরে আবার স্যুটকেস হাতে নিয়ে বেরিয়েও গেছেন। …শুনেই আমার খটকা লাগল। খালিই মনে হতে লাগল যে, এর মধ্যে কোথাও কিছু একটা গন্ডগোল রয়েছে।” 

“কেন, হঠাৎ অমন কথা মনে হল কেন?” 

তক্ষুনি এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না বঙ্কুবাবু। তাঁর চোখের চাউনি এমনিতে ভাবলেশহীন। সেই চোখেই ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “এমনিতে তো কিছু মনে হওয়ার কথা নয়। ও তো নোঙর ফেলতে জানে না, বাড়ির উপরে বিশেষ টানও নেই, হঠাৎ-হঠাৎ আসত, আবার হঠাৎ-হঠাৎ চলেও যেত। তা হলে আর এই হঠাৎ এসে আবার হঠাৎ চলে যাওয়ায় আমার খটকা লাগবে কেন? তবু লেগেছিল। কেন লেগেছিল জানো? এর আগে যখনই কোথাও গিয়েছে, কিংবা বাইরে দু-চার দিন কাটিয়ে আবার বাড়ি ফিরেছে, আমাকে সেটা জানাতে ওর একবারও ভুল হয়নি। এই প্রথম দেখলুম যে, ছেলেটা বাড়িতে ফিরল, আবার ঘন্টাখানেক বাদে বাড়ি থেকে চলেও গেল, কিন্তু আমাকে সে-কথা জানাল না।” 

“তুমি কি সেইদিনই পুলিশে খবর দিয়েছিলে?” 

“না। ভাবলুম, হয়তো তাড়া ছিল, তাই খবরটা আমাকে দেয়নি। কিংবা এমনও হতে পারে যে, বাইরের লোকের সঙ্গে অফিস-ঘরে বসে আমি ব্যাবসার কথা বলছি শুনে আমাকে বিরক্ত করতে চায়নি। তো ঠিক আছে, যেমন মাঝে-মাঝেই যায়, এবারও তেমন কয়েকটা দিনের জন্যে কোথাও গেছে হয়তো। তখন অন্তত তা-ই ভেবেছিলুম। কিন্তু সাত-সাতটা দিন কেটে গেল, লক্ষ্মণ তবু ফিরল না। তখন মনে হল, তাই তো, আমাকে না-জানিয়ে চলে গেল কেন? এমন তো কখনও হয় না।” 

“তখন তুমি পুলিশে খবর দিলে, কেমন?” 

“হ্যাঁ। সেইসঙ্গে কলকাতা, দিল্লি, বোম্বাই, মাদ্রাজ আর বাঙ্গালোরের বড়-বড় সব কাগজগুলোতে নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনও পাঠিয়ে দিলুম। সঙ্গে লক্ষণের ফোটোগ্রাফ। ফোন করে জেনে নিয়েছিলুম, কোন্ কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে কত টাকা লাগবে। বিজ্ঞাপনের সঙ্গে চেকও পাঠিয়ে দিই। ছেপে বেরুতে তাই দেরিও হয়নি।” 

“পুলিশ কোনও হদিশ করতে পারেনি, কেমন?”

“কিচ্ছু না। সে তো তোমাকে কলকাতাতেই বলেছি। বিজ্ঞাপন দিয়েও লাভ হল না। একজনও এমন কোনও খবর দিল না, যার সূত্র ধরে এগোনো যায়। তাও বলেছি তোমাকে।” 

“বলেছ। কিন্তু তখন তাড়াহুড়োর মধ্যে সব শুনেছি তো। তাই ভাবছিলুম যে, উই শুড গো ওভার অল দ্যাট ওয়ান্স এগেন। আর তা ছাড়া, কিরণবাবু তো সবটা জানেন না। ডিটেলগুলো ওঁরও জেনে নেওয়া ভাল।” 

এতক্ষণ আমি একটাও কথা বলিনি। চুপ করে সব শুনে যাচ্ছিলুম। এবারে বললুম, “লক্ষ্মণ এই যে নিখোঁজ হয়ে গেল, এত দিনের মধ্যেও ওর যে একটা খবর পাওয়া গেল না, রামু এটাকে কীভাবে নিয়েছে?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “কী করে বলব। ও তো আমার সঙ্গে কথাই বলতে চায় না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এটা ঠিক কবে থেকে হয়েছে?” 

“এইট্রিনাইন থেকে। রামু সেই বছর বি.কম. পাশ করে, লক্ষ্মণ বি.এ.। রামু ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল। রেজাল্ট বেরোবার পরেই বায়না ধরে বসে, বিলেত যাবে। আমি রাজি হইনি।” 

রাজি না হবার কারণটা আমি ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে শুনেছিলুম। তবু বললুম, “কেন?”

বঙ্কুবাবু করুণ হেসে বললেন, “আমার অবস্থা তো দেখছেন। চোখে দেখতে পাই না, স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়েছে। লক্ষ্মণ যে ব্যাবসার কাজকর্ম দেখবে, সে-আশা কোনও দিনই ছিল না। যা-কিছু ভরসা ওই রামু। তো সেই রামুও বিলেত যেতে চাইছে, কবে ফিরবে কে জানে, ততদিন আমি বাঁচব কি না, তারও ঠিক নেই। আমি তাই চাইছিলুম যে, বাপ বেঁচে থাকতে-থাকতে ব্যাবসার দায়িত্ব ও বুঝে নিক। …কী করে রাজি হব বলুন?” 

“বাস্, সেই থেকে এই অবস্থা?” 

“সেই থেকে এই অবস্থা। এমনিতেই ও অবশ্য কম কথা বলে। তবে ওই যে ওর বিলেত যাওয়া আটকে দিলুম, তখন থেকে আর কথাই বলতে চায় না। কিছু জিজ্ঞেস করলে হাঁ-হুঁ করে উত্তর দেয়, এই পর্যন্ত।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বুঝলুম। এবারে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। লক্ষ্মণ যেদিন নিখোঁজ হয়, সেদিন বাড়ি থেকে বেরুবার আগে কি রামুকে কিছু বলে গিয়েছিল?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “রামু তখন বাড়িতে থাকলে বলত নিশ্চয়। কিন্তু রামু তো তখন বাড়িতেই ছিল না।” 

“কোথায় গিয়েছিল?” 

“শহরে। …মানে আমাদের বাড়িটা যে ঠিক ভুবনেশ্বর-শহরে নয়, সেখানে থেকে মাইল কয়েক দূরে, তা তো তুমি জানোই। তো রোজ না-হলেও মাঝে-মাঝেই রামু সকালবেলার জলখাবার খেয়ে ভুবনেশ্বরে চলে যায়, আবার ফিরেও আসে দুপুর একটা-দেড়টার মধ্যেই। সেদিনও গিয়েছিল।” 

“কীসে করে যায়? সেদিনই বা কীসে করে গিয়েছিল?” 

“কেন, বাড়ির গাড়িতেই। বাড়িতে তো তিনটে গাড়ি। একটা আমার, আর দুটো ওদের দুই ভাইয়ের। দুজনেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। নিজেরাই চালায়।” 

“ঠিক আছে, কিন্তু ভুবনেশ্বরে কেন যায়, সেটা কখনও জিজ্ঞেস করেছ?” 

“তা করেছি বই কী। বলে যে, বঙ্কুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। তা ছাড়া, লাইব্রেরিতেও যায় মাঝে-মধ্যে। তো যা বলছিলুম। রামু সেদিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবার খানিক বাদে লক্ষ্মণ আসে। ফলে তখন দু-ভাইয়ের দেখা হয়নি। আবার, ভুবনেশ্বর থেকে সেদিন রামু যখন ফেরে, লক্ষ্মণ তার খানিক আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। ফলে তখনও দেখা হয়নি দু-ভাইয়ের।” 

“এসব কথা তোমাকে কে বলেছে?” 

“পীতাম্বর। ওর কাছে কথাটা শুনে যে আমি রামুকে ডেকে পাঠাইনি, তা নয়। ডেকে পাঠিয়েছিলুম। জিজ্ঞেসও করেছিলুম যে, হ্যাঁ রে, তোর ভাই তো আজ এসেছিল, তার সঙ্গে তোর দেখা হয়নি? তো রামু বললল, না।” 

একটুক্ষণ চুপচাপ কাটল। তারপর বঙ্কুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আর-কিছু জানতে চাও?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন তোমার কী করা উচিত, সেটা কিছু ভেবেছ?” 

বঙ্কুবাবু হাত উলটে বললেন, “কী যে করব সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না। রামুকে তো বারবার বলছি, ঠিক আছে, যা বাবা, এতই যখন ইচ্ছে, তখন যা বিলেতে। তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস। তা তাতেও তো এখন রাজি হচ্ছে না। এর মধ্যে আবার ঠিক করেছিলুম যে, গোটা ব্যাবসাটা আমার নিজের নামে না-রেখে ওর সঙ্গে একটা পার্টনারশিপের ব্যবস্থা করিয়ে নেব। তার দলিলপত্রও একজন ছুঁদে লইয়ারকে দিয়ে তৈরি করিয়ে ফেলেছিলুম। কিন্তু ও তাতে সই করল না।” 

“তুমি নিজে ওকে সই করতে বলেছিলে?” 

“প্রথমে পীতাম্বরের হাতে কাগজপত্র দিয়ে সই করিয়ে আনতে বলেছিলুম। তো পীতাম্বর ফিরে এসে বলল, বড়দাদাবাবু বলে দিয়েছেন যে, আগে ছোটভাই ফিরে আসুক, তখন ও-সব সই-টইয়ের কথা ভাবা যাবে, তার আগে নয়।” 

“তখন তুমি নিজেই সই করাতে গেলে?” 

“তা যেতে হল বই কী।” বঙ্কুবাবু বললেন, “কিন্তু তাতে কি কোনও কাজ হল? হল না হে চারু, কিছুই হল না। রামু আমার সঙ্গে একটা কথা পর্যন্ত বলল না। কিন্তু আমি আর কতদিন বাঁচব? তুমি একবার বলে দ্যাখো না। আর কিছু না, একটা সই করে দিক। তোমাকে তো খুব মান্যি করে। আমার কথা রাখেনি, কিন্তু তোমার কথাটা নিশ্চয় রাখবে। একবার অনুরোধ করে দ্যাখো ভাই।” 

“ঠিক আছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এককালে ওরা দুজনেই আমার কথা শুনত। কিন্তু সে তো আজকের ব্যাপার নয়। ওদের শেষ দেখেছি পাঁচ-সাত বছর আগে। তখন শুনত। কিন্তু এই পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে তো ওদের নিয়ে একবারও তুমি ব্যাঙ্গালোরে আমার বাড়িতে আসোনি, আর আমারও যাওয়া হয়নি ভুবনেশ্বরে। ফলে ইতিমধ্যে ওরা পালটে গেছে, কি না, তাও আমার জানা নেই। কিন্তু ঠিক আছে, এত করে তুমি যখন বলছ, তখন রামুকে আমি একবার অনুরোধ করে দেখব নিশ্চয়ই। তা যাতে সই করাতে হবে, সেই কাগজপত্রগুলো তোমার সঙ্গে আছে তো?” 

“তা তো সঙ্গে করে নিয়ে আসিনি। সেগুলো ভুবনেশ্বরে রয়েছে।” 

“তা হলে তো আমাকেও ভুবনেশ্বরে যেতে হয়।” 

“আবার কবে ভুবনেশ্বরে যাবে তুমি? দেরি হয়ে যাবে না?” 

‘কিচ্ছু দেরি হবে না। কাল তো আমরা কলকাতায় ফিরছি। তোমরা সেখান থেকে ভুবনেশ্বরে কবে যাচ্ছ?” 

“কালই জগন্নাথ এক্সপ্রেস ধরছি। অর্থাৎ পরশু ভোরে পৌঁছব।” 

“ঠিক আছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমিও পরশুই পৌঁছচ্ছি। তবে ভোরে নয়, দুপুরে। এই ধরো দুটো নাগাদ। …কী হল? এতে অত অবাক হবার কী আছে? …নাও, এখন ঘরে যাও, আপাতত আমার আর-কিছু জানবার নেই। …কিরণবাবু, ওকে ওর ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসুন।” 

১৮ 

বঙ্কুবাবুকে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিয়ে আমাদের ঘরে এসে ঢুকলুম। তারপর দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললুম, “উরে বাবা!” 

ভাদুড়িমশাই ইতিমধ্যে আরাম-কেদারাটির দখল নিয়েছিলেন। সেখানে বসে তাঁর সেই ফাইলটা খুলে কী-সব কাগজপত্র দেখছিলেন তিনি। আমি যে ফিরে এসেছি, সেটা বুঝতে পেরেও ফাইল থেকে মুখ তুললেন না। যা পড়ছিলেন, তারই উপরে চোখ রেখে বললেন, “কী হল?” 

“আর বলবেন না, মিসেস ঘোষ দেখলুম ঘুমোননি, জেগেই ছিলেন।” 

“তা তো থাকতেই পারেন। রাত এখনও এগারোটাও বাজেনি।” 

“এক কপি স্টারডাস্ট পড়ছিলেন।” 

“আপনি কি ভেবেছিলেন যে, ঘুমোবার আগে উনি স্টারডাস্ট না পড়ে জেমস জয়েসের ইউলিসিস পড়বেন?” 

“না, তা নয়, তবে বঙ্কুবাবুর উপরে খুব রেগে রয়েছেন বলে মনে হল।” 

‘কেন, কেন,” ফাইলটা সারিয়ে রেখে ভাদুড়িমশাই বললেন, “অমন কথা মনে হল কেন? “

“একবার টোকা দিতে দরজা খোলেননি। দু-বার টোকা দিতেও না। তিনবারের বার দরজা খুলে দিলেন। ওঃ, সে এক রণচন্ডী মূর্তি! ভুরু নেই, নীচের পাটির সামনের দুটো দাঁত নেই! ওঃ, সে এক বীভৎস ব্যাপার!” 

“যাদের আমরা সুন্দরী ভাবি, মেক আপ তুলে ফেললে তাদের অনেককেই ওরকম দেখাবে! কিন্তু বর্ণনা ছাড়ুন, রেগে রয়েছেন সেটা বুঝলেন কী করে?” 

“দরজা খুলে দিতে কটমট করে বঙ্কুবাবুর দিকে তাকালেন। তারপর হাতের ম্যাগ্যাজিনখানা বঙ্কুবাবুর নাকের ডগায় উঁচিয়ে ধরে বললেন, অনেক রাত হয়েছে, যাও এবারে শুয়ে পড়ো গিয়ে!” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বটে? কিন্তু বঙ্কু তাতে কী করল?” 

“সেইটেই তো আশ্চর্যের ব্যাপার মশাই। আমি ভেবেছিলুম, বঙ্কুবাবু একেবারে সুড়সুড় করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়বেন। কিন্তু তা তো তিনি করলেনই না, উলটে মিসেস ঘোষকে ধমক দিয়ে বললেন, শাট আপ, ইউ সিলি উয়োম্যান! তারপর গলার স্বর একেবারে পালটে ফেলে আমাকে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ ফর অ্যাকসেপটিং আওয়ার টার্ম… সত্যি আমরা খুব কৃতজ্ঞ রইলুম।” 

“জাস্ট লাইক বঙ্কু।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কলেজে যা দেখেছিলুম, আজও… মানে এই পঁচাত্তর বছর বয়েসেও … ঠিক সেইরকমই আছে। একটুও পালটায়নি।” 

টেবিলে জাগ আর গেলাস রাখা রয়েছে। সেলোফেনের মোড়ক থেকে গেলাসটা বার করে তাতে জল ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো এক গেলাস জল খেয়ে ফেললুম। তারপর টেবিলের সামনে থেকে চেয়ারটাকে সরিয়ে নিয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করলুম, “ব্যাপারটা কী বলুন তো?” 

“কীসের ব্যাপার?” 

“এই যে রামুর উপর মাঝে-মাঝেই হামলা হচ্ছে, এটা নিয়ে বঙ্কুবাবুকে কি আরও কিছু প্রশ্ন করলে ভাল হত না?” 

“কী প্রশ্ন করব?” 

“এই যেমন টাকার লোভে… মানে বঙ্কুবাবুর সম্পত্তির লোভে… কেউ এ-কাজ করতে পারে কি না।” 

“কে করবে?” 

“কেন, দীপকই তো করতে পারে। আপনিই তো বলছিলেন…”

“মোটেই আমি অমন কথা বলিনি। আমি একটা সম্ভাবনার কথা ভাবছিলুম মাত্র। মেবি আই ওয়াজ থিংকিং অ্যালাউড। কিন্তু ওটা তো আরও অনেকের সম্বন্ধেই ভাবা যায়। আর তা ছাড়া, একটা কথা ভেবে দেখুন। দীপক কে? না বঙ্কুর শালা। তো বঙ্কুকে আমি কী জিজ্ঞেস করব? ‘ওহে বঙ্কু, দীপক যে রামুকে খুন করতে পারে, এই কথাটা ভেবে দেখেছ?” …আরে দূর মশাই, এসব কথা ওইভাবে কাউকে বলা যায় নাকি?” 

“বেশ তো, ওইভাবে না হয় না-ই বললেন। কিন্তু দীপককে উনি কতটা বিশ্বাস করেন, একটু কায়দা করে সেটা তো জেনে নেওয়া যায়। যেমন ধরুন, এটা তো আপনি বলতেই পারেন যে, ওহে বঙ্কু, একা যখন সব সামলাতে পারছ না, তখন দীপককে তোমার ব্যাবসার মধ্যে ঢুকিয়ে নিচ্ছ না কেন?” 

“ওভাবে বললে বঙ্কু কী জবাব দিত, সেটা জানি বলেই জিজ্ঞেস করবার দরকার বোধ করিনি।”

“কী জবাব দিতেন, সেটা আপনি জানেন?”

“জানি বই কী। বঙ্কু বলত, ‘অমিতাভ বচ্চন যার গুরুজি, তাকে দিয়ে ব্যাবসার কাজ চলবে না বলেই ঢোকাইনি।’ …কিন্তু, কিরণবাবু, দীপককে ব্যাবসায় ঢোকাতে চায় না বলেই যদি আপনি ভাবেন যে, সব ব্যাপারেই দীপককে ও অবিশ্বাস করে, তা হলে কিন্তু মস্ত ভুল করবেন। বঙ্কু মনে করে, ব্যাবসা-বাণিজ্যে ওর মাথা খুলবে না, কিন্তু তার থেকে কি এটা ইনফার করা যায় যে, বঙ্কুর ধারণা, খুন-খারাপির লাইনে দীপকের মাথা খুলবে? না না, তা নিশ্চয় ভাবা চলে না। আর তা ছাড়া, এই ক’দিন তো খুব কাছের থেকে ওদের দেখলুম। তাতে মনে হল, দীপককে বঙ্কু একটি আকাট অপদার্থ ভাবে ঠিকই, কিন্তু স্নেহও করে।” 

“তা হলে কে হামলা করছে?”

“এর জবাব দুটো হতে পারে।” 

“একটা-একটা করে বলুন।” 

“বলছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এক নম্বর জবাব, এমন কেউ হামলা করছে, যে ওকে প্ৰাণে মারতে চায় না, শুধু ভয় দেখাতে চায়।” 

“এটা আপনি আগেও আমাকে বলেছেন। এবারে দু-নম্বর জবাবটা দিন।” 

ভাদুড়িমশাই সরাসরি আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “সম্ভবত কেউই হামলা করছে না।”

বললুম, “তার মানে?” 

“মানেটা এখুনি জানা চাই?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “এত তাড়া কীসের? অনেক রাত হয়েছে, এবারে লক্ষ্মী ছেলের মতো শুয়ে পড়ুন দেখি।” 

১৯ 

হাওড়া স্টেশনে ঢুকে বড় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, পাঁচটা চল্লিশ। এইখানেই আমার দাঁড়াবার কথা। 

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ভাদুড়িমশাই এসে গেলেন। বললেন, “চলুন, ভিতরে যাওয়া যাক। গাড়ি ছাড়বে পাঁচটা পঞ্চান্নয়।” 

তা ঠিক পাঁচটা পঞ্চান্নতেই ধৌলি এক্সপ্রেস ছাড়ল। এয়ারকন্ডিশন্ড ফার্স্ট ক্লাস চেয়ার-কারে আসন পেয়েছি। হ্যান্ডব্যাগ দুটোকে উপরে তুলে দিয়ে আরাম করে বসা গেল। স্টেশনে ঢুকবার সময় ভাদুড়িমশাই দুখানা খবরের কাগজ কিনে ফেলেছিলেন। তার একটা আমাকে দিয়ে অন্যটার হেডলাইনে চোখ বুলোতে লাগলেন তিনি। 

খবরের কাগজে আমার মন বসছিল না। আমি ভাবছিলুম গত কয়েক দিনের কথা। ৫ মার্চ মঙ্গলবার আমি ত্রিপুরায় যাই। সেখানে ছিলুম মোট চার রাত্রি। ৫ মার্চ সিপাহিজলায়, ৬ মার্চ সাগরমহলে, ৭ মার্চ উদয়পুরে আর ৮ মার্চ আগরতলায়। কাল ৯ মার্চ বিকেলের ফ্লাইটে কলকাতায় ফিরেছি। কিন্তু বিশ্রাম পাইনি। মাত্র একটা রাত্রি কলকাতায় থেকেই আজ আবার শেষ-রাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে ভোরবেলায় ট্রেন ধরে চলেছি ভুবনেশ্বরে। 

ভুবনেশ্বরে যে যেতেই হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা অবশ্য ছিল না। কিন্তু বাড়ি ফিরে শুনলুম, ছেলের এখুনি এলাহাবাদে ফিরবার দরকার নেই, আরও হপ্তাখানেক সে কলকাতায় থাকবে। তখন মন হল, যাই তা হলে, ভুবনেশ্বর থেকে ঘুরেই আসি। বাসন্তীও বলল, ‘দিন দুই-তিনের জন্যে যদি হয় তো ঘুরে আসতে পারো, তবে তার বেশি থেকো না।’ এদিকে ভাদুড়িমশাই বলেছিলেন যে এয়ারপোর্ট থেকে তিনি সরাসরি বেহালায় যাবেন। সেখানে অরুণবাবুর মায়ের খবর জেনে তারপর ফিরে আসবেন যতীন বাগচি রোডে। সেখানকার ফোন যদি না ইতিমধ্যে ঠিক হয়ে থাকে তো অন্য কোনও জায়গা থেকে রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে আমাকে ফোন করে জেনে নেবেন যে, রবিবার সকালে আমার পক্ষে ভুবনেশ্বর যাওয়া সম্ভব হবে কি না। মোট কথা, আমার ফোন করবার দরকার নেই, তিনিই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবেন। 

বাড়ি ফিরে ছেলের সঙ্গে দেখা হয়নি। বাসন্তী বলল, বঙ্কুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়েছে। সেটা স্বাভাবিক। অনেকদিন বাদে-বাদে কলকাতায় আসে, তাই যখনই আসে, রোজই একবার বঙ্কুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বেরোয়। ছেলে বাড়ি ফিরল সাতটা নাগাদ। তার খানিক বাদে এলেন সদানন্দবাবু। ঘরে ঢুকে একগাল হেসে বললেন, “ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে ত্রিপুরায় গিয়েছিলেন শুনলুম। কী ব্যাপার মশাই?” 

সদানন্দবাবুকে আমার পাঠকরা আশা করি ভুলে যাননি। ভদ্রলোক আমাদের সামনে বাড়িতে থাকেন। পরোপকারী, সদাহাস্যময় মানুষ। অতিমাত্রায়া স্বাস্থ্যসচেতন, চায়ের সঙ্গে দুধ কিংবা চিনি খান না, রোজ ভোরবেলায় দু-মাইল হাঁটেন। বয়স সত্তরেরও বেশ কয়েক বছর বেশি, কিন্তু স্বাস্থ্য একটুও টসকায়নি। তো এই মানুষটি কিছুকাল আগে একটা খুনের মামলায় জড়িয়ে যান। ভাগ্যিস তখন ভাদুড়িমশাই কলকাতায় ছিলেন, নইলে আর সেই বিপদ থেকে তাঁকে উদ্ধার পেতে হত না। তো তখন থেকেই সদানন্দবাবু ভাদুড়িমশাইয়ের দারুণ ভক্ত। 

বললুম, “ত্রিপুরায় গিয়েছিলুম ঠিকই, তবে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে যাইনি। ফিরেছি অবশ্য তাঁরই সঙ্গে। কিন্তু খবরটা আপনি কোথায় পেলেন?” 

“কেন, বউমার কাছে। ভাদুড়িমশাই যে সেখানে ছিলেন, সেও তো তাঁরই কাছে শুনলুম। শুনেছি, খুব বিউটিফুল জায়গা। সত্যি?” 

“ষোলো-আনার উপরে আঠারো-আনা সত্যি। বেড়াবার পক্ষে একেবারে আদর্শ।” 

“কিন্তু আপনারা তো আর বেড়াবার জন্যে ত্রিপুরায় যাননি। ব্যাপারটা কী বলুন তো।” 

বললুম, “অতি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এক কোটিপতির ছেলে, তাকে মারবার জন্যে একদল গুন্ডা লাগানো হয়েছে, কিন্তু কিছুতেই তারা ছেলেটাকে ঘায়েল করতে পারছে না। যতবার তারা গুলি চালাচ্ছে, ততবারই ফশকে যাচ্ছে।” 

“দূরমশাই, আপনি ঠাট্টা করছেন।” 

“বা রে, এর মধ্যে আবার ঠাট্টা দেখলেন কোথায়?” 

“ঠাট্টা নয়? গুলিই যদি চালাচ্ছে, তো বারবার ফশকে যাচ্ছে কেন?”

সদানন্দবাবুর প্রশ্নের জবাব দেওয়া গেল না। ফোন বেজে উঠল। ভাদুড়িমশাই। বললুম, “কী খবর? মালতীর শাশুড়ি ভাল আছেন তো?” 

“পার্ফেক্টলি অল রাইট। লো ব্লাডপ্রেশার। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। অরুণরা কালই যতীন বাগচি রোডে ফিরে এসেছে। ফোনও ঠিক হয়ে গেছে। ওদের বাড়ি থেকেই কথা বলছি।” 

“ভুবনেশ্বরে কালই যাচ্ছেন তো?” 

“কথা যখন দিয়েছি, তখন নিশ্চয় যাব। আপনার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে?” 

“মনে হয়েছিল, হবে না। কিন্তু ছেলে আরও হপ্তাখানেক কলকাতায় থাকবে। তা হলে আর বাধা কী?”

“তা হলে চলুন। ধৌলি এক্সপ্রেসে যাচ্ছি। ভোর পৌনে ছটায় হাওড়া স্টেশনে বড় ঘড়ির নীচে অপেক্ষা করব। দেরি করবেন না। গাড়ি যে পাঁচটা পঞ্চান্নয় ছাড়ে এটা মনে রাখুন।” 

জায়গা পাওয়া যাবে কি না, জিজ্ঞেস করতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “রিজার্ভেশন নেই। তবে চিন্তা করবেন না। খুব ভোরের ট্রেন তো, তাই ভিড় বড়-একটা হয় না। ব্যবস্থা একটা ঠিকই হয়ে যাবে।” 

তা হলও। দিব্যি পা ছড়িয়ে ঠান্ডা কামরায় বসে আমরা ভুবনেশ্বরে চলছি। 

খড়গপুর পর্যন্ত হকারদের ভিড় ছিল। হকার থাকলে যা না-থেকে পারে না, সেই চেঁচামেচিও ছিল। তার উপরে আবার মাঝে-মাঝেই কারা যেন চেন ট্রেনে থামিয়ে দিচ্ছিল ট্রেনটাকে। তা খড়গপুর ছাড়াবার পরে আর সে-সব উৎপাত নেই। কামরা একেবারে শান্ত। শেষ রাত্তিরে উঠে ট্রেন ধরতে হয়েছে বলে অনেকে ইতিমধ্যে ঘুমিয়েও পড়েছেন দেখছি। 

খবরের কাগজখানাকে সামনের সিটের পিছনে লাগানো জালি ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে ভাদুড়িমশাই ইতিমধ্যে একটা ইংরেজি নিউজ-ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাতে সম্ভবত মন বসাতে পারছিলেন না। তাই সেটাও একটু বাদেই তিনি জালি-ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলেন। হাত দুখানাকে বুকের উপরে জড়ো করে চোখ বুজে বসে রইলেন খানিকক্ষণ। আমি জানি, উনি ঘুমোচ্ছেন না। কিছু-একটা নিয়ে ভাবছেন। ওঁকে এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে না। জানলায় চোখ রেখে আমি বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলুম। 

এয়ার-কন্ডিশনড কামরা, তাই জানলায় কাচ লাগানো, ফলে একটু অস্বস্তি হয় ঠিকই, তবে বাইরের ঘরবাড়ি গাছপালা আর মানুষজন দেখতে কোনও অসুবিধে হয় না। দেখতে ভালই লাগছিল। গাছপালাগুলো এমন জোরে মাথা নাড়ছিল আর মাঝে-মাঝেই মাঠ জুড়ে এমন ধুলো উড়ছিল যে, বুঝতে পারছিলুম, বাইরে ঝোড়ো হওয়া বইছে। একটু আগে ভদ্রক ছাড়িয়েছি। ছোটবড় কয়েকটা নদীও পরপর পেরিয়ে এলুম। এ-সব নদীর কী নাম, কিচ্ছু জানি না। সদানন্দবাবুর কথা মনে পড়ল। ত্রিপুরা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন ‘বিউটিফুল জায়গা’। আসলে কিন্তু সব জায়গাই সুন্দর। তবে সৌন্দর্যেরও আছে রকমফের। সেইটে যিনি বোঝেন, নিষ্পাদপ মরুভূমিও তাঁর চোখে মোটেই অসুন্দর ঠেকে না। 

কামরার মধ্যে ধূমপান নিষেধ। ভাদুড়িমশাই ইতিমধ্যে তাই সিগারেট খাবার জন্যে কামরা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে বললেন, “কী ভাবছেন এত?” 

বললুম, “ভাবছিলেন তো এতক্ষণ আপনিই। কী নিয়ে ভাবছিলেন, তাও আন্দাজ করতে পারি। কিছু কিনারা হল?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ভাবনার কোটি হাত-পা, লাখো মাথা, প্রকান্ড হাঁ।” 

“কাব্যি করতে হবে না। কিছু কিনারা হয়নি, কেমন?” 

“একেবারেই যে হয়নি তা নয়। কিন্তু এখন থাক, এ-সব কথা পরে হবে। আপনি কী ভাবছিলেন বলুন।” 

“আমি ভাবছিলুম সদানন্দবাবুর কথা।” 

“কাল তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে?” 

“না হয়ে পারে? আমি যে ত্রিপুরায় গিয়েছিলুম, আর আপনিও যে সেখানে ছিলেন, আগরতলা থেকে ফোনে আমাদের খবর পেয়ে বাসন্তীই তা ওঁকে জানিয়ে দিয়েছিল যে।” 

“বটে? তা কেন আমরা ত্রিপুরায় গিয়েছিলুম, তা ওঁকে বলেছেন?”

“একটু অন্যভাবে বলেছি।” 

“কী রকম?” 

“ওই মানে আসল ঘটনাকে একটু পালটে নিয়ে বললুম যে, এক কোটিপতির ছেলেকে খতম করবার জন্যে গুন্ডা লাগানো হয়েছে। কিন্তু গুন্ডারা কিছুতেই তাকে খতম করতে পারছে না। যতবার গুলি চালাচ্ছে, ততবারই ফশকে যাচ্ছে।” 

“সদানন্দবাবু তাতে কী বললেন?” 

হেসে বললুম, “সদানন্দবাবু বললেন, গুলিই যদি চালাচ্ছে তো বারবার ফশকে যাচ্ছে কেন? ভাদুড়িমশাই গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, “অ্যাঁ, সদানন্দবাবু এই কথা বললেন? অব অল পার্সনস সদানন্দবাবু?” 

বললুম, “বুঝুন ব্যাপার!” 

“বুঝবার তো কিছু নেই। ভদ্রলোক যা বলেছেন, সেটাই হচ্ছে মোক্ষম কথা। হি হ্যাজ হিট দ্য নেইল রাইট অন ইটস হেড! গুলিই যদি চালাচ্ছে তো বারবার ফশকে যাচ্ছে কেন? ঠিক, ঠিক, এ একেবারে লাখ কথার এক কথা! গলাই যদি টিপে ধরছে তো দমবন্ধ করে মেরে ফেলছে না কেন? ধাক্কাই যদি মারছে তো মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে না কেন? ইটই যদি ছুড়ে মারছে তো সেটা মাথায় না পড়ে পাশে পড়ছে কেন? …বাঃ, বাঃ, চমৎকার! এক্সেলেন্ট! …আরে মশাই, এই কথাটা আমিও আপনাকে বলেছি, অথচ আপনি কিছুই বুঝতে পারেননি!” 

এর পর আর কী বলব। গলা টিপে ধরলেই যে কেউ পটাং করে মরে যাবে তার কোনও মানে নেই, আচমকা একটা ধাক্কা মারলেই যে কারও মাথা ফাটবে তার কোনও মানে নেই, আবার ইট ছুড়ে মারলেই যে সেটা কারও মাথায় লাগবে, তারও কোনও মানে নেই। অথচ নীরমহলের ঘটনাটার পর থেকে দেখছি, এরই উপরে ভাদুড়িমশাই যত গুরুত্ব দিচ্ছেন। কেন দিচ্ছেন, ঈশ্বর জানেন। কিন্তু ভদ্রলোক যে-রকম উত্তেজিত, তাতে মনে হল, এখন আর এ বিষয়ে কিছু না-বলাই ভাল। জানলায় মুখ রেখে চুপচাপ দেখতে লাগলুম যে, গাড়ি একটা মস্ত বড় নদী পার হচ্ছে। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নদীটার নাম জানেন? 

মুখ না ফিরিয়েই বললুম, “না।” 

“রাগের কিছু নেই। সদানন্দবাবু সত্যি একটা বুদ্ধির কথা বলেছেন। যা-ই হোক, এটা মহানদী। নদী পেরোলেই কটক, এ-রাজ্যের পুরনো রাজধানী। তা ভুবনেশ্বর তো প্রায় এসে গেল।” 

কটকে ঢুকতে গেলেও নদী, আবার কটক থেকে বেরোতে গেলেও নদী। সেটা অবশ্য মহানদীর মতন এত চওড়া নয়। ভুবনেশ্বর এখান থেকে মাত্রই তিরিশ কিলোমিটার। সেই তিরিশ কিলোমিটার পথ পেরোতেই এক ঘন্টার মতো সময় লেগে গেল। কথায় বলে ‘তালগাছের আড়াই হাত’। শেষের ওই আড়াই হাত ওঠাই নাকি সবচেয়ে শক্ত। তা এও দেখছি সেই ব্যাপার। নামে যদিও এক্সপ্রেস, শেষ পথটুকু এল একেবারে প্যাসেঞ্জার-গাড়ির মতন ঢিকুস-টিকুস করে। যেন বড়ই অনিচ্ছেয় আমাদের ভুবনেশ্বরে এনে পৌঁছে দিল। 

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম দেড়টা বাজে। ঠিক ছিল, স্টেশনের বাইরে এসে আমরা একটা ট্যাক্সি ধরে নেব। তার আর দরকার হল না। ওদিকের প্ল্যাটফর্ম দিয়ে বাইরে বেরোতে হবে। তার জন্যে লাইন পেরোনো দরকার। সেটা পেরোবার জন্যে ওভারব্রিজে উঠতে যাচ্ছি, হঠাৎ কোত্থেকে বিজ এসে আমাদের হাত থেকে হ্যান্ডব্যাগ দুটো ছিনিয়ে নিয়ে বলল, “আসুন স্যার, আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি।” 

বললুম, “আমরা যে গাড়িতে আসব, তুমি তা জানলে কী করে?” 

বিজু বলল, “আমরাও আজই সকালে এসে পৌঁছেছি। তো বাড়ি থেকে দুখানা গাড়ি স্টেশনে এসেছিল তখন। বাবুরা তার একটা নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন, আর আমাকে বললেন, তুই একটা গাড়ি নিয়ে শহরেই থেকে যা, ভাদুড়িসাহেব আর চ্যাটার্জিসাহেব হয়তো ধৌলি এক্সপ্রেসেই চলে আসবেন, যদি আসেন তা হলে একেবারে তাঁদের নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিবি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাবুদের ওই একটা গাড়িতেই হয়ে গেল?” 

“তা কেন হবে না? ওঁরা তো মাত্র তিনজন।” 

“তার মানে দীপক আর রাজেশ আসেনি?” 

“দীপকবাবুর টিকিট কাল পাওয়া যায়নি। উনি আজ রাত্তিরের গাড়িতে উঠে কাল সকালে এসে পৌঁছবেন।” 

“আর রাজেশ?” 

“তিনি আসবেন না। কলকাতায় তাঁর কী কাজ রয়েছে।” 

কিন্তু আমরা যে আজ ধৌলি এক্সপ্রেসে আসছি, বঙ্কুবাবু সে-কথা বুঝলেন কী করে? ভাদুড়িমশাইকে জিজ্ঞেস করলুম, “আপনি কি বঙ্কুবাবুকে বলে রেখেছিলেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ধৌলি এক্সপ্রেসেই যে আসব, তা বলিনি। শুধু বলেছিলুম যে, তোমরা যে-দিন পৌঁছচ্ছ, আমরাও সেইদিন পৌঁছব, তবে ভোরে নয়, দুপুরে। তা চালাক মানুষ তো, ওর থেকেই যা বুঝবার ঠিক বুঝে নিয়েছে।” 

কথা বলতে-বলতে আমরা স্টেশনের বাইরে চলে এসেছিলুম। প্রাইভেট গাড়ি রাখবার জায়গাটা একটু দূরে। বিজু বলল, “আপনারা এখানে একটু অপেক্ষা করুন। আমি গিয়ে গাড়িটা নিয়ে আসছি।” 

মিনিট দুই-তিনের মধ্যেই গাড়ি আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা খুলে দিয়ে বিজু বলল, “উঠুন স্যার।” 

গাড়িতে উঠে ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি বিজু। সকাল থেকে তো এইখানেই রয়েছ, তোমার স্নান-খাওয়াদাওয়া নিশ্চয় হয়নি?” 

বিজু বলল, “ও নিয়ে ভাববেন না স্যার, আমার বাড়ি তো এইখানেই, বাড়ি থেকে ও-সব সেরেসুরে এসেছি। রোজ আমি এইখান থেকে ডিউটি করতে যাই, তারপর ডিউটি সেরে ফের বাড়িতে ফিরে আসি।” 

গাড়ি চলতে শুরু করল। 

ভুবনেশ্বর যে কলকাতা কি বোম্বাইয়ের মতো মস্ত শহর, তা নয়, তবে স্বাধীনতার পরে এখানকার যে নতুন এলাকাটা গড়ে উঠেছে, সেটা বেশ ছড়ানো। রাস্তাগুলো চওড়া-চওড়া, বসতিগুলি ঘিঞ্জি নয়, জায়গায় তুলনায় লোকসংখ্যা এখনও কমই বলতে হবে, কেউ কারও ঘাড়ের উপরে নিশ্বাস ফেলছে না, নতুন বলেই কিছু বাড়ি বেশ হাল ফ্যাশনের, মাঝে মাঝেই পার্ক। সব মিলিয়ে রীতিমত ঝকঝকে চেহারা। 

বিজু বলল, “আপনারা কি কয়েকটা দিন থাকবেন স্যার?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন বলো তো?” 

“যদি থাকেন, তো এর মধ্যে একদিন নন্দনকানন থেকে আপনাদের ঘুরিয়ে আনি। এখানে যত সাদা বাঘ আছে, আর কোনও চিড়িয়াখানায় তা নেই।” 

আমার দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “নন্দনকাননটা কী জানেন তো? এখানকার চিড়িয়াখানা।” তারপর বিজুর উদ্দেশে বললেন, “না হে বিজু, কথাটা তো ভালই বলেছ, কিন্তু এ-যাত্রায় বোধহয় সময় করতে পারব না।” 

শহরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে গাড়ি একটু বাদেই হাইওয়েতে গিয়ে পড়ল। এই হাইওয়ে ধরে পুরী চলে যাওয়া যায়। দূরত্ব বেশি নয়, মাত্রই ষাট কিলোমিটার। এখন ভরদুপুর, কিন্তু টুরিস্ট বাস চলার কামাই নেই। পুরী, কোণার্ক, ভুবনেশ্বর—পর্যটক-পরিক্রমার এই যে ত্রিভুজাকৃতি পথ, আজকাল দেখছি অনেকে একে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল বলতে শুরু করেছেন! বলতেই পারেন, কারণ পুরী কিংবা ভুবনেশ্বরে যাঁরা ছুটি কাটাতে আসেন, নিতান্ত একটা জায়গা দেখে তাঁরা খুশি হন না, তিনটেই তাঁদের দেখা চাই। ফলে, কন্‌ডাকটেড টুরের অজস্র অফিস আজকাল গজিয়ে উঠেছে সর্বত্র। তাদের লাক্সারি কোচ এই রাস্তা দিয়ে অনবরত ছুটছে। এয়ার-কন্ডিশন্‌ড কোচ, ভিডিও কোচ, কোনওটারই কিছু অভাব নেই। পথেই পড়ে বলে যেমন খন্ডগিরি-উদয়গিরি তেমন ধৌলির জাপানি বুদ্ধমন্দিরও তারা টুরিস্টদের দেখিয়ে দেয়। 

গাড়ির জানলা থেকেই পাহাড়চূড়ার সেই ধরধবে সাদা মন্দির আমি দেখতে পেয়েছিলুম। জায়গাটা যে ভুবনেশ্বরের খুব কাছে, ভাদুড়িমশাই সে-কথা আমাকে আগেই বলেছিলেন, কিন্তু তাই বলে যে এত কাছে, তা আমি ভাবিনি। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমরা ধৌলিতেই যাচ্ছি বটে, তবে মন্দিরের দিকে নয়। নদী পার হয়ে বাঁ-দিকে একটা রাস্তা পড়বে। সেই রাস্তা ধরে খানিক এগোলেই বঙ্কুর বাড়ি। একদম নদীর ধারে, কাছেপিঠে অন্য কোনও ঘরবাড়ি নেই। বঙ্কু আসলে একটু নিরিবিলি থাকতে ভালবাসে, ভিড়ভাট্টা পছন্দ করে না।” 

বললুম, “সে তো বুঝতেই পারছি। ভিড়ভাট্টাই যদি পছন্দ করবেন, তা হলে আর এমন জায়গায় বাড়ি করবেন কেন, ভুবনেশ্বর শহরেই তো থাকতে পারতেন। 

দেখতে দেখতে নদী এসে গেল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “নদীটার নাম জানেন?” 

বললুম, “না।” 

“দয়া। বড় বিচিত্র নাম।” 

“নামটাকে বিচিত্র বলছেন কেন?” 

“এইজন্যে বলছি যে, এই দয়া নদীর ধারেই বড় নির্দয় একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। নদীর পাশের মাঠটা দেখছেন তো? এই মাঠেই হয়েছিল অশোকের কলিঙ্গজয়ের যুদ্ধ। গোটা নদী ভরে গিয়েছিল মানুষের রক্তে। সেই রক্তধারা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন চন্ডাশোকও। তা নইলে আর তিনি ধর্মাশোক হয়ে উঠবেন কেন?” 

দয়া নদীর ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি বাঁ-দিকের পথ ধরল। বেশি দূর যেতে হল না। খানিকটা এগিয়েই বিজু বলল, “আমরা এসে গেছি স্যার।” 

বঙ্কুবাবু যে বিরাট বড়লোক, সেটা জানতুম। তাই ধরেই নিয়েছিলুম যে, তাঁর বাড়িটাও বেশ বড় মাপেরই হবে। এখন দেখলুম, বাড়ি নেহাতই একটা নয়, তিনটে। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলে বাঁ-দিকে আউটহাউস, ডানদিকে কাজের লোকদের কোয়ার্টার্স। তারপরে মস্ত লন। লনের দু-দিক দিয়ে দুটো চওড়া রাস্তা গিয়ে মূল বাড়ির গাড়িবারান্দার সামনে পৌঁছেছে। রাস্তার দু-দিকে দেবদারুর সারি। গাছগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে নানা রকমের দেশি-বিদেশি ফুলের টব। 

মূল বাড়িটা বাংলো প্যাটার্নের, দোতলা। বঙ্কুবাবু চোখে খুবই কম দেখেন বটে, কিন্তু তাঁর শ্রবণশক্তি নিশ্চয়ই খুব প্রখর। বাড়িতে গাড়ি ঢুকবার শব্দ পেয়েই তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু আমরাই এসেছি, সম্ভবত সেটা বুঝতে পারেননি বলেই বিশেষ হাসছিলেন না। ভাদুড়িমশাই গাড়ি থেকে নেমে বললেন, “আমরা এসেছি বঙ্কু।” 

এতক্ষণে হাসি ছড়িয়ে পড়ল বঙ্কুবাবুর মুখে। হাত বাড়িয়ে ভাদুড়িমশাইকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তোমার কথার যে কখনও কোনও নড়চড় হয় না, সে তো সেই ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি। এসো, এসো।” 

গাড়ি থেকে বিজু আমাদের হ্যান্ডব্যাগ দুটো নামিয়ে এনেছিল। ব্যাগ দুটো কোথায় রাখবে, জিজ্ঞেস করতে বঙ্কুবাবু বললেন, “দোতলার পুব-দক্ষিণ-খোলা ঘরটায় এঁরা থাকবেন, সেইখানেই রেখে আয়।” তারপর ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরাও বিজুর সঙ্গে দোতলায় চলে যাও। কিন্তু দেরি কোরো না, হাতমুখ ধুয়েই নীচে চলে এসো। তোমরা তো নিশ্চয় স্নান করে বেরোওনি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি করেছি, কিন্তু কিরণবাবু সম্ভবত করেননি। তবে আমি বলি কী, এত বেলায় কিরণবাবুরও আর স্নান করে কাজ নেই, বরং বিকেলে স্নান করে নেবেন।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “সেই ভাল। আড়াইটে বাজে, উপর থেকে ঘুরে এসে তোমরা খেতে বসে যাও।” 

বিজু আমাদের দোতলায় পৌঁছে দিয়ে বলল, “আমি বরং একটু দাঁড়াই। আপনারা মুখ-হাত ধুয়ে নিন, তারপরে আপনাদের খাবার ঘরে নিয়ে যাব।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দরকার হবে না, আমি তো এ-বাড়িতে আগেও এসেছি, তুমি যেতে পারো।” 

বিজু চলে গেল। 

আমরাও একটু বাদে নীচে নেমে এলুম। বঙ্কুবাবু ডাইনিং হলে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, “ডলি আর রামু খেয়ে নিয়েছে। তোমরা যে সত্যিই এই ট্রেনে আসবে, তা ওরা বিশ্বাসই করতে পারেনি। নয়তো ওরাও তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করত।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুমিও খেয়ে নিলেই বুদ্ধির কাজ করতে। তা ওরা কোথায়? একজনকেও তো দেখছি না।” 

“ট্রেনে কাল ওদের একজনেরও ঘুম হয়নি। দুজনেই ঘুমিয়ে নিচ্ছে। ডেকে দেব?” 

“আরে না না, ডাকবার দরকার নেই। রাত্তিরে তো দেখা হচ্ছেই।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “রাত্তিরে কেন, বিকেলেই দেখা হবে।” 

“বিকেলে আমি থাকছি না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “একবার ভুবনেশ্বরে যেতে হবে। ফিরতে-ফিরতে একটু রাত হয়ে যেতে পারে, তা নিয়ে ভেবো না। … ও হ্যাঁ, একটা কথা, বোম্বাইয়ে গোটা দুই-তিন ফোন করা দরকার।” 

“সে তো তোমার ঘর থেকেই করতে পারো। এস টি ডি-র ব্যবস্থা রয়েছে। স্ট্রেট ডায়াল করবে, কোনও অসুবিধে নেই। বোম্বাইয়ের কোড নাম্বার হল জিরো ডাব্‌ল টু।” 

“ঠিক আছে, তা হলে ওই কথাই রইল।” 

খাওয়া শেষ হয়েছিল। আমরা উঠে পড়লুম।” 

দোতলায় উঠে ভাদুড়িমশাই বললেন, “চলুন, চট করে একবার ছাত থেকে ঘুরে আসি।” বিরাট ছাত। এ-বাড়ির কম্পাউন্ডটা যে কত বড়, ছাতে না উঠলে সেটাও আমি বুঝতে পারতুম না। যেমন সামনে, তেমন পিছন দিকেও বিস্তর জমি। সামনে যেমন লন, পিছনে তেমন সুইমিং পুল। তারও পিছনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাগান। পুব দিকের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াতে নদীটাও চোখে পড়ল। জমি সমতল নয়, একটু ঢেউ-খেলানো। গোটা কম্পাউন্ডই উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এতই উঁচু যে, কোনও দিক থেকেই পাঁচিল ডিঙিয়ে কারও ভিতরে ঢোকা সম্ভব নয়। 

ভাদুড়িমশাইকে সে-কথা বলতে তিনি বললেন, “যদি বা, কেউ ঢোকে, সে বেরুবে কী করে? অসম্ভব। অথচ এই ছাতেই নাকি রামুর গলা টিপে ধরা হয়েছিল। লোকটা কী করে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালিয়ে গেল, তাই ভাবছি।” 

বললুম, “কাজটা যে বাইরের কারও, তা ভাবছেন কেন? ভিতরের কারও তো হতে পারে।”

“তা পারে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভূতের হওয়াও কিছু বিচিত্র নয়। চলুন নীচে যাওয়া যাক।”

দোতলায় নেমে ভাদুড়িমশাই বললেন, “এবারে বোম্বাইয়ে তিনটে ফোন করতে হবে।”

“কাকে?” 

“একটা আমাদের বোম্বাই-এজেন্টকে, আর দুটো দুই বঙ্কুকে। আজ তো রবিবার, অফিস ছুটি। দেখি বাড়িতে পাওয়া যায় কি না। যদি পাই তো ওদের ছুটির বারোটা বেজে গেল!” 

দুজনকে পাওয়া গেল। বোম্বাই অফিসের এজেন্টকে আর দুই বঙ্কুর একজনকে। অন্যজন নাকি ছুটি কাটাবার জন্যে শুক্রবার বিকেলেই লোনাভুলা চলে গিয়েছেন, সোমবার সকালের আগে ফিরবার আশা নেই। 

যে দুজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল, ভাদুড়িমশাই তাঁদের একই কথা বললেন। বোম্বাইয়ে যাঁরা ক্রিকেট-কোচিং দেন, তাঁদের প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করতে হবে, নিশাকর ঘোষ নামের কোনও বাঙালি ছেলেকে তিনি কোচ করেন কি না। যদি তাঁদের কেউ এমন কথা বলেন যে, হ্যাঁ, ওই নামে কাউকে কিছুদিন আগেও তিনি কোচ করতেন, কিন্তু এখন আর করেন না, তা হলে জেনে নিতে হবে, কবে থেকে সে কোচিং ক্যাম্পে আসা বন্ধ করেছে। 

ওদিক থেকে কে কী বলেছিলেন, জানি না, তবে ভাদুড়িমশাই দেখলুম ফোন নামিয়ে রাখবার আগে দুজনকে একেবারে একই নির্দেশ দিলেন। “ও ইয়েস, ই’ট্স এক্সট্রিমলি আর্জেন্ট, অ্যান্ড আই লুক ফরওয়ার্ড টু হিয়ারিং ফ্রম ইউ।” 

কথা শেষ হল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু বাদেই আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। ফিরতে হয়তো রাত হবে। তার মধ্যে বোম্বাই থেকে কোনও কল্ আসবে বলে বিশ্বাস করি না। কিন্তু কাল সকালেও আমার এখানে থাকবার আশা কম। সম্ভবত আটটা নাগাদ বেরিয়ে গিয়ে বারোটা-একটার মধ্যে ফিরব। তো আমি থাকব না, সেই সময়ে যদি বোম্বাই থেকে কেউ আমার খোঁজ করে, তা হলে মেসেজটা আপনি রেখে দেবেন।” 

বললুম, “আমাকে কোনও মেসেজ দিতে যদি ওরা রাজি না হয়?” 

“দেবে। একটা কোড-নাম্বার মনে রাখুন, ফাইভ জিরো ডাব্‌ল এইট। এই নাম্বারটা কোট করলেই দেবে। …আপনি বিশ্রাম নিন, আমি ভুবনেশ্বরে চললুম।” 

কোড-নাম্বারটা আমার পকেট-ডায়েরিতে টুকে নিতে-নিতে বললুম, “চলুন, আপনাকে নীচে পৌঁছে দিয়ে আসি।” 

নীচে নেমে দেখলুম, বঙ্কুবাবু তখনও শুতে যাননি, ড্রইংরুমে বসে আছেন। সামনে দাঁড়িয়ে পীতাম্বর তাঁকে কিছু বলছিল। আমরা ঘরে ঢুকতে সে চুপ করে গেল। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি ভুবনেশ্বরে যাচ্ছি বঙ্কু। ফিরতে যদি বেশি রাত্তির হয়, তা হলে আর আমার জন্যে বসে না-থেকে তোমরা খেয়ে নিয়ো।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “একটু বোসো। ড্রাইভারদের কাউকে ডেকে পাঠাই।” 

“ড্রাইভার শুধু গাড়িটা বার করে দিক, সঙ্গে যেতে হবে না। এদিককার পথঘাট তো সবই আমার চেনা।” 

পীতাম্বর গিয়ে ড্রাইভারদের খবর দিয়ে এল। তার কয়েক মিনিট বাদেই একটা কটেসা দেখলুম গাড়িবারান্দার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ড্রাইভারের কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে ভাদুড়িমশাই গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। আমি আবার উপরে চলে এলুম।