চশমার আড়ালে – ১০

১০ 

আমার ঘুম ভাঙতে-ভাঙতে সাধারণত একটু দেরি হয়ে যায়। তাও বাসন্তী যতক্ষণ না এসে ঠেলা মেরে তুলে দিচ্ছে, ততক্ষণ আমি বিছানা ছেড়ে উঠি না, ঘুম ভাঙবার পরেও বেশ কিছুক্ষণ মটকা মেরে পড়ে থাকি। আজ ভাদুড়িমশাইও ঠেলাঠেলি করেননি, তবু ভাল করে রাত না পোহাতেই আজ ঘুম ভেঙে গেল। ঘরে একটা জিরো-পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। পাশ ফিরে দেখলুম, ভাদুড়িমশাইয়ের বিছানাটা খালি। বুঝতে অসুবিধে হল না, তিনি বাথরুমে ঢুকেছেন। ঘরের সামনে ছোট বারান্দা। বিছানা থেকে নেমে, চটিতে পা গলিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালুম। চোখ জুড়িয়ে গেল। আকাশে তখন অল্প-অল্প আলো ফুটছে। সেই আলো আর-একটু স্পষ্ট হতেই জলার ওদিকে ঝলমল করে উঠল নীরমহল। একটা পাখি কোথাও ডেকে উঠল। আর সঙ্গে-সঙ্গে সাড়া পড়ে গেল চতুর্দিকে। মনে হল ওই ডাকটার জন্যেই যেন প্রতীক্ষা করছিল হাজার-হাজার পাখি, একইসঙ্গে তারা এবারে সাড়া দিয়ে উঠেছে। 

“চলুন, একটু ঘুরে আসা যাক।” 

কখন যে ভাদুড়িমশাই আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, বুঝতে পারিনি। তাঁর গলা শুনে তাই চমকে উঠেছিলুম। বললুম, “আজ তো আমরা উদয়পুরে যাব, তাই না?” 

“সে তো বেলা হলে। চা-জলখাবার না-খেয়ে তো আর বেরুনো হচ্ছে না, তার অনেক আগেই আমরা ফিরে আসতে পারব।” 

নীচে নেমে জলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালুম। দেখা গেল, দুটো নৌকো সেখানে খুঁটির সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। শিকল দিয়ে তালা লাগানোর ব্যাপার নয়, স্রেফ দড়ি দিয়ে বাঁধা। ভাদুড়িমশাই বললেন, “চলুন, নৌকা যখন রয়েছে, তখন আর ভাবনা কী। কাল যা কাণ্ড হল, তাতে তো জায়গাটা আপনার ভাল করে দেখাই হল না।” 

“যাব যে, মাঝি কোথায়?” 

“সম্ভবত ঘুমোচ্ছে। এখন যদি তার জন্যে বসে থাকি তো বেলা বেড়ে যাবে। আর তা ছাড়া, মাঝির দরকারই বা কী। লগি যখন রয়েছে, তখন আমিই চালিয়ে নিতে পারব।” 

“কিন্তু চৌকিদারকে তো একবার জানিয়ে যাওয়া দরকার।” 

“ফিরে এসে জানালেই হবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিন, আর দেরি করবেন না, উঠে পড়ুন।”

পাশাপাশি দুটো নৌকোর একটায় উঠে পড়লুম। তারপর খুঁটির সঙ্গে বাঁধা দড়ি খুলে, লগিটা হাতে নিয়ে ভাদুড়িমশাইকে বললুম, “নৌকোটা আমিই চালাচ্ছি। আমি পূর্ববঙ্গের মানুষ, অন্তত এ-কাজটা আপনার চেয়ে আমি বোধহয় ভাল পারব।” 

নীরমহলে পৌঁছতে মিনিট কুড়িও লাগল না। নৌকোটা পাড়ে ভিড়িয়ে, একটা পাথরের সঙ্গে নৌকোর দড়ি বেঁধে রেখে খাড়াই পথ ধরে আমরা উপরে উঠে এলুম। 

বিশাল বাড়ি। কাল তবু কিছু লোকজন ছিল, আজ মাত্র আমরা দুটি প্রাণী। মনে হচ্ছিল যেন বিশাল একটা প্রাসাদ নয়, ভয়ঙ্কর এক শূন্যতার হাঁয়ের মধ্যে এসে আমরা ঢুকেছি। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে আমরা উপরতলায় উঠে ‘লুম। তখনও ভাল করে আলো ফোটেনি, বাগানে, বারান্দায়, সিঁড়িতে আর প্রকাণ্ড এক-একটা ঘরের মধ্যে চলেছে রহস্যময় আলো-আঁধারির খেলা। যে-খেলা দেখে, কী জানি কেন, গা-ছমছম করে। কোনও কারণ নেই, তবু এইরকম একটা অনুভূতি ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে যে, আমাদের চোখের আড়ালে, কিন্তু খুব কাছেই, কোনও একটা ষড়যন্ত্র চলেছে। ঘুলঘুলির ভিতর দিয়ে বাতাস বয়ে যাবার শব্দকেও চাপা-গলার কথা বলে মনে হয়। সেইসঙ্গে এমনও একটা আশঙ্কা জেগে ওঠে যে, কিছু একটা ঘটবে, তার আর খুব বেশি দেরি নেই। 

প্রাসাদের যে-দিকটা অন্দরমহল, সেই দিকে দিয়ে আমরা দোতলায় উঠেছি। কয়েকটা চাতাল আর ঘর আমাদের দেখাও হয়ে গেছে। এবারে সামনের দিকে যাব। এক-টুকরো লনের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা ওদিকে চলে গেছে। ঘর থেকে সেই রাস্তায় নামবার জন্যে পা বাড়াতে যাচ্ছি, হঠাৎ ভাদুড়িমশাই নিঃশব্দে আমাকে বাধা দিলেন। অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি মুখের সামনে একটা আঙুল তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ এখন কথা বলা চলবে না। পরক্ষণেই তাঁর ডান হাতের তর্জনী সামনের দিকে ঘুরে গেল। নির্দেশ মতো সামনের দিকে তাকাতেই ছলাত করে উঠল আমার বুকের রক্ত। বাগানের পাশের পথ ধরে সামনের দিকের যে ঘরটায় যাব বলে পা বাড়িয়েছিলুম, তার ভিতর থেকে একটি লোক বেরিয়ে আসছে। আকাশে আলো ফুটেছে, কিন্তু ওদিকটা এখনও ছায়াচ্ছন্ন। লোকটি যে কে, বুঝতে পারলুম না। ঘর থেকে বেরিয়ে, ডাইনে ঘুরে সে সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে গেল। 

একটু বাদেই নীচের তলা থেকে জলের শব্দ পাওয়া গেল। মনে হল, এককালে এই রাজবাড়ির অন্দরমহলের যে ঘাটে এসে নৌকো ভিড়ত শব্দটা সেইদিক থেকে আসছে। ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেউ নৌকো নিয়ে এখানে এসেছিল, এখন ফিরে যাচ্ছে।” 

বললুম, “লোকটাকে চিনতে পারলেন?” 

“ভাল করে দেখতে পাইনি। একে তো অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছি, তার উপর ওর মুখটা ওদিকে ফেরানো ছিল তো, তাই দেখা গেল না। তবে হাঁটার ভঙ্গি আর অন্য দু-একটা জিনিস থেকেও কিছুটা আন্দাজ করা যায়।” 

“কী আন্দাজ করলেন?” 

“আন্দাজটা ঠিক কি না, সেটা আগে বুঝে নিই, তারপরে বলব।” 

“লোকটা এখানে কী করতে এসেছিল, সেটা বুঝতে পারলেন?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সে তো শেষ-রাত্তিরে ঘুম থেকে উঠেই বুঝেছি। আপনি যদি আর-একটু আগে শয্যাত্যাগ করতেন, তো আপনিও বুঝতে পারতেন।” 

কিছুই বোধগম্য হল না। শুধু এইটুকু বুঝলুম যে, ভাদুড়িমশাই এখন আর এ নিয়ে কোনও কথা বলতে রাজি নন। বললুম “ঠিক আছে, তা হলে এখন ফেরা যাক। নাকি তারও কিছুক্ষণ থাকবেন এখানে?” 

“এমনিতে তো থাকবার কোনও কারণ নেই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে এখুনি যদি ফিরি, তো লোকটা বুঝে ফেলবে। আগে ও জলাটা পার হোক।” 

আমরা গিয়ে নৌকোয় উঠলুম আরও মিনিট পঁচিশেক বাদে। তখন সূর্য উঠে গেছে, রোদ্দুর পড়ে ঝিকমিক করছে গোটা জলা। টুরিস্ট লজে গিয়ে যখন পৌঁছলুম, তখন সাড়ে ছ’টা বাজে। অথচ, মজার ব্যাপার, আমাদের দলের অনেকেরই তখনও ঘুম ভাঙেনি। 

ঘরে ঢুকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “যান, আপনি এবারে স্নান করে নিন।” 

স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলুম, ভাদুড়িমশাই ঘরে নেই। পাশের ঘরে সস্ত্রীক বঙ্কুবাবু থাকেন। জামাকাপড় পালটে তৈরি হয়ে বঙ্কুবাবুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকবার দরকার হল না, দরজা খোলাই ছিল। যা ভেবেছিলুম তা-ই। ভাদুড়িমশাই আর বঙ্কুবাবু সেখানে বসে গল্প করছেন। বঙ্কুবাবুর দৃষ্টিশক্তি যতই দুর্বল হোক, কান সজাগ। পায়ের শব্দে বুঝতে পেরেছিলেন, কেউ ঘরে ঢুকেছে। বললেন, “কে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিরণবাবু।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “আরে আসুন, আসুন।” 

এ-ঘরে গোটা দুই বাড়তি চেয়ার রয়েছে। তার একটায় বসে বললুম, “মিসেস ঘোষ কোথায়?”

“তিনি বাথরুমে ঢুকেছেন স্নান সেরে বেরুতে তাঁর সময় লাগবে। তাই চারুকে ডেকে পাঠিয়ে কথা বলছিলুম।” 

“আপনার নিশ্চয় স্নান হয়নি এখনও?” 

“তা হয়নি, তবে তাড়া তো নেই।” 

বললুম, “আমাদের বাথরুমটা তো খালি। ইচ্ছে করলে সেখানে গিয়েও আপনি স্নান সেরে নিতে পারেন।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “তার দরকার হবে না।…..কিন্তু এদিকে একটা মুশকিল হয়েছে।” 

“আবার কী মুশকিল হল?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর বলবেন না। এখানে যারা চিংড়িমাছের চাষ করে, তারা বলছে কাল রাত্তিরে কেউ এদিক থেকে একটা নৌকো নিয়ে নীরমহল গিয়েছিল। তা চিংড়িমাছ ধরবার জন্যে এই যে জলের তলায় বাক্স রেখে দেওয়া হয়, তার নিশানা থাকে তো। নৌকো চালাবার সময় সেই নিশানাগুলো বাঁচিয়ে চলতে হয়। তো যে-ই কাল রাত্তিরে নৌকো নিয়ে ওদিকে গিয়ে থাক, নিশানাগুলো সে বাঁচিয়ে চলেনি। নৌকোর ধাক্কা লেগে তা, অনেকগুলো নাকি ভেসে গেছে। ফলে তারা মুশকিল পড়েছে, কোথায় কোথায় বাক্স পুঁজেছিল, নিশান না থাকায় তার হদিশ করতে পারছে না।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “শুনলুম, আজ ভোর না-হতেই আনারা একবার নীরমহলে গিয়েছিলেন। তা-ই?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে তো তোমাকে বললুমই। কিন্তু না, আমি নজর রেখেছিলুম কিরণবাবু ও-সব নিশানার ধারেকাছেও যাননি।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “সে তো ওরাও বলছে। ওরা রাত জেগে মাছ পাহারা দেয়। ওরা তোমাদের কথা বলছে না। বলছে, তোমরা ওদিকে যাবার তা প্রায় ঘন্টা দুয়েক আগে একটা নৌকো নিয়ে এদিক থেকে কেউ নীরমহলে গিয়েছিল।” 

বলতে যাচ্ছিলুম, যে গিয়েছিল, চিনতে না পারলেও তাকে আমরা দেখেছি। কিন্তু ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাতে তিনি চোখের ইশারায় আমাকে চুপ করে যেতে বললেন। বঙ্কুবাবু বললেন, “কে গিয়েছিল, বুঝতে পারছি না। ওরা বলছে, সে আমাদেরই লোক। কথাটা হয়তো মিথ্যেও নয়। তার কারণ, ট্যুরিস্ট লজে কাল রাত্তিরে শুধু আমরাই ছিলুম।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিশানাগুলো ভেসে যাওয়ায় ওদের খুব ক্ষতি হল।” 

বঙ্কুবাবু তাঁর একখানা হাত তুলে মাছি তাড়াবার মতন একটা ভঙ্গি করে বললেন, “তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। ক্ষতি যখন হয়েছে, তখন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা কি আর হবে না। যা-ই দাবি করুক, দিয়ে দেব। ইন ফ্যাক্ট, কত টাকা ওদের দিতে হবে, পীতাম্বরকে তা আমি জেনে আসতেও বলেছি। না না, ওটা কোনও ব্যাপার নয়। আমি ভাবছি, মাঝরাত্তিরে এখান থেকে কে ওদিকে গেল, আর সে গেলই বা কেন একে তো রামুর মাথা তাক করে ওখানে ইট ছোড়া হয়েছিল, তার উপরে আবার এই ব্যাপার। না হে চারু, এ-সব আমার একটুও ভাল লাগছে না। শেষে না হিতে বিপরীত হয়।” 

“অর্থাৎ?” 

“অর্থাৎ আর কী, ভুবনেশ্বরে ফিরে যাব।” 

“মিসেস ঘোষের ফিল্মের কী হবে?” 

“গুলি মেরে দাও। ফিল্ম হবে না।” 

“না হলে কী হবে, সেটা ভেবে দেখেছ?” এমনিতেই নিচু গলায় কথা বলছিলেন ভাদুড়িমশাই। এবারে গলার স্বর আরও নামিয়ে বললেন, “গোটা প্ল্যানটাই তা হলে ব’নচাল হয়ে যাবে। আর তা ছাড়া, ভুবনেশ্বরই কি খুব সেফ জায়গা? সেখানেও যে রামুর উপরে হামলা হয়েছিল, সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন?” 

“তা বটে।” বঙ্কুবাবু কয়েক মুহূর্তে চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “তা হলে আমাকে কী করতে বলো?” 

“আমি বলি, উদয়পুরে চলো। তাতে আমি আরও একটা দিন সময় পাচ্ছি। এর মধ্যে হয়তো আরও দু-একটা ব্যাপার আমার নজরে আসবে। তেমন বুঝলে আমিই তোমাকে ভুবনেশ্বরে ফিরে যেতে বলব। হয়তো আমিও তখন যেতে চাইব তোমার সঙ্গে।” 

বাথরুম থেকে জল পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল এতক্ষণ। শব্দটা বন্ধ হতেই ভাদুড়িমশাই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “তা হলে ওই কথাই রইল। তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমরা চলি।” 

বঙ্কুবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা নিজেদের ঘরে চলে এলুম। 

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বললুম, “বঙ্কুবাবু খুব ঘাবড়ে গেছেন মনে হল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এমন অবস্থাতে পড়লে সবাই একটু ঘাবড়ায়। এটা কিছু আশ্চর্য ব্যাপার নয়। একটা ছেলে নিখোঁজ। অন্যটার উপরেও দুমদাম হামলা হচ্ছে। যা সব ঘটছে, তাতে কে না ঘাবড়ায় বলুন।” 

“তা বটে।” 

“এখন একটা কথা বলুন দেখি। আমি তো আপনার হয়ে খুব সাফাই গাইলুম, কিন্তু জলার ওই নিশানাগুলো ভাসিয়ে দেবার কাজটা আপনার দ্বারাই হয়নি তো?” 

“মোটেই নয়।” জোরগলায় বললুম, “হতে পারত, যদি না কাল দুপুরেই আপনি আমাকে জানিয়ে দিতেন যে, ওই নিশানাগুলো দেখেই বুঝে নেওয়া হয়, মাছ ধরবার বাক্সগুলো জলের তলায় ঠিক কোন-কোন জায়গায় রেখে দেওয়া হয়েছে। সে-কথা জানবার পরেও নিশানাগুলোকে ডিসটার্ব করব কি ভাসিয়ে দেব, আমি কি এতই বোকা নাকি? 

“অর্থাৎ, এ-কাজটা সে-ই করেছে, আমাদের বেশ খানিকটা আগেই একটা নৌকো নিয়ে যে কিনা এদিক থেকে নীরমহলে গিয়েছিল।” 

বললুম, “তা তো বটেই। কিন্তু সে কে?” 

“এর উত্তর তো সেই আগের কথাতেই দিতে হয়। তাকে আপনিও দেখেছেন, আমিও দেখেছি। কিন্তু একে তো দূর থেকে দেখেছি, তার উপরে আবার আবছা অন্ধকারের মধ্যে দেখা। তাও লোকটার মুখটা ছিল ফেরানো। মুখটা তাই দেখতে পাইনি। তা হলে আর কী করে বলব যে, সে কে। তবে হ্যাঁ, আন্দাজ একটা করেছি। আন্দাজটা যে আর-একটু আগে ঘুম থেকে উঠলে আপনিও করতে পারতেন, তাও বলেছি আপনাকে। কিন্তু না, স্রেফ আন্দাজের উপরে নির্ভর করে এখুনি তাকে শনাক্ত করাটা ঠিক হবে না। বরং আর-একটু দেখি। লক্ষণগুলো আর-একটু মেলাই।” 

ন’টা নাগাদ ব্রেকফাস্ট করতে নামলুম আমরা। উদয়পুরের পথে রওনা হতে-হতে প্রায় দশটা বাজল। গাড়ির সেই একই ব্যবস্থা। বঙ্কুবাবু, মিসেস ঘোষ, রামু আর পীতাম্বর অ্যাম্বাসাডারে। দীপক, রাজেশ আর আমি মারুতিতে। অ্যাম্বাসাডারটা বিজু চালাবে। মারুতির চালক ভাদুড়িমশাই। অ্যাম্বাসাডার আমাদের আগে রওনা হতেই মারুতি তার পিছু ধরল। 

আগরতলা থেকে যে-পথ দিয়ে সিপাইহিজলায় এসেছিলুম, সিপাহিজলা থেকে সাগরমহলে আসার পথের সঙ্গে তার খুব-একটা তফাত চোখে পড়েনি। মাঝে-মাঝে ঢেউ-খেলানো হলেও দুটোই মোটামুটি সমতল। এবারে সাগরমহল থেকে উদয়পুরে যাবার সময় দেখলুম রাস্তার চেহারা ক্রমেই পালটে যাচ্ছে। যা ছিল সমতলভূমি, ক্রমে ক্রমে তার বিস্তার যেন গুটিয়ে যাচ্ছে। এখানে-ওখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে ছোট-বড় সব টিলা। আর একটু বাদেই শুরু হয়ে গেল পাহাড়িয়া পথ। দার্জিলিংয়ের মতো শার্প বেন্ড না-থাকলেও রাস্তাটা একটু ঘোরালোই বটে। ঘুরতে-ঘুরতে কখনও উপরে উঠে যাচ্ছি, কখনও নামছি নীচের দিকে। 

দীপক আর রাজেশ এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি। এবারে পিছন থেকে দীপকের গলা পাওয়া গেল। “মিঃ চ্যাটার্জি, এই রাস্তাটাকে কাজে লাগাবেন না?” 

‘কীভাবে লাগাব?’ 

“ধরুন সামনের ওই অ্যাম্বাসাডারটায় ভিলেন পালাচ্ছে। আর যে হিরো, সে এই মারুতি চালিয়ে ফলো করছে তাকে। একেবারে ব্রেক-নেক স্পিড। উঃ, পাহাড়ের একটু উপর থেকে কিন্তু দারুণ ছবি তোলা যায়।” 

বললুম, “ছবি তো রাজেশের ব্যাপার। …ওহে রাজেশ, তুমি কী বলো?”

রাজেশ কোনও উত্তর দিল না। পিছন ফিরে দেখলুম, সে অকাতরে ঘুমুচ্ছে। 

গোমতী নদী পেরিয়ে একটু বাদেই আমরা উদয়পুরে ঢুকলুম। ত্রিপুরার এটা পুরনো রাজধানী এখানে ত্রিপুরেশ্বরী দেবীর মন্দিরের কাছে একটা রেস্ট-হাউসে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে গিয়ে যে যার ঘরে ঢুকে পড়লুম। আমাদের ঘরে একটা ইজিচেয়ার রয়েছে। ভাদুড়িমশাই তাতে গা ঢেলে দিয়ে বললেন, “রাজেশ কেন ঘুমুচ্ছিল জানেন?” 

“কেন?” 

ভাদুড়িমশাই রহস্যময় হাসলেন। বললেন, “কাল রাত্তিরে ওর একটুও ঘুম হয়নি।” 

১১ 

এই গেস্ট-হাউসটা একতলা, তবে বেশ ছড়ানো। সামনে-পিছনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। একটা বাগানও রয়েছে। সেটায় অবশ্য যত্নের ছাপ বিশেষ নেই। ফুলগাছগুলো যে-যার ইচ্ছেমতো ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে;দেখলেই বোঝা যায় যে, যত্ন করে কেউ তাদের ছাঁটে না। এখানে-ওখানে কিছু আগাছাও জন্মেছে। সেগুলো উপড়ে ফেলা দরকার। ঘাসগুলোও সমানভাবে ছাঁটা নয়। একদিকে একটা লন মোয়ার পড়ে রয়েছে। দেখেই বোঝা যায়, অনেক দিন সেটাকে কেউ কাজে লাগায়নি। 

ম্যানেজারকে এই নিয়ে প্রশ্ন করেছিলুম। তিনি বললেন, যে-লোকটা মালির কাজ করে, পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে সে আগরতলায় গেছে, অথচ এদিকে এক মাস কেটে গেল, তবু ফিরবার নাম নেই। ফলে বাগানের এই হাল। এখন তো তবু বাগান বলে চেনা যাচ্ছে, আর-কিছুদিন যাক, তখন আর জঙ্গলের সঙ্গে এর বিশেষ তফাত থাকবে না। 

বাগানের অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়েছিল ঠিকই, তবে সামনে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। রাস্তার একদিকে এই গেস্ট হাউস, অন্যদিকে একটা বিশাল দিঘি। দিঘিতে নামবার জন্যে বাঁধানো ঘাট রয়েছে। টলটলে জলের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি এই ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে দিঘিতে নেমে যাই। 

ভাদুড়িমশাই আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন নিশ্চয়। তাই মৃদু হেসে বললেন, “সম্ভব নয়।” 

“নয় কেন?” 

“আধ ঘণ্টার মধেই লাঞ্চের ডাক পড়বে। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা লোকেশন বাছাই করতে বেরিয়ে পড়ব।” 

“ও হ্যাঁ, ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে যেতে হবে।” হেসে বললুম, “মিসেস ঘোষ যে লালপেড়ে গরদের শাড়ি পরে, কপালে একটা মস্ত সিঁদুরের টিপ চড়িয়ে পুজোর ডালি হাতে নিয়ে মন্দিরে যাবেন, ছবির এই ভাইটাল দৃশ্যটার কথাই আমার মনে ছিল না।” 

“শুধু এই দৃশ্যটা কেন, অনেক কিছুই ইদানীং আপনার মনে থাকছে না। কিন্তু না, শুধু ত্রিপুরেশ্বরীর নন্দির নয়, খুব পুরনো একটা শিবমন্দিরও রয়েছে এখানে। পোড়ামাটির মন্দির। সেটাও দেখতে হবে। আর তা ছাড়া, এমনিতেও এই শহরটা একটু ঘুরে দেখা দরকার।” 

“তা হলে কখন দিঘিতে নামব?” 

“কেন, বিকেলের দিকে নামলে ক্ষতি কী। নাকি বিকেলে স্নান করলে আপনার শরীর খারাপ হবে?” 

“আর ধুর মশাই, আমার শরীর অত পলকা নয়।”

“তা হলে ওই কথাই রইল। এখন চলুন, ঘরে যাওয়া যাক।” 

গেস্ট হাউসে তিন-বিছানার ঘর নেই। ঘরগুলো বড়ও নয় বিশেষ। তাই বাড়তি একটা খাটও কোথাও ঢোকানো যাচ্ছে না। বঙ্কুবাবুকে এই কথাটা জানাতে তিনি বলেছিলেন, তার দরকারই বা কী, পাঁচটা ডাবল-বেডের ঘর নিয়ে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।” 

তা-ই নেওয়া হয়েছে। একটা ঘরে সস্ত্রীক বঙ্কুবাবু থাকবেন, একটা ঘরে ভাদুড়িমশাই আর আমি, একটা ঘরে রাজেশ আর দীপক, একটা ঘরে পীতাম্বর আর বিজু। পঞ্চম ঘরটা একা রামুর দখলে। বঙ্কুবাবু তাতে অবশ্য রাজি হতে চাইছিলেন না। বারবার বলছিলেন, “রামু কেন একা থাকবে। বরং ও আর ডলি একঘরে থাক, আমি একা শোব।” কিন্তু বঙ্কুবাবু চোখে প্রায় দেখতেই পান না, তেষ্টা পেলে নিজে এক গ্লাস জল গড়িয়ে নেবার ক্ষমতাও তাঁর নেই, তাঁকে তাই একা থাকতে দিতে কেউই রাজি নয়। রামু নিজেই বলল, “না না, সেটা ঠিক হবে না। তা ছাড়া, ভুবনেশ্বরের বাড়িতেও তো আমি একাই থাকি, এখানেও থাকতে পারব।” 

রামু এমনিতে খুবই কম কথা বলে। সত্যি বলতে কী, সিপাহিজলায় অজ্ঞান হয়ে পড়বার পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে আর নীরমহলের ইট ছোড়ার ব্যাপারটার বিবরণ দিতে গিয়ে সেই যে সে কয়েকটা কথা বলেছিল, তার পর থেকে এখনও পর্যন্ত তাকে একবারও মুখ খুলতে দেখিনি। ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে অবশ্য শুনেছিলুম যে, সে একটু চাপা স্বভাবের ছেলে। তাই বলে যে এতই চাপা, সেটা ভাবিনি। তার উপরে লক্ষ করলুম, কথা যেমন কালেভদ্রে বলে, তেমন আবার সেটা বলে খুবই নিচু গলায়। 

দুপুরের খাওয়া ঢুকে যাবার পরে ঘরে ফিরে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে রামুর বিষয়ে কথা হচ্ছিল। বললুম, “আপনি ঠিকই বলেছিলেন। ছেলেটার স্বভাব সত্যি বড্ড চাপা। পরশু সন্ধে থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত মাত্র দু-বার ওকে মুখ খুলতে দেখলুম। দুপুরবেলায় খাওয়ার কথাই ধরুন না। ঝোলটা নুনে-কাটা, ভাতটা ঠিকমতো সেদ্ধ হয়নি, ডালটাও মনে হয় একটু ধরে গিয়েছিল। তাই নিয়ে সবাই কত কথা বলল, ম্যানেজারকে ডেকে পাঠিয়ে ধমকানো হল পর্যন্ত, অথচ আমরা যে সবাই এত চেঁচামেচি করছি, সেদিকে ওর যেন কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই, নিঃশব্দে খেয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল, সামান্য একটা টু-শব্দ পর্যন্ত করেনি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বরাবর কিন্তু এমন ছিল না ছেলেটা। কথা কম বলত ঠিকই, তবে এত কম নয়।” 

“পরিবর্তনটা কবে থেকে হল?” 

“বছর দুয়েক আগে থেকে। আরও স্পষ্ট করে বলি, ওর বি.কম. পাশ করবার খবর বেরুবার পর থেকে।” 

“বি.কম. পাশ করলে কি কম কথা বলতে হয়?” হেসে বললুম, “কই, এমন তো কখনও শুনিনি।”

ভাদুড়িমশাইও হাসলেন। বললেন, “তা নয়, আসলে কী হয়েছিল বলি, গ্র্যাজুয়েট হবার পরেই বঙ্কুর সঙ্গে ওর ঝগড়া বেধে যায়।” 

“কীসের ঝগড়া?” 

“রামু বিলেত যেতে চেয়েছিল। বঙ্কু যেতে দেয়নি।” 

“কেন? ওঁদের তো টাকার অভাব নেই। ইচ্ছে করলে শুধু নিজের ছেলে কেন, পাড়াপড়শির ছেলেদের তো অক্লেশে উনি বিলেত ঘুরিয়ে আনতে পারেন।” 

“আরে মশাই, এটা টাকার ব্যাপার নয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সবটা আগে শুনুন। নইলে আপনি কিছুই ধরতে পারবেন না। একে তো বঙ্কুর চোখ খারাপ, বিস্তর চিকিচ্ছে করিয়েও নাকি দৃষ্টিশক্তির কিছুমাত্র উন্নতি হয়নি, তার উপরে ওর শরীরও ভেঙে পড়েছে। বঙ্কু তাই কিছুদিন ধরেই ভাবছিল যে, বি-কম পাশ করবামাত্র রামুকে তার কারবারে টেনে নেবে। রামুকে সে-কথা স্পষ্ট করে ও জানিয়েওছিল। বলেছিল, বিলেতে গিয়ে লেখাপড়া করা মানে তো আরও বছর পাঁচেকের ধাক্কা, তদ্দিন ও বাঁচবে কি না তারই ঠিক নেই। ও-সব চলবে না। এম.কম. পড়েই বা কী হাতিঘোড়া হবে, বাপ যদি আই.এ. পাশ করে এতখানি করতে পেরে থাকে তো বুঝতে হবে, হাতে-কলমে যা শেখা যায়, সেটাই আসল শিক্ষা। সুতরাং বিলেতের চিন্তায় গুলি মেরে দিয়ে এক্ষুনি রামু তার বাপের সঙ্গে খাতাপত্তর নিয়ে বসে কাজ-কারবার বুঝে নিক। 

“রামু তাতে রাজি হল না, কেমন?” 

“তা-ই কখনও হয়? বঙ্কুরই ছেলে তো, সেও সমান জেদি। বিলেতে যাওয়া হল না বটে, কিন্তু এম.কম.ও পড়ল না, কারবারেও ঢুকল না। লাভের মধ্যে একেবারে গুম মেরে গেল। একটু চাপা স্বভাবের তো ছিলই, কম কথা বলত, নিচু গলায় কথা বলত, সবই মেনে নিচ্ছি, তাই বলে এত অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ওই যে বিলেত যাওয়া আটকে দেওয়া হল, বাস, তারপর থেকেই একেবার মৌনী বাবা হয়ে গেছে।” 

বললুম, “বঙ্কুবাবুই বা অমন করলেন কেন? কোনও মানে হয়? ছেলে তো তাঁর একটা নয়, দুটো রামুর ইচ্ছেয় বাধা না-দিয়ে লক্ষ্মণকে তিনি তাঁর কারবারে টেনে নিলেই তো গোল মিটে যেত। বয়েস তো দুজনের একই। তা হলে আটকাচ্ছিল কোথায়?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “লক্ষ্মণকে আপনি ভাল করে দেখেননি তো, তাই অমন কথা বলতে পারলেন। তার দ্বারা অনেক কিছুই হতে পারে, কিন্তু ব্যাবসা হওয়া সম্ভব নয়। তার ধাতে ওটা নেই সে যদি ইন্ডিয়ার টেস্ট-টিমে ঢুকে পড়ে আর ইনিংস ওপেন করতে নেমে রিচার্ড হ্যাডলির প্রথম বলেই ছক্কা মারে, আমি অবাক হব না। সে যদি মোহনবাগানের হয়ে আই.এফ.এ. শিল্ড খেলতে নেমে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে, আমি বলব, বাঃ, এইরকমই তো হবার কথা ছিল। সে যদি এর পরের এশিয়াডে সাঁতারের ইভেন্ট থেকে গোটা-তিনেক সোনা তুলে আনে, তাতেও আমি বলব, এতে এত অবাক হবার কী আছে। তাই বলে ব্যাবসা? না মশাই, সকলের দ্বারা সব কাজ হয় না, লক্ষ্মণের দ্বারা ব্যাবসা হওয়া সম্ভব নয়। বঙ্কু সে-কথা ভালই জানত। এদিকে রামুও বায়না ধরে বসল, সে বিলেত যাবে।” 

“রামুর বিলেত যাবার কথায় কি এইজন্যেই বঙ্কুবাবু অত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন?” 

“এইজন্যেই।” 

ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বললেন, “যাক, বঙ্কুর সমস্যাটা তা হলে এতক্ষণে আপনি ধরতে পেরেছেন। লক্ষ্মণ তো ক্রিকেট, টেনিস আর সাঁতার নিয়েই মত্ত। পড়াশুনো নামমাত্র করে, পরীক্ষা দেয়, টেনেটুনে পাশও করে যায়, কিন্তু সেই একেবারে বাচ্চা-বয়েস থেকে দেখেছি, খেলার মাঠ আর সুইমিং পুলই তার ধ্যানজ্ঞান। বঙ্কু বুঝে গিয়েছিল, লক্ষ্মণকে দিয়ে ব্যাবসা চলবে না, জোর করে চালাতে গেলে ব্যাবসা দু-দিনে লাটে উঠবে, সে তাই রামুর উপরে ভরসা করে বসে ছিল। তার ফল কী হয়েছে, সে তো দেখতেই পাচ্ছেন।” 

“রাগারাগি না-করে একটু ভাল করে বুঝিয়ে বললে হয়তো কাজ হত। আমার ধারণা, বঙ্কুবাবু সেটা কখনও করেননি।” 

“প্রথমটায় করেনি ঠিকই, কিন্তু পরে বিস্তর বুঝিয়েছে। এমনকী, বঙ্কু যখন দেখল যে, কিছুতেই কিছু হবার নয়, তখন একদিন এমনও বলেছিল যে, ঠিক আছে, রামুর কথাই থাক, বিদেশে গিয়ে পড়াশুনো করুক সে, তবে হ্যাঁ, একটা শর্ট কোর্স করে তাড়াতাড়ি তাকে ফিরে আসতে হবে, যাতে ফিরে এসে তার বাপকে সে জীবিত দেখতে পায়। যাতে বাপের জীবদ্দশায় সে ব্যাবসার কাজকর্ম বুঝে নিতে পারে।” 

“এটা কবেকার ঘটনা?” 

“এও গত অগস্ট মাসের ঘটনা।” 

“যে-ভাবে বলছেন, তাতে মনে হয় গত অগস্টে আরও কিছু ঘটেছিল।” 

ভাদুড়িমশাই ভর্ৎসনার গলায় বলনে, “আরে হি ছ, কিরণবাবু, আপনার হলটা কী বলুন তো? এককালে আপনার .মনারির আমি কত তারিফ করতুম, কিন্তু ইদানীং দেখছি অনেক-কিছুই আপনি মনে রাখতে পারেন না! কালই রাত্তিরে আপনাকে বললুম যে, ভুবনেশ্বরের বাড়ির ছাতে রামুর উপরে ফার্স্ট অ্যাটাকটা হয় গত অগস্ট মাসে, আর আজই সেটা আপনি ভুলে মেরে দিলেন? আরে ধুর মশাই, এই বয়েসে একেবারে বাঁধাকপি হয়ে যাচ্ছেন দেখছি!” 

লজ্জিত গলায় বললুম, “তা হয়তো একটু হয়েছি। বয়েস তো সত্যি নেহাত কম হল না।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ বাজে কথা ছাড়ুন তো, বয়েসে আপনি আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট বই বড় নন। আসল কথা, আপনার মনোযোগ কমে যাচ্ছে। এখন যা বলছি শুনুন। দুটো যে শুধু একই মাসের ঘটনা, তা নয়, একই দিনের ঘটনা। সকালবেলায় বঙ্কু বলল, রামুকে বিদেশে পাঠাতে তার আপত্তি নেই, তবে তাড়াতাড়ি দেশে করে এসে তাকে বাপের কাছ থেকে ব্যাবসার কাজকর্ম বুঝে নিতে হবে, আর সন্ধেবেলাতেই বাড়ির ছাতে রামুর গলা টিপে ধরা হল!” 

“এর মধ্যে কি কোনও কার্যকরণের যোগ রয়েছে?” 

“তা আমি কী করে বলব।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে থাকাটা কিছু বিচিত্র নয়। অন্তত সন্দেহ একটা হতেই পারে। সন্দেহটা ারও জোর পাচ্ছে কেন জানেন?” 

“কেন?” 

“ভেবে দেখুন, কাল খুব ভোরে তো আমরা সিপাহিজলায় একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলুম। ফিরে দেখি আপনার ঘরের বাথরুমের সামনে রামু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তো আজ ভোরবেলায় আপনি যখন স্নান করবার জন্যে বাথরুমে ঢুকেছেন, তখন আমি বঙ্কুর ঘরে চলে আসি। মিসেস ঘেষ তখন ঘরে ছিলেন না। তিনিও স্নান সেরে নিচ্ছিলেন। আপনি যখন আমার খোঁজে বঙ্কুর ঘরে আসেন, তখনও তিনি বাথরুম থেকে বেরোননি।” 

বললুম, “সে তো জানি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যা জানেন না, সেটা এবারে মন দিয়ে শুনুন। যাতে পরে আবার না ভুলে যান। আপনি আসবার আগে বঙ্কু আমাকে একটা কথা বলে, যে-কথার গুরুত্ব হয়তো বঙ্কু নিজেও জানে না।” 

“কী বলেন উনি?” 

“বঙ্কু বলে যে, শরীরের এই অবস্থায় সে যে আর খুব বেশিদিন ব্যাবসার কাজকর্ম সামলাতে পারবে, তা তার মনে হয় না। ছোট ছেলে নিখোঁজ, বড় ছেলে উদাসীন, সে এখন বুঝতে পারছে না যে, কী করা উচিত। তাতে আমি বললুম, রামুকে সে আর-একটু ভাল কবে বুঝিয়ে বলুক যে, বাবার কাছ থেকে এবারে তার সবকিছু বুঝে না-নিলেই নয়। তাতে বঙ্কু বলল, ‘মাগের দিনই সিপাহিজলায় বেড-টি খাবার পরে রামুকে ডেকে পাঠিয়ে কথাটা সে বলতে গিয়েছিল, কিন্তু ভাল করে কথাটা সে পাড়তে পর্যন্ত পারেনি। রামুকে যে এবারে ব্যাবসার কাজকর্ম বুঝে নিতে হবে, এই কথাটা বলবামাত্র সে নাকি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।” 

“বঙ্কুবাবু যখন রামুর সঙ্গে কথা বলবার জন্যে তাকে ডেকে পাঠান, তখন সেখানে আর-কেউ ছিল কি না, বঙ্কুবাবুকে তা আপনি জিজ্ঞেস করেছেন?” 

“তা করেছি বই কী। বঙ্কু বলল, মিসেস ঘোষ তো ছিলেনই, পীতাম্বরও ছিল।” 

“পীতাম্বর লোকটি কেমন!” 

“ভিতরে-ভিতরে কেমন জানি না, তবে বাইরে যা দেখেছি, তাতে খারাপ ক্লবার উপায় নেই। কিন্তু ও-কথা একটু পরে ভাবলেও চলবে। আপাতত যা ভাবছি সেটা ই যে, এগরেও সেই একই ঘটনা ঘটল। রামুকে ডেকে বঙ্কু যেদিন বলল যে, তাকে এবারে ব্যাবসার দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে, সেইদিনই ফের হামলা হল রামুর উপরে। তাও একবার নয়, দু’দু-বার। প্রথম অ্যাটে সিপাহিজলা, দ্বিতীয অ্যাটেম্‌৳ নীরমহলে। একই দিনের সকালে আর বিকেলে। …কী মনে হয় আপনার? দুটো ব্যাপার কি আলাদা? মানে, রামুকে ব্যাবসার দায়িত্ব বুঝে নিতে বলা আর এই মামলা হওয়া, এর মধ্যে কি কোনও যোগ-সম্পর্ক নেই?” 

বললুম, “এটা একটা অ্যাকসিডেন্টাল ব্যাপারও তো হতে পারে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা তো হতেই পারে। তবে কিনা ইংরিজিতে এইরকম একটা কথা আছে যে, দ্য রিপিটিশান অব অ্যান অ্যাকসিডেন্ট রস দ্য অ্যাকসিডেন্ট অব্ ইটস অ্যাকসিডেন্টাল ক্যারেক্টার। তখন সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে, এটা কাকতালীয় ব্যাপার নয়, এর মধ্যে একটা কার্যকারণের যোগসম্পর্ক রয়েছে।” 

ঘরের বাইরে কার গলা পাওয়া গেল। দরজা খুলে দেখলুম, দীপক দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “জিজাজি বললেন, একটু বাদেই সবাই বেরিয়ে পড়ব। আপনারা তৈরি হয়ে নিন।” 

বেরোতে বেরোতে চারটে বেজে গেল। প্রথমেই যাওয়া হল ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দিরে। পাশের দিঘিটি বিশাল। বিরাট-বিরাট সব মাছ তার ঘাটের কাছে কিলবিল করছে। রুই, কাতলা, মৃগেল। কোনওটার ওজন সের পাঁচ-ছয়ের কম হবে না। ওই যে একরকম ভুড়িওয়ালা হলদেটে মাছ আজকাল কলকাতার বাজারে প্রচুর ওঠে, তাও দেখলুম অগুন্তি। মস্ত একটা কচ্ছপও হঠাৎ ঘাটের রানার কাছে ভুশ করে ভেসে উঠল। এ-সব মাছ কেউ ধরে না, ধরবার নিয়মই নেই। ভক্তজনের ছুড়ে দেওয়া মুড়ি আর ময়দার গুলি এরা কপাকপ গিলছে আর নির্বিবাদে নিজেদের ওজন বাড়িয়ে চলেছে। 

মন্দিরে ঢুকতে-ঢুকতে মিসেস ঘোষ হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে সিঁড়িটা ধাপে-ধাপে উঠে গেছে, এটা দেখে রাখুন। হাতে পুজোর থালা নিয়ে এই ধাপগুলোতে পা ফেলে-ফেলে আমি যখন মন্দিরের দিকে এগোব, সামনে কোনও উঁচু জায়গা থেকে তখন ক্যামেরা চলবে। ক্যামেরা প্রথমে ধরবে গোটা ক্রাউডটাকে, তারপর ধীরে-ধীরে আমার চারপাশের লোকজনকে ছেঁটে ফেলে শুধু আমাকে। তারপর এক সময় আমার গোটা শরীরটা বাদ দিয়ে শুধু মুখখানা।” 

মিসেস ঘোষ আজ লালপেড়ে গরদের শাড়ি পরে আসেননি। তবে মন্দিরে গিয়ে প্রণামটা খুবই ভক্তিভরে করলেন। শানের উপরে মাথা রেখে অনেকক্ষণ যেভাবে স্থির হয়ে রইলেন, তাতে মনে হল, কী জানি, যে-ছবিটা তুলবেন বলে এখানে এসেছেন, সেটা একটা ‘সুপার হিট’ হয়তো হলেও হয়ে যেতে পারে। 

স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে অবশ্য এখানকার পুরনো শিবমন্দিরটি অনেক বেশি দ্রষ্টব্য। কয়েক শো বছরের প্রাচীন মন্দির, দেওয়ালে ফাটল ধরেছে, বটের চারাও শিকড় ছড়িয়েছে এখানে-ওখানে, কিন্তু সেই বিধ্বস্ত মহিমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে যেন চোখের পলক পড়তে চায় না। পুরনো এই মন্দিরটি অবশ্য পরিত্যক্ত, তার পাশে একটি নতুন শিবমন্দির তৈরি করে সেখানে পুজোর ব্যবস্থা হয়েছে। ভক্তের ভিড় সেই নতুন মন্দিরেই বেশি, মিসেস ঘোষও সেখানেই পুজো দিতে ঢুকলেন। তারপর খানিক বাদে মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে বললেন, “এটিকেও কিন্তু গল্পের মধ্যে ঢোকানো চাই।” 

বললুম, “কীভাবে ঢোকাব?” 

“সে আর এমন শক্ত কী,” মিসেস ঘোষ বললেন, “একটা স্বপ্নাদেশের ব্যবস্থা করলেই তো হয়। হিরোইন যখন ঘুমোচ্ছে, তখন একটা ড্রিম-সিকোয়েন্স রাখুন। স্বপ্নের মধ্যে মহেশ্বর এসে বলবেন যে, হিরোইন তাঁর পুজো করলেই হিরোর বিপদ কেটে যাবে। আর ঘুম থেকে উঠেই হিরোইন ছুটে আসবে এই মন্দিরে… বাস্, আপনার কাজ হয়ে গেল।” 

বললুম, “ঠিক আছে। হয়ে যাবে।” 

গেস্ট হাউসে যখন ফিরলুম, বিকেল তখনও ফুরিয়ে যায়নি। সামনের বারান্দায় বসে চা খাওয়া হল সবাই মিলে। রাস্তার ওদিকে বিশাল দিঘি। ঘাটে নেমে স্নান করছে অনেকে। জলের উপর দিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢেউয়ের বৃত্ত। দেখতে-দেখতে নেশা ধরে যায়। মনে হয়, যাই, খানিক জল ঝাঁপিয়ে আসি। 

একই কথা দীপক আর রাজেশেরও মনে হয়েছিল নিশ্চয়। হঠাৎ একইসঙ্গে উঠে দাঁড়াল তারা। দীপক বলল, “আপনারা বসুন, আমি আর রাজেশ একটু সাঁতার কেটে আসি।” তারপর রামুর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমিও যাবে নাকি ভাঞ্জা?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “না না, রামুর গিয়ে কাজ নেই। পরশু ওর একটু সর্দিজ্বর-মতো হয়েছিল, গলাও ভেঙেছে, এই অবেলায় স্নান করলে ফের জ্বর বাধিয়ে বসবে। তা ছাড়া ও তো সাঁতারই জানে না।”

দীপক বলল, “তাই তো, আমার খেয়ালই ছিল না। ভাঞ্জা তা হলে আপনাদের সঙ্গে কথা বলুক, আমরা যাই।” 

রাজেশকে নিয়ে নিজেদের ঘরের দিকে চলে গেল দীপক। খানিক বাদে দু’জনে যখন ফের বেরিয়ে এল, তাদের পরনে তখন সুইমিং ট্রাঙ্ক। গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে তারা দিঘির দিকে চলে গেল। 

ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললুম, “আমরাও ওদের সঙ্গে গেলে পারতুম।” 

ভাদুড়িমাশাই বললেন, “থাক গে, এখন আর ইচ্ছে করছে না।” 

কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। তারপর বঙ্কুবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, “জানো চারু, এইসব সময়েই যেন লক্ষ্মণের কথাটা আরও বেশি করে মনে পড়ে যায়। ছেলেটা দারুণ সাঁতার কাটত।” 

আমরা চুপ করে রইলুম। রামু একবার মুখ তুলে তাকাল বাবার দিকে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার মুখ নামিয়ে নিল। কিছু বলল না। 

ভাদুড়িমশাই সম্ভবত লক্ষ্মণের প্রসঙ্গটাকে চাপা দিতে চাইছিলেন। সম্ভবত তিনি চাইছিলেন না যে, যে-ছেলে হারিয়ে গেছে, যাকে আর ফিরে পাবার কোনও সম্ভাবনাই হয়তো নেই, তার কথা ভেবে-ভেবে বঙ্কুবাবু আরও মন খারাপ করুন। বললেন, “চলো বঙ্কু, ঘরে যাওয়া যাক।” 

বারান্দা থেকে সবাই আমরা যে-যার ঘরে চলে এলুম। 

সুরটা একটু কেটে গিয়েছিল, তাই ঘরে ফিরেও আর কথাবার্তা বিশেষ জমল না। ভাদুড়িমশাই তাঁর সুটকেস থেকে একটা ফাইল বার করে নিয়ে চুপচাপ তার কাগজপত্রগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন। 

একটা ব্যাপার দেখে একটু অবাকই হয়েছিলুম। রাম আর লক্ষ্মণ, এদের কেউই মিসেস ঘোষের নিজের ছেলে নয়। কিন্তু তা না-ই হোক, পাঁচ বছর বয়েস থেকে তিনি যে এদের কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, সেটা তো অস্বীকার করা যাচ্ছে না। সেই ছেলে দুটোর মধ্যে একটা নিখোঁজ, আর অন্যটার উপরেও ক্রমাগত হামলা হচ্ছে, মিসেস ঘোষ তবু নির্বিকার, তা নিয়ে যেন কোনও ভাবনাই তাঁর নেই। ভদ্রমহিলার একমাত্র ভাবনা দেখছি নিজেকে নিয়ে। কী করে তিনি হিরোইনের রোলটা পাবেন, কোন্ দৃশ্যে কী পোশাক পরবেন, কোত্থেকে তাঁর মুখের উপর ক্যামেরা চার্জ করতে হবে, বাস্, এসে অবধি দেখছি যে, স্রেফ এই নিয়েই তিনি মত্ত। দেখে যে শুধু অবাক হচ্ছিলুম তা নয়, ব্যাপারটা ঘোর বিসদৃশও লাগছিল। ভেবেছিলুম, ভাদুড়িমশাইকে যখন একা পাওয়া গেছে, তখন এই নিয়ে দু-একটা কথা বলব। কিন্তু যে-রকম একমনে তিনি তাঁর ফাইল দেখছেন, তাতে আর কিছু বলা গেল না। কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে কয়েকটা নিউজ-ম্যাগাজিন কিনে এনেছিলুম, এখনও সেগুলোর উপরে চোখ বুলোনো হয়নি। হ্যান্ডব্যাগ থেকে তারই একটা বার করে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে তার পাতা ওলটাতে লাগলুম। 

রাত্তিরের খাওয়ার ডাক পড়ল সাড়ে-নটায়। রান্না এবেলাও সুবিধের হয়নি। বঙ্কুবাবু তা নিয়ে দু-একটা মন্তব্যও করলেন। তা ছাড়া আর খাওয়ার টেবিলে বিশেষ কোনও কথা হল না। 

খাওয়া শেষ হতে-হতে দশটা। ভেবেছিলুম, এবারে হয়তো ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে দু-একটা কথা বলা যাবে, কিন্তু তাও বলা গেল না। ঘরে ফিরেই আবার তিনি তাঁর ফাইল টেনে নিয়ে পড়তে বসে গেলেন। 

বললুম, “ওটা শেষ হতে আর কতক্ষণ লাগবে?” 

ফাইল থেকে চোখ না-তুলেই ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার দেরি হবে। আপনি শুয়ে পড়ুন। কাল আবার সকাল-সকাল উঠতে হবে।” 

অগত্যা শুয়ে পড়লুম। ঘুমে চোখ বুজে এল প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই। কতক্ষণ ঘু?য়েছিলুম, জানি না, হঠাৎ একটা মৃদু ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। বললুম, “কে?” 

“আমি চারু। একটু উঠুন তো।” 

ধড়মড় করে উঠে বললুম, “কী ব্যাপার?” 

“আস্তে কথা বলুন। একটু বাইরে যেতে হবে।” 

নিজেদের ঘর থেকে নিঃশব্দে বারান্দায় বেরিয়ে আমরা রামুর ঘরের সামনে গিয়ে থামলুম। সামান্য ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে ভাদুড়িমশাই তাঁর পেনসিল-টর্চ জ্বাললেন। রামুর বিছানা খালি। অ্যাটাচ্‌ড বাথরুমটায় টর্চ ফেলে দেখা গেল, সেখানেও কেউ নেই। 

কোথায় গেল ছেলেটা? জিজ্ঞাসু চোখে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাতে তিনি ঠোঁটে আঙুল তুলে আমাকে কথা বলতে নিষেধ করলেন। টর্চ ঘুরিয়ে গোটা ঘরটা দেখে নিলেন কয়েকবার। টেবিলের উপরে অ্যাকাউন্টেন্সির একটা বই আর একজোড়া চশমা পড়ে রয়েছে। বই আর চশমাটা তুলে নিয়ে ভাদুড়িমশাই দেখলেন। আমাকে দেখালেন। তারপর আবার যথাস্থানে রেখে দিয়ে চাপা গলায় বললেন, “চলুন, ঘরে যাওয়া যাক।” 

রামুর ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা ফের আগের মতোই ভেজিয়ে রেখে আমরা নিজেদের ঘরে ফিরে এলুম। 

১২ 

ভোর পাঁচটায় ভাদুড়িমশাই আবার ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন আমার। বললেন, “চলুন, একটু ঘুরে আসা যাক।” 

বললুম, “দেখুন মশাই, কাল মাঝরত্তিরে একবার আপনি আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছেন। এখন আবার সেই এক কান্ড। এ তো দেখছি মহা জ্বালাতনের ব্যাপার হল!” 

“সে তো মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটের জন্যে ঘুম ভাঙিয়েছিলুম। তারপর ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়েই তো ঘুমিয়ে পড়লেন। নিন নিন, যথেষ্ট ঘুমিয়েছেন, এবারে লক্ষ্মীছেলের মতো উঠে পড়ুন দেখি।” 

“বেড-টি না-খেয়েই?” 

“বেড-টি এখানে সাতটার আগে দেবে না। ততক্ষণ কি ঘুমোবেন নাকি? চলুন, রাস্তার কোনও দোকান থেকে বরং চা খাওয়া যাবে।” 

মুখে-চোখে জল দিয়ে, গেস্ট হাইস থেকে বেরিয়ে এসে অবশ্য মনে হল যে, কাজটা নেহাত খারাপ করিনি। বেরোবার আগে রামুর দরজাটা সামান্য ঠেলে দেখলেন ভাদুড়িমশাই। ভিতর থেকে সেটা বন্ধ। বাইরে ভোরের হাওয়া বইছে। এমন হাওয়া কলকাতায় আমরা পাই না। তার উপরে আবার আমি থাকি শেয়ালদা পাড়ার গলিতে, মানুষজনের নিশ্বাসে আর ডিজেলের ধোঁয়ায় বাতাস সেখানে সর্বক্ষণই গরম হয়ে থাকে। বছর কয়েক আগেও দেখেছি, অন্তত সন্ধের দিকে কলকাতায় একটা গা-জুড়োনো ঠান্ডা হাওয়া বইত। ইদানীং সেটার ছোঁয়াও আর বিশেষ পাই না। 

দিঘির পশ্চিম পাড়ের রাস্তা দিয়ে আমরা এগোচ্ছিলুম। ভাদুড়িমশাই বললেন, “এই রকমের আরও কয়েকটা বড়-বড় দিঘি রয়েছে এই উদয়পুরে। সবই রাজাদের আমলের।” 

“সিপাহিজলাতেও তো বিশাল একটা দিঘি দেখলুম।” 

“তা দেখেছেন। তবে কমলাসাগরটা এখনও দেখা হয়নি।”

“ওটা তো কসবার কালীবাড়ির কাছে। তাই না?” 

“রাইট।” 

“ওটার কথা শঙ্করের কাছে শুনেছি। কমলাসাগরে কীভাবে জল উঠল, তাই নিয়ে একটা গল্পও শুনেছি শঙ্করের কাছে। তবে দেখা হয়নি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আজ তো আমরা আগরতলায় ফিরে যাচ্ছি। দেখি যদি ফেরার পথে কমলাসাগরটা আপনাকে দেখিয়ে দেওয়া যায়। জায়গাটা একেবারে বাংলাদেশের বর্ডারে।” 

কথা বলতে-বলতে গেস্ট হাউসের সামনের দিঘিটা ত এরা পেরিয়ে এসেছিলুম। তারপরেই আবার আর-একটা দিঘি। সেটাও মস্ত বড় 

বললুম, “ব্যাপার কী বলুন তো। কুমিল্লা সম্পর্কে এককালে শুনতুম যে, জায়গাটা নাকি ফেমাস ফর ইটস ব্যাঙ্কস অ্যান্ড ট্যাঙ্কস। তা ত্রিপুরার শহরগুলোও দেখছি, ব্যাঙ্ক না হোক, ট্যাঙ্কের ব্যাপারে মোটেই পিছিয়ে নেই। ওরেব্বাবা, এ তো দিঘির পর দিঘি!” 

“তা যা বলেছেন!” ভাদুড়িমশাই হাসলেন, “এখানকার দিঘি সত্যি দেখার মতো।” 

“এত দিঘি কেন? জলের কষ্ট মেটাবার জন্য?” 

“সেটা অবশ্যই একটা কারণ, তবে আসল কারণ নয়।” 

“আসল কারণটা কী?” 

“আসল কারণ লোকজনকে কাজে লাগাবার এটাই ছিল একটা মস্ত উপায়। বিশেষ করে অজন্মার বছরে। ফসল ভাল হয়নি, দুর্ভিক্ষের লক্ষণ দেখা দিয়েছে, গাঁ-গঞ্জ ঝেঁটিয়ে লোকজন চলে আসছে রাজধানীতে, এই অবস্থায় রাজকোষ থেকে সাহায্য না-দিয়ে উপায় থাকত না। তো সেই সাহায্য কীভাবে দেওয়া হবে? ভিক্ষে হিসেবে দেওয়া যায়। কিন্তু কারও পক্ষেই সেটা সম্মানের হয় না। না রাজার পক্ষে, না প্রজার পক্ষে। তার চেয়ে বরং কাজের ব্যবস্থা করো। নতুন একটা দিঘি হোক, নতুন একটা রাস্তা হোক। প্রজাদের সেই দিখি কাটাবার কি রাস্তা বানাবার কাজে লাগিয়ে দাও। তারা কাজ করুক, কাজের বিনিময়ে রাজার গোলা থেকে ধান নিয়ে যাক। ওই যাকে টেস্ট রিলিফ বলা হয়, সেই ব্যাপার আর কী। এতে একদিকে যেমন প্রজারা বেঁচে যেত, অন্যদিকে তেমন দেখতে-দেখতে তৈরি হয়ে যেত বিশাল সব দিঘি, কিংবা বিরাট সব রাস্তা।” 

বললুম, “রাজতন্ত্রের হয়ে ওকালতি করছেন না তো?” 

ভাদুড়ি মশাই ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, “আপনি তা-ই বুঝলেন? বলিহারি বুদ্ধি আপনার। আরে মশাই, রাজতন্ত্র গেছে, আপদ গেছে। কিন্তু তাই বলে আবার এমন কথা ভাববেন না যে, রাজারা সবাই মানুষ হিসেবে ছিলেন অতি পাষন্ড। না মশাই, তাঁদের মধ্যেও বিস্তর ভাল মানুষ ছিলেন। এমন মানুষ, প্রজাদের সুখ-দুঃখের কথাটা যাঁরা ভাবতেন। শুধু ফূর্তিফার্তা করেই তাঁরা সময় কাটাতেন না। বাট দেয়ার রোল হ্যাজ বিন প্লেড আউট। পৃথিবী জুড়ে এখন চলছে মন্ত্রিতন্ত্র। কিন্তু সমস্যা কি তাতে মিটেছে? মন্ত্রীরাই যে সবাই একেবারে নিপাট সজ্জন, তাও কি আমরা বলতে পারছি? বুকে হাত দিয়ে বলুন দেখি, মন্ত্রীরা সবাই খুব অনেস্ট লোক? তাঁরা কি কেউ ঘুষ খান না? তাঁরা কেউ দলের স্বার্থে দেশকে ডোবান না? তাঁরা কেউ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নেন না? …কী হল, চুপ করে রইলেন কেন?” 

বললুম, “আপনার কথাগুলো ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ঠিক আছে, এ-সব কথা তা হলে থাক। মিসেস ঘোষের ফিল্ম নিয়েই বরং আলোচনা করি।” 

বললুম, “ফিল্ম যে কী হবে, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। ও নিয়ে আর কোনও কথা বলে লাভ নেই। আর বললেই যে মিসেস ঘোষ সে-কথায় কান দেবেন তাও মনে হয় না। ওটাও তাই মুলতুবি থাক। আমি আসলে রামুর কথা ভাবছি।” 

“অর্থাৎ মাঝরাতিরে রামু তার ঘর থেকে কোথায় গিয়েছিল, এই তো?” 

“হ্যাঁ।” 

“প্রশ্নটার উত্তর আমার জানা নেই, তবে জেনে যাব নিশ্চয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে অন্য একটা উত্তরের কিছুটা আভাস পেয়েছি।” 

“সে কী?” 

“এখন বলব না।” ভাদুড়িমশাই হাসলেন, “আগে নিশ্চিত হই যে, উত্তরটা কারেক্ট, তারপর বলব। …কিন্তু না, আর নয়। এবারে ফেরা যাক।” 

“রাস্তার কোনও দোকান থেকে আমাকে চা খাওয়াবেন বলেছিলেন।” 

“এদিকে তো একটাও দোকান এখনও চোখে পড়ল না। চলুন, গেস্ট হাউসে ফিরে গিয়ে বরং চা খাবেন।” 

গেস্ট হাউসে ফিরতে-ফিরতে প্রায় সাতটা বাজল। দেখলুম, সামনের বারান্দায় বসে সবাই গল্প করছেন। আমাদের দেখে দীপক বলল, “আসুন, আসুন! আমাদের এক-রাউন্ড চা ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “বোসো, চারু। মিঃ চ্যাটার্জি, আপনিও বসুন। …ডলি, আর-এক রাউন্ড চা দিতে বলো।” 

দীপক বলল, “দিদি তো একটু আগে ভিতরে চলে গেল।” 

“ঠিক আছে, তা হলে তুমিই গিয়ে চায়ের অর্ডারটা দিয়ে এসো। …তারপর চারু, তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিশেষ কোথাও নয়। আসলে অনেক দিনের অব্যেস তো, ভোরবেলায় উঠে মাইল কয়েক হেঁটে না এলে আমার শরীরের জড়তা ঠিক কাটতে চায় না। …তা, কী নিয়ে তোমাদের কথা হচ্ছিল?” 

চায়ের অর্ডার দিয়ে দীপক ইতিমধ্যে ফিরে এসেছিল। উত্তরটা সে-ই দিল। বলল, “সাঁতার নিয়ে। কাল সন্ধেয় সাঁতার কেটে খুব ভাল লেগে গিয়েছিল আমাদের। আমি আর রাজেশ মাঝরাত্তিরে তাই আবার গিয়ে দিঘিতে নেমেছিলুম। ভাঞ্জাও সঙ্গে ছিল। ওকে ডাকতে বলল, ‘আমি তো সাঁতার কাটতে জানি না, তবে চলো, সঙ্গে যাচ্ছি তোমাদের, পাড়ে বসে থাকব।’ তা, ভাঞ্জাও খুব এনজয় করেছে।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাঃ, এ তো খুবই ভাল কথা। আমাদের যদি ডাকতে তো আমরাও গিয়ে নেমে পড়তুম। …তো রামু, আমি বলি কী, তুমিও এবারে সাঁতারটা শিখে নাও। ওর চেয়ে ভাল এক্সারসাইজ আর হয় না।” 

রামু লাজুক হাসল। কিছু বলল না। 

বঙ্কুবাবু বললেন, “তোমার চারুকাকা ঠিক কথাই বললেন। শুধু পড়াশুনোয় ভাল হলেই হয় না, শরীরটাও মজবুত রাখা চাই।” 

চা এসে গিয়েছিল। চটপট খেয়ে ভাদুড়িমশাই উঠে পড়লেন। বললেন, “তোমরা কি আর কিছুক্ষণ “বসবে এখানে?” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “একটু বসি। ঘরে গিয়ে আর কী করব, খানিক বাদেই তো ব্রেকফাস্টের ডাক পড়বে। ততক্ষণে বরং দীপক আর রাজেশের সঙ্গে কথা বলা যাক।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমরা তা হলে টুকিটাকি দু-একটা কাজ সেরে নিই ততক্ষণে। আসুন, কিরণবাবু।” 

করিডর দিয়ে আমরা ঘরের দিকে পা বাড়ালুম। ভাদুড়িমশাই কিন্তু ঘরে ঢুকলেন না। বললেন, “আপনি ঢুকে যান, আমি এক্ষুনি আসছি।” 

ভাদুড়িমশাই ঘরে ফিরলেন মিনিট খানেকের মধ্যেই। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বললেন, “মিস্টিরিয়াস ব্যাপার।” 

বললুম, “কোথায় গিয়েছিলেন?” 

“দীপকের ঘরে। মাঝরাত্তিরে যারা জলে নেমেছিল, তাদের সুইমিং ট্রাঙ্ক দুটো তো এর মধ্যেই শুকিয়ে যাবার কথা নয়। কিন্তু ওদের বাথরুমে যে দুটো সুইমিং ট্রাঙ্ক ঝুলছে দেখলুম, সে দুটো একেবারে শুকনো খটখটে। ঘরে কিংবা বাথরুমে অন্য কোনও ভিজে কাপড়ও দেখলুম না!” 

“তার মানে?” 

“তার মানে মাঝরাত্তিরে ওরা দিঘিতে নামেনি।” 

১৩ 

ব্রেকফাস্ট টেবিলে বঙ্কুবাবু বললেন, “চারু, খানিক বাদেই তো আমরা রওনা হচ্ছি, তবে আজকের ফ্লাইটে কলকাতায়, ফিরব না। আজ আমাদের আগরতলায় থাকতে হবে। কলকাতায় ফিরব কাল বিকেলের ফ্লাইটে। তোমার কিংবা কিরণবাবুর তাতে কোনও অসুিবধে নেই তো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার সুবিধে-অসুবিধে নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। কিরণবাবুকে নিয়েও ভাববার কিছু নেই; বাড়তি এক-আধ দিন যে থাকতে হতে পারে, তা আমি ওঁকে বলেই রেখেছি।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “ধন্যবাদ। আপনার কাছে আমার অনেক ঋণ জমা হয়ে রইল।” 

কথাগুলি অবশ্যই আমার উদ্দেশে বললেন, কিন্তু আমি যেহেতু এতক্ষণ কোনও কথা বলিনি, তাই বঙ্কুবাবু বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে, ব্রেকফাস্ট টেবিলের ঠিক কোনখানে আমি বসে আছি। ধন্যবাদটা তাই খানিকটা স্বগতোক্তির মতো শোনাল। 

আমি বললুম, “একটা দিন বাড়তি যদি আগরতলায় থাকি, তাতে আমার সুবিধেই হবে। আর-কিছু না হোক, স্টোরিটা কোত্থেকে কীভাবে শুরু হবে, সেটা অন্তত ভেবে নিতে পারব। বাট অফ কোর্স ইট উইল বি ডান্ অন দ্য বেসিস অব দ্য প্লট দ্যাট আই হ্যাভ রিসিভড ফ্রম মিসেস ঘোষ।” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “আমার একটা আবদার আছে কিন্তু। সেটা আপনাকে রাখতে হবে।”

“বলুন।” 

“ছবির টাইটেলে গল্পের ক্রেডিট-লাইনটা কিন্তু আমাকেই দিতে হবে।” 

বললুম, “বিলক্ষণ। গল্প তো আপনারই, আমি সেটা লিখে দিচ্ছি বই তো নয়।” 

মিসেস ঘোষ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বললেন, “বাস্, তা হলে ওই কথাই রইল। আমি এখন ঘরে চললুম। একটু বাদেই তো রওনা হচ্ছি, তৈরি হয়ে নিতে হবে।”

রাজেশ, দীপক আর রামুও ডাইনিং হল থেকে নিজেদের ঘরে চলে গেল। 

বঙ্কুবাবু ঘরে যাবেন বলে পীতাম্বরকে ডাকতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু বোসো, বঙ্কু। দু-একটা কথা আছে। তুমি কি আজ আমাকে ঘন্টা খানেক সময় দিতে পারবে? কয়েকটা প্রশ্ন ছিল। …না না, ঘরে এখন কেউ নেই। যা বলবার, স্বচ্ছন্দে বলতে পারো।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “প্রশ্নগুলো কী নিয়ে?” 

“যে জন্যে তুমি আমার সাহায্য চাও, তাই নিয়ে। একটু ডিটেলসে তোমার সঙ্গে কথা বলা দরকার।” 

“সেটা কি এখন সম্ভব? একটু বাদেই তো আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি।” 

“ঠিকই বলেছ, এখানে সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যাপারটাকে আর পিছিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। আগরতলায় আমরা কোথায় থাকব?” 

“হোটেলে। সেখানে পাঁচটা ঘর নিয়ে রাখা হয়েছে।” 

“চমৎকার। সেখানে কোনও একটা সময়ে কোনও একটা অজুহাত দেখিয়ে আমাদের ঘরে তোমাকে চলে আসতে হবে।” 

“কী অজুহাত দেখাব?” 

“বলবে যে, ডিরেকশান আর স্ক্রিপ্‌ট-রাইটিংয়ের পেমেন্ট নিয়ে আমাদের সঙ্গে তোমার দু-একটা কথা বলা দরকার।” 

“ঠিক আছে।” বঙ্কুবাবু বললেন, “কিন্তু একটা কথা সত্যি করে বলো। রামুর বোনও বিপদ ঘটবার আশঙ্কা নেই তো?” 

“ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, ওর জন্যে তো ‘মামিই আছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে ওই কথাই রইল। …দাঁড়াও, নিজে উঠবার চেষ্টা কোরো না, পীতাম্বরকে ডেকে দিচ্ছি।” 

পীতাম্বর ঘরের বাইরেই অপেক্ষা করছিল। ডাকবামাত্র সামনে চলে এল।। 

ঘরে এসে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কোনও কাজ কি বাকি পড়ে আছে?” 

চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললুম, “না। স্নান-টান সবই তো করে নিয়েছি। হ্যান্ডব্যাগে যা-কিছু ঢোকাবার ছিল, তাও ঢোকানো হয়ে গেছে।” 

“অর্থাৎ আপনি রেডি?” 

“একদম রেডি।” 

“তা হলে শুয়ে পড়ুন।” 

“বেরিয়ে পড়তে হবে না?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আপনার পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতাও দেখছি আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।” 

“তার মানে?” 

“মানে আর কিছুই নয়, মিসেস ঘোষ যে প্রসাধন-পর্ব না-সেরেই আজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে চলে গিয়েছিলেন, সেটাই আপনি খেয়াল করে দেখেননি। তাঁর মেক-আপ শেষ হতে অন্তত আধ ঘন্টা লাগবে। বঙ্কুদের ঘরের দরজা তো হাট করে খোলাই ছিল। আসবার সময় এটাও আপনার চোখে পড়তে পারত যে, সবকিছু সেখানে ছত্রখান হয়ে পড়ে আছে। সে-সব গোছগাছ করে নিতে তা ধরুন আরও আধঘন্টা তো লাগবেই। সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল?” 

“এক ঘন্টা।” 

“এখন ন’টা বাজে। তার সঙ্গে এক ঘন্টা যোগ করলে হয় দশটা। কিরণবাবু, আপনি লম্বা হোন, দশটার আগে আমরা এখান থেকে রওয়া হচ্ছি না।” 

শুয়ে পড়ে বললুম, “যা, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না না, আমি আপনাকে শুয়ে পড়তে বলেছি ঠিকই, কিন্তু তাই বলে যেন নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়বেন না। বরং শুয়ে-শুয়ে একটু চিন্তা করুন।” 

“কী নিয়ে চিন্তা করব? মিসেস ঘোষের ওই কিম্ভূত প্লটটা কীভাবে ডেভেলাপ করব, তাই নিয়ে?”

“ও নিয়ে চিন্তার কী আছে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যেভাবে প্রাণ চায়, ডেভেলাপ করুন। ড্রিম সিকোয়েন্সের মধ্যে যখন একবার মহাদেবের আবির্ভাব হয়েছে, তখন আর তাঁকে নেহাত স্বপ্নের মধ্যে আটকে রাখবেন না। তাঁকে বাস্তবে নিয়ে আসুন। দেখিয়ে দিন যে, বড়লোকটার লেঠেলরা যখন হিরোকে ধরে পেটাচ্ছে, তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে হিরোইন খুব করুণ গলায় একটা গান গাইতে লাগল। তা প্লে-ব্যাকে লতা মঙ্গেশকর গাইবে তো, মহাদেব তাই আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারলেন না। কৈলাস থেকে নেমে এসে তিনি লতার গানের সঙ্গে তাল রেখে তান্ডব নাচতে লাগলেন আর ত্রিশূল দিয়ে সমানে সেই লেঠেলগুলোকে বেধড়ক পেটাতে লাগলেন।” 

বললুম, “আর ইউ সিরিয়াস?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আরে দূর মশাই, আপনিও যেমন! মিসেস ঘোষের কথায় সায় দিয়ে যাচ্ছেন, বেশ করছেন, তাই বলে কি ওই রদ্দি প্লটের উপরে কোনও ছবি হয় নাকি? হয় না। আপনাকেও অতএব ওর উপরে স্টোরি-ফোরি লিখতে হবে না। তার বদলে একটা কথার জবাব দিন দেখি।” 

“বলুন।” 

“দীপককে আপনার কেমন লাগছে?” 

“খারাপ কেন লাগবে। একটু সিনেমা-পাগ্‌লা আছে ঠিকই, তবে কিনা যা ব্যাকগ্রাউন্ড আর যা বয়েস, তাতে সেটাই তো স্বাভাবিক। দীপকের একটা কথা শুনলে অবশ্য হাসি পেয়ে যায়।” 

“কোন্ কথাটা? ভাঞ্জা?” 

“ঠিক ধরেছেন। যখনই ও রামুকে ভাঞ্জা বলে, তখনই আমার টিভি-সিরিয়ালের মহাভারতের কথা মনে পড়ে যায়। শকুনির ভুমিকায় গুপি পেন্টালের মুখখানাও তক্ষুনি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কী বলব মশাই, অনেক কষ্টে তখন হাসি চেপে রাখতে হয়।” 

“ভাগ্নেকে ভাঞ্জা বলবে, তাতে হাসির কী আছে। ওটা বাদ দিন, এমনিতে ওকে আপনার কেমন লাগে?” 

“বললুমই তো। খারাপ লাগে না।” 

“টাকার জন্যে ও কাউকে খুন করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”

চমকে উঠে বললুম, “খুন? কাকে খুন করবে?” 

“ধরা যাক রামুকে।” 

“কেন, রামুকে ও খুন করবে কেন?” 

“নাঃ, শুধু যে আপনার মেমারির ধার আর পাওয়ার অব অবজারভেশান কমে গেছে, তা নয়, কিরণবাবু, আপনার বুদ্ধিও আগের তুলনায় অনেক ভোঁতা হয়ে গেছে দেখছি।” 

বুঝলুম, প্রতিবাদ করে কোনও লাভ হবে না। তা ছাড়া, কথাটা যে একেবারে মিথ্যে, তাও হয়তো নয়। অন্তত বাসন্তী এই কথাটা আজকাল প্রায়ই বলে। তাই মিনমিন করে বললুম, “আমার কথা ছাড়ুন। দীপক যে রামুকে খুন করতে পারে, এই কথাটা আপনার কেন মনে হচ্ছে?” 

“আমার যে অমন কথা মনে হচ্ছে তা কিন্তু আমি বলিনি। আমি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখছিলুম।” 

“ঠিক আছে, ধরে নেওয়া গেল যে, দীপক রামুকে খুন করতে পারে। অন্তত এমন একটা সম্ভাবনার কথাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু একটা মোটিভ থাকা চাই তো। সেটা কী?” 

“মোটিভ অনেক-কিছুই হতে পারে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার মধ্যে যেটা অভিয়াস, সেটার কথাই ভাবা যাক। আপনাকে যা বলেছি, তার থেকে আপনি নিশ্চয় বুঝেছেন যে, বঙ্কু এখন কোটি-কোটি টাকার মালিক।” 

“তা বুঝেছি।” 

“ভাল। এখন এটাও আপনি স্বচক্ষে দেখছেন যে, বঙ্কুর শরীর মোটেই ভাল যাচ্ছে না। একে তো ও চোখে খুবই কম দেখতে পায়, তার উপরে ওর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে।” 

“হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।” 

“চমৎকার। তো বঙ্কু যদি এখন মারা যায়, তা হলে সেই কোটি-কোটি টাকা কে পাবে?”

বললুম, “এ কি একটা প্রশ্ন হল নাকি? বঙ্কুবাবু যদি অন্যরকম কোনও উইল না করে মারা যান, তা হলে টাকাটা পাবেন মিসেস ঘোষ আর বঙ্কুবাবুর দুই ছেলে।” 

“বাঃ, ঠিক বলেছেন। কিন্তু বঙ্কুর ছোট ছেলে যে নিরুদ্দেশ, সেটা ভুলে যাবেন না। সে যদি আর ফিরে না আসে, তা হলে? টাকাটা তখন বঙ্কুর বউ আর বড় ছেলে পাচ্ছে। তাই না?”

“তা বটে।” 

“এবারে বড় ছেলেটাকেও যদি সরিয়ে দেওয়া যায়?” 

“ওরেব্বাবা, তা হলে তো সব টাকাটাই মিসেস ঘোষের হাতে এসে যায়।” 

“কিন্তু মিসেস ঘোষের নিজের কোনও ছেলেপুলে নেই। বঙ্কুর তাবং টাকা তাঁর হাতে এসে গেলে অতএব শেষ পর্যন্ত কার লাভ হচ্ছে?” 

আমার মুখ দিয়ে যেন কোনও কথাই সরছিল না। অনেক কষ্টে বললুম, “এটা তো ভেবে দেখিনি। সেইজন্যেই কি দীপক রামুকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছে?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কে বলল যে, সে রামুকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছে? আমি কিন্তু অমন কথা একবারও বলিনি।” 

“ঠিক আছে, আপনি কিছু বলেননি, আমি বলেছি। কিন্তু এর মধ্যে কি রাজেশেরও হাত রয়েছে?”

“যাচ্চলে, কোথায় আমি প্রশ্ন করব, আপনি জবাব দেবেন, তা নয়, আপনিই দেখছি আমাকে জেরা করতে শুরু করলেন। রাজেশের কথা আপাতত ভুলে যান। বলুন, দীপককে আপনার কেমন লাগে? বেশ ভাল করে ভেবেচিন্তে বলুন।” 

“ভালই তো লাগত।” 

“পাস্ট টেন্স কেন? এখন কি আর তত ভাল লাগছে না?”

“না মানে…” আমতা-আমতা করে বললুম, “কাল মাঝরাত্তিরে সত্যি ও কি সাঁতার কাটতে দিঘিতে নামেনি?” 

“বলল তো নেমেছিল, কিন্তু ঘরে কিংবা বাথরুমে তো ভিজে কিছুই দেখলুম না। এমনকী, তোয়ালেটা পর্যন্ত শুকনো। নাঃ, ব্যাপারটা সত্যি ভাবিয়ে তুলল! এক হতে পারে…”

কী হতে পারে, সেটা আর শোনা হল না। ভেজানো দরজায় টোকা দিয়ে পীতাম্বর এসে ঘরে ঢুকল। বলল, “সবাই রেডি। আপনাদের আসতে বললেন।” 

১৪ 

ফিরতি পথে আমরা যে সিপাহিজলায় খানিকক্ষণ থেমে তারপর অগরতলায় যাব, আগেই সেটা বলে রাখা হয়েছিল। গাড়িতে উঠবার সময় বঙ্কুবাবু বললেন, “লাঞ্চ আমরা সিপাহিজলাতেই খেয়ে নেব। ঘন্টাখানেক ওখানে একটু বিশ্রাম করা যাবে।” 

আসবার সময় পথের দু’দিকে খর নজর রেখেছিলুম, ফিরবার সময়ে তাই আর দৃশ্য-ট্রিশ্য দেখবার বিশেষ উৎসাহ ছিল না। তা ছাড়া মাঝ-রাত্তিরে ভাদুড়িমশাই কালও ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিলেন বলে এখন আবার চোখ দুটো যেন ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু নিজেও গাড়ি চালাই বলে এটা খুব ভালই জানি যে, ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে কখনও ঢুলতে নেই। ওটা বড় ছোঁয়াচে ব্যাপার, ওতে ড্রাইভারের চোখও ঘুমে জড়িয়ে আসতে থাকে। এই পাহাড়িয়া পথে তা যদি হয়, তবেই তো সর্বনাশ। 

ভাদুড়িমশাইকে বললুম, “গাড়িটা একটু থামাবেন?” 

সামনের দিক থেকে চোখ না ফিরিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন?”

“ওয়াটার-বল থেকে চোখে একটু ভাল করে জল ছিটিয়ে নেব।”

“ঘুম-ঘুম লাগছে নাকি?” 

“হ্যাঁ।” 

“তা বেশ তো, একটু ঘুমিয়ে নিন না।” 

“আপনার গাড়ি চালাতে তাতে কোনও অসুবিধে হবে না তো?” 

“কিছুমাত্র না।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আমার অব্যেস আছে। শুধু একটা কাজ করুন। আপনার সিটটা তো অ্যাডজাস্টেবল, ঠেলে একটু পিছিয়ে দিন, তা হলে পা ছড়িয়ে ঘুমুতে পারবেন।”

দীপক আমার ঠিক পিছনেই বসে আছে। ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে সে বলল, “দাঁড়ান দাঁড়ান, আগে আমি একটু ডাইনে সরে বসি, তার পরে সিট অ্যাডজাস্ট করবেন, নইলে আমার হাঁটুতে চোট লাগবে।” 

বললুম, “আরে ভাই, ভয় পেয়ো না, যেমন বসে আছি সেইভাবেই আমি ঘুমিয়ে নিতে পারবে। কাউকে নড়াচড়া করতে হবে না।” 

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম জানি না। গাড়ি যে থেমে গেছে, তাও বুঝতে পারিনি। ভাদুড়িমশাইয়ের গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙল। “নিন, এবারে উঠে পড়ুন।” 

চোখ খুলে বললুম, “সিপাহিজলায় পৌঁছে গেছি?” 

“বিলক্ষণ। চলুন, ভিতরে যাওয়া যাক।” 

ভিতরে ঢুকে দেখলুম, ড্রইংরুমে সবাই বসে আছেন। মিসেস ঘোষ বললেন, “এরা তো জানত আমরা আসব, তাই রান্না করে রেখেছে। আপনারা হাতমুখ ধুয়ে নিন, তারপরে সবাই একসঙ্গে খেতে বসে যাব।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “ওহে চারু, আগরতলা থেকে শঙ্করও ফিরে এসেছে। এবারে নাকি কলকাতার লাইন পেতে অসুবিধে হয়নি। যাদের যাদের ফোন নাম্বার দিয়েছিলুম, সব্বাইকে খবর দিতে পেরেছে। ও নিয়ে আর কোনও চিন্তা কোরো না। তোমার ভগ্নিপতির মা’ও এখন অনেকটা ভাল আছেন।” 

বললুম, “যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।” 

গলা শুনে বঙ্কুবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ও হ্যাঁ কিরণবাবু, আপনার জন্যে খবর আছে একটা। আপনার স্ত্রী জানিয়েছেন যে, এলাহাবাদ থেকে আপনার ছেলে অফিসের কাজে কলকাতায় এসেছে। তবে তাই বলেই যে আপনাকে এখুনি পড়িমরি করে আগরতলায় ছুটে আজ বিকেলের ফ্লাইট ধরতে হবে, তার কোনও মানে নেই। ছেলে এখন হপ্তাখানেক কলকাতায় থাকবে, তার আগে এলাহাবাদে ফিরবে না।” 

বেয়ারা এসে খবর দিল, খাবার দেওয়া হয়েছে। মুখহাত ধুয়ে আমরা ডাইনিং হলে গিয়ে ঢুকলুম।

খেতে-খেতে কথা হচ্ছিল। এক ফাঁকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি একটা কথা ভাবছি বঙ্কু।”

“বলো।” 

“তোমরা তো খেয়ে উঠে একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর আগরতলা রওনা হবে। তো আমি ভাবছিলুম যে, তোমরা বিশ্রাম নাও, সেই ফাঁকে আমি কিরণবাবুকে একবার কসবার কালীবাড়িটা দেখিয়ে দেব। …তারপর সেখান থেকে আগরতলার হোটেলে গিয়ে মিট করব তোমাদের সঙ্গে।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “তা বেশ তো। কিরণবাবুর যখন কসবার কালীবাড়ি দেখা হয়নি, তখন দেখিয়ে দেওয়াই তো উচিত। কমলাসাগরটাও দেখে নিতে পারবেন।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমিও তা-ই ভাবছিলুম। অবশ্য একটা প্রবলেম হচ্ছে…”

“কেন, এতে আবার প্রবলেম কীসের?” 

“না মানে আনরা যদি যাই তো দীপক আর রাজেশকেও আমাদের সঙ্গে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে ওদেরও বিশ্রাম নেওয়া হয় না।” 

বঙ্কুবাবু হোহো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “আরে দূর, ওরা ইয়াং ম্যান, ওদের আবার বিশ্রামের কী দরকার। না না, ও নিয়ে তুমি ভেবো না। আর তা ছাড়া, ওদের যে তোমার সঙ্গে যেতেই হবে, তাও নয়।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে ওরা যাবে কী করে? তোমার অ্যাম্বাসাডারে তো অলরেডি পিছনে তিনজন সামনে দু’জন রয়েছে। আরও দুজনকে যে গাদাগাদি করে ওর মধ্যে ঢোকানো যায় না, তা নয়। বড় গাড়ি যখন, জায়গা হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু তাতে তোমাদের কষ্ট হবে। না না, তার দরকার নেই।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “আমার গাড়িতে ঢোকাতে হবে কেন? শঙ্কর আর-একটা গড়ি নিয়ে এসেছে আগরতলা থেকে। মানে ভাড়া করতেও হয়নি। কলকাতায় ক’টা ফোন করবার জন্যে আগরতলায় আমার এক এজেন্টের বাড়িতে শঙ্কর গিয়েছিল তো, তা সে নিজের থেকেই শঙ্করকে দিয়ে গাড়িটা পাঠিয়ে দিল।” 

“তবে তো কথাই নেই। দীপক আর রাজেশ তা হলে শঙ্করের গাড়িতে আগরতলায় যাক। ওরা সেক্ষেত্রে একটু বিশ্রামও নিতে পারবে। আমি আর কিরণবাবু মারুতিটা নিয়ে কসবার পথে রওয়া হয়ে পড়ি, কেমন?” 

“স্বচ্ছন্দে।” বঙ্কুবাবু বললেন, “আগরতলায় আমরা কোন হোটেলে উঠব, তা তো তুমিই জানোই।” 

খাওয়া শেষ হতেই আমরা কসবার পথে বেরিয়ে পড়লুম। পিছনের সিট এ-যাত্রায় ফাঁকা।

সিপাহিজলা থেকে কসবা মোটামুটি কাছেই। বড় রাস্তায় পড়ে বাঁ-দিকে টার্ন নিলেন ভাদুড়িমশাই। তারপরেই দাঁতে জিব ঠেকিয়ে আক্ষেপের একটা শব্দ করে বললেন, “যাচ্চলে!” 

বললুম, “কী হল?” 

“বড্ড ক্ষতি হয়ে গেল! এবারেও আপনার চশমা পরা বাঁদর দেখা হল না! সিপাহিজলায় আবার যখন আাসতেই হল, স্বচ্ছন্দে একবার চিড়িয়াখানাটা আপনাকে ঘুরিয়ে আনা যেত।” 

বললুম, “কিসসু ক্ষতি হয়নি। চশমা পরা বাঁদর দেখবার জন্যে চিড়িয়াখানায় যেতে হবে কেন, সে তো কলকাতা, দিল্লি, মাদ্রাজ, বোম্বাই, কোনওখানেই কিছু কম দেখি না।” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তা বটে!” 

যে-রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলুম আমরা, সেটা বিশেষ চওড়া নয়। তবে একে তো খানাখন্দ নেই, তার উপরে উলটো-দিক থেকে বাস কি ট্রাক খুব-একটা আসছিল না বলে গাড়ি চালাতে তেমন কিছু অসুবিধেও হচ্ছিল না। মাঝে-মাঝে দু-একটা ছোটখাটো টিলা আমাদের চোখ পড়ছিল। রাস্তাটা একেবারে ভারত-বাংলাদেশের বর্ডার ঘেঁষে তৈরি হয়েছে। টিলাটা যদি ভারতবর্ষের মধ্যে, তো তার নীচেই বাংলাদেশের ধানখেত। 

বললুম, “ওদিককার লোক তো স্বচ্ছন্দেই এদিকে চলে আসতে পারে, মশাই।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আসেও। এদিকে একটা মস্ত হাট বসে। তো প্রতি হাটবারে ওদিককার লোক দলে-দলে মুরগি, মাছ আর আনাজপত্র নিয়ে এদিকে চলে আসে; তারপর সে-সব বিক্রি করে যা পাওয়া।গল তাই দিয়ে দরকারি দু-একটা জিনিস… এই ধরুন ওষুধ কি জামাকাপড় কিনে নিয়ে আবার দলে-দলে ওদিকে ফিরেও যায়।” 

বললুম, “শঙ্করও তা-ই বলছিল বটে। কিন্তু এ তো ঘোর বেআইনি ব্যাপার। পাসপোর্ট, ভিসা, এসব তবে কেন হয়েছে?” 

“ও-সব বড়লোকদের জন্যে হয়েছে। গরিবেরা ও-সবের ধার ধারে না।” 

কথা বলতে-লতে আমরা কমলাসাগরে পৌঁছে গিয়েছিলুম। মস্ত দিঘি। পাড়ে ছোটখাটো কয়েকটা চা-পান-মিষ্টির দোকান। খানিক এগিয়ে চওড়া শান-বাঁধানো সিঁড়ি। তার ধাপগুলিতে পা ফেলে-ফেলে কালীবাড়ির চাতালে উঠে যেতে হয়। একটা দোকানে দু-গ্লাস চায়ের কথা বলে দিয়ে আমরা দিঘির ধারের গাছতলায় গিয়ে দাঁড়ালুম। দিঘির ওদিকে খানিকটা উঁচু জমি। তারপরেই সেই জমি হঠাৎ নীচে নেমে গিয়েছে। শুরু হয়েছে ধু-ধু ধানখেত। ভাদুড়িমশাই আঙুল তুলে বললেন, “ওই যে ধানখেত দেখছেন, ওটা বাংলাদেশের মধ্যে।” 

বললুম, “বর্ডার পাহারা দেবার ব্যবস্থা নেই?”

“আছে বই কী। কি গোটা বর্ডার পাহারা দিতে হলে পাঁচ ফুট অন্তর-অন্তর সেপাই দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। তা কি সম্ভব? তার উপরে ভাবুন, আমাদের বর্ডার কি শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে? নেপাল রয়েছে, পাকিস্থান রয়েছে, চিন রয়েছে—কত পাহারা দেবেন?”

“অর্থাৎ রাত্তিরবেলায় আমি যদি এখানে আসি, আর বর্ডার টপকে নেমে যাই ওই ধানখেতের মধ্যে, কেউ আমাকে বাধা দেবে না?” 

“রাত্তিরে নামবার দরকার কী,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “এখন এই দিনের বেলাতেই নেমে দেখতে পারেন, কেউ আপনাকে বাধা দেবে না।” 

বাধা দেবার মতো সত্যিই কেউ নেই। না এদিকে, না ওদিকে। বললুম, “এতে তো স্মাগলারদের মস্ত সুবিধে।” 

“তা তো বটেই। রাত্তিরের অন্ধকারে আসিও পাচার হয়ে আসতে পারে। তাতেই বা বাধা দিচ্ছে কে? আপনি শুধু এই বর্ডার দেখছেন। পঞ্জাবে যান, কাশ্মীরে যান, সর্বত্র. আর্মস আসছে সীমান্ত পেরিয়ে। গাদা বন্দুক নয়, সফিসটিকেটেড মানে আর্মস। চিনা, মার্কিন, কোনও কিছুরই অভাব নেই। এক্সট্রিমিস্টদের কোমরের জোরটা কারা জোগাচ্ছে, সেটাও বুঝতে পারেন না?” 

বললুম, “আর বুঝে দরকার নেই। চলুন, কালীবাড়ি থেকে ঘুরে আসি।” 

চায়ের দোকানের একটি বাচ্চা ছেলে ইতিমধ্যে দু-গেলাস চা দিয়ে গিয়েছিল। দিঘির ধারে একটা।।ছতলায় বসে চা খাওয়া হল, তারপর চায়ের দাম মিটিয়ে আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলুম কালীবাড়ির চাতালে। 

কালীমূর্তিটি শুনলুম বাংলাদেশ থেখে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেও অবশ্য হালের ব্যাপার নয়, অনেক কাল আগের ঘটনা। জায়গাটা মনোরম। বেশ নিরিবিলিও বটে। খানিকক্ষণ সেখানে কাঠিয়ে আমরা আবার গাড়িতে এসে উঠলুম। 

খানিকটা এগোবার পরে জিজ্ঞেস করলুম, “রাত্তিরে যে বঙ্কুবাবুকে হোটেলে আমাদের ঘরে আসতে বললেন, তখন কি সেখানে আমার থাকা উচিত হবে?” 

“নিশ্চয় হবে।” ভাদুড়িমশাই আমার দিকে মুখ না-ফিরিয়ে হেসে বললেন, “আমি চাইছি আপনি থাকুন। আসলে, ওর সঙ্গে আমার যে কথা হবে, আপনার সেটা শোনা দরকার।” 

“কেন?” 

“বা রে, আমিও বুড়ো হচ্ছি না? ওকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। উত্তরে ও যা বলবে, তারই মধ্যে থেকে হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে এমন দু’একটা কথা, যা কিনা খুবই ভাইটাল। আমি হয়তো সেটা মিস্ করে যেতে পারি। আপনি একটু খেয়াল রাখবেন।” 

এবারে আমার হাসবার পালা। বললুম, “ভাইটাল কথাটা আপনি মিস করে যাবেন আর আমি ধরে রাখতে পারব? খুব বিনয়ী হয়েছেন দেখছি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এটা নতুন কিছু নয়, বরাবরই আমি বিনয়ী। আপনারা সেটা নেঝেন না। ভাবেন যে, লোকটা নেহাত খারাপ নয়, তবে কিনা বড্ডই দাম্ভিক। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। কিন্তু সে-কথা থাক, আর কোনও প্রশ্ন করবেন?”

“কী নিয়ে বঙ্কুবাবুর সঙ্গে কথা বলবেন?”

“সে তো আপনার সামনেই আমি বঙ্কুকে বললুম। যে ব্যাপারে ও এ মার সাহায্যে চেয়েছে, তাই নিয়ে।” 

“অর্থাৎ রামুর প্রোটেকশন নিয়ে?” 

“হ্যাঁ। কিন্তু এখানে থেকে যে সেটা কী করে দেব, বুঝে উঠতে পারছি না ….বাস্, ‘এ নিয়ে এখন আর কোনও প্রশ্ন নয়। ইউ মে আস্ক মি ইয়োর নেকসট কোয়েশ্চেন।”

“আপাতত আর-কোনও প্রশ্ন নেই।” 

“সে কী, রানিমহলে ওই যে লোকটাকে আমরা অধো-অন্ধকারের মধ্যে পিছন থেকে দেখতে পেলুম, সে কে, আর রাত্তিরে ওখানে সে কী করছিল, তাও জিজ্ঞেস করবেন না?” 

লজ্জিত হয়ে বললুম, “ও হ্যাঁ, ওটা তো ভুলেই গিয়েছিলুম। তা…” 

ভাদুড়িমশাই আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, “থাক্, থাক্, আপনাকে আর পশ্ন করতে হবে না! তবে কিনা এইজন্যেই বলছিলুম যে, আপনার বিস্মরণশক্তি ইদানীং অনেক বেড়ে গেছে।” 

“তা তো বেড়ে গেছে। কিন্তু লোকটা কে?”

“রাজেশ।” 

“অ্যাঁ! এলেন কী? রাজেশ ওখানে কী করছিল?” 

“ছবি তুলছিল।” 

“ছবি তুলছিল শেষরাতের অন্ধকারে?” 

“কেন, অন্ধকারে কি ছবি তোলা যায় না? ফ্ল্যাশ তা হলে কী করতে আছে?” 

“তা বুঝলুম, কিন্তু দিনের বেলাতেও তো আমাদের সঙ্গে রাজেশ ওখানে গিয়েছিল। তখন ছবি না-তুলে শেষরাতে যাবার দরকার হল কেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দিনের বেলায় যে ছবি তোলেনি, তা নয়, তবে তার সবই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। তখন নাকি কালার ফিল্ম নিতে ভুলে গিয়েছিল। ফলে আবার যেতে হয়।” 

“আপনাকে এই কথা বলছে?” 

“না বললে আমি জানব কী করে?” 

“আপনি বিশ্বাসও করেছেন?” 

“না-করবার কোনও কারণ অন্তত এখনও খুঁজে পাইনি।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আমার তো রাত থাকতে ঘুম ভেঙে যায়, সেই সময় বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, নীরমহলে পরপর কয়েকবার আলো জ্বলে উঠল। খুব উজ্জ্বল আলো। তখনই আন্দাজ করেছিলুম যে, কেউ নিশ্চয় ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তুলছে। … তবে হ্যাঁ, ভিজে জামাকাপড় কি তোয়ালের সন্ধানে আজ সকালে একবার ওদের ঘরে ঢুকেছিলুম তো, তখন আর-একটা জিনিস আমার চোখে পড়ে যায়।” 

“কী?” 

“একটা পিস্তল। টেবিলের টানার মধ্যে ছিল। …কী হল, কথা বলছেন না যে? ঘাবড়ে গেলেন নাকি?” 

বললুম, “ঘাবড়ে যাবারই তো কথা। তা পিস্তলটা কার?” 

“কী করে বলব? রাজেশেরও হতে পারে, দীপকেরও হতে পারে। …কিন্তু ও নিয়ে এখন ভেবে কিছু লাভ নেই। তার বদলে আপনি একটা কাছ করুন দেখি। আমার হ্যান্ডব্যাগটা তো পিছনের সিটে রয়েছে। হাত বাড়িয়ে ওটা সামনে নিয়ে আসুন।” 

ভাদুড়িমশাইয়ের হ্যান্ডব্যাগটা সামনের সিটে নিয়ে এসে আমার কোলের উপরে রেখে বললুম, “এবার কী করব? কিছু বার করতে হবে?” 

“হ্যাঁ, ওর মধ্যে একটা ফাইল রয়েছে, সেটা বার করুন। দেখবেন, লক্ষ্মণের নিরুদ্দেশ হবার বিজ্ঞাপন যে ক’টা কাগজে বেরিয়েছিল, তার সবগুলিরই ক্লিপিং রয়েছে ওখানে। যে বিজ্ঞাপনে লক্ষ্মণের ছবিটা সবচেয়ে পরিস্কার ছাপা হয়েছে, সেটা দেখুন।…না না, দায়সারাভাবে দেখলে হবে না, বেশ ভাল করে দেখতে হবে।”

ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই ফ্ল্যাট ফাইলে রাখা বিজ্ঞাপনের কাটিংগুলোর উপরে আমি চোখ বুলোতে শুরু করেছিলুম। মনে হল, কলকাতার টেলিগ্রাফ পত্রিকাতেই ছবিটা সবচেয়ে পরিষ্কার ছাপা হয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে ছবিটা দেখেও কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারলুম না। 

বললুম, “কিছুই তো বুঝতে পারছি না। কী ব্যাপার বলুন তো?” 

“কিচ্ছু মনে পড়ছে না?”

“কই, না তো।” 

“ইডেন গার্ডেন। বারো বছর আগে। নাইনটিন সেভেনটিনাইন। তাও মনে পড়ছে না? …ভাবুন, ভাবুন।” 

“ভাবছি তো, কিন্তু আপনার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই ধরতে পারছি না।” 

“বেশ, তা হলে আরও কয়েকটা ক্লু দিচ্ছি। ক্রিকেট-টেস্ট, বিটুইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আমরা ক্লাব-হাউসে বসে খেলা দেখছিলুম… একটা বছর দশ-বারোর ছেলে আমাদের পাশে বসে…”

হঠাৎ যেন একটা পর্দা সরে গেল আমার চোখের সামনে থেকে।