চশমার আড়ালে – ১

জানলার ধারে সিট পেয়েছিলুম। বাইরে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, রানওয়ে পড়িমরি পিছনে ছুটছে। একটু বাদেই প্লেন আকাশে উঠে পড়ল। এখন সব শান্ত। একটুও কাঁপুনি নেই, গতির ঝড়টাও টের পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু কানে আসছে চাপা একটা গোঁগোঁ শব্দ। 

বোয়িং নয়, এয়ারবাল। আগের এয়ারবাসগুলোর তুলনায় আকারে একটু ছোট। কিন্তু ছিলছাম। ব্যাঙ্গালোরের দুর্ঘটনার পরে এই নতুন কেনা প্লেনের বহরকে একেবারে পুরোপুরি বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ক্ষতি হচ্ছিল কোটি-কোটি টাকা। দিল্লির জমানা তার কিছুদিন পরেই পালটে যায়। তা নইলে এই চমৎকার প্লেনগুলোকে যে আরও কতকাল বেকার বসিয়ে রাখা হত, কে জানে। 

৫ মার্চ, মঙ্গলবার। দুপুর এখন দুটো। দেড়টায় টেক-অফের কথা ছিল। আধ ঘন্টা দেরিতে ছেড়েছে। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই আগরতলায় পৌঁছে যাব। 

পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে এদের আনুষ্ঠানিক স্বাগত সম্ভাষণ শেষ হয়েছে। প্রথমে হিন্দি, তারপর ইংরেজি। ক্যাপ্টেনের নাম কী বলল, বুঝলাম না। এখন রুটিনমাফিক বলা হচ্ছে, প্লেনের মধ্যে হঠাই যদি অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় তো কী করতে হবে। একজন এয়ার হস্টেস হাতে কলমে সেটা দেখিয়েও দিচ্ছেন। কেমন যেন প্যান্টোমাইমের মতো মনে হয়। কেউ কি দেখছে? বুঝবার চেষ্টা করছে কিছু? 

‘জলপান’ এসে গেল। হাতে-হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। আমারটা পড়েই রইল। বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছি। খিদে নেই। 

একটা সিগারেট ধরাতে পারলে ভাল হত। কিন্তু আজকাল তো এত অল্প সময়ের ‘উড়ান’-এ ধূমপান করতে দেওয়া হয় না। সিগারেটের প্যাকেটটা ফের পকেটে ঢুকিয়ে তাই সামনের জালি ব্যাগ থেকে খবরের কাগজ বার করে নিলুম একটা। তাতেও অবশ্য মন বসানো গেল না। 

আসলে শুধু দুটো প্রশ্নই কাল রাত্তির থেকে আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভাদুড়িমশাই কোথায় গেলেন? আমিই বা এখন কোথায় যাচ্ছি? আগরতলাই আমার শেষ গন্তব্য জায়গা নয়, সেখান থেকে অন্য কোথাও আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু কোথায়? এ-দুটো প্রশ্নের উত্তর যতক্ষণ না পাচ্ছি, কোনও কিছুতেই ততক্ষণ আমি মন বসাতে পারব না। 

ব্যাপারটা যে গোলমেলে, তাতে সন্দেহ নেই। কাল সওয়া দশটায় যখন অফিসে রওনা হই, তখন কি আমি ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পেরেছিলুম যে, এই রকম একটা ব্যাপার ঘটতে চলেছে? মোটেই না। রাত দশটায় বাড়ি ফিরেও কিছু বুঝতে পারিনি। 

পৌনে এগারোটায় অফিসে পৌঁছই। শোলদা-পাড়ায় থাকি, সেখান থেকে অফিসে পৌঁছতে পনেরো মিনিটের বেশি সময় লাগবার কথা নয়। লাগেও না। কিন্তু কাল ফ্লাই-ওভার ছিল জ্যাম-জমাট, চৌরঙ্গি পাড়ায় পৌঁছতে পৌঁছতে আধ ঘন্টা কাবার। 

অফিসে ঢুকে নিজের ঘরে গিয়ে বসতে-না-বসতেই ফোন বেজে উঠল। 

“হ্যালো…..”

“আপনার একটা ফোন এসেছিল।” 

গলা শুনে বুঝলুম, পি.বি. এক্স.-এর অপারেটর। বললুম, “কখন?” 

“মিনিট পাঁচ-সাত আগে।” 

“নাম বলেছে?” 

“হ্যাঁ, মালতি সান্যাল। বললেন যে, খুব জরুরি দরকার। একটু বাদে আবার ফোন করবেন।”

“কী দরকার কিছু বললেন?” 

“না!” অপারেটর-মেয়েটি আমতা-আমতা করে বলল, “না….মানে আমি ঠিক জিজ্ঞেস করিনি।”

“ঠিক আছে।” ফোন নামিয়ে রেখে কাজে বসে গেলুম। 

মালতী আর ফোন করেনি। আমার করা উচিত ছিল। কিন্তু করা হয়নি। হরেক কাজে এমন জড়িয়ে গিয়েছিলুম যে, মালতীর কথা মনেই ছিল না। 

মনে পড়ল রাত-দশটায় বাড়ি ফিরে। তাও হয়তো মনে পড়ত না, বাসন্তীর সঙ্গে কথা বলতে-বলতে যদি না অরুণ সান্যালের অর্থাৎ মালতীর স্বামীর প্রসঙ্গটা উঠত। ক’দিন ধরেই আমার শরীর বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। মাথা ঘোরে, দুর্বল বোধ করি, ঘন্টা দুই-আড়াই একটানা কাজ করলেই হাঁফ ধরে যায়। বাসন্তীকে সে-কথা বলতে বলল, “অরুণবাবুকে দিয়ে তোমার ব্লাড প্রেশারটা একবার দেখিয়ে নাও।” 

বাস, অমনি মনে পড়ল মালতীর কথা। বললুম, “মালতী কি ফোন করেছিল?” 

“কই, না তো।” বাসন্তী বলল, “কেন, কিছু হয়েছে?” 

কিছু না-বলে টেলিফোনের কাছে উঠে গিয়ে ডায়াল ঘোরাতে লাগলুম। লাইন পাওয়া গেল না। যতবার ডায়াল করি, ওদিক থেকে এনগেজড টোন বাজতে থাকে। 

ফিরে এসে বাসন্তীকে বললুম, “মালতী আজ আমাদের অফিসে ফোন করেছিল। তখনও আমি অফিসে গিয়ে পৌঁছইনি। অপারেটর-মেয়েটি বলল, খুব নাকি জরুরি দরকার।” 

“তুমি ফোন করেছিলে?” 

“করা উচিত ছিল। কিন্তু করা হয়নি। ভুলে গিয়েছিলুম।” 

“কৌশিকের কিছু হয়নি তো?” 

“কৌশিককে নিয়ে ভাবছি না। সে তো ব্যাঙ্গালোরে ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে রয়েছে। মামার কাছে রয়েছে যখন, তখন ভাবনার কিছু নেই। আমি ভাবছি অরুণের কথা। ডাক্তার-মানুষ, অথচ নিজেরই শরীরের যত্ন নেয় না। এদিকে কিছুদিন আগে ওর একটা ছোটখাটো স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে। ভাবনা তো ওকে নিয়েই। কী করা যায় বলো তো?” 

বাসন্তী বুঝতে পেরেছিল, মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তা নিয়ে যদি শুতে যাই, তো রাত্তিরে আমার ঘুম হবে না। নিজেই ফোনের কাছে উঠে গিয়ে বার কয়েক ডায়াল করল। তারপর ফিরে এসে বলল, “না, এনগেজড!” 

বললুম, “খবরটা তা হলে পাই কী করে?” 

বাসন্তী বলল, “চলো, গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়া যাক। রাত প্রায় এগারোটা বাজে, রাস্তায় ভিড়ভাট্টা নেই, ঝট করে ঘুরে আসতে পারব।” 

ছোট মেয়ে পারুল গেছে এলাহাবাদে, তার দাদার কাছে। স্বচ্ছন্দে অতএব বেরিয়ে পড়া যেতে পারে। বাসন্তী চটপট কাপড় পালটে নিল। তারপর দরজায় তালা লাগিয়ে সিঁড়ির ধাপে পা রেখেছি কি রাখিনি, শুনতে পেলুম, টেলিফোন বাজছে। নিশ্চয়ই মালতী, তক্ষুনি আবার তালা খুলে ভিতরে ঢুকে ফোনের রিসিভার তুললুম। কিন্তু ‘হ্যালো’ বলতেই ওদিক থেকে যাঁর কথা ভেসে এল, গলা শুনে তাঁকে চিনতে পারলুম না। 

“মিঃ চ্যাটার্জি?” 

“হ্যাঁ…..আপনি কে বলছেন?” 

ওদিক থেকে যিনি কথা বলছিলেন, তিনি হাসলেন। এক মুহূর্ত পরে বললেন, “আমাকে আপনি চিনবেন না।” 

“তা হলে?” 

“যা বলছি শুনুন। মিঃ ভাদুড়িকে আজ সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।” 

বললুম, “সে কী, ব্যাঙ্গালোর থেকে কেউ ফোন করেছিল?” 

“ব্যাঙ্গালোর থেকে ফোন করবার কথা উঠছে কেন, এটা কলকাতার ব্যাপার।”

“তার মানে?” 

“মানে আর কিছুই নয়, একটা কাজে কাল তিনি ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতায় আসেন। উঠেছিলেন মিঃ সান্যালের বাড়িতে। আজ সকালে যথারীতি লেকের ধারে জগিং করতে যান। বাস, তারপর থেকে আর তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।” 

“আপনি এসব কথা জানলেন কী করে?” 

“আমি মিঃ সান্যালের প্রতিবেশী। শুনলুম মিসেস সান্যাল আপনাকে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ একবার ফোন করেছিলেন, কিন্তু আপনি তখন অফিসে ছিলেন না। তার খানিক বাদেই ওঁদের বাড়ির ফোনটা ডেড হয়ে যায়। একটু আগে ওঁরা অবশ্য একটা খবর পেয়েছেন।” 

“লোক মারফত?” 

“না, ফোন এসেছিল।” 

“ফোন তো বলছেন ডেড, তা হলে ফোনে খবর এল কী করে?” 

“মিঃ সান্যালের ধর্মতলার চেম্বারে। সেখানকার ফোন ঠিক আছে।” 

“খবরটা ভাল তো?” 

“মিঃ সান্যাল তো তা-ই বললেন। তিনি এই খানিকক্ষণ হল বাড়ি ফিরেছেন। বাড়ির ফোন ঠিক নেই বলে আমাকেই বললেন, আপনাকে সব জানাতে। …..তো যা বলছিলুম। মিঃ সান্যাল বলছেন, কালই দুপুরের ফ্লাইটে আপনি একবার আগরতলা যেতে পারলে ভাল হয়।” 

“কেন? আগরতলার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?”

ভদ্রলোক আবার হাসলেন। তারপর বললেন, “তা তো জানি না।” 

“আপনার নামটা জানতে পারি?” 

“স্বচ্ছন্দে। প্রমোদ সেন। আমি ওঁর দু-তিনটে বাড়ি পরে থাকি।….আচ্ছা, নমস্কার।” 

ভদ্রলোক ফোন ছেড়ে দিলেন। ফলে আর-কিছু জিজ্ঞেস করা গেল না। 

রিসিভারটা নামিয়ে রেকে বাসন্তীর দিকে ঘুরে দাঁড়ালুম। বাসন্তী বলল, “কী ব্যাপার? কোনও খারাপ খবর?” 

বললুম, “কিছু বুঝতে পারছি না। ভাদুড়িমশাই কাল কলকাতা এসেছেন। আজ সকালে জগিং করতে বেরিয়েছিলেন, তারপর থেকে নিখোঁজ।” 

“সে কী! কে বলল?” 

“মালতীদের এক প্রতিবেশী। নাম বললেন প্রমোদ সেন। বলছেন, কাল দুপুরের ফ্লাইটে আমাকে আগরতলা যেতে হবে। নাকি অরুণ তাই-ই চায়। যাব?”

“অরুণবাবুকে জিজ্ঞেস না করে যেয়ো না।” 

“তাকে পাচ্ছি কোথায়? ওদের ফোন তো খারাপ।….তবে হ্যাঁ, চেম্বারের ফোনটা নাকি ঠিক আছে।” 

“বেশ তা হলে কাল সকালে অরুণবাবুর চেম্বারে ফোন করে ব্যাপারটা জেনে নাও। আটটা নাগাদ উনি চেম্বারে বসেন।…..মোট কথা, ওঁকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করাটা ঠিক হবে না।” 

বললুম “অরুণ যদি যেতেও বলে, তাতেও কিন্তু ঝামেলা মিটছে না।” 

“কীসের ঝামেলা?” 

বললুম “টিকিটের। আগরতলায় বইমেলা চলছে। প্লেনের টিকিট পাওয়া শক্ত হবে।”

শেষপর্যন্ত অবশ্য না-করতে হল অরুণের চেম্বারে ফোন, না কাটতে হল টিকিট। আজ সকালে কলিং বেল বাজতে দরজা খুলে আমি অবাক। দেখি, শশাঙ্ক দাড়িয়ে রয়েছে। 

অরুণের চেম্বারে শশাঙ্ক রিসেপশনিস্টের কাজ করে। বললুম, “কী ব্যাপার শশাঙ্ক?” 

শশাঙ্ক আমার হাতে একটা লম্বাটে খাম তুলে দিয়ে বলল, “ডাক্তারবাবু পাঠিয়েছেন। ওর মধ্যে একটা চিঠি আছে, আর আগরতলার একটা টিকিট।” 

খাম খুলে চিঠিটা বার করলুম। সংক্ষিপ্ত চিঠি। দুপুরের ফ্লাইটে আমি আগরতলা যেতে পারলে ভাল হয়। ভাদুড়িমশাই ভাল আছেন, তবে কোথায় আছেন, এখুনি সেটা জানা যাচ্ছে না। এত অল্প সময়ের মধ্যে আমার টিকিট পেতে অসুবিধে হতে পারে ভেবে কালই সে শশাঙ্ককে দিয়ে টিকিট কাটিয়ে রেখেছে। আমি যদি যেতে না পারি, তা হলে টিকিটটা যেন শশাঙ্কের হাতেই ফেরত দিই, অন্তত কিছু টাকা সে-ক্ষেত্রে রিফান্ড পাওয়া যাবে। 

টিকিটের সঙ্গে চিঠিখানা একটা ক্লিপ দিয়ে আঁটা। 

চিঠি পড়ে শশাঙ্কের দিকে তাকিয়ে বললুম, “তুমি আসায় ভালই হল। আর-একটু বাদেই ডাক্তারবাবুকে আমি তাঁর চেম্বারে ফোন করতে যাচ্ছিলুম।” 

শশাঙ্ক বলল, “ফোন করলে তো তাঁকে পেতেন না।” 

“কেন?” 

“ডাক্তারবাবুর মায়ের খুব অসুখ।” শশাঙ্ক বলল, “আজ সকালেই ওঁরা বেহালা চলে গেলেন। চেম্বারও তাই বন্ধ।” 

অরুণের পৈতৃক বাড়ি বেহালায়। সেখানকার ফোন-নম্বর আমার জানা নেই। শশাঙ্কও জানে না বলল। তবে বাড়িটা চেনে। এখান থেকে ও নাকি বেহালাতেই যাবে। বলল, “ডাক্তারবাবুকে যদি কিছু জানাবার থাকে তো আমাকে বলতে পারেন, আমি জানিয়ে দেব।” 

বললুম, “এমনিতে কিছু জানাবার নেই। শুধু বোলো যে, আমি যাচ্ছি।” 

শশাঙ্ক চলে গেল। 

দরজা বন্ধ করে খাবার ঘরে ফিরে দেখলুম, বাসন্তী টেবিল সাজাচ্ছে। পট থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে মুখ না তুলেই বলল, “ব্যাপারটা আমার ভাল ঠেকছে না।” 

ভাল কি আমারই ঠেকছে? সবটাই কেমন যেন গোলমেলে ব্যাপার। আমাকে ফোন করবার পরেই বিগড়ে গেল মালতীদের ফোন। রাত্তিরে সে-কথা যিনি আমাকে জানালেন, সেই প্রমোদ সেনকে আমি চিনি না। সকালে শশাঙ্ক অবশ্য অরুণের চিঠি নিয়ে এসেছে। কিন্তু সে-চিঠির হস্তাক্ষর অরুণের না অন্য-কারও তাও আমার জানবার উপায় নেই। অরুণের গোটাকয় প্রেসক্রিপশন আমাদের বাড়িতে আছে ঠিকই, কিন্তু সে তো ইংরেজিতে লেখা, তার বাংলা হাতের লেখা আমি কখনও দেখিনি। এদিকে আবার মায়ের অসুখের খবর পেয়ে সে নাকি বেহালায় চলে গেছে। ফলে তার ধর্মতলার চেম্বারেও একটা ফোন করা গেল না। স্রেফ অন্যের কথার উপরে নির্ভর করে আমি আগরতলা যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি, সেটুকু পর্যন্ত কেউ আমাকে জানায়নি। গিয়ে যে কী করব, কোথায় উঠব, কার সঙ্গে কথা বলব, তাও আমার জানা নেই। এ তো একেবারে বুনো হাঁস তাড়া করে বেড়াবার ব্যাপার 

পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমটা ফের ‘জ্যান্ত’ হয়ে উঠতে আমার চমক ভাঙল। ওড়ার পালা শেষ হয়ে এল, ‘থোড়া বাদসে’ আমরা আগরতলার মাটি ছোঁব। একটু বাদেই ঘড়ঘড় করে শব্দ হল একটা। প্লেনের নোজ-হুইল এতক্ষণ গোটানো ছিল, সেটা আবার খুলে যাবার শব্দ। জানলায় চোখ রেখে দেখলুম, গাছপালা বাড়িঘরের আকার ক্রমেই বড় হয়ে চলেছে। তারপরে মৃদু একটা ঝাঁকুনি। প্লেন এখন আর পাখি নয়, রানওয়ের উপর দিয়ে সে এখন একটা চিতাবাঘের মতন দৌড়চ্ছে। 

দৌড়ের সেই গতিও একসময় কমতে কমতে স্তব্ধ হয়ে গেল। যাত্রীরা উঠে দাঁড়িয়েছেন। মাথার উপরে লকার থেকে যে যাঁর জিনিসপত্র নামিয়ে নিচ্ছেন। প্লেনের দরজায় সিঁড়ি লেগেছে। এবারে আমরা নীচে নামব 

নীচে নেমে টার্মিনালের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলুম যে, আগরতলায় তো আসা গেল, এবার এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে মোটামুটি শস্তা একটা হোটেলের খোঁজ করতে হবে। ঠিক এই সময়েই টার্মিনাল-বিল্ডিং থেকে ট্রাউজার্স আর শার্ট পরা বছর তেইশ-চব্বিশের একটি ছেলে আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “মিঃ চ্যাটার্জি?” 

বললুম, “হ্যাঁ।” 

ছেলেটি বলল, “প্লিজ কাম উইথ মি। জিজাজি আপনার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।” 

মালপত্রের ঝামেলা নেই, যা পরে আছি তা ছাড়া আমার হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে রয়েছে গোটা-দুই ট্রাউজার্স আর শার্ট। বেশি দিনের জন্যে তো আর আসিনি। কেন এসেছি তার আঁচ না পেলেও এটুকু আন্দাজ করে নিয়েছি যে, দু-তিন দিনের বেশি আমাকে এখানে থাকতে হবে না, ওতেই অতএব চলে যাবে। হ্যান্ডব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে আমরা এয়াপোর্টের বাইরে এসে দাঁড়ালুম। 

জিজাজি অর্থাৎ এর জামাইবাবু লোকটি যে কে, তা এখনও জানা হয়নি। তবে এটা বোঝা গেল যে, তিনি আমাকে চেনেন। তা নইলে আর এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন কেন 

ওদিকে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকটি আম্বাসাডার আর প্রিমিয়ার গাড়ি। লাল রঙের একটা মারুতিও দেখলুম। আমাদের দেখে মারুতি গাড়িটা এগিয়ে এল। ছেলেটি তার পিছনের দরজা খুলে দিয়ে বলল, “উঠুন।” 

গাড়িতে ঢুকে হ্যান্ডবাগটা পিছনের লাগেজ-স্পেসে নামিয়ে রাখলুম। ভেবেছিলুম, ছেলেটি আমার পাশে এসে বসবে। সে কিন্তু সামনের দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশের সিটে গিয়ে বসল। তারপর আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, “এর আগে আপনি কভি আগরতলায় এসেছেন?” 

বললুম, “না।…..কিন্তু আপনার নামটাই তো এখনও জানা হয়নি।” 

“দীপক মালহোত্রা। আপনি আমাকে দীপক বলবেন।” 

ড্রাইভার বলল, “তা হলে কি শহরটা ওঁকে একটু দেখিয়ে নিয়ে তারপর সিপাহিজলার দিকে যাব?” 

দীপক তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “মোটে তো সাড়ে-তিনটে বাজে। জিজাজির কথা শুনে যা মালুম করলুম, সাগরমহল থেকে তাঁর বন্ধুকে নিম্নে সাতটা সাড়ে সাতটার আগে তিনি সিপাহিজলায় লোটবেন না। তব তো এখন ঘন্টা দুয়েক আমরা আগরতলায় কাটাতে পারি। অবশ্য এখানে দেখবার মতো কিছু নাই।….ঠিক আছে, চলো, সময়টা তো যা হোক করে কাটাতে হবে।” 

গাড়ি চলতে শুরু করল। 

দীপক যে বাঙালি নয়, সেটা তার নাম জানবার আগেই বুঝতে পেরেছিলুম। হিন্দির মিশেল দিয়ে বাংলা মোটামুটি ভালই বলে, কিন্তু উচ্চারণ একটু ভাঙা-ভাঙা। 

বললুম, “তোমার নাম তো জানা গেল, কিন্তু তোমার জিজাজির পরিচয় এখনও পাইনি।”

সামনের সিট থেকে আবার মুখ ঘোরাল দীপক। বলল, “সে কী, জিজাজিকে আপনি চিনেন না?”

“না।” 

“বাট আই থট হি ওয়জ এ ক্লোজ ফ্রেন্ড অব ইয়োর্স। বঙ্কু ঘোষের নাম আপনি শুনেন নাই?”

বললুম, “বঙ্কুবিহারী ঘোষ? ওই মানে যাঁকে একালের এক ফিনানসিয়াল উইজার্ড বলা হয়, তিনি তো?” 

“হাঁ, হাঁ, উইজার্ড।” দীপক হেসে বলল, “টেক্সটাইল, ট্রান্সপোর্ট, কেমিক্যালস, হর কিসিমের বিজনেসে তাঁর টাকা খাটছে। তা ছাড়া রয়েছে তিন-তিনটা সিনেমা হল। গোটা চার-পাঁচ ফিল্ম ভি প্রোডিউস করেছেন। তার মধ্যে তিনটেই হিট।” 

হেসে বললুম, “তাঁকে কেন চিনব না? তবে তিনিই যে তোমার জিজাজি, তা কী করে জানব? তা ছাড়া আমি নাহয় তাঁকে চিনলুম, কিন্তু আমার মতো সামান্য লোককে তো তাঁর চিনবার কথা নয়। তাতেই একটু অবাক হচ্ছি।” 

দীপক বলল, “ও নো, মিঃ চ্যাটার্জি, ইউ আর আন্ডার এস্টিমেটিং ইয়োরসেলফ। 

“কী করে বুঝলে?” 

“আপনি তো একজন রাইটার, তাই না?”

“ওই একটু লেখালেখি করি।” 

“বাস,” দীপক হেসে বলল, “ওরই জন্য জিজাজি আপনাকে চিনেন, আর ওরই জন্যে তিনি আপনাকে ক্লকাতা থেকে এখানে আনিয়েছেন।” 

বললুম, “কেন, লেখক দিয়ে তাঁর কী কাজ হবে?” 

“বা রে, নতুন যে ফিল্মটা তিনি করবেন, তার কহানির স্ক্রিপট লিখাতে হবে না?” 

“তা তো হবেই।” 

“তো সেটা আপনি লিখবেন। হা হা।” 

জীবনে কখনও ফিল্মের স্ক্রিপট লিখিনি। অথচ, আর-কিছু নয়, স্রেফ স্ক্রিপট লেখাবার জন্য আমাকে কিনা কলকাতা থেকে আগরতলায় নিয়ে আসা হয়েছে। বিশ্বাস হল না। 

দীপক সম্ভবত ভেবেছিল যে, কথাটা শুনে আমি খুব উল্লসিত হব। উল্লাসের লক্ষণ না-দেখে বলল, “কী হল মিঃ চ্যাটার্জি, কিছু বলছেন না যে?” 

“কী বলব?” 

“বাঃ, গল্পটা কী, কার লিখা, কাস্টের কথা কী ভাবা হচ্ছে, কে হিরো কে হিরোইন, লোকেশন-শুটিং কোথায় চলবে, কিচ্ছু জানবেন না?” 

শুকনো গলায় বললুম, “জেনে তো লাভ নেই, স্ক্রিপট যে লিখব তার সময় কোথায়? কলকাতায় আমি বিস্তর কাজ ফেলে এসেছি, যত তাড়াতাড়ি পারি এখান থেকে আমাকে ফিরে যেতে হবে।” 

কথাটাকে আমলই দিল না দীপক। বলল, “আরে, সাত দিনের তো মামলা। আমার দিদির লিখা কহানি, তাঁর সঙ্গে বসবেন, এক হপ্তার মধ্যে আপনাকে স্ক্রিপট লিখার কাজ খতম হয়ে যাবে। ব্যস, আপনার ছুট্টি।” 

বুঝলুম, পাগলের পাল্লায় পড়েছি, প্রতিবাদ করে কোনও লাভ হবে না। ‘ঠিক আছে’ বলে তাই জানলায় চোখ রেখে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলুম। 

এর আগে আর কখনও আমার আগরতলায় আসা হয়নি। তবে অনেক বছর আগে একবার আগরতলার মাটি ছুঁয়েছিলুম বটে। এদিকে তখন এয়ারবাস চলত না, বোয়িংও না। সেই সময়ে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের ফকার ফ্রেন্ডশিপ প্লেনে একবার শিলচর যেতে হয়েছিল। সে-প্লেন দমদম থেকে আকাশে উঠে প্রথমে নামত আগরতলায়, তারপর আধ-ঘন্টাটাক সেখানে থেমে থেকে তারপর যেত শিলচর। যাঁরা শিলচরের যাত্রী, প্লেন থেকে তাঁদের আগরতলায় নামতে দেওয়া হত না। কিন্তু নেমেছিলুম। জানলা থেকে দেখেই জায়গাটা আমার এত ভাল লেগে যায় যে, পাইলটের অনুমতি নিয়ে টার্মিনাল বিল্ডিং থেকে ঘুরে এসে আমি আবার প্লেনে উঠি। 

দীপক বলছিল এখানে দেখবার মতো কিছু নেই। ও কিছু জানে না। আসলে দেখবার মতো কিছু কোথাও আছে কি না, তা নির্ভর করে কে কী দেখতে চায়, তার উপরে। যদ্দুর বুঝতে পারছি, এই ত্রিপুরায় ও বোম্বাইয়ের মেরিন-ড্রাইভের মতন একটা তেল-চুকচুকে রাস্তা দেখতে চায়, রাস্তার ধারে সারি-সারি ফাস্ট-ফুডের দোকান আর ভিডিও গেমের পার্লার দেখতে চায়। সে-সব দেখছে না বলেই ও বেজার হয়ে জানিয়ে দিচ্ছে যে, এখানে দেখবার মতো কিছু নেই। 

কিন্তু ওর বয়েস আর আমার বয়েসের মাঝখানে তো বিস্তর ফারাক। দু’দিকে তাকিয়ে আমার তাই দিব্যি লাগছিল। পথটা একটু ঢেউ-খেলানো, কিন্তু কোথাও খানাখন্দ নেই। দু’দিকে মস্ত-মস্ত দালানকোঠার জঙ্গল নেই, বরং ফাঁকা জমিজায়গা রয়েছে প্রচুর। অনেক বাড়িতেই কাঠের বেড়া, টিনের চাল। ঢেউ-খেলানো চালগুলো রং করা, তাতে বেশ বাহার খুলেছে। গাছপালাও বিস্তর। শহরের এলাকায় ঢুকতে গাছপালা খানিকটা কমে গেল বটে, কিন্তু রাস্তায় যে তেমন ভিড়ভাট্টা নেই, এইটে দেখে খুব আরাম পাওয়া গেল। 

ড্রাইভারটির বয়স মোটামুটি বছর তিরিশেক। গাড়ি চালাতে চালাতেই আমাকে সে সব চিনিয়ে দিচ্ছিল। ….এই হল লাটসাহেবের বাড়ি। আর ও-পাশে ওই যে বাগানটা দেখছেন, ওটা হয়েছে রবিঠাকুরের নামে। বাগানের একদিকে একটা খেলনা-ঘর রয়েছে, সেখানে আছে নানান জায়গার পুতুল। পারেন তো একদিন এসে দেখে যাবেন স্যার। বাগানের সামনে, রাস্তাটা দেখছেন তো, ওই রাস্তার ডান দিকে পড়ছে সার্কিট হাউস। এ দিকে দেখুন গান্ধীজির স্ট্যাচু। বাগানের মধ্যে রবিঠাকুরেরও একটা খুব সুন্দর স্ট্যাচু রয়েছে।…. 

ত্রিপুরার রাজবাড়িটা চমৎকার। এখন অবশ্য আর রাজবাড়ি নয়, বিধানসভা। রাজবাড়ির লোকেরা তা হলে এখন কোথায় থাকেন? ড্রাইভার বলল, “রানিমা তো এখানকার একজন মন্ত্রী, তাঁরা থাকেন পিছন-দিকের আর-একটা বাড়িতে। তবে সেটা এর চেয়ে অনেক ছোট।” 

রাজবাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আমরা ইতিমধ্যে আর-একটা পথ ধরে এগোচ্ছিলুম। এক জায়গায় দেখলুম বেশ ভিড়। আগরতলায় আসা ইস্তক কোথাও এইরকম মানুষজন আর যানবাহনের ঠেলাঠেলি দেখিনি, তাই জিজ্ঞেস করলুম, “ব্যাপার কী? এখানে এত ভিড় কেন?” 

দীপক বলল, “নিশ্চয় গুরুজির কোনও বই রিলিজ হচ্ছে।” 

তাতে আমি আরও অবাক হয়ে বললুম, “গুরুজি! তিনি আবার কে?” 

ড্রাইভারটিকে এতক্ষণ হাসতে দেখিনি। এবারে সে হোহো করে হেসে উঠল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, “দীপকবাবুর গুরুজি হচ্ছেন অমিতাভ বচ্চন। কিন্তু না স্যার, ওটা সিনেমা হলের ভিড় নয়, ওখানে বইমেলা চলছে। ভিতরে গিয়ে দেখবেন?” 

যাবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দীপকের দেখলুম তার গুরুজির বই নিয়ে যত উৎসাহ, বইমেলা নিয়ে উৎসাহ তার সিকির সিকিও নয়। বলল, “না না, অত সময় নেই। পাঁচটা বেজে গেছে। বরং কোনও হোটেলে নিয়ে চলো, সেখানে কিছু খেয়ে নিয়ে তারপর সিপাহিজলার দিকে রওনা হওয়া যাক। মিঃ চ্যাটার্জির নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে।” 

প্লেনে কিছুই খাইনি। একটু-একটু খিদে যে পাচ্ছিল না, তা নয়, কিন্তু কী জানি কেন, কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না। বললুম, “তোমাদের যদি খিদে পেয়ে থাকে তো খেয়ে নাও, আমার জন্যে ভাবতে হবে না, আপাতত আমার এক কাপ চা পেলেই চলবে।” 

যেমন কলকাতা, তেমনি আগরতলাও একটা পুরো রাজ্যের রাজধানী বটে, কিন্তু কলকাতার গা থেকে যেমন গ্রামীণ সৌরভ একেবারে নিঃশেষে মুছে গেছে, আগরতলায় সেটা হয়নি। লোকজনের কথাবার্তা আর আচার-আচরণে এখনও সারল্য আর আন্তরিকতার ছোঁয়া মেলে, মস্ত কোনও শহরে যেটা আশাই করা চলে না। তার একটা কারণ হয়তো এই যে, আগরতলায় এখনও শিল্পের বিশেষ প্রসার ঘটেনি; সেটা যখন ঘটবে, কল-কারখানার দাপটে এই সারল্য আর আন্তরিকতাও যে তখন শুকিয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার এখনও অনেক দেরি। আগরতলা এখনও সুখী, শান্ত, ছোট্ট একটি শহর, তার চৌহদ্দি ছাড়াবামাত্র আপনি নির্ভেজাল কোনও গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়বেন। এমন গ্রাম, যার চাষের জমির উপরে এখনও ইটখোলা তার থাবা বসায়নি। 

শহরের পাশেই বাংলাদেশের বর্ডার। ইতিমধ্যে সেখান থেকেও ঘুরে এসেছি। দেখেছি, যেমন এদিকে তেমন ওদিকেও ঘন-ঘন সাইকেল রিকশা এসে থামছে, তারপর মাঝখানের জমি হেঁটে পার হচ্ছে মানুষজন। যাতায়াতের বিরাম নেই। দীপক খানিকক্ষণ আমার সঙ্গে ছিল না, আড়ালে গিয়ে সিগারেট খাচ্ছিল বোধহয়। ড্রাইভারটির নাম শঙ্কর। পূর্ববঙ্গের ছেলে। একাত্তরে যখন খান-সেনাদের অত্যাচার একেবারে চরমে ওঠে, তখন ওরা বর্ডার পেরিয়ে আগরতলায় এসে ঢুকেছিল, তারপরে আর ফিরে যায়নি। শঙ্করই আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাচ্ছিল। বলল “এখান দিয়ে বর্ডার পেরোতে হলে তো কাগজপত্র লাগে, ওদিকে ও-সবের দরকার হয় না।” 

“ওদিকে মানে?” 

“কসবার কালীবাড়ির দিকে। আজ তো আমরা সিপাহিজলায় যাচ্ছি। কাল কালীবাড়ি দেখবেন চলুন। ওইসঙ্গে কালীবাড়ির পাশে কমলাসাগরও দেখা হয়ে যাবে।” 

“সাগর মানে? মস্ত বড় দিঘি?” 

“মস্ত বড়। তবে উদয়পুরের দিঘির মতন অত বড় নয়। কমলাসাগরে জল আসা নিয়ে অবিশ্যি একটা গল্প আছে।” 

শঙ্করের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছিল। বললুম, “কী গল্প? স্বপ্নাদেশের?” 

অবাক হয়ে শঙ্কর খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপব বলল, “ঠিক ধরেছেন। আপনি জানেন?” 

হেসে বললুম, “না, জানি না।” 

“তা হলে বললেন কী করে? 

“পুরনো সবকিছু নিয়েই একটা-না-একটা গল্প থাকে তো, তাই আন্দাজ করেছিলুম। যা-ই হোক, তোমার কমলাসাগরের গল্পটা তুমি বলো।” 

শঙ্কর বলল, “রাজা তো মন্দিরের কাছে দিঘি কাটালেন, কিন্তু দিঘিতে কিছুতেই জল আসে না। ব্যাপার দেখে সকলের মাথায় হাত। তো শেষপর্যন্ত মা-কালী এসে রাজাকে স্বপ্নে দেখা দিলেন। বললেন, রানিকে এসে নিজের হাতে এক কোদাল মাটি কাটতে হবে, তা নইলে এই দিঘিতে জল আসবে না।” 

“তা রানি-মা এসে কোদাল চালালেন?” 

“না চালিয়ে উপায় আছে? বাপ রে!”

“জলও উঠল?” 

শঙ্কর একগাল হেসে বলল, “উঠল বলে উঠল। রানি-মা এসে যেই না এক-কোদাল মাটি কেটেছেন, পাতাল ফুঁড়ে অমনি এমন তোড়ে জল বেরোতে লাগল যে, দেখতে না দেখতে দিঘি ভরাট।” 

দীপকের সিগারেট খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। আড়াল থেকে সে এই সময়ে সামনে এসে পড়ায় গল্পটা আর এগোয়নি। এখন আমরা মোটামুটি ভদ্র-গোছের একটা হোটেলে বসে চা খাচ্ছি। চা খাওয়া শেষ হলেই আমরা সিপাহিজলার দিকে রওনা হব। 

রওনা হতে-হতে তা প্রায় ছ’টা। সবে মার্চ মাস শুরু হয়েছে, কলকাতায় এই সময়ে গরম পড়ে যায়, কিন্তু এখানে মোটামুটি ঠান্ডাই চলতে থাকে শুনেছি, কিন্তু হোটেলের মধ্যে একটু-একটু গরম বোধ হচ্ছিল। বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তার কারণটা বোঝা গেল। দিব্যি মেঘ জমেছে। হঠাৎ এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ছুটে এল, সঙ্গে-সঙ্গে উড়তে লাগল ধুলো। যে গাছপালাগুলো এতক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তারাও অমনি এমনভাবে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল যে, মনে হল প্রকৃতির রাজ্যে একটা-কিছু সর্বনাশের ঘটনা ঘটে গেছে। 

দীপককে বললুম, “ঝড় উঠেছে দেখছি, এর মধ্যে গাড়ি চালানো ঠিক হবে?” 

দীপক হেসে বলল, “ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। শঙ্কর খুব এক্সপার্ট ড্রাইভার। ও ঠিকই চালাতে পারবে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।” 

ঝড় থামতেই শুরু হল বৃষ্টি। গেড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায়। তারপর একেবারে মুষলধারে। 

তারই মধ্যে হেডলাইট জ্বেলে গাড়ি ছুটছে। বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচবার জন্যে জানলায় কাচ তুলে দেওয়া হয়েছে। সারাক্ষণ ওয়াইপার চালিয়ে সামনের উইন্ডস্ক্রিন থেকে জল সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু কাচের ভিতরের দিকটা বাষ্পে কারবার ঢাকা পড়ে যাওয়ায় পথঘাটের প্রায় কিছুই আমার চোখে পড়ছিল না। 

ঘন্টা দেড়েক গাড়ি চলবার পরে বুঝতে পারলুম যে, বৃষ্টি এবারে ধরেছে। আমার দু’পাশের জানলার কাচ দুটো নামিয়ে নিলুম। চারদিকে একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে মাঝে-মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। তাতে বুঝলুম যার উপর দিয়ে চলছি, সেটা মসৃণ একটা রাস্তাই বটে। 

হাতঘড়ির রেডিয়াম লাগানো ডায়ালের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, আটটা দশ। 

গাড়ির গতি ইতিমধ্যে অনেক কমে গিয়েছিল। বললুম, “আর কত দূর দীপক?”

দীপক বলল, “আমরা এসে গেছি।” 

গাড়ি থামল। হেডলাইটের আলোয় সামনে যা আমার চোখে পড়ল, সেটা একটা বে। বড় মাপের দোতলা কাঠের বাড়ি। ভিতরে ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে। 

হর্ন বাজাতে হল না। গাড়ির শব্দ পেয়েই বাড়ির ভিতর থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন, তিনি আমার চেনা মানুষ। আমাকে দেখে দু-হাত বাড়িয়ে দিয়ে চারু ভাদুড়ি বললেন, “ওয়েলকাম টু সিপাহিজলা।” 

এইখানে এই পরিবেশে, এমনভাবে যে ভাদুড়িমশাইয়ের দেখা পেয়ে যাব, তা আমি ভাবিনি। ভাদুড়িমশাই সাত-সকালে জগিং করতে বেরিয়ে নিরুদ্দেশ হলেন, আর সেইদিনই রাত্তিরে ফোন করে আমাকে বলা হল যে, পরদিন আমাকে আগরতলা যেতে হবে, এ দুটো ঘটনার মধ্যে যে একটা যোগসূত্র রয়েছে, তা আমি আন্দাজ করেছিলুম ঠিকই, কিন্তু আজই যে তাঁর দেখা পেয়ে যাব, তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। 

আনন্দে আমার মুখ দিয়ে যেন কথাই সরছিল না। আবার একইসঙ্গে রাগও হচ্ছিল খুব। রাগটাই প্রথমে প্রকাশ পেল। বললুম, “আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই। এইখানে এই জঙ্গলে এসে লুকিয়ে রয়েছেন, আর ওদিকে কলকাতায় সকলের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ!” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “এটা জঙ্গল হবে কেন, অতি চমৎকার জায়গা : রাত্তির বলে বুঝতে পারছেন না, সকাল হলে বুঝবেন।…..আর হ্যাঁ, কারও নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হবারও তো কিছু নেই। কাউকে কিছু না-বলে কাল আগরতলায় চলে আসতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এখানে পৌঁছেই তো দীপককে দিয়ে কলকাতায় ফোন করানো হয়। কেন, মালতী কোনও ফোন পায়নি?” 

দীপক এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবারে বলল, “আপনি তো কলকাতার দুটো নম্বর আমাকে দিলেন। একটা বালিগঞ্জের, একটা ধর্মতলার। বালিগঞ্জের নাম্বারটা লাগতে পারিনি।” 

আমি বললুম, “কী করে লাগবে, মালতীদের বাড়ির নাম্বারটা কাল সকাল সাড়ে-দশটার পর থেকেই খারাপ।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাই?” তারপর দীপকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আর ধর্মতলার চেম্বারের নাম্বারটা?” 

দীপক বলল, “সেটাও প্রথম দিকে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করে রাত আটটা নাগাদ পাওয়া গেল।” 

“ডাক্তারবাবুকে পেয়েছিলে?” 

“তা পেয়েছিলুম। কিন্তু আপনি যে ভাল আছেন, আর মিঃ চ্যাটার্জিকে যে আজ দুপুরের ফ্লাইটে আগরতলা আসতে হবে, এর বেশি আর কিছুই বলতে পারিনি। লাইন কেটে গেল।” 

“তা হলে আজ সকালে আবার ফোন করলে না কেন? কাল থেকে আজ বিকেল পর্যন্ত তো তুমি আগরতলাতেই ছিণে। অনায়াসেই আজ একটা ফোন করে ডিটেলস জানাতে পারতে।” 

আমি বললুম, “ফোন করে কোনও লাভ হত না। চেম্বার বন্ধ। অরুণের মায়ের খুব অসুখ। ওরা তাই বেহালার বাড়িতে চলে গেছে।” 

“আপনাকে যে এখানে আসতে হবে, এ-কথা আপনাকে কে জানাল? অরুণ?”

“না। ওঁদের এক প্রতিবেশী। নাম বললেন, প্রমোদ সেন। তা ছাড়া অরুণের চিঠি নিয়ে শশাঙ্ক….মানে অরুণের চেম্বারের রিসেপশনিস্ট আজ সকালে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। অরুণের চিঠি পড়ে শুধু এইটুকু জানা গেল যে, ‘আজই আমাকে এখানে আসতে হবে। আপনি যে ভাল আছেন, চিঠিতে তারও উল্লেখ ছিল। কিন্তু কোথায় আছেন, কাদের কাছে আছেন, কেনই বা জগিং করতে গিয়ে হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেলেন, সে-সব কিছু জানায়নি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিজে জানলে তো আপনাকে জানাবে। দীপকের কথা তো শুনলেন, অরুণকে সব কথা খুলে বলবার সুযোগই ও পায়নি, তার আগেই লাইন কেটে যায়।”

দীপক বলল, “লাইনে খুব ডিলটারব্যান্সও হচ্ছিল।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “থাক, ও সব কথা পরে হবে। অরুণদের বেহালার বাড়ির ফোন-নাম্বারটা আমার কাছে আছে। তুমি বরং কাল সকালেই একবার আগরতলা গিয়ে বেহালায় একটা ফোন করে সব জানাও। অরুণের মা এখন কেমন আছেন, সেই সময়ে সেটাও জেনে নিয়ো।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, ভিতরে চলুন। ওঁরা অপেক্ষা করছেন।” 

একেবারে যে ভিতরে ঢুকলুম তা নয়। একতলার সামনের বারান্দাটা দেখলুম বেশ চওড়া, তার উপরে সোফা সেটি দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো। মেঝেতে দড়ির কার্পেট। চারদিকে কাচের দেওয়াল। কাঠের চৌকো চৌকো ফ্রেমের মধ্যে কাচগুলিকে বসানো হয়েছে, বাইরের দৃশ্য যাতে সহজেই চোখে পড়ে, চোখ আটকে না যায়। বাইরে অবশ্য এখন অন্ধকার, তাই কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। বারান্দার একদিক থেকে একটা কাঠের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। বুঝলুম এই বারান্দাটাকেই বসবার ঘর হিসাবে ব্যবহার করা হয়। 

মাঝখানের সোফাটায় যিনি বসে ছিলেন, কাগজে তাঁর ছবি আমি দেখেছি, তাই চিনতে অসুবিধে হল না। বঙ্কুবিহারী ঘোষ। একমাথা সাদা চুল, মুখ নিচু করে তিনি কিছু ভাবছিলেন। আমরা এসে ঢুকতে তিনি মুখ তুললেন, কিন্তু সোফা ছেড়ে উঠলেন না। যেমন বসে ছিলেন, তেমন বসে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বঙ্কু এসেছেন চারু?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ। হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হল তো, তাই পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গেল।”

লক্ষ করলুম, প্রশ্নটা ভদ্রলোক ভাদুড়িমশাইকে করলেও তাঁর চোখ দুটি ছিল আমার দিকে। এবারে ভাদুড়িমশাইয়ের গলা শুনে তিনি তাঁর দিকে চোখ ফেরালেন। বললেন, “চা আনতে বলি। তোমার বন্ধুর তো ধকল নেহাত কম হয়নি। রাতটা উনি বিশ্রাম নিন, কাজের কথা কাল সকালে হবে। এখন চা খাও। আমিও তোমাদের সঙ্গে এক কাপ খাব।” 

গাড়ির শব্দ পেয়েই সম্ভবত উনুনে চায়ের জল চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বঙ্কুবাবুকে তাই আর কাউকে ডেকে চায়ের কথা বলতে হল না, ট্রের উপরে চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে ভিতরের দিকের দরজার পর্দা সরিয়ে উর্দি পরা একজন বেয়ারা এসে ঘরে ঢুকল। তার পিছন-পিছন এলেন একজন মহিলাও। বেয়ারাকে বললেন, “এখন তুমি যাও, দরকার হলে আমি ডাকব।” 

ভদ্রমহিলার বয়স মনে হল বছর চল্লিশ। প্রসাধন একটু উগ্র রকমের। ঠোঁটে পুরু লিপস্টিক। ভুরু একেবারে ধনুকের মতো বাঁকানো। ওটা যে স্বাভাবিক ভুরু নয়, প্লাক করে ওকে ওই আকৃতি দেওয়া হয়েছে, দেখবামাত্র সেটা বোঝা যায়। পরনে স্লিভলেস ব্লাউস, শিফনের শাড়ি। পায়ে মখমলের চটি। বয়স যা-ই হোক, চেহারায় একটা খুকি খুকি ভাব অনেকেই বজায় রাখতে চান। ইনিও সম্ভবত তা-ই চাইছেন। মুখটা চেনা-চেনা মনে হল, কিন্তু কোথায় দেখেছি, তক্ষুনি তা মনে করতে পারলুম না। 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বসুন মিসেস ঘোষ। একটা ভাল খবর দিচ্ছি। কাজটার জন্যে আমরা যাঁকে চাইছিলুম তিনি এসে গেছেন।” 

ভদ্রমহিলা পট থেকে পেয়ালায় চা ঢালছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে মাথাটা একটু নোয়ালেন। তারপর আবার পেয়ালার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, “ওঁরটা তো জানি, আপনারটাও এই দু’দিনে জেনে নিয়েছি, মিঃ চ্যাটার্জির কতটা দুধ-চিনি লাগবে?” 

বললুম, “দুধ চিনি লাগবে না। আমি স্রেফ লিকার খাই।’ 

মিসেস ঘোষ আবার সামান্য হাসলেন। বললেন, “বাঃ, একেবারে আমারই মতন।” 

কাপে কাপে চা ঢালা হয়ে গিয়েছিল। সোফা থেকে উঠে গিয়ে আমি আর ভাদুড়িমশাই আমাদের কাপ দুটো নিয়ে এলুম। ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীর দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমারটা নাও।” 

লক্ষ করলুম বঙ্কুবাবু হাত বাড়িয়ে দিলেন বটে, কিন্তু ঠিক যে কাপটার দিকেই, তা নয়। ফলে মিসেস ঘোষ তাঁর সোফা থেকে উঠে গিয়ে স্বামীর হাতে কাপটা ধরিয়ে দিলেন। বললেন, “খাওয়া হয়ে গেলে নিজেই যেন আবার কাপটা নামিয়ে রাখতে যেয়ো না। আমাকে বোলো, আমি নামিয়ে রাখব।” 

যা সন্দেহ করেছিলুম, সেটাই তা হলে ঠিক। বঙ্কুবাবু হয় আদৌ কিছু দেখতে পান না, অথবা খুবই কম দেখতে পান। 

ভাদুড়িমশাইয়ের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সাইড টেবিলে কাপ-প্লেট নামিয়ে রেখে তিনি বললেন, “মিঃ চ্যাটার্জি তো এসেই গিয়েছেন, কিন্তু আমি বলি কী,কাজের কথাটা আজ না হয়ে কাল হলেও ক্ষতি নেই। 

আমি বললুম, “কাজ তো একটা স্ক্রিপট লেখা, তাই না?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে তো দেখছি জানেনই। কিন্তু কথাটা আপনাকে কে বলল?”

হেসে বললুম, “আপনি অবশ্যই বলেননি। 

“তা হলে?” 

“দীপক বলেছে। ওর কাছেই শুনলুম যে, সেইজন্যই আমাকে তলব করা হয়েছে এখানে।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “আহা-হা, ব্যাপারটা ওভাবে নিচ্ছেন কেন? আপনি একজন বিখ্যাত লেখক, আর আমরা নেহাতই ব্যাবসা করে খাই। আমরা কি আপনাকে তলব করতে পারি? ও নো নো, কাইগুলি এটাকে ওভাবে নেবেন না। আমরা আপনার সাহায্য চাই, আর আপনি আমাদের সাহায্য করতে কষ্ট করে এখানে এসেছেন। তার জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ।” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “অ্যান্ড অ্যাজ এ টোকেন অব আওয়ার গ্র্যাটিচিউড, উই শ্যাল পে ইউ হ্যান্ডসামলি।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “আহা-হা ডলি, ইউ হ্যাভ এ টেনডেনসি অব সেয়িং দি রং থিং অ্যাট দি রং মোমেন্ট। এখুনি পেমেন্টের কথা তুলছ কেন? দয়া করে আগে উনি রাজি হোন, ও-সব কথা তার পরে উঠবে।” 

আমি বললুম, “কী করে রাজি হব? আমি লিখি বটে, কিন্তু সব লেখাই কি এক গোত্রের? স্ক্রিপট লেখার একটা আলাদা টেকনিক আছে। আমি সে-সব জানি না। তা হলে আমি কী করে স্ক্রিপট লিখব?” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “সে কী, আপনি কখনও ফিল্মের গল্পের স্ক্রিপট লেখেননি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিনয় খুবই ভাল জিনিস, কিরণবাবু, কিন্তু সেটা একটা মাত্রার মধ্যে থাকা চাই। আপনার বিনয় দেখছি মাত্র। হাড়িয়ে যাচ্ছে। ……ওহে বঙ্কু, আমার এই বন্ধুটির কথা বিশ্বাস কোরো না।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “আরে আমি কেন বিশ্বাস করতে যাব? আমি মাল বেচে খাই, লোক চিনতে আমার ভুল হয় না। মিঃ চ্যাটার্জি যে সাচ্চা লোক, সে আমি ওঁর কথা শুনেই বুঝেছি। এখন তুমি ওঁকে রাজি করাও চারু।” 

ঢোক গিলে বললুম, “কিন্তু……” 

কথাটা শেষ করতে পারলুম না। ভাদুড়িমশাই একেবারে গর্জন করে উঠে বললেন, “ঢের হয়েছে, কিরণবাবু, আর কিন্তু-কিন্তু করবেন না। কী ভেবেছেন আপনি বলুন তো? ইতালিয়ান গবর্নমেন্টের হয়ে গোটা কয়েক ডকুমেন্টারি করবার প্রোজেক্ট নিয়ে যেহেতু গত কয়েক বছর আমি বিদেশে ছিলুম তাই দেশের কোনও খববই আমি রাখি না, কেমন? এই যে ভেনিসের ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘প্রদীপের নীচে’ ফিল্মটা স্পেশ্যাল অ্যাওয়ার্ড পেল, তার চিত্রনাট্য তো আপনারই লেখা। তা হলে?” 

ভাদুড়িমশাই গত কয়েক বছর বিদেশে ছিলেন? তাও আবার ডকুমেন্টারি করবার জন্যে? কই, আমি তো কিছুই জানি না। হ্যাঁ, মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকায় গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেখানে মাত্র মাসখানেক কাটিয়ে তারপর অক্টোবরেই তো দেশে ফিরে আসেন। আর এই ‘প্রদীপের নীচে’! ও-রকম কোনও ফিল্মের নামই আমি শুনিনি, চিত্রনাট্য লেখা তো দূরের কথা। 

আমি একেবারে থ হয়ে গেলুম। বলতে যাচ্ছিলুম, ব্যাপার কী বলুন তো, আমি কি অ্যালিসের সেই আজব জগতে এসে পড়লুম নাকি, কোনও কিছুরই তো মাথামুণ্ডু আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, ভাদুড়িমশাই তো আবোল-তাবোল কথা বলবার লোক নন, নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যাপার আছে এর মধ্যে। তাই, ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের কিছু বলে অবস্থাটার আপাতত সামাল দেওয়াই ভাল। 

আমতা আমতা করে বললুম, “ওটা…মানে ওই স্ক্রিপটটা তো? ওটা তো বছর কয়েক আগে লেখা, আসলে ওরাই বইটা তুলতে একটু দেরি করে ফেলল। কিন্তু ওটার স্ক্রিপট লিখতে পেরেছি বলেই যে এটারও পারব, তার তো কোনও মানে নেই। গল্পটাই তো এখনও দেখিনি।” 

ভাদুড়িমশাই বঙ্কুবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী হে বঙ্কু, ঠিক বলেছিলুম কি না? না না, ও নিয়ে তুমি ভেবো না। কিরণবাবুকে যখন পেয়েছি, তখন আওয়ার প্রবলেম ইজ সল্ভড।” তারপর আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে, “আরে মশাই, গল্প নিয়ে ভাববেন না। গল্প মিসেস ঘোষেরই। তবে প্লটটা আমাকে শুনিয়েছেন মাত্র, এখনও লিখে ফেলতে পারেননি। দারুণ প্লট। স্রেফ ওরই জন্যে ফিল্মটা নির্ঘাত হিট হবে।” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “প্লটটা আপনার বন্ধুকে বলব?” 

“না, না, এখন নয়, এখন নয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাল তো আমরা লোকেশন ঠিক করতে সাগরমহল যাচ্ছি। সারাটা দিন ওখানে থাকব। রাত্তিরটাও ওখানেই কাটাবার ইচ্ছে। সুতরাং বিস্তর সময় তখন পাওয়া যাচ্ছে।” 

আমি বললুম, “বলেন তো এখনও শুনতে পারি। আমার কোনও আপত্তি নেই।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “থাক, ডলি, আজ উনি খুব ক্লান্ত, সারাটা দিন জার্নির ধকল গেছে, আজ উনি তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন। উই শুড়নট রাশ হিম। কী বলো চা, ঠিক বলিনি?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুমি তো এ পর্যন্ত বেঠিক কিছু বলোনি। এটাও ঠিকই বলেছ।” 

মিসেস ঘোষ উঠে পড়লেন। বললেন, “আপনারা মুখ-হাত ধুয়ে নিন, আমি ওদিকে যাই। কিন্তু দীপক কোথায় গেল?” 

ড্রইং রুমের লাগোয়া ঘরেই ছিল দীপক। সম্ভবত সেখানে থেকে কথা শুনছিল আমাদের। বেরিয়ে এসে বলল, “আমাকে কিছু বলবে?” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “তুইও মুখ-হাত ধুয়ে নে। একটু বাদে খেতে দেব। আর হ্যাঁ, শঙ্কর কোথায়? তাকে দেখছি না যে? আগরতলায় ফিরে যায়নি তো?” 

“ফিরে যেতে চেয়েছিল। আমি যেতে দিইনি। কাল তো তোমরা সবাই সাগরমহলে যাচ্ছ, তার জন্যে অন্তত দুটো গাড়ি লাগবে। শঙ্করকে তাই আটকে রেখেছি।” 

“ঠিক করেছিস।” 

কথাটা বলে মিসেস ঘোষ ভিতরে চলে গেলেন। 

দীপক আর পাশের ঘরে ঢুকল না। আমার পাশের সোফাটায় বসে পড়ে বলল, “আমি তো কাল আবার আগরতলায় যাচ্ছি, আপনাদের সব ঠিক আছে তো?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “অ্যাবসলিউটলি। মিঃ চ্যাটার্জি প্রথমটায় রাজি হচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছেন। নইলে খুব মুশকিলে পড়তুম।” 

বঙ্কুবাবু বললেন, “লেখক মানুষ তো, খুব সাবধানে তাই হ্যান্ডল করতে হয়। তোমার দিদি সেটা বোঝেন না। টাকার কথা তুলে এক্ষুনি সব ভণ্ডুল করে দিচ্ছিলেন। আরে বাবা, টাকা তো আমরা দেবই কিন্তু শুধু টাকা ঢাললেই কি মনের মতো কাজ পাওয়া যায়? নাকি টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করানো যায় সবাইকে?” এমনভাবে কথাটা বললেন বঙ্কুবাবু, যেন ব্যাপারটা তাঁর মতন আর কেউ বোঝে না। যেন সারা জীবন শুধু লেখক হ্যান্ডল করেই তিনি কাটিয়েছেন। 

খানিকটা সময় গল্প করে কাটল। সিনেমার গল্প নয়, ত্রিপুরার মানুষজন আর বন-জঙ্গল পাহাড়-নদীর গল্প। শুনলুম বাইরে থেকে এখন যতটা শান্ত দেখাচ্ছে, এই অঞ্চল বরাবর ঠিক ততটাই শান্ত ছিল না। অশান্তির আগুন যে এখনও মাঝে-মাঝে জ্বলে ওঠে না, তা নয়, তবে তার মূলে রয়েছে সেই রকমের ইন্ধন, যা শুধু রাজনীতিকরাই জুগিয়ে থাকেন। সেটা যে কোথায় তাঁরা জোগান না বলা শক্ত। দেশের আর-পাঁচটা জায়গায় যে আগুন জ্বলছে, তার ইন্ধন তো তাঁরাই জোগাচ্ছেন। এ ব্যাপারে ত্রিপুরাকে অতএব আলাদা করে দেখবার জো নেই। 

বেয়ারা একটু আগে এসে কাপ-প্লেট তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এবারে ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে মিসেস ঘোষ বললেন, “আপনারা আসুন, খেতে দেওয়া হয়েছে। ….মি চ্যাটার্জি, বেয়ারা আপনার হ্যান্ডব্যাগটা উপরে তুলে দিয়েছে, ওই মানে উপরে যে ঘরটায় আপনি থাকবেন। ইচ্ছে করলে আগনি জামাকাপড় পালটে আসতে পারেন।” 

বললুম, “দরকার হবে না। খাওয়া শেষ করে তারপর উপরে যাব।” 

দীপক বলল, “ভাঞ্জা কোথায়? তাকে দেখছি না যে?” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “রামু? ওর একটু মাথা ধরেছিল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়েছে।”

ভিতরে ডাইনিং হল। আমরা গিয়ে খেতে বসলুম। খেতে-খেতেই লক্ষ করলুম যে, মিসেস ঘোষকে একটু গম্ভীর দেখাচ্ছে। কারণটা হয়তো এই যে, এখনও তিনি তাঁর গল্পের প্লটটা আমাকে শুনিয়ে দেবার সুযোগ পাননি। 

দোতলায় পাশাপাশি দুটো ঘর। ঘরের সামনে, ঠিক একতলারই মতন, চওড়া ঘেরা-বারান্দা। যে-ঘরটায় আমাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, তার লাগোয়া খানিকটা ফাঁকা জায়গা। ছাদ। দোতলায় সবখানি জায়গা জুড়ে ঘর তোলা হয়নি বলে ওই ছাদের সুবিধেটা পাওয়া যাচ্ছে। ছাদটা রেলিং দিয়ে ঘেরা। 

একটা ঘরে ভাদুড়িমশাই থাকবেন, একটা ঘরে আমি। দুটো ঘরে দুটো সিঙ্গল খাট। তাতে পরিপাটি করে বিছানা পাতা। ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম। উঁকি মেরে দেখলুম, তাতে শাওয়ার ওয়াশ-বেসিন ইত্যাদি সবই রয়েছে। অর্থাৎ ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি নেই। 

একতলার মতন দোতলার ঘেরা বারান্দাটাও সোফা সেটি দিয়ে সাজানো। ভাদুড়িমশাই সেখানে বসে সিগারেট খাচ্ছিলেন। জামাকাপড় পালটে আমি তাঁর পাশের সোফায় এসে বসলুম। বললুম, “এবারে একটু খুলে বলুন তো ব্যাপারটা কী।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এমন কিছু জটিল ব্যাপার নয়। সকালে লেকে গিয়েছিলুম জগিং করতে। সেখানে বঙ্কুর সঙ্গে দেখা হয়। বঙ্কু আমার কলেজ-জীবনের বন্ধু। ছাত্র ভাল ছিল, কিন্তু গরিব-ঘরের ছেলে, পয়সার অভাবে পড়াটা চালিয়ে যেতে পারেনি, আই. এ. পাশ করবার পরে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ছোটোখাটো একটা ব্যাবসা শুরু করে। প্রথমটায় খুব সুবিধে হয়নি, পরে সেকেন্ড ওয়ার্লড ওয়রের সময় ওর কপাল খুলে যায়। ধুলোমুঠি সোনা বলে একটা কথা আছে না? একেবারে সেই ব্যাপার। কয়লা, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, যা ধরে, তা-ই সোনা। আপনি খবরের কাগজে কাজ করেন, ওর এখনকার অবস্থা তো আপনার না-জানবার কথা নয়।” 

“জানি বই কী, কিন্তু ওঁর জোরটা আসলে কোথায়?” 

“আসল জোর হার্ড-ক্যাশ। ও তো ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট নয়, ট্রেডার। কিন্তু এমন কোনও ট্রেড নেই, যার থেকে ও কোটি-কোটি টাকা আদায় করে নিচ্ছে না। ওই হার্ড-ক্যাশের জন্যেই। অনেক ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টকেও এসে বঙ্কুর কাছে হাত পাততে হয়। দুকোটি টাকা দরকার, এক্ষুনি চাই। কে দেবে? বঙ্কু দেয়। কত পার্সেন্ট ইন্টারেস্টে দেয়, শুনলে আপনি আঁতকে উঠবেন। অথচ ওকে দেখুন, ওর কথাবার্তা শুনুন, ওর চালচলন খেয়াল করুন, কিচ্ছুটি আপনি বুঝতে পারবেন না।” 

“কলেজ জীবন শেষ হবার পরেও আপনি ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন?” 

“তা রেখেছিলুম বই কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সকলের সঙ্গেই আমি যোগাযোগ রাখি, বঙ্কুর সঙ্গেও রেখেছি। তাই বলে কি আর প্রায়ই ওর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়? তা হয় না। তবে ওর ব্যাবসার জাল তো সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। ব্যাঙ্গালোরেও বছরে একবার-দুবার যায়। তখন খবর দেয়, দেখা করে। ইতিমধ্যে আবার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের একটা মালটিস্টোরিড বিল্ডিংয়ে দুটো ফ্ল্যাট কিনেছে। সেই সূত্রে কলকাতায় এসেছিল। ফলে লেকের ধারে দেখা হয়ে গেল। নইলে আবার কবে দেখা হত, কে জানে।” 

“সাধারণত উনি থাকেন কোথায়?” 

“ভুবনেশ্বরে। তবে শহরের মধ্যে নয়। শহর থেকে মাইল কয়েক দূরে। ওই যে হাইওয়েটা ভুবনেশ্বর থেকে পুরীর দিকে চলে গিয়েছে, তার ধারে বাড়ি করেছে। বিশাল বাড়ি।” 

বললুম, “সেখান থেকেই ওঁর অন্যান্য জায়গার সব অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।”

চারু ভাদুড়ি হেসে বললেন, “অন্যান্য জায়গায় তো ওর কোনও অফিস নেই। অফিস তো ওর এজেন্ট আর সাব-এজেন্টদের। বছরে ও একবার দুবার তাদের কাছে যায়, পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়ে চলে আসে।” 

অবাক হয়ে বললুম, “শুনেছি ওঁর বিশাল কারবার। তা হলে অন্য কোথাও অফিস খোলেন না কেন? খরচের ভয়ে?” 

ভাদুড়িমশাই আবার হাসলেন। বললেন, “খর্চার ভয়ে নয়, ঝামেলার ভয়ে। বঙ্কু বলে, একগাদা অফিস খোলা মানেই একগাদা ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়া।” 

“কিন্তু এজেন্টরা তো ওঁকে ঠকাতে পারে।” 

“কেউ যে কখনও ঠকাবার চেষ্টা করেনি, তা নয়। কেউ ভুল-হিসেব দেখিয়ে ওকে কম টাকা দিয়েছে, কেউ টাকা ধার নিয়ে শোধ করেনি। তার ফল কী হয়েছে, জানেন?” 

“কী হয়েছে?” 

“বঙ্কু হ্যাজ সিম্পলি ড্রিভন দেম আউট অব দেয়ার বিজনেস। ব্যবসায়ী মহলে ওর ক্লাউটের কথা তো শুনলেন। একবার যদি কাউকে ও ব্লা্যকলিস্ট করে, তো তার হয়ে গেল, অন্য কোনও ব্যবসায়ী তাকে আর চিমটে দিয়েও ছুঁয়ে দেখবে না। ওভারনাইট হি বিকামস এ পারিয়া। অ্যান আউটকাস্ট।” 

খানিকক্ষণ চুপচাপ কাটল। ফাল্গুন মাস। খানিক আগে ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাতাসে ঠাণ্ডার আমেজ। বেশ শীত-শীত করছিল। ঘরে গিয়ে একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে ফিরে এসে বললুম, “আসল কথাটা এখনও কিন্তু জিজ্ঞেস করিনি।” 

ভাদুড়িমশাই ইতিমধ্যে আর-একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন। এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “হঠাৎ কাউকে কিছু না-বলে কেন বঙ্কুর সঙ্গে এখানে চলে এলুম এই তো?…..আসলে এমনটা যে হবে, তা আমিও জানতুম না। কী হল জানেন, লেক থেকে বঙ্কু আমাকে তার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। যে-লোকটা ওর ফ্ল্যাটের দেখাশোনা করে, একমাত্র সে ছাড়া আর কেউ সেখানে ছিল না। সে-ই বঙ্কুকে লেকের ধারে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সে-ই আমাদের সঙ্গে আবার ফ্ল্যাটে ফিরে আসে।” 

“কেন, ওঁর স্ত্রী সেখানে ছিলেন না?” 

“না। ওর স্ত্রীকে আপনি দেখেছেন। শালাকেও দেখেছেন। তবে ওর বড়ছেলে রামু তো ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাকে তাই দেখেননি। তিনজনকে নিয়েই ও ভুবনেশ্বর থেকে কলকাতায় এসেছিল। ভেবেছিল, সবাই মিলে আগরতলায় যাবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেটা হয়নি। ব্যাবসার একটা কাজে ও বাড়তি একটা দিনের জন্যে কলকাতায় আটকে যায়। ফলে, ওর বউ ছেলে আর শালা পরশুদিন আগরতলায় এসেছে আর আমরা এসেছি কাল।” 

“তা তো বুঝলুম, কিন্তু আপনাকে আসতে হল কেন?” 

“না এসে উপায় ছিল না যে!” ভাদুড়িমশাই হাসলেন। “কিন্তু সবটা আগে শুনুন। ওর জীবনে কয়েকটা প্রবলেম দেখা দিয়েছে। তাই নিয়ে কথা বলতে-বলতে সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। তখন ও উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চলি রে, সাড়ে বারোটার মধ্যে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে হবে। তুই আমার সঙ্গে গেলে বড় ভাল হত।” 

“ব্যস, অমনি আপনি ওঁর সঙ্গে আগরতলায় চলে এলেন?” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওর প্রবলেম যে কী, তা আপনি জানেন না কিরণবাবু। জানলে সম্ভবত আপনিও বলতেন যে, আসাটাই ঠিক হয়েছে, না এলে অন্যায় হত। …একেবারে একবস্ত্রে চলে এসেছিলুম। এখানে এসে রেডিমেড একজোড়া ট্রাউজার্স, দুটো শার্ট আর ওই কিছু আন্ডারগার্মেন্টস কিনে নিয়েছি।” 

“কিন্তু মালতীকে একটা খবর না দিয়েই চলে এলেন কেন?”

“সাড়ে এগারোটায় ডিসিশন নিই যে, আমি আসব। তৎক্ষণাৎ মালতীকে ফোন করি। একবার নয়, তিন-চার বার। কিন্তু প্রত্যেকবারই এনগেজড টোন আসতে থাকে। তখন ঠিক করি, এয়ারপোর্টে তো মোটামুটি সাড়ে-বারোটার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি, সেখান থেকে ফোন করব। তা যে করিনি, তাও নয়। কিন্তু সেই একই ব্যাপার, এনগেজড।” 

বললুম, “সাড়ে দশটার পরেই ওদের বাড়ির ফোনটা বিগড়ে গিয়েছিল যে!” 

“সে তো এখন আপনার কাছে শুনছি। এদিকে সিকিউরিটি চেকের জন্যে বারবার ডাক পড়ছিল। তাই মনে হল, ঠিক আছে, আগরতলা থেকে ফোন করব। আসলে ওদের ফোনটাই যে বিগড়ে গিয়েছে তা তো আর তখন জানতুম না। তাই ভাগ্যিস বুদ্ধি করে অরুণের চেম্বারের নম্বরটা দীপককে দিয়েছিলুম। নইলে হয়তো আপনারা একটা হুলুস্থুলু বাধিয়ে দিতেন। মালতীদের বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে যেত, আর খবর না-পেয়ে আপনিও ভাবতেন যে, আমি গুমখুন হয়েছি।” 

হেসে বললুম, “সত্যি বলতে কী, খবরটা পেয়েও আমি বিশেষ নিশ্চিন্ত হতে পারিনি। সারাটা পথ দুশ্চিন্তায় কেটেছে।” 

চারদিকের গাছপালার ভিতর দিয়ে ঝরঝর করে হাওয়া বইছে। সামনে বাগান। তার মধ্যে এখানে-ওখানে কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট। নীচের লন আর কয়েকটা ফ্লাওয়ার বেডের উপরে তার আলো পড়েছে। ডালপালার নড়াচড়া ছাড়া আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলুম আমরা। তারপর ভাদুড়িমশাই-ই প্রথম কথা বললেন। 

“এই যে হঠাৎ আপনি চলে এলেন, এতে আপনার কাজের কোনও ক্ষতি হবে না তো?”

বললুম, “না।” 

“অফিসকে জানিয়ে এসেছেন, আশা করি।” 

“তা জানিয়েছি।” 

“কয়েকটা দিন কিন্তু এখানে থাকতে হতে পারে।” 

“দরকার হলে থাকব। কিন্তু স্ক্রিপট লেখার ব্যাপারটা কী বলুন তো?” 

“ওটা আপনাকে এখানে নিয়ে আসার একটা ফিকির মাত্র। ভয় নেই, আপনাকে ও-সব চিত্রনাট্য-ফাট্য লিখতে হবে না। তবে হ্যাঁ, লিখবার একটা ভান অবশ্যই করতে হবে।” 

“আর আপনি কী করবেন?” 

“শুনলেন তো,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “বিদেশে গত কয়েক বছর ধরে আমি ফিল্ম তুলে বেড়িয়েছি, আর এখানে একটা ফিল্ম তুলতে পারব না? যে ছবির জন্যে এখানে লোকেশন বাছাই করতে আসা হয়েছে, আমি তার পরিচালক।” 

“ব্যাপারটা কী বলুন তো? চেষ্টা করলে আমি যে একটা স্ক্রিপট লিখে দিতে পারব না, তা নয়, কিন্তু আপনার ব্যাপারটা তো ডাহা মিথ্যে। গত কয়েক বছর মোটেই আপনি বিদেশে ছিলেন না।” 

“ঠিক। ওই লাস্ট ইয়ারে একবার বস্টনে গিয়েছিলুম। তাও মাত্র মাসখানেকের জন্যে।”

“ফিল্মের ব্যাপারেও ইউ নো নেক্সট টু নাথিং। যতই খারাপ হোক, কেঁদে ককিয়ে একটা স্ক্রিপট আমি ঠিকই খাড়া করতে পারব, কিন্তু ডিরেকশন? ওর তো আপনি অ-আ-ক-খও জানেন না।” 

হাত উলটে ভাদুড়িমশাই বললেন, “বোঝো ঠ্যালা। আরে বাবা, আপনাকে কি আমি বলেছি যে, ও-সব আমি জানি। জানি না মশাই, কিচ্ছুটি আমি জানি না। হল তো?” 

“তা হলে এ-সব মিথ্যে কথা এদের বলছেন কেন। এঁরা তো ভাবছেন, আপনি একজন ত্রুফো কিংবা গোদার। ধরা পড়লে যে হাতে হাতকড়ি পড়ে যাবে মশাই। আপনি তো মারা পড়বেনই, আমিও রেহাই পাব না!” 

সম্ভবত আমার গলাটা একটু উঁচুতে উঠে গিয়েছিল, ভাদুড়িমশাই বললেন, “অত উত্তেজিত হবেন না, যা বলবার আস্তে বলুন। একটা কথা আপনাকে মনে রাখতে বলি। এখানে যাঁদের দেখছেন, তাঁদের কাউকেই আমি শত্রু ভাবছি না, অন্তত ভাববার কোনও কারণ এখনও ঘটেনি; তবে কিনা, যার কথায় আমি আগরতলায় এসেছি, একমাত্র সেই বঙ্কুকেই আমি বিশ্বাস করছি, আর কাউকে নয়।” 

“বঙ্কুবাবুকে তা হলে মিথ্যে-পরিচয় দিচ্ছেন কেন?” 

“ওকে কেন মিথ্যে-পরিচয় দেব?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও সব জানে।” 

আমি তো অবাক। অনেক কষ্টে বলতে পারলুম, “বলেন কী!” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিকই বলছি। সমস্যাটা ওর, যা-কিছু টাকা ঢালবার তা ও-ই ঢালছে আর ও কিছু জানবে না? তা কি হয় কিরণবাবু? তা হয় না। এই যে অরুণ আপনার টিকিট কেটে দিয়েছে, তার টাকাও বঙ্কু রিইমবার্স করে দেবে, তার অর্ডার হয়তো কলকাতার কোনও এজেন্টকে ইতিমধ্যে পাঠানোও হয়েছে, দীপক যে কাল বিকেল থেকে আজ আপনি এসে পৌঁছনো পর্যন্ত আগরতলায় ছিল, তার মধ্যেই যদি অর্ডারটা পাঠানো না হয়ে থাকে, তো বলব, বঙ্কুকে আমি চিনি না। ওকে তো অনেক কাল ধরে দেখছি। তাই জানি যে, নিজের প্রাপ্যটা ও যেমন গলায় গামছা বেঁধে আদায় করে নেয়, অন্যের পাওনা মেটাবার ব্যাপারেও ওর তেমন তর সয় না। ও যে একেবারে স্ক্র্যাচ থেকে এখানে উঠে এসেছে, এটাও তার একটা মস্ত কারণ।” 

ভাদুড়িমশাই আবার একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর তাতে মস্ত একটা টান দিয়ে গলগল করে খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “বঙ্কুর আর-একটা মস্ত গুণ, ওয়ান ক্যান টেক হিম ইনটু ওয়ান’স কনফিডেন্স। অতিবড় সন্দিগ্ধ ব্যবসায়ীও তার দু’নম্বর খাতা দেখিয়ে ওর কাছে লোন চায় শুনেছি। কথাটা বঙ্কুই আমাকে বলেছে, যদিও ব্যবসায়ীর নামটা জানায়নি।” 

“আপনি জানতে চেয়েছিলেন?” 

“চেয়েছিলুম।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “জেনে তো আমার লাভ নেই, তবু যে জানতে চেয়েছিলুমৃ তার কারণ আর কিছুই নয়, স্রেফ ওকে পরীক্ষা করা। তা দেখলুম, যতবার প্রসঙ্গটা তুলি, ততবারই ও কায়দা করে এড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত বলল, ‘দ্যাখো ভাই, তুমি তো ওর কম্পিটিটর নও, ব্যাবসা-জগতের লোকই নও তুমি, তাই আমি খুব ভালই জানি যে, নামটা তোমাকে বললেও আমার এই পার্টির কোনও ক্ষতি হবে না। তবু বলব না কেন জানো? বললে সেটা বিশ্বাসের খেলাপ হবে, নিজের কাছে আমি ছোট হয়ে যাব। কিরণবাবু, আমার প্ল্যানের কথা সাধারণত আমার ক্লায়েন্টকে আমি বলি না। কিন্তু বঙ্কুকে বলেছি। তার একটা কারণ, বঙ্কুকে বিশ্বাস করা যায়।” 

“অর্থাৎ আরও কারণ আছে?” 

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আছে। ফিল্ম তোলার নাম করে যে ছকটা আমি সাজিয়েছি, বঙ্কুর খুব কাছের অন্তত তিনজন মানুষ তাতে ইনভলভড।” 

“অর্থাৎ ওঁর স্ত্রী, ছেলে আর শালা। মানে দীপক। এই তো?” 

“কারেক্ট। তবে, ফিল্মের সূত্রেই যে ছক সাজালুম, তার কারণ কিন্তু মিসেস ঘোষ। ভদ্রমহিলার খুব ইচ্ছে, তাঁর গল্প নিয়ে এবারে একটা বাংলা ছবি হোক।” 

“তার মানে এর আগেও ওঁর গল্প নিয়ে ফিল্ম হয়েছে নাকি?” 

“হয়েছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বঙ্কু এর আগেও চারটে ফিল্ম প্রোডিউস করেছে। সব ক’টাই হিন্দি, আর সব ক’টারই স্টোরি মিসেস ঘোষের।” 

হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আগরতলায় দীপকই এই ফিল্ম প্রোডাকশানের কথাটা প্রথম আমাকে জানিয়েছিল। বলেছিল যে, তার জিজাজি চার-পাঁচটা ফিল্ম প্রোডিউস করেছেন। বললুম, “দীপক বলছিল, তার তিনটেই নাকি হিট-ছবি।” 

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সব ক’টাই সুপার ফ্লপ। তবে বঙ্কুর তাতে কিছু আসে যায় না। ও ধরেই নিয়েছে, তরুণী ভার্যাটিকে খুশি রাখবার জন্যে মাঝে-মাঝে এইভাবে কিছু টাকা জলে ঢালতে হবে।”

“ছকটার কথা পরে হবে, আগে সমস্যাটার কথা শুনি। বঙ্কুবাবুর সমস্যাটা কী ধরনের? ব্যবসায়িক?” 

“না, পারিবারিক।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সমস্যার কথা পরে বলব। অল ইন গুড টাইম। আগে অন্য একটা কথা শুনুন।” 

শোনা হল না। বাতাসে একটা মৃদু সুবাস ছড়িয়ে গিয়েছিল। পিছন ফিরে দেখলুম, মিসেস ঘোষ সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখাচোখি হতে মৃদু হেসে বললেন, “আপনারা এখনও শুয়ে পড়েননি?” 

বললুম, “ঘুম আসছে না। তাই দুজনে বসে গল্প করছিলুম।” 

মিসেস ঘোষ বললেন, “তা হলে কি প্লটটা এখন বলব?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না, না, আর রাত জাগাটা আপনার ঠিক হবে না। কাল তো ব্রেকফাস্টের পরেই আমরা বেরিয়ে পড়ছি, সকালে আপনার বিস্তর খাটাখাটনি রয়েছে, এখন আপনি শুয়ে পড়ুন।”

মিসেস ঘোষের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। আর একটিও কথা না বলে পিছন ফিরে তিনি সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।