চরিত্র-বিচার
অঙ্কশাস্ত্রে প্রশ্ন ওঠে না, এ বাবদে আপনার কিংবা আমার অভিজ্ঞতার কী। রসনির্মাণে ঠিক তার উল্টো। সেখানে লেখক আপন অভিজ্ঞতা থেকে চরিত্র নির্মাণ করেন, আর পাঠক আপন অভিজ্ঞতা দিয়ে সেটাকে অল্পবিস্তর যাচাই করে নেন। কিন্তু যখন কোনও জাতির চরিত্র নিয়ে আলোচনা হয় তখন সেটাকে একদিক দিয়ে যেমন অঙ্কশাস্ত্রের মতো নৈর্ব্যক্তিক করা যায় না। ঠিক তেমনি সেটাকে সম্পূর্ণ নিজের অভিজ্ঞতার ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না এবং তখন আবার এ প্রশ্নও উঠে যেসব লোক আলোচনায় যোগ দিলেন তাঁদের অভিজ্ঞতা এ বাবদে কতখানি।
আমার অতি সামান্য আছে। তাই এই ভূমিকা দিয়ে আরম্ভ করতে হল। এবং অনুরোধ, নিজের অভিজ্ঞতার দোহাই যদি মাত্রা পেরিয়ে যায় তবে যেন পাঠক অপরাধ না নেন। সেটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছায়। ‘বাঙালিচরিত্র’ সম্বন্ধে যদি প্রামাণিক পুথি-প্রবন্ধ থাকত, তবে তারই ওপর নির্ভর করে আলোচনা অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারত। তা নেই। বস্তুত আমাদের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয় অন্য প্রদেশের লোক দ্বারা বাঙালি সম্বন্ধে অকৃপণ, অকরুণ নিন্দাবাদ থেকে। যথা ‘বাঙালি বড় দম্ভী’, ‘বাঙালি অন্য প্রদেশের সঙ্গে মিশতে চায় না।’ সহৃদয় মন্তব্য যে একেবারেই শুনতে পাওয়া যায় না, তা নয়– যেমন শুনবেন, ‘বাঙালি মেয়ে ভালো চুল বাঁধতে জানে,’ কিংবা ‘ব্যবসাতে বাঙালিকে ঘায়েল করা (অর্থাৎ ঠকানো) অতি সরল।’
আমি ভারতবর্ষের সব প্রদেশেই বাস করেছি। দিল্লিতেই প্রায় চার বৎসর ছিলুম। চোখ-কান খোলা-খাড়া না রাখলেও সেখানে আপনাকে অনেক খবর অনেক গুজব শুনতে হয়।
বাঙালির প্রতি আপনার যদি কোনও দরদ থাকে তবে কিছুদিনের মধ্যেই আপনি কতকগুলো জিনিস বুঝে যাবেন।
(১) সিন্ধি পাঞ্জাবি দেশহারা হয়ে দিশেহারা হয়নি। সিন্ধিরা বোম্বাই অঞ্চলে, পাঞ্জাবিরা দিল্লি অঞ্চলে আপন ব্যবসা-বাণিজ্যে দিব্য গোছগাছ ছিমছাপ করে নিয়েছে। বরঞ্চ অনেক স্থলে এদের সুবিধেই হয়েছে বেশি। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। দিল্লির কনট সার্কাস থেকে মুসলমান হোটেলওয়ালারা চলে যাওয়াতে সেখানে পাঞ্জাবিরা গাদা গাদা রেস্তোরাঁ খুলেছে। ফলে খাস দিল্লির মোগলাই রান্না, সেখান থেকে লোপ পেয়েছে এখন যা পাবেন সে বস্তু পাঞ্জাবি রান্না, লাহোর অঞ্চলের। (দিল্লির রান্নার কাছে সে রান্না আজ পাড়াগেঁয়ে)। এই পাঞ্জাবিদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার অন্ত নেই। এদের কেউ কেউ পারমিট-গিরমিট ব্যাপারে আমার কাছে দৈবেসৈবে সাহায্য নিতে এসেছে কিন্তু কখনও হাত পাতেনি। এরা যা খাটছে এবং খেটেছে তা দেখে আমি সর্বান্তঃকরণে এদের কল্যাণ এবং শ্রীবৃদ্ধি কামনা করেছি।
তাই অতিশয় সভয়ে শুধুই, পুব-বাংলার লোক পশ্চিম-বাংলায় এসে অনেক করেছে, কিন্তু পাঞ্জাবি-সিন্ধিরা যতখানি পেরেছে ততখানি কি তাদের দ্বারা হয়েছে? এ বড় বে-দরদ এবং বেয়াদব প্রশ্ন। পূর্ববঙ্গবাসীরা এ প্রশ্নে আমার ওপর চটে গিয়ে অনেক কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেবেন। আমি নতশিরে সব উত্তর মেনে নিচ্ছি এবং এ স্থলে আগেভাগেই বলে রাখছি, আমি তাদের উকিল হয়েই এ আলোচনা আরম্ভ করেছি, তাদেরই সাফাই গাইবার জন্য একটু ধৈর্য ধরুন।
(২) চাকরি যেখানে ব্যক্তিবিশেষ কিংবা ব্যবসাবিশেষের চাকরি, সেখানে সে চাকরির মূল্য চাকুরের পক্ষে যথেষ্ট কিন্তু দেশের পক্ষে তা যৎসামান্য। কিন্তু চাকরি যখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে হয়, তখন তার গুরুত্ব অসাধারণ। সকলেই জানেন, দেশের শ্রীবৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মুখে অনেকগুলো বিরাট বিরাট পরিকল্পনা রয়েছে। এসব পরিকল্পনা ফলবতী করার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত বর্তায় কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ওপর।
তাই প্রশ্ন, এইসব চাকরি পাচ্ছে কজন বাঙালি? পূর্বের তুলনায় এদের উপস্থিত রেশিয়ো কী? পূর্বের তুলনা বাদ দিলেও, প্রাদেশিক জনসংখ্যার হিসেবে তারা তাদের ন্যায্য হকগত রেশিয়ো পাচ্ছে কি?
দিল্লিবাসী বাঙালিমাত্রই একবাক্যে তারস্বরে বলবেন, ‘না, না, না।’ পরশ্রীকাতর অবাঙালিও সে ঐক্যতানে যোগ দেন। মনে মনে হয়তো বলেন, ‘ভালোই হয়েছে।’ তা সে কথা থাক।
কেন পায়নি তার জন্য আমি কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষ দেব না। দোষ বাঙালির। কে কেন পারল না, সে সাফাই গাইবার জন্যই এ আলোচনা। একটু ধৈর্য ধরুন।
(৩) অথচ দ্রষ্টব্য, দিল্লির সাংস্কৃতিক মজলিসে বাঙালি এখনও তার আসন বজায় রাখতে পেরেছে। এই কিছুদিন পূর্বেই শম্ভু মিত্র দিল্লিতে যা ভেল্কিবাজি দেখালেন সে কেরামতি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। অল্পের ভেতর লিটল থিয়েটার চালান চাটুয্যে। দিল্লিতে যাবতীয় চিত্রভাস্কর্য প্রদর্শনী হয় বাঙালি উকিলবাবুর তাঁবুতে। গাওনা-বাজাতে বাঙাল আলাউদ্দিন সায়েব রবিশঙ্করের কথা নাই-বা তুললুম। শিক্ষাদীক্ষায় মৌলানা আজাদ সায়েব। সাহিত্যে হুমায়ুন কবীর।
ইতোমধ্যে সত্যজিৎ রায়ের তোলা ‘পথের পাঁচালী’ দিল্লি ছাড়িয়েও কহাঁ কঁহা মুল্লুকে চলে গিয়েছে। নভেম্বরে বুদ্ধ-জয়ন্তী হওয়ার পূর্বেই হাঁকডাক পড়ে গিয়েছে, কে করে তবে ‘নটীর পূজা’, কাকে ডাকা যায় ‘চণ্ডালিকা’র জন্য?
অর্থাৎ বাঙালির রসবোধ আছে, অর্থাৎ স্পর্শকাতর। তাই সে সেনসিটিভ এবং অভিমানী।
আলিপুর বোমা হামলার সময় শমসুল হক (কিংবা ইসলাম) নামক একজন ইন্সপেক্টর আসামিদের সঙ্গে পিরিত জমিয়ে ভেতরের কথা বের করে ফাঁস করে দেয়। বোমারুরা তাই তার উল্লেখ করে বলত, “হে শমসুল, তুমিই আমাদের শ্যাম, আর তুমিই আমাদের শূল।’
স্পর্শকাতরতাই বাঙালি ‘শ্যাম’ এবং স্পর্শকাতরতাই তার ‘শূল’। শুধুমাত্র কিছু না দিয়ে স্টেজ সাজিয়ে নিয়ে দশটা বাঙালি তিন দিনের ভেতর যেরকম একটা নাট্য খাড়া করে দিতে পারে অন্য প্রদেশের লোক সেরকম পারে না। আবার যেখানে পাঁচটা সিন্ধি পারমিটের জন্য বড় সায়েবের দরজায় পঞ্চান্ন দিন ধরনা দেবে সেখানে বাঙালির নাভিশ্বাস ওঠে পাঁচ মিনিটেই। সংসার করে খেতে হলে ড্রিল-ডিসিপ্লিনের দরকার। আর ওসব জিনিস পারে বুদ্ধিতে যারা কিঞ্চিৎ ভোঁতা, অনুভব-অনুভূতির বেলায় একটুখানি গণ্ডারের চামড়া-ধারী।
স্পর্শকাতরতা এবং ডিসিপ্লিন এ-দুটোর সময় হয় না? বোধহয় না। লাতিন জাতটা স্পর্শকাতর, তাদের ভেতর ডিসিপ্লিনও কম। ইংরেজ সাহিত্য ছাড়া প্রায় আর সব রসের ক্ষেত্রে ভোঁতা– তাই তার ডিসিপ্লিনও ভালো।
এ আইনের ব্যত্যয় জর্মনিতে। চরম স্পর্শকাতর জাত মোক্ষম ডিসিপ্লিন মেনে নিলে কী মারাত্মক অবস্থা হতে পারে হিটলার তার সর্বোত্তম উদাহরণ। হালের জর্মনরা তাই বলে, ‘অতখানি ডিসিপ্লিন ভালো নয়।’ কিন্তু এ কথা কাউকে বলতে শুনিনি, ‘অতখানি স্পর্শকাতরতা ভালো নয়।’
কোনও জিনিসেরই বাড়াবাড়ি ভালো নয়, সে তো আমরা জানি, কিন্তু আসল প্রশ্ন, লাইন টানব কোথায়? জাতীয় জীবনে স্পর্শকাতরতা থাকবে কতখানি আর ডিসিপ্লিন কতখানি? কিংবা শুধাই উপস্থিত যে মেকদার বা প্রোপৰ্শন আছে সেটাতে বাড়াই কোন বস্তু– স্পর্শকাতরতা, বা ডিসিপ্লিন?
গুণীরা বিচার করে দেখবেন।