চতুর্দশ। ভগ্নপ্রাণ সম্রাট
পুষ্পিত বকুল গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায় একটি মর্মর বেদি, তারই উপরে বসে রাজকবি বাণভট্ট একমনে ‘হর্ষচরিত’ রচনায় নিযুক্ত হয়ে আছেন।
এমন সময়ে সেনাপতি সিংহনাদ সেখানে এসে উচ্চকণ্ঠে ডাকলেন, ‘ওহে বাণভট্ট।’
বাণভট্ট মুখ তুলে বললেন, ‘ব্যাপার কী? কাব্যকুঞ্জবনে মত্তহস্তীর প্রবেশ কেন?
সিংহনাদ বললেন, ‘একে তো তোমাদের মতো মেয়েলি কবিদের পাল্লায় পড়ে মহারাজা অসি ছেড়ে মসির ভক্ত হয়েছেন, তার উপরে ওই চিনা পরিব্রাজকটা এসে আমাদের অন্ন যে একেবারে মারবার চেষ্টা করছে, সে-খবর রাখো কি?’
‘তুমি পরিব্রাজক হুয়েন সাঙের কথা বলছ?’
‘হ্যাঁ গো, হ্যাঁ! সে যে মহারাজকে নিজের হাতের মুঠোর ভিতরে পুরে ফেলেছে!’
‘পরিব্রাজকের হাতের মুঠো এমন প্রকাণ্ড যে তার মধ্যে আমাদের এত বড় মহারাজার স্থান সংকুলান হয়েছে?’
‘তা ছাড়া আর কী বলি বলো? ওই চিনা পরিব্রাজক জাদু জানে হে, জাদু জানে! মহারাজা এত দিন হীনযান সম্প্রদায়ের বৌদ্ধদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাতেন, প্রজারা তা পছন্দ না করলেও কোনও রকমে সহ্য করে থাকত। কিন্তু ওই চিনা পরিব্রাজকের পরামর্শে মহারাজা এখন মহাযান সম্প্রদায়কেও মাথায় তুলতে চান। আহার নেই, নিদ্রা নেই,—দিনরাত তিনি ‘বুদ্ধ বুদ্ধ’ করে পাগল। হিন্দু হয়েও তিনি বুদ্ধের পায়ে দাসখত লিখে দিয়েছেন। তাঁর কড়া হুকুম হয়েছে, সাম্রাজ্যের কোথাও আর জীবহিংসা করা চলবে না। যে আমিষ খাবে তার প্রাণদণ্ড অনিবার্য।
বাণভট্ট হেসে বললেন, ‘এ জন্যে তুমি উত্তেজিত হচ্ছ কেন বন্ধু? মহারাজা তোমার বেতন বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ তো দেননি?’
‘বাণভট্ট, তুমি হচ্ছ একটি আস্ত পণ্ডিত-মূর্খ! বেতন এখনও পাচ্ছি বটে, কিন্তু তার পর? আমরা তোমাদের মতো শাস্ত্রজীবী নই, আমরা হচ্ছি অস্ত্রজীবী। কিন্তু রাজ্যের সকলকেই যদি অহিংসার সাধনা করতে হয়, তাহলে তো সমস্ত অস্ত্রশস্ত্রই হবে ব্যর্থ! সে ক্ষেত্রে, অস্ত্রজীবীদের অকারণে বসিয়ে বসিয়ে মাহিনা দিয়ে পুষে রাখবেন, আমাদের মহারাজা এতটা নির্বোধ নন।’
বাণভট্ট বললেন, ‘সিংহনাদ ভায়া, তোমার আর্তনাদ থামাও। তুমি কি বলতে চাও, অহিংসা বলতে বোঝায়, সাপ কামড়াতে এলেও আমরা তাকে মারতে পারব না? কোনও শত্রুদেশ আক্রমণ করতে এলেও আমাদের মহারাজা হাত গুটিয়ে বুক পেতে দেবেন?’
সিংহনাদ মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, ‘কী জানি ভাই, আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে!’
বাণভট্ট সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করে বললেন, ‘তাহলে তোমার সন্দেহ-ভঞ্জন করো; ওই দ্যাখো, মহারাজা নিজেই এই দিকে আসছেন।’
হর্ষবর্ধন আসতে আসতে হাসতে হাসতে বললেন, ‘এক আসরে অসি আর মসির সেবক! লক্ষণ তো ভালো নয়! কিন্তু মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে কিছুক্ষণ কাব্যগুঞ্জনে যোগ দিতে এলুম, কিন্তু এখানেও নতুন কোনও ষড়যন্ত্রের আয়োজন হচ্ছে নাকি?’
‘ষড়যন্ত্র মহারাজ?’
‘হ্যাঁ বন্ধু ষড়যন্ত্র—ষড়যন্ত্র—আমার বিরুদ্ধে চারিদিকেই চলছে বিষম ষড়যন্ত্র! তুমি কি এরই মধ্যে সব কথা ভুলে গেলে? রাজধানীর পরিব্রাজক হুয়েন সাঙের ধর্মোপদেশ শোনবার জন্যে আহ্বান করেছিলুম বিরাট সভা! আমার আমন্ত্রণ রক্ষা করেছিল চার হাজার বৌদ্ধ শ্রমণ, তিন হাজার জৈন আর ব্রাহ্মণ। পবিত্র গঙ্গা-তটে বিপুল এক মঠ স্থাপন করে আকাশচুম্বী দেউলের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলুম আমার দেহের সমান উঁচু বুদ্ধদেবকে। কয় দিন ধরে চলল মহোৎসব। আমন্ত্রিতদের আদর-আপ্যায়নের কোনওই ত্রুটি হয়নি। বুদ্ধ, ধর্ম আর সংঘের সম্মান রক্ষার জন্যে চারিদিকে মুক্ত হস্তে ছড়িয়ে দিয়েছিলুম মণি-মুক্তা, স্বর্ণ-রৌপ্য। কিন্তু তার ফল হল কী? আমি বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী বলে ব্রাহ্মণরা চক্রান্ত করে মঠে আগুন ধরিয়ে দিলে। অনেক কষ্টে কোনওক্রমে মঠের কতক অংশ রক্ষা পেল বটে, কিন্তু আমি নিজে হলুম এক নির্বোধ ব্রাহ্মণের দ্বারা আক্রান্ত! ভগবান বুদ্ধের কৃপায় সে যাত্রা রক্ষা পেলুম। তার পর জানা গেল, পাঁচ শত ব্রাহ্মণ লিপ্ত ছিল সেই হীন ষড়যন্ত্রে।’
বাণভট্ট বললেন, ‘জানি মহারাজ, এত শীঘ্র যে ভীষণ ষড়যন্ত্রের কাহিনি ভুলিনি। কিন্তু সেই ব্রাহ্মণের দল তো আজ নির্বাসিত?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু রাজ্যে এখনও অসংখ্য দুরাত্মার অভাব নেই। নিরপরাধ, নির্বিরোধী পরিব্রাজক হুয়েন সাং! ব্রাহ্মণরা তাঁকেও হত্যা করতে চায়, কেবল আমার জন্যেই তাদের সেই দুরভিসন্ধি সিদ্ধ হচ্ছে না। বোধ করি, এই সব দেখে-শুনেই পরিব্রাজক তাঁর স্বদেশে ফেরবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আমিও সম্মতি না দিয়ে পারিনি। আগামী সপ্তাহেই পরিব্রাজক তাঁর স্বদেশের দিকে যাত্রা করবেন।’
বাণভট্ট বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, পরিব্রাজকের উপরে দেশের লোক—বিশেষ করে ব্রাহ্মণরা মোটেই খুশি নয় বটে।’
হর্ষবর্ধন বললেন, ‘বন্ধু, তুমিও তো ব্রাহ্মণ?’
বাণভট্ট সহাস্যে বললেন, ‘হ্যাঁ মহারাজ, আমি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেছি বটে! কিন্তু কবি হয়ে আমি নিজের জাত খুইয়েছি!’
‘কী—রকম?’
‘কবির জাত নেই। কবির মানসী জন্মদান করে সর্বজাতির সর্বশ্রেণির মানুষদের। কিবা রাজা, কিবা রাখাল, কিবা ব্রাহ্মণ, কিবা চণ্ডাল—কবির আত্মীয়তা সকলের সঙ্গেই, কবির সহানুভূতি সকলেরই উপরে।’
হর্ষবর্ধন সানন্দে বললেন, ‘সাধু কবি, সাধু! বন্ধু, রাজাও হচ্ছেন কবির মতো—তাঁরও উচিত নয় জাতবিচার করা। ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত সবাই তাঁর পুত্রস্থানীয়। প্রত্যেক ধর্মকেই সম্মান করা হচ্ছে রাজার কর্তব্য। কিন্তু সেই কর্তব্যই পালন করেছি বলে আজ আমার বিরুদ্ধে হচ্ছে এত ষড়যন্ত্র।’
সিংহনাদ বললেন, ‘না মহারাজ, চিনা পরিব্রাজক দেশত্যাগ করলেই ব্রাহ্মণদের আপত্তির আর কোনও কারণ থাকবে না।’
হর্ষবর্ধন তিক্ত স্বরে বললেন, ‘তাই নাকি? রাজ্যে এখন যুদ্ধবিগ্রহ নেই বলে নিশ্চয়ই আপনি দিবারাত্রব্যাপী নিদ্রাদেবীর সাধনা করছেন?’
সিংহনাদ আমতা আমতা করে বললেন, ‘না মহারাজ, না মহারাজ! যুদ্ধও নেই, পরিশ্রমও নেই। তাই আমি আজকাল অনিদ্রা রোগে ভুগছি।’
‘তবে এ-কথা শোনেননি কেন যে আমাকে হত্যা করবার জন্যে ব্রাহ্মণদের উত্তেজিত করেছিল আমারই অন্যতম অমাত্য অর্জুনাশ্ব?’
সিংহনাদ সচমকে বললেন, ‘বলেন কী মহারাজ? কোথায় সেই পাষণ্ড? মহারাজের আদেশ পেলে আমি তাকে চুলের মুঠি ধরে এখানে টেনে আনতে পারি।’
‘পারবেন না সেনাপতি। অর্জুনাশ্ব আপনার চেয়ে নির্বোধ নয়। সে এখন পলাতক। তবে এইটুকু খবরও পেয়েছি, নির্বাসিত সেই পাঁচ শত ব্রাহ্মণের সঙ্গে মিলে অর্জুনাশ্ব আমার বিরুদ্ধে অসভ্য জাতিদের উত্তেজিত করবার চেষ্টা করছে। বন্ধু বাণভট্ট, আমার মন ভেঙে গিয়েছে।’
‘কেন মহারাজ?’
‘বৃদ্ধ হয়েছি, পরলোকের দরজা চোখের সামনেই খোলা রয়েছে। সারা জীবন ধরে যাদের জন্যে এই বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করে গেলুম, আমার দানের অধিকারী হওয়ার মতো যোগ্যতা তাদের কোথায়? আমি অপুত্রক। আমার অবর্তমানে এই সাম্রাজ্যের কর্ণধার হওয়ার মতো কেউ নেই। অদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি—অরাজকতা, রক্তপাত, অত্যাচার! আমার এত সাধের সার্থক স্বপ্ন, কোথায় মিলিয়ে যাবে শরতের লঘু মেঘের মতো!’