চতুর্দশ । চিনের পথে অচিন দেশে
বজ্রের দর্প চূর্ণ। ঊনসত্তর বৎসরের ভার জীবনের উপর নিয়ে তৈমুর স্তিমিত দৃষ্টিতে একবার অতীতের দিকে তাকিয়ে দেখলেন—যেমন করে শেষ দৃষ্টিপাত করে অস্তাচলের সূর্য পূর্ব আকাশের দিকে।
যাদের সঙ্গে তরবারি হাতে করে তিনি যাত্রাপথে বেরিয়েছিলেন, তারা সবাই হয়েছে আজ অনন্ত পথের পথিক। যাদের সাহায্যে তিনি বড় বড় যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন সেই সৈফুদ্দিন, জাকু বার্লাস ও আক বোগা প্রমুখ সবাই করেছে আজ মহাপ্রস্থান। সর্বপ্রথম পুত্র এবং তাঁর ছেলে মহম্মদও পরলোকে। চিরকালের জন্যে হারিয়েছেন তিনি জীবনের প্রথম সঙ্গিনী আলজাইকেও। তিনি আজ পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তির অধিকারী, কিন্তু অধিকতর শ্রেষ্ঠ কোনও শক্তিধর তাঁর কাছ থেকে একে একে কেড়ে নিয়েছেন সবচেয়ে প্রিয় সহধর্মিণী, আত্মজ, বন্ধু ও স্বজন! তিনি আজ একাকী, অত্যন্ত একাকী। অন্যান্য বংশধরও আছেন, সেনাপতিও আছেন, কিন্তু তাঁর অবর্তমানে এই বিরাট ও অতুলনীয় সাম্রাজ্যের শাসনদণ্ড গ্রহণ করতে পারেন এমন যোগ্য ব্যক্তি আর একজনও নেই। তাঁর চারিদিক ঘিরে বিপুল জনতা,—কিন্তু তিনি একাকী, বড় একাকী!
তিনি আর কী দেখলেন?
দেখলেন—নিজের হাজার হাজার ক্রোশব্যাপী অতি দীর্ঘ যাত্রাপথ—কিন্তু তার মধ্যে কোথাও নেই জীবনের মহোৎসব। সেই দূরদূরান্তরে বিস্তৃত ধু ধু পথ জুড়ে ঢেউ খেলিয়ে বয়ে যাচ্ছে কেবল রক্তের রাঙা নদী। তার দুই পাশে জেগে আছে মরুভূমির পর মরুভূমি—সেখানে ফল-ফুল-তরু-লতা-শস্য জন্মায় না, সেখানে নেই ছায়াময় গ্রাম, সমৃদ্ধ নগর, সমাজ সংসারের কলরব, তার বদলে সেখানে দেখা যায় শুধু গগনস্পর্শী অগ্নিশিখা ও কুণ্ডলী পাকানো ধূম্ররাশি এবং বীভৎস নরমুণ্ডের পাহাড়ের পর পাহাড়!
অতীতের দিকে তাকিয়ে তৈমুর কি দুঃখিত, লজ্জিত, অনুতপ্ত হলেন?
একটিমাত্র যুদ্ধের পর রণক্ষেত্রের দৃশ্য দেখে ভারত সম্রাট অশোক চিরদিনের মতন অস্ত্র ত্যাগ করেছিলেন।
কিন্তু তৈমুর অশোক নন।
স্তিমিত চক্ষে অগ্নিবর্ষণ করে বৃদ্ধ তৈমুর ঘোড়ায় চড়ে আবার গর্জন করে উঠলেন, ‘অস্ত্র ধরো, অস্ত্র ধরো! এসো বীর তাতারিরা, চলো আবার দিগবিজয়ে!’
সবাই বিস্ময়ে সচকিত! সম্রাট তৈমুর যার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে পারেন, পৃথিবীতে এমন দেশ আর কোথায় আছে?
তৈমুর বললেন, ‘আমরা প্রায় সমগ্র এশিয়া জয় করেছি, বাকি আছে কেবল চিনদেশ। আমরা এমন সব মহা মহা রাজার গর্ব চূর্ণ করেছি যে পৃথিবী চিরদিন আমাদের স্মরণ করে রাখবে। কত যুদ্ধে তোমরা আমার সঙ্গী হয়েছ, কিন্তু তোমাদের পরাজয়ের কলঙ্ক মাখতে হয়নি কখনও। চিনদেশের পৌত্তলিকের সাধ্য নেই, তোমাদের সামনে দাঁড়ায়! আমার সঙ্গে চলো সেই দেশে!’
যে চেঙ্গিজ খাঁয়ের বংশধরদের সাম্রাজ্যকে অবলম্বন করে তৈমুর করেছিলেন আত্মপ্রতিষ্ঠা, সেই মহান সম্রাট, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দিগবিজয়ী চেঙ্গিজও জীবন-সন্ধ্যায় বেরিয়েছিলেন দক্ষিণ চিনের পথে, নিজের দিগবিজয় ব্রত সম্পূর্ণরূপে সফল করবার জন্যে। পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। চেঙ্গিজ হয়েছিলেন পৃথিবীর সর্বেসর্বা। কিন্তু মহাকালের পরিহাসে তাঁর শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। আত্মপ্রসাদে স্ফীত হয়ে তৈমুরও কি ভেবেছিলেন, চেঙ্গিজ যা পারেননি, সেই কার্যে সফল হয়ে তিনি চেঙ্গিজেরও যশকে ম্লান করে দেবেন? সম্ভব!
মহাকাল? ও হচ্ছে পৌত্তলিক অভিধানের কথা, তৈমুর তা নিয়ে মাথা ঘামালেন না।
‘অস্ত্র ধরো! অস্ত্র ধরো! চেঙ্গিজ অক্ষম হয়েছিলেন, আমরা সক্ষম হব!’
অস্ত্রধারীর অভাব হল না। সমরখন্দের সিংহদ্বার দিয়ে বহির্গত হল দুই লক্ষ সৈনিক—দুই লক্ষ মৃত্যুদূত! তাঁর প্রিয় সমরখন্দের বাইরে এসে তৈমুর ঘোড়ার পিঠে বসে মুখ ফিরিয়ে নিজের রাজধানীকে আর একবার দেখবার চেষ্টা করলেন। নীলাকাশকে স্পর্শ করতে চাইছে তার শত শত গম্বুজ ও মিনার। কিন্তু তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না।—তাঁর দৃষ্টি হয়ে এসেছে অতি-ক্ষীণ! তাঁর চোখের পাতা এমনি ঝুলে পড়েছে যে হঠাৎ দেখলে মনে হয়, তিনি নিদ্রিত। তৈমুর আবার অশ্বচালনা করলেন, কিন্তু কিছু বললেন না মুখে।
নভেম্বর মাস—শীত ফেলছে হু হু করে শীতল শ্বাস। কিছুদিন যেতে না যেতেই আরম্ভ হল বরফপাত। তারপরই জাগল তুষারের ঝড়। যে দুই লক্ষ বীর পদভারে পৃথিবীর বুক কাঁপাচ্ছিল তালে তালে, তাদের শীত-জর্জর পা-গুলো পড়ল এলিয়ে। নদীর জল দেখা যায় না, সে গায়ে দিয়েছে বরফের চাদর। রাস্তাগুলো অচল হয়ে উঠেছে পুঞ্জ পুঞ্জ তুষারে। কত সৈন্য মরল, কত ঘোড়া মরল।—শিলাপাত, তুষারপাত; যুবক যোদ্ধাদের দেহ আর বয় না—কিন্তু বৃদ্ধ যোদ্ধা তৈমুর চলেছেন, চলেছেন, চলেছেন! সত্তর বছরের উদ্দাম পথিক!
কোথায় চলেছেন? কার আহ্বানে?…
শেষটা তাঁকেও থামতে হল—ওত্রার শহরে গিয়ে।
সেনাপতিদের ডেকে তিনি বললেন, ‘ওই উত্তরগামী পথ—ওই হচ্ছে চিনের পথ! আপাতত বাকি শীতকালটা এইখানেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু মনে রেখো, বসন্তকাল এলেই আবার যাত্রা করতে হবে।’
বসন্তকাল। তৈমুরের আদেশ কেউ ভোলেনি। সৈন্যরা আবার যাত্রা আরম্ভ করলে। ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস। উত্তরগামী চিনের পথ।
আবার মেঘধ্বনি করলে কাড়া-নাকাড়া, আবার আকাশে উড়ল পতাকার পর পতাকা, প্রতি রাত্রে আবার বাজতে লাগল বেণু-বীণা—দিগবিজয়ী তৈমুরের প্রশস্তি গাইবার জন্যে।
কিন্তু এ হচ্ছে মৃত দিগবিজয়ীর প্রশস্তি গান!
পৃথিবীপতি তৈমুর পৃথিবী ত্যাগ করেছেন ওত্রার নগরে। ভগবানের চাবুক ফিরে গিয়েছে ভগবানের কাছে। তৈমুরের সুসজ্জিত শ্বেত অশ্ব সমতালে পা ফেলে, বৃহৎ বাদশাহি পতাকার ছায়া মেখে অগ্রসর হচ্ছে, কিন্তু আজ তার পৃষ্ঠে নেই সেই বিশ্ববিখ্যাত আরোহী।
শেষ দৃশ্যে দেখি—
শয্যাশায়ী তৈমুর। পাশে বসে সম্রাজ্ঞী সরাই মুল্ক খানুম। চারিদিকে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী, সেনাপতি, আমির, ইমান ও চিকিৎসক প্রমুখ।
তৈমুর ক্ষীণ স্বরে বললেন, ‘আমাকে হারিয়ে তোমরা পাগলের মতন ছুটোছুটি হাহাকার কোরো না। তাহলে সব বিশৃঙ্খল হয়ে যাবে। বীরের মতন তরবারি ধরে থাকো—একতাবদ্ধ হও। চিনদেশে যাত্রা করো—’
তৈমুরের আদেশ। সেনাদল নিয়ে সেনাপতিরা চিনদেশের দিকে ছুটলেন।
বেশি দূর যেতে হল না। দ্রুতগামী অশ্বে চড়ে দূত এসে দেশের খবর দিলে। এরই মধ্যে তৈমুরের বংশধরদের মধ্যে রাজ্য নিয়ে বিপ্লব উপস্থিত হয়েছে।
চিন আর ভগবানের চাবুকের মার খেলে না। সেনাদল নিয়ে সেনাপতিরা আবার ফিরলেন সমরখন্দের দিকে।
তৈমুর বড় হতে চেয়েছিলেন চেঙ্গিজ খাঁয়ের চেয়ে। কিন্তু চেঙ্গিজ খাঁ কেবল দিগবিজয় এবং তৈমুরের চেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপন করেননি, সেই সাম্রাজ্যের ভিত্তি এমন সুদৃঢ় করেও গিয়েছিলেন যে, তার আকার ক্রমেই বৃহত্তর হয়ে দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়েছিল।
আর তৈমুরের দিগবিজয়ের ফলে পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়ানো রইল ধ্বংসস্তূপের পর ধ্বংসস্তূপ এবং তাঁর মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাম্রাজ্যও গেল ধ্বংসের পথে। তৈমুর কেবল ধ্বংস করেই গেলেন, স্থায়ী কিছু সৃষ্টি করে যেতে পারলেন না। তাঁর নাম আজও তাই পৃথিবীর কাছে মহামারির মতোই ভয়ানক।
তৈমুরের পুত্র ও পৌত্ররা স্থানীয় শাসনকর্তার মতন এখানে-ওখানে রাজদণ্ড চালনা করেই তুষ্ট ছিলেন। তাঁরা কেউ তৈমুরের ভয়াবহ তরবারি ধারণ করতে সাহসী হননি—তাঁরা ছিলেন সাহিত্য ও চারুশিল্পের পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু তৈমুরের মৃত্যুর শতাব্দীকাল পরে তাঁর বংশের মধ্যে আবার নেচে উঠেছিল প্রচণ্ড তাতারের উত্তপ্ত রক্তধারা! এবং দিল্লির সিংহাসনে বসে ভারতে মোগল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ বাবর করলেন তাঁর পূর্বপুরুষ মহান তৈমুরের স্মৃতি-তর্পণ।
এইতেই বোঝা যায়—রক্ত একবার জাগে, আবার ঘুমিয়ে পড়ে, আবার জেগে ওঠে।