চতুর্থ খণ্ড – সন্দেহ-ঘোরতর (মেঘ ঘনীভূত হইল—অন্ধকার)
প্রথম পরিচ্ছেদ – ভাব-বৈলক্ষণ্য
ফিরিয়া আসিয়া দত্ত সাহেব বিশেষ মনোযোগের সহিত সেই বিষ-গুপ্তির অন্তর্গত বিষ পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিলেন। পরীক্ষায় বেন্টউড ও জুলেখার উপরে তাঁহার সন্দেহ ঘোরতর হইল। তাহারা উভয়ে মিলিয়া যে সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে, তদ্বিষয়ে তিনি একরকম কৃতনিশ্চয় হইতে পারিলেন। কিন্তু তাহারা সুরেন্দ্রনাথের শবদেহ অপহরণ করিবে কেন? এই চিন্তা তাঁহার মস্তিষ্ক আকুল করিয়া তুলিল। মৃতদেহ লইয়া হত্যাকারীদের কি লাভ? কিন্তু মৃতদেহ যে অপহৃত হইয়াছে, তাহা নিশ্চয়। কাহার দ্বারা এ কাজ হইয়াছে, কে বলিবে? একমাত্র রহিমবক্স এ সম্বন্ধে কিছু বলিতে পারে; কিন্তু সে এখনও অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে; আর কখনও তাহার জ্ঞান হইবে কি না, তাহার কোন নিশ্চয়তা নাই। যদিও বুঝিতে পারা যাইতেছে, বেন্টউডের দ্বারাই এই ভীষণ রহস্যপূর্ণ হত্যাকাণ্ড হইয়াছে, এবং জুলেখা বেন্টউডের সহযোগিনী—কিন্তু রহিমের সাহায্য ব্যতিরেকে তাহা কিরূপে সপ্রমাণ হইবে? দত্ত সাহবে কিছুতেই ভাবিয়া ঠিক করিতে না পারিয়া অত্যন্ত ব্যাকুল হইতে লাগিলেন।
দত্ত সাহেব একবার মনে করিলেন, ইনস্পেক্টর গঙ্গারামবাবুকে এ সময়ে একবার বিষ-গুপ্তির পুনঃপ্রাপ্তির সংবাদটা দিলে হয়, এ সময়ে তাঁহার সহিত একটা পরামর্শ করা উচিত। তাহার পর আবার ভাবিলেন, গঙ্গারামকে আপাততঃ এ সংবাদ না দেওয়াই ভাল। তাহাতে এমন বিশেষ কি ফল হইবে? ইহাতে তিনি তাঁহার অপেক্ষা অধিক আর কি বুঝিবেন? এইরূপ ভাবিয়া দত্ত সাহেব মনে মনে স্থির করিলেন, যতক্ষণ না বেন্টউডের বিরুদ্ধে বিশিষ্ট প্রমাণাদি সংগ্রহ হইতেছে, ততক্ষণ এ সকল গোপন করাই শ্রেয়ঃ। যদি কোন রকমে বেন্টউড জানিতে পারে যে, পুলিস তাহার পশ্চাতে লাগিয়াছে, তৎক্ষণাৎ সে সতর্ক হইবে। তখন আর তাহাকে সহজে বশে আনিতে পারা যাইবে না। বেন্টউড যেরূপ চতুর-পাকাবুদ্ধির লোক, তাহার খরতর বুদ্ধি-প্রবাহে এইরূপ শতটা গঙ্গারাম কোথায় ভাসিয়া যাইবে! সুতরাং দত্ত সাহেব আপাততঃ সে বিষয়ে নিজের মুখ বন্ধ রাখাই যুক্তিসঙ্গত বোধ করিয়া কতকটা নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন।
তাহার পর দত্ত সাহেব কোন উপায়ে সহজে বেন্টউডকে ফাঁসীকাঠে উত্তোলন-উপযোগী প্রমাণ সংগ্রহ করিবেন, তাহাই নিবিষ্টচিত্তে ভাবিতে লাগিলেন।
এমন সময়ে ধীরপাদবিক্ষেপে সেই গৃহমধ্যে অমরেন্দ্রনাথ প্রবেশ করিলেন। তাঁহার সুন্দর মুখকান্তি বিষণ্ণ এবং বিবর্ণ। চোখের চারিদিকে কে যেন কালি মাড়িয়া দিয়াছে। অমরেন্দ্র নিঃশব্দে দত্ত সাহেবের নিকটবর্ত্তী হইলেন। দেখিলেন, তাঁহার হাতে সেই বিষ-গুপ্তি! বিষগুপ্তি দেখিয়া অমরেন্দ্রনাথের মলিনমুখ আরও মলিন হইয়া গেল। সেই বিষ-গুপ্তির প্রতি কম্পিত অঙ্গুলি নিৰ্দেশ করিয়া তদধিক কম্পিতকণ্ঠে কহিলেন, “একি! আপনি এ বিষ-গুপ্তি কোথায় পাইলেন?”
দত্ত। আমিনা আমাকে দিয়া গিয়াছে।
অমর। [চকিতে] আমিনা—আমিনা—
অমরেন্দ্রনাথের কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া গেল। দত্ত সাহেব অমরেন্দ্রনাথের এরূপ অত্যুৎদ্বিগ্নভাব, দেখিয়া সাতিশয় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। কহিলেন, “আমিনার উপরে সন্দেহের কোন কারণ নাই। আশানুল্লা তাহার নিকটে এ বিষ-গুপ্তি বিক্রয় করিতে আসিয়াছিল। এই কতক্ষণ পূৰ্ব্বে আমিনা তাহাকে সঙ্গে করিয়া এখানে আসিয়াছিল।”
বিস্ময়বিকম্পিতকণ্ঠে অমরেন্দ্রনাথ বলিল, “আশানুল্লা! সে এ বিষগুপ্তি কোথায় পাইল? তাহারও সহিত কি এ হত্যাকাণ্ডের কোন সংস্রব আছে মনে করেন?”
দ। না, সে নিজে ঐ হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত নাই। সে সেলিনাদের বাড়ীর গেটের নিকটে ইহা কুড়াইয়া পাইয়াছে মাত্ৰ
অ। এ বিষ-গুপ্তি সেখানে কে ফেলিল?
দ। কে ফেলিল, সে কথাই এখন আমি জানিতে চাই। কাহার দ্বারা এ কাজ হইয়াছে, একবার সন্ধান করিয়া দেখ দেখি; তাহার পর কেমন করিয়া সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারীকে ফাঁসীকাঠে তুলিয়া দিতে হয়, তাহা আমার কাছে দেখিতে পাইবে।
অমরেন্দ্রনাথ বিস্ময়চকিতদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ দত্ত সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তাহার পর বলিলেন, “আপাততঃ যতদূর আপনি অগ্রসর হইয়াছেন, তাহাতে কাহার উপরে আপনার সন্দেহ হয়?”
দত্ত। আমার একান্ত বিশ্বাস, বেন্টউড আমাদের সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিয়াছে।
অ। অসম্ভব! কি রূপে তাহা হইবে?
দত্ত। বেন্টউডের ইচ্ছা সেলিনাকে বিবাহ করে; সুরেন্দ্রনাথ তাহার অভীষ্টসিদ্ধির অন্তরায়।
অ। তাহা হইলে সুরেন্দ্রনাথকে কেন, বেন্টউড আমাকেই হত্যা করিত। সেলিনার মাতা আমার সহিত তাঁহার কন্যার বিবাহ দিবার জন্য একপ্রকার স্থিরসিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন। ধরিতে গেলে সুরেন্দ্রনাথের অপেক্ষা বরং আমিই বেন্টউডের অভীষ্টসিদ্ধির প্রধান অন্তরায়।
দত্ত। আমি যা’ বলিতেছি, তুমি তা’ ঠিক বুঝিতে পার নাই। সেলিনা সুরেন্দ্রনাথের একান্ত অনুরাগিনী, চেষ্টা করিলে সে অনায়াসে তাহার মাতার মত ফিরাইতে পারিত। এমন কি, এখন যদি তুমি সুরেন্দ্রনাথের ন্যায় বেন্টউডের স্বকার্য্য সাধনের অন্তরায় হইয়া দাঁড়াও, তাহা হইলে বেন্টউড তোমাকেও খুন করিয়া নিজের পথ নিষ্কন্টক করিবে। এ স্থির—নিশ্চয়!
অ। না, আমাকে আর হত্যা করিবার তাঁহার কোন প্রয়োজন নাই। আমি আর এখন সেলিনাকে বিবাহ করিতে সম্মত নহি। হত্যাকারী ধৃত হউক বা না হউক, আমি এ জীবনে সেলিনাকে আর বিবাহ করিব না।
দ। সহসা তোমার এ মত-পরিবর্তনের কারণ কি? সেলিনার উপরে তোমার ত যথেষ্ট অনুরাগ ছিল।
অ। ছিল কেন—এখনও আছে—ভবিষ্যতে আজীবন তেমনই থাকিবে; তথাপি আমি সেলিনাকে বিবাহ করিব না।
দ। কেন?
অ। কোন বিশেষ কারণ আছে।
দত্ত। কি এমন বিশেষ কারণ?
অ। সে কথা এখন আপনাকে বলিতে পারিব না।
দত্ত। সে কারণের সহিত কি এই হত্যাকাণ্ডের কোন সংস্রব আছে।
অ। আপনি আমাকে এ সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না—জিজ্ঞাসা করিলেও ঠিক
উত্তর পাইবেন না। আমি কিছুতেই সে কথা আপনাকে বলিতে পারিব না। তাহা একান্ত অসম্ভব জানিবেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – অমরেন্দ্র—বিপদে
দত্ত সাহেব বসিয়াছিলেন। ক্ষোভে, দুঃখে, ক্রোধে জ্বালিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। দাঁড়াইয়া সদুঃখে কহিলেন, “এখন তোমাদের কাছে এইরূপ ব্যবহারই আমার পাওয়া উচিত। যে কালে আমার উপরে তোমার বিশ্বাস নাই, তখন কোন কথা জানিবার জন্য এরূপ পীড়াপীড়ি করা আমার একান্ত অন্যায় হইয়াছে। তবে তোমাদিগকে বুকে করিয়া মানুষ করিয়াছি বলিয়া, আমি তোমাদের সরল ব্যবহারের সর্ব্বদা প্রতীক্ষা করিয়া থাকি। এখন বুঝিতেছি, সেটা আমার বড় অন্যায় হইয়াছে।”
চিত্তোদ্বেগপূর্ণহৃদয়ে, নিরতিশয় দুঃখের সহিত মৃদুকণ্ঠে অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “আমাকে ক্ষমা করুন। যদি বলিবার হইত, এতক্ষণ বলিতাম। একটা বিশেষ কারণে আমাকে আপাততঃ মুখ বন্ধ রাখিতে হইবে। ইহার পর—”
বলিতে বলিতে অমরেন্দ্রনাথ সহসা চুপ করিয়া গেলেন।
দত্ত সাহেব কহিলেন, “ইহার পর কি?”
অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “আমি যাহা কিছু জানি, ইহার পর—সময় বিশেষে হয় ত তাহা আপনার নিকটে প্রকাশ করিতে পারি।”
চমকিতভাবে দত্ত সাহেব কহিলেন, “কি তুমি জান, কি পরে প্রকাশ করিবে? হত্যা সম্বন্ধে কোন কথা?”
অমরেন্দ্রনাথ উত্তেজিত কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “হাঁ, এই হত্যা সম্বন্ধে। কিন্তু, আপনার নিকটে সে কথা বলিতে আমার সাহস হয় না। আপনি নিজগুণে আমাকে ক্ষমা করিবেন—কোন কথা জিজ্ঞাসা করিয়া আর আমায় বিপদে ফেলিবেন না।”
গম্ভীরভাবে দত্ত সাহেব কহিলেন, “বুঝিলাম না, কি এমন ভয়ানক কথা, যাহা তোমাকে জিজ্ঞাসা করাও অনুচিত?”
অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “যখন আপনি এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্যের মর্ম্মোদ্ভেদ করিতে পারিবেন, তখন সকলই জানিতে পারিবেন। জানিতে পারিবেন, কোন্ কারণে আমি আপনার সহিত আজ এরূপ অকৃতজ্ঞের ন্যায় ঘৃণ্য ব্যবহার করিলাম।”
বলিতে বলিতে সহসা অমরেন্দ্রনাথ কক্ষের বাহির হইয়া গেলেন; পাছে, দত্ত সাহেব সেই অপ্রকাশ্য বিষয় শুনিবার জন্য আরও পীড়াপীড়ি করিয়া তাঁহাকে বিপদে ফেলেন।
সহসা অমরেন্দ্রাথের এরূপ ভাব-বৈলক্ষণ্যে দত্ত সাহেবের সংশয়মত্ততা অরও বাড়িবার দিকে চলিল। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, অমরেন্দ্র এমন কিছু অবগত আছে, যাহাতে এ নিবিড় রহস্য আবরণের অন্তরাল হইতে সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকাণ্ডটা অনেক পরিষ্কার হইয়া আসিতে পারে; তদ্ব্যতীত লাসচুরিরও একটা কিনারা হইতে পারে; কিন্তু কি আশ্চর্য্য, অমরেন্দ্র কিছুতেই তাঁহার নিকটে একটি বর্ণও প্রকাশ করিতে চাহে না!
দত্ত সাহেব যতই এই সকল কথা ভাবিতে লাগিলেন, ততই তাঁহার বিস্ময়-বিমূঢ়তা দ্বিগুণ হইয়া উঠিতে লাগিল। এবং তাঁহার চক্ষুর সম্মুখে অন্ধকার নিবিড় হইতে নিবিড়তর হইতে লাগিল। তখন দত্ত সাহেব একবার রহিমবক্সের খোঁজ লইতে চলিলেন। মনে করিলেন, যদি সে কিছু প্রকৃতিস্থ হইয়া থাকে, মৃতদেহ অপহরণকারীর সন্ধানটা তাহার নিকটে পাওয়া যাইতে পারে। বিশেষতঃ দত্ত সাহেবের বিশ্বাস, যাহার দ্বারা মৃতদেহ অপহৃত হইয়াছে, তাহার দ্বারাই সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকাণ্ডটা সমাধা হইয়াছে।
দত্ত সাহেব যাইয়া দেখিলেন, রহিমবক্সের সংজ্ঞালাভ হইয়াছে। কথা কহিতে পারে। সহসা তাহাকে এরূপ প্রকৃতিস্থ দেখিয়া দত্ত সাহেব যথেষ্ট আনন্দিত এবং ততোধিক বিস্ময়াপন্ন হইলেন। সম্মুখবর্ত্তী গফুরের মাকে কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।
গফুরের মা বলিল, “সেই রুমালখানা খুলিয়া লওয়া অবধি রহিম একটু একটু করিয়া কথা কহিতে পারিতেছে।”
তখন দত্ত সাহেব দারুণ সংশয়ান্ধকারের মধ্যে আলোকের আর একটা শিখাপাত হইতে দেখিলেন। সেলিনা মিথ্যাকথা বলিয়াছে, সেই বিষাক্ত রুমাল রহিমবক্সকে অচেতন করিবার অভিপ্রায়ে ব্যবহৃত হইয়া থাকিবে; জুলেখা বিষাক্ত গন্ধের ঔষধ মাখাইয়া বেন্টউডকে সেই রুমাল দিয়া থাকিবে; সেলিনা যদি মিথ্যা না বলিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার রুমাল সে আর কোথায় ফেলিয়া থাকিবে; নতুবা সে অমরেন্দ্রনাথের ন্যায় কোন কথা গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছে। যাহাই হউক, এই সকল দারুণ দুর্ঘটনার মূলীভূত কারণ বেন্টউড ও জুলেখা—আর কেহই নহে।
দত্ত সাহেব রহিমবক্সকে কহিলেন, “রহিম, বোধ হয়—তুমি আগেকার অপেক্ষা এখন নিজের শরীরটা অনেক ভাল বোধ করিতেছে?”
ক্ষীণকণ্ঠে ধীরে ধীরে রহিমবক্স বলিল, “আগেকার চেয়ে অনেকটা ভাল। হুজুর আমার কোন দোষ নাই; কি জানি, হঠাৎ মাথায় যেন কি একটা গোলমাল বাঁধিয়া গেল, আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম।”
দত্ত সাহেব সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে সময়ে কাহাকেও ঘরের ভিতরে দেখিতে পাইয়াছিলে?”
সেইরূপ ক্ষীণস্বরে রহিম বলিল, “হুজুর, ঘরের ভিতরে সেই—সেই জুলেখা ডাকিনীকে একবার দেখিয়াছিলাম।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “তাহা আমি পূৰ্ব্বেই বুঝিয়াছি।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – অমরেন্দ্র-বিভ্রাটে
রহিম দুই-একটি কথায় আবার অবসন্ন হইয়া পড়িল। তাহার আবার মোহ হইল। সে আর কথা কহিতে পারিল না। সেখানে থাকিয়া আর কোন ফলোদয় হইবে না বুঝিয়া, এবং যাহাতে রহিমের শুশ্রূষা ভাল রকমে হয়, সেজন্য দত্ত সাহেব গফুরের মাকে বিশেষরূপে সতর্ক করিয়া সে স্থান পরিত্যাগ করিলেন। এবং অমরেন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিতে চলিলেন।
অমরেন্দ্রনাথের ঘরে অমরেন্দ্রকে দেখিতে পাইলেন না। বাতায়ন, উন্মুক্ত করিয়া দেখিলেন, বাংলো ঘরের সম্মুখে উন্মুক্ত তৃণভূমিতে অতি বিষণ্ণভাবে ধীরে ধীরে অমরেন্দ্র একাকী পরিক্রমণ করিতেছেন। দত্ত সাহেব তাঁহার সহিত দেখা করিতে নীচে নামিয়া আসিলেন।
তাহার পর যখন অমরেন্দ্রনাথ দত্ত সাহেবকে ক্রমশঃ তাঁহার নিকটবর্ত্তী হইতে দেখিলেন, তখন সৰ্ব্বনাশ গণিলেন; আবার হয়ত তিনি সেই সকল কথা তুলিবেন, আবার হয়ত তিনি পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিবেন, এই সব ভাবিয়া অমরেন্দ্রের ম্লান মুখ আরও ম্লান হইয়া গেল। তাহার পর দত্ত সাহেবের প্রথম কথায় অমরেন্দ্র নিজের বিপদ বুঝিয়া শিহরিত এবং সশঙ্ক হইয়া উঠিলেন। দত্ত সাহেব কহিলেন, “শুন অমর। তোমার সাহায্য ব্যতিরেকে আমি এখন প্রকৃত ঘটনা জানিতে পারিয়াছি।”
অমর। প্রকৃত ঘটনা কি?
দত্ত। কে রহিমকে অজ্ঞান করিয়াছে, আর কাহার দ্বারা সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ অপহৃত হইয়াছে, সে কথা আমি তোমাকে এখন নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি।
অমর। তাহা হইলে আপনি আমার অপেক্ষা আরও বেশী জানেন। আমি সুরেন্দ্রনাথের হত্যা সম্বন্ধে কিছু কিছু জানি বটে—কিন্তু তাহার মৃতদেহ অপহরণ সম্বন্ধে কিছুই জানি না।
দত্ত। [ক্রোধভরে] তুমি জানিয়া-শুনিয়াও আমাকে এখন কোন রকমে সাহায্য করিতে চাও না—কি আশ্চৰ্য্য!
তাহার পর সদুঃখে পরিবর্তিত স্বরে দত্ত সাহেব কহিলেন, “আচ্ছা অমর, তোমাকে কোন কথা বলিতে হইবে না—তুমি যাহা জান, গোপন রাখিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিয়ো। তোমার সাহায্য গ্রহণ না করিয়া দেখি, আমার নিজের ক্ষমতায় আমি কতদূর কি করিতে পারি।”
অমরেন্দ্রনাথ নীরবে রহিলেন।
দত্ত সাহেব অমরেন্দ্রের প্রতি অন্তস্তল-পর্যন্ত-অন্বেষণক্ষম সকোপদৃষ্টি স্থাপন করিয়া কহিলেন, “কোন্ লোক মৃতদেহ-অপহারক, এবং কে রহিমের অজ্ঞানকারী, তাহাদিগের নাম জানিবার জন্য কই তুমি ত আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে না? ইহার কারণ কি, অমর?”
অমর কহিলেন, “নাম জানিবার আবশ্যকতা নাই, আমি অনুভবে তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছি।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “বটে! কে বল দেখি?”
অমর কহিলেন, “সেলিনার মাতা।”
দত্ত সাহেব চকিত হইয়া এক পদ পশ্চাতে হটিয়া গেলেন। কহিলেন, “না, তোমার অনুমান ভুল। ইহাতে সেলিনার মাতার কোন হাত নাই।”
অমর কহিলেন, “আপনার মুখেই শুনিয়াছি, যে ঘরে মৃতদেহ ছিল, সে ঘরে সেলিনার মাতার একখানি বিষাক্ত রুমাল পাওয়া গিয়াছে। ইহাতেই আমি এইরূপ অনুমান করিয়াছি।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “সে রুমাল সেলিনার মাতার হইলেও, তিনি নিজে এ সকল ঘটনার ভিতরে নাই। আমি ত তোমাকে পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, সেলিনা স্বীকার করিতেছে, সেই রাত্রে রুমালখানা সে ফেলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু এখন আমি বুঝিতে পারিতেছি, সেলিনার সে কথা মিথ্যা।”
অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “সেলিনা! মিথ্যা বলিয়াছে, অসম্ভব!”
দত্ত। অসম্ভব কিছুই নয়, সেলিনার মিথ্যা বলিবার কারণ আছে—সে কাহাকে ঢাকিবার জন্য-
অমর। [বাধা দিয়া] বুঝিয়াছি, তাহার মাতার জন্য সে মিথ্যা বলিয়াছে।
দত্ত সাহেব তাঁহার অনুসন্ধিৎসু তীক্ষ্ণদৃষ্টি পুনরায় অমরেন্দ্রের চক্ষুর উপর স্থির রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেলিনার মাতার উপরে তোমার সন্দেহ বদ্ধমূল দেখিতেছি; তুমি তাঁহার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ দিতে পার?”
“কিছু না—কিছু না—আমার ধারণামাত্র।” বলিয়া অমরেন্দ্র, দত্ত সাহেবের সেই তীক্ষ্ণদৃষ্টি হইতে অব্যাহতি পাইবার জন্য তাড়াতাড়ি অন্য দিকে মুখ ফিরাইলেন।
মস্তকান্দোলন করিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “ধারণামাত্র! এরূপ ধারণার কারণ?”
অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “কারণ কিছুই নাই—প্রমাণও কিছুই নাই—আমার ধারণা অমূলক হইতে পারে।”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – বিভ্ৰাট-বৈষম্য
দত্ত সাহেব কহিলেন, “তুমি আমার সহিত এইরূপ আশ্চর্য্যজনক ব্যবহার করিয়া যতটা আনন্দ বোধ করিতেছ, আমার যে ঠিক সেইরূপ আনন্দ বোধ হইতেছে—এমন তুমি মনে করিয়ো না। তুমি জান, আমি জোর করিয়া তোমাকে সকল কথা বলাইতে পারি—সে ক্ষমতা আমার আছে।”
“জোর করিয়া!” কাতরকণ্ঠে অমর পুনরুক্তি করিলেন মাত্র এবং সভয়ে দুই-এক পদ পশ্চাতে সরিয়া গেলেন।
দত্ত সাহেব কহিতে লাগিলেন, “হাঁ জোর করিয়া! সে ক্ষমতা কি আমার নাই? জান, যখন তুমি এতটুকু, তখন হইতে আমি তোমাকে অপত্যস্নেহে পালন করিয়া আসিতেছি—আমারই চেষ্টায় এখন তুমি জ্ঞানবান্—বিদ্বান্, বুদ্ধিমান্ হইয়া জগতের মাঝখানে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে শিখিয়াছ। ইহাতে কি তোমার উপরে আমার কোন অধিকার থাকিতে পারে না? এমন কি আমি তোমার মুখে একটা সত্য কথা শুনিবার প্রত্যাশা রাখিতে পারি না।” বলিয়া চুপ করিলেন।
অমরেন্দ্র ভূন্যস্তদৃষ্টি হইয়া অনেকক্ষণ অধোবদনে রহিলেন। নীরব, অনেক্ষণ তাঁহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। দত্ত সাহেবের কথা অনেকক্ষণ শেষ হইলেও, অমরেন্দ্র তাহা জানিতে পারিলেন না। বোধ হইল, যেন সেই কথাগুলি এখনও মূর্ত্তির ন্যায় চীৎকার করিয়া তাঁহাকে বেড়িয়া ঘুরিতেছে। অমর উন্মত্তের ন্যায় হইলেন, উত্তেজিতভাবে সবেগে মাথা তুলিয়া কঠিনকণ্ঠে কহিলেন, “আমি জানি, আমার যখন জ্ঞান বিদ্যাবুদ্ধি হইয়াছে, তখন সে কথা আমাকে বুঝানো অনাবশ্যক। আমি জানি, আপনার ঋণ অপরিশোধ্য। তথাপি আমি সে কথা কিছুতেই আপনার নিকটে প্রকাশ করিতে পারিব না—” এই বলিয়া যুক্তকর হইলেন—”আপনাকে সে কথা বলিলে, আপনি নিশ্চয়ই প্রথমে আমার উপরেই দোষারোপ করিবেন।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “অমর, আমি তোমার কথা বুঝিতে পারিলাম না।”
অমরেন্দ্রনাথ ব্যাকুলভাবে কহিলেন, “আপনি বুঝিবেন কি—আমি নিজেকে নিজেই বুঝিতে পারিতেছি না। আমার ন্যায় হতভাগ্য মূর্খ এ জগতে আর কেহ নাই।”
কিছু উষ্ণ হইয়া দত্ত সাহেব বিরক্তস্বরে কহিলেন, “সে কথা নিশ্চয়ই, তুমি যদি তোমার ভাই-এর হত্যাকারীকে জানিয়াও তুমি আমার কাছে সে কথা প্রকাশ করিতে অস্বীকার কর, তাহা হইলে ইহা অপেক্ষা অধিক তোমার আর কি মূর্খতা হইতে পারে? তুমি যাহা জান—এখনও স্বীকার কর। স্বীকার করিবে কি না—বল। এই আমি শেষবার তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।”
পূর্ব্ববৎ উত্তেজিত হৃদয়ে অমরেন্দ্র কহিলেন, “কিছুতেই নয়, আমিও আপনাকে এই শেষ উত্তর দিলাম। যাহা জানি, তাহা বলিবার নহে—কিছুতেই আমি বলিতে পারিব না; আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করিবেন না। আমার কথায় যদি আপনার সন্দেহ হয়, আপনি ডাক্তার বেন্টউডকে জিজ্ঞাসা করিবেন।” বলিতে বলিতে নিদারুণ উদ্বেগে অমরের মুখ চোখ লাল হইয়া উঠিল।
দত্ত সাহেব তাহা লক্ষ্য করিলেন। কহিলেন, “তাহাকে কি জিজ্ঞাসা করিব? সে নিজে হত্যাকারী। তাহার দ্বারাই এই সকল কাণ্ড হইয়াছে?”
চকিত হইয়া অমরেন্দ্র কহিলেন, “কে আপনাকে বলিল, বেন্টউড এই সকল ঘটনার মূল? কিরূপে আপনি জানিতে পারিলেন?”
দত্ত। সে কথা আমি এখন তোমাকে বলিতে পারি না। সে অনেক কথা। সে সেলিনার রূপে মুগ্ধ, দারুণ ঈর্যাবশে সে সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে।
অমর। দারুণ ঈর্যাবশেও কি সে সুরেন্দ্রনাথের শবদেহ অপহরণ করিয়াছে?
দত্ত। না, সে কাজ জুলেখার দ্বারা হইয়াছে।
অমর। জুলেখা!
দত্ত। [দৃঢ়স্বরে] হাঁ, জুলেখা। আমি রহিমের মুখে এইমাত্র শুনিলাম, জুলেখা তাহাকে হতজ্ঞান করিয়াছিল। কোন্ অভিপ্রায়ে সে রহিমকে অজ্ঞান করিল? মৃতদেহ অপহরণ করিবার জন্য নহে কি? অবশ্যই মৃতদেহ-অপহরণে তাহার সেইরূপ একটা গূঢ় অভিপ্রায় ছিল। সে অভিপ্রায় বেন্টউডের হত্যাপরাধটা গোপন করা ভিন্ন আর কিছুই নহে।
অমর। বুঝিতে পারিলাম না।
দত্ত। তবে শোন, আমি তোমাকে বুঝাইয়া বলিতেছি। বেন্টউড আমাদের সেই বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছিল, আর সেই বিষ-গুপ্তি দ্বারাই সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে; এরূপ স্থলে যখন সুরেন্দ্রনাথের সেই শব শব-ব্যবচ্ছেদ পরীক্ষার পূর্ব্বেই অপহৃত হইয়াছে, তখন তোমার নিজের বুদ্ধিতে অবশ্যই আমার কথাটা বুঝিতে পারিবে।
অ। কিছুমাত্র না।
দত্ত। যদি সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহের শব-ব্যবচ্ছেদ পরীক্ষা হইত তাহা হইলে নিশ্চয়ই বিষের কথা প্রকাশ পাইত; এবং সেই বিষ যে, বিষ-গুপ্তির বিষ, তাহাও পরীক্ষায় সপ্রমাণ হইত। তাহা হইলে বিষ-গুপ্তির দ্বারাই যে সুরেন্দ্রনাথ খুন হইয়াছে, এ কথা তখন গোপন থাকিত না।
অ। তাহার পর?
দত্ত। [ক্রুদ্ধস্বরে] তাহার পর। তোমার মোটাবুদ্ধিতে এইটুকু আর বুঝিতে পারিতেছ না? পাছে পোস্টমর্টেম পরীক্ষায় বিষ বাহির হইয়া রাসায়নিক-পরীক্ষার দ্বারা সমুদয় রহস্য প্রকাশ পায়, সেইজন্য জুলেখা বেন্টউডের পরামর্শমতে মৃতদেহ অপহরণ করিয়াছে।
অ। বেন্টউডের জন্য জুলেখা এত কষ্ট স্বীকার করিতে যাইবে কেন?
দত্ত। জুলেখা বেন্টউডকে ভয় করে। সে ভয়ের কারণ কি, আমার অপেক্ষা তাহা তুমি বেশী জান। আমি তোমার নিকটেই তাহা এখন শুনিতে চাই।
অ। না, আমি সে কথা ঠিক বলিতে পারি না।
দত্ত সাহেব অমরেন্দ্রের এরূপ অবাধ্যভাব দেখিয়া রাগিয়া অস্থির হইয়া উঠিলেন। নিজেকে তখন সালাইতে পারিলেন না। ক্রোধকম্পিত কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “অমর, এখনও সাবধান হইয়া চল। আমি অনেক সহ্য করিয়াছি—আর পারিব না। তোমার এই সকল আচরণে বেশ বুঝিতে পারিতেছি, তোমার মনের ভিতর একটা ভয়ানক গূঢ় অভিসন্ধি আছে। জান তুমি, সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারীকে ধৃত করিয়া তাহার যথোপযুক্ত শান্তিবিধান এবং সেইজন্য আমাকে সৰ্ব্বতোভাবে সাহায্য করা এখন তোমার একমাত্র প্রধান কর্তব্য? কিন্তু তুমি কোন বিষয়ে কোন রকমে আমাকে তিলমাত্র সাহায্য করিতে একান্ত নারাজ। তোমার এরূপ মতিগতি আদৌ ভাল নহে। এখনও যদি তোমার এইরূপ জঘন্য মতিগতির পরিবর্ত্তন না হয়, তাহা হইলে তুমি নিশ্চয় জানিয়ো, আমি তোমার মুখদর্শন করিব না। একবার তুমি আমার মন হইতে গেলে, সেখানে কিছুতেই আর স্থান পাইবে না।”
অমর ইহার কি উত্তর করেন, শুনিবার জন্য দত্ত সাহেব ক্ষণকাল স্থিরদৃষ্টিতে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। অমরেন্দ্র একতিল নড়িলেন না, অমরেন্দ্র একটি কথাও কহিলেন না—অমরেন্দ্র কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না। সেইরূপ ম্রিয়মাণভাবে, অধোবদনে নতনেত্রে অমরেন্দ্র নীরবে ভূমি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।
মুহ্যমান অমরেন্দ্রের সেই ভাবে দত্ত সাহেবের রাগ দুঃখে পরিণত হইল। তিনি আর তথায় দাঁড়াইতে ইচ্ছা করিলেন না। দ্রুতপদে বাটীর ভিতরে চলিলেন।
যতক্ষণ তাঁহাকে দেখা গেল, অমরেন্দ্রনাথ একদৃষ্টে তাঁহার দিকে চহিয়া রহিলেন; এবং তাঁহাকে উদ্দেশ করিয়া অনুচ্চস্বরে আপন মনে কহিলেন, “যদি আমি এখন আপনার নিকটে সত্যকথা প্রকাশ করিতাম, তাহা হইলে আপনি আমায় কি বলিতেন? আপনি এখন আমার উপরে যেমন দোষারোপ করিয়া তিরস্কার করিতেছেন, তখনও তাহাই করিতেন। তবে বলিয়া লাভ কি? “ পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া ললাটের স্বেদ মোচন করিতে করিতে অমরেন্দ্রনাথ অপরদিকে চলিয়া গেলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – দত্তসাহেব স্বয়ং ডিটেক্টিভ
অমরেন্দ্রনাথের অপ্রত্যাশিতপূর্ব্ব আচরণে দত্ত সাহেবের মন যথেষ্ট ব্যথিত এবং মস্তিষ্ক অত্যন্ত বিচঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। এ পৰ্য্যন্ত তিনি সরলভাবে অমরকে খুব সরল বোধ করিয়া আসিতেছেন, কিন্তু এখনকার অমরের এইরূপ বিসদৃশ ব্যবহারে তাঁহার হৃদয়ে সে ভাব আর স্থান পাইল না। দত্ত সাহেব চিন্তা করিতে লাগিলেন, “অমরেন্দ্র এই হত্যাকাণ্ডের অবশ্যই কিছু-না-কিছু অবগত আছে; কিন্তু কেন সে কিছুতেই সে কথা প্রকাশ করিতে চাহে না? এমন কি আমার কাছেও প্রাণপনে গোপন করিতেছে। অমরও কি পিশাচ বেন্টউডের ষড়যন্ত্রপূর্ণ ফাঁদে পা দিয়াছে? কে জানে!” ভাবিয়া ভাবিয়া দত্ত সাহেব তাঁহার এই সকল প্রশ্নের কোন সদুত্তর ঠিক করিতে পারিলেন না। পরিশেষে চিন্তাবসন্ন বিরক্ত চিত্তে ও সকল চিন্তা মন হইতে অনেক কষ্টে দূরীকৃত করিলেন। রহিমের কাহিনীতে যদি এই সকল রহস্যান্ধকারাচ্ছন্ন দুর্ঘটনার কোন অংশ কিছু পরিষ্কার হয়, এইরূপ আশা করিয়া দত্ত সাহেব সাগ্রহপাদবিক্ষেপে রহিমের ঘরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, রহিমের মোহ অপনীত হইয়াছে; এবং দীর্ঘকাল নির্বিঘ্নে নিদ্রাভোগে সে পূৰ্ব্বাপেক্ষা অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইতে পারিয়াছে। গোফুরের মা শয্যার একপার্শ্বে বসিয়াছিল। দত্ত সাহেবের ইঙ্গিতে সে সত্বর উঠিয়া গেল। দত্ত সাহেব রহিমকে নির্জ্জনে পাইয়া অবিলম্বে একেবারে কাজের কথা পাড়িলেন। বলিলেন, “রহিম, বোধ করি, আগেকার অপেক্ষা এখন অনেক সুস্থ আছ?”
“আগেকার চেয়ে অনেক ভাল।”
“কথা কহিতে কষ্ট হইবে না?”
“না হুজুর, এখন আমি এক-আধ ঘণ্টা আপনার সঙ্গে বেশ কথা কহিতে পারিব।”
“আধঘণ্টা হইলেই যথেষ্ট হইবে। আমি কতকগুলি কথা তোমার কাছে জানিতে আসিয়াছি। সেদিনকার রাত্রে প্রথম হইতে কি কি ঘটিয়াছিল, বল দেখি?”
“সেই জুলেখার কথা?”
“হাঁ, সেই জুলেখার কথা।”
রহিম চক্ষু মুদ্রিত করিয়া ক্ষণকাল নীরবে রহিল। কষ্ট করিয়া পূর্ব্ব ঘটনা স্মরণ করিতে লাগিল। তাহার পর ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল, “সেই রাত্রে আমাকে মৃতদেহের পাহারায় বসাইয়া আপনি চলিয়া গেলে, আমি একখানা চৌকী লইয়া বিছানার কাছে গিয়া বসিলাম। ঘরের ভিতরে টেবিলের উপরে একটা বাতি জ্বলিতেছিল, আমি সেই বাতিটা হাতে লইয়া ভাল করিয়া দেখিলাম, জানালাগুলি ভিতর হইতে বন্ধ আছে।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “বেশ মনে পড়ে?”
রহিম বলিল, “হাঁ হুজুর, আমার বেশ মনে পড়িতেছে। সকল জানালার লোহার ছিট্কিনী দেওয়া ছিল। দরজা কেবল চাপা ছিল। আপনি আবার যদি ফিরিয়া আসেন মনে করিয়া দরজা আমি ভিতর হইতে বন্ধ করি নাই।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “না, আমি আর ফিরিয়া আসি নাই; অমর শয়ন করিতে চলিয়া গেলে, আমি লাইব্রেরী ঘরেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। বিশেষতঃ আমি তোমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করি।”
রহিম বলিল, “হুজুর, তাহা আমি জানি, আমিও যতদূর সাধ্য আপনার সে বিশ্বাস রাখিয়া চলি। কিন্তু সে রাত্রে আমার কোন দোষ নাই। জুলেখা আসিয়া আমাকে মুস্কিলে ফেলিল; আমি তার কোন মন্দ করিনি, তবু সে কেন যে আমাকে এমন করিল, কি জানি, হুজুর।”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – লাসচুরি সম্বন্ধে
রহিমের মুখের উপরে নিজের তীক্ষ্ণদৃষ্টি অবিচল রাখিয়া দত্ত সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলে, কি একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়াছে, জান?”
রহিম বলিল, “না হুজুর, আমি কিছুই জানি না।”
দত্ত। গফুরের মা কিছু বলে নাই?
রহিম। কিছু বলে নাই, হুজুর।
দত্ত সাহেব বুঝিলেন, রহিম যাহা বলিতেছে, তাহাতে অবিশ্বাসের কিছুই নাই। কহিলেন, “সুরেন্দ্রনাথের লাস চুরি গিয়াছে।”
রহি। [সবিস্ময়ে] লাস চুরি! সে কি, লাস কেন চুরি যাইবে?
দত্ত। সে কথা কে বলিবে? শেষরাত্রে আমরা তোমার ঘরে গিয়া দেখি, লাস নাই; জানালা খোলা আছে, আর তুমি অজ্ঞান হইয়া মাটিতে পড়িয়া আছে।
রহি। [চিন্তিতভাবে] জানালা কি খোলা ছিল, হুজুর? তাহা হইলে ভিতর দিক্ হইতে কেহ খুলিয়া থাকিবে।
দত্ত। জুলেখা খুলিয়া থাকিবে।
রহি। ঠিক হইয়াছে হুজুর, সেই জুলেখাই তবে এই লাস চুরি করিয়াছে।
দত্ত। কেমন করিয়া সে ঘরের ভিতরে আসিল?
রহি। সে খাটের নীচে লুকাইয়াছিল, হুজুর।
দত্ত। [সাগ্রহে] খাটের নীচে! তুমি নিশ্চয় জান?
রহি। হাঁ হুজুর, আমার কথা ঠিক। সে খাটের নীচে লুকাইয়াছিল। আমি দরজার দিকে মুখ করিয়া ঠিক খাটের পাশে বসিয়াছিলাম। চারিদিক্কার জানালা বন্ধ ছিল, আর কোন দিক্ দিয়ে আসিবার উপায় ছিল না। যদি সে দরজা দিয়া আসিত, আমি সেইদিকে মুখ ফিরিয়া বসিয়া ছিলাম, তখনই তাহাকে দেখিতে পাইতাম। কোথায় কিছু নাই, হঠাৎ পিছন দিক্ দিয়া সে একবার দুই হাতে জড়াইয়া আমার গলাটা খুব জোরে টিপিয়া ধরিল।
দত্ত। পিছন দিক হইতে?
রহি। হাঁ, হুজুর! একটু তন্দ্রা আসিলেও তখন আমার বেশ হুঁস ছিল। আপনি যখন উঠিয়া যান, তখন আমি বেশ জাগিয়াছিলাম। তাহার পর কি যেন একটা গন্ধে আমার একটু একটু ঘুমের ঝোঁক আসিতে লাগিল। এমন সময়ে আমার পিছন দিকে একটা শব্দও হইল, কিন্তু আমার মাথাটা তখন কেমন ভারি হইয়া উঠিয়াছিল; ইচ্ছা থাকিলেও, আমি মুখ ফিরাইয়া দেখিতে পারিলাম না। এমন সময়ে জুলেখার সেই কালো কালো হাত দুখানা যেন একবার দেখিতে পাইলাম, তৎক্ষণাৎ পিছন দিক্ হইতে সে একহাতে আমার গলাটা জোর করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিল, আর একহাতে একখানা রুমাল আমার মুখের উপরে চাপিয়া ধরিল।
দত্ত। [আপনমনে] বটে, সেলিনা যে আমাকে মিথ্যাকথা বলিয়াছে, তাহা আমি বুঝিয়াছিলাম। [রহিমের প্রতি উচ্চকণ্ঠে] তারপর, রহিম, তখন তুমি চীৎকার করিয়া উঠিলে না কেন?
রহি। চীৎকার করিব কি, হুজুর, আমার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না; সকলই যেন স্বপ্নের মত বোধ হইতে লাগিল; তবুও আমি জোর করিতে লাগিলাম। সে ধাক্কা দিয়া আমাকে ফেলিয়া দিল, খাটের কোণ লাগিয়া মাথায় খুব আঘাত লাগিল।
দত্ত। তাহার পর আর কিছু মনে পড়ে না?
রহি। না হুজুর, এ সকল কি কাণ্ড, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। জুলেখা যে কিরূপে ঘরের ভিতরে লুকাইয়াছিল, আমি এখন ঠিক বুঝিতে পারিতেছি।
দত্ত। আমারও তাহা জানা দরকার। কি বল দেখি?
রহি। বোধহয়, আপনার মনে আছে, সেদিন জুলেখা আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিল।
দত্ত। হাঁ, তার মনিবের সহিত দেখা করিবার জন্য আমাকে ডাকিতে আসিয়াছিল। তাহাতে কি হইয়াছে?
রহি। সেদিন সে আপনার ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিল বটে, কিন্তু একেবারে আমাদের বাড়ী ছাড়িয়া যায় নাই।
দত্ত। কিরূপে তুমি জানিলে?
রহি। ঠিক বলিতেছি, হুজুর। আমার সঙ্গে যখন সে বাড়ীর বাহিরে আসিতেছিল, সেই সময়ে ডাক্তার সাহেব আসিয়া তাহাকে ডাকিলেন; তাহার সহিত তিনি কি একটা পরামর্শ করিতে লাগিলেন। আমি নিজের কাজে চলিয়া গেলাম। আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, যে ঘরে লাস ছিল, সেই ঘরে ডাক্তার সাহেব খাটের নীচে জুলেখাকে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ – চিন্তা ও উদ্বেগ
মনিবের সহিত দীর্ঘকাল কথোপকথনে রহিম আবার বড় অবসন্ন হইয়া পড়িল; এবং জোরে জোরে তাহার নিঃশ্বাস বহিতে লাগিল। যাহা কিছু শুনিবার শোনা হইয়াছে; সুতরাং দত্ত সাহেব রহিমকে কথা কহিতে মানা করিয়া, এবং গফুরের মাকে ডাকিয়া দিয়া রোগী-কক্ষ ত্যাগ করিলেন।
রহিমের কাহিনীতে দত্ত সাহেব সৰ্ব্বতোভাবে কৃতনিশ্চয় হইতে পারিলেন যে, কয়েকদিন ধরিয়া যে সকল দুর্ঘটনা ঘটিতেছে, সমুদয় বেন্টউডেরই কাজ। বেন্টউডের কৌশলে জুলেখা খাটের নীচে লুকাইয়া ছিল, তাহারই উপদেশ মত সে যথাসময়ে রহিমকে অজ্ঞান করিয়া বাহিরের দিক্কার সেই জানালা খুলিয়া দিয়াছিল। উন্মুক্ত জানালা দিয়া বেন্টউড ঘরের ভিতরে আসিয়াছিল, এবং তাহারা দুইজনে ধরাধরি করিয়া সেই জানালা দিয়া সহজে লাস বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছে। কিন্তু লাস বাহির করিয়া লইয়া যাইবার কারণ কি? এ প্রশ্নের সদুত্তর স্থির করা দত্ত সাহেবের পক্ষে দুর্ঘট হইল।
জুলেখার নিকটে এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাইবে স্থির করিয়া দত্ত সাহেব তাহার সহিত একবার দেখা করা প্রয়োজন বোধ করিলেন। ভাবিতে লাগিলেন, তাহার নিকটে যদি সহজে এ প্রশ্নের সদুত্তর না পাওয়া যায়, তাহা হইলে তাহাকে জেলে পাঠাইবার ভয় দেখাইয়া নিজের কার্যোদ্ধার করিতে হইবে। কে বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছে, কে হত্যাকারী, কে মৃত দেহ-অপহারক এবং এই সকল ষড়যন্ত্রের প্রকৃত মর্ম্ম, যেরূপে হউক তাহার মুখ দিয়া বাহির করিয়া লইতে হইবে। সন্দেহ নাই, এই তিন অপরাধেই বেন্টউড অপরাধী। জুলেখার জোবানবন্দীতে এখন তাহা সাব্যস্ত হইলে বেন্টউডকে সহজে পুলিসের হাতে সমর্পণ করা যাইবে।
সেদিন অনেকক্ষণ সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল; সুতরাং দত্ত সাহেব পরদিন প্রাতে জুলেখার সহিত দেখা করিবেন, স্থির করিলেন। রাত্রে আহারাদির পর নিজের শয়ন-গৃহে গিয়া শয্যায় পড়িয়া দত্ত সাহেব নিবিষ্ট মনে এই সকল চিন্তা করিতে লাগিলেন। আপনা-আপনি বলিতে লাগিলেন,
“আজ যতদূর করিবার, তাহা করিয়াছি; বেন্টউড যে এই সকল কাণ্ড করিয়াছে, সে বিষয়ে সবিশেষ নিঃসন্দেহ হইতে পারিয়াছি। কাল নিশ্চয়ই তাহাকে অপরাধী সাব্যস্ত করিতে পারিব। যদি জুলেখা সহজে সত্যকথা বলতে না চাহে, তাহা হইলে তাহাকেও জেলে পাঠাইতে কুণ্ঠিত হইব না।”
এইরূপে দত্ত সাহেব বর্ত্তমান চিন্তার একটা মীমাংসা করিয়া শান্তি লাভের চেষ্টা করিলেন। চেষ্টা মাত্র, কিছুতেই তাঁহার নিদ্রাকর্ষণ হইল না। তখন আবার অমরেন্দ্রের কথা তাঁহার মনে পড়িয়া গেল—অমরেন্দ্রনাথের সেই দিনের সেই অবাধ্যতা, সেই অসদাচরণ এবং সেই বিসদৃশ-ব্যবহার নির্জ্জন রাত্রে ভীষণভাব ধারণ করিয়া দত্ত সাহেবের সর্ব্বাঙ্গে যেন কশাঘাত বর্ষণ করিতে লাগিল। অমরেন্দ্রের কথা যতই ভাবিতে লাগিলেন, তাঁহার প্রতি দত্ত সাহেবের রাগ আরও প্রবল হইতে প্রবলতর হইতে লাগিল, এবং শয্যা যেন কন্টকাকীর্ণ হইয়া উঠিল। তিনি বুঝিলেন, যতদিন না এই সকল ভীষণ দুর্ঘটনামূলক রহস্যের উদ্ভেদ হইতেছে, ততদিন মনে শান্তি এবং চিন্তা-রাক্ষসীর হাত হইতে অব্যাহতি লাভ করা একান্ত দুর্ঘট।
কল্য প্রাতে উঠিয়া যে কাজগুলি দত্ত সাহেবকে আগে শেষ করিতে হইবে, তিনি সৰ্ব্বাগ্রে তাহারই একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া ফেলিলেন; একবার জুলেখার সহিত দেখা করিয়া, যেরূপে হউক তাহার মুখ দিয়া ভিতরকার সমুদয় কথা বাহির করিয়া লইতে হইবে। এদিকে ডাক্তার বেন্টউড ও ইনস্পেক্টর গঙ্গারামবাবুকে ডাকিয়া আনিবার জন্য আশানুল্লাকে প্রেরণ করিতে হইবে। তাঁহারা আসিলে সংগৃহীত প্রমাণ-প্রয়োগ গঙ্গারামের দ্বারা বেন্টউডকে গ্রেপ্তার করাইতে হইবে। তখন পুলিসের চেষ্টায় এবং বিচারকালীন জোবানবন্দীতে কোন্ অভিপ্রায়ে বেন্টউডের এই সকল যড়যন্ত্র এবং তাহার ভিতরের কথা সমুদয় প্রকাশ হইয়া পড়িবে। এইরূপে সোজা পথ অবলম্বন করাই শ্রেয়ঃ স্থির করিয়া দত্ত সাহেব রাত্রের অবশিষ্টাংশের কিয়দংশ নিদ্রাবিষ্ট ও কিয়দংশ স্বপ্নাবিষ্ট হইয়া এবং জাগিয়া অতিবাহিত করিলেন।
দত্ত সাহেব যখন শয্যা ত্যাগ করিলেন, তখন পূৰ্ব্বাকাশে প্রভাতোদয় হইয়াছে। নবীন সূর্য্যের রক্তরশ্মিতে চারিদিক্ ঝল্ ঝল্ করিতেছে। এবং চারিপ্রান্ত হইতে অশ্রান্ত কলরব উঠিয়া সুষুপ্ত বিশ্বজগৎকে দ্রুত জাগ্রত করিয়া তুলিতেছে। দেবদারুগাছের শাখা-প্রশাখা দোলাইয়া, সরসীবক্ষ ঊর্ম্মিচঞ্চল করিয়া স্নিগ্ধস্পর্শ প্রভাতবায়ু বহিতে আরম্ভ করিয়াছে। হাত মুখ ধুইয়া দত্তসাহেব পত্র লিখিতে বসিলেন; একখানিতে বিশেষ কাজ আছে বলিয়া গঙ্গারামকে সত্বর আসিতে লিখিলেন; অপরখানিতে রুগ্ন রহিমবক্সকে দেখিবার অজুহাত দেখাইয়া ডাক্তার বেন্টউডকে আসিতে লিখিলেন; তখনই পত্র দুইখানি আশানুল্লার হাতে যথাস্থানে পাঠাইয়া দিলেন। আশানুল্লা দত্ত সাহেবের অনুগ্রহলাভের জন্য সচেষ্ট ছিল; একটু খঞ্জ হইলেও দত্ত সাহেবের আদেশ পালন করিতে খুব সোৎসাহপাদবিক্ষেপে চলিয়া গেল।
ডাক্তার বেন্টউডের জন্য দত্ত সাহেব এইরূপ একটা ফাঁস প্রস্তুত রাখিয়া স্বয়ং জুলেখার সহিত দেখা করিতে বাহির হইলেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ – রহস্য গভীর হইল
সেলিনাদের বাটীতে উপস্থিত হইয়া দত্ত সাহেব প্রথমেই জুলেখার দেখা পাইলেন; প্রথমে তাহার কাছে নিজের মনোভাবের কিছুই প্রকাশ করিলেন না। তাহার সহিত দ্বিতলের বারান্দায় গিয়া বসিলেন; এবং সেলিনার মাতাকে সংবাদ দিতে বলিলেন। জুলেখা মিসেস্ মারশনকে ডাকিয়া আনিতে গেল। দত্ত সাহেব কিরূপভাবে কথাটা প্রথমে তুলিবেন, তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। ক্ষণপরে জুলেখা পুনরায় একাকী ফিরিয়া আসিল; এবং তাহার মনিব শীঘ্র আসিতেছেন বলিয়া প্রস্থানের উপক্রম করিল।
দত্ত সাহেব বাধা দিয়া রুক্ষস্বরে কহিলেন, “দাঁড়াও, এখন গেলে চলিবে না—বিশেষ একটা কথা আছে।”
দত্ত। চালেনা-দেশমের সম্বন্ধে দুই-একটি কথা জিজ্ঞাসা করিবার আছে।
জু। আমি যা’ জানি, তা’ বেবাক্ হুজুরকে একদিন বলিয়াছি।
দত্ত। বেবাক্ এখনও হয় নাই—কিছু কিছু ফাঁক গিয়াছে। ডাক্তার বেন্টউডের জন্য চালেনা- দেশমের নূতন বিষ তৈয়ারি, সেই বিষ রুমালে লাগাইয়া, বিছানার নীচে লুকাইয়া থাকা, রহিমবক্সকে অজ্ঞান করা, তোমার এই সব কথাগুলা কে বলিবে?”
কথাগুলা শুনিয়া ভয়ে জুলেখার চোখ দুটা কপালে উঠিয়া গেল। জুলেখা ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিল না, দত্ত সাহেব এ সকল কথা কিরূপে জানিতে পারিলেন। সহসা জুলখা কোন কথা কহিতে পারিল না। অনতিবিলম্বে কিছু প্রকৃতিস্থ হইতে পারিল। তখন কিছু সাহসসঞ্চয়পূৰ্ব্বক দত্ত সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া একবার সশব্দে অবিশ্বাসের হাসি হাসিয়া উঠিল।
জুলেখার সেই উচ্চহাস্যে দত্ত সাহেব অধিকতর বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “শুধু ইহাই নহে, তাহার পর বাহিরের দিক্কার জানালা খুলিয়া বেন্টউডকে ঘরের ভিতরে আসিতে দিয়াছিলে; এবং দুইজনে মিলিয়া সুরেন্দ্রনাথের লাস চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছ।”
“লাস—চুরি—সুরেন্দ্রনাথের—” জড়িতকণ্ঠে বলিতে বলিতে জুলেখা সভয়বিস্ময়ে দুইপদ পশ্চাতে হটিয়া গেল।”
পূর্ব্বাপেক্ষা স্বর আরও উচ্চ করিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “হাঁ সুরেন্দ্রনাথের লাস, বেন্টউড আর তুমি দুজনে মিলিয়া চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছ। জুলেখা, এখন আর অস্বীকার করিলে চলিবে না—তাহাতে কোন ফল নাই; আমি তোমার মুখ দেখিয়া সব বুঝিতে পারিতেছি।” বলিয়া দত্ত সাহেব স্থির তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জুলেখার মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।
দত্ত সাহেবের কথায় জুলেখার আপাদমস্তক ঘন ঘন কম্পিত হইতে লাগিল। রাগে কি ভয়ে জুলেখার সর্ব্বাঙ্গে যে কম্প সমুপস্থিত, দত্ত সাহেব তাহা নির্ণয় করিতে পারিলেন না। এমন সময়ে বারান্দার পার্শ্ববর্ত্তী একটা গৃহের দ্বার উন্মোচন করিয়া, মিসেস্ মার্র্শন স্তম্ভিতভাবে দ্বারসমীপাগত হইয়া দাঁড়াইলেন। জুলেখা তাঁহার পাদমূলে সাষ্টাঙ্গে লুটাইয়া পড়িয়া হাউ হাউ করিয়া চীৎকারে কাঁদিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
মিসেস্ মার্র্শন জুলেখার এরূপ ব্যাকুলভাবে চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “জুলেখা, কি হইয়াছে? এমন করিয়া তুই কাঁদিতেছিস্ কেন?”
জুলেখার ক্রন্দনের বিরাম নাই—সে সুর আরও চড়াইয়া দিল।
দত্ত সাহেব কহিলেন, “আগে উহাকে চুপ করিতে বলুন, তাহার পর যাহা ঘটিয়াছে—সকলই আমি বলিতেছি।”
শব্দায়মানা জুলেখাকে নিরস্ত করিবার জন্য সান্ত্বনার স্বরে মিসেস্ মার্শন কহিলেন, “জুলেখা, চুপ কর, উঠিয়া দাঁড়া; কি হইয়াছে যে এমন করিতেছিস্?” জুলেখাকে হাত ধরিয়া উঠাইবার চেষ্টা করিলেন।
উঠিতে উঠিতে, কাঁদিতে কাঁদিতে জুলেখা বলিতে লাগিল, “আমি কি ঝুাত বলিয়াছি? আমি আর কিছুই জানি না; হুজুর সাহেব আজ আমাকে ঝুট্-মুট্—”
দত্ত সাহেব জুলেখাকে আর বেশী বলিতে দিলেন না। তাড়াতাড়ি উঠিয়া পশ্চাদ্দিক্ হইতে তাহার গলাটা ধরিয়া এমন সবেগে সঞ্চালন করিয়া দিলেন যে, সে একেবারে চুপ। জুলেখা একবার কাতর নেত্রে সেলিনার মাতার মুখের দিকে চাহিল; চাহিয়া তৎক্ষণাৎ মস্তক অবনত করিল। বলিতে পারি না, হঠাৎ কোন্ কারণে মিসেস্ মার্শনের মুখ চোখ সহসা বিবর্ণভাব ধারণ করিল। বিবর্ণমুখে একখানি চেয়ার টানিয়া তিনি বসিয়া পড়িলেন।
জুলেখা ও মিসেস্ মার্শনের সহসা এইরূপ ভাবান্তরে দত্ত সাহেবের মনে ঘোরতর সন্দেহ উপস্থিত হইল। আপাততঃ তিনি মিসেস্ মার্শনের রুমালাদি সংক্রান্ত কোন প্রসঙ্গের কোন উত্থাপন না করিয়া জুলেখার সম্বন্ধে সমুদয় কথা তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিতে লাগিলেন।
জুলেখা স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া সকলই শুনিয়া যাইতে লাগিল; সে আর চীৎকার করিয়া উঠিল না, অথবা সে দত্ত সাহেবের বাচ্যমান কোন কথার প্রতিবাদের চেষ্টা করিল না।
নবম পরিচ্ছেদ – জুলেখা—বিভ্রাটে
স্থিরচিত্তে সমুদয় শুনিয়া সেলিনার মাতা একবার দীননেত্রে জুলেখার মুখের দিকে চাহিলেন। তাহার পর দত্ত সাহেবের দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “কেমন করিয়া হইবে? আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা একেবারে অসম্ভব!”
একান্ত উত্তেজিতভাবে দত্ত সাহেব উঠিতে উঠিতে—বসিয়া বলিলেন, “কিসে অসম্ভব। আপনার জুলেখাতে সকলই সম্ভব। আমি আপনাকে যে সকল কথা বলিলাম, তাহার একটি বর্ণও মিথ্যা নহে। জুলেখাকে বড় সহজ মনে করিবেন না। বিষাক্ত রুমালের দ্বারা জুলেখা যে, রহিমকে অজ্ঞান করিয়াছিল, তাহা আপনি রহিমের মুখে স্পষ্ট শুনিলে তখন আর অবিশ্বাস করিতে পারিবেন না।”
সেলিনার মাতা জুলেখার দিকে ফিরিয়া ক্রোধকম্পিত উচ্চকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “জুলেখা, এ সকল কি সত্য? ঠিক করিয়া বল্।”
জুলেখা একবার মুখ তুলিয়া প্রশ্নকর্ত্রীর মুখের দিকে চাহিল। কি উত্তর করিবে, স্থির করিতে না পারিয়া, পুনরায় পূর্ব্ববৎ নতমুখে রহিল।
দত্ত সাহেব কহিলেন, “জুলেখা আর বলিবে কি, সকল কথাই এখন প্ৰকাশ পাইয়াছে— জুলেখাই আমাদের সুরেন্দ্রনাথের হত্যার একমাত্র কারণ।”
জুলেখা রুক্ষস্বরে কহিল, “না–না—আমি কেন সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিব?”
দত্ত সাহেব মুখ বিকৃত করিয়া কহিলেন, “চালেনা-দেশমের জন্য কে নুতন বিষ তৈয়ারি করিয়াছিল?”
জুলেখা বলিল, “তা’ আমি কি জানি, আমি চালেনা-দেশম দেখি নাই।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “এইখানে—এই বাড়ীর গেটের ধারে চালেনা দেশম পাওয়া গিয়াছে।” জুলেখা বলিল, “তা’ হবে, কিন্তু আমি আপনার চালেনা-দেশম দেখি নাই।”
দত্ত সাহেব ক্রোধভরে কহিলেন, “চালেনা-দেশমে যে নূতন বিষ দেখিলাম, তা’ তুমি ছাড়া এখানকার আর কেহই তৈয়ারি করিতে জানে না। তবে সে বিষ কে তৈয়ারি করিল?”
জুলেখা কহিল, “তা’ আমি কি করিয়া বলিব? আমি ইহার কিছুই জানি না।”
মিসেস্ মার্শন দত্ত সাহেবকে কহিলেন, “তাহা হইলে আপনি এখন জুলেখাকেই সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারিণী বলিয়া স্থির করিতেছেন?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “এক রকম তাহাই বটে। জুলেখা নিজের হাতে সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করে নাই। সর্ব্বতোভাবে হত্যাকারীর সাহায্য করিয়াছে। জুলেখার সহায়তার হত্যাকারী সহজে সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিয়া আত্মগোপন করিতে পারিয়াছে।”
মিসেস মার্শন জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে সে হত্যাকারী? আপনি তাহাকে জানেন?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “খুব জানি, হত্যাকারী নিজে ডাক্তার বেন্টউড।”
একটা আশ্বস্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মিসেস্ মার্শন কহিলেন, “বলেন কি! ডাক্তার বেন্টউড হত্যাকারী! তিনি কেন সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিতে গেলেন?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “কারণ আছে। আপনার কন্যা সেলিনা সুরেন্দ্রনাথের একান্ত অনুরাগিণী। ডাক্তার বেন্টউডের একান্ত ইচ্ছা, সেলিনাকে বিবাহ করে; কিন্তু তাহার সে ইচ্ছা পূরণের প্রধান অন্তরায় সুরেন্দ্রনাথ, তাই সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে।”
মিসেস্ মার্শন কহিলেন, “ইহা কি কখনও সম্ভব? এইজন্য তিনি খুন করিতে গেলেন—কি আশ্চৰ্য্য!”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “আশ্চর্য্যের কিছুই নাই। যাহাই হোক, আপনি নিশ্চয় জানিবেন, জুলেখার তৈয়ারি বিষে সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হইয়াছে। জুলেখাই সেই বিষে রহিমকে অজ্ঞান করিয়া বেন্টউডকে বাঁচাইবার জন্য সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ তাহাকে বাহির করিয়া দিয়াছে।”
মিসেস্ মার্শন দৃঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “জুলেখা, এ সকল কি সত্য?”
জুলেখা কহিল, “হাঁ, পরগম্বর সাহেব আমাকে যেরূপ হুকুম করিয়া ছিলেন, তাহাই আমি করিয়াছি।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “পয়গম্বর সাহেব আবার কে? ডাক্তার বেন্টউড নাকি?”
জুলেখা। হাঁ, তিনিই
দত্ত। তোর পয়গম্বর সাহেবের মৎলবে তুই সুরেন্দ্রনাথের লাস চুরি করিয়াছিস?
জু। হাঁ।
দত্ত। সে লাসে তোর পয়গম্বর সাহেবের কি দরকার?
জু। সে কথা পয়গম্বর সাহেবকে জিজ্ঞাসা করুন।
দত্ত। তোর পয়গম্বর সাহেব সে লাস এখন কোথায় রাখিয়াছে?
জু। আমি জানি না, পয়গম্বর সাহেব জানেন।
দত্ত। আইনের মুখে পড়িলে সকল কথা বাহির হইয়া পড়িবে।
দশম পরিচ্ছেদ – রহস্য গভীর হইল
মিসেস্ মার্শন সভয়ে কহিলেন, “আপনি আইনের কথা কি বলিতেছেন? আপনি মামলা- মোকদ্দমা করিবেন, স্থির করিয়াছেন?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “হাঁ, শীঘ্রই আমি ডাক্তার বেন্টউডকে গ্রেপ্তার করাইব, স্থির করিয়াছি।” চমকিত হইয়া সেলিনার মাতা কহিলেন, “কি সৰ্ব্বনাশ! কেন—ডাক্তার বেন্টউডকে কেন?” দত্ত সাহেব রুষ্টভাব কহিলেন, “কেন? বেন্টউডই বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছিল, সেই বিষ – গুপ্তির সাহায্যে সে সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে, তাহার পর সুরেন্দ্রনাথের লাস অপহরণ করিয়াছে।”
নিতান্ত হতাশভাবে মিসেস্ মার্র্শন চেয়ারের উপর হেলিয়া পড়িলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁহার মুখ মৃত্যুবিবর্ণীকৃত হইয়া গেল। তিনি সভয়ে চক্ষু মুদিত করিলেন।
সহসা মিসেস্ মার্শনের এরূপ ভাব-বৈলক্ষণ্যে জুলেখা তাঁহার সুতরল কৃষ্ণহাস্যের তরঙ্গ তুলিয়া উচ্চকণ্ঠে বারত্রয় বলিল, “টম্বরু—টম্বরু—টম্বরু।”
দত্ত সাহেব অবিচলিতস্বরে জুলেখাকে কহিলেন, “টম্বরু হইতে তোর পয়গম্বর সাহেবের কোন উপকার হইবে না। আমাদের এ দেশে টম্বরু কাউরূপীর কোন বুজরুকী কিছুমাত্র খাটিবে না। দেখি, এবার তোকে কোন্ টম্বরু রক্ষা করে!”
সভয়ে মিসেস্ মার্শন কহিলেন, “আপনি কি আমাদের জুলেখাকেও পুলিসের হাতে দিবেন?” দত্ত সাহেব কহিলেন, “নিশ্চয়ই।”
মিসেস্ মার্শন কহিনেল, “কেন? জুলেখা ত সুরেন্দ্রনাথকে খুন করে নাই।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “না করিলেও খুনীর সহায়তা করিয়াছে। জুলেখা নিজ মুখে নিজের অপরাধ স্বীকার করিয়াছে।”
“কি ভয়ানক! সকল দিকেই সৰ্ব্বনাশ বাঁধিয়া গেল,” বলিয়া একান্ত কাতরভাবে মিসেস্ মার্র্শন এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া চক্ষুঃ নিমীলিত করিলেন।
দত্ত সাহেব কহিলেন, “কেবল জুলেখার জন্যই কি আপনি এত কাতর হইতেছেন?”
“না,” বলিয়া মিসেস্ মার্শন আরও কি বলিতে যাইতেছিলেন, জুলেখার ইঙ্গিতে সহসা তিনি নিরস্ত হইলেন।
তৎক্ষণাৎ সগৰ্ব্বে মস্তকোত্তোলন করিয়া জুলেখা দত্ত সাহেবকে কহিল, “হাঁ, কেবল জুলেখার জন্য। জুলেখার কেহ কিছু করিতে পারিবে না। পয়গম্বর সাহেব জুলেখাকে রক্ষা করিবেন।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “তোর পয়গম্বর সাহেব আগে নিজেকে রক্ষা করুক—তার পর অপরকে রক্ষা করিবে?” মিসেস্ মারশনের প্রতি “আমি যেজন্য আসিয়াছিলাম, তাহা শেষ হইয়াছে। আপাততঃ আমি উঠিলাম,” বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
কাতরস্বরে মিসেস্ মার্শন কহিলেন, “আপনি কি আমাদের সর্ব্বনাশ করিবেন?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “আপনি এমন কথা বলিতেছেন কেন? সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারীকে আমি সমুচিত প্রতিফল দিতে মনস্থ করিয়াছি মাত্র!”
তাহার পর দত্ত সাহেব দ্রুতপদে সে স্থান ত্যাগ করিলেন।
.
যখন দত্ত সাহেব বারান্দা অতিক্রম করিয়া সোপানাবতরণ করিতেছেন, তখন সোপানের পার্শ্ববর্ত্তী একটা কক্ষের দ্বারদেশ হইতে ব্যগ্রকণ্ঠে কে কহিল, “চলুন—এখানে না, আপনার সহিত অনেক কথা আছে। আপনাদিগের যে কথাবার্ত্তা হইতেছিল, আমি অন্তরালে থাকিয়া সমুদয় শুনিয়াছি।”
দত্ত সাহেব পশ্চাতে ফিরিয়া দেখিলেন, সে সেলিনা। সেলিনা তাঁহার অনুসরণোম্মুখী। দত্ত সাহেব বলিলেন, “তোমার সহিত কথা কহিতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। একদিন তুমি সেই রুমাল সম্বন্ধে আমাকে অনেক মিথ্যাকথা বলিয়াছ।”
সেলিনা মৃদুস্বরে কহিল, “হাঁ, আমি মিথ্যাকথা বলিয়াছি; তা’ ছাড়া তখন আর কোন উপায় দেখি নাই। কাহাকে ঢাকিবার জন্য আমাকে এরূপ করিতে হইয়াছিল।”
“ডাক্তার বেন্টউডকে?”
“না, তিনি কেন?”
“তবে কে?”
“যিনি বিষ-গুপ্তি অপহরণ করিয়াছিলেন।”
“দেখিতেছি, তুমি তবে সকল খবর রাখ। কে সে—ডাক্তার বেন্টউড?”
“না—না—তিনি না—তিনি—”
“তবে কে?—জুলেখা?”
“না, জুলেখাও নয়—আমার মা।”
একাদশ পরিচ্ছেদ – রহস্য-গভীরতর
বিস্ময়বিমূঢ় হইয়া দত্ত সাহেব সেলিনার নিকট হইতে অনেকটা সরিয়া দাঁড়াইলেন। কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করিতে তাঁহার প্রবৃত্তি হইল না। সন্দিগ্ধচিত্তে অস্ফুটস্বরে কহিলেন, “তোমার মা! তিনি বিষ-গুপ্তি লইয়াছিলেন?”
সেলিনা কহিল, “হাঁ, তিনি কেবল আপনার অজ্ঞাতে বিষ-গুপ্তি গ্রহণ করেন নাই; যাহা করিয়াছেন, তাহা তিনি নিজেরও অজ্ঞাতে করিয়াছেন।”
ভ্রূভঙ্গী করিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “তুমি একি অসম্ভব কথা বলিতেছ? এমন কি কখন হইতে পারে? কেবল আমি কেন, কেহই ইহা বিশ্বাস করিবে না।”
সেলিনা কহিল, “আপনি এত শীঘ্র অবিশ্বাস করিবেন না; কথাটা আগে আমাকে ভাল করিয়া, বুঝাইয়া বলিতে দিন। আমি যাহা জানি, সমুদয় আপনাকে বলিতেছি। পূর্ব্বে আমার নাম গোপন করিবার জন্য আমাকে আপনার নিকটে মিথ্যা বলিতে হইয়াছিল। আপনি এখন প্রকৃত দোষী ব্যক্তির সন্ধান পাইয়াছেন, আর আমার সত্য গোপন করিবার কোন আবশ্যকতা নাই। আমি যাহা জানি, আজ সমস্ত আপনাকে সত্য বলিব। চলুন—নীচে চলুন, এখানে কোন কথা হইবে না, মা কিংবা জুলেখা এখনই এদিকে আসিতে পারে; জুলেখাকে আমার বড় ভয়—সে ডাকিনী সব করিতে পারে।”
বলিতে বলিতে সেলিনা তাড়াতাড়ি দত্ত সাহেবকে অতিক্রম করিয়া সোপানশ্রেণী হইতে দ্রুতপদে নামিতে লাগিল। দত্ত সাহেব তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ নামিয়া আসিলেন। উভয়ে নিম্নতলস্থ কোন একটি সর্ব্বাপেক্ষা নিভৃত কক্ষে গিয়া বসিলেন।
সেলিনা কহিল, “আমার মা কেন এত বড় গর্হিত কাজ করিলেন, তাহার কারণ প্রকাশ পাইলে, আপনি আমার মাকে আর দোষ দিতে পারিবেন না। জুলেখা তাহার ফাঁদে কেবল আমার মাকে কেন—আমাকেও এমন ভাবে জড়াইয়া ফেলিয়াছে, সহজে মুক্তির আশা নাই। জুলেখা হইতেই আমাদের সর্ব্বনাশ হইবে। আজ এক বৎসর জুলেখা কেবল আমাদিগের সর্ব্বনাশের চেষ্টা করিতেছে। এখন আমার মুখে সকল কথা শুনিলে আপনি বেশ স্পষ্ট বুঝিতে পারিবেন, আমাদের কোন অপরাধ নাই। ডাক্তার বেন্টউড ও জুলেখা এই সকল দুর্ঘটনার নিয়ন্তা।”
দত্ত। বেন্টউড ও জুলেখা উভয়ে মিলিয়া কি সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে?
সেলি। হাঁ, নিশ্চয়ই
দত্ত। তাহারাই লাস চুরি করিয়াছে?
সে। নিঃসন্দেহ।
দত্ত। তবে তুমি এই সকল কথা পূর্ব্বে আমাকে বল নাই কেন?
সে। আমি তখন ইহা নিজে ঠিক করিয়া কিছু বুঝিতে পারি নাই—পারিলেও বোধ হয় বলিতে পারিতাম না। জুলেখা আমাকে শাসন করিয়া বলিয়াছিল, যদি আমার মুখ হইতে তাহার বিরুদ্ধে কোন কথা প্রকাশ পায়, সে আমার মাকে হত্যাপরাধে ফেলিবে।
দত্ত। [চিন্তিতভাবে] বুঝিয়াছি। এখন আমি তাহাদের মনের অভিপ্রায় অনেকটা বুঝিতে পারিলাম। জুলেখার ইচ্ছা, ডাক্তার বেন্টউডের সহিত তোমার বিবাহ হয়।
সে। আমার মার তাহাতে কিছুমাত্র ইচ্ছা নাই। অনিচ্ছাসত্ত্বেও যাহাতে তিনি সহজে বেন্টউডের হাতে আমাকে সমর্পণ করিতে বাধ্য হন, সেইজন্য তাঁহার উপর দিয়া বেন্টউড ও জুলেখা দু’জনে মিলিয়া ভিতরে ভিতরে এই সকল কাণ্ড করিতেছে।
দত্ত। বলিতে পার, জুলেখা কেন বেন্টউডকে এত ভয় করে?
সে। জুলেখা ডাক্তার বেন্টউডকে ভয় করে না, বেন্টউডের কাছে টম্বরু নামে একটুক্রা পাথর আছে, সেটাকেই জুলেখার যত ভয়।
দত্ত সাহেব আবার বিষম সমস্যায় পড়িলেন। কহিলেন, “টম্বরু! হাঁ, জুলেখার মুখে টম্বরুর নাম শুনিয়াছি বটে। সে জিনিষটা কি?”
সেলিনা বলিতে লাগিল, “বাদামের মত ছোট একখণ্ড কৃষ্ণবর্ণ প্রস্তর। বাদামের মত ছোট— কিন্তু দেখিতে ঠিক বাদামের মত নহে; সে রকম অস্বাভাবিক আকারের প্রস্তরখণ্ড বড়-একটা দেখিতে পাওয়া যায় না। ছোটনাগপুরের খাড়িয়ারা সেই প্রস্তরখণ্ডকে টম্বরু বলিয়া থাকে। তাহাদের বিশ্বাস, সেই টম্বরুতে প্রেতযোনী বাস করে। যাহার কাছে সেই টম্বরু পাথর থাকে, কেহ তার কোন শত্রুতাচরণ করিতে পারে না। যদি কেহ করে, টম্বরুর সাহায্যে সহজে সে শত্রুকে নিপাত করা যায়। এই পাথরের উপরে তাহাদের বিশ্বাস ও ভক্তি কতদূর অবিচল ও দৃঢ়, তাহা শুনিয়া চমৎকৃত হইতে হয়। এমন কি এই টম্বরুকে দেখিতে, পূজার্চ্চনা করিতে তাহারা অনাহারে বিশক্রোশ পথ ছুটিয়া যায়। উহা হস্তগত করিবার জন্য তাহারা এক-একটা নগর জ্বালাইয়া দিতে এবং শতসহস্রের জীবন নষ্ট করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হয় না। প্রায় এক শত বৎসর পূর্ব্বে কোন একজন ফকির তাহাদের অজ্ঞাতে ছোটনাগপুর হইতে ঐ টম্বরু পাথর লইয়া বোম্বে পলাইয়া গিয়াছিল। সেই সময়ে ডাক্তার বেন্টউডও একবার বোম্বে গিয়াছিলেন। এবং টম্বরু পাথরখানি তথা হইতে সংগ্রহ করিয়া ফিরিয়া আসেন। আমি জুলেখার মুখে শুনিয়াছি যে, জুলেখার মারও ঐরূপ আর একটা টম্বরু পাথর ছিল। কিন্তু সে কোথায় সেটা রাখিয়াছিল, ভ্রমক্রমে সে কথা মৃত্যু পূর্ব্বে কাহারও নিকটে প্রকাশ করিয়া যায় নাই। জুলেখার মত জুলেখার মাও অনেক মন্ত্রতন্ত্র জানিত, এবং এইরূপ ভূত-প্রেত সাধনা করিয়া বেড়াইত। তাহার মেয়ে এখন ঠিক তাহারই মত হইয়াছে। মার মৃত্যুর পর যতদিন জুলেখা আসামে ছিল, সেই টম্বরু পাথরের সন্ধান করিয়া করিয়া ফিরিত। এমন কি–সে নিজের হাতে অনেক স্থানে মাটি অবধি কাটিয়া দেখিয়াছে। জুলেখার এখনও ইচ্ছা, সেই টম্বরুর সন্ধানে সে আর একবার আসামে ঘুরিয়া আসে। তাহার পর এখানে বেন্টউডের নিকটে টম্বরু পাথর দেখিয়া সে তাঁহাকে দেবতার ন্যায় ভক্তি করিতে আরম্ভ করিয়াছে। বেন্টউড যাহা বলে, জুলেখা তৎক্ষণাৎ তাহা শিরোধার্য্য করিয়া লয়। সে যাহা হোক, আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, কেবল আমাকে বিবাহ করিবার অভিলাষে বেন্টউড এই সকল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছেন, এবং জুলেখাকে দিয়া একটার পর একটা কাজ সম্পন্ন করিয়া লইতেছেন। আপনি এইমাত্র জুলেখার মুখে শুনিয়াছেন যে, জুলেখার নিকটে বেন্টউড পয়গম্বর সাহেব।”
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – রহস্য-গভীরতম
দত্ত সাহেব সেলিনার মুখের উপর তীক্ষ্ণদৃষ্টি স্থাপন করিয়া কহিলেন, “ছিঃছিঃ তোমরা জুলেখার এই সব নিরর্থ কাহিনীতে বিশ্বাস কর! জুলেখা তোমাদের মাথা একেবারে বিগড়াইয়া দিয়াছে।”
সেলিনা কহিল, “তাহা বড় মিথ্যা নহে। কিন্তু এখন আমি নিজে ও সকল বড় বিশ্বাস করি না। আগে সত্য বলিয়া আমার মনে হইত; এমন কি আমার মা নিজে আগে এই সব খুব বিশ্বাস করিতেন। আসামে যত সব অসভ্য বন্য জাতির সহিত মিশিয়া তাঁহার মতিগতি অনেকটা বিগড়াইয়া গিয়াছিল। কিন্তু এখন আমরা কেহই ইহা মনে একেবারে স্থান দিই না। বিশেষতঃ জুলেখা বেন্টউডের সহিত এরূপ মিশিতে আরম্ভ করিয়াছে, আর যে রকমে আমাদিগকে বিপদে ফেলিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহাতে আমার ইচ্ছা যে, আমি এখনই আমাদের বাড়ী হইতে তাহাকে দূর করিয়া দিই। কিন্তু অনেক দিন হইতে জুলেখা আমাদের এখানে আছে বলিয়া মা স্নেহবশতঃ তাহাকে কাজে জবাব দিতে চাহেন না।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “বটে, তুমি বিষ-গুপ্তি চুরি সম্বন্ধে কি বলিতেছিলে?”
সেলিনা বলিতে লাগিল, “যে দিন রাত্রে আপনার বিষ-গুপ্তি অপহৃত হয়, সেইদিন আমি উপরের বারান্দায় একাকী বসিয়াছিলাম। উজ্জ্বল জ্যোৎস্নালোকে চারিদিক্ বেশ সুস্পষ্ট দেখা যাইতেছিল। সেই উজ্জ্বল জ্যোৎস্নালোকে নীচের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, কোথা হইতে জুলেখার সহিত আমার মা বাহির হইয়া আসিলেন, তাহার পর সম্মুখদ্বারে গিয়া দাঁড়াইলেন। জুলেখাও সঙ্গে সঙ্গে গোপনে গেল। আমি ছায়ার মধ্যে বসিয়াছিলাম, তাহারা কেহই আমাকে দেখিতে পায় নাই। জুলেখা একবার সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিয়া আমার মাকে হাত মুখ নাড়িয়া কি বলিল, এবং অঙ্গুলিনিৰ্দ্দেশে আপনাদিগের বাড়ী দেখাইয়া দিল। তাহার পর মন্ত্র বলিতে বলিতে দুই-একবার মার আপাদমস্তক হস্ত সঞ্চালন করিল। তখনই মা টলিতে টলিতে অথচ দ্রুতপদে আপনাদিগের বাটীর দিকে চলিয়া গেলেন। সেই সময়ে উজ্জ্বল চন্দ্রালোকে আমার মার মুখের দিকে চাহিয়া আমি অত্যন্ত ভীত হইলাম। সে মুখ যে তখন কেমন এক রকম বিবর্ণ দেখিলাম, তাহা জীবিত মনুষ্যের বলিয়া বোধ হইল না। চক্ষুঃ অৰ্দ্ধনিমীলিত। তাহার পর তিনি—”
বাধা দিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “বুঝিয়াছি—মন্ত্র নহে, পিশাচী জুলেখা তোমার মাকে হিপ্নটাইজ করিয়াছিল।”
সেলিনা কহিল, “তাহাই হইবে, তাহার পর মা চলিয়া গেলে, জুলেখা আবার বাড়ীর ভিতরে চলিয়া আসিল। মার মুখ দেখিয়া আমার অত্যন্ত ভয় হইয়াছিল, আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না—ছুটিয়া বাড়ীর বাহির হইয়া আসিলাম। মা যে পথে গিয়েছিলেন, সেইদিকে প্রাণপণে ছুটিতে লাগিলাম। আপনার বাড়ীর কাছে গিয়া দেখিলাম, মা তখন আপনাদের বাগানের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছেন। আমি আর অগ্রসর হইতে সাহস করিলাম না; সেইখানে দাঁড়াইলাম। দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলাম, বাগান অতিক্রম করিয়া মা একটা ঘরের ভিতরে যাইলেন; সেই ঘরে তখন একটা আলো জ্বলিতেছিল। তখনই তিনি বাহির হইয়া আসিলেন; যে পথে গিয়াছিলেন, সেই পথে ফিরিতে লাগিলেন। তখন দেখিলাম, তখন তাঁহার হাতে একটা কি রহিয়াছে। উজ্জ্বল চন্দ্রালোকে তাহা এক-একবার ঝক্মক্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে। তাহার পর তিনি কিছু নিকটস্থ হইলে দেখিলাম, সেটা আপনাদের সেই বিষ-গুপ্তি। তখন আমার মনের অবস্থা যে কিরূপ হইল, কেমন করিয়া বলিব? তেমন দিবসের ন্যায় পরিস্ফুট জ্যোৎস্নালোকেও আমি চারিদিকে অন্ধকার দেখিলাম। আমি দাঁড়াইতে পারিলাম না—প্রাণপণে ছুটিয়া বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলাম। আবার বারান্দার সেইখানে গিয়া রুদ্ধশ্বাসে বসিলাম। নীচের দিকে চাহিয়া রহিলাম। দেখিলাম, তখনই মা সেই বিষ-গুপ্তি হাতে লইয়া উপস্থিত। জুলেখা আবার বাহির হইয়া আসিল, মার কাছে গিয়া তাঁহার হাত হইতে সেই বিষ-গুপ্তিটা তুলিয়া লইল। তাহার পর হাত ধরিয়া তাঁহাকে বাড়ীর ভিতরে লইয়া গেল। আমার সকলই যেন স্বপ্ন বলিয়া মনে হইতে লাগিল।”
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – ঘটনা-বৈষম্য
বিস্ময়াবিষ্ট ও কৌতূহলাক্রান্ত হৃদয়ে দত্ত সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তখন তুমি কি করিলে?” সেলিনা কহিল, “অল্পক্ষণ পরে আমি মার সহিত দেখা করিতে গেলাম। শুনিলাম, তখন তিনি শয়ন করিয়াছেন। জুলেখাকে আমার বড় ভয়—ভয়ে তখন আমি আর কোন কথা কহিতে পারিলাম না। তাহার পর যখন আপনার মুখেই শুনিলাম, সেই বিষ-গুপ্তির বিষে আপনার ভাগিনেয় খুন হইয়াছেন, তখন আমি আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলাম না। সেদিন আমি যাহা দেখিয়াছিলাম, সমুদয় জুলেখাকে বলিলাম, এবং তাহারই দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছে বলিয়া তাহাকে অনেক তিরস্কার করিতে লাগিলাম। আমার কথা শুনিয়া জুলেখা রাগে জ্বলিয়া উঠিল। আমাকে শাসাইয়া কহিল, যদি আমি বিষ-গুপ্তি সম্বন্ধে কাহারও নিকটে কখনও কোন কথা প্ৰকাশ করি, তাহা হইলে সে এই হত্যাপরাধের দোষারোপ করিয়া আমার মাকে বিপদে ফেলিবে।”
দত্ত সাহেব অত্যন্ত আবেগের সহিত বলিয়া উঠিলেন, “কি সর্ব্বনাশ! সে তোমার মাকেও কি এইরূপ ভয় দেখাইয়াছিল?”
সেলিনা কহিল, “না, মার কাছে কোন কথা বলে নাই। আমিও মাকে কোন কথা বলি নাই। মা যেরূপ ভয়-তরাসে, তাহাতে জুলেখার নিকটে এ কথা শুনিলে মা ভয়েই মরিয়া যাইতেন। পাছে জুলেখা কোন সৰ্ব্বনাশ ঘটাইয়া দেয়, সেই আশঙ্কায় আমি এ কথা কাহারও কাছে বলিতে সাহস করি নাই। এমন কি আপনার কাছেও আমাকে মিথ্যা কহিতে হইয়াছে, নতুবা আমার মা ভয়ানক বিপদে পড়েন। যাহাই হউক, সেই মিথ্যা কথার জন্য আপনি এখন আমাকে ক্ষমা করিবেন। কি ভয়ানক বিপদে পড়িয়াই আমাকে আপনার সমক্ষে মিথ্যা কহিতে হইয়াছে, আপনি তাহা অবশ্যই এখন বুঝিতে পারিতেছেন। এখন আমি সমুদয় আপনার নিকটে প্রকাশ করিলাম। আমাদের আর উপায় নাই, আপনি একমাত্র ভরসা আছেন, জুলেখা আর বেন্টউডের হাত হইতে আমাদিগকে উদ্ধার করুন।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “বেন্টউড সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে, সে সম্বন্ধে তোমার আর কোন সন্দেহ নাই?”
সেলিনা কহিল, “কিছুমাত্র না। সেই সকল ঘটনায়, মানসিক উদ্বেগে সহসা আমি একদিন পীড়িত হইলাম। বৈকালে অত্যন্ত জ্বর হইল। আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, জুলেখা আমার জন্য ঔষধ প্রস্তুত করিবার ছলে, বিষ-গুপ্তির বিষ তৈয়ারি করিয়াছিল; সেই বিষে বিষ-গুপ্তি পূর্ণ করিয়া ডাক্তার বেন্টউডকে পাঠাইয়া থাকিবে। ডাক্তার বেন্টউড সেই বিষ-গুপ্তিতে আপনার ভাগিনেয়কে হত্যা করিয়াছে। তাহার পর জুলেখার সাহায্যে তাঁহার মৃতদেহও চুরি করিয়া আনিয়াছে।”
দত্ত। তাহাদের এই লাস চুরির কারণ কিছু বলিতে পার?
সে। না, তা’ আমি ঠিক করিয়া কিছু বলিতে পারি না। সে যাহাই হউক, এখন আপনি বোধ হয়, বেশ বুঝিতে পারিতেছেন, কোন্ গুরুতর কারণে, কি ভয়ানক বিপদে পড়িয়া সে দিন আপনার সমক্ষেও আমাকে মিথ্যা কহিতে হইয়াছিল।
দত্ত সাহেব সেলিনার মুখের উপরে প্রশংসমান দৃষ্টি স্থাপন করিয়া কহিলেন, “হাঁ, সেজন্য আমি কিছুমাত্র দুঃখিত নহি, বরং সুখী হইলাম। তোমার নিকটে আমার আর একটি কথা জিজ্ঞাস্য আছে। লাস চুরির সেই ভয়ানক রাত্রে, তেমন দুর্যোগ মাথায় করিয়া একাকী তুমি সেরূপ উন্মত্তভাবে আমাদের বাড়ীতে কেন গিয়াছিলে? অবশ্যই তাহার কোন একটা কারণ থাকিবার কথা।”
সে। হাঁ, সেদিন আমার মনের ঠিক ছিল না; তাহা না থাকিলেও সে রাত্রে জুলেখাকে আমাদের বাড়ীতে না দেখিয়া আমার বড় ভয় হইয়াছিল যে, সে আবার একটা কি কাণ্ড ঘটাইতে বাহির হইয়াছে।
দত্ত। সেদিন রাত্রে কি জুলেখা তোমাদের বাড়ীতে ছিল না?
সে। না, পূৰ্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি, সেদিন আমি পীড়িতা হইয়া বিছানায় পড়িয়া ছিলাম। মা আমার বিছানায় বসিয়া আমার মাথায় ধীরে ধীরে পাখার বাতাস করিতেছিলেন। আমার অসুখ হইলে জুলেখা প্রায় আমাকে ছাড়িয়া কোথায় থাকে না—সতত আমার কাছেই থাকে; কিন্তু সেদিন তাহাকে আমার ঘরে না দেখিয়া আমার মনে বড় ভয় হইল। আমি মাকে জুলেখার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। মা বলিলেন, সে আজ আসিবে না, বলিয়া গিয়াছে। শুনিয়া আমি আরও ভয় পাইলাম। বুঝিলাম, জুলেখার আজও একটা কোনও ভয়ানক উদ্দেশ্য আছে। তখন বাহিরে সন্ধ্যার অন্ধকারের ন্যায় আমার মনেও নানা বিভীষিকা ক্রমে ক্রমে ঘনাইয়া আসিতে লাগিল। আমি অত্যন্ত অস্থির হইয়া উঠিলাম।
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – ভাব-বৈষম্য
দত্ত। বুঝিয়াছি, সেদিন জুলেখা বেন্টউডের সহিত পরামর্শ করিতে তাহার বাটীতে গিয়াছিল।
সে। হাঁ, আমিও আগে তাহাই মনে করিয়াছিলাম। তাহার পর একজন ভৃত্য আমার জন্য চা তৈয়ারি করিয়া আনিলে, আমি তাহাকে জুলেখার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। সে বলিল, আপনার ভাগিনেয়ের সৎকার হইবে, সেইজন্য জুলেখা আপনাদের বাড়ীতেই গিয়াছে।
দত্ত। মিথ্যাকথা। আমার বেশ মনে পড়িতেছে, সেদিন জুলেখা আমাকে বলিল, তুমিই তাহাকে আমার নিকটে পাঠাইয়াছ, সে তোমার সহিত দেখা করিতে আসিবার জন্য আমাকে বারংবার অনুরোধ করিতে লাগিল।
সে। কি ভয়ানক মিথ্যাকথা! আমি ইহার বিন্দুবিসর্গ জানিতাম না। সেদিন সে আমাকে কোন কথা বলিয়া যায় নাই, আমিও তাহাকে কিছু বলি নাই। যাহাই হউক, রাত ক্রমে বাড়িতে লাগিল, তথাপি জুলেখা ফিরিল না। জুলেখার যেরূপ ভয়ানক প্রকৃতি—তাহাতে এত রাত পর্য্যন্ত বাহিরে থাকিতে দেখিয়া আমার উদ্বেগ শতগুণে বাড়িয়া উঠিল। তাহার সেই বিষ-গুপ্তি চুরি—সেই সব ভয়ানক কথা আমার মনে উঠিতে লাগিল; আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। আকুলভাবে ঘরের ভিতরে বিছানায় পড়িয়া ছটফট করিতে লাগিলাম। তাহার পর রাত দুইটা বাজিয়া গেল, তখনও আমি জাগিয়া তখনও জুলেখা ফিরিল না। তখন আমি নিঃসন্দেহ হইতে পারিলাম যে, অবশ্যই কোন-একটা ভয়ানক দুরভিসন্ধিতে জুলেখা এত রাত পর্যন্ত বাহিরে ঘুরিতেছে। অনেক রাত অবধি জাগিয়া মা তখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। মনের নিদারুণ উদ্বেগে আমি ঘর হইতে বাহিরে আসিলাম। বাহিরে বারান্দার বসিলাম, সেই নির্জ্জনে কত রকম দুশ্চিন্তা যেন সজীব হইয়া আমার চক্ষের সম্মুখে ঘুরিতে লাগিল। আমি উন্মত্তের মত হইয়া উঠিলাম। ছুটিয়া তখনই আপনার বাড়ীর দিকে চলিলাম। তাহার পর যাহা ঘটিয়াছে, আপনি সকলই জানেন।
দত্ত। হাঁ, সকলই জানি। জুলেখার সহায়তায় বেন্টউড যে লাস চুরি করিয়াছে, তাহা নিশ্চিত। কিন্তু বলিতে পার, সেলিনা ইহাতে তাহাদের কোন্ অভিপ্রায় সিদ্ধ হইবে?
সে। তাহারাই জানে। আমি যাহা জানি, সকলই আপনাকে বলিলাম। এখন আপনি কি করিবেন, স্থির করিয়াছেন?
দত্ত। ডাক্তার বেন্টউডের সঙ্গে একবার দেখা করিতে হইবে। বোধ করি, এতক্ষণ সে আমাদের বাড়ীতে আসিয়াছে।
সে। [সবিস্ময়ে] বেন্টউড! আপনাদের বাড়ীতে!
দত্ত। হাঁ, আমি বেন্টউড ও ইনস্পেক্টর গঙ্গারামকে আসিতে লিখিয়াছি। ইচ্ছা আছে, আজই সুরেন্দ্রনাথের হত্যাপরাধে বেন্টউডকে পুলিসের হাতে সমর্পণ করিব।
সে। আর জুলেখাকে?
দত্ত সাহেব পকেট হইতে ঘড়ি বাহির করিয়া দেখিলেন। বলিলেন, “না আপাততঃ তাহাকে পুলিসের হাতে ফেলিবার কোন প্রয়োজন দেখি না। সে সহজে এখান হইতে পলাইতে পারিবে না।”
সেলিনা কহিল, “বিশেষতঃ যতক্ষণ ডাক্তার বেন্টউডের কাছে টম্বরু পাথর আছে, ততক্ষণ সে এখান হইতে একপদ নড়িতেছে না।”
দত্ত সাহেব উঠিয়া কহিলেন, “আর আমি বিলম্ব করিতে পারিব না। হাতে অনেক কাজ রহিয়াছে। তোমার সঙ্গে এখন যে সকল কথাবার্তা হইল, কেহ যেন কিছুমাত্র জানিতে না পারে।”
সেলিনা কহিল, “না, সে বিষয় আপনি খুব নিশ্চিন্ত থাকিবেন।”
দত্ত সাহেব সেলিনার নিকট হইতে বিদায় লইলেন। দুই-এক পদ অগ্রসর হইয়া পুনরায় ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “আর একটা কথা বলিতে ভুল করিয়াছি। বিষ-গুপ্তি অপহরণের এই সকল কথা কি অমরেন্দ্রনাথ শুনিয়াছে? তোমার মার দ্বারা এই কাজ হইয়াছে, সে কি তাহা জানে?”
সেলিনা একটু চিন্তিত হইল। মুহূর্ত্তপরে কহিল, “না, তাহা আমি ঠিক বলিতে পারি না। বোধ হয়, তিনি কিছু জানেন, আমাকে দেখিলেই সহসা তাঁহার মুখ যেন কিছু অপ্রসন্ন হইয়া উঠে— কেমন যেন তাঁহাকে কিছু অন্যমনস্ক বোধ হয়। ইতিপূর্ব্বে একদিন তিনি, আমাদের কোন ভয় নাই বলিয়া দুই-একবার আশ্বাসও দিলেন। তাহাতেই আমি বোধ করি, তিনি ভিতরকার কথা কিছু জানেন।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “হাঁ, আমারও তাহাই মনে হয়। কি জানি হয় ত, কোন রকমে অমরেন্দ্র এ ঘটনার কিছু কিছু জানিতে পারিয়াছে। যাহাই হউক, এখন আমি চলিলাম। পরে আবার আমি তোমার সহিত দেখা করিব।”
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – উদ্বেগ-বৈষম্য
মুহূর্ত্ত পরে দত্ত সাহেব তথা হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন। সেলিনাদের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া তিনি নিজের বাড়ীর দিকে দ্রুতপদে চলিতে লাগিলেন। সেলিনা অমরেন্দ্রনাথের সম্বন্ধে যে দুই-একটা কথা বলিল, তাহাতে দত্ত সাহেবের মনে এক ঘোরতর সন্দেহের আন্দোলন উপস্থিত হইল। তিনি অনেক চিন্তার পর স্থির করিলেন, অমরেন্দ্রনাথের বিশ্বাস, মিসেস্ মার্শনের দ্বারাই এই হত্যাকাণ্ড সমাধা হইয়াছে, সেইজন্য সে কোনক্রমে আমার কাছে সে কথা প্রকাশ করে নাই। সেইজন্যই সে বলিয়াছিল, সে যদি আমার কাছে সে সম্বন্ধে কোন কথা প্রকাশ করে, তাহা শুনিয়া আমি বরং তাহাকে আরও তিরস্কার করিব। সে যে কেন আমার কাছে কোন কথা প্রকাশ করিতে সাহসী হয় নাই, এখন আমি তাহার বিশিষ্ট কারণ জানিতে পারিলাম। এমন কি, এইজন্যই সে এখন সেলিনাকে বিবাহ করিতেও সম্মত নহে। জানিয়া-শুনিয়া নরহস্ত্রীর কন্যাকে কোন্ ভদ্রসন্তান বিবাহ করিতে সম্মত হয়? কিন্তু যখন সে শুনিবে, ইহাতে সেলিনার মাতার কোন অপরাধ নাই, এবং ডাক্তার বেন্টউডই হত্যাপরাধী, তখন সে বুঝিতে পারিবে, পরের প্ররোচনায় কি একটা দুঃসহ মিথ্যা ধারণা স্বেচ্ছায় সে নিজের বুকের মধ্যে অনর্থক পোষণ করিতেছিল।
দত্ত সাহেব ভাবিতে ভাবিত ক্রমে নিজের বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, বাটীর বহির্দ্বারে অমরেন্দ্রনাথ দাঁড়াইয়া।
অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “ডাক্তার বেন্টউড ও গঙ্গারামবাবু আপনার অপেক্ষায় বাহিরের ঘরে বসিয়া আছেন।”
দত্ত। হাঁ, সেইজন্যই আমি তাড়াতাড়ি আসিতেছি। আমি তাহাদের দুজনকেই আসিতে লিখিয়াছিলাম।
অ। [বিস্মিতভাবে] আপনিই আসিতে লিখিয়াছিলেন?
দত্ত। হাঁ অমর, তুমি শুনিয়া আরও বিস্মিত হও—আমি গঙ্গারামবাবুকে দিয়া বেন্টউডকে গ্রেপ্তার করাইব।
অ। ডাক্তার বেন্টউডকে গ্রেপ্তার করাইবেন—কি ভয়ানক! কোন্ অপরাধে?
দত্ত। [তীক্ষ্ণকণ্ঠে] সুরেন্দ্রনাথের হত্যাপরাধে। একি, তুমি যে আমার কথা শুনিয়া একেবারে আকাশ হইতে পড়িলে! অমর, আমি মিথ্যাকথা বলি নাই। তোমার সাহায্য ব্যাতিরেকে আমি প্রকৃত হত্যাকারীকে সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছি। ডাক্তার বেন্টউড সেই হত্যাপরাধী। [সস্নেহে] অমর, তুমি যে কেন তখন আমার নিকটে কোন কথা প্রকাশ কর নাই, তাহার কারণ আমি এখন জানিতে পারিয়াছি।
শিহরিয়া অমর কহিলেন, “কি সর্বনাশ! কিরূপে আপনি তাহা জানিতে পারিলেন?”
দত্ত সাহেব সস্নেহে বলিতে লাগিলেন, “যাক্, সেজন্য আমি আর কিছুমাত্র দুঃখিত নহি, তোমার উপরেও আমার আর কিছুমাত্র রাগ নাই; বরং আমি এখন মনে মনে সুখী হইয়াছি, তুমি খুব বুদ্ধিমানের কাজই করিয়াছ।”
দত্ত-সাহেবের কথা শুনিতে শুনিতে অমরেন্দ্রনাথের মুখ উদ্বেগবিবর্ণীকৃত এবং চক্ষের দৃষ্টি অত্যন্ত নিষ্প্রভ হইয়া গেল। অমরেন্দ্র জড়িতকণ্ঠে কহিলেন, “আপনি কাহার কাছে শুনিলেন? কে আপনাকে—কে আপনাকে বলিল?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “সেলিনা।”
“কি ভয়ানক! সেলিনা বলিয়াছে!” বলিতে বলিতে অমরেন্দ্রনাথ দূরে সরিয়া দাঁড়াইলেন। সহসা তাঁহার মুখমণ্ডল প্রবল রক্তোচ্ছ্বাসে আরক্ত হইয়া উঠিল—পরক্ষণে অন্ধকার বিবর্ণ মলিন হইয়া গেল।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ – সন্দেহ-বৈষম্য
অমরেন্দ্রনাথ আর তথায় দাঁড়াইলেন না; দত্ত সাহেবের মুখের দিকে চাহিতে আর তাঁহার সাহস হইল না; তিনি নতমুখে দ্রুতপদে বাটীমধ্যে ঢুকিলেন। দত্ত সাহেব অমরেন্দ্রনাথের এই আকস্মিক অভূতপূর্ব্ব অধীরতার কোন কারণ নির্দ্দেশ করিতে না পারিয়া বড় বিস্মিত হইলেন; এবং তাঁহার মন কিছু সন্দেহযুক্ত হইল। তিনি অমরকে সহসা তথা হইতে চলিয়া যাইতে দেখিয়া দুই-একবার প্রভুত্বের দৃঢ়স্বরে দাঁড়াইতে কহিলেন। অমরেন্দ্র তাহাতে কর্ণপাত না করিয়া অধিকতর দ্রুতবেগে বাটীমধ্যে চলিয়া গেলেন। দত্তসাহেবের বিস্ময়ের সীমা আরও বর্দ্ধিত হইল। পরক্ষণে তিনিও বাটীমধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং লাইব্রেরী ঘরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, সেখানে গঙ্গারাম একাকী বসিয়া আছেন।
দত্ত সাহেব তাঁহাকে কহিলেন, “এই যে আপনি আসিয়াছেন, ডাক্তার বেন্টউড কোথায়?”
গঙ্গারাম কহিলেন, “তিনি রহিমকে দেখিবার জন্য এইমাত্র উঠিয়া গেলেন।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “একাকী উঠিয়া গেলেন?”
গঙ্গারাম কহিলেন, “না, মিঃ অমরেন্দ্রনাথ তাঁহার সহিত গিয়াছেন।”
শুনিয়া দত্ত সাহেবের মনে ভারি একটা খট্কা লাগিল। ভাবিলেন, অমরেন্দ্রনাথ কোন গুপ্ত পরামর্শের জন্য বেন্টউডকে এখান হইতে রহিমের ঘরে লইয়া গিয়াছে। এইজন্যই অমরেন্দ্র বহির্দ্বার হইতে আমার অগ্রে তাড়াতাড়ি এখানে চলিয়া আসিল। কিন্তু বেন্টউড শত্রু, শত্রুর সহিত অমরেন্দ্রের কি গুপ্ত পরামর্শ? এইখানে দত্ত সাহেব বিষম সমস্যায় পড়িলেন। অমরেন্দ্রের উপরে তাঁহার সন্দেহ আরও প্রবল হইয়া উঠিল; আর তাঁহাকে বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হইল না; বারংবার তাঁহার মনে হইতে লাগিল, এই সকল পৈশাচিক কাণ্ডে বেন্টউডের সহিত অমরেন্দ্রও কিছু কিছু লিপ্ত আছে।
দত্ত সাহেবের একবার ইচ্ছা হইল, রহিমের ঘরে গিয়া দেখিয়া আসেন, সেখানে বেন্টউড ও অমরেন্দ্র উভয়ে মিলিয়া কি করিতেছেন। কিন্তু অনাবশ্যক বোধে সে ইচ্ছা তখনই পরিত্যাগ করিলেন। মনে করিলেন, আজ তাঁহার সহিত সেলিনার যে সকল কথাবাৰ্ত্তা হইয়াছে, অমরেন্দ্র তাহার কিছু শুনে নাই; তাহাতে অমরেন্দ্রর নিকটে বেন্টউড বিশেষ কোন নূতন সংবাদই সংগ্রহ করিতে পারিবে না। আপাততঃ ইনস্পেক্টর গঙ্গারামের সহিত এদিক্কার সমুদয় বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া ফেলা যুক্তিযুক্ত; তাহার পর পুলিসের হাতে পড়িয়া তাহাদিগকে সকল কথাই নিজের মুখে স্বীকার করিতে হইবে। এবং তাহাদের ভিতরের যাহা কিছু দুরভিসন্ধি, সমুদয় বাহির হইয়া পড়িবে—সহজে কেহই অব্যাহতি পাইবে না।
দত্ত সাহেব এইখানেই নিজের গোয়েন্দাগিরির একটা মস্ত ভুল করিয়া বসিলেন। এরূপ স্থলে কোন নামজাদা পাকা ডিটেক্টিভ কখনই এরূপ মীমাংসায় উপনীত হইতে পারিতেন না, এবং এমন সুযোগ ত্যাগ করা তাঁহার পক্ষে সাতিশয় কষ্টসাধ্য হইত। এ সময় হয় তিনি অন্তরালে থাকিয়া তাঁহাদের গুপ্ত পরামর্শ শ্রবণ করিতেন; তাহাতে অসুবিধা হইলে, সহসা তাঁহাদের সম্মুখীন হইয়া মন্ত্রণার একটা বিঘ্ন উৎপাদন করিতেন। যাহাই হউক, সেজন্য দত্ত সাহেবকে কোন দোষ দেওয়া যাইতে পারে না; কারণ তিনি নিজে ডিটেক্টিভ নহেন, তবে তিনি দায়ে পড়িয়া নিজের জন্য নিজে গোয়েন্দাগিরি করিয়া অপরের সাহায্য ব্যতিরেকে যতদূর সত্য আবিষ্কার করিতে পারিয়াছেন, তাহাই যথেষ্ট, এবং সেজন্য তিনি ধন্যবাদার্হ।
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – রহস্য-বৈষম্য
দত্ত সাহেব একখানি চেয়ার টানিয়া বসিয়া কহিলেন, “গঙ্গারামবাবু, আপনাকে হঠাৎ এমন সময়ে কি জন্য আসিতে লিখিয়াছি, জানেন কি?”
গঙ্গারাম মৃদু হাস্যের সহিত কহিলেন, “লোকে আমাদিগকে আর কিসের জন্য ডাকিয়া থাকে? বোধ করি, সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধীয় কোন বিষয়ে আবার আমাকে দরকার হইয়াছে।”
দত্ত। তাহাই বটে। এই হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে আপনি আর কোন সন্ধান-সুলভ করিতে পারিলেন কি?
গঙ্গা। লাস-চুরি সন্ধানে খুব একটা সন্ধান হইয়াছে বটে। সেদিন রাত্রে লাস চুরির সময়ে আশানুল্লা পাড়াতেই ছিল। সে কিছু কিছু দেখিয়াছে।
দত্ত। [চমকিত ভাবে] আশানুল্লা! সে কি এখান হইতে লাস বাহির করিয়া লইয়া যাইতে দেখিয়াছে?
গঙ্গা। আপনার বাড়ী হইতে বাহির করিয়া আনিতে দেখে নাই। কিন্তু লাস গাড়ীর ভিতরে চাপাইতে দেখিয়াছে?
দত্ত। গাড়ীর ভিতরে!
গঙ্গা। হাঁ, একখানা গাড়ী আপনার বাড়ীর কিছু তফাতে দাঁড়াইয়াছিল; আশানুল্লা দূরে থাকিয়া দুইজন লোককে একটা মৃতদেহ সেই গাড়ীর ভিতরে তুলিয়া দিতে দেখিয়াছে। সে দুইজনের মধ্যে একজন স্ত্রীলোক। আশানুল্লা সহজে তাহাদের নাম বলিতে চাহে না।
দত্ত। হাঁ, আমি তাহাই মনে করিয়াছিলাম। সেই দুইজনের মধ্যে একজন যে স্ত্রীলোক, তাহা আমি পূৰ্ব্বেই জানিতে পারিয়াছি।
গ। কি নাম, বলুন দেখি?
দত্ত। নাম পরে শুনিবেন। আশানুল্লা আর কি দেখিয়াছে, বলুন। সমস্তটা শুনিবার জন্য আমার অত্যন্ত আগ্রহ হইতেছে। সে গাড়ীখানা কি ভাড়াটে গাড়ী?
গ। না, বাড়ীর গাড়ী, ব্রুহাম?
দত্ত। কোন ডাক্তারের ব্রুহাম?
গ। আশানুল্লা আপনাকেও সকল কথা বলিয়াছে, দেখিতেছি।
দত্ত। সে আমাকে এ সম্বন্ধে কোন কথা বলে নাই। তাহার পর কি হইল?
গ। মৃতদেহ গাড়ীর ভিতরে তুলিয়া তাহার গাড়ীর দরজা বন্ধ করিয়া দিল। পরক্ষণে স্ত্রীলোকটা সেখান হইতে চলিয়া গেল।
দত্ত। সে কোন্ দিকে গেল?
গ। আপনার বাড়ীর সম্মুখবর্তী বাগানের ভিতরে প্রবেশ করিল। তাহার পর যে, সে কোথায় গেল, আশানুল্লা তাহা দেখে নাই।
দত্ত। আর সেই লোকটা?
গ। লোকটা নিজেই কোবক্সে উঠিয়া গাড়ী হাঁকাইয়া দিল। গাড়ীতে কোচম্যান কি সহিস আর কেহই ছিল না।
দত্ত। না থাকিবারই কথা; এ সব কাজে এই রকম ঘটিয়া থাকে। আর কেহ জানিতে না পারে, সেজন্য তাহাদের যতদূর সতর্ক হওয়া দরকার, তাহাও কিছুমাত্র ত্রুটি হয় নাই।
গ। ত্রুটি হয় নাই সত্য; কিন্তু কাৰ্য্যতঃ তাহা ঠিক ঘটে নাই। লোকটা যখন লাস লইয়া গাড়ী হাঁকাইয়া দিল, তখন আশানুল্লা গোপনে গাড়ীর পিছনে সহিসের স্থান দখল করিয়া গাড়ীর সঙ্গে সঙ্গে চলিল। আশানুল্লা মনে ভাবয়াছিল, শেষ পৰ্য্যন্ত কি ঘটে দেখিয়া পরে কথাটা সকলের কাছে প্রকাশ করিবার ভয় দেখাইয়া সেই লোকটার কাছে কিছু আদায় করিবে। সেইজন্য সে গাড়ীর পিছনে চাপিয়া আলিপুরে গিয়াছিল।
দত্ত। হাঁ, সে আলিপুরে ডাক্তার বেন্টউডের বাড়ী পৰ্য্যন্ত গিয়া দেখিয়া আসিয়াছে। সেখানে বেন্টউড আর কাহাকেও না ডাকিয়া নিজে মৃতদেহ বাটীমধ্যে বহিয়া লইয়া গিয়াছে। নিজেই গাড়ী ঘোড়া আস্তাবল খুলিয়া ফেলিয়াছে। কেমন, আমি যাহা বলিতেছি, সত্য কি না?
গঙ্গারাম আশ্চর্যান্বিত হইয়া দত্ত সাহেবের মুখের দিকে বিস্ময়োৎফুল্ল নেত্রে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কিরূপে জানিলেন? নিশ্চয় আশানুল্লার মুখে আপনি এ সব কথা শুনিয়াছেন।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “কিছুমাত্র না। সে আমাকে কোন কথা বলে নাই। গঙ্গারামবাবু, এখন অনেক খবরই আমাকে রাখিতে হয়—আজকাল চারিদিকের খবর রাখাই আমার কাজ হইয়াছে। আপনি যে স্ত্রীলোকের কথা বলিতেছিলেন, যে লাস-চুরিতে ডাক্তার বেন্টউডের যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিল, তাহাকেও যে আমি না জানি, তাহা নহে—সে জুলেখা। গঙ্গারামবাবু আরও শুনুন, ডাক্তার বেন্টউড কেবল লাস চোর নয়—সে নিজে সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারী।”
গঙ্কারাম কহিলেন, “কি সৰ্ব্বনাশ! বলেন কি আপনি! পূর্বে তাহা জানিলে, আমি ওয়ারেন্টখানা বদলাইয়া আনিতাম।”
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – রহস্য-বৈষম্য
ওয়ারেন্টের কথা শুনিয়া দত্ত সাহেবের চোখ মুখ একটা অপ্রত্যাশিতপূর্ব্ব পুলকসঞ্চারে সহসা উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি তবে বেন্টউডকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য ওয়ারেন্ট বাহির করিয়াছেন?”
গঙ্গারাম কহিলেন, “হাঁ, আমি আশানুল্লার মুখে যতদূর শুনিলাম, তাহাতে কেবল লাস-চুরির চার্জে বেন্টউডের নামে ওয়ারেন্ট বাহির করিয়াছি।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “তাহার পর আমার মুখে যতদূর শুনিলেন, তাহাতে আপনি খুনের চাৰ্জ্জ দিয়া অনায়াসে বেন্টউডের নামে আরও একটা ওয়ারেন্ট বাহির করিতে পারিবেন।”
গঙ্গা। তাহাকে আপনি খুনী সাবুদ করিতে পারিবেন।
একান্ত উত্তেজিত ভাবে চেয়ার ঠেলিয়া উঠিয়া, টেবিলে সজোরে একটা চপেটাঘাত করিয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন, “নিশ্চয়ই! আমি যতদূর প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারিয়াছি, তাহাতে আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি, ডাক্তার বেন্টউডই আমার ভাগিনেয় সুরেন্দ্রনাথের একমাত্র হত্যাকারী।”
দত্ত সাহেবের সেই উচ্চকণ্ঠধ্বনি দূরে মিলাইতে না মিলাইতে, সেই কক্ষের দ্বার ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হইয়া গেল। সেই সদ্যোমুক্ত দ্বারে দাঁড়াইয়া বেন্টউড স্থির ধীর গম্ভীর; তাহার দৃষ্টি একান্ত চাঞ্চল্যচিহ্ন-বিরহিত, অতি তীক্ষ্ণ; মুখ গম্ভীর। তাহার পশ্চাতে বাহিরে অমরেন্দ্রনাথ মলিনমুখে দাঁড়াইয়া। দীর্ঘকাল পরে কোন ব্যক্তি রোগ-শয্যা ত্যাগ করিয়া আসিলে তাহাকে যেরূপ দেখায়, অমরেন্দ্রকে দেখিয়া তাহাই বুঝাইতেছে।
দত্ত সাহেব বেন্টউডের কঠোর দৃষ্টিপাতে বুঝিতে পারিলেন, বেন্টউড বাহিরে থাকিয়া তাঁহাদের অনেক কথাই শুনিয়াছেন। বেন্টউড প্রথমে কি বলেন, তাহা শুনিবার জন্য প্রথমে নিজে কিছু বলিলেন না; নীরবে রহিলেন।
বেন্টউড তখন কহিলেন, “মিঃ দত্ত, আমার উপরে যে আপনি হত্যাপরাধ চাপাইতেছেন, তাহা আমি শুনিয়াছি। ভদ্রলোককে নিজের বাড়ীতে ডাকিয়া আনিয়া তাহার সহিত এইরূপ ব্যবহার করা আপনার ন্যায় বিচক্ষণ ব্যক্তির ঠিক কাজ হয় না। অভ্যাগত ভদ্রলোকের প্রতি কি ইহাই আপনার কর্ত্তব্য?”
দত্ত সাহেব কঠোরকণ্ঠে কহিলেন, “আপনি আর সর্ব্বসমক্ষে নিজেকে অভ্যাগত ভদ্রলোক বলিয়া পরিচিত করিবেন না।”
বেন্টউড কহিলেন, “হাঁ, আমার ভুল হইয়াছে; এখন আমি অভ্যাগত কেন? আপনার শিকার। এতক্ষণে আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, রহিমবক্সকে দেখিবার অজুহাতে আপনি আমাকে এখানে ডাকিয়া আনিয়া ফাঁদে ফেলিতেছেন। আপনি মনে করিয়াছেন, আপনার ফাঁদে পড়িয়া, বিষ-গুপ্তি-চুরি, হত্যা, লাস-চুরি, এই তিনটি অপরাধ নিতান্ত নিরীহের ন্যায় কি আমি নিজের ঘাড়ে তুলিয়া লইব?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “তাহা কেন? আপনি দুইটা অপরাধে অপরাধী।”
“কোন্ কোন্ অপরাধে?” বলিয়া বেন্টউড সদম্ভপাদক্ষেপে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন; এবং ইনস্পেক্টরের পার্শ্ববর্তী একখানি চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। ইনস্পেক্টর গঙ্গারামবাবু পকেটমধ্যস্থ ওয়ারেন্টখানিতে অঙ্গুলিস্পর্শ করিয়া প্রস্তুত হইয়া রহিলেন। ইচ্ছা, দত্ত সাহেবের প্রমাণ প্রয়োগে বেন্টউড অপরাধী সাব্যস্ত হইলেই, সেই মুহূর্তে তাহাকে গ্রেপ্তার করিবেন। অমরেন্দ্রনাথ দ্বারের নিকটবর্ত্তী একখানা চেয়ারে বসিয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে গৃহমধ্যস্থ সকলের গতিবিধি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আর সকলেই বসিয়া—কেবল একাকী দত্ত সাহেব সম্মুখবর্তী টেবিলে ভর করিয়া দাঁড়াইয়া।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – বিভ্ৰাট-বৈষম্য
দত্ত সাহেব গম্ভীরভাবে বলিতে লাগিলেন, “ডাক্তার বেন্টউড, আপনি যে একজন অতি চতুর লোক, তাহা আমি বেশ জানি। ইহার উপরে আপনি যেরূপ একজন সুদক্ষ রসায়নবিদ, তাহাতে আপনার আবশ্যক মত অর্থ থাকিলে, আপনি নিজের উন্নতির পথ যথেষ্ট সুগম করিতে, এবং শীঘ্র মাথা তুলিতে পারিতেন। অথচ অর্থাভাবে আপনি কিছুই করিতে পারিতেছেন না। সেই অর্থাভাব দূর করিবার জন্য এই বয়সে আপনি সেলিনাকে বিবাহ করিতেও কুণ্ঠিত নহেন।”
ম্লানহাস্যের সহিত বেন্টউড কহিলেন, “অথবা তাহার প্রণয়ীকে হত্যা করিতে। ইহাও এই সঙ্গে বলুন।”
দত্ত সাহেব সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া গম্ভীর মুখে কহিলেন, “তাহার পর আপনি জানিতে পারিলেন, সেই সেলিনার অনুরাগী সুরেন্দ্রনাথ।”
বেন্টউড কহিলেন, “কেবল সুরেন্দ্রনাথ কেন, অমরেন্দ্রনাথও সেই সেলিনার অনুরাগী।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “সে কথা পরে হইতেছে। আপনিও নিজে সেলিনার অনুরাগী; সুতরাং সুরেন্দ্রনাথ আপনার অন্তরায়, সেই অন্তরায় দূর করিতে, আপনার অভীষ্ঠসিদ্ধির জন্য আপনি আমাদের অপহৃত বিষ-গুপ্তি হস্তগত করেন।”
বেন্ট। বটে, বটে! কাহার দ্বারা অপহৃত, সে কথাটাও এখানে একবার প্রকাশ করুন।
দত্ত। মিসেস্ মার্র্শন।
অমরেন্দ্রনাথ চকিত হইয়া, অৰ্দ্ধোত্থিত হইয়া কহিলেন, “মিসেস্ মারশন! তিনি কি আমাদের বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছিলেন?”
বেন্টউড সপরিহাসে কহিলেন, “হাঁ, সুবিজ্ঞ দত্ত সাহেবের মুখ হইতে যখন একথা বাহির হইয়াছে, তখন ইহা আমাদের সকলেরই খুব বিশ্বাস করা কর্ত্তব্য।”
দত্ত সাহেব বলিতে লাগিলেন, “মিসেস্ মার্শন সেই বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়া জুলেখাকে দিয়াছিলেন। জুলেখা আপনাদের আদেশে সেই বিষ-গুপ্তিতে নূতন বিষ ঢালিয়া আপনাকে দিয়াছিল। আপনি নিজের পথ নিষ্কন্টক করিবার জন্য সেই বিষ-গুপ্তিতে সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছেন।”
বেন্টউড কহিলেন, “ইহা কি সম্ভব? আমি এমনই একজন ভয়ানক লোক্?”
দত্ত সাহেব বলিতে লাগিলেন, “তাহার পর আপনি সুরেন্দ্রনাথের লাস চুরি করিয়াছেন। ইহাতেও জুলেখা আপনাকে অনেক সাহায্য করিয়াছিল। সেইদিন সন্ধ্যা হইতে সে খাটের নীচে লুকাইয়াছিল, যথাসময়ে সে বিষ-গুপ্তির বিষের বিষাক্ত গন্ধের দ্বারা আমাদের খানসামা রহিমকে অজ্ঞান করিয়াছিল। জুলেখার সাহায্যে আপনি এতবড় একটা ভয়ানক কাজ অতি সহজে শেষ করিতে পারিয়াছিলেন।”
বেন্টউড উপর দিকে মুখ তুলিয়া ছাদতলের কড়ি বরগা দৃষ্টি করিতে করিতে অন্যমনস্কভাবে কহিলেন, “তাহা হইলে জুলেখাও এই সকল কাজে বেশ লিপ্ত আছে বলিয়া, বোধ হয়।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “বোধ হয় কেন, নিশ্চয়ই। আপনি কি নিজে তাহা জানেন না? না জানেন, পরে জুলেখাকে যখন আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে দেখিবেন, তখন বেশ জানিতে পারিবেন।”
বেন্টউড কহিলেন, “তাহা হইলে আপাততঃ আমাকেই গ্রেপ্তার করা হইতেছে, দেখিতে পাই।”
বিংশ পরিচ্ছেদ – বিস্ময়-বৈষম্য
ইনস্পেক্টর গঙ্গারামবাবু, ডাক্তার বেন্টউডের সংযতচিত্ততা দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন।
কহিলেন, “তাহার আর ভুল কি আছে? এই দেখুন, লাস-চুরির অপরাধে আপনাকে বন্দী করিবার ওয়ারেন্ট আমার নিকটে রহিয়াছে।”
ওয়ারেন্টের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া মৃদুহাস্যের সহিত বেন্টউড কহিলেন, “আমাকে লাস-চোর বলিয়া আপনি প্রমাণ দিতে পারিবেন?”
গঙ্গারামবাবু কহিলেন, “আশানুল্লার জোবানবন্দীতে আপনি সে প্রমাণ পাইবেন।”
আশানুল্লার নাম শুনিয়া বেন্টউডের ললাটদেশ কুঞ্চিত এবং মুখমণ্ডল ভ্রুকুটিভীষণ হইয়া উঠিল। ভ্রূভঙ্গী করিয়া কহিলেন, “আশানুল্লা, সে কি জানে?”
গঙ্গা। সে সকলই জানে। যখন জুলেখা আর আপনি উভয়ে মিলিয়া সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ গাড়ীতে তুলিতেছিলেন, তখন গোপনে থাকিয়া আশানুল্লা সকলই দেখিয়াছে। সে তখন আপনার সেই গাড়ীর পিছনে উঠিয়া আপনার বাড়ী পৰ্য্যন্ত গিয়াছিল, সেই লাস আপনাকে নিজের বাড়ীর মধ্যে লইয়া যাইতেও দেখিয়া আসিয়াছে।
বেন্ট। বটে। কিন্তু এ সকল উড়ো প্রমাণে কোন কাজ হইবে না। আপনি কি আমার বাড়ী অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছেন?
গঙ্গা। দেখি নাই—এইবার দেখিতে হইবে।
বেন্ট। অনর্থক কষ্ট পাইবেন—লাস বাহির করিতে পারিবেন না। যাহাই হউক, আপনি বিশিষ্ট প্রমাণ না দেখাইয়া আমাকে বন্দী করিতে পারেন না।
গঙ্গা। প্রমাণ পরে পাইবেন, আপাততঃ আমি মহারাণীর নামে আপনাকে বন্দী করিলাম। বেন্ট। কোন্ অপরাধে?
গঙ্গা। লাস-চুরির অপরাধে?
বেন্ট। [দত্ত সাহেবের প্রতি] এইমাত্র? তাহা হইলে সুরেন্দ্রনাথের হত্যাপরাধে আমাকে বন্দী করা হইতেছে না?
দত্ত। ব্যস্ত হইতে হইবে না, ম্যাকবেথপ্রবর! ব্যস্ত হইতে হইবে না। এখন ফাঁসীকাঠ হইতে নিজের গলাটা বাঁচাইবার চেষ্টা করিলে ভাল হয়।
বেন্ট। হাঁ, সেজন্য আমাকে আপাততঃ কিছু ভীত, ভীত কেন, চিন্তিত হইতে হইয়াছে—ইহার একটা উপায় করিতে হইবে বই কি। এ সময়ে একজন ব্যারিষ্টারের সাহায্য আমার একান্ত প্রয়োজন। আশা করি, আমার এই মিথ্যা অভিযোগের জন্য নবীন ব্যারিষ্টার অমরেন্দ্রনাথ আমার পক্ষ সমর্থন করিবেন।
একান্ত বিবর্ণমুখে অমরেন্দ্রনাথ স্বপ্নোত্থিতের ন্যায় বলিয়া উঠিলেন, “আমি! আমি আপনার পক্ষ সমর্থন করিব! কি সৰ্ব্বনাশ!”
পরক্ষণে অমরেন্দ্রের বিবর্ণীকৃত স্নান মুখমণ্ডলে বিবিধ-বর্ণ-বৈচিত্র্য প্রকটিত হইতে লাগিল। পরক্ষণে ডাক্তার বেন্টউড তাঁহার প্রতি মর্ম্মভেদী দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “নিশ্চয়ই। নতুবা কে আমাকে রক্ষা করিবে? তুমি কি অস্বীকার করিতেছ?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “অবশ্যই অমর ইহাতে অস্বীকার করিবে।”
অমরেন্দ্রনাথ মুখ তুলিয়া একবার দত্ত সাহেবের মুখের দিকে, তাহার পর বেন্টউডের, তাহার পর ইনস্পেক্টরের মুখের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চাহিয়া তাহার পর দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “সৰ্ব্বসমক্ষে স্বীকার করিলাম, আমিই ডাক্তার বেন্টউডের পক্ষ সমর্থন করিব।”
পরক্ষণে কক্ষ একান্ত নিঃশব্দে—এমন কি সূচিকাপাতের শব্দও সুস্পষ্ট শ্ৰুত হয়।