চতুর্থ খণ্ড – অভিনব রহস্য
প্রথম পরিচ্ছেদ – রমণীর হৃদয়
আদালত হইতে খালাস পাইয়া রস্তমজী কলের পুত্তলীর ন্যায় যে অবগুন্ঠনাবৃতা রমণীর সহিত গাড়ীতে উঠিয়াছিলেন, সে কে তাহা তিনি জানিতেন না, সে সময়ে কোন বিষয়ের বিচারের ক্ষমতাও তাঁহার ছিল না।
গাড়ীর শব্দে সহসা তাঁহার চৈতন্য হইল। তিনি স্তম্ভিতহৃদয়ে রমণীর দিকে চাহিলেন। তখন তাহার মুখ হইতে অবগুণ্ঠন অপসারিত হইয়াছিল। দেখিয়া, চমকিত হইয়া রস্তমজী বলিলেন, “তুমি!”
রমণী উত্তর করিল, “হাঁ, আমি, কিন্তু এখন আর আমি সে রতনবাঈ নাই—কমলার দাসী।”
রস্তমজী আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলেন, “কমলার দাসী!”
রতনবাঈ মৃদুস্বরে কহিল, “হাঁ, কমলার দাসী।”
“কেন?”
“কেন? তুমি বিপদে, আর আমি পরম নিশ্চিন্ত মনে নীরবে বসিয়া রহিব? তাহা হইলে আমার জীবনে ফল কি? কমলা দাসী না হইলে তুমি এ বিপদ্ হইতে উদ্ধার হও না—তোমার অপবাদ যায় না—প্রকৃত দোষীর দণ্ড হয় না; কাজেই আমি কমলাবাঈ-এর দাসী।”
“আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না; আমার আর বুঝিবার শক্তি নাই।”
“যদি সময় হয় সকল খুলিয়া বলিব। এখন তুমি যাও—ইচ্ছা কর, আমার বাড়ীতে গিয়া থাকিয়ো।”
“তুমি কোথায় যাইবে?”
যেখান হইতে আসিয়াছি, সেইখানেই যাইতেছি। আমি কমলাবাঈ-এর নিকট যাইব?”
“কেন? আমি এখন মুক্ত হইয়াছি। আর তোমার সেখানে যাইবার প্রয়োজন কি? আমি তোমায় যাইতে দিব না।”
“এখনও পাপীর দণ্ড হয় নাই—এখনও তাহারা জেলে যায় নাই। তাহাদের যত দিন দণ্ড না হয়, ততদিন তুমিও নিজেকে নিরাপদ মনে করিয়ো না। তাহারা তোমাকে বিপদে ফেলিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা পাইতেছে—ভিতরে ভিতরে গভীর ষড়যন্ত্র চলিতেছে।”
“কে তাহারা? আমি ত কাহারও কখনও কোন অনিষ্ট করি নাই।”
“অনিষ্ট না করিলে কি শত্রু হয় না?”
“কে তাহারা?”
“বর্জরজী আর মাঞ্চারজী।”
(সবিস্ময়ে) “কে!”
“বর্জরজী—আর মাঞ্চারজী। এতে বিস্মিত হইবার কিছুই নাই।”
“আমি তাহাদের কোন ক্ষতি করি নাই?”
“করিয়াছ, তুমি কমলাবাঈকে বিবাহ করিতে চাও।”
“তাহাতে তাহাদের কি?”
“তাহারাও কমলাবাঈকে চাহে, তাহারা হরমসজীর অতুল সম্পত্তির অধীশ্বর হইতে চাহে।”
“কি?”
“ভয় নাই, আমি থাকিতে তুমি ব্যতীত কমলাবাঈকে কেহ পাইবে না।”
“সেকি রতন! তুমি একি বলিতেছ?”
“ঠিক বলিতেছি, আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়ো না। কমলা বাঈকে আমি আগে দুই চক্ষে দেখিতে পারিতাম না। তাহার নাম শুনিলে আমার সর্ব্বাঙ্গে আগুন ছুটিত। আগে তাহাকে দেখি নাই। এখন তাহার সহিত বাস করিয়া তাহাকে যতদূর বুঝিয়াছি, তাহাতে তাহার উপর আমার আর রাগ নাই। আমি তাহাকে ভালবাসিয়াছি। আমি তাহার পায়ের ধূলার যোগ্যও নই।”
“রতন, একি পরিহাস—না আমার মন বুঝিবার চেষ্টা করিতেছ?”
রতন সে কথার কোন উত্তর না দিয়া জোরের সহিত কহিল, “তুমি আমাকে—পথের ভিখারিণীকে—এই পাপিষ্ঠাকে—নিজের ভগ্নীর মত ভালবাসিয়াছ, আমার সহস্র অপরাধ মার্জ্জনা করিয়াছ, মৃত্যুমুখ থেকে আমাকে রক্ষা করিয়াছ, রাজরাণীর মত রাখিয়াছ—আমার পাপ মন, আমি অন্য ভাবে তোমায় ভালবাসিয়াছিলাম, হৃদয়ের দেবতা বলিয়া তোমার পূজা করিয়াছিলাম; কিন্তু এখন আর আমি সে রতন নাই—সে রতন মরিয়া গিয়াছে, দেখি এখন তোমার ভগিনী হইবার উপযুক্তা হইতে পারি কিনা। দেখি, তেমন কোন কাজ করিতে পারি কিনা—রস্তম, রস্তম—আমাকে ক্ষমা কর—আমাকে ক্ষমা কর।” রতন আত্মসংযম করিতে পারিল না, দুইহাতে মুখ ঢাকিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
রস্তমজী সস্নেহে তাহাকে আপনার পার্শ্বে টানিয়া লইয়া, মুখ হইতে হাত টানিয়া লইয়া, রতনের সেই নীহারাক্ত কমলের ন্যায় অশ্রুসিক্ত সুন্দর মুখখানি মুছাইয়া দিলেন। চোখের জল আর কিছুতেই থামে না।
রতন সহসা চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিল। সত্বর চক্ষের জল বস্ত্রাঞ্চলে মুছিল। বলিল, ‘গাড়ী থামাইতে বল, আমি এইখানে নামিব।”
রস্তমজী বলিলেন, “বাড়ীতে চল।”
রতন বলিল, “না, সময় হইলে যাইব। গাড়ী থামাইতে বল।”
রস্তমজী কহিলেন, “না—রতন, এখানে না।”
তখন রতনবাঈ আপনিই গাড়ী থামাইতে বলিবার উদ্যম করায় অগত্যা রস্তমজী কোচম্যানকে ডাকিয়া গাড়ী থামাইতে বলিলেন। গাড়ী থামিল।
রতন নামিতে নামিতে বলিল, “সেই বৃদ্ধ মারাঠী যাহা বলেন, তাহাই করিয়ো। তিনিই তোমাকে রক্ষা করিয়াছেন। আমি যাহা করিয়াছি, তাঁহারই হুকুমে করিয়াছি। তিনি আমাদের প্রকৃত বন্ধু, তিনিই তোমার শত্রুদিগকে প্রতিফল দিবেন।”
এই বলিয়া রতন সত্বর গাড়ী হইতে নামিয়া একটি গলির ভিতর প্রবিষ্ট হইয়া মুহূৰ্ত্তমধ্যে দৃষ্টির বাহির হইয়া গেল।
রস্তমজী কোচম্যানকে নিজের ঠিকানা বলিয়া গাড়ী হাঁকাইতে বলিলেন। তাঁহার মাথা ঘুরিতে লাগিল। তিনি নিতান্ত ক্লান্তভাবে গাড়ীতে ঠেসান দিয়া বসিলেন। তাঁহার সে সময়ের মনের অবস্থা আমরা বর্ণন করিবার প্রয়াস পাইব না।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বৃদ্ধ বদ্ধপরিকর
ক্রমে সেই গাড়ীখানা রস্তমজীর বাড়ীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। তিনি কম্পিতপদে গাড়ী হইতে নামিলেন। স্পন্দিত হৃদয়ে বাড়ীর দ্বারে গিয়া দাঁড়াইলেন। আবার তিনি জেল হইতে খালাস হইয়াছেন।
অমনই তাঁহার পূর্ব্বের সকল কথা মনে পড়িল। আর একদিনও তিনি এমনই জেল হইতে মুক্তি পাইয়া বাড়ীতে আসিতেছিলেন; কিন্তু বাড়ীতে প্রবেশ করিতে পারেন নাই, আবার পুলিস কর্তৃক ধৃত হইয়াছিলেন।
আপনা-আপনিই তাঁহার দৃষ্টি রাজপথের চারিদিকে পড়িল; হৃদয় সবেগে স্পন্দিত হইতে লাগিল; কিন্তু আজ তিনি কোথায়ও পুলিসকে দেখিতে পাইলেন না।
তখন তাঁহার কোচম্যানের কথা মনে পড়িল। তাহাকে বলিলেন, “একটু অপেক্ষা কর, ভাড়া দিতেছি।”
সে উত্তর করিল, “ভাড়া আগেই পাইয়াছি।”
কোচম্যান গাড়ী হাঁকাইয়া চলিয়া গেল। রস্তমজী ভাবিলেন, “পাছে আমার নিকট টাকা না থাকে ভাবিয়া রতন আগেই ভাড়া দিয়াছে।” তিনি হৃদয়ে বড় বেদনা পাইলেন।
তিনি স্পন্দিতহৃদয়ে বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হইলেন। তাহাকে দেখিয়া তাঁহার ভৃত্য হাসিমুখে তাঁহার নিকট ছুটিয়া আসিল। সে কোন কথা কহিতে পারিল না। তাহার মুখ দেখিলেই বুঝা যায় যে, সে মনিবকে দেখিয়া ঘড়ই আনন্দিত হইয়াছে।
রস্তমজীও কোন কথা কহিতে পারিলেন না। তাঁহার চক্ষে জল আসিল, তিনি তাহার দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া নিজ প্রকোষ্ঠে প্রবিষ্ট হইলেন।
সেই গৃহে এক ব্যক্তি বসিয়াছিলেন। সেখানে তাঁহাকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া রস্তমজী বড় বিস্মিত হইলেন। যিনি বসিয়াছিলেন, তিনি সেই বৃদ্ধ মারাঠী—একখানি সংবাদ-পত্রে গভীর মনসংযোগ করিয়াছেন। বসিবার ভঙ্গিও আবার তেমনি নবাবী ধরণের। একখানা চেয়ারে অর্দ্ধশায়িতভাবে বসিয়া একখানি প্রকাণ্ড চরণ টেবিলের উপর আর একখানি চরণ পার্শ্বস্থ চেয়ারের উপরে তুলিয়া দিয়াছেন। যেন নিজেরই ঘরবাড়ী। রস্তমজী গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেও কাশীনাথ নায়েকের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই, তিনি সংবাদপত্রে দৃষ্টি ন্যস্ত রাখিয়াই বলিলেন, “এস, তোমার অপেক্ষায় আমি বসিয়া আছি।”
রস্তমজী কি বলিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না, নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন।
সংবাদ-পত্র দেখিতে দেখিতে কাশীনাথ বলিলেন, “বসো, একটু সুস্থ হও বাপু। তোমার মত বিপদে পড়িলে অন্যলোকে হয় ত পাগল হইয়া যাইত।”
এবার রস্তমজী অনেক কষ্টে কথা কহিলেন। বলিলেন, “আপনার অনুগ্রহেই এ বিপদ হইতে মুক্তি পাইয়াছি।”
কাশীনাথ সংবাদ-পত্র হইতে চক্ষু না উঠাইয়া কহিলেন, “সে তোমার বড় ভুল। সকলই ভগবানের হাত। তিনি নির্দোষীকে কখন দণ্ডিত করেন না।”
“তিনিই আপনাকে আমার এ বিপদে মিলাইয়া দিয়াছিলেন, নতুবা আমার রক্ষা পাইবার উপায় ছিল না।”
“আর দুই-একজন সাহায্য না করিলে আমি কিছুই করিতে পারিতাম না।”
“তাঁহাদের নাম জানিতে পারি নাকি?”
“দুইজনই তোমার বন্ধু।”
“কে?”
“এঁদের দুজনেরই নাম বলিতে পারি। একজন ফ্ৰামজী।”
“ফ্রামজী আমার জন্য প্রাণপণ করিবে, তাহা আমি জানি। আর একজন কে?”
“একটি স্ত্রীলোক।”
“স্ত্রীলোক! কে সে স্ত্রীলোক?”
এইবার কাশীনাথ নায়েক সংবাদ-পত্রখানি একপার্শ্বে রাখিয়া রস্তমজীর দিকে চাহিলেন। বলিলেন, “তুমি কি তাহা জান না? খুব জান—রতনবাঈ। তাহার সাহায্য না পাইলে আমি হয় ত কিছুই করিতে পারিতাম না। আমি তাহাকে পতিতা ভাবিয়াছিলাম, এখন আমি আমার ভুল বুঝিয়াছি, নারী রূপে সে দেবী।”
রস্তমজীর চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া আসিল। তিনি কষ্টে আত্মসংযম করিয়া বলিলেন, “আমি ইহা জানিয়াছি। তিনিই আমাকে গাড়ী করিয়া আদালত হইতে আনিয়াছেন।”
“তাহা আমি জানি।”
“দেখিতেছি, আপনি সকলই জানেন। আমায় বলুন, আপনি কে?”
“কতবার বলিব? তোমার পিতার বাল্য-বন্ধু। তোমার বিপদাপদে কি তোমাকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য নহে?”
“আপনি না আসিলে আমার কি হইত জানি না।’
“ভাল লোকের সহায় ভগবান্।”
“যদিও আমি নিদোষী বলিয়া খালাস হইয়াছি, তবুও আমার মুখ দেখাইতে লজ্জা করিতেছে।”
“তোমার মনের অবস্থা আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি। যাহাতে প্রকৃত দোষী ধৃত হইয়া তোমার মান শতগুণে বৃদ্ধি পায়, এই চেষ্টায় আমি এখন ঘুরিতেছি। কোন ভয় নাই বাপু, একদিন দেখিবে, আমি সব কাজ হাঁসিল করিয়া ফেলিয়াছি।”
“আপনি ইচ্ছা করিলে অনায়াসে তাহা পারিবেন।”
“এইজন্য তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করিব। সময় কম, আমরা তৎপর না হইলে আমাদের কার্য্য পণ্ড হইতে পারে; এই জন্য আমি এখনই তোমার নিকট আসিয়াছি। গোপনে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব। সেইজন্য ফ্রামজীকেও এখান হইতে বিদায় করিয়া দিয়াছি।”
“ফ্ৰামজী আসিয়াছিল?”
“হাঁ, সে তোমার সহিত দেখা করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিল। আমি তাহাকে সন্ধ্যার সময় আসিতে বলিয়া দিয়াছি। মন্দ করিয়াছি কি?”
“আপনি যাহা ভাল বলিয়া বুঝিবেন, তাহাই ভাল, তবে তাহার সহিত দেখা করিবার জন্য আমার মনও বড় ব্যাকুল রহিয়াছে।”
“সন্ধ্যার সময় দেখা হইবে। আমার কথা এখন না হইলে, যে কাজে নিযুক্ত হইয়াছি, তাহাতে ব্যাঘাত পড়িতে পারে।”
“বলুন, কি জিজ্ঞাসা করিবেন।”
“তুমি আহারাদি করিয়া একটু বিশ্রাম করিয়া লও, আমি অপেক্ষা করিব।”
“আমার একেবারেই ক্ষুধা নাই। বিশ্রামের কোন আবশ্যকতা নাই। আপনি বলুন।”
“তোমাকে সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছিলাম, এখনও তাহাই জিজ্ঞাসা করিতেছি—সেই স্ত্রীলোকের সহিত•তোমার কি কথা হইয়াছিল, তাহাই আমি জানিতে চাই।”
“আপনি আমার অনেক করিয়াছেন, আপনার অনুরোধ রক্ষা না করা আমার পক্ষে অতিশয় অন্যায়। আমি আপনাকে মিনতি করিয়া বলিতেছি, আমাকে ক্ষমা করুন—আমি সে কথা কিছুতেই বলিতে পারিব না।”
“আচ্ছা তোমাকে বিবেচনার জন্য দশ মিনিট সময় দিলাম। নিজের কর্ত্তব্য ভাবিয়া দেখ।”
এই বলিয়া বৃদ্ধ চক্ষু মুদিত করিয়া চেয়ারে ঠেস দিয়া বসিলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – ইনি কি সৰ্ব্বজ্ঞ
ঠিক দশ মিনিট পরে চক্ষু মেলিয়া কাশীনাথ একদৃষ্টে রস্তমজীর দিকে চাহিলেন। রস্তমজী তাঁহার চোখের দিকে চাহিতে সাহসী না হইয়া অবনতমস্তকে বসিয়া রহিলেন।
তখন বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বলিলেন, “রস্তমজী, পূর্ব্বে তুমি সেই স্ত্রীলোকের ঠিকানা আমাদের কিছুতেই বল নাই। কিন্তু তুমি পাগলের ন্যায় আত্মহত্যা করিতে ইচ্ছা করিলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি কই?”
রস্তমজী বলিলেন, “আমি তা ত জানি। কিন্তু আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না, কেন আমি তাহার কথা আপনাকে বলিতে পারিতেছি না।”
কাশীনাথ হাসিয়া বলিলেন, “কিছু কিছু বুঝি। তুমি যে জন্য সে কথা বলিতেছে না—তাহা আমি জানি।”
রস্তমজী আশ্চর্যান্বিত হইয়া বৃদ্ধের মুখের দিকে চাহিলেন।
বৃদ্ধ কাশীনাথ বলিলেন, “যে খুন করিয়াছে, তুমি যাহাকে খুনী মনে কস্তিছ, তাহাও আমি জানি।”
রস্তমজী সবিস্ময়ে বলিলেন, “আপনি কি রূপে জানিলেন যে, আমি কাহাকে খুনী মনে করিতেছি?”
কাশীনাথ বলিলেন, “আমি অনেক কথা জানি। তুমি মনে করিয়াছ, হরমসঙ্গী খুন করিয়াছেন।” রস্তমজী অতিশয় বিস্মিত হইয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
কাশীনাথ বলিলেন, “দেখিতে পাইতেছ ত যে, আমি অনেক কথা জানি। আরও জানি, তুমি যে স্ত্রীলোককে দেখিতে গিয়াছিলে, তিনি হরমসজীর বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন।”
রস্তমজী এতই বিস্মিত হইয়াছিলেন যে, তাঁহার কণ্ঠ হইতে বাক্য নিঃসৃত হইল না। তিনি ব্যাকুলভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনি সৰ্ব্বজ্ঞ।”
কাশীনাথ বলিলেন, “শোন—শোন—এই স্ত্রীলোক পেষ্টনজীর রক্ষিতা ছিল। পেষ্টনজী রমসজীর নিকট টাকা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে এই স্ত্রীলোকের নিকট হইতে তাহাদের বিবাহের সার্টিফিকেট ভুলাইয়া লইয়াছিল।”
রস্তমজী অস্থিরভাবে বলিলেন, “তা হইলে আপনি ত সকলই জানেন। এখন বুঝিতেছি, আপনি সকলেই জানেন।”
“এখন কি সব কথা খুলিয়া উত্তর দিবে?”
“আপনি ত সকলই জানিয়াছেন, আর কি বলিবার আছে?”
“তোমার মনের ধারণা আমার অজ্ঞাত নহে। হরমসজী খুন করুন বা নাই করুন, তোমার একান্ত বিশ্বাস, তিনিই খুন করিয়াছেন। হায়, এমন নির্ব্বোধ তুমি, তাঁহার কন্যাকে তুমি ভালবাস বলিয়া এমন একটা খুনের অপরাধ ঘাড়ে লইয়া নিজের অমূল্য জীবনটা ফাঁসীর দড়ীতে নষ্ট করিতে বসিয়াছিলে।”
“আপনি সত্যই বলিতেছেন। আমার বিশ্বাস, সার্টিফিকেটের জন্য হরমসজীই পেষ্টনজীকে খুন করিয়াছেন—আর কে করিবে? আর কে তাহার বুক হইতে সার্টিফিকেট লইবার জন্য তাহাকে খুন করিবে? আর কে সার্টিফিকেটের কথা জানিবে?”
“সেই কথাই এখন জিজ্ঞাস্য-কে পেষ্টনজীকে খুন করিল! সার্টিফিকেটের খবর আর কাহারও পাওয়া কি শক্ত। এই ত আমরা জানিতে পারিয়াছি।”
“সম্ভব, কিন্তু সেই স্ত্রীলোক বলিয়াছিলেন যে, এ কথা তিনি আর কাহাকেও বলেন নাই।”
“তিনি না বলিতে পারেন, কিন্তু পেষ্টনজী ত বলিতে পারে। এই দেখ না কেন, সিন্দুক খুলিবার গুপ্ত সঙ্কেত তুমি আর হরমসজী ব্যতীত আর কেহ জানিত না, তবুও অপরে জানিয়াছিল।”
“সে কথা সত্য, আমি ইহার কারণ কিছুই বুঝিতে পারি নাই।”
“এ বিষয় পরে আলোচনা করিব, এখন এই স্ত্রীলোক সম্বন্ধে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তিনি যাহা কিছু বলিয়াছিলেন, তাহাই আমি জানিতে চাই। ইহাতে চোর ও খুনী উভয়েই শীঘ্র ধৃত হইবে।”
“যখন আপনি সকলই জানিয়াছেন, তখন আর আপনাকে বলিতে আপত্তি কি?”
“হাঁ, আমি আগাগোড়া সব শুনিতে চাই।”
“তবে শুনুন, সকলই বলিতেছি।”
বৃদ্ধ চেয়ারে ঠেসান দিয়া বসিলেন। রস্তমজী আনুপূর্বিক সমস্ত বত্তান্ত বলিয়া যাইতে লাগিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – পাপের ফল
রস্তমজী বলিলেন, “আপনি ত জানেন যে, পেষ্টনজীর খুনের রাত্রে আমার সহিত কমলা বাঈএর দেখা হয়। আমি এফিনষ্টোন সার্কেল হইতে বাহির হইলে একটা বালক আমার হাতে একখানা চিঠী দেয়।”
“তুমি কি তখনই সেই স্ত্রীলোকটির সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলে?”
“হাঁ, স্ত্রীলোকটি মৃত্যু-শয্যায়—দেরী হইলে হয় ত তাঁহার সঙ্গে আর দেখা হইবে না, ভাবিয়া আমি অতি সত্বরপদে যাইতেছিলাম।”
“হঠাৎ পেষ্টনজীর সঙ্গে দেখা হয়?”
“হাঁ, সে ভয়ানক মাতাল হইয়াছে দেখিয়া, আমি একখানা গাড়ীতে তাহাকে তুলিয়া দিয়া সত্বর পাইদুনির দিকে চলিয়া যাই।”
“তাহার পর আর সেদিকে ফিরিয়া দেখ নাই?”
“না।”
“তার পর?”
“তার পর পাইদুনির ‘চলে’ গিয়া সেই স্ত্রীলোকটির সঙ্গে দেখা করি।”
“তখন তাহার অবস্থা কিরূপ?”
রস্তমজী বলিতে লাগিলেন, “আমি গিয়া দেখিলাম যে, তাঁহার অন্তিম কাল উপস্থিত। তিনি আমাকে দ্বার বন্ধ করিয়া দিতে ইঙ্গিত করিলেন। আমি দ্বার বন্ধ করিয়া দিলাম। তিনি আমাকে নিকটে বসিতে ইঙ্গিত করিলেন। আমি ইতস্ততঃ করিতেছি দেখিয়া, তিনি বিষণ্ণ হাসি হাসিয়া অতি অস্পষ্টস্বরে বলিলেন, ‘পূর্ব্বে আমার এমন অবস্থা ছিল না—বসো।’ আমি দেখিলাম, স্ত্রীলোকটির যথার্থই বড় দুৰ্দ্দশা হইয়াছে। একখানা ছেঁড়া কাপড়ের উপর পড়িয়া আছেন। ঘরে আসবাবের মধ্যে একটা ভাঙা টিনের বাক্স। ঘরের কোণে একটি কেরোসিনের ল্যাম্প মিট্ মিট্ করিয়া জ্বলিতেছিল। আমি বসিলাম। তিনি যাহা আমাকে বলিয়াছিলেন, সংক্ষেপে আমি আপনকে তাহাই বলিতেছি। হরমসজী তাঁহার স্বামী—তাহা তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন। তিনি বলিলেন, যখন তাঁহার বয়স পনের ষোল বৎসর, তখন তাঁহার সহিত হরমসজীর পরিচয় হয়। হরমসজী তাঁহাকে ভালবাসিয়াছিলেন, তিনিও হরমসজীকে ভালবাসিতেন। তাঁহার মাতার চরিত্র অতিশয় খারাপ ছিল, সুতরাং তাঁহাকে বিবাহ করিলে লোকসমাজে মুখ দেখাইতে পারিবেন না বলিয়া হরমসজী বিবাহে ইতস্ততঃ করিতে থাকেন; কিন্তু তিনি পীড়াপীড়ি করায় হরমসজী গোপনে তাঁহাকে বিবাহ করেন। তখন হরমসঙ্গীর অবস্থা ভাল ছিল না। তাঁহার অবস্থা একটু ভাল হইলেই বিবাহের কথা সকলকে বলিবেন, এইরূপ বলেন। অর্থ উপার্জ্জনের চেষ্টায় হরমসজী বোম্বে আসেন। তিনি সুরাটেই থাকিতেন। দুই বৎসর যাইতে-না-যাইতে তাঁহার এক কন্যা হয়, কিন্তু সেই কন্যা হওয়ায় হরমসজী আরও বিভ্রাটে পড়িলেন। এই সময়ে এক ব্যক্তির সহিত সেই স্ত্রীলোকের পরিচয় হইয়াছিল। তখন তিনি কন্যাটিকে লইয়া বাড়ীর বাহির হইয়া যান। আর কখনও হরমসজীকে নিজের কোন সংবাদ দেন নাই। নানা স্থানে নানা ভাবে থাকিয়া অবশেষে বোম্বেতে একটি স্ত্রীলোকের নিকটে কন্যাকে দিয়া আর একজন লোকের সহিত কলিকাতায় চলিয়া যান।”
কাশীনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “মেয়েটিকে যে স্ত্রীলোকের নিকটে রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহার নাম কি তিনি তোমায় বলিয়াছিলেন?”
রস্তমজী বলিলেন, “বোধ হয় বলিয়াছিলেন, এখন ঠিক মনে হইতেছে না।”
কাশীনাথ বলিলেন, “মনে করিয়া দেখ।”
রস্তমজী ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিলেন, “হাঁ, মনে হইয়াছে। তিনি শেষে আমার হাত ধরিয়া এক টুক্রা কাগজ দিয়া বলিয়াছিলেন, ‘আমি মেয়েকে যাহার নিকট রাখিয়াছি, এই কাগজে তাহার নাম ঠিকানা আছে। কিন্তু যে ঠিকানা আছে, সেখানে তাহারা এখন নাই, আমি নেক চেষ্টা করিয়াছিলাম, কোন সন্ধান পাই নাই। এখন আমার কাছে শপথ কর যে, তুমি তাহার অনুসন্ধান করিবে। তাহার অবস্থাও নিশ্চয়ই আমার মত হইয়াছে, তোমার অন্তঃকরণ মহৎ—যদি কখনও তাহার সন্ধান পাও, তাহাকে আশ্রয় দিয়ো।”
কাশীনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে কাগজ কই?”
রক্তমজী উঠিয়া একটা টেবিলের ড্রয়ারের মধ্য হইতে এক টুক্রা কাগজ খুঁজিয়া বাহির করিলেন। কাশীনাথ দেখিলেন, তাহাতে কেবল মাত্র লেখা আছে;—
“পাৰ্ব্বতীবাঈ—ডনকান রোডের ৭নং চল। আমার মেয়ের নাম বেলাবাঈ।”
কাশীনাথ কাগজখানি লইয়া বহুক্ষণ নাড়াচাড়া করিলেন। তৎপরে ধীরে ধীরে বলিলেন,
“এ মেয়ের সম্বন্ধে তিনি আর কিছু বলিয়াছিলেন?”
রস্তমজী বলিলেন, “আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম যে, আমি তাঁহার মেয়েকে কিরূপে চিনিব। তাহাতে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘সে বড়ই সুন্দরী, তেমন সুন্দরী আর কেহ নাই। আরও চিনিবার উপায় আছে, আমি রাক্ষসী—একদিন সে বড়, দৌরাত্ম্য করায় একখানা হাতা গরম করিয়া তাহার বাম উরুতে ধরিয়াছিলাম। সে পোড়া দাগ এখনও আছে।”
কাশীনাথ বলিলেন, “রস্তমজী দেখিতেছ, মানুষ কতদূর নৃশংস জীবও হইতে পারে।” রস্তমজী বলিলেন, “সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তও তাঁহার যথেষ্ট হইয়াছিল। আমি যে অবস্থায় তাঁহাকে দেখিয়াছিলাম, কুকুর শিয়ালও বোধ হয়, তেমন অবস্থায়, তেমন কষ্টে মরে না।”
কাশীনাথ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “পাপের প্রতিফল এ সংসারে আছেই।” নানা ভাবে উভয়েরই হৃদয় পূর্ণ হইল। তাঁহারা বহুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ইহা কি সত্য?
অনেকক্ষণ পরে বৃদ্ধ কাশীনাথ প্রথমে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিলেন। বলিলেন, “পেষ্টনজী ‘সম্বন্ধে তিনি কি বলিয়াছিলেন?”
রস্তমজী বলিলেন, “হাঁ, শেষে তিনি পেষ্টনজীর নিকটে ছিলেন। পেষ্টনজী তাঁহার নিকট তাঁহার বিবাহের কথা শুনিয়াছিল। এই সময়ে জুয়াখেলায় পেষ্টনজী সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। হরমসঙ্গী যে খুব বড় লোক হইয়াছিলেন, তাহা সে জানিত। তাহাই অনেক বলিয়া কহিয়া সে সেই স্ত্রীলোকের নিকট হইতে· সার্টিফিকেট দুইখানি ভুলাইয়া লইয়া বোম্বে আসে। অনেক দিন তাঁহার কোন সন্ধান না পাইয়া, স্ত্রীলোকটিও বোম্বে আসিয়া পেষ্টনজীর সঙ্গে দেখা করেন। পেষ্টনজী তাঁহাকে প্রথমে প্রায় উড়াইয়াই দিয়াছিল, কিন্তু পাছে তিনি হরমসজীকে সকল কথা বলিয়া দেন, এই ভয়ে তাঁহাকে নানা কথা বলিয়া ভুলাইয়া রাখিতেছিল। কিন্তু এক পয়সা দিয়া ও সাহায্য করে নাই। পেষ্টনজীর এইরূপ ব্যবহারে আর নিতান্ত কষ্টে পড়িয়া স্ত্রীলোকটার অনুতাপের উদয় হয়, তিনি তখন হরমসজীকে সকল কথা প্রকাশ করিয়া বলিবেন স্থির করিয়াছিলেন; কিন্তু সাহস করিয়া কিছুই বলিতে পারেন নাই। এই সময়ে তিনি পীড়িতা হইয়া পড়েন। তিনি আমার কথা শুনিয়াছিলেন। আমার সহিত যে কমলার বিবাহ হইবার কথা আছে, তাহাও জানিতে পারিয়াছিলেন, তাহাই যখন বুঝিলেন যে, তাঁহার আর বাঁচিবার সম্ভাবনা নাই, তখন তিনি বাড়ীর একটি স্ত্রীলোককে অনেক বলিয়া-কহিয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দেন। তাহার পর যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা আপনি অবগত আছেন।”
কাশীনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখানে পেষ্টনজীর সঙ্গে যে বর্জরজীর আলাপ-পরিচয় হইয়াছিল, তাহা তিনি তোমাকে কিছুই বলেন নাই?”
রস্তমজী বলিলেন, “না, তবে পেষ্টনজীর সঙ্গে যে বর্জরজীর খুব আলাপ পরিচয় হইয়াছিল, তাহা ত আমি জানি।”
“কি রকমে?”
“হরমসজীর বাড়ীতেই ইহাদের সহিত আমার পরিচয় হয়। পেষ্টনজী ও বর্জরজী ত প্রত্যহই হরমসজীর বাড়ীতে যাইত।”
“উভয়ে খুব প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয়?”
“না, পেষ্টনজী বর্জরজীর অসাক্ষাতে তাহার খুব নিন্দা করিত।”
“পেষ্টনী সময়ে সময়ে খুব মাতাল হইত, না?”
“প্রায়ই।”
“বর্জরজী কি জন্য বোম্বে এসেছে, তাহা তুমি জান না?”
“কিরূপে জানিব?”
“আমি জানি। তাহার বড় ভাই-এর সহিত হরমসজীর স্ত্রী রাজাবাঈ-এর বিবাহের পূর্ব্বে গুপ্ত প্রণয় ছিল।”
“মিথ্যাকথা। তাঁহার ন্যায় সচ্চরিত্রা স্ত্রীলোক বোম্বে সহরে নাই।”
“তাহা আমি জানি। বিবাহের পর হইতে রাজাবাঈ খুব ভাল। তাঁহার ন্যায় পতিব্রতা স্ত্রীলোক অল্পই আছে।”
“আমি তাঁহাকে খুব ভাল জানি।”
“ছেলেবেলায় ভুল অনেকেই করে। যাহা হউক তাহার জন্য রাজাবাঈকে এখন কেহ কুলটা বলিবে না।”
“আপনি আমার পিতৃবন্ধু—পিতৃতুল্য। আপনি বলিতেছেন, সুতরাং আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইতেছে। অন্য কেহ হইলে সহ্য করিতাম না।”
“সত্য কথা আর মূল বৃত্তান্ত শুনিতে যদি তোমার আপত্তি থাকে, তবে বলিব না—এই পর্যন্ত থাক্; কিন্তু তোমার শোনা উচিত,” বলিয়া কাশীনাথ উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
রস্তমজী ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “রাগ করিবেন না। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা আমার বিশ্বাস হয় না।”
কাশীনাথ বলিলেন, “বিশ্বাস করা না করা সে তোমার ইচ্ছা। তোমারই নির্দোষতা সপ্ৰমাণ করিবার জন্য অনেক স্থানে ঘুরিয়া দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া অনেক কষ্টে এই সকল তথ্য সংগ্রহ করিতে হইতেছে। তবে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, এই পর্য্যন্ত জানি যে, বর্জরজী মাঞ্চারজীকে সঙ্গে করিয়া হরমসজীর টাকা আত্মসাৎ করিবার জন্য বোম্বে আসিয়াছে। রাজা বাঈকে পূর্ব্বকথা প্রকাশ করিয়া দিব বলিয়া ভয় দেখাইয়াছে। তাঁহার নিকট হইতে ভয় দেখাইয়া অনেক টাকা লইয়াছে—এখনও লইতেছে। ইহার ভিতর আরও অনেক গুপ্তরহস্য আছে।”
কাশীনাথ নীরব হইলেন, নীরবে রস্তমজীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। রস্তমজীও কোন কথা কহিতে পারিলেন না—অবাঙ্মুখে ভূমি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।
তখন কাশীনাথ বলিলেন, “এমন কি তাঁহার নিকট হইতে এই দুই জনে তাঁহার বহুমূল্য গহনাগুলি লইয়া গণেশ মলের গদীতে বাঁধা দিয়া টাকা লইয়াছে; সেই টাকাই আবার হরমসজীর ব্যাঙ্কে জমা রাখিয়াছিল। এ বৃদ্ধ বয়সে আমার যদি মাথার মধ্যে বুদ্ধি নামক পদার্থের এক বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট থাকে, তবে ইহাও বলিতে পারি যে, তুমি যে টাকা সিন্দুকে রাখিয়াছিলে, সেই টাকা তাহারাই লইয়াছে।”
রস্তমজী নিতান্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন, “আপনি বলেন কি!”
কাশীনাথ বলিলেন,”ঠিকই বলি। তাহার পর রাজাবাঈ-এর হাতে এক পয়সা নাই দেখিয়া হরমসজীকে হাত করিবার চেষ্টায় আছে।”
রস্তমজী কঠিনকণ্ঠে বলিলেন, “এই দুরাত্মারা আরও কি করিবে!”
কাশীনাথ বলিলেন, “কমলা বাঈকে বিবাহ করিবে।”
রস্তমজী লম্ফ দিয়া উঠিলেন। কাশীনাথ বলিলেন, “সেই জন্যই বলিতেছিলাম যে, যাহাতে এই দুরাত্মারা আর অধিক অনিষ্ট করিতে না পারে, যাহাতে সমুচিত দণ্ড হয়, তাহা করিতে হইবে।”
এই বলিয়া কাশীনাথ ধীরে ধীরে ঘরের বাহির হইয়া গেলেন। রস্তমজী হতাশহৃদয়ে, ঘুর্ণিতমস্তকে চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – “হা সয়তানী, তোর এই কাজ!”
পূর্ব্বোক্ত ঘটনার, দুই দিবস পরে। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। সহরের সর্ব্বত্র শান্তি বিরাজ করিতেছে, কেবল পল্লবান্তরালবর্ত্তী বায়ুর শন্ শন্ শব্দ শ্রুত হইতেছে। মনে হয় মাতা যেমন রোরুদ্যমান দুরন্ত শিশু সন্তানকে অপনার বক্ষে স্নেহভরে চাপিয়া ধরিয়া সান্ত্বনার গান গাইয়া চুপ করাইয়া থাকে তেমনই নিস্তব্ধতা সহরের কোলাহলকে আপনার প্রশান্ত বক্ষে ঢাকিয়া লইয়া একটা মৃদুমধুর গান ধরিয়াছে।
রস্তমজী নিজ শয়ন কক্ষে নিদ্রিত। বাহির হইতে দ্বারে উপর্যুপরি করাঘাতের শুনিয়া তিনি সবিস্ময়ে জাগিয়া উঠিলেন। জড়িতকণ্ঠে বলিলেন, “কে ও?”
বাহির হইতে উত্তর হইল, “আমি কাশীনাথ, দ্বার খুলিয়া দাও।”
শশব্যস্তে উঠিয়া দ্বার খুলিতে খুলিতে রস্তমজী বলিলেন, “এত রাত্রে?”
কাশীনাথ কক্ষে পদার্পণ করিয়াই বলিলেন, “কাজ আছে—শীঘ্র পোষাক করিয়া লও। বাহিরে যাইতে হইবে।”
রস্তমজী বলিলেন, “কি মুস্কিল, এত রাত্রে! কি ব্যাপার—কোথায় যাইতে হইবে?” কাশীনাঞ্জ বিরক্তভাবে বলিলেন, “দূর হউক, যাহা বলিতেছি, আগে কর—জামাটা শীঘ্র গায়ে দিয়া লও—পথে সকলই শুনিতে পাইবে, এখন একটা মিনিট নষ্ট করিবার সময় আমার নাই।”
রস্তমজী একটা কোট লইয়া গায়ে দিলেন; কাশীনাথ তাঁহার হাত ধরিয়া টানিয়া সেখান হইতে দ্রুতপদে বাহির হইয়া পড়িলেন। বাহিরে একখানা ভাড়াটীয়া গাড়ী অপেক্ষায় ছিল, তন্মধ্যে উভয়ে উঠিয়া বসিলেন। কাশীনাথ কোচম্যানকে বলিলেন, “দ্বিগুণ জোরে হাঁকাইয়া যাও, দ্বিগুণ ভাড়া পাইবে।”
গাড়ী দ্বিগুণ বেগে ছুটিল, এবং অনতিবিলম্বে নির্দিষ্ট স্থানে আসিয়া পড়িল। কাশীনাথ নায়েক ও রস্তমজী তাড়াতাড়ি গাড়ী হইতে নামিয়া পড়িলেন। কাশীনাথ কোচম্যানকে ভাড়া দিয়া বলিলেন, “আধ ঘণ্টা এখানে অপেক্ষা করিবে; যদি আমরা আধ ঘণ্টার মধ্যে আসিয়া পড়ি ভালই। নতুবা তুমি গাড়ী লইয়া চলিয়া যাইয়ো।”
প্রচুর ভাড়া পাইয়া কোচম্যান অত্যন্ত খুসী হইয়া দুই-তিনটি সেলাম দিল।
কাশীনাথ এবং রস্তমজী কিছুদূর অগ্রসর হইয়া একটা সঙ্কীর্ণ পথিমধ্যে প্রবেশ করিলেন। বায়ু বড় শীতল এবং প্রবল। পূর্ব্বে একবার খুব এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছিল। রাস্তার অবস্থাও ভাল নহে—স্থানে স্থানে কদমিত। আকাশও এখনও ভাল পরিস্কার হয় নাই—মেঘ জমিয়া আছে এবং অন্ধকার বিশ্বব্যাপী। বিদ্যুতের তীক্ষ্ণ দীপ্তিতে সেই বিরাট অন্ধকারের বিশাল বক্ষ বারংবার বিদীর্ণ হইতেছিল। অতিকষ্টে দুইজনে সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্য দিয়া কদমাক্ত পথ অতিক্রম করিতে লাগিলেন। কিছুদূরে আসিয়া রস্তমজী বলিলেন, “এ স্থান আমার পরিচিত। তাহার পর পার্শ্বস্থিত উদ্যান-বাটীকার দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া বলিলেন, “এইখানে মাঞ্চারজী থাকেন।”
কাশীনাথ কোন কথা কহিলেন না; নীরবে চলিতে লাগিলেন। তাহার পর সেই উদ্যান-বাটীর গেটের সম্মুখে আসিয়া দেখিলেন, সেখানে একখানা গাড়ী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। সেখানিও ভাড়াটীয়া গাড়ী। কোচম্যান শীতল বায়ু হইতে আত্মরক্ষার্থ গাড়ীর ভিতরে অর্দ্ধশায়িত অবস্থায় অবস্থান করিতেছে। বিদ্যুতের আলোকে কাশীনাথ দেখিলেন, কোচ্ম্যান নিদ্রিত।
কাশীনাথ তাহার নিকটে গিয়া বলিলেন, “বড় আরামে বেজায় ঘুমাইতেছ যে।”
কোচম্যানের এইমাত্র নিদ্ৰাকৰ্ষণ হইয়াছিল। তখনই সে ভাল হইয়া উঠিয়া বসিল। তেমন সময়ে সেই নিৰ্জ্জনস্থানে দুইজন লোককে গাড়ীর দ্বার সম্মুখে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া তাঁহার মনে বড় ভয় হইল, সে তাড়াতাড়ি নিজের পকেটের ভিতরে হাত পুরিল, দেখিল, পরিপূর্ণ — কিছুই স্থানান্তরিত হয় নাই। সে বিরক্তভাবে বলিল, “আমার লোক আছে, আমি ভাড়া যাইতে পারিব না।”
কাশীনাথ বলিলেন, “তা আমি জানি। তবে বাপু, আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই; তুমি যে লোককে ভাড়া আনিয়াছ, সে মধ্যবয়সী স্ত্রীলোক কি না বল দেখি সত্যকথা বলিলে এখনই পাঁচটাকা বক্শিস পাইবে।”
বক্সীশের নাম শুনিয়া কোম্যানের আরও ভয় হইল। তাঁহাদের দুজনকে গুণ্ডা বলিয়াই তাহার দৃঢ় প্রতীতি হইল। সে বলিল, “কেন গোলমাল করছ, আমার ভাড়া আছে, শীঘ্র চলে যাও—যদি না যাও, আমি এখনই লোকজন ডাকিব।”
কাশীনাথ রস্তমজীর হাত ধরিয়া, টানিয়া লইয়া সেখান হইতে আরও কিছুদূর অগ্রসর হইলেন। বলিলেন, “বেটা পাজী—গোলমাল করিতে পারে, গেট দিয়া যখন ভিতরে যাইতে পারিলাম না, তখন অন্য কোন উপায় অবলম্বন করিতে হইবে।”
চারিদিকে উচ্চ প্রাচীর—অনেক কষ্টে কাশীনাথ প্রাচীরের উপরে উঠিলেন। তাহার পর রস্তমজী উঠিলেন। এবং উভয়ে ভিতর দিয়ে লাফাইয়া পড়িলেন। প্রকাণ্ড উদ্যান, চারিদিকে বড় বড় গাছ, অন্ধকারে বিকটাকৃতি দৈত্যের ন্যায় দাঁড়াইয়া আছে। উদ্যানের মধ্যস্থলে একখানি অনতিপ্রশস্ত দ্বিতল বাটী। সেই বাটীর দ্বিতলস্থ কোন কক্ষের একমাত্র উন্মুক্ত গবাক্ষে আলো দেখা যাইতেছে।
কাশীনাথ সমুলে বিশেষ মনোযোগের সহিত নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, “তুমি বাপু এখানে অনেকবার আসিয়াছ—এখানকার বিষয় তুমি বেশ জান; বল দেখি, দ্বিতলে যে ঘরে আলো জ্বলিতেছে, ওখানে কে থাকে?”
“উহা মাঞ্চারজীর শয়ন-কক্ষ।”
“বটে—আর নীচের ঘরগুলিতে কি হয়?”
“নীচের ঘরগুলিতে রন্ধন স্নান-আহারাদি হয়।”
“চাকরেরা কোন্ ঘরে থাকে?”
‘মাঞ্চারজী, চাকর-বাকর বড় রাখে না, দুই একজন ঠিকা চাকর আছে, তাহারা কাজ করিয়া চলিয়া যায়।”
“তবে ত বেশ সুবিধাই হইয়াছে, গোপনে বাড়ীর ভিতরে সহজেই ঢুকিতে পারা যাইবে। একজন স্ত্রীলোক মাঞ্চারজীর সহিত এই রাত্রে দেখা করিতে আসিয়াছে, তাহার অভিসন্ধিটা কি গোপনে থাকিয়া জানিতে হইবে।”
সন্ধিগ্ধভাবে রস্তমজী বলিলেন, “আমাদের ইহা দেখা অত্যন্ত গর্হিত কাৰ্য্য।”
সন্দেহ নাই,” কাশীনাথ রস্তমজীর মুখ হতে কথাটা যেন লুফিয়া লইয়া বলিলেন; “হা আমার দুরদৃষ্ট! তুমি কি মনে করিয়াছ, এই মধুর রজনীতে এই মধুর বায়ুসেবনের জন্য আমরা ভ্রমণে বাহির হইয়াছি? দুই-একটা গর্হিত কাজও করিতে হইবে।”
“কিন্তু কেহ যদি আমাদিগকে দেখিতে পায়?”
“দেখিতে পায়—ক্ষতি কি? তুমি সরাসর মাঞ্চারজীর সম্মুখে চলিয়া যাইবে, বন্ধু বন্ধুর সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে, ইহাতে দোষাবহ কিছুই নয়।”
উভয়ে বাটীর দ্বারসম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। দ্বার ভিতর হইতে রুদ্ধ। পরে জানালাগুলি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, সেগুলিও ভিতর হইতে রুদ্ধ। এই সময়ে আবার ভয়ানক বেগে বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। কাশীনাথ মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন; রস্তমজীকে টানিয়া লইয়া সেখান হইতে ফিরিলেন। এখনও মাঞ্চারজীর শয়ন কক্ষে আলো জ্বলিতেছে। গবাক্ষের রেশমী পর্দ্দায় দুই-একবার মনুষ্যের ছায়াও পড়িতে দেখা গেল। মাঞ্চারজী জাগ্রত সন্দেহ নাই। কাশীনাথের কৌতূহল চরমসীমা অতিক্রম করিয়া উঠিল। কাশীনাথ আপন মনে বলিয়া উঠিলেন, “ঘরের ভিতরে কি হইতেছ, যদি কোন রকমে দেখিতে পাওয়া যাইত, তাহা হইলে রহস্যটা অনেক তরল হইয়া আসিত; কিন্তু উপায় নাই—অনেক উচ্চে অভিনয়টা চলিতেছে। আর আমরা বাইশ হাত নীচে পড়িয়া রহিয়াছি—আচ্ছা দেখা যাক!”
এই বলিয়া কাশীনাথ উদ্যান বেড়িয়া ঘুরিতে লাগিলেন। রস্তমজী তাঁহার কাণ্ডকারখানা দেখিয়া অবাক্ হইয়া গেলেন। কাশীনাথের যেন ইহা নিজের বাড়ী — যেখানে-সেখানে যাইতেছেন, এটা-ওটা টানিতেছেন; পরের বাড়ীতে এমনভাবে এরূপ সময়ে প্রবেশ করিয়া যতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, তাহার কিছুই দেখিলেন না—কোনদিকেই ভ্রূক্ষেপ নাই। এদিকে সবেগে দমকা বাতাসে বৃষ্টির ঝাপ্টা আসিয়া চোখে মুখে লাগিতেছে—সেদিকেও কাশীনাথের লক্ষ্য নাই—তিনি কোন রকমে ভিতর প্রবেশ করিয়া, জল কাদা ভাঙ্গিয়া চারিদিকে ব্যাকুলভাবে ঘুরিতে লাগিলেন। রস্তমজীও তাঁহার অনুসরণ করিতে লাগিলেন।
কাশীনাথ বলিলেন, “কোন রকমে গবাক্ষে উঠিতে হইবে—উঠা চাইই।”
হঠাৎ একটা কথা রস্তমজীর মনে পড়িয়া গেল, তিনি বলিলেন, “এই বাগানে একখানা কাঠের সিঁড়ী পড়িয়া আছে।”
“কি আশ্চর্য্য! এতক্ষণে ইহা বল নাই কেন? কোথায় সে সিঁড়ী?”
“বাগানের উত্তর প্রান্তে একটা গাছের তলায় পড়িয়া আছে।”
উভয়ে সেইদিকে ছুটিয়া চলিলেন; অনতিবিলম্বে সেই সিঁড়ী মাঞ্চারজীর শয়ন কক্ষের সেই উচ্চ গবাক্ষের নিম্নে সংলগ্ন হইল। কিন্তু গবাক্ষ হইতে সেই সিঁড়ীর অগ্রভাগ প্রায় চারিহাত নিম্নে রহিল। রস্তমজী বলিলেন, “সিঁড়ীটা ছোট, ইহাতে কোন কাজ হইবে না।”
“কেন হইবে না,” মহা উৎসাহের সহিত কাশীনাথ বলিয়া উঠিলেন, “নিশ্চয়ই হইবে, বলিয়াই গৃহ-প্রাচীর হইতে কাশীনাথ দুই হাত তফাতে দাঁড়াইয়া সেই সিঁড়ীটা নিজের স্কন্ধে তুলিয়া ধরিলেন। বলিলেন, “এইবার তুমি উঠিয়া পড়।”
রস্তমজী বিনা বাক্যব্যয়ে সিঁড়ীতে উঠিতে লাগিলেন; তাঁহারও হৃদয় উৎসাহ এবং কৌতূহলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি সেই উন্মুক্ত গবাক্ষের নিকটে মুখ লইয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার মাথা ঘুরিয়া গেল—দেহের সমস্ত শিরা শূন্য করিয়া প্রবলবেগে রক্ত ছুটিয়া বুকের মধ্যে জমাট বাঁধিয়া গেল। তিনি জড়িতকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “হা সয়তানি, তোর এই কাজ!” ঝড়বৃষ্টিতে তাঁহার কণ্ঠস্বর ডুবিয়া গেল! তিনিও পরক্ষণে কাঁপিতে কাঁপিতে বৃক্ষচ্যুত শাখার ন্যায় ভূতলে পড়িয়া গেলেন।
কাশীনাথ তাড়াতাড়ি সিঁড়ীখানা নামাইয়া রস্তমজীকে তুলিতে গেলেন। তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন, “কি দেখিলে—ব্যাপার কি? বেশী আঘাত লাগিয়াছে কি?”
রস্তমজী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। যদিও তিনি অনেক উচ্চ স্থান হইতে পড়িয়াছিলেন, কিন্তু কোন গুরুতর আঘাত লাগে নাই। যে আঘাত লাগিয়াছিল, তাহা রস্তমজীর তখন ভ্রূক্ষেপেই আসিল না। মনের যখন শোচনীয় অবস্থা, তখন স্বভাবতই শারীরিক যন্ত্রণার দিকে কাহারও লক্ষ্য থাকে না। ভগ্নকন্ঠে রস্তমজী বলিতে লাগিলেন, “কি দেখিয়াছি—যাহা স্বপ্নেও ভাবি নাই— কমলাবাঈকে দেখিলাম! বুঝিয়াছেন, কমলাবাঈ—পিশাচী—মাঞ্চারজীর শয়ন-কক্ষে—এই রাত্রে বিলাসী মাঞ্চারজীর সহিত—” আর বলিতে পারিলেন না—তাঁহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া গেল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ – সত্য না স্বপ্ন?
কাশীনাথের মনেও বড় গোলযোগ বাঁধিয়া গেল। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, “তবে কি আমারই ভ্রম হইল? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রাজাবাঈই হইবেন—তাই ত কমলা এখানে এমন সময়ে কেন?” তিনি রস্তমজীকে বলিলেন, “রস্তমজী, তোমার ভুল হইয়াছে।”
রস্তমজী অত্যন্ত বেগের সহিত কহিলেন, “না মহাশয়, অন্য অনেক বিষয়ে আমার ভ্রম হইতে পারে, কিন্তু অন্য কাহাকেও কমলাবাঈ বলিয়া আমার ভ্রম হইতে পারে না। সেদিন আপনি ইহাকে কিরূপ ভাবে দেখিয়াছেন, বেশ মনে আছে; এখন বলুন দেখি, সেই কমলা বাঈ কি বিশ্বাসঘাতিনী!” বলিয়া বিস্ফারিতনেত্রে রস্তমজী কাশীনাথের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
কাশীনাথ তাঁহার মনের শোচনীয় অবস্থা বুঝিতে পারিলেন; কোন উত্তর করিতে পারিলেন না। নিজের ভ্রমে তাঁহারও মনের অবস্থা বিগড়াইয়া গিয়াছিল। তিনি মুহূর্ত মধ্যে সহস্রবার ভাবিলেন, কমলাবাঈ এখানে এমন সময়ে কেন? কোন একটা সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সহসা একটা কথা তাঁহার মনে উদয় হইল, তাহাই কি ঠিক নহে?
কাশীনাথকে নিরুত্তর দেখিয়া রস্তমজী সেইরূপভাবে বলিতে লাগিলেন, “হায়, মুহূর্ত্ত পূর্ব্বে এই কমলাবাঈকে আমি কত সরল, কত পবিত্র মনে করিয়াছি, স্বর্গের দেবী অপেক্ষাও তাহাকে উচ্চ আসন দিয়াছি—তাহার এই কাজ! সে কি না একজন লম্পটের উপভোগ্যা। হায় নারী, একান্ত নির্ব্বোধেরাই তোমাদের উপরে একান্ত বিশ্বাস স্থাপন করিয়া থাকে! তোমরা পিশাচী, তোমাদের অসাধ্য কৰ্ম্ম এ জগতে কিছুই নাই। হায়! একজন পিশাচীর উপরে নির্ভর করিয়া আমি পূর্ব্বে আকাশ দুর্গ নির্ম্মাণ করিয়াছিলাম, এক ফুৎকারে নিমেষের মধ্যে তাহা চূর্ণ হইয়া গেল! আর মাঞ্চারজী—তাহাকে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু বলিয়াই জানিতাম—সে এখন কমলার জার—এখন হয়ত দুজনে আমারই অন্ধবিশ্বাস ও দুর্ভাগ্য লইয়া হাস্য-পরিহাসে মত্ত—আর আমি এই নিৰ্জ্জনে হস্তপদবদ্ধ মূকের ন্যায় নিয়তির কঠিন পীড়নে নিষ্পেষিত হইতেছি! আমাকেও ধিক্! এ জগতে কাহাকেও বিশ্বাস করিতে নাই—বিশ্বাঘাতকতার বাঁকা বিষমাখা ছুরি সর্ব্বত্র উদ্যত!” মনের আবেগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ায় তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া গেল। কাহারও গৰ্ব্বে আঘাত লাগিলে মানুষকে এইরূপ উন্মত্ত করিয়া তুলে—ইহার উপর রস্তমজী প্রবঞ্চিত। রস্তমজী বলিলেন, “এ পর্যন্ত অনেক সহ্য করিয়াছি; ইহা একান্তই অসহ্য—এখানে দাঁড়াইয়া নিজের অদৃষ্টের উপর দোষারোপ করা ভীরু কাপুরুষের কর্ম্ম! আমি উভয়কেই এখনই পাপের উপযুক্ত প্রতিফল দিব।”
এই বলিয়া রস্তমজী উন্মত্তবেগে দ্বারের দিকে ছুটিলেন। কাশীনাথ তাঁহার হাত টানিয়া ধরিয়া বলিলেন, “তুমি এখন কি করিতে চাও?”
রস্তমজী দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “পিশাচ আর পিশাচীর রক্ত দর্শন; আমি এখনই দ্বার ভাঙিয়া উপরে উঠিব—নিন্দা গোলযোগে আর আমার ভয় নাই—আর কিছুতেই আমার কোন ক্ষতি হইবে না। কাপুরুষের মত অতি গুপ্তভাবে কোন কাজ করিতে চাই না, এ কলঙ্ক ধৌতের জন্য যাহা আবশ্যক—তাহা প্রকাশ্যেই করিব।”
কাশীনাথ বলিলেন, “তুমি যাহা মনে করিতেছ, তাহা করিতে পাইবে না।”
“কে আমায় বাধা দিবে?”
“আমি।”
“আপনি? স্বপ্নেও ইহা আপনি ভাবিবেন না—এখন কেহই আমাকে নিবৃত্ত করিতে পারিবে না। আমি এখনই এই পিশাচ পিশাচীর সম্মুখীন হইব। দেখি, সহসা আমাকে দেখিয়া তাঁহারা নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কতদূর লজ্জিত হয়; তাহার পর—তাহার পর দুজনকেই খুন করিব—খুন করিয়া নিজের দুর্ব্বহ জীবনের অবসান নিজের হাতেই করিব। আপনি কিছুতেই আমাকে নিরন্ত করিতে পারিবেন না।” বলিয়া রস্তমজী কাশীনাথের মুষ্টিমধ্য হইতে নিজের হাত টানিয়া বাহির করিবার জন্য সাধ্যানুসারে বল প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। কাশীনাথের মুষ্টি বজ্রকঠিন না হইলে, এতক্ষণ রস্তমজী যাহা বলিলেন, হয় ত তাহা সম্পন্ন করিতে পারিতেন।
কাশীনাথ বলিলেন, “দেখ রস্তমজী, তুমি একটা গোলযোগ বাধাইয়া সমস্তই পণ্ড করিবে দেখিতেছি—যেটুকু আশা ভরসা আছে, তাহাও ঘুচিয়া যাইবে।”
“আর আপনি আশা ভরসার কথা বলিবেন না।”
“দেখ মাঞ্চারজীকে যদি এখন কোন রকমে সতর্ক করিয়া দেওয়া হয়, সে সহজেই আমাদের হাতছাড়া হইয়া যাইবে—আর তোমার কলঙ্ক সারাজীবন অব্যাহত রহিয়া যাইবে।”
“সে আশঙ্কা আর আমার নাই।”
“তোমার না থাকিতে পারে, আমার আছে। তোমার নিৰ্দ্দোষিতা সপ্রমাণ করিবার জন্য আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাহা বোধ করি, তুমি এখনও বিস্মৃত হও নাই। এ বয়সে তোমার অনেক সুন্দরী স্ত্রী জুটিবে, সন্দেহ নাই; কিন্তু পরে কলঙ্ক অপনোদনের কোন উপায় থাকিবে না।”
মনের ভিতরে যখন তুমুল কাণ্ড উপস্থিত হয়—বাহিরের দিকে তখন লক্ষ্য থাকে না। উভয়ের কদমে পা ডুবিয়া গিয়াছে, মাথার উপরে প্রবলবেগে ধারাপাত হইতেছে—এবং দম্কা বাতাসে বৃষ্টির ঝাপটে বিশ্বজগৎ একান্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে—সেদিকে কাহারও দৃষ্টি নাই।
দৃঢ়সংকল্প রস্তমজী বলিলেন, “না, আর আমি আপনার কথা শুনিতে চাই না, আমি আপনার নিজের অপমানের নিজেই প্রতিকার করিব। আপনার সাহায্য অনাবশ্যক।”
অক্ষুণ্ণভাবে কাশীনাথ বলিলেন, “বেশ বাপু, আমার সাহায্যে আর তোমার দরকার নাই, তবে একটা কথা না বলিয়া থাকিতে পারিতেছি না। নিজের আপমানের প্রতিকার নিজেই করিতে চাও, কর, কিন্তু বালকের মত কিছু করিয়ো না—যাহা করিবে মানুষের মতই করিবে।”
ক্রোধভরে মাথা তুলিয়া রস্তমজী বলিলেন, “মহাশয়!”
উত্তেজিতভাবে কাশীনাথ বলিলেন, “হাঁ, আমি আবার বলিতেছি, বালকের মত কিছু করিয়ো না। বাপু, তুমি নিতান্ত ছেলেমানুষ—বালকের যে জ্ঞান আছে, বোধ হয় তাহাও তোমার নাই। মনে ভাবিয়া দেখ দেখি, তুমি এখন বাড়ীর ভিতরে গিয়া কি করিবে; সঙ্গে তোমার কোন অস্ত্র-শস্ত্র আছে? নাই। তুমি হুড়মুড় করিয়া ঘরে ঢুকিবে—আর মাঞ্চারজীর সঙ্গে খুব একটা দাঙ্গা সুরু হইবে। যখন তোমরা যুদ্ধে ব্যাপৃত—আর সুযোগ বুঝিয়া কমলাবাঈ চট্ করিয়া বাড়ীর বাহিরে আসিয়া নিজের গাড়ীতে উঠিবে, ঘোড়া ছুটিবে—আর তোমরা দুজনে ঘরের ভিতরে লড়াই করিতে থাকিবে; তা তোমাদের মধ্যে কে বেশী বলবান, তাহা আমার জানা নাই—তাহা হইলে উপসংহারের ঘটনাটাও আগে হইতেই বলিয়া দিতে পারিতাম।”
কাশীনাথের কথায় রস্তমজীর চৈতন্যোদয় হইল, নিজের শরীরের অবস্থাও তাঁহার স্মরণ হইল, কয়েক দিনের নানাবিধ দুর্ঘটনা ও দুর্ভাবনায় তিনি শরীর ও মনের বল উভয়ই হারাইয়া ফেলিয়াছেন। রস্তমজী নীরবে রহিলেন।
কাশীনাথ বলিতে লাগিলেন, “অস্ত্র-শস্ত্র থাকিলেও বিশেষ কোন ফল হইত না। যাহাকে দুই-চারি দিনের চেষ্টায় ফাঁসীকাঠে ঝুলাইয়া দেওয়া যাইতে পারে, তাহাকে পিস্তলের গুলি দাগিয়া নিজের জীবনকে বিপন্ন করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।”
“আপনি এখন আমাকে কি করিতে বলেন?”
“অপেক্ষা করিতে—ধৈর্য্য বড় চমৎকার জিনিষ। এই মনে কর, প্রতিহিংসা একটা ফল বিশেষ; সেই ফলটি যদি কাঁচায় পাড়িয়া নষ্ট না করিয়া, সেটাকে গাছ-পাকা করিবার জন্য কিছু সময় দেওয়া হয়, তাহা হইলে যে, তাহা যথাসময়ে উপাদেয় ভোগ্য হইতে পারে—সন্দেহ নাই।”
কাশীনাথের সারগর্ভ যুক্তিপূর্ণ ব্যাক্যে রস্তমজীর মন টলিল। কাশীনাথ তাহা বুঝিতেও পারিলেন। বলিলেন, “কমলাবাঈকে তুমি দেখিয়াছ, কিন্তু সে কেন এখানে আসিয়াছে, কি প্রয়োজন, তাহার কিছুই তুমি জান না। অথচ রাগিয়া অস্থির—অবিবেচক ব্যক্তিগণের জন্যই অনুতাপের সৃষ্টি হইয়াছে। আমার বিশ্বাস, হয় ত ইহাতে কমলার কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিহীত আছে—আমরা তাহা জানি না।”
মজ্জমান্ ব্যক্তি একটা তৃণ পাইলেই তাহা অবলম্বন করিতে চেষ্টা করে। সোৎসাহে রস্তমজী বলিলেন, “কিরূপে ভিতরের কথা জানিতে পারা যায়?”
“তাহাদের যদি আমি এখন একবার দেখিতে পাইতাম, মুখের ভাব দেখিয়াই অনেকটা বুঝিতে পারিতাম—কমলার কোন্ উদ্দেশ্যে এখানে আগমন হইয়াছে।”
“বেশ আপনি প্রতিজ্ঞা করুন, যাহা আপনি দেখিবেন, শুনিবেন—তাহা আমার পক্ষে অপ্রীতিকর হউক না কেন—অকপটে সমুদয় আমার কাছে প্রকাশ করিবেন?”
“প্রতিজ্ঞা করিলাম, কোন কথা গোপন করিব না।”
তন্মুহূর্তে রস্তমজী সেই কাঠের সিঁড়ীটা অবলীলাক্রামে নিজের ঘাড়ে টানিয়া তুলিলেন। তাঁহার দেহে যে এখনও এতটা শক্তি আছে, কিছু পূর্ব্বে এ বিশ্বাস তাঁহার আদৌ ছিল না। তিনি বলিলেন, “আপনি শীঘ্র উঠুন।”
অষ্টম পরিচ্ছেদ – রহস্যের মেঘ ঘনীভূত
কাশীনাথ তাড়াতাড়ি সিঁড়ীর উপরে উঠিয়া গেলেন। গবাক্ষের সেই রেশমী পর্দ্দার অন্তরাল হইতে দেখিলেন, সত্যই সেখানে কমলাবাঈ রহিয়াছে, রস্তমজীর ভুল হয় নাই। কক্ষমধ্যে মাঞ্চারজীও আছে। একজন বিলাসী যুবকের কক্ষে এই নির্জ্জন নিশীথে কোন যুবতীর একাকিনী অবস্থিতি নিশ্চয়ই সন্দেহজনক—কাজটা অবশ্যই গর্হিত—তবে কি কমলা কলঙ্কিনী। কাশীনাথ বড় গোলযোগে পড়িলেন কাশীনাথ দেখিলেন, কমলাবাঈ ঘরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া আছে, তাহার রূপের প্রভা ও দাঁড়াইবার ললিত কোমল ভঙ্গিতে সমগ্র ঘরখানা উজ্জ্বলীকৃত। তাহার দেহে জরীর কাজকরা নীলরঙের একখানা শাল রহিয়াছে; কমলাবাঈ উত্তেজিতভাবে মাঞ্চারজীকে কি বলিতেছে। বাহিরের জল-ঝড়ের শব্দে তাহা বুঝিতে পারা গেল না; কিন্তু তাহার মুখ চোখের ভাবে রাগের লক্ষণই অনেকটা প্রকাশ পাইতেছে।
মাঞ্চারজী বিছানায় অর্দ্ধশায়িত অবস্থায় পড়িয়া আছে; বড় একটা কথা কহিতেছিল না— এক একবার কেবল ক্রোধভরে উচ্চকণ্ঠে বলিতেছে, “আমাকে বলা মিছে, আমার দ্বারা কিছুই হইবে না।”
ব্যাপার কি হইতেছে, কাশীনাথ কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার মন অত্যন্ত কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া উঠিল, কিন্তু বাহিরের ঝড় বৃষ্টির শব্দে কিছুই শুনিবার যো নাই। তাঁহার এত আগ্রহ হইতে লাগিল যে, তাঁহার অঙ্গুলিস্থ বহুমূল্য হীরকাঙ্গুরীয়ের বিনিময়েও যদি তিনি তাহাদের কথা শুনিতে পান, তাহাতেও তিনি সম্মত। কাশীনাথ ভাবিলেন, কোন বিষয় লইয়া উভয়ের বচসা হইতেছে। হয়ত প্রেমের মানাভিমানের অভিনয় চলিতেছে।
এই সময়ে কমলাবাঈ উত্তেজিতভাবে ভর্ৎসনার স্বরে আরও কি বলিতে লাগিল। বলিতে বলিতে তাহার বিশালায়ত কৃষ্ণতার চক্ষুদ্বয় হীরকখণ্ডের ন্যায় দীপ্তিশীল হইয়া উঠিল। সেই সময়ে মাঞ্চারজীর মুখের চোখের কিরূপ ভাববৈলক্ষণ্য ঘটে দেখিবার জন্য, কাশীনাথ মাঞ্চারজীর মুখের দিকে ঘন ঘন চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। কথাও শুনিতে পাওয়া যাইতেছে না, তবে যদি মুখ চোখের ভাব-ভাঙ্গিতে ব্যাপারটা কিছু বুঝিতে পারা যায়। কমলাবাঈ-এর বলা শেষ হইলে মাঞ্চারজীর আর সে উদাসীন ভাব রহিল না; এবার সে বড় রাগিয়া উঠিল, উপাধানে একটা মুষ্ট্যাঘাত করিয়া হাত মুখ নাড়িয়া কঠিনকণ্ঠে কমলাবাঈকে কতকগুলো কথা শুনাইয়া দিল।
সহসা কমলারও ভাববৈলক্ষণ্য ঘটিল। তাহার আর সে উত্তেজিত ভাব রহিল না। নীহারাক্ত নীলোৎপলের ন্যায় তাহার চক্ষু দুটি অশ্রুপূর্ণ হইয়া ছল ছল করিতে লাগিল। হতভাগিনী কাঁদিয়া ফেলিল, এবং নতজানু হইয়া বসিয়া যুক্তকরে করুণকণ্ঠে অনেক কথাই বলিতে লাগিল। অশ্রুধারায় তাহার প্রফুল্ল অনিন্দ্য-সুন্দর মুখখানি প্লাবিত হইয়া গেল।
মাঞ্চারজী অবজ্ঞাভরে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া লইল। কমলার কাতরোক্তিতে কর্ণপাত করিতে সম্পূর্ণ ঔদাসীন্য প্রকাশ করিতে লাগিল। একটি কথারও উত্তর করিল না।
তখন কমলাবাঈ হতাশভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল; ধীরে ধীরে কক্ষের বাহির হইয়া গেল। তখনই আবার ধীরে ধীরে প্রবেশ করিল; দীননয়নে মাঞ্চারজীর মুখের দিকে চাহিয়া আবার কক্ষের বাহির হইয়া গেল। আবার ফিরিল, কয়েকবার এইরূপ করিল। এমন একটা কিছু ব্যাপার হইয়াছে যে, সে যাইতে কৃতসংকল্প হইয়াও যাইতে পারিতেছে না। এবার ফিরিয়া আসিয়া কমলা বাঈ এমন একটা কথা বলিল, যাহাতে তাহার অভীষ্টসিদ্ধির পথ প্রশস্ত হইয়া গেল। মাঞ্চারজী তাড়াতাড়ি উঠিয়া দেরাজের ভিতর হইতে একতাড়া কাগজ-পত্র বাহির করিয়া গৃহ মধ্যস্থিত ক্ষুদ্র টেবিলের উপরে ফেলিয়া দিল।
কাশীনাথের মুখ অপ্রসন্ন ভাব ধারণ করিল। তিনি ভাবিলেন, ব্যাপারটা বড় ভাল ঠেকিতেছে না—নিশ্চয়ই এই কাগজগুলি প্রেমপত্র। কমলাবাঈ কি এইগুলি হস্তগত করিবার জন্যই এত সাধ্য-সাধনা করিতেছিল?
কমলাবাঈ কাগজগুলি খুলিয়া দীপালোক সম্মুখে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে লাগিল। কমলা বাঈকে তাহাতে বড় সন্তুষ্ট বলিয়া বোধ হইল না। সে মাঞ্চারজীকে আরও কোন বিষয়ের জন্য অনুনয় করিতে লাগিল। মাঞ্চারজী মাথা নাড়িয়া অস্বীকার করিল। তখন কমলাবাঈ সেই কাগজগুলি হতাশভাবে সেই ক্ষুদ্র টেবিলের উপরে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল।
মাঞ্চারজী তখন আরও একতাড়া কাগজ তাহার সম্মুখে ফেলিয়া দিল। সেই তাড়ায় লাল, নীল, সবুজ, পীত, গোলাপী—নানা বর্ণের কাগজ। এবার কমলাবাঈ উভয় তাড়া হইতে কয়েকখানা কাগজ বাছিয়া লইয়া বাকীগুলা ঘৃণা ভরে বাম হস্তে টেবিলের একপার্শ্বে ঠেলিয়া দিল এবং গমনোদ্যত ভাবে দাঁড়াইয়া মাঞ্চারজীকে কি বলিল। মাঞ্চারজী ল্যাম্পটা হাতে লইয়া তাহার অনুসরণ করিল। কক্ষ অন্ধকারে পূর্ণ হইয়া গেল।
কাশীনাথ নামিতে নামিতে আপন মনে বলিলেন, “আমি কি অন্ধ—কাগজগুলি গুপ্ত প্রেমপত্র নয়—নিশ্চয়ই বন্ধকী জিনিসের রসীদ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই সকল ব্যাপারের মধ্যে একটা জঘন্য রহস্য নিহিত আছে।” কাশীনাথ নামিয়াই সেই কাঠের সিঁড়ীখানা টানিয়া মাটির উপরে শোয়াইয়া রাখিলেন; কতকগুলি ফুলের চারা গাছ তাহাতে চাপা পড়িল—ভাঙ্গিয়া গেল—কেহই সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করিলেন না। উভয়ে অদূরবর্তী একটা গাছের তলায় গিয়া লুকাইয়া রহিলেন। সেখান হইতে বাগানের গেট বেশ দেখা যায়।
অনতিবিলম্বে বাড়ীখানার একটা দ্বার উদ্ঘাটিত হইল—দীপালোক অন্ধকারময় উদ্যান ভূমিতে ছড়াইয়া পড়িল। অগ্রে কমলা, তাহার পশ্চাতে মাঞ্চারজী বাহির হইয়া আসিল। উভয়ে কোন দিকে না চাহিয়া বাগানের গেটের দিকে চলিয়া গেল। কমলাবাঈ চঞ্চলপদে গাড়ীতে উঠিয়া বসিল। গাড়ী সবেগে ছুটিয়া চলিয়া গেল। এবং মাঞ্চারজী আলো লইয়া মাথা নাড়িতে নাড়িতে বাটীমধ্যে প্রবেশ করিয়া সশব্দে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।
গুপ্তস্থান হইতে কাশীনাথ ও রস্তমজী বাহির হইয়া আসিলেন। রস্তমজী বলিলেন, “এইবার আপনি প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন—বলুন, আপনি কি দেখিলেন, দেখিয়া কি বুঝিলেন। যদি কিছু জঘন্য কুৎসিত ব্যাপারও দেখিয়া থাকেন, তাহাও আমি সহ্য করিতে প্রস্তুত। বলুন, আমার পক্ষে একান্ত অপ্রিয়কর হয়, ক্ষতি নাই—আপনি নিশ্চিন্ত হউন—আমি বিচলিত হইব না।”
কাশীনাথ বলিলেন, “অদ্যকার এই ঘটনার একদিন তুমি নিজেকে সর্ব্বাধিক সৌভাগ্যবান্ মনে করিবে—আর এই সন্দেহের জন্য তোমাকে অত্যন্ত অনুতাপ করিতে হইবে।”
রস্তমজী বলিলেন, “আপনার কথা বুঝিতে পারিতেছি না।”
কাশীনাথ বলিলেন, “এখন বুঝিবার দরকারও নাই। যাহা হউক, এখানে অবস্থান করিবার মৌরসী পাট্টা লইয়া আমরা আসি নাই; চল, আরও অনেক কাজ আছে; মাঞ্চারজী গেট বন্ধ করিয়া গিয়াছে, যে ভাবে আমরা বাগানে প্রবেশ করিয়াছিলাম, সেই ভাবেই প্রস্থান করিতে হইবে।”
এই বলিয়া কাশীনাথ রস্তমজীর হাত ধরিয়া দ্রুতপদে চলিলেন। মজী বলিলেন, “সিঁড়ীখানা যে ওইখানেই পড়িয়া রহিল।”
কাশীনাথ বলিলেন, “তা থাক্, যখন আমরা বাগানের সর্ব্বত্র চরণচিহ্ন অঙ্কিত করিয়া যাইতেছি, আর যখন ঐ চরণচিহ্নগুলি নষ্ট করিবার কোন উপায় নাই; তখন আর এই সিঁড়ীখানার জন্য চিন্তা কেন? সিঁড়ীখানা দেখিয়া মাঞ্চারজী মনে করিবে কয়েকজন চোরের শুভাগমন হইয়াছিল।”
উভয়ে প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া বাহিরে আসিলেন। দূর হইতে তাঁহারা একটা শব্দ শুনিয়া গেটের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, একজন লোক গেটের বাহির হইয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল। সে মাঞ্চারজী।
রস্তমজী বলিলেন, “লোকটার মন দুরভিসন্ধিতে পূর্ণ—রাত্রেও নিদ্রা নাই।”
কাশীনাথ বলিলেন, “আমরা সু-অভিসন্ধি লইয়াই বড় নিদ্রা যাইতে পরিতেছি, তা, ও বেচারার মন ত দুরভিসন্ধিতে পূর্ণ।”
রস্তমজী বলিলেন, “এতরাত্রে যায় কোথায়?”
কাশীনাথ বলিলেন, “চরিত্রহীন ব্যক্তি এতরাত্রে যায় কোথায়—এ প্রশ্ন নিষ্প্রয়োজন। এখন চল, নতুবা গাড়ীখানা হয়ত চলিয়া যাইবে।”
উভয়ে কিছুদূর আসিয়া দেখিলেন, যেখানে তাঁহারা তাঁহাদের কোচম্যানকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া গিয়াছিলেন, এখনও সে সেইখানে অপেক্ষা করিতেছে। রস্তমজীর পরিধেয় বস্ত্রাদি কর্দ্দমাক্ত দেখিয়া তাহার মনটা সন্দেহপূর্ণ হইল। ভাবিল, লোক দুটী সদুদ্দেশ্যে আসে নাই; যখন দ্বিগুণ ভাড়ার লোভ দেখাইয়াছিল,তখনই মনে একটা খট্কা লাগিয়াছিল। যাহা হউক, সে উভয় আরোহীকে লইয়া গাড়ী জোরে হাঁকাইয়া দিল।
রস্তমজী গাড়ীতে উঠিয়াই কাশীনাথের উপরে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন বর্ষণ আরম্ভ করিয়া দিলেন; মধ্যে মধ্যে “হাঁ” “না” “হাঁ” এই রকম সংক্ষিপ্ত উত্তর পাইতে লাগিলেন। তাহাতে রস্তমজীর পরিতৃপ্তি হইল না—মনে এনে বড়ই অসন্তুষ্ট হইলেন; ভাবিলেন, “হইলেনই বা পিতৃবন্ধু; তা বলিয়, আমার উপরে এতটা কর্তৃত্ব একান্ত অনুচিত। আমি বালক নহি—আমি বলিতেছি, বালক নহি, কিন্তু ইনি আমাকে তাহার বেশি কিছু মনে করেন না।”
মনের এই দুরবস্থা, শরীরের অবস্থাও তদ্রূপ, রস্তমজী বড় কাতর হইয়া পড়িলেন; অনাবৃত স্থানে দাঁড়াইয়া অনাবৃত মস্তকে অজস্র বৃষ্টিধারা উপভোগ করিয়াছেন, দ্বিতল হইতে কদমাক্ত ভূমিতে আছাড় খাইয়া পড়িয়াছেন,—পরিধেয় বস্ত্রাদি সিক্ত ও কদমাক্ত, তাহার উপর গাড়ী যেমন সবেগে ছুটিয়াছে, তেমনই সবেগে শীতল বায়ু গাড়ীর মধ্যে হুহু শব্দে প্রবেশ করিতেছে—শীতে রস্তমজীর অস্থি চুর্ণ হইতে লাগিল।
ইচ্ছা করিয়াই যে কাশীনাথ রস্তমজীর কথায় বড় কর্ণপাত করিতে ছিলেন না, তাহা নহে। প্রকৃতই তাঁহার মনের ভিতরে বড় গোলমাল বাঁধিয়া গিয়াছিল; তিনি হেলিয়া পড়িয়া বড় বড় পা দুখানি সম্মুখস্থ আসনের উপরে তুলিয়া দিয়া অৰ্দ্ধনিমীলিত নেত্রে ভাবিতেছিলেন, “রহস্যের উপরে রহস্যের অবতারণা, রহস্য ক্রমেই গভীর হইতেছে; তিনি এতক্ষণ যে সকল সূত্ৰ সংগ্ৰহ করিয়া গ্রন্থি রচনা করিতেছিলেন, আজিকার রাত্রের এই ঘটনায় সমুদয় শিথিল হইয়া গেল। তিনি দেখিলেন, এই রহস্যময় নাটকের প্রধান অভিনেতা ও অভিনেত্রী বর্জরজী, মাঞ্চারজী, রাজা বাঈ ও কমলাবাঈ। এই চরিত্র চতুষ্টয়ের বিশ্লেষণে তাঁহার বুদ্ধি ও কৌশলের কল্পদ্রুম স্বরূপ মস্তিষ্কও বিচঞ্চল হইয়া উঠিল। একান্ত অস্থির হইয়া তিনি স্থির করিলেন, ভাবিয়া কিছুই হইবে না, সমুদয় হাতে তুলিয়া নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিতে হইবে, সহজে এ সকল রহস্যের উদ্ভেদ হইবে না।”
অনতিবিলম্বে গাড়ীর চাকার শব্দ ঠেলিয়া কাশীনাথের বিকট নাসিকা গৰ্জ্জন ধ্বনিত হইতে লাগিল।
ক্রমে গাড়ী রস্তমজীর বাসার সম্মুখে আসিয়া লাগিল। কাশীনাথ আপনা হতেই জাগিয়া উঠিলেন। রস্তমজী নামিয়া পড়িলেন। এমন সময়ে দূরবর্ত্তী গির্জ্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া দুইটা বাজিল। সহসা কাশীনাথের স্মরণ হইল, এখনও তাঁহার আহার হয় নাই—ক্ষুধারও উদ্রেক হইয়াছে। বলিলেন, “তাই ত—অনেক রাত—কিছু আহারের আবশ্যক ছিল যে!”
রস্তমজী বলিলেন, “এখনও আপনার আহার হয় নাই—এত রাত্রে—”
বাধা দিয়া কাশীনাথ বলিলেন, “যাক্, সেজন্য তোমাকে মাথা ঘামাইতে হইবে না—এখন আমি যা বলি, মনোযোগ দিয়া শুন, আমার হাতে এখন অনেক কাজ, খুব সম্ভব, পাঁচ-সাতদিন আমার দেখা পাইবে না। কিন্তু যে কয়দিন আমি না আসিতে পারি, তুমি খুব সাবধানে থাকিবে, মোটকথা বাসা হইতে একেবারে বাহির হইয়ো না।
রস্তমজী কি বলিতে যাইতেছিলেন, কাশীনাথ কোচম্যানকে লক্ষ্য করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “জল্দী গাড়ী হাঁকাও।”
রস্তমজীর মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল, কাশীনাথকে লইয়া গাড়ী সবেগে দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেল।
নবম পরিচ্ছেদ – গুপ্ত পরামর্শ
একদা বর্জরজী ও মাঞ্চারজী নিজেদের বাসায় বসিয়া এইরূপ পরামর্শ করিতেছিল; মাঞ্চারজী বলিল, “এখন কি উপায়? আর ত চলে না। টাকা আমার চাই-ই চাই।”
“শীঘ্র যোগাড় হইবে।”
“আর কথায় কাজ নাই, আমি রাজাবাঈ-এর নিকট হইতে যাহা কিছু ফাঁকি দিয়া আনি, তাহার বেশীর ভাগ মহাশয়ের হাতেই যায়। আমাকে কি আপনি একেবারে নিরেট বোকা ঠাওরাইয়াছেন?”
“তুমি দিন রাত আমার সঙ্গে ঝগড়া করিয়া নিজেরও সর্ব্বনাশ করিবে—আমারও সর্ব্বনাশ করিবে।”
“অত-শত আমি বুঝি না। তুমি হরেকজীর সমস্ত টাকা উড়াইয়াছ, নতুবা সে সব আমারই হইত।”
“আহা, মহাশয়ও কি দুই হাতে সে টাকা উড়ান নাই?”
“আমি সে সব জানি না। আমার টাকা চাই-ই চাই।”
“শীঘ্র পাবে।”
“ও কথায় আমি আর ভুলিতেছি না। আমাকে সব খুলিয়া বল, না হইলে আমি সব রাজা বাঈকে গিয়া বলিয়া দিব।”
ক্রোধে বর্জরজীর মুখ লাল হইয়া গেল। সে অতিকষ্টে আত্মসংযম করিয়া বলিল, “তবে শোন, হরমসজীর সমস্ত টাকাই আমাদের হইবে।”
মাঞ্চরজী বলিল, “কেমন করিয়া—সেইটা ব্যাখ্যা হউক।”
বর্জরজী বলিল, “আমি শীঘ্রই কমলাবাঈকে বিবাহ করিব।”
মাঞ্চারজী লম্ফ দিয়া উঠিয়া বসিল। বলিল, “কি!”
বর্জরজী পুনরপি কহিল, “আমি শীঘ্রই কমলাকে বিবাহ করিব।”
মাঞ্চারজী হো হো শব্দে হাসিতে লাগিল। ক্রোধে বর্জরজীর মুখ ভয়ানক হইয়া উঠিল। মুহূৰ্ত্ত মধ্যে নিজ মনোভাব গোপন করিয়া সে বলিল, “ইহাতে হাসিবার কি আছে? কমলাবাঈ-এর সহিত আমার বিবাহ হইলে, হরমসজীর সমস্ত বিষয় আমারই হইবে।”
“আর আমি বেচারা, অশ্বের তৃণসংগ্রহে ব্যস্ত থাকিব!”
‘যাহাতে তোমার টাকার অভাব না হয়, সে ব্যবস্থা আমি করিব।”
“মশাই গো, আপনি আমাকে কি চতুস্পদ শ্রেণীভুক্ত মনে করেন?”
“কিসে বুঝিলে?”
“কেন? অবস্থাটা ঘুরাইয়া লওয়া হউক না কেন।
“কি রকম?”
“বুঝিতে পারিতেছেন না? তবে বুঝাইয়া দিই। এই মনে করেন, আপনার যথেষ্ঠ বয়স হইয়াছে, আপনার বিবাহের বয়স আর নাই। না হয় আমিই কমলা বাঈকে বিবাহ করিলাম। আমি আপনার টাকার বন্দোবস্ত করিব—আপনি না-ই করিলেন?”
বর্জরজী বলিল, “তোমার সহিত কমলাবাঈ-এর বিবাহ দিতে হরমসজী রাজী হইবে কেন?”
মাঞ্চারজী বলিল, “মহাশয়ের ন্যায় গুণবান্ সুপুরুষের সহিত বিবাহ দিতে সম্মত হইবেন, ইহার কারণটা শুনিতে পাই না কি?”
বর্জরজী রুষ্ট হইয়া বলিল, “মাঞ্চারজী, তুমি কি আমার সহিত এইরূপ ঝগড়া করিয়া সমস্ত কাজ পণ্ড করিবে?”
মাঞ্চারজী বলিল, “কাহার ইচ্ছা কাজ পণ্ড করে? তবে মহাশয় আমাকে দিয়া কাজ হাসিল করিবেন, ভাগের বেলায় ষোল আনা নিজে লইবেন, আবার সুন্দরীটিকেও বিবাহ করিবেন, অথচ আমি নীরবে দাঁড়াইয়া দেখিব, এ যদি আপনি মনে ঠিক করিয়া থাকেন তবে সেটা আপনার সম্পূর্ণ ভ্রম। আমি নিতান্ত ছেলেমানুষ নই—সব বুঝিতে পারি। আমিই কমলা বাঈকে বিবাহ করিব।”
“তোমার সহিত হরমসজী বিবাহ দিবে না।”
“মহাশয়ের সঙ্গে দিবে কেন?”
“কারণ আছে—সময়ে দেখিতে পাইবে।”
“কারণ আমি শুনিতে চাই।”
“এখন বলিব না।”
“না বল—থাক, আমি আমার পথ দেখিব।”
“দেখ মাঞ্চারজী, আমি না থাকিলে তোমার কি দশা হইত একবার ভাবিয়া দেখ। তুমি ঘোর কৃতঘ্ন। তোমাকে এখনও সাবধান হইতে বলিতেছি।”
মাঞ্চারজী আবার হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। বর্জরজী এবার আর ক্রোধ সম্বরণ করিতে পারিল না। বলিল, “বটে! জান, যে দিন ইচ্ছা, সেইদিনই আমি তোমাকে জেলে পাঠাইতে পারি।” -মাঞ্চারজী তাহার কথায় কোন উত্তর না দিয়া বিকট উচ্চহাস্যে চারিদিক প্রতিধ্বনিত করিয়া তুলিল।
সহসা বর্জরজী লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “মূর্খ, দেখিতেছ না, কে আমাদের কথা শুনিতেছে,” এই বলিয়া সবলে সে দ্বার উন্মুক্ত করিল। দেখিল, তাহার ভৃত্য ধীরে ধীরে চলিয়া যাইতেছে। তখন বর্জরজী সিংহবিক্রমে লম্ফ দিয়া গিয়া তাহার কেশাকর্ষণ করিল, সে কাঁদিয়া বলিয়া উঠিল, “হুজুর, আমি ত কিছুই করি নাই।”
দশম পরিচ্ছেদ – বিঘ্ন
বর্জরজীর ভৃত্য চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। বর্জরজী বলিল, “বেটা, চেঁচাবি ত মেরে হাড় গুঁড়া করিব।”
“হুজুর, আমি ত কিছুই করি নাই।”
“বেটা, তুই আমাদের কথা শুনিতেছিলি।”
“হুজুর না।”
“তবে দরজার কাছে কি করিতেছিলি?”
“হুজুর, আমি এইখান দিয়া যাচ্ছিলাম।”
“আমাদের কথা শুনিস্ নাই, ঠিক বলছিস্ বেটা?”
“ঠিক হুজুর।”
মাঞ্চরজী বলিল, “ও কি দরকারে শুনিবে?”
বর্জরজী ভৃত্যকে ছাড়িয়া দিয়া বলিল, “হাঁ, এ বেটা নিতান্ত গাধা, আমার ভুল হইয়াছে, বলিয়া সে গৃহে প্রবিষ্ট হইল; তৎপরে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। আবার দুই জনে বসিল। বর্জরজী বলিল, আমাদের একটু সাবধানে থাকিতে হইয়াছে।”
মাঞ্চারজী জিজ্ঞাসা করিল, “কেন—আমাদের কে সন্দেহ করে?”
“রস্তমজী বেটা ফাঁসী গেলে কোনই ভয়ের কারণ ছিল না। এখন একটু সাবধানে থাকা ভাল।”
“ওর সব সাক্ষী যোগাড় করিল কে?”
“আমি ত তোমার মত চক্ষু বুজে নাই।”
“কে ওর সাহায্য করিতেছে?”
“এক বেটা বুড়ো মারাঠী, বলে ওর বাপের বন্ধু।”
“ঠিক কি তাই?”
“সন্ধানে আছি।”
“যাই কর, আমার টাকা চাই।”
“দিন কত অপেক্ষা কর।”
“সে সব টাকা কি করিলে? দুলাখ টাকা একদিনে উড়ে যায় না?”
“তোমার পাণ্ডিত্যের জন্যই আমাদের জেলে যাইতে হইবে।”
“আমি কেন যাইব? যেতে হয় তুমি যাবে।”
“বটে?”
“নয় কেন? আমি কি করিয়াছি? কেবল তোমাকে সন্ধান বলে দিয়াছিলাম।”
“দিন রাত ঝগড়া কর কেন?’
‘দায়ে পড়ে করি। ভাগ্যিস্ আমি রতনের বাড়ী গিয়াছিলাম,—কত কষ্টে তাহাকে বুঝাইয়াছিলাম যে, রস্তমজী আর তাহাকে পূর্ব্বের ন্যায় যত্ন করে না—তাহা আমিই জানি—’
“সে সব কথায় দরকার কি?”
“দরকার এই যে—”
বাধা দিয়া “তুমি একটা প্রকাণ্ড গাধা,” বলিয়া বর্জরজী সক্রোধে উঠিয়া দাঁড়াইল।
এই সময়ে কে দ্বারে ঘা দিল।
বর্জরজী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে ওখানে?”
বাহির হইতে উত্তর হইল, “হুজুর আমি।”
বর্জরজী সক্রোধে বলিল, “দুর হ বেটা—এখান থেকে।”
ভৃত্য কহিল, “হুজুর, একখানা পত্র।”
পত্রের কথা শুনিয়া বর্জরজী দ্বার খুলিল। ভৃত্য তাহার হাতে একখানা পত্র দিয়া বলিল, “ডাকহরকরা এই পত্র এখনই দিয়ে গেল।”
বর্জরজী পত্র লইয়া খুলিল। একবারমাত্র পত্রে দৃষ্টিপাত করিয়া ভৃত্যকে বলিল, “যা বেটা এখান থেকে।”
সে ছুটিয়া পলাইল।
বর্জরজী আবার দ্বার বন্ধ করিল। গম্ভীরভাবে মাঞ্চারজীর নিকটে আসিয়া তাহাকে পত্ৰ দিয়া বলিল, “দেখ।”
পত্র পাঠ করিয়া মাঞ্চারজীর মুখ পাণ্ডুর হইয়া গেল। সে ব্যাকুল ভাবে কহিল, “উপায়?”
পত্রখানি এই;–
“স্নেহাস্পদ মাঞ্চার,
তোমরা যে লোক পাঠাইয়াছ, তাহার মুখে সকল কথা শুনিলাম। তোমাদের এতদিন কোন সংবাদ না পাইয়া আমি বড়ই ভাবিত হইয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম যে, তোমরা বোম্বের আমোদ-প্রমোদে এ বুড়ীকে একেবারে ভুলিয়া গিয়াছ। তাহা কি কখনও হয়? তোমরা আমাকে বোম্বে লইয়া যাইবার জন্য যে লোক পাঠাইয়াছ, তিনি বড় ভদ্রলোক। আমি তাঁহার সহিত আজ রাত্রের গাড়ীতে বোম্বে রওনা হইব। তোমাকে যতদিন না দেখিতে পাইতেছি, ততদিন আমার প্রাণে শান্তি নাই। চারিদিনের দিন বোম্বাই পৌঁছিব-ষ্টেশনে থাকিয়ো।
তোমার স্নেহময়ী—
মা।”
বর্জরজী কথা কহে না দেখিয়া মাঞ্চারজী বলিল, “এখান থেকে লোক তাহাকে আনিতে গিয়াছে, কি সৰ্ব্বনাশ!”
বর্জরজী ধমকাইয়া, বলিল, “আরে মূর্খ, বুঝিতে পারিতেছ না, পুলিস আমাদের কথা জানিতে পরিয়াছে। পুলিসের লোকেই তাকে আনিতেছে।”
মাঞ্চারজী বলিল, “পুলিস কিরূপে জানিবে?”
বর্জরজী বলিল, “পুলিস অনেক কথাই জানিতে পারে—আর এক মিনিটও দেরী করিবার সময় নাই।”
“তবে উপায়?”
“যদি বাঁচিতে চাও, আমি যতক্ষণ না ফিরি,কোথাও যাইও না, কাহারও সহিত দেখা করিও না।”
“তুমি কোথায় যাইতেছ?”
“পরে বলিব।”
“বুঝিয়াছি; টাকা-কড়ী লইয়া আমাকে পুলিশের হাতে ফেলিয়া পলাইতে চাও।”
“গাধা, তোমার জন্যই এ বিপদ ঘটিয়াছে,” বলিয়া বর্জরজী সত্বর গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেল। মাঞ্চারজীও তাহার অনুসরণ করিতেছিল, কিন্তু কি ভাবিয়া গৃহমধ্যে আসিয়া বসিল।
দূরে দাঁড়াইয়া ভৃত্য এ দৃশ্য দেখিতেছিল। সে মনে মনে বলিল, “ভায়াদের লীলা খেলা এবার শেষ হয়ে এসেছে।”
একাদশ পরিচ্ছেদ – বিপদ-সাগরে
সেখান হইতে বর্জরজী বরাবর হরমসজীর বাড়ীতে আসিল। বৃদ্ধ লালুভাই যে তাঁহার অনুসরণ করিয়াছিলেন, তাহা সে জানিতে পারে নাই।
বর্জরজী জানিত, এই সময়ে হরমসজী নীচে আফিস ঘরে থাকেন, সুতরাং রাজা বাঈএর সহিত তাহার গোপনে সাক্ষাতের সুবিধা হইল।
বর্জরজীকে দেখিয়াই অভাগিনী রাজাবাঈ-এর হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতে লাগিল। তিনি সভয়ে তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইলেন।
বর্জরজীর বাজে কথা কহিবার সময় ছিল না। একেবারে কাজের কথা পাড়িল, “আমি বিশেষ কাজে আজ আপনার কাছে আসিয়াছি।”
রাজাবাঈ ম্লানমুখে কহিলেন, “বলুন।”
বর্জরজী কহিল, “আপনার মাঞ্চারজীকে লইয়া আমি বড়ই ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছি। আপনি যে টাকা দিয়াছেন, সে সমস্তই ইহার মধ্যে উড়াইয়া দিয়াছে—এক পয়সাও নাই।”
রাজাবাঈ কাতরকণ্ঠে কহিলেন, “এত টাকা কেমন করিয়া এত শীঘ্র গেল?”
“খরচ করিলে কতদিন থাকে?”
“আমাকে এখন কি করিতে বলেন?”
“টাকা চাই।”
“আমার হাতে আর এক পয়সাও নাই।”
“এ রকমে কত দিন চলিবে? টাকা চাই। সে ‘টাকা’ ‘টাকা” করিয়া আমাকে পাগল করিল। আমি আপনার মাঞ্চারজীর জন্য আর কি করিব? দেখিতেছি, আমাকে সকল কথা হরমসজীকে বলিয়া তাঁহারই সাহায্য চাহিতে হইল।”
ব্যাধের উদ্যত শর দেখিয়া হরিণীর যেরূপ ভাব হয়, বর্জরজীর কথায় রাজাবাঈ-এর মনের অবস্থা সেইরূপ হইল।
রাজা বাঈ বস্ত্রাঞ্চলে মুখ ঢাকিয়া নিঃশব্দে কাঁদিতে লাগিলেন। বোধ হইল, যেন তাঁহার হৃদয় ফাটিয়া যাইবার উপক্রম হইল।
দুরাত্মা বর্জরজীর পাষাণ হৃদয়, ইহাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হইল না। সে বলিল, “ইহার একমাত্র উপায় আছে।”
জলমগ্ন ব্যক্তি সামান্য তৃণ পাইলে তাহা যেরূপ ব্যাকুলভাবে ধারণ করে, সেইরূপ বর্জরজীর কথায় আশ্বস্ত হইয়া অভাগিনী রাজাবাঈ বর্জরজীর দিকে চাহিলেন। কাতরভাবে বলিলেন, “আর যদি কোন উপায় থাকে বলুন।”
“ইহার একমাত্র উপায়, আমার সহিত কমলাবাঈ-এর বিবাহ—”
সহসা সম্মুখে বজ্রপাত হইলে যেরূপ লোক চমকিত হইয়া উঠে, রাজাবাঈ-এরও সেইরূপ হইল। তিনি বলিলেন, “না না—আমি আমার পাপের জন্য নরক-যন্ত্রণা ভোগ করিতেছি, প্রাণ থাকিতে মেয়েকে সে যন্ত্রণায় ফেলিব না।”
বর্জরজী কহিল, “আমার সহিত তাহার বিবাহ হইলে তাহার নরক-যন্ত্রণা ভোগ হইবে কেন? আমি তাহাকে ভালবাসি।”
সহসা রাজাবাঈ উঠিয়া বলিলেন, “না যথেষ্ট হইয়াছে, আর না। আর এ যন্ত্রণা ভোগ করিব না। আর তোমার মত দুরাত্মা রাক্ষসের করকবলিত হইয়া থাকিব না। আমি আজই ইহার একটা প্রতিকার করিব।”
ভ্রুকুটিকুটিল মুখে বর্জরজী কহিল, “সে আপনার ইচ্ছা। প্রথম থেকেই আমার সকল কথাতেই আপনি এইরূপ আপত্তি করিয়া আসিতেছেন, শেষে আমার কথা শুনিতে হইয়াছে।”
“আর শুনিব না।”
“তাহাই ত বলিতেছি, সে আপনার ইচ্ছা—অভিরুচি। তবে এটা স্থির যে, আমি কমলাকে বিবাহ করিব। পিতা সাগ্রহে কন্যা সম্প্রদান করিবেন।”
“কন্যাকে বিষ খাওয়াইয়া মারিবেন, তবুও তিনি তোমার সঙ্গে বিবাহ দিবেন না।”
“সেটা আপনার ভুল। আমি তাঁহাকে রাজী করিব। দেখিবেন, তিনি আপত্তি করা দূরে থাক, বরং আহ্লাদিত হইবেন।”
‘আমি কিছুতেই এ বিবাহ হইতে দিব না।”
“সেটাও আপনার ভুল। অন্য আর কোন উপায়ে টাকা পাইবার সম্ভাবনা নাই। কমলার সহিত আমার বিবাহ হইলে আমাদের আর টাকার কোন ভাবনা থাকিবে না। কেবল আমি একার জন্য বলিতেছি না, আপনার মাঞ্চারজীরও আর কোন অভাব হইবে না।”
“প্রাণ থাকিতে আমি তোমার মত রাক্ষসের সহিত কমলার বিবাহ দিব না।”
“সে আপনার গুরুতর ভুল। আমার সহিত কমলার বিবাহ হইবে। আমি বলিতেছি, আমি তাহাকে বিবাহ করিবই।”
“সে করিবে না।”
“তা আমি দেখিয়া লইব। আগে তাহার মত লইব—তাহার পর হরমসজীর নিকট এই বিবাহ প্রস্তাব করিব।”
“আমি আর তোমাকে ভয় করি না।”
“সে আপনার অভিরুচি। যখন আপনি আমার সদুপদেশে কর্ণপাত করিতেছেন না, তখন আমাকে হরমসজীর নিকটেই যাইতে হইল। তাঁহাকে বলিব, আপনার গুণবতী ভার্য্যার গুপ্ত প্রণয়ের—”
রাজাবাঈ দাঁড়াইয়াছিলেন, কাঁপিতে কাঁপিতে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার সংজ্ঞা বিলুপ্তের উপক্রম হইল, মাথা ঘুরিতে লাগিল—তিনি উন্মাদিনীর ন্যায় বর্জরজীর পদপ্রান্তে পড়িলেন। বলিলেন, “দয়া কর—তোমার প্রাণে কি একটুও দয়া নাই!
বর্জরজী ধীরে ধীরে পা সরাইয়া লইয়া বলিল, “আপনি একটু ভাবিয়া দেখিলে বুঝিবেন, আমি ভালই বলিতেছি। আপনি আপত্তি করুন, আর নাই করুন—আমি কমলাকে বিবাহ করিবই। আমি এখন চলিলাম, কাল দেখা করিব। আমি নিশ্চয়ই জানি, কাল আপনিও আমার এ প্রস্তাবে সম্মত হইবেন।”
এই বলিয়া বর্জরজী বিদায় হইল। কম্পিত পদে রাজাবাঈ উঠিয়া দাঁড়াইলেন, তিনি পড়িয়া যাইতেছিলেন, সামলাইয়া নিকটস্থ কৌচে বসিয়া পড়িলেন।
পার্শ্ববর্তী গৃহ হইতে আর দুইজনে এই দৃশ্য দেখিতেছিল। তাহাদের মধ্যে একজন ধীরে ধীরে সেই গৃহে প্রবেশ করিল।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – রতনবাঈ সম্বন্ধে
যে আসিল, সে আর কেহ নহে—কমলাবাঈ। তাহাকে দেখিয়া হতভাগিনী রাজাবাঈ অতিকষ্টে আত্মসংযম করিয়া উঠিয়া বসিলেন। অতি কষ্টে তিনি নিজ মনোভাব গোপন করিবার প্রয়াস পাইলেন—কিন্তু পারিলেন না। কমলাবাঈ ধীরে ধীরে মাতার পদপ্রান্তে আসিয়া বসিল। সজলনয়নে বলিল, “মা, আমি সব শুনিয়াছি—সব জানিয়াছি, আগে হইতেই আমি সব জানিতাম।”
রাজাবাঈ আর আত্মসংযমে সক্ষম হইলেন না। কাঁদিয়া বস্ত্রাঞ্চলে মুখ ঢাকিলেন। কমলা বাঈ বলিল, “এই কয়েক মাস হইতে আমি তোমার যাতনা দেখিতেছি,—মনের আগুন গোপন করিতে গিয়া, তুমি তিল তিল করিয়া পুড়িয়া মরিতেছ। মায়ের এত যন্ত্রণা কি মেয়ের প্রাণে সহ্য হয়? তোমার যদি অসহনীয় কষ্টই হইল, তবে আমার বাঁচিয়া থাকিয়া লাভ কি? মা, আমি বর্জরজীকে বিবাহ করিব।”
রাজাবাঈ উন্মত্তার ন্যায় কন্যার মুখের দিকে চাহিলেন। ব্যাকুল ভাবে বলিলেন, “না— না—না—তুই তাকে জানিস্ না।”
“বেশ জানি। তবুও আমি তাহাকে বিবাহ করিব।”
“না—না—না—কিছুতেই না।”
“তাহা না করিলে লোকের নিকটে—সমাজে আমাদের মুখ দেখাইবার উপায় থাকিবে না, এই সকল ভয়নাক কথা প্রকাশ হইলে বাবার মাথা হেঁট হইবে—আমাদের দেখাইয়া লোকে হাসিবে—কুচরিত্রা বলিবে—আমাদের বাঁচিয়া থাকিয়া ফল কি?”
“না—না—না—তুই তাহাকে জানিস্ না। আমি মরিতেছি—প্রাণ থাকিতে কখনই তোকে এ বিবাহ করিতে দিব না।”
“আমার কোন কষ্ট হইবে না। আমাদের বংশের মান-সম্ভ্রম রক্ষা করা আমার কি কৰ্ত্তব্য নয়? যদি ইহা না পারি, তবে আমার মৃত্যুই শ্রেয়ঃ।”
“কমলা আর তুই আমাকে কষ্ট দিস্ না। যথেষ্ট কষ্ট পাইয়াছি।”
“যাহাতে তোমার আর কষ্ট না থাকে, তাহাই করা আমার কাজ।”
“তুই তাহাকে জানিস্ না—সে রাক্ষস।”
“আমি জানি।”
“সে কেবল টাকা পাইবার জন্য তোকে বিবাহ করিতে চায়।”
“তাহাও আমি জানি।”
“আমি কোন্ প্রাণে তোকে তার হাতে দিব?”
“মা, তাহা না হইলে আমাদের আর মুখ দেখাইবার উপায় থাকিবে না। লোকে তোমায় কুচরিত্রা বলিলে আমি কি বাঁচিব? আমি কি আত্মহত্যা করিব না? বাবা এ কথা শুনিলে কি করিবেন কে জানে! এই দুরাত্মা আমাকে পাইলেই যদি আমাদের মান-সম্ভ্রম রক্ষা হয়, তাহা হইলে তাহা করা কি অমাদের উচিত নহে?”
এই বলিয়া কমলাবাঈ বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে কয়েকখানি অলঙ্কার বাহির করিয়া জননীর সম্মুখে রাখিল।”
রাজাবাঈ সেই গহনা কয়েকখানি দেখিয়া এত চমৎকৃত হইল যে, সেখানে কয়েকটা উদ্যতফণা সর্পকে দেখিলেও বোধ হয়, তেমন হইতেন না। ব্যগ্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কমলা, এ গহনা কোথায় পাইলে?”
কমলা বলিল, “আমি সব জানি। তোমার গায়ে একখানাও গহনা নাই, বাবা যদি কোন দিন গহনার খোঁজ করেন, সকলই প্রকাশ হইয়া যাইবে—সৰ্ব্বনাশ হইবে—এই ভয়ে আমি মাঞ্চারজীর নিকট হইতে গোপনে বন্ধকী রসিদ আদায় করিয়া, নিজের কয়েকখানি গহনার বদলে এই কয়েকখানি গণেশ মলের নিকট হইতে ছাড়াইয়া আনিয়াছি। এইগুলি তুমি সর্ব্বদা পরিতে— এইগুলি আগে ছাড়াইয়া আনিয়াছি। এইগুলি তুমি সর্ব্বদা পরিতে—এইগুলি আগে দরকার।”
রাজাবাঈ ব্যাকুলভাবে কাঁদিয়া উঠিলেন। কমলা সেদিকে না চাহিয়া বলিতে লাগিল, “আমার জীবন কি—আমার সুখ-দু’খ কি—হায়, শেষে আমার সবই গেল—আমি মরিতে বসিয়াছি—মরিব!”
কমলাও আর আত্মসংযম করিতে পারিল না—কাঁদিয়া উঠিল।
এই সময়ে আর একটি সুন্দরী আসিয়া ধীরে ধীরে কমলার পার্শ্বে বসিল। সস্নেহে তাহার হাত ধরিল। এবার যে আসিল-সে রতন।
রতন আসিয়া পার্শ্বে বসিয়া কমলার হাত ধরিলে কমলা হৃদয়ে পূৰ্ব্বাপেক্ষা বল পাইল। কমলা সত্বর চোখের জল মুছিল। বলিল, “মা, আমি কাহারই কথা শুনিব না,—আমি বর্জরজীকে বিবাহ করিব। আমি নিজেই তাহাকে আজই পত্র লিখিব।”
“না—না—আমি বাঁচিয়া থাকিতে না,” বলিয়া রাজাবাঈ চমকিত হইয়া কমলার দিকে চাহিলেন। তাঁহার পার্শ্বে রতনবাঈকে দেখিয়া বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইলেন। তাঁহার শিরার সমস্ত শোণিত যেন রুদ্ধ হইয়া গেল। তাঁহার কণ্ঠ হইতে বাক্য নিঃসৃত হইল না।
কমলা বলিল, “রতন সকলই জানে। মা, রতন আমার আর দাসী নয়। রতন রস্তমজীকে রক্ষা করিয়াছে—রতন এখন হইতে আমার বোন। সে সকলই জানে—তাহার জন্য তোমার ভয় নাই। বরং আমার মুখ হইতে কথা বাহির হইতে পারে—তাহার মুখ হইতে কখনও একটি কথা বাহির হইবে না।”
রতন ধীরে ধীরে আসিয়া রাজাবাঈ-এর পদপ্রান্তে বসিল। তাঁহার হাত দুইখানি ধরিল। বলিল, “মা, এই দুরাত্মার দণ্ড দেওয়া কি আমাদের উচিত নয়?”
রাজাবাঈ ব্যাকুলভাবে তাহার দিকে চাহিলেন; তাঁহার দুই চক্ষু দিয়া দরবিগলিত ধারে অশ্রু বহিতে লাগিল।
রতনবাঈ বলিল, এই রাক্ষসের সহিত কমলার বিবাহ হইবে না। তাহার পূর্ব্বেই ইহার সমুচিত দণ্ড হইবে। আপনি অধীর হইবেন না। নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি বলিতেছি, এই বিবাহ কিছুতেই হইবে না। কমলার সহিত রস্তমজীরই বিবাহ হইবে।”
শেষের কয়েকটি কথা এরূপভাবে রতনের কণ্ঠ হইতে নির্গত হইল সে, কমলা চমকিত হইয়া তাহার দিকে চাহিল।
রতনবাঈ বলিল, “কমলা জানেন, আমাদের এক বৃদ্ধ মারাঠী বন্ধু আছেন। ইনি রস্তমজীর পিতার বন্ধু ছিলেন। নাম কাশীনাথ নায়েক। ইনিই রস্তমজীকে রক্ষা করিয়াছেন। আমি এখনই তাঁহার নিকট যাইতেছি। তিনি আমাদের সকলকেই রক্ষা করিবেন।”
এই বলিয়া রতন গমনোদ্যত ভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল। রাজাবাঈ ত্রস্তভাবে বলিলেন, “তোমার কথায়, আমি কেন জানি না, আমার প্রাণে আবার আশার সঞ্চার হইতেছে। বাছা, তুমি ত দাসী নও—তুমি কে?”
“মা, যদি সময় পাই, একদিন বলিব,” বলিয়া রতন সত্ত্বর সেখান হইতে প্রস্থান করিল।
তখন মা ও মেয়ে উভয়ে উভয়ের গলা জড়াইয়া আকুলভাবে কাঁদিতে লাগিলেন। চক্ষের জলে অনেক সময়েই প্রাণের জ্বালার অনেক লাঘব হয়।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – দুরভিসন্ধি
এদিকে বর্জরজী নিম্নে আসিয়া হরমসজীর সহিত সাক্ষাৎ করিল।
তাঁহাদের উভয়ের বহুক্ষণ ধরিয়া কথোপকথন হইল। তৎপরে বরজী আফিস হইতে বাহির হইয়া গেল। সেখান হইতে বাসায় ফিরিল। দেখিল, মাঞ্চারজী চেয়ারে বসিয়াই নিদ্রা যাইতেছে।
বর্জরজী অতিশয় ঘৃণার সহিত তাহার দিকে চাহিল। বলিল, “এমন অপদার্থ জীব লইয়াও আমাকে কাজ করিতে হইতেছে! ইচ্ছা করিলে এখনই ইহাকে সরাইতে পারি; কিন্তু ইহাকে সরাইলে পাছে রাজাবাঈ গোল করে, তাহাই পারিতেছি না। থাক তুমি, আরও দিন কতক।” বলিয়া সে সবলে মাঞ্চারজীকে নাড়া দিল। মাঞ্চারজী চমকিত হইয়া জাগিয়া উঠিয়া বসিল। ঘুমের ঘোরে প্রথমে কিছু বুঝিতে পারিল না।
বর্জরজী ঘৃণাভরে বলিল, “ঘুমাইবার সময়ই বটে!”
মাঞ্চারজী বলিল, “কি করিতে হইবে বল।”
বর্জরজী বলিল, ভাল কথা শুনিবার অবস্থা আছে কি?”
“কেন থাকিবে না।”
“তবে শোন, পুলিস আমাদের পশ্চাতে লাগিয়াছে। একটু অসাবধান হইলেই তুমিও মরিবে, আমিও মরিব।”
“উপায় কি?”
“আমার কিছু করিতে পারে, এমন পুলিস এখনও জন্মায় নাই।”
“তাহা জানি।”
“যদি কোন বিপদ্ হয়, তোমার মূর্খতার জন্যই হইবে।”
“যাহা বলিতেছি, তাহাই ত করিতেছি।”
“এখন আর ঝগড়া মারামারি করিবার সময় নাই। তাহা হইলে মারা যাইবে।”
“বল, কি করিতে হইবে।”
“আমাদের বাঁচিবার একমাত্র উপায় আছে।”
“কি?”
“কমলাকে আমার বিবাহ করা।”
“সে ত আগেই শুনিয়াছি।”
“আমার সঙ্গে কমলার বিবাহ হইলে হরমসজী তখন বাধ্য হইয়া আমাদিগকে রক্ষা করিবেন। তাঁহার ধন মান ক্ষমতা তিনই আছে, তিনি আমাদের সহায় থাকিলে কে আমাদের কি করে?”
“সুন্দর বন্দোবস্ত, তার পর?”
“ঠাট্টা—দেখ নিজেই মারা যাইবে, আমার কিছুই হইবে না।”
“ঠাট্টা করিতেছি না—তাহার পর কি বন্দোবস্ত, তাহারই আজ্ঞা হউক।”
“সেই বুড়ী মাগী পুলিসের হাতে পড়িয়াছে—”
সে আমার মা—এই বুঝিয়া তাহার সম্বন্ধে কথা বলিয়ো।”
“পুলিসের হাত থেকে তাকে সরাইতে হইবে—নতুবা আমাদের সমূহ বিপদ।”
“সে রওনা হইয়াছে—এখন তাহাকে কোথায় পাইবে? তাহাকে এখানে পৌঁছিতে দাও।”
“এখানে একবার পৌঁছিলে তাহার সহিত আমাদের সাক্ষাৎ করা অসম্ভব। তাহা হইলে তাহাকে তখন একেবারে উড়াইয়া দিতে হইবে তখন তাহাকে আমরা একেবারে চিনিব না।”
“বটে? তিনি আমার মা।”
‘সেই জন্য আমি আজই রওনা হইব। পথে কোন স্টেশনে থাকিব, কলিকাতার গাড়ী সেই স্টেশনে আসিলে তাহাকে সরাইব।”
“তাহা হইলে মহাশয় আজই রওনা হইবেন। হুঁ, বুঝিয়াছি, মহাশয় টাকাগুলি লইয়া চম্পট দিতেছেন। আর এই গরীব বেচারা এখানে থাকিয়া জেলে যাক্।”
বর্জরজীর ঘোরতর রাগ হইল। বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে এক তাড়া নোট মাঞ্চারজীর ক্রোড়ে নিক্ষেপ করিয়া বলিল, “এমন জানোয়ারকে লইয়াও আমাকে চলিতে হইতেছে! এই সমস্ত টাকা তোমার কাছেই রহিল। এখন যদি মরিতে না চাও ত, যাহা বলি শোন।”
মাঞ্চারজী বলিল, “মহাশয় গো, রাগ করিবেন না। সমান সমান বিপদ্—টাকার সময়
সমান সমান ভাগ হইলেই আর বিবাদ-বিসম্বাদ হয় না।”
“টাকা আমার যথেষ্ট হইবে—সব টাকাই ত তোমাকেই রাখিতে দিলাম।”
“উত্তম বন্দোবস্ত! এখন আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত আছি।”
“আমি এখনই রওনা হইতেছি। যেমন করিয়া হয়, তোমার মাকে পুলিসের হাত হইতে সরাইতে হইবে।”
“উচিত বটে, কিন্তু সে কি এতক্ষণ সব কথা বলিয়া ফেলে নাই?”
“বলুক—পুলিস তাহাকে খুঁজিয়া না পাইলে কিছুই করিতে পারিবে না।”
“তাহাকে সরাইবে কেমন করিয়া।”
“দেখি পুলিশ কত বুদ্ধি ধরে।”
“আমি জানি, তোমার অসাধ্য কাজ কিছুই নাই।”
“এখানে খুব সাবধানে থাকিবে। কাহারও সঙ্গে দেখা করিয়ো না। রাজাবাঈ-এর সহিত যেমন দেখা করিতে তেমনি করিয়ো। তাহাদের কাহাকেও কোন কথা বলিয়ো না। তবে আমি এখন রওনা হইলাম।”
“আচ্ছা।”
বর্জরজী প্রস্থান করিলে মাঞ্চারজী বলি, “আমার গুণধর খুল্লতাত মহাশয় আমাকে একটি জানোয়ারই মনে করিয়াছেন। এখন টাকাগুলি হস্তগত হইয়াছে—আর এখানে তিলার্দ্ধ দেরী করা উচিত নয়—সরিয়া পড়াই কৰ্ত্তব্য। খুল্লতাত মহাশয় ফিরেন ত ভাল। আমি ইহার মধ্যে সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া লই। তিনি আসিয়া দেখিবেন, খাঁচা খালি। হা-হা-হা!”
এই বলিয়া মাঞ্চারজী একটা বিকট হাস্য করিয়া উঠিল। ভৃত্য দ্বারের পার্শ্বে থাকিয়া সকল কথা শুনিতেছিল; এখন সে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে সরিয়া গেল।
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – রহস্যের আর একটুকু
একদিন অত্যন্ত ক্ষুণ্নমনে দাদাভাস্কর কীর্ত্তিকরের নিকটে আসিয়া বলিলেন, “গুরুদেব যা করেন, তার উপর কথা নাই—আমার কেস্টী একেবারে মাটি হয়ে গেল।”
সেখানে বৃদ্ধ লালুভাইও বসিয়াছিলেন, তিনি দাদাভাস্করের মুখের দিকে সবিস্ময়ে চাহিলেন। কীর্ত্তিকর, বলিলেন, “কেন হে?”
দাদাভাস্কর বলিলেন, “আর কেন, আপনি অনর্থক বিলম্ব করছেন?”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “কি করিতে বল।”
দাদাভাস্কর বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “বলি, আমার মাথা আর মুণ্ড।”
কীর্ত্তিকর হাসিয়া বলিলেন, “ও! তোমাকে আজ যে ভারি উষ্ণ দেখিতেছি।”
দাদা। পিঠের দুপদা চামড়া উঠে গেলে সকলেই উষ্ণ হয়। বেটার নড়ে চড়ে, আর তেড়ে এসে মার লাগায়—যেন কোম্পানীর নাগড় পেয়েছে। আর দিন কত এই রকম চাকরী বজায় রাখতে হলে, চট করে ভবলীলাটা সাঙ্গ হয়ে যাবে।
কীৰ্ত্তি। আজ-কাল বড় বাড়াবাড়ী নাকি?
দাদা। বেজায়—বেটারা যেন সাপের পাঁচ পা দেখেছে—এমন বিদকুটে বদমায়েস আমি আমার বয়সে আর কখনও দেখি নাই।
কীৰ্ত্তি। এই ত বয়স তোমার সাতাশ আটাশ, এখনও অনেক দিন পড়িয়া আছে। এই পুলিশ লাইনে থাকিলে ইহার অপেক্ষাও আরও অনেক ভারি ভারি বদমায়েস দেখিতে পাইবে।
দাদা। সেজন্য দাদাভাস্কর প্রস্তুত আছে, কিন্তু এখন এ দুই ব্যাটাকে গ্রেপ্তার করে চালান দিন।
কীর্ত্তি। ভয় নাই, আর কাহাকেও চালান দিতে হইবে না।
দাদা। কেন?
কীর্ত্তি। তোমার মাম্লা জিত হইয়া গিয়াছে। তোমার কাজ ভগবান্ করিয়া দিয়াছেন। দাদা। আপনি ত সকল সময়ই আমাকে উপহাস করেন।
“উপহাস নয়—এই দেখ,” বলিয়া কীর্ত্তিকর দাদাভাস্করের হস্তে একখানি পত্র দিলেন।
দাদাভাস্কর পত্রখানি পড়িলেন; –
“মাননীয় পুলিস কমিশনার সাহেব, বোম্বাই।
মহাশয়,
আমার ব্যাঙ্কের সিন্দুক হইতে এক লক্ষ টাকা চুরী যায়। সেই চুরীর জন্য আপনার কর্ম্মচারিগণ আমার খাজাঞ্চী রস্তমজীকে গ্রেপ্তার করেন; কিন্তু তাঁহার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ না থাকায় তাঁহাকে খালাস দেওয়া হয়।
আপনাকে আনন্দের সহিত জানাইতেছি যে, ঐ টাকা একেবারেই চুরী যায় নাই। বোধ হয়, ভুলক্রমে রস্তমজী নোটগুলি সিন্দুকের উপর রাখিয়া সিন্দুক খুলিয়াছিলেন। ডালা তুলিবার সময় ঐ নোটের তাড়া সিন্দুকের পাশে পড়িয়া যায়।
যে কারণেই হউক, রস্তমজী মনে করিয়াছিলেন যে, তিনি নোট সিন্দুকের মধ্যে রাখিয়াছিলেন; কিন্তু সেটা তাঁহার ভুল, এখন দেখিতে পাইতেছি।
আজ ঐ সিন্দুক রং করিবার জন্য সরাইলে নোটের তাড়া সিন্দুকের পাশ হইতে পাওয়া গিয়াছে। রস্তমজী যে বৃথা নানা কষ্ট পাইয়াছেন, ইহাতে আমি প্রাণে বড়ই কষ্ট পাইয়াছি। আপনাদিগকেও অনর্থক কষ্ট দিয়াছি বলিয়া বিশেষ দুঃখিত হইয়াছি।
কিন্তু আমি ইচ্ছা করিয়া এরূপ করি নাই, ইহা অবগত হইয়া আপনি ও আপনার সুদক্ষ কর্ম্মচারিগণ সকলেই আমাকে নিশ্চয়ই অনুগ্রহ করিয়া ক্ষমা করিবেন। এ চুরি সম্বন্ধে আর আপনাদের কোন কষ্ট পাইতে হইবে না। আমি আমার টাকা পাইয়াছি।
বশম্বদ
হরমসজী—ব্যাঙ্কার
এলফিনষ্টোন সারকেল।
বোম্বাই।”
কীর্ত্তিকর হাসিয়া বলিলেন, “দেখিলে দাদাভাস্কার, উপহাস করিতেছিলাম কি? ভগবান্ তোমার কেস মিটাইয়া দিয়াছেন।”
দাদা। কিছুই বুঝিলাম না।
কীৰ্ত্তি। এই চিঠীখানি বাহির করিলে তোমার আসামীকে তখনই বেকসুর ছাড়িয়া দিতে হইত। তাঁহার নিকট কোন কথাই জানিতে পারিতে না।
দাদা। তবে কি এ কেস এই পৰ্য্যন্ত?
কীৰ্ত্তি। কাজেই। তুমি একটা দায় হইতে উদ্ধার পাইলে।
দাদা। সরকারী চাকরী, এখনই ত আবার একটা ঘাড়ে চাপিবে।
কীৰ্ত্তি। বসিয়া বসিয়া প্রতিমাসে ১লা তারিখে মাহিনা পকেটস্থ করিতে পারিলেই খুব খুসী — না?
দাদা। আপনি যাহা ইচ্ছা বলিতে পারেন। সে কথা যাক, হরমসজী যাহা লিখিয়াছেন, তাহা কি আপনি বিশ্বাস করেন?
কীৰ্ত্তি। আমি ত পাগল হই নাই।
দাদা। তিনি তবে এ চিঠী কেন লিখিলেন? লাখ টাকা চুরি গেল—আর টাকা না পাইয়া চুপ্ করিয়া থাকিবেন। বোধ হয়, টাকা পাইয়াছেন।
কীৰ্ত্তি। এক পয়সাও নয়।
দাদা। (সবিস্ময়ে) তবে?
কীৰ্ত্তি। তবে? পরে জানিতে পারিবে।
বৃদ্ধ লালুভাই বলিলেন, “এই ত্রিশ বৎসর ডিটেটিভ ডিপার্টমেন্টে চাকরী করিতেছি—চুল পাকিয়া গেল; এই চুরি আর খুনের মত গোলযোগে ব্যাপার আর কখনও দেখি নাই। যাই হোক, দাদাভাস্কর ভায়া নিষ্কৃতি পাইলেন—আমি কবে যে এ পাপ মোকদ্দমার হাত হইতে এড়াইব; তাহা ভগবান্ জানেন।”
কীর্ত্তি। ভয় নাই। আপনার আসামী শীঘ্রই ধরা পড়িবে, সাজাও পাইবে। আসুন, এখন তিন জনে মিলিয়া এই খুনের তদন্ত করা যাক্। আরও শুনিয়াছেন, হরমসজী বর্জরজীকে কন্যা সম্প্রদান করিবেন। ইহার ভিতরেও গভীর রহস্য আছে। ইহারও তদন্ত দরকার—রহস্য ক্রমেই গভীর হইতেছে।
লালুভাই বলিলেন, “তাহা হইলে আমাদের অনুমান ঠিক।”
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – বেনামী পত্র
প্রায় সপ্তাহ পরে হঠাৎ একদিন কাশীনাথ আসিয়া উপস্থিত। রস্তমজী তাঁহাকে বসিতে আসন দিয়া কুশল প্রশ্ন করিলেন।
কাশীনাথ বলিলেন, “আমার কুশল সংবাদের জন্য ব্যস্ত হইবার আবশ্যকতা নাই। এই কয়দিন তুমি কি করিয়াছ, একটা হিসাব দাও দেখি। কোন নূতন খবর আছে কি?”
রস্তমজীর মুখ সহসা লাল হইয়া উঠিল। ভগ্নকন্ঠে বলিলেন, “আমি একটা বড় দুষ্কৰ্ম্ম করিয়া ফেলিয়াছি—কাজটা নির্ব্বোধের মত—”
কাশীনাথ বাধা দিয়া বলিলেন, “গৌরচন্দ্রিকা রাখ, কি করিয়াছ বল।”
রস্তমজী বলিলেন, “আমি একখানা সংবাদ পত্রে দেখিতে পাইলাম, বর্জরজীর সহিত কমলার বিবাহ হইবে; আমি হরমসজী সাহেবকে একখানা বেনামী চিঠী দিয়াছি; লিখিয়াছি, মাঞ্চরাজীর সহিত তাঁহার স্ত্রীর—”
বাকীটা রস্তমজী শেষ করিতে পারিলেন না, ঠিক সেই সময়ে কাশীনাথের দৃঢ়মুষ্টি টেবিলের উপরে সশব্দে পড়িল, এবং টেবিলের উপরিস্থিত জিনিষগুলা ঝন্ ঝন্ করিয়া উঠিল। রস্তমজী চাহিয়া দেখিলেন, নায়েক মহাশয়ের প্রফুল্ল মুখকান্তি প্রাবৃট-প্রদোষের মেঘের মত গম্ভীর হইয়াছে।
কাশীনাথ বলিলেন, “কি ভয়ানক বোকামী—একদিনে একেবারে সব মাটি করিয়া দিলে!” আর কিছু না বলিয়া চেয়ার ছাড়িয়া কাশীনাথ উঠিয়া পড়িলেন; এবং অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে গৃহমধ্যে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার পদক্ষেপে গৃহতল ঘন ঘন কম্পিত হইতে লাগিল। রস্তমজী কাশীনাথের এমন বিচলিত ভাব আর কখনও দেখেন নাই।
সহসা কাশীনাথ থামিয়া, ফিরিয়া কঠিনকণ্ঠে রস্তমজীকে সক্রোধে বলিলেন, “তুমি কেন বালকের মত, বোকার মত, মূর্খের মত এমন কাজ করিলে? তোমার মত অর্বাচীন আর দুটি নাই!”
“মহাশয়—”
“তোমার মুণ্ড; তুমি ডুবিয়া যাইতেছ, দেখিয়া তোমাকে ধরিবার জন্য একজন জলে ঝাঁপাইয়া পড়িল, তোমাকে সে প্রায় কূলে টানিয়া আনিয়াছে, এমন সময়ে তুমি নিতান্ত আহাম্মুখের মত তাহার পা দুটী এমন কঠিনভাবে জড়াইয়া ধরিলে যে, তাহারও সন্তরণ বন্ধ। আমি যাইবার সময় তোমাকে কি বলিয়া গিয়াছিলাম? মনে আছে, না স্মরণ-শক্তির মস্তকটাও একেবারে ভক্ষণ করিয়া বসিয়া আছ?”
“আপনি আমাকে নিশ্চেষ্টভাবে বাসার মধ্যেই থাকিতে বলিয়া গিয়াছিলেন।”
“এই ত বেশ স্মরণ আছে; তবে এমন সচেষ্ট হইবার কি দরকার ছিল?” নায়েক মহাশয়ের স্বরে গুপ্ত বিদ্রূপের আভাস ছিল।
শিক্ষকের নিকটে তিরস্কৃত হইয়া বিদ্যালয়ের ভয়ার্ত ছাত্রের মত কম্পিত কণ্ঠে রস্তমজী বলিলেন, “পরশ্বঃ রাত্রে বড় গরম পড়িয়াছিল, গরমে মাথাটা বড় ধরিয়াছিল; আর বাসায় বসিয়া বসিয়া মনটাও যত অপ্রসন্ন হইয়া উঠিয়াছিল, কিছু ভাল না লাগায় একটু বেড়াইতে বাহির হইয়াছিলাম। পথে একখানা সংবাদ-পত্র কিনিয়া দেখি, এ ব্যাপার—বর্জরজীর সঙ্গে কমলার বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে।”
কেন—তুমি প্ৰতিশ্ৰুত আছ, সকল বিষয়েই তুমি আমার উপরে নির্ভর করিবে।”
“কিন্তু আপনি উপস্থিত ছিলেন না; আর আপনিও বোধ হয়, এরূপ সংবাদ শুনিয়া বিস্মিত হইতেন।”
নিতান্ত অস্থিরভাবে কাশীনাথ বলিলেন, “থাক, আর যুক্তি প্রয়োগে দরকার নাই। যারা নিতান্ত বোকা—বোকামীর সময় তারা এইরূপ বিস্মিত হয়। কি মুস্কিল-বেনামী চিঠী! তুমি ঠিক জান না, আজ আমাকে তুমি কি মস্ত বিভ্রাটে ফেলিলে। কোন কোন লোককে কোন কোন বিষয়ে আমি আশ্বাস দিয়াছিলাম, তাদের কাছে আর আমার মান-সম্ভ্রম রহিল না দেখিতেছি; তোমার জন্য তাদের কাছে আমাকে মিথ্যাবাদী প্রবঞ্চক হইতে হইল। আমি যে এখানকার একজন—” বলিতে বলিতে সহসা মধ্যপথে থামিয়া গিয়া বলিলেন, এখন আর বাজে কথায় কাজ নাই, এখন তুমি যে ভুল করিয়া বসিয়াছ, উহার সংশোধনের চেষ্টা করা দরকার হইতেছে। কখন তুমি সেই সৰ্ব্বনেশে পত্র ডাকঘরে দাও।”
“রাত তখন দশটা হইবে; চিঠীখানা চিঠীর বাক্সে ফেলিয়া আমার মনে বড় অনুতাপ হইতে লাগিল।”
“চিঠীখানা হাত হইতে বাক্সের মধ্যে খসিবার পূর্ব্বে সেই অনুতাপটা উপস্থিত হইলে কাজ হইত। যাক্ তাহা হইলে তোমার সেই অমৃতময় পত্র কাল প্রথম ডাকেই হরমসজীর হস্তগত হইয়াছে। বোধ হয় প্রথম ডাকের পত্রগুলি তিনি নিজের বসিবার ঘরেই পড়িয়া থাকেন—সে সময়ে সেখানে তিনি একা থাকেন?”
“হাঁ, প্রথম ডাকের পত্রগুলি তিনি নিজের বসিবার ঘরেই পড়েন। দশটার পর আফিসে আসিয়া বসেন।”
“তোমার পত্রের কথাগুলি মনে আছে কি? বেশ ভাবিয়া-চিন্তিয়া মনে করিয়া বল দেখি, ইহা এখন আমার জানা দরকার হইয়াছে।”
“ভাবিয়া-চিন্তিয়া বলিতে হইবে না, আমার আগাগোড়া বেশ মনে আছে”, বলিয়া রস্তমজী—পত্রে যাহা লিখিয়াছিলেন, বলিলেন।
বিশেষ মনোযোগের সহিত কাশীনাথ সমস্তটা শুনিয়া গেলেন। ভ্রূ ও ললাট কুঞ্চিত করিয়া নীরবে অন্যদিকে চাহিয়া বসিয়া রহিলেন। এবং কি উপায়ে তিনি এই বৃহৎ ভ্রমের সংশোধন করিবেন, ভাবিতে লাগিলেন। অনন্যোপায় হইয়া তিনি মনে মনে অত্যন্ত অস্থির হইয়া উঠিলেন। অনেকক্ষণ পরে বলিলেন, “একেবারে জঘন্য পত্র! একেবারে সব কথা পরিষ্কার করিয়া লিখিয়া গিয়াছ! তুমি কেবল নির্ব্বোধের মত কাজ কর নাই—এ কাজ বর্বরোচিত হইয়াছে—যাহার একবিন্দু বিবেচনা-শক্তি আছে, সে কখনও কাহাকে এমন সাংঘাতিক পত্ৰ লিখিতে পারে না। তুমি আবার বল—কি লিখিয়াছ।”
রস্তমজী আবার বলিলেন। পুর্বে যাহা বলিয়াছিলেন, এবারেও ঠিক তাহাই বলিয়া গেলেন, একটি শব্দেরও গোলমাল হইল না।
কাশীনাথ বলিতে লাগিলেন, “চূড়ান্ত হইয়াছে—এমন রচনায় যে তুমি সিদ্ধহস্ত, তা আমি আগে জানিতাম না। ‘সেই ব্যক্তিই কি আপনার পত্নীর অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়া বাজারে বন্ধক দিয়াছে?’ কি ভয়ানক —ইহার ফল ত ভয়ানক হইবারই কথা। তাহার পর কি বিষম বিদ্রূপাত্মক উপদেশ ‘কিন্তু আমি হইলে কদাচ সাধারণের নিকট এরূপ নিন্দার্হ হইয়া থাকিতে পারিতাম না;’ ইহার উপর ‘স্ত্রীর উপরে নজর রাখিতাম।’ রস্তমজী তোমার এ পত্রের ফল বড়ই শোচনীয় হইবে দেখিতেছি।”
এই বলিয়া তিনি চিন্তিতভাবে রস্তমজীর মুখের দিকে চাহিয়া ছিলেন। ক্ষণপরে বলিলেন, “রস্তমজী, হরমসজী কি বড় বদ্রাগী লোক?”
রস্তমজী বলিলেন, “না, সহজে রাগেন না, কিন্তু রাগিলে আর রক্ষা থাকে না।”
“তা হইলে ত আর উপায় নাই—বিপটা অবশ্যম্ভাবী।”
“কি বিপদ?”
“বিপদ্ ভয়ানক—একেবারে সব মাটি! কোন বিবেচক লোক রাগের মাথায় সহসা কোন কাজ করে না; কিন্তু হরমসঙ্গী যদি এখন তোমার চিঠী পড়িয়া রাগিয়া অস্থির হইয়া রাজা বাঈএর কাছে গিয়া আদেশ করেন, হীরামুক্তার অলঙ্কারগুলি বাহির করিয়া দাও। তখন সমুদয়ই প্রকাশ হইয়া পড়িবে; বাধ্য হইয়া রাজাবাঈ নিজের অপরাধ স্বীকার করিয়া লইবেন। আর আমাদেরও আশালতা ঐখানে সমূলে উৎপাটিত হইয়া যাইবে।”
“ভাল বুঝিতে পারিলাম না।”
“তা যদি পারিবে—তাহা হইলে এমন পত্র পাঠাও! ওদিকে রাজাবাঈ-এর মুখ খুলিবে—আর এদিকে পাখীও উড়িবে; মাঞ্চারজী কি বর্জরজীকে আর কিছুতেই কায়দা করিতে পারা যাইবে না। তাহারা যদি এখন সরিয়া পড়ে, তবে ঐখানে তোমারও দুর্নামের একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হইয়া গেল।”
রস্তমজী কি বলিতে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে দ্বারের দিকে তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। দেখিলেন, দ্বারদেশে রতনবাঈ। রতনবাঈ ধীরে ধীরে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ – রতনের দৌত্য
কাশীনাথ রতনবাঈকে দেখিয়া বলিলেন, “এই যে রতন, কি মনে করে? তোমার মুখ দেখিয়া বোধ হইতেছে—অনেক নূতন খবর আছে।” বলিয়া জিজ্ঞাসমাননেত্রে রতনের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
রতনবাঈ বলিল, “মনিব-বাড়ীতে একটা কিছু হইয়াছে— যেরূপ ব্যাপার দেখিতেছি, তাহাতে বোধ হয়, একটা দারুণ দুর্ঘটনার সূত্রপাত হইয়াছে। কমলাবাঈ আপনাকে সংবাদ দিবার জন্য তাড়াতাড়ি আমাকে আপনার কাছে পাঠাইয়া দিলেন।”
কাশীনাথ বলিলেন, “হাঁ, কমলা বড় বুদ্ধিমতী। ভাল কাজই করিয়াছে। তোমাদের বাড়ীতে এখন বর্জ্যরজীর যাতায়াত কিরূপ?’
রতন বলিল, “বিবাহের কথা ঠিক হওয়াতে যাতায়াত খুবই চলিয়াছে।”
কথাটা শুনিয়া, রস্তমজী রাগিয়া অস্থির হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, “কি! সেই বদমাস খুনী চোর এখনও হরমসজীর বাড়ীতে ঢুকিতে পায়—কমলার সহিত বাক্যালাপ করে? মহাশয়, ইহার নাম কি আপনার প্রতিজ্ঞা পালন। আপনি যে আশা দিয়ে আমাকে একেবারে আকাশে তুলিয়াছিলেন, তা কি—”
বাধা দিয়া কাশীনাথ নায়েক বলিলেন, “বহুৎ আচ্ছা—আর বেশী বুদ্ধি প্রকাশ করিবার দরকার নাই—যা করিয়াছ, তাই সামলান দায় হইয়া উঠিয়াছে; যদি তুমি নিজেকে নিজেই রক্ষা করিতে না পার, তবে তোমার জন্য যাহারা যুঝিতেছে, তাহাদের কাজে বাধা দিয়া আরও বোকামী করা কেন? এক বেনামী চিঠী লিখিয়া ত আমাকে মহা মুস্কিলে ফেলিয়াছ!”
অত্যন্ত রুক্ষস্বরে রস্তমজীকে এইরূপ তিরস্কার করিয়া কাশীনাথ নায়েক রতনের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “বল ত বাছা—কি বলিতেছিল। হরমসজীর বাড়ীর গোলযোগের কারণটা কিছু বুঝিতে পারিয়াছ কি?”
রতন কহিল, “না, ঠিক এখনও বুঝিতে পারি নাই। তবে ব্যাপার যেরূপ দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে আমার আশঙ্কা হইতেছে শীঘ্রই একটা কিছু ভায়নক দুর্ঘটনা ঘটিবে। পূৰ্ব্বলক্ষণ সবই স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। আমি রাজাবাঈকে কোন কথা উত্থাপনের চেষ্টা করিলে তিনি অন্য কথা ফেলিয়া তাহা চাপা দিয়া ফেলেন; কোন সময়ে কথা না কহিয়া সরিয়া যান—সর্ব্বদা অন্যমনস্ক—কি ভাবিতেছেন, কি করিতেছেন, কিছুই বুঝিবার যো নাই।”
“হরমসজীর খবর কি?”
“হাঁ, আমিই সেই কথা বলিব মনে করিতেছিলাম। তিনিও বড় বিপন্ন। তাঁহারও মনে মন নাই; কাল হইতেই তাঁহার, এই ভাব—একেবারে নূতন কণ্ঠস্বর—যেন আর একজনের। সে স্বর ক্ষুব্ধ কর্কশ—মধুরতার নাম গন্ধ নাই। দৃষ্টি উন্মাদের, যে জিনিষটার দিকে চাহিয়া থাকেন, সেটা যে তিনি দেখিতেছেন এরূপ বোধ হয় না; কিন্তু সেই দৃষ্টি যখন রাজাবাঈ-এর দিকে পড়ে, তখন আরও ভয়ানক হয়ে উঠে। কাল সন্ধ্যার সময়ে যেমন তিনি শুনিলেন, মাঞ্চারজী আসিয়াছেন, অমনি একটা জরুরী কাজ আছে বলিয়া তীরবেগে ঘরের বাহির হইয়া গেলেন।”
কাশীনাথ নায়েক বলিয়া উঠিলেন, “তবেই ঠিক হইয়াছে; হরমসঙ্গী হঠাৎ রাগিয়া উঠিবার লোক নহেন—বয়স হইয়াছে, বড় রকমের ব্যবসা চালাইতেছেন, বিবেচক লোক—ঝাঁ করিয়া একটা কাণ্ড করিয়া ফেলিতে পারেন না—আমার অনুমানই ঠিক; কেমন রস্তমজী, এখন তিনি প্রমাণ সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিতেছেন?” রস্তমজীকে উত্তর করিবার অবসর না দিয়াই আবার তখনই তিনি রতনের দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “রাজাবাঈ আর তাঁহার কন্যা কি কাল বেড়াইতে বাহির হইয়াছিলেন?”
রতনবাঈ কহিল, “হাঁ, বৈকালে একবার বাহির হইয়াছিলেন।”
কাশীনাথ বলিলেন, “তাঁহারা বাহির হইয়া গেলে হরমসজী কি করিতেছিলেন, দেখিয়াছ?” রতন কহিল, “আমিও তাঁহাদের সঙ্গে বেড়াইতে গিয়াছিলাম।”
কাশীনাথ আপন মনে বলিলেন, “করিবেন আর কি—প্রমাণ সংগ্রহ—প্রমাণ তিনি ভাল রকমই পাইয়াছেন। (রস্তমজীর প্রতি) বাপু, তুমি এক চিঠিতে আমাকে মহা মুস্কিলেই ফেলিলে—এমন কাজও করে।”
কাশীনাথ নায়েকের কথায় রতনের মনে ধাঁধা অনেকটা ঘুচিয়া গেল। রতন বলিল, “ওঃ! এতক্ষণে আমি বুঝিতে পারিলাম। এখন হরমসঙ্গী সমুদয়ই জানিতে পারিয়াছেন।”
“হাঁ, তিনি মনে করিতেছেন, তিনি সকলই জানিয়া ফেলিয়াছেন, অনুকূল প্রমাণ পাইতেছেন। কিন্তু ভিতরে যে গূঢ় রহস্য আছে, তাহা হইতে তিনি এখনও অনেক দূরে আছেন কিন্তু রতন, তুমি, কিরূপে বুঝিলে তিনি এখন সকলই জানিতে পারিয়াছেন?”
রতন কহিল, “তিনি কাল গেটের দ্বারবানকে ডাকিয়া বলিলেন, যাহার নামে যে কোন চিঠী-পত্র আসুক না কেন, সকল চিঠীই যেন আগে তাঁহার হাতে দেওয়া হয়।”
কাশীনাথ বলিলেন, “কখন তিনি এই হুকুম জারী করিলেন?”
রতন কহিল, “সন্ধ্যার সময়।”
কাশীনাথ কহিলেন, “হাঁ, ঠিকই হইয়াছে; ব্যাপারটা গুরুতরই হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তিনি ঠিক পথই অবলম্বন করিয়াছেন। এইরূপ ভাবে ভিতরকার সমুদয় তথ্য সংগ্রহ করিয়া যখন তিনি কৃতনিশ্চয় হইতে পারিবেন, তখন অবলীলাক্রমে ইহার প্রতিশোধ দিবেন। কিন্তু এখন কথা হইতেছে, এ সময়ে কোন রকমে তাঁহাকে নিরস্ত করিতে পারা যায় কি না? তিনি যে বেনামী চিঠী পাইয়াছেন, তাহা যে একান্ত অমূলক, একথা এখন কোন রকমে যদি তাঁহাকে বুঝাইতে পারা যায়, তাহা হইলে—” সহসা মধ্যপথে থামিয়া কাশীনাথ নায়েক গভীর চিন্তামগ্ন হইলেন। অবনতমস্তকে ভাবিতে লাগিলেন।
অনেকক্ষণ চিন্তান্বিত থাকিয়া সহসা কাশীনাথ রতনের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “যাহা হউক, বাছা, তোমার কথায় অনেকটা ব্যাপার বুঝিতে পারা গেল। এখন শীঘ্রই যাহা হয়, একটা কিছু আমাকে করিতে হইবে। হাত পা গুটাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে চলিবে না। তুমি এখন সেখানে ফিরিয়া যাও, যখন যাহা ঘটে—সকল দিকেই যেন সতর্ক দৃষ্টি থাকে। যখন যে কাজ করিবে, বিবেচনা করিয়া করিয়ো। তোমার উপরেও হরমসঙ্গীর সন্দেহ হইয়াছে যে, তুমিও এই ষড়যন্ত্রের ভিতরে আছ। যখন যা ঘটে—সব খবরই যেন আমি পাই। স্মরণ থাকে যেন, অতি তুচ্ছ খবরও এখন মহা মূল্যবান্।”
রতনবাঈ চলিয়া গেল।
এমন সময়ে ভিত্তিসংলগ্ন ঘড়ীটাতে টং টং করিয়া বারটা বাজিয়া গেল। ঘড়ীর শব্দে কাশীনাথের চেতনার সঞ্চার হইল। তিনি বলিলেন, “কি বিভ্রাট! ইহারই মধ্যে বেলা বারটা, কিছু আহারের আবশ্যক ছিল যে।”
রস্তমজী কাশীনাথের এইরূপ বিচলিত ভাব দেখিয়া মনে মনে অত্যন্ত বিচলিত হইয়া উঠিয়াছিলেন; তিনি ক্ষুণ্ণভাবে কহিলেন, “তাই ত, আপনাকে আমি বড়ই বিপদে ফেলিলাম।”
কাশীনাথ বলিলেন, “হাঁ বাপু, মহাবিপদ্—এখন যে আমি কি করি, ভাবিয়া পাইতেছি না। দেখ দেখি বাপু! তোমার এক বেনামী চিঠীর জন্য এখন আমাকে কি ভয়ানক অসুবিধা ভোগ করিতে হইতেছে!”
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – বেনামী পত্রের ফল
কাশীনাথ যেরূপ ভাবিয়াছিলেন, রস্তমজীর সেই বেনামী পত্রখানা পাইয়া হরমসজীর ঠিক সেইরূপ ভয়ানক অবস্থাই হইয়াছিল।
বেলা তখন নয়টা। হরমসজী নিজের বসিবার ঘরে আসিয়া বসিয়াছেন, এমন সময়ে নয়টার ডাকের একতাড়া চিঠী তাঁহার হস্তগত হইল। তন্মধ্যে একখানি চিঠী দেখিয়া পাঠের পৰ্ব্বেই মনে কেমন একটা খট্কা লাগিল। পত্রখানার স্থানে স্থানে রকম রকম লেখা, এক একটা অক্ষরের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন মূৰ্ত্তি—দেখিয়া বোধ হয়, লেখক যেন পত্রের সর্ব্বত্র নিজের হস্তাক্ষর গোপন করিবার চেষ্টা করিয়াছে। পত্রখানি বেনামী। এমন বেনামী পত্র বাবসায়ীমাত্রেরই অনেক আসে, কাহারও পত্রে গালাগালি বর্ষণ—কাহারও পত্রে প্রহারের ভয় প্রদর্শন—কাহারও পত্রে অর্থের আবেদন—কারণ ব্যবসায়ীদিগকে নানা রকম লোকের সহিত কাজ-কারবার করিতে হয়। যাহা হউক, এই বেনামী পত্রের লেখক যে এমন মধুবর্ষণ (?) করিয়াছে, ইহা তাঁহার স্বপ্নাতীত। তিনি পত্রখানি পাঠ করিলেন;
“মহাশয়, আপনার খাজাঞ্জীকে কারাগারে পাঠাইয়া আপনি খুবই বিবেচকের ন্যায় কাৰ্য্য করিয়াছেন, সন্দেহ নাই। অবশ্যই আপনি তাহার সততার সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়াই এরূপ করিয়াছেন, কিন্তু এইটুকু আপনার একবার ভাবিয়া দেখা উচিত ছিল, যে আপনার সিন্দুক হইতে টাকা চুরী করিয়াছে, সেই ব্যাক্তিই কি আপনার পত্নীর অলঙ্কারগুলিও অপহরণ করিয়া বাজারে বন্ধক দিয়াছে।
আপনার প্রকৃতি কিরূপ জানি না; কিন্তু আমি যদি হইতাম, তবে কদাচ সাধারণের নিকট এরূপ নিন্দার্হ হইয়া নিশ্চেষ্ট থাকিতে পারিতাম না; সত্বরেই ইহার প্রতিকার করিতাম, নিজের স্ত্রীর উপরেও সর্ব্বদা নজর রাখিতাম, আর তাহার সুপুরুষ আত্মীয়দিগকেও আদৌ বিশ্বাস করিতাম না।
কোন হিতৈষী বন্ধু।”
পত্র পড়িয়া হরমসজীর মাথা ঘুরিয়া গেল। তাঁহার সুখ-সৌভাগ্যে কে এ বজ্রাঘাত করিল! অতীতের সুখচ্ছবি মানস-ক্ষেত্রে উদিত হইয়া তাঁহার বর্ত্তমানকে আরও ভীষণ করিয়া তুলিল। তাঁহার স্ত্রী তাঁহার সহিত প্রবঞ্চনা করিতেছে—অথচ সেই স্ত্রীর উপরে তাঁহার অটল বিশ্বাস— একান্ত নির্ভর। হরমসজী উন্মত্তের মত হইলেন, তাঁহার মস্তকে কে যেন অলক্ষ্য হস্তে একটা গুরুবার হাতুড়ী দিয়া বারংবার সবেগে আঘাত করিতে লাগিল। তাঁহার হাত পা, মন সকলই অবশ হইয়া গেল—তিনি স্তম্ভিতভাবে শূন্যদৃষ্টিতে সেই উন্মুক্ত বেনামী পত্রের দিকে চাহিয়া রহিলেন। সহসা তিনি দারুণ ক্রোধে অধীর হইয়া উঠিলেন। দন্তে দন্তে ঘর্ষণ করিয়া বলিলেন, “আমি কি নির্বোধ’—কোন্ ইতরের একখানা কুৎসিত বেনামী পত্রের উপর আস্থা স্থাপন করিয়া, আমার সতী-সাধ্বী স্ত্রীর পবিত্র স্বভাবের উপর এই জঘন্য সন্দেহ করিতেছি!”
এই বলিয়া তিনি পত্রখানা লইয়া মদিত করিয়া সম্মুখ হইতে দূরে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিলেন। বলিলেন, “এই চিঠীর কথা আমাকে একেবারে ভুলিয়া যাইতে হইবে, এমন সচ্চরিত্রার উপরে এমন কলুষিত দোষারোপের কথা ভাবিতেও পাপ আছে।”
তিনি ইহা বলিলেন বটে, কিন্তু অন্যান্য পত্রগুলি খুলিতেও আর তাঁহার সাহস হইল না। তিনি মনে করিলেন, সেই বেনামী পত্রের কথা আর ভাবিবেন না, কিন্তু সেই বেনামী পত্রের অক্ষরগুলা যেন সজীব হইয়া তাঁহার চারিপাশে দাঁড়াইয়া মহা চীৎকার আরম্ভ করিয়া দিল। তিনি মনকে অন্যদিকে ফিরাইবার কোন সদুপায় দেখিতে না পাইয়া একান্ত নিশ্চেষ্ট হইয়া পড়িলেন। সন্দেহ ক্রমশই প্রবল হইতে লাগিল, এবং সর্পের মত ঘন ঘন পাকাইয়া উঠিয়া পঞ্জরের অস্থিগুলা যেন চূর্ণ করিয়া দিতে লাগিল; এবং তাহার সবিষ দংশনে সমস্ত হৃদয় জৰ্জ্জরিত হইয়া উঠিল; হতভাগ্য হরমসজী সহস্র চেষ্টা করিয়াও আর নিজেকে সামলাইতে পারিলেন না। তিনি টেবিলের উপরে মাথা রাখিয়া, দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া নিজের স্ত্রীর সম্বন্ধে অনেক কথা ভাবিতে লাগিলেন। পারিবারিক অকিঞ্চিৎকর ছোট ছোট দৈনন্দিন ঘটনাগুলি লইয়া মনের ভিতর তোলপাড়া করিতে লাগিলেন; এমন অনেক ঘটনা—যাহা তিনি উপেক্ষা করিয়াছিলেন, এখন সেগুলি তাঁহার স্ত্রীর বিপক্ষে মহা দোষাই হইয়া উঠিতে লাগিল। সন্দেহবীজ এক মুহূর্ত্তে, উপ্ত হইয়া অসংখ্য শাখা পল্লবে তাঁহার চিত্তবৃত্তি একেবারে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল; এবং তাহার মূল হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশ পর্য্যন্ত সঞ্চারিত হইল। হতভাগ্য হরমনজী একেবারে নিরুপায় হইয়া পড়িলেন। তিনি কাতরকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “দয়াময় ঈশ্বর! আমাকে এই বিপদ হইতে রক্ষা কর—এক মুহূর্ত্তে আমার সব যায়–সুখ, সৌভাগ্য, ঐশ্বর্য্য, মানসম্ভ্রম, ধৰ্ম্ম কৰ্ম্ম সব। প্রভু, তুমি না রক্ষা করিলে আর কে আছে আমার—দাও প্রভু, এ দুর্ঘটনা দুঃস্বপ্নে পরিণত করিয়া দাও!” তিনি সবেগে উঠিয়া গৃহমধ্য দ্রুত পরিত্র __ করিয়া ফিরিতে লাগিলেন। তাঁহার স্ত্রী যে এই পাপাভিনয়ে সংশ্লিষ্ট আছেন, ইহা মন হইতে মুছিয়া ফেলিবার জন্য তিনি পত্রলেখকের নানাবিধ দুষ্ট উদ্দেশ্য বাহির করিতে লাগিলেন। অক্ষরগুলা যেন তীক্ষ্ণাগ্র কন্টকের ন্যায় করতল বিদ্ধ করিতে লাগিল। তিনি পত্রখানি দেখিতে দেখিতে বলিলেন, “আমার কোন কর্ম্মচারীর দ্বারা এই কাজ হইয়াছে—সন্দেহ নাই। হয় ত কাহাকে কোনদিন আমি ভর্ৎসনা করিয়াছি—কি কাহার মাহিনা বাড়াইতে রাজী হই নাই, অথবা এমন কেহ হইবে, যাহাকে জবাব দিয়াছি—এখন সে এইরূপে প্রতিশোধ নিয়াছে।” তাঁহার আফিসে অগণ্য কৰ্ম্মচারী–অনেকেরই কথা তিনি ভাবিয়া দেখিলেন, কিন্তু এমন কাহাকেও ভাবিয়া পাইলেন না যে, এমন নিৰ্দ্দয়ভাবে এমন সাংঘাতিক পত্র লিখিতে পারে। হরমসজী ভাবিতে লাগিলেন, একখানা বেনামী পত্রের উপর আস্থা স্থাপন করা তাঁহার উচিত হয় নাই; মুখের উপরে কোন কথা বলিতে যাহাদের সাহস হয় না—এরূপ ভীরু কাপুরুষ নরাধমদের পত্রের উপর নির্ভর করা একান্ত মূর্খতা। এরূপ পত্রপাঠের পূর্ব্বেই অগ্নিমুখে সমর্পণ করাই আমার উচিত ছিল।
কিন্তু হরমসজী বুঝিলেন না, মনে যতটা করা যায়—কাজে ঠিক ততটা হয় না। এ পত্রখানা অগ্নিমুখেই সমর্পণ কর—কাগজ যেমন দগ্ধ হয়, উহাও সেইরূপ দগ্ধ হইয়া ভস্মে পরিণত হইবে; তথাপি সেই ভষ্মাবশেষ হইতেও সন্দেহের বিষ হৃদয়মধ্যে প্রবেশ করিয়া অনন্ত বিশ্বাস এবং পবিত্র শান্তি নষ্ট করিয়া ফেলিবে। সর্প মরিল—কিন্তু সর্পের বিষ-দন্ত বক্ষে বিদ্ধ হইয়া রহিল—সর্পের মৃত্যুতে লাভ কি?
মনের সহিত যুদ্ধ করিয়া করিয়া অবশেষে হরমসজী ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। ভাবিলেন, সেই পত্র তিনি তাঁহার স্ত্রীকে দেখাইবেন। হাঁ স্ত্রীকেই দেখাইবেন—সহসা তাঁহার মস্তিকে বিদ্যুদগ্নি ঝকিয়া উঠিল; তিনি একান্ত হতাশভাবে কৌচের উপরে হেলিয়া পড়িলেন; এবং চুলের মধ্যে দিয়া বারংবার অঙ্গুলি সঞ্চালন করিয়া চুলগুলাকে অত্যন্ত অপরিষ্কার করিয়া ফেলিলেন। আপন মনে বলিলেন, “না কিছুতেই এই পত্র তাহাকে এখন দেখান যাইতে পারে না—হয় ত এই পত্র সত্য হইবে—প্রকৃতই যদি আমি আমার স্ত্রীর নিকটে প্রবঞ্চিত হইয়া থাকি, তাহা হইলে তাহা হইলে—দূর হৌক—এই পত্র দেখাইয়া এখন হইতে তাহাকে সতর্ক করিয়া দিয়া কি ফল হইবে? এই পত্রের মধ্যে কতখানি সত্য নিহিত আছে, এখন তাহাই আমাকে আবিষ্কার করিতে হইবে।”
তাঁহার মত উদার, সহৃদয়, ন্যায়পরায়ণ মহৎ ব্যক্তিকে যে একদিন এরূপভাবে পারিবারিক, গোয়েন্দাগিরি করিতে হইবে, ইহা তিনি পূর্ব্বে স্বপ্নেও ভাবেন নাই; ইহা তাঁহার পক্ষে সহজ কথা নহে—কিন্তু যতই দুঃসাধ্য—যতই কঠিন হউক না কেন, ইহা তাঁহাকে করিতেই হইবে। তাহার পর রহস্যোদ্ভেদ ক্রমশঃ যতই ভয়ানক হইয়া উঠুক—ক্রোধের ও উদ্বেগের চিহ্নমাত্র প্রকাশ না করিয়া তাঁহাকে নীরবে অগ্রসর হইতে হইবে।
এমন সময়ে আহারের সময় হইল। একজন ভৃত্য ডাকিতে আসিল। হরমসজী তাহাকে বিদায় করিয়া দিয়া, দর্পণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া নিজের মুখ দেখিলেন। নিজের মুখ দেখিয়া নিজেই ভীত বিস্মিত হইলেন; চোখে মুখের পূর্ব্ব ভাব সব একেবারে বদ্লাইয়া গিয়া কেমন এক রকম ভয়ানক হইয়া উঠিয়াছে।
হরমসজী বলিলেন, “আমি কি এমনই দুর্বল! এখন অধীর হইলে চলিবে না; যতক্ষণ না সত্য আবিষ্কার হয়, ততক্ষণ আমাকে মনোভাব সম্পূর্ণরূপে দমন করিয়া রাখিতে হইবে- অবশ্যই ইহা আমি করিব।”
হরমসজী বাটীর ভিতরে গিয়া আহারে বসিলেন। আহারে বসিয়া অনেক কথাই কহিতে লাগিলেন। যাহাতে রাজা বাঈ তাঁহার ভাবান্তর লক্ষ্য করিয়া কোন প্রশ্ন করিবার অবসর না পান, সেজন্য তিনি কথার উপরে কথা ফেলিয়া সময়টা কাটাইতে লাগিলেন। অবশেষে তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আজ তিনি কোথায় বেড়াইতে যাইবেন কি না।
রাজাবাঈ কহিলেন, “হাঁ, আজ আমি কমলাবাঈকে লইয়া একবার বেড়াইতে যাইব।”
হরমসজী জিজ্ঞাসিলেন, “কখন?”
রাজাবাঈ কহিলেন, “অপরাহ্ণে।”
হরমসজী একটা সুদীর্ঘ নিশ্বাস টানিলেন, যেন তাঁহার মাথা হইতে একটা প্রকাণ্ড বোঝা নামিয়া গেল। অদ্য সন্ধার পূর্ব্বেই তিনি কার্য্যোদ্বার করিতে পারিবেন, স্থির করিয়া অনেকটা আশ্বস্ত হইলেন। তিনি মনে করিলেন, সন্দেহের তুষানলে এরূপ প্রতিক্ষণে দগ্ধ হওয়া অপেক্ষা সত্যাবিষ্কারটা যেমনই ভয়ানক হউক না কেন, তাহাও এক্ষণে তাঁহার পক্ষে প্রার্থনীয়। তিনি মনের ভিতরে অত্যন্ত ছট্ফট্ করিতে লাগিলেন; এবং যাহাতে মনের ভাব বাহিরে কিছুমাত্র প্রকাশ না পায়, সেজন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
আহারাদির শেষে তিনি পুনরায় নিজের বসিবার ঘরে প্রবেশ করিলেন।
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – আশার শেষ
সময় কাহারও বাধা মানে না—বেলা অবসান হইয়া আসিল। সূর্য্য অস্তাচলচূড়াবলম্বী হইলেন; গাছের ছায়া বিপরীত দিকে ক্রমশঃ দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হইতে লাগিল। বায়ুর উত্তাপ এখনও কমে নাই। এমন সময়ে বাহিরে শকট-চক্রের ঘর্ঘর শব্দ উঠিল। শুনিয়া হরমসজী গবাক্ষ হইতে মুখ বাড়াইয়া দেখিলেন, কন্যাকে লইয়া তাঁহার স্ত্রী গাড়ীতে উঠিয়া বেড়াইতে বাহির হইয়া গেলেন।
আর এক মুহূর্ত্ত বিলম্ব নয়—হরমসজী দ্রুত কম্পিতপদে শয়ন কক্ষে প্রবেশ করিলেন। নির্দ্দিষ্ট স্থান হইতে চাবী বাহির করিয়া সর্ব্বাগ্রে লোহার সিন্দুকটা খুলিয়া ফেলিলেন। দ্রুতহস্তে সিন্দুক হইতে কতকগুলা ভেলভেট ও মরক্কোমণ্ডিত ছোটখাট গহনার বাক্স বাহির করিলেন, কতকগুলা বাক্স সিন্দুকের মধ্যে খুঁজিয়াই পাইলেন না। যেগুলি পাইলেন, এক একটি করিয়া সেইগুলি খুলিতে লাগিলেন।
সকল শূন্য!
“তবে বেনামী পত্র সত্য? না—না—ইহা অসম্ভব! ইহা কখন হইতে পারে না,” ভগ্নকণ্ঠে হরমসজী বলিয়া উঠিলেন। বলিয়া তিনি সিন্দুকের ভিতরে যাহা কিছু ছিল, টানিয়া টানিয়া বাহির করিয়া খুলিয়া উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া দেখিতে লাগিলেন, যদি রাজাবাঈ সমুদয় গহনা একসঙ্গে বাঁধিয়া কোথায় রাখিয়া থাকেন। কিন্তু তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিলেন, একখানাও অলঙ্কার দেখিতে পাইলেন না। হীরামুক্তাখচিত রাশি রাশি গহনা কোথায় গেল!
হরমসজী নিরুপায় হইয়া এবার ভাবিলেন, হয়ত গহনার হীরামুক্তা খুলিয়া পড়িয়াছে, সেইজন্য তাহার স্ত্রী সেইগুলি মেরামত করাইতে পাঠাইয়াছেন; কিন্তু তাহার মধ্যে অনেক গহনাই ত নূতন; সকলগুলিই এক সঙ্গে মেরামত করিতে পাঠাইয়াছেন, এমনও কি হয়? তিনি আমবার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন। প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও একখানি অলঙ্কার খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিলেন না।
তখন তাঁহার স্মরণ হইল, ইতোমধ্যে একদিন তিনি তাঁহার স্ত্রীকে নিরলঙ্কারা দেখিয়া মধ্যে মধ্যে গহনাগুলি পরিতে বলিয়াছিলেন। রাজাবাঈ তাহাতে বলেন, “গহনা পরিয়া আর কি হইবে, আমাদের যে অনেক দামী গহনা আছে, ইহা এখনাকার সকলেই জানে।”
হাঁ—লজ্জা ভয় ঘৃণা দূরে থাক—রাজাবাঈ মৃদুহাস্যে পরিস্কারকণ্ঠে স্বচ্ছন্দে সেইদিন ঠিক এই উত্তরই করিয়াছিলেন। কি আশ্চর্য্য, কুটিল হৃদয়কে সরলতার আবরণে এমন ভাবে ঢাকিয়া রাখা যায়। আজ এক যুগকাল আমাকে অন্ধ করিয়া রাখিয়াছে। সহসা তাঁহার সন্দেহান্ধকার পূর্ণ হৃদয়ের মধ্যে আশার ‘একটা ক্ষীণতর শীর্ণ রশ্মিরেখা প্রতিভাত হইল, তাহা নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর; কিন্তু মগ্নোমুখ ব্যক্তি সম্মুখে তৃণ দেখিলেও অবলম্বন করে। হরমসজী ভাবিলেন, হয় ত তাঁহার স্ত্রী সমুদয় অলঙ্কার তাঁহার দুহিতার নিকট রাখিয়াছেন।
তখনই তিনি কমলাবাঈ-এর শয়ন-কক্ষে প্রবেশ করিলেন। অলঙ্কারের সিন্দুক খুলিয়া ফেলিলেন। খুলিয়া কি দেখিলেন? দেখিলেন, রাজাবাঈ-এর অলঙ্কার ত নাই-ই; তা ছাড়া কমলাবাঈ-এর আট-দশখানি অলঙ্কার নাই। আট-দশটী মরক্কোমণ্ডিত কৌটা খালি পড়িয়া রহিয়াছে।
কি সৰ্ব্বনাশ! তাহা হইলে কমলা বাঈও কি এই পাপাভিনয়ের সহিত যোগ দিয়াছে— সে-ও কি এই কলুষিত ঘৃণ্য ব্যাপারে লিপ্ত হইয়াছে?
এই শেষ আঘাতটা মুমূর্ষু হরমসজীর পক্ষে বড় গুরুতর হইল। তাঁহার মাথা ঘুরিয়া গেল, তিনি টলিতে টলিতে কমলার শয্যার উপরে বসিয়া পড়িলেন—এবং কঠিনভাবে বারংবার উভয় হস্তে করতল মদিত করিতে লাগিলেন। তাঁহার বর্ত্তমান শোচনীয়, ভবিষ্যৎ অন্ধকারময়, এবং অতীতের স্মৃতি তাঁহার সর্ব্বাঙ্গে কশাঘাত করিতে লাগিল। তাঁহার যশঃ, মান, খ্যাতি প্ৰতিপত্তি, মনের শান্তি, সংসারের সুখ, জীবনের উচ্চ আশা, সব যেন একদণ্ডে এক ফুৎকারে ধূলিসাৎ হইয়া গেল। বিশ বৎসরের কঠিন পরিশ্রমে লব্ধ অতুল-ঐশ্বর্য্য তাঁহার চক্ষে ভস্মস্তূপে পরিণত হইয়া গেল। কিছুরই কোন পরিবর্ত্তন হয় নাই, সকলই ঠিক আছে—যেখানকার যে জিনিষটি যেখানে যেমন ভাবে থাকে এখনও ঠিক তেমনই আছে; বাহিরে জগতের কাজ—আজ বিশ বৎসর যেমন চলিয়া আসিতেছে—আজও ঠিক সেইভাবে চলিতেছে; কিন্তু তাঁহার হৃদয়ের আজ একি বিষম পরিবর্তন—যেখানে অদ্যাপি দয়া মায়া, স্নেহে প্রেম ও ভালবাসার শান্তি স্রোত বহিতেছিল—সেখানে কোথা হইতে সহসা এ ভীষণ অনলকুণ্ড জ্বলিয়া উঠিল?
হরমসজী আপন মনে বলিতে লাগিলেন, “এ সংসার কি ভয়ানক! হায় রে কবির কল্পনা—নরক আর কোথায়? এইখানে—রমণীর হৃদয়ে! রাজাবাঈ আমার সহিত প্রতারণা করিতেছে—এই বিশ বৎসর কাল! দারিদ্র্যের নিদয় পীড়নে রাজাবাঈ-এর হৃদয়ের রক্ত যখন দিন দিন শুষ্ক হইয়া যাইতেছিল, আমি তাহাকে বিবাহ করি। এখন আর তাহার সে কথা স্মরণ নাই। আমাকে ভুলাইবার জন্য সে কতবার কতই প্রেমের কথা বলিয়াছে, কত মতে নিজের অনুরাগ প্রকাশ করিয়াছে—কত সময়ে কত রকমে আমার প্রশংসাবাদ করিয়াছে—আমার পত্নী হইয়া যে পরম সৌভাগ্যবতী, ইহা আমাকে বুঝাইবার জন্য সে কতবার কত কথাই আমাকে শুনাইয়াছে। হায় হায় সকলই মিথ্যা— সকলই ছলনা—সকলই রচনা! এমন পিশাচীও থাকে— আমার এই অগাধ ভালবাসার এই প্রতিদান! কি ভয়ানক শঠতা! ভগিনীপুত্র বলিয়া নিজের প্রণয়ভাজনকে অবলীলাক্রমে আমার সংসারের মধ্যে আনিয়া পিশাচী কি চাতুরীর খেলা খেলিয়াছে। আমার সম্মুখেই সে নারকী আমার অন্তঃপুরে আসে—হাসে, গল্প করে—একসঙ্গে বসিয়া আহার করে—পাপিষ্ঠের কি সাহস-আমার চক্ষের উপরে এই কুৎসিত প্রেমাভিনয়ে মত্ত! ধিক আমাকে—নির্ব্বোধ আমি—এতদিনে ইহার কিছুই বুঝি নাই। যদি এই বেনামী পত্ৰ না নাই তাম—এইভাবে আরও কতদিন কাটিত কে জানে! যিনিই এই বেনামী পত্রের লেখক হউক না কেন, নিশ্চয় তিনি আমার পরম বন্ধু।”
বিশ্বাস যখন আসে, তাহার সবটুকু লইয়া আসে; আবার যখন যায়, সবটুকুই লইয়া যায়। আজ হরমসজীর অগাধ বিশ্বাস একেবারে নষ্ট হইয়া গেল। তিনি সিন্দুকের যেখানে যাহা ছিল, গুছাইয়া তুলিয়া রাখিয়া নিজের বসিবার ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। দ্বাররক্ষককে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, যখন যাঁহার নামে যে কোন চিঠা আসিবে, যেন তাঁহার হাতে সর্ব্বাগ্রে দেওয়া হয়।
মানুষের যখন গর্ব্বে আঘাত লাগে, তখন মানুষ এইরূপ উন্মত্ত হইয়া উঠে—এবং মরিতে ইচ্ছা করে। হরমসজী একবার মনে করিলেন, তাঁহাকে আত্মহত্যা করিতে হইবে—আত্মহত্যা করিয়া এ যন্ত্রণার হাত এড়াইতে হইবে। আবার ভাবিলেন, এই প্রতারণার যথোচিত শাস্তি বিধান না করিয়া মরা কাপুরুষতা। ইহার প্রতিশোধ দিয়া—তাহার পর যাহা হয় করিবেন। এখন মরিয়া পাপিষ্ঠার পাপের পথ সুগম করা যুক্তিসিদ্ধ নহে।
সন্ধ্যার সময় রাজাবাঈ কন্যা ও রতনকে লইয়া ফিরিয়া আসিলেন। হরমসজী অনেক কষ্টে মনোভাব দমন করিতে লাগিলেন। রাত আটটার পর মাঞ্চারজী অন্তঃপুর মধ্যে প্রবেশ করিল। তাঁহার সেই সর্ব্বস্বাপহারীকে দেখিয়া পাছে রাগ সামলাইতে না পারেন, এই ভাবিয়া হরমসজী তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া গেলেন। মাঞ্চারজী চলিয়া গেলে, হরমসজী অনেক রাত্রে বাড়ী ফিরিলেন।
উনবিংশ পরিচ্ছেদ – বিপদের সূচনা
পরদিন মধ্যাহ্নে অনেকগুলি পত্র হরমসজীর হস্তগত হইল। তন্মধ্যে একখানি স্থানীয় পত্র দেখিয়া হরমসজী তাড়াতাড়ি সেইখানা খুলিয়া পাঠ করিলেন—
“মাসী মা—বিশেষ দরকার, যেরূপে হউক আজ আমার সঙ্গে দেখা করা চাই-ই। অবশ্য আপনি আজ সন্ধ্যার পর এখানে একবার আসিবেন; কোনমতে অন্যথা না হয়। আমি নিজে যে কেন যাইতে পারিলাম না, আসিলে তাহাও জানিতে পারিবেন। নিজে যাইতে পারিলে আপনাকে এই কষ্ট দিতাম না। ব্যাপার যেরূপ দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে বোধ হয়, শীঘ্রই সমুদয় ব্যাপার প্রকাশ হইয়া পড়িবে।
মাঞ্চারজী।”
হরমসজীর আপাদমস্তক কাঁপিতে লাগিল। প্রতিহিংসা সাধনের সুযোগ উপস্থিত দেখিয়া উন্মত্ত আনন্দাবেগে হরমসজী বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ, ঠিক হইয়াছে। এইবার নিজের হাতে পাইয়াছি আমি, ইহাই ত চাই।”
হরমসজী উঠিলেন। আমারীর ভিতর হইতে একটী পিস্তল বাহির করিলেন। ঘুরাইয়া ফিরাইয়া পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। পরে গুলি ভরিয়া ঠিক করিয়া রাখিলেন।
হরমসজী মনে করিতেছিলেন, তিনি যাহা করিতেছেন, কেহ তাহা দেখিতেছে না। কিন্তু রতনের সতর্ক দৃষ্টি বরাবরই তাঁহার উপরে ছিল। হরমসজী নিজগৃহে পিস্তলে গুলি পুরিতেছেন, ইহা রতনবাঈ অন্তরাল হইতে দেখিল।
হরমসঙ্গী পিস্তলটা আলমারীর মাথায় রাখিয়া দিয়া মাঞ্চারজীর প্রেরিত পত্রখানি পূর্ব্ববৎ মুড়িয়া ফেলিলেন। এবং পত্রখানি কোন দাসীর দ্বারা রাজাবাঈ-এর নিকটে পাঠাইয়া দিবার জন্য উঠিয়া গেলেন।
সুযোগ বুঝিয়া রতনবাঈ হরমসজীর প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিল। অনতিবিলম্বেই আবার বাহির হইয়া আসিল। তখনই জুতার শব্দ করিতে করিতে হরমসজী আসিয়া পুনরায় সেই কক্ষমধ্যে গেলেন।
জুতার শব্দ শুনিয়া রতনবাঈ অন্তরালে লুকাইয়াছিল। হরমসজী কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে অপরদিকে চলিয়া গেল।
রতনবাঈ আপন মনে বলিল, “যথাসাধ্য করিলাম—এখন কোন রকমে শেষ রক্ষা করিতেই হইবে। কিন্তু উপায় কি—এখন নায়েক মহাশয়কে খবর দেওয়া চাই-ই, বিপদের মেঘ মাথার উপরে খুবই ঘনাইয়া আসিয়াছে। তাঁহার সাহায্য ভিন্ন এখন আর কোন উপায় দেখি না।”
সন্ধ্যা হইল। রাজাবাঈ নিজের গাড়ীতে উঠিয়া বাহির হইয়া গেলেন।
সেই পিস্তলটা লইয়া হরমসজী তখনই একখানা ভাড়াটিয়া গাড়ীতে উঠিয়া স্ত্রীর অনুসরণ করিলেন।
রতন অন্তরাল হইতে সকলই দেখিল। দেখিয়া আকুল ভাবে আপনার মনে বলিয়া উঠিল, “হায়, এইবার বুঝি সকলই ফুরাইল!”
রতনবাঈ একখানা পত্রে এই সংবাদ লিপিবদ্ধ করিয়া একজন ভৃত্য দ্বারা কাশীনাথ নায়েকের নিকটে পাঠাইয়া দিল।
বিংশ পরিচ্ছেদ – বেনামী পত্রের ফল ভীষণ হইল!
রাজাবাঈ যখন উপস্থিত হইলেন, তখন মাঞ্চারজী একাকী নিজের বিছানায় পড়িয়াছিল। রাজাবাঈকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিল। রাজাবাঈ আসিয়া শয্যার একপার্শ্বে বসিলেন।
মাঞ্চারজী বলিল, “আমি অনেক কষ্ট দিয়াছি, আজও এই কষ্ট দিলাম; সেজন্য আমি অপরাধী। আমি বড়ই বিপদে পড়িয়াছি—হয়ত সারা জীবন ইহার জন্য আমাকে অনুতাপ করিতে হইবে। আমি যে কথা বলিবার জন্য আজ—”
আর বলা হইল না—ভীষণ শব্দে দ্বার খুলিয়া গেল। মাঞ্চারজী লাফাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল—তাহার সম্মুখে হরমসজীর ভীষণ মূর্তি, হাতে পিস্তল, মুখভাব একেবারে বিকৃত এবং চক্ষুদ্বয় উল্কাপিণ্ডের ন্যায় জ্বলিতেছে। হরমসজী অট্টহাসি হাসিয়া বলিলেন, “হাঁ, তোমরা হঠাৎ আমাকে দেখিয়া বড় বিস্মিত হইয়াছ। তোমরা মনে করিয়াছিলে তোমাদের শঠতা চিরকাল অব্যাহত থাকিবে।”
সকলই নীরব। ক্ষণকাল পরে মাঞ্চারজী সাহস সঞ্চয় করিয়া কহিল, “মেসো মহাশয়, আমি আপনাকে—”
হরমসজী আর বলিতে দিলেন না। ধমক দিয়া কহিলেন, “চুপ কর, পিশাচ, যথেষ্ট হয়েছে—আর মিথ্যা রচনায় আবশ্যক নাই—আমার চক্ষু খুলিয়াছে—আর বৃথা চেষ্টা কেন?”
মাঞ্চরজী সভয়ে কহিল, “আমি শপথ করিয়া বলিতেছি—”
হরমসজী গৰ্জ্জন করিয়া কহিলেন, “কে তোর মিথ্যা শপথ শুনিতে চায়? আর কিছুতেই আমাকে প্রতারিত করিতে পারিবি না—আমি সকলই জানিতে পারিয়াছি; আমার স্ত্রীর সমস্ত অলঙ্কার লইয়া কে বাঁধা দিয়াছে? কে আমার সিন্দুক হইতে টাকা চুরী করিয়াছে?—তুই। তোরই জন্য তোরই অপরাধে আমি একজন নিরপরাধ কর্মচারীকে পুলিসের হাতে দিয়াছি। তোর পাপের যথোচিত প্রতিফল গ্রহণ কর।”
এই বলিয়া তিনি মাঞ্চারজীর মস্তক লক্ষ্য করিয়া পিস্তল উঠাইলেন। মাঞ্চারজী ভয়ে অস্ফুট চীৎকার করিয়া সরিয়া দাঁড়াইল—তাহার সর্ব্বাঙ্গ ভয়ে কাঁপিতে লাগিল।
রাজাবাঈ-এর বিবর্ণ মুখ আরও বিবর্ণ হইয়া গেল।
রাজাবাঈ কাঁপিতে কাঁপিতে জানু পাতিয়া হরমসজীর পায়ের কাছে বসিয়া পড়িলেন। বুঝিতে পারিলেন, সকল প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে—এতদিন তিনি অনেক কষ্টে মিথ্যার উপরে মিথ্যার আরোপ করিয়া পাপ ঢাকিয়া আসিতেছিলেন; কিন্তু আজ হঠাৎ তাঁহার সমস্ত চেষ্টা বিফল হইয়া গেল। তিনি যুক্তকরে, সজলনেত্রে, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে হরমসজীকে বলিলেন, “আমাকে ক্ষমা কর! আমি তোমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করিতেছি!”
রাজাবাঈ-এর করুণ কণ্ঠে এবং কাতর প্রার্থনার হরমসজীর মন অতীত বিশ বৎসরের সমগ্র সুখ-সৌভাগ্য মনে পড়িয়া গেল। তাঁহার পদতল হইতে কেশাগ্র পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিল। যাঁহাকে তিনি হৃদয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী করিয়াছিলেন, যাঁহার একটা ইঙ্গিতে তাঁহার সুখ দুঃখ নিয়মিত হইত, যাঁহার একটু হাসিতে তিনি স্বর্গ-সুখ উপভোগ করিতেন, এবং ভ্রূকুটী দেখিলে প্রমাদ গণিতেন—তাঁহার এই কাজ! যখন বৰ্ত্তমান এইরূপ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তখন অতীত সুখের কথাগুলি মানুষের মনে আগে জাগিয়া উঠে। এবং তাহাই প্রবল হইয়া বৰ্ত্তমানকে ঢাকিয়া দেয়। হরমসজীরও তাহাই হইল। হরমসজীর প্রবাহ হৃদয় বিগলিত হইল। তিনি ভগ্নকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “হতভাগিনি! আমি কি করিয়াছি, যেজন্য তুমি আমার সহিত এমন গুরুতর প্রবঞ্চনা করিলে? আমার একমাত্র অপরাধ, সর্ব্বান্তঃকরণে তোমাকে ভালবাসিয়া ছিলাম। একদিন ও তোমাকে অযত্ন করি নাই—কোনদিন আমার মুখ হইতে একটি কঠিন কথাও শুনিতে পাও নাই—কি অসুখে ছিলে? তোমাকে সুখী করিবার জন্য আমি কি প্রাণপণ করি নাই? তবে তুমি কি অসুখে ছিলে? সংসারের এত সুখ তোমার সহিল না, তাই রিপুতাড়নে মত্ত হইয়া শেষে এই নরকের মাঝখানে আসিয়া পড়িয়াছ। সেখানকার কথা একবার স্মরণ করিয়া দেখ দেখি, সেখানে তোমার উপরে সকলের শ্রদ্ধা-ভক্তি কত—সকলের কাছে মান-সম্ভ্রম কিরূপ? কাম-লালসার বশবর্তিনী হইয়া সব ভুলিলে! হতভাগিনি, নিজের দোষে সব নষ্ট করিলে—সব হারাইলে! আমার অযাচিত অগাধ ভালবাসায় যদিই তোমার অরুচি হইয়াছিল—তবে আর সব দিক্ ভাবিয়া দেখিলে না কেন? কন্যা কমলাবাঈ তাহার মুখ চাহিলে না কেন? তাহার মুখ চাহিয়াও এ লালসা ত্যাগ করিতে পারিলে না?” হরমসজী ধীরে ধীরে কথাগুলি বলিতেছিলেন; অনেক কষ্টেই তাঁহার মুখ হইতে কথা বাহির হইতেছিল—এক একটা কথায় যেন তাঁহার শ্বাস রুদ্ধ হইয়া যাইতেছিল।
মাঞ্চারজী অত্যন্ত মনোযোগের সহিত সব শুনিতেছিল! ভাবিল, হরমসজী সকল খবর না পাইলেও কিছু কিছু বুঝিতে পারিয়াছেন। কিন্তু যাহা বুঝিয়াছেন, তাহা প্রকৃত ব্যাপার অপেক্ষাও সাংঘাতিক। এই সময়ে যদি তাঁহার ভ্রম বুঝাইয়া দেওয়া না হয়, তাহা হইলে নিজেরও রক্ষা নাই। এইরূপ ভাবিয়া মাঞ্চারজী বলিল, “মেসো মহাশয়, আমার কথা আগে শুনুন, তাহা হইলে আপনি — “
মাঞ্চারজীকে বলিলেন, “চুপ্—পিশাচ—চুপ।”
মাঞ্চারজী ভয় পাইয়া চুপ করিল। কাহারও মুখে আর কথা নাই। সেই নীরবতার মধ্যে রাজা বাঈএর অস্ফুট ক্রন্দনধ্বনি অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট হইয়া উঠিল।
হরমসজী বলিলেন, “আমি কেন এখানে আসিয়াছি, জান? তোমাদের দুজনকেই খুন করিবার জন্য। কিন্তু নারীহত্যা করিয়া হাত কলুষিত করিতে আর ইচ্ছা নাই—কাপুরুষের মত কোন নিরস্ত্র ব্যক্তিকেও আমি খুন করিব না।
মাঞ্চারজী কি বলিতে যাইতেছিল, হরমসজী বলিলেন, “আগে আমার কথাটা শেষ হউক। তোমার জীবন এখন আমার হাতে—আমি যেরূপ অবস্থায় পড়িয়া খুন করিতেছি, এরূপ স্থলে অনেক আসামী আইনের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া থাকে; কিন্তু সে সুবিধায় আমার কোন প্রয়োজন নাই। ওই তোমার রিভার রহিয়াছে, এখনই উহা তুলিয়া আত্মরক্ষা করিতে চেষ্টা কর।”
মাঞ্চারজী ব্যাকুলভাবে কহিল, “না—আমি তা কিছুতেই পারিব না।”
বজ্রনাদে হরমসজী কহিলেন, “পারিতেই হইবে। এখনও আত্মরক্ষার চেষ্টা কর, নতুবা—“ হরমসজীর পিস্তলের অগ্রভাগ মাঞ্চারজীর বক্ষঃস্থল স্পর্শ করিল। মাঞ্চারজীর চোখে চারিদিক্ হইতে প্রলয়ের গভীর অন্ধকার ঘনাইয়া আসিল—মাঞ্চারজী ছুটিয়া গিয়া হরমসঙ্গীকে লক্ষ্য করিয়া পিস্তল উঠাইল।
হরমসজী বলিলেন, “যাও, তুমি ঘরের কোণে সরিয়া গিয়া দাঁড়াও—আমি এখানে ঠিক আছি। ঐ দেখ, ঘড়ীর কাঁটার দিকে চাহিয়া দেখ, এখনই বাজিবে, এক মিনিটও বিলম্ব নাই। ঘড়ীর শব্দ হইবামাত্র দুজনেই গুলি করিব। লক্ষ্য ঠিক করিয়া লও।”
ঘরের দুই কোণে উদ্যত হস্তে উভয়ে দাঁড়াইলেন। উভয়ে উভয়ের প্রতি লক্ষ্য স্থির করিতে লাগিলেন। কাহারও মুখে আর কথা নাই।
আর বিলম্ব নাই—এই মুহূর্ত্ত মধ্যে সব ফুরাইবে! রাজা বাঈএর বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল; তিনি উন্মদিনীর ন্যায় উভয়ের মাঝখানে দাঁড়াইলেন। আকুলভাবে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “দয়া কর—দয়া কর—আমি আর কোন কথা গোপন করিব না—এখনই সব বলিতেছি—খুন করিতে হয়, আমাকে কর—”
হরমসজী বুঝিলেন, পিশাচী প্রেমাকাঙ্ক্ষীর জন্য নিজের জীবন দিতে চায়। তাঁহার ক্রোধ চরম সীমায় উঠিল। তিনি রাজা বাঈএর হাত ধরিয়া একদিকে জোর করিয়া ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন, “সমুখ হইতে দূর হইয়া যাও।”
রাজা বাঈ দূরে নিক্ষিপ্ত হইলেন। তৎক্ষণাৎ উঠিয়া তিনি মাঞ্চারজীর দিকে ছুটিয়া গেলেন। এবং তাহাকে আপন বঙে বেষ্টন করিয়া ধরিয়া কাতরকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, “আমাকে খুন কর, কেবল আমাকে—ওগো, কেবল আমিই অপরাধিনী।”
হরমসজী দীপ্তনেত্রে সেই দৃশ্য দেখিলেন। তখনই লক্ষ্য ঠিক করিয়া পিস্তল তুলিলেন—তখনই পিস্তলের মুখে ধূম্রাগ্নিশিখা নির্গত হইল, এবং পিস্তলের শব্দে প্রকোষ্ঠ প্রকম্পিত ও ধূমরাশিতে পূর্ণ হইয়া গেল।
রাজা বাঈ সেইরূপ ভাবে মাঞ্চারজীকে বেষ্টন করিয়া আছেন। উভয়ের কেহই আহত হইলেন না।
হরমসজী আবার পিস্তল উঠাইলেন। লক্ষ্য ঠিক করিলেন। পিস্তল পূর্ব্ববৎ গৰ্জ্জিয়া উঠিল। এবারেও কেহই আহত হইলেন না। তাহার পর তৃতীয়বার—এখনও রাজা বাঈ ও মাঞ্চারজী অনাহত।
আবার হরমসজী পিস্তল উঠাইলেন। কিন্তু এবার কে পশ্চাত হইতে আসিয়া তাঁহার পিস্তল কাড়িয়া লইল। আগন্তুকের দেহে অপরিসীম ক্ষমতা। তিনি তৎক্ষণাৎ হরমসজীকে টানিয়া লইয়া, বিছানায় ফেলিয়া তাড়াতাড়ি রাজাবাঈকে দেখিতে গেলেন।
আগন্তুক বাহির হইতে পিস্তলের শব্দ শুনিয়াছিলেন; কিন্তু রাজাবাঈকে এখন অনাহত দেখিয়া তিনি অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “আঃ! ধর্ম্ম রক্ষা করিয়াছেন!”
পাঠক! ইনি আপনাদের পরিচিত কাশীনাথ নায়েক। ইনি রতনের নিকট সংবাদ পাইয়া আসিয়াছেন। রতন যে হরমসজীর পিস্তল হইতে গোপনে গুলি বাহির করিয়া লইয়াছিল, ইনি তাহা জানিতেন না। এই জন্যই পিস্তলের শব্দ শুনিয়া তাঁহার আশঙ্কা হইয়াছিল, বুঝি তিনি রাজা বাঈকে এক্ষেত্রে রক্ষা করিতে পারিলেন না।
হরমসজী সক্রোধে বলিলেন, “তুমি কে—কেন আমাকে বাধা দিতেছ? আমি কিছুতেই ইহাদের অপরাধ ক্ষমা করিব না—দুজনকেই খুন করিব।”
একজনকেও নয়। আমি কে? আমি আপনার বন্ধু—বন্ধু না হইলেও আপাততঃ বন্ধুত্বের একটা কাজ করিলাম; একদিন আপনি ইহা জানিতে পারিবেন।” এই বলিয়া কাশীনাথ এত জোরে হরমসজীর হাত চাপিয়া ধরিলেন যে, হরমসজী অত্যন্ত বেদনা অনুভব করিলেন।
তৎপরে কাশীনাথ তাঁহার কানের নিকটে মুখ লইয়া অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “আপনি এ যাত্রা বড় বাঁচিয়া গিয়াছেন—ঈশ্বর রক্ষা করিয়াছেন; অনর্থক খুনের দায়ে পড়িয়া সব নষ্ট করিতেন। আপনি সেই বেনামী পত্রে প্রবঞ্চিত হইয়াছেন।”
হরমসজী স্ত্রীর দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া হতাশভাবে বলিলেন, “আপনার কথা বিশ্বাস করিতে পারিতাম, কিন্তু আমার স্ত্রী নিজের মুখে নিজের পাপ স্বীকার করিয়াছে।”
কাশীনাথ বলিলেন, “সত্য, কিন্তু আমি জানি তাঁকে আপনি যে পাপে পাপিনী মনে করিতেছেন, তিনি তাহা নহেন। আপনি এই যে লোকটাকে খুন করিতে আসিয়াছেন, জানেন আপনি—সে কে?”
হরমসজী বলিলেন, “জানি—আমার স্ত্রীর জার।”
কাশীনাথ বলিলেন, “না, আপনার স্ত্রীর পুত্র।”
একবিংশ পরিচ্ছেদ – বিস্ময় বাড়িল
হরমসজী উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে একবার মাঞ্চারজীর দিকে, পরে নিজের স্ত্রীর দিকে—শেষে কাশীনাথের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “মিথ্যা কথা—আমাকে প্রবঞ্চিত করিবার চেষ্টা করিতেছ— তোমাদের ষড়যন্ত্রে আমি ভুলিব না।”
কাশীনাথ নায়েক বলিলেন, “যথেষ্ট প্রমাণ পাইবেন; তবে সেজন্য তাড়াতাড়ি করিলে চলিবে না। ইহার জন্য আপনাকে দুই একদিন সবুর করিতে হইবে। আমিই আপনাকে প্রমাণ দিতে প্রতিশ্রুত রহিলাম।”
হরমসজী বলিলেন, “আপনার কথায় বিশ্বাস কি?”
কাশীনাথ বিরক্তভাবে বলিলেন, “না বিশ্বাস হয়, আমি নিজের পথ দেখি, আপনি যাহা করিতেছিলেন—তাহাই করুন; তাহার পর সারা-জীবনটা অনুতাপ করিয়া মরিতে থাকুন।”
হরমসজী বলিলেন, “আপনি কে?”
কাশীনাথ বলিলেন, “নিজের নামটা ভিন্ন আমার নিজের তেমন কোন বিশেষ পরিচয় নাই। আমার নাম কাশীনাথ নায়েক।”
হরমসজী বলিলেন, “হাঁ, আপনার নাম আমি শুনিয়াছি; আপনিই আমার ভূতপূর্ব্ব খাজাঞ্চী রস্তমজীর মোকদ্দমা তদ্বির করিয়া তাহাকে রক্ষা করিয়াছেন। আপনি রস্তমজীর পিতৃবন্ধু।”
কাশীনাথ বলিলেন, “হাঁ, আমিই সেই কাশীনাথ নায়েক। রস্তমজীর মোকদ্দমার তদ্বিরের জন্য আমাকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করিতে হয়। তাহাতে আমি আপনাদের সম্বন্ধেও অনেক কথা জানিতে পারি। তাহাই আমি আপনাকে বলিতেছি, মাঞ্চারজীর সম্বন্ধে যাহা বলিলাম, তাহার সকল তথ্য আপনি দুই-একদিনের মধ্যে সমুদয় জানিতে পারিবেন। আপনি আপনার স্ত্রীকে এখনই বাড়ীতে পাঠাইয়া দিন। ইঁহাকে এখন কোন কথা জিজ্ঞাসা করিয়া ব্যথিত করিবেন না; যথাসময়ে আমার মুখে সমুদয় শুনিতে পাইবেন। এখন আমার সঙ্গে আসুন, আপনাদিগকে আমি গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া আসি।”
মাঞ্চারজী ব্যতীত সকলে বাহির হইয়া গেলন। মাঞ্চারজী একা বসিয়া আকাশ-পাতাল ভাবিতে লাগিল। এবং এই সকল ঘটনা নিদাঘ রজনীর ঘোরতর দুঃস্বপ্ন বলিয়া বারংবার অঙ্গুলি দংশন করিয়া নিজেকে সচেতন করিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিল।
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ – ধরা পড়িল
সকলে চলিয়া গেলে মাঞ্চারজী সমস্ত রাত্রি জাগিয়া নানা দ্রব্যাদি বাঁধিল। প্রাতের গাড়ীতেই সরিয়া পড়িবে, এইরূপ স্থির করিয়াছিল। শেষরাত্রে একটু শয়ন করিয়াছিল। কাজেই ঘোর নিদ্রায় মগ্ন হইয়াছিল। বেলা প্রায় আটটা বাজে—তখনও সে নিদ্রামগ্ন।
পুনঃ পুনঃ দ্বারে করাঘাতের শব্দ হওয়ায় তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। ভীত হইয়া সে তাড়াতাড়ি শয্যা হইতে উঠিল। পাপীর হৃদয়ে শান্তি কোথায়?
মাঞ্চারজী পলায়নের ইচ্ছায় প্রথমে জানালার দিকে ধাবিত হইল; কিন্তু সেই দ্বিতলের জানালা হইতে লাফাইয়া পড়িলে প্রাণ রক্ষার কোন সম্ভাবনা নাই।
এই সময়ে বাহির হইতে তাহার ভৃত্যের কণ্ঠস্বর শুনা গেল। অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া মাঞ্চারজী দ্বারের নিকট আসিল। দ্বারের ছিদ্র দিয়া দেখিল, ভৃত্য ব্যতীত আর কেহ আছে কি না।
অন্য কাহাকেও না দেখিয়া সে দ্বার উন্মুক্ত করিল। ভৃত্যকে রোষকষায়িতলোচনে বলিল, “বেটা আমি ঘুমাইতেছি—কে তোকে আমার ঘুম ভাঙাইতে বলিল?”
ভৃত্য বলিল, “দায়ে পড়িয়া ভাঙাই। মহাশয়ের নামে একখানা ওয়ারেন্ট আছে।”
“বেটা আমার সঙ্গে ঠাট্টা!” বলিয়া মাঞ্চারজী লম্ফ দিয়া তাহার দিকে ধাবিত হইল।
ভৃত্য নিমেষমধ্যে সরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “কেন হাতকড়ী পরাইতে বাধ্য করিবে। লাভের মধ্যে উহাতে কেবল দশ জনে জানিবে।”
এবার মাঞ্চারজী ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় তাহাকে আক্রমণ করিল। বলিল, “বল্ বেটা তুই কে?”
ভৃত্য হাসিয়া বলিল, “আমি মহাশয়দেরই দাসানুদাস — আমার নাম দাদাভাস্কর—একজন ডিটেক্টিভ-কৰ্ম্মচারী।”
এই সময়ে কে পশ্চাদ্দিক্ হইতে মাঞ্চারজীর গলা ধরিয়া টানিয়া দাদাভাস্করের নিকট হইতে দূরে নীত করিল। বলিল, “মাঞ্চরজী—হরমসজীর ব্যাঙ্কের চুরীর অপরাধে আমি তোমাকে ধৃত করিলাম।”
মাঞ্চারজী শরাহত সিংহের ন্যায় ফিরিয়া দাঁড়াইল। দেখিল, একজন সাহেব ইনস্পেক্টর ও চারিজন কনেষ্টবল। দেখিয়া তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল; এবং তাহার সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল। সে অব্যক্ত স্বরে বলিল, “আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি চুরী করি নাই।”
ইনস্পেক্টর। ভালই, তাহা হইলে মুক্তি পাইবে। এখন এস।
মাঞ্চারজী। কিরূপে যাইব? এখানে এখন কেহ নাই।
ইনস্পেক্টর। সে ভাবনা এখন তোমাকে ভাবিতে হইবে না। আমাদের লোক থাকিবে—এস।
মাঞ্চারজী ইতস্ততঃ করিতেছে দেখিয়া সাহেব বলিল, “কেন গোল করিয়া দশ জনের সম্মুখে অপমানিত হও। গোল করিলে আমাদের বাধ্য হইয়া তোমাকে হাতকড়ী দিয়া লইয়া যাইতে হইবে।”
মাঞ্চরিজীর গলা শুকাইয়া গিয়াছিল—তাহার মুখ দিয়া আর কথা সরিল না- যন্ত্র-চালিতের ন্যায় মাঞ্চারজী পুলিসের সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
তাহারা প্রস্থান করিলে দাদাভাস্কর সমস্ত গৃহটী পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখিলেন। যেখানে যাহা ছিল, সেইখানেই তাহা রাখিলেন। তৎপরে দ্বারে চাবী লাগাইয়া চাবীটা দ্বারের পার্শ্বে পূৰ্ব্বৎ ঝুলাইয়া রাখিলেন।
সেইখানে আর একজন ডিটেক্টিভ-কৰ্ম্মচারী অপেক্ষা করিতেছিল। দাদাভাস্কর তাহাকে বলিলেন, “এইখানে পাহারায় থাক। দেখো যেন সে না টের পায় যে, তুমি পাহারায় আছ। তাকে এক মিনিটের জন্যও চোখের অন্তরাল হতে দিয়ো না।”
ডিটেকটিভ। তার সাধ্য নাই যে, আমার চোখের বাহিরে যায়।
দাদা। খুব সাবধান—না হইলে মাষ্টারের হাতে রক্ষা নাই।
ডিটেক্টিভ। বলিতে হইবে না।
দাদাভাস্কর সেই বাড়ী পরিত্যাগ করিলেন। পথে লালুভাই-এর সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি বলিলেন, “কত দূর কি করিলে?”
দাদাভাস্কর বুক ফুলাইয়া কহিলেন, “কাজ ফতে।”
“কি রকম?”
“এতদিনে আসল চোর ধরিয়াছি।”
“বটে, কে সে?”
“মাঞ্চারজী।”
“মাঞ্চারজী!”
“কেন, আশ্চর্য্য হইতেছেন নাকি?”
“কীর্ত্তিকর সাহেব, কি বলিয়াছেন?”
“তিনি মাঞ্চারজীকে ধরিয়া তাঁহার নিকটে লইয়া যাইতে বলিয়াছিলেন। না হইলে সে আজই লম্বা দিত।”
“বটে—”
“হাঁ। তাহাই তাহাকে এইমাত্র গ্রেপ্তার করিয়াছি। ইনস্পেক্টর তাহাকে থানায় লইয়া গিয়াছেন।”
“তুমি ত দেখিতেছি, তোমার কেসের এক রকম হেস্তনেস্ত—যাহা হয় একটা করিয়া ফেলিলে।”
“আপনার কেসের কতদূর?”
“এখনও কিছুই করিতে পারি নাই। আমার প্রমাণ যাহার বিরুদ্ধে—কীর্ত্তিকর সাহেব তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে দেন না।”
“কে—হরমসজী?”
“হাঁ।”
“তিনি যে প্রমাণ সংগ্রহ করিতে বলিয়াছিলেন, তাহার কতদূর কি করিলেন?”
“কতক করিয়াছি, তাহাই বলিতে তাঁহার নিকট যাইতেছি।”
“আমিও তাঁহার নিকট যাইতেছি। চলুন, একসঙ্গে যাই।”
উভয়ে কথা কহিতে কহিতে কীর্ত্তিকর সাহেবের সহিত দেখা করিতে চলিলেন।
পরদিবস বর্জরজী ফিরিয়া আসিল। দ্বারে চাকী দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল। সহসা তাহার দৃষ্টি পার্শ্ববর্তী চাবীর দিকে পড়িল।
বর্জরজী দ্বার খুলিয়া গৃহে প্রবিষ্ট হইল। তৎপরে যেখানে যাহা যেরূপ ছিল, ঠিক সেইরূপ রাখিয়া, পূর্ব্বের ন্যায় দ্বার রুদ্ধ করিয়া তৎক্ষণাৎ সে বাটী পরিত্যাগ করিয়া গেল।
ডিটেক্টিভ-কৰ্ম্মচারী অলক্ষ্যে থাকিয়া নীরবে তাহার অনুসরণ করিল।