চতুর্থ অধ্যায় । সাপ আর সাপের ডিম
রাজা ফিলিপ গায়ের জোরে গ্রিসের রাষ্ট্রগুলিকে মাথা নত করতে বাধ্য করলেন। তাঁকে স্বীকার করলে না কেবল স্পার্টা।
কিন্তু মনে মনে কুলীন গ্রিকরা তাঁর শত্রু হয়েই রইলেন। ডিমোসথেনেস তো স্পষ্ট ভাষাতেই বলে বেড়াতে লাগলেন, ‘ফিলিপকে গ্রিক বলাই যেতে পারে না। সে হচ্ছে ষোলো আনা বর্বর।’
ডিমোসথেনেসের এ উক্তি হচ্ছে ভিত্তিহীন। মাসিডনের বাসিন্দারা গ্রিক ছাড়া আর কিছুই নয়। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতেও আলেকজান্ডার নামে মাসিডনের আর এক রাজা গ্রিকদের সঙ্গে গ্রিকের মতোই পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
ডিমোসথেনেস চাইতেন, গ্রিসের মধ্যে সর্বপ্রধান হোক এথেন্স। এই স্বপ্নকে সফল হতে দিলেন না বলেই ফিলিপ পড়লেন তাঁর বিষ দৃষ্টিতে।
ফিলিপ কিন্তু এইসব বিরুদ্ধতাকে তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দিলেন। স্পষ্ট কথা সহ্য করবার শক্তি তাঁর ছিল। এ সম্বন্ধে একটি গল্প আছে।
সেকালকার গ্রিকরা অত্যন্ত মদ্যপান করতেন। ফিলিপও মাঝে-মাঝে মদের মাত্রা বাড়িয়ে মত্ত হয়ে পড়তেন।
একদিন ফিলিপ মাতাল হয়ে বসে আছেন, এমন সময়ে একজন স্ত্রীলোক কোনও বিষয় নিয়ে কী অভিযোগ করতে এল।
ফিলিপ তাকে ধমক দিয়ে বিদায় করতে চাইলেন।
স্ত্রীলোকটি বললে, ‘আমি আপনার বিরুদ্ধে নালিশ করব।’
ফিলিপ রাগে গর্জন করে বললেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তুই কার কাছে নালিশ করবি?’
স্ত্রীলোকটি বললে, ‘অমাতাল ফিলিপের কাছে।’
ফিলিপ একেবারে চুপ।
ফিলিপ শত্রুকেও মিত্র করতে জানতেন। আর একটি গল্প শোনো।
একদিন ফিলিপের কাছে খবর এল, একজন সেনানী তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন।
পরামর্শদাতারা বললেন, ‘লোকটাকে হয় প্রাণদণ্ড দেওয়া, নয় কারাগারে নিক্ষেপ করা হোক।’
ফিলিপ বললেন, ‘না। দেহের কোনও অংশে রোগ হলেই কি সেই অংশ কেটে ফেলা উচিত? আগে কি দেখা উচিত নয়, ওষুধ দিয়ে তা সারানো যায় কি না?’
ফিলিপ সেই চক্রান্তকারী সেনানীকে ডেকে আনালেন। তাকে আদর যত্ন করলেন, উপহার দিলেন।
লজ্জিত সেনানী চলে গেল। সেইদিন থেকে সে হল ফিলিপের পরম ভক্ত। বাপের এ গুণও ছেলে পেয়েছিলেন আংশিক ভাবে।
গ্রিসের নায়ক হয়ে ফিলিপ তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে মেটাবার জন্যে উদ্যোগ আয়োজনে নিযুক্ত হলেন। একটি মহাসভায় গ্রিসের সমস্ত রাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ করা হল। সবাই প্রতিনিধি পাঠালে—কেবল স্পার্টা ছাড়া (খ্রিঃ পূঃ ৩৩৭)।
সেই সভায় ফিলিপ সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন যে, চিরশত্রু পারস্যের বিরুদ্ধে সমগ্র গ্রিস যদি না এক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার সর্বনাশের সম্ভাবনা। পারস্যকে আগে আক্রমণ না করলে সেইই আমাদের আক্রমণ করবে।
রাষ্ট্র প্রতিনিধিরা প্রস্তাবটাকে মনে মনে পছন্দ না করলেও মুখে সায় দিতে বাধ্য হলেন। এবং কী কী উপায়ে প্রস্তাবটাকে কার্যে পরিণত করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হল—যদিও এ-আলোচনায় কারুরই বিশেষ আগ্রহ দেখা গেল না।
ফিলিপের পক্ষে প্রতিনিধিদের সম্মতিই হল যথেষ্ট। তাঁদের আগ্রহ থাক আর না থাক, ফিলিপের আগ্রহ জ্বলন্ত!
কোমর বেঁধে ফিলিপ কাজে লেগে গেলেন। সামরিক ব্যবস্থাপক ও রণকৌশলী ও সৈন্যচালক হিসাবে গ্রিসের মধ্যে তিনি তখন ছিলেন অদ্বিতীয়। তার উপরে গত মহাসভায় তিনি পেয়েছেন সম্পূর্ণ কর্তৃত্বের ভার—কারুর নেই তাঁকে বাধা দেবার অধিকার।
পুরো বারো মাস ধরে চলল উদ্যোগ পর্ব।
আলেকজান্ডারেরও চিত্তে তখন জাগ্রত হয়েছে উচ্চাকাঙ্ক্ষা! তিনি বিষণ্ণ স্বরে বললেন, ‘পৃথিবীর সমস্ত দেশ বাবাই নিজে দখল করবেন, আমাদের জন্যে আর কিছুই রেখে যাবেন না।’
ফিলিপের নির্দেশে এথেন্সের সমস্ত যুদ্ধজাহাজ সমুদ্রের বুকে ভাসল। এশিয়া মাইনরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত অধিকার করবার জন্যে মাসিডনের সেনাপতি পার্মেনিয়োকে সসৈন্যে প্রেরণ করা হল।
ফিলিপ তাঁর চিরপ্রার্থিত অভিযানের জন্যে প্রস্তুত! এমন সময়ে ঘটল বিষম দুর্ঘটনা।
পারিবারিক এক বিবাদে হত্যাকারীর হস্তে ফিলিপ হঠাৎ মারা পড়লেন। তাঁর বয়স তখন ছেচল্লিশ বৎসর (খ্রিঃ পূঃ ৩৩৬)।
সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যময় বিপ্লবের সূত্রপাত।
এথেন্সে আনন্দ উৎসবের সাড়া পড়ে গেল। সে মাসিডনের কাছে নত হয়েছিল কেবল ভয়ে, পারস্যের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষার ইচ্ছা তার কিছুমাত্র ছিল না।
বক্তা ডিমোসথেনেস অভিনয়ের সুরে বললেন, ‘ফিলিপ মরেছে, একথা আমি বিশ্বাস করি না। ফিলিপ মরলে তার দেহের দুর্গন্ধে এতক্ষণে সারা গ্রিস পূর্ণ হয়ে যেত!’
অন্যান্য গ্রিক রাষ্ট্রও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। চারিদিকেই মাসিডনের শত্রু! ফিলিপ মৃত, বজ্রমুষ্টির ভয় আর নেই। থ্রেস ও ইল্লিরিয়াও আবার বিদ্রোহের জন্যে তৈরি হতে লাগল। ফিলিপের ছেলে আলেকজান্ডার, সে তো একফোঁটা বালক! মাত্র কুড়ি বৎসর বয়স তার! তাকে আবার ভয় কী? সর্বত্রই এই মনোভাব।
এখন কালবিলম্ব করলেই সর্বনাশ! কিন্তু বিলম্ব হল না।
শত্রুরা নির্বোধ। তারা আলেকজান্ডারকে এখনও চিনতে পারেনি। তারা কিছু সন্দেহ করবার আগেই আলেকজান্ডার বিপদের গুরুত্ব বুঝে সচেতন হয়ে উঠলেন। সর্বপ্রথমে তিনি করলেন পিতৃহত্যাকারীকে বধ। তারপর বিভিন্ন শত্রুরা সম্মিলিত হবার আগেই সসৈন্যে ঝড়ের মতন তাদের উপরে গিয়ে পড়লেন। শত্রুরা স্তম্ভিত! একে একে আবার তারা করলে মাথা নত।
এথেন্সে গুজব রটল, পার্বত্য প্রদেশের ভিতরে গিয়ে আলেকজান্ডার যুদ্ধে মারা পড়েছেন। পথ একেবারে নিষ্কণ্টক ভেবে এথেন্সের বিদ্রোহীরা মুখোশ খুলে ফেললে—এমন সময় তাদের সামনে এসে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেন অত্যন্ত জীবন্ত, বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার!
তাড়াতাড়ি আবার মাথা নত করে এথেন্স হাসিমুখে বললে, ‘এসো বীর, অভিনন্দন নাও।’
আলেকজান্ডার সব বুঝেও মুখে কিছু বললেন না।
সমগ্র গ্রিস বললে, ‘রাজা ফিলিপ পরলোকে। আজ থেকে তুমিই আমাদের নেতা।’
থিবজ প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। তার ফলও হল ভয়ানক। আলেকজান্ডারের সঙ্গে লড়তে গিয়ে সে হেরে গেল। তারপর গোটা থিবজ পরিণত হল ধ্বংসস্তূপে। আলেকজান্ডার চিরদিনই কাব্যপ্রিয়। তাঁর হুকুমে ভাঙা হল না খালি গ্রিসের গীতিকবি পিন্ডারের বাড়ি। যদিও পিন্ডার তখন পরলোকে, তবু তাঁর স্মৃতিমাখা ওই বাড়িখানি আলেকজান্ডার পবিত্র বলেই মনে করলেন।
থিবজের পরিণাম দেখে গ্রিসের অন্যান্য নগর সভয়ে উপলব্ধি করতে পারলে, প্রৌঢ় ফিলিপের চেয়ে প্রায় বালক আলেকজান্ডার কম সাংঘাতিক নন। প্রভু হবার যোগ্যতা তাঁর আছে। তাঁর কাছে বশ মানা ছাড়া উপায় নেই।
গ্রিসে ‘সিনিক’ নামে এক সম্প্রদায়ের দার্শনিক ছিলেন। তাঁদের মোটামুটি মত হচ্ছে এই : বেশিরভাগ মানুষ অসুখী, কারণ তারা হরেক রকম সামাজিক বন্ধনে বন্দি এবং তারা যা চায় তা পায় না—অর্থাৎ ভালো খাবার, ভালো পোশাক ও বিলাসী জীবন। যদি সত্যিকার সুখী হতে চাও, তবে ওইসব তুচ্ছ জিনিসের কথা ভুলে যাও এবং পথচারী কুকুরের মতন সরল ভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করো। এই রকম মতের জন্যে গ্রিসের লোকরা ‘সিনিক’-দার্শনিকদের নাম রেখেছিল, ‘কুকুর’।
গ্রিসে তখন ডায়োজেনেস নামে একজন বিখ্যাত ‘সিনিক’ ছিলেন। আজও তাঁর নাম অমর। তিনি কেবল ল্যাঙট পরে বাস করতেন মস্তবড় একটা মাটির জালার ভিতরে। সরল জীবনযাত্রার চূড়ান্ত!
আলেকজান্ডার একদিন কৌতূহলী হয়ে তাঁকে দেখতে গেলেন। ডায়োজেনেস তখন প্রায় নগ্ন অবস্থায় জালার ভিতরে বসেছিলেন।
আলেকজান্ডার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পণ্ডিত, আপনাকে সুখী করবার জন্যে আমি কী করতে পারি?’
জালার ভিতর থেকে ডায়োজেনেস বললেন, ‘আমার সুমুখ থেকে বিদায় হতে পারো।’
এই কবুল জবাবে আলেকজান্ডার খুশি হলেন। আসবার সময়ে বললেন, ‘আমি যদি আলেকজান্ডার না হতুম, তাহলে আমি ডায়োজেনেস হতে চাইতুম!’