চতুর্থ। মেঘ আর বিদ্যুৎ
কাবুল থেকে কান্দাহারের পথ। তৈমুর হয়েছেন দক্ষিণের যাত্রী।
তারপর আমির হুসেনের সঙ্গে দেখা। হুসেনের দল তৈমুরের চেয়ে ভারী।
তুষারবর্ষী শীত—মানুষের দেহকে ভাসিয়ে বরফ করে দিতে চায়। তৈমুর ও হুসেন সদলবলে বিশ্রাম করতে লাগলেন।
তন্মধ্যে সিজিস্থানের এক সর্দার এসে তাঁদের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করলেন। তাঁর প্রজারা বিদ্রোহী হয়েছে, তৈমুর ও হুসেন সর্দারের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ দমন করতে রাজি হলেন।
তৈমুর রাজি হলেন কেবল নতুন অ্যাডভেঞ্চারের লোভে। হুসেন রাজি হলেন এই ফাঁকে দক্ষিণ প্রদেশের প্রভু হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষায়।
এই তিন যোদ্ধার সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে সিজিস্থানের বিদ্রোহীরা দাঁড়াতে পারলে না। দুর্গের পর দুর্গ বিদ্রোহীদের হাতছাড়া হতে লাগল।
অতি লোভী হুসেন ভাবলেন, দাঁও মারবার এই মস্ত সুযোগ! তিনি গ্রামের পর গ্রাম লুণ্ঠন করতে লাগলেন, চারিদিকে নিজের সৈন্যদের ঘাঁটি বসালেন।
নির্বোধ হুসেন! ব্যাপার দেখে খাপ্পা হয়ে সিজিস্থানের সর্দার বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমস্ত গোলযোগ মিটিয়ে ফেললেন এবং তারপর আক্রমণ করলেন তৈমুর ও হুসেনকেই।
তৈমুরের রণকৌশলে সিজিস্থানীরা পরাজিত হল বটে, কিন্তু তিনি নিজে হলেন আহত। একটা তির এসে তাঁর হাতের হাড় ভেঙে দিলে, আর একটা এসে ঢুকল তাঁর পায়ের ভিতরে। হুসেনের নির্বুদ্ধিতার জন্যে শাস্তি পেতে হল তৈমুরকেই।
সেই গিরিরাজ্যের মধ্যে আহত ও অকর্মণ্য তৈমুরকে বিশ্রাম করবার পরামর্শ দিয়ে, হুসেন নিজের সৈন্যদল নিয়ে উত্তর দিকে যাত্রা করলেন।
খবর পেয়ে স্বামীর সেবা করবার জন্যে এলেন আলজাই। জন্মযোদ্ধা তৈমুর বাধ্য হয়ে অস্ত্র ছেড়ে গার্হস্থ্য জীবনযাপন করতে লাগলেন। কোলে বসে খেলা করে ছেলে জাহাঙ্গির, পাশে বসে মিষ্টি কথা বলেন সুন্দরী আলজাই, সামনের উপত্যকা দিয়ে আঙুরলতা দুলিয়ে বয়ে যায় ফুলগন্ধী বাতাস, রাতের চাঁদ উঠে তাঁদের পানে তাকায় আলোমাখা মুখে!
তৈমুরের কিন্তু শান্তি নেই—আলস্য তাঁর পক্ষে বিষ। বিপুল বিশ্ব জাগতে চায় যাঁর নখদর্পণে, ফুলের কুঞ্জে বসে দিবাস্বপ্ন দেখতে তাঁর ভালো লাগবে কেন?
কিন্তু উপায় নেই, দেহ অপটু। অশান্ত তৈমুরের মন করে ছটফট, চারিদিকে ঘোরাফেরা করেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
কিছুকাল পরে অধীর স্বরে তিনি বললেন, ‘নিয়ে এসো আমার ঘোড়া, নিয়ে এসো আমার তরবারি, নিয়ে এসো আমার বর্ম আর শিরস্ত্রাণ!’
তৈমুর আবার যোদ্ধার সাজ পরলেন। তিনি সিধে হয়ে দাঁড়ালেন বটে, কিন্তু হাঁটতে গেলেই তাঁকে খোঁড়াতে হয়। তাঁর পা আর সারল না, এবং তখন থেকেই তাঁর নাম হল তৈমুর লং বা খোঁড়া তৈমুর!
তৈমুরের হাতের ভাঙা হাড় তখনও জোড়া লাগেনি, তিনি ঘোড়ার লাগাম পর্যন্ত ধরতে পারেন না; কিন্তু তবু তাঁকে যাত্রা করতে হল।
শ্যালক হুসেন আবার এক কীর্তি করে বসেছেন। বোকার মতন তৈমুরের মানা না মেনে জাট-মোগলদের আক্রমণ করতে গিয়ে হেরে ভূত হয়েছেন। তৈমুর চলেছেন তাঁকেই সাহায্য করতে।
গিরিসঙ্কটের সামনেই এক নদী। সেইখানে ছাউনি ফেলে তৈমুর অপেক্ষা করছেন, এমন সময়ে একদিন এক ঘটনা।
পরিষ্কার রাত, ধবধবে চাঁদের আলো। আড়ষ্ট খঞ্জ পদকে কার্যক্ষম করে তোলবার জন্যে তৈমুর একাকী নদীর তীরে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছেন।
ভোরের আভাস জাগল পূর্বাকাশে—তখনও তৈমুর বিনিদ্র।
আচম্বিতে দেখা গেল, গিরিসঙ্কটের অন্য পাশ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে দলে দলে সশস্ত্র অশ্বারোহী। তৈমুর তখনই নিজের সৈন্যদের ডাক দিয়ে একলাই ছুটে গেলেন তাদের দিকে।
চিৎকার করে বললেন, ‘কে তোমরা? কোথা থেকে আসছ? কোথায় যাচ্ছ?’
উত্তর এল, ‘আমরা হচ্ছি প্রভু তৈমুরের ভৃত্য। আমরা তাঁরই খোঁজে চলেছি।’
সাবধানের মার নেই। তৈমুর বললেন, ‘আমিও তৈমুরের চাকর। তোমরা যদি প্রভুর কাছে যেতে চাও, আমার সঙ্গে এসো।’
তিনজন লোক এগিয়ে এসেই তৈমুরকে চিনতে পেরে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সসম্মানে তাকে অভিবাদন করলে।
তখন তৈমুরও চিনলেন। এরা তাঁরই—অর্থাৎ বার্লাস গোষ্ঠীর তিন সর্দার।
তাদের মুখে খবর পাওয়া গেল, জাট-মোগলেরা আবার এমন অত্যাচার শুরু করেছে যে, সারা দেশের লোক খেপে উঠছে। দেশের লোক এখন দলপতিরূপে পেতে চায় আমির তৈমুরকেই।
এত বড় সুযোগ তৈমুর ছাড়লেন না। যদিও এখনও দেহ তাঁর প্রায় পঙ্গু, তবু তিনি ছাউনি তুলে ধরলেন দেশের পথ।
আমু নদীর তীর ধরে যাত্রা করেছেন জাট-মোগলদের সেনাপতি বিকিজুক। সঙ্গে তাঁর বিশ হাজার সুশিক্ষিত অশ্বারোহী সৈন্য।
আমু নদীর আর এক তীর ধরে অগ্রসর হয়েছেন তৈমুর। তাঁর অর্ধশিক্ষিত সৈন্যের সংখ্যা পুরো পাঁচ হাজারও হবে না।
আমু নদী ক্রমে সঙ্কীর্ণ হয়ে এল। তারপর একটি পাথরের সেতু। এক মাস পরে বিকিজুক এইখানে এসে তাঁবু ফেললেন।
তৈমুর নদীর এ তীরে মাত্র পাঁচ শত লোক রেখে বাকি সৈন্য নিয়ে লুকিয়ে নদী পার হলেন। তারপর পাহাড়ের আনাচে-কানাচে নিজের সৈন্যদের ছড়িয়ে দিয়ে সকলকে রাত্রির অন্ধকারে অর্ধচন্দ্রাকারে শত্রুব্যূহের দিকে অগ্রসর হতে বললেন, তাদের উপরে হুকুম রইল, তারা যেন সকলেই মশাল জ্বেলে এগিয়ে যায়।
গভীর রাত্রে জাট-মোগলরা সভয়ে দেখলে, তাদের তিন দিক বেষ্টন করে এক অগ্নিময় বিপুল অর্ধচক্র এগিয়ে আসছে! তারা ভাবলে, শত্রুরা সংখ্যায় অগণ্য!
ভোর হওয়ার আগেই ভীত জাট-মোগলরা বিশৃঙ্খল হয়ে পালাতে আরম্ভ করলে! তৈমুর তখন আক্রমণ করলেন বিপুল বিক্রমে।
ইতিমধ্যে আমির হুসেনও সসৈন্যে এসে পড়লেন। তিনি বললেন, ‘পরাজিত শত্রুর অনুসরণ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।’
তৈমুর বললেন, ‘ওরা এখনও পরাজিত হয়নি।’
অপটু দেহেও তৈমুর দ্বন্দ্বযুদ্ধে বিকিজুক ও অন্য দুইজন সেনাপতিকে স্বহস্তে হারিয়ে বন্দি করলেন। জাট-মোগলদের দুর্দশা দেখে সাহস সঞ্চয় করে দলে দলে তাতারী এসে তৈমুরের পক্ষে যোগদান করতে লাগল।
তারপরেই খবর এল মহান খাঁ তোগলক আর ইহলোকে বর্তমান নেই। পিতার গদিতে বসবার জন্যে যুবরাজ ইলিয়াজ তাড়াতাড়ি সমস্ত জাট সৈন্য নিয়ে তখনকার মতন স্বদেশের দিকে যাত্রা করলেন।
বিজয়ী তৈমুর তাঁর প্রিয় জন্ম নগর সবুজ শহর দখল করতে ছুটলেন। এখানেও তাঁর অপূর্ব কৌশলে জাট-মোগলরা হেরে গেল বিনা যুদ্ধেই।
তৈমুর এখানেও তাঁর সেপাইদের সবুজ শহরের চারিদিকে দূরে দূরে ছড়িয়ে দিলে। তারপর তারা অসংখ্য গাছের ডাল ভেঙে ধুলো ঝাঁট দিতে দিতে অগ্রসর হল।
নগরের জাট-মোগলরা দূরে যেদিকে তাকায়, সেই দিকেই দেখে পুঞ্জ পুঞ্জ ধুলোর মেঘ! তারা ভাবলে, না জানি কত সৈন্যই আসছে আমাদের আক্রমণ করবার জন্যে!
শহর ফেলে দিলে তারা পিঠ টান!
তৈমুর এক বিপুল বাহিনীকে হারিয়ে দিলে আগুনখেলা দেখিয়ে এবং একটি নগর দখল করলেন তুচ্ছ ধুলোরাশি উড়িয়ে!
তারপরেই তৈমুরের তারকা আর একবার হল নিম্নগামী।
নতুন মহান খাঁ ইলিয়াজ নিজের পরাজয় ভুললেন না। আবার তিনি সদলবলে এলেন তৈমুরকে শাস্তি দিতে।
এবারে জাট-মোগলরা সংখ্যায় তাতারীদের চেয়ে কম বটে, কিন্তু তাদের শিক্ষা, অস্ত্রশস্ত্র ও অশ্ব ছিল তাতারীদের চেয়ে ঢের উন্নত।
তৈমুর নিজের সৈন্যদল তিন অংশে বিভক্ত করলেন—দক্ষিণভাগ, মধ্যভাগ ও বামভাগ। দক্ষিণ ভাগ ছিল সমধিক প্রবল এবং বামভাগ ছিল সবচেয়ে দুর্বল। তৈমুর ইচ্ছা করেই নিজে বামভাগের ভার নিয়ে দক্ষিণভাগে পাঠিয়ে দিলেন আমির হুসেনকে। কথা রইল, দরকার হলেই হুসেন এসে তাঁকে সাহায্য করবেন।
এদিকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন করে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। হা হা রবে গর্জন করছে ক্রুদ্ধ ঝটিকা! ভূমি কর্দমাক্ত, চলতে পা বসে যায়; নদী খেপে উঠেছে, চারিদিকে ছুটছে বন্যার প্রবাহ; ধনুকের ছিলা ভিজে গেছে—তাতারীদের প্রিয় অস্ত্র অচল।
তবু কেবলমাত্র তরবারি-বর্শা ও কুঠার নিয়ে তৈমুর সদলবলে দুর্দান্ত সিংহের মতন জাট-মোগলদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অস্ত্রে অস্ত্রে ঝনৎকার, মেঘে মেঘে বিদ্যুৎ—পৃথিবীতেও অসি-বর্শার বিদ্যুৎ-চমক, অঙ্গহীন দেহ—দেহহীন মুণ্ড, ভূমিতলে রক্তহাসির উচ্ছ্বাস, জাট-মোগলদের জয়নাদ ‘দার উ গুর!’ তাতারীদের জয়নাদ—’আল্লা হো আকবর!’ গতির ঝড়, আহতদের মৃত্যু-চিৎকার!
তৈমুর শত্রুদের পতাকা কেড়ে নিলেন। পতাকা হারিয়ে জাট-মোগলরা হতাশভাবে পশ্চাৎপদ হতে লাগল।
এই সময়ে চাই হুসেনের দলকে! হুসেন এলেই যুদ্ধজয়!
তৈমুরের দূত হুসেনের কাছে ছুটে গিয়ে বললে, ‘আমার প্রভু আপনাকে আহ্বান করেছেন—শীঘ্র আসুন!’
হুসেন চটে গিয়ে দূতের গালে প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিয়ে আমিরি চালে বললেন, ‘তৈমুর আমাকে হুকুম দিতে চায়, আমি কি কাপুরুষ?’
দূতের মুখে সব শুনে তৈমুর অনেক কষ্টে ক্রোধ সংবরণ করলেন। তারপর হুসেনের দুই আত্মীয়ের দ্বারা বলে পাঠালেন, ‘জাট-মোগলেরা পালাবার জন্য প্রস্তুত, এখন সকলে মিলে আক্রমণ করলে জয়ী হব আমরাই।’
হুসেন সক্রোধে বললেন, ‘আমি কি পশ্চাৎপদ হয়েছি? তবে আমাকে বার বার অগ্রসর হতে বলা হচ্ছে কেন? সবুর করো, আগে আমি আমার সৈন্যদের এক জায়গায় এনে জড়ো করি!’
হুসেন তখনও গেলেন না। জাট-মোগলদের সংরক্ষিত সৈন্যরা তৈমুরকে ফিরে আক্রমণ করলে। ফল, তৈমুরের পরাজয়।
তৈমুর প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘হুসেনের সঙ্গে আর কখনও যুদ্ধযাত্রা করব না।’
হুসেন তাঁর কাছে লোক পাঠিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘চলো, আমরা ভারতবর্ষের দিকে যাই।’
তৈমুর তখন অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন। উত্তর দিলেন, ‘ভারতবর্ষে বা নরকে, তুমি যেখানে খুশি যাও, তাতে আমার কী?’
হুসেনের দোষে নিশ্চিত জয় তাঁর হাতছাড়া হয়ে গেল। এজন্যে হুসেনকে তিনি জীবনে আর ক্ষমা করেননি। তৈমুরের শত্রুতা যে কী নিষ্ঠুর, হুসেন অল্পদিন পরেই তা বুঝতে পেরেছিলেন।
তৈমুর আবার সমরখন্দে ফিরে এসে দেখলেন, নিয়তির ভাণ্ডারে তাঁর জন্যে আরও নিদারুণ দুঃখ সঞ্চিত হয়ে আছে।—
তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী আলজাইকে মৃত্যু এসে হঠাৎ কেড়ে নিয়ে গেল।
কিন্তু এখন শোকের সময় নেই। সারা দেশ ছেয়ে ছুটে আসছে বিজয়ী শত্রুরা পঙ্গপালের মতন! বাধা দিতে হবে, তাদের বাধা দিতে হবে!