চতুর্থ। আবার দুঃসংবাদ
সপ্তাহ কাল পরে হর্ষবর্ধন যখন অশ্রুভারাক্রান্ত চক্ষে পিতার রোগশয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, মহারাজা প্রভাকরবর্ধনের সংজ্ঞা তখন লোপ পেয়েছে।
বিপদের উপরে বিপদ। মহারানি যশোমতী প্রতিজ্ঞা করেছেন, স্বামীহারা পৃথিবীতে তিনি এক মুহূর্ত বাস করতে রাজি নন, প্রভাকরবর্ধনের আগেই দেহত্যাগ করবেন জ্বলন্ত চিতায়।
হর্ষবর্ধন মায়ের পায়ের তলায় আছড়ে পড়ে আকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘মা, মা। আমি কি একসঙ্গে মাতৃপিতৃহারা হব?’
যশোমতী বললেন, ‘বাছা, স্নেহের মোহে আমাকে অভিভূত করবার চেষ্টা কোরো না। সন্তানকে ইহলোকে রেখে পিতামাতা পরলোকে গমন করবেন, এই হচ্ছে ভগবানের নিয়ম। কিন্তু তার পরও পিতামাতা জীবিত থাকেন সন্তানের মধ্যেই। সুতরাং আমাদের অভাব তোমাকে অনুভব করতে হবে না। ধার্মিক হও, বীর্যবান হও, আর্যাবর্তের গৌরব হও,—তোমার প্রতি এই আমার শেষ আশীর্বাদ।’
প্রধানমন্ত্রী এসে বললেন, ‘মহারানি, মহারাজের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আজকের রাত কাটে কি না সন্দেহ! এখন আমাদের কর্তব্য কী? যুবরাজ সুদূর রণস্থলে, কিন্তু রাজসিংহাসন তো এক মুহূর্ত শূন্য থাকতে পারে না। তবে কি আমরা ছোট রাজকুমারকেই সিংহাসনের অধিকারী বলে মনে করব?’
যশোমতী শান্ত স্বরে বললেন, ‘মন্ত্রীবর, জ্যেষ্ঠ আর কনিষ্ঠ, জননীর কাছে সব পুত্রই সমান। যাকে যোগ্য মনে করেন, তাকেই আপনারা সিংহাসনের উপরে স্থাপন করতে পারেন। আমি এখন পরলোকের যাত্রী, ঐহিক বিষয় নিয়ে আর কেন আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছেন? আমার চোখের সামনে এখন জাগছে কেবল স্বামী দেবতার পবিত্র পাদপদ্ম, তাই দেখতে দেখতে এইবারে আমি অগ্নিশয্যায় শয়ন করব’ বলতে বলতে তিনি সেখান থেকে প্রস্থান করলেন দ্রুতপদে।
প্রধানমন্ত্রী দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘তাই তো, মহারাজা এখন হতবাক, মহারানিও আমাদের কোনও স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে গেলেন না। আমাদের কর্তব্য কী, কিছুই বুঝতে পারছি না।’
হর্ষবর্ধন বললেন, ‘আপনাদের কর্তব্য তো খুব স্পষ্ট।’
মন্ত্রী সবিস্ময়ে বললেন, ‘কী রকম?’
‘পিতৃদেবের মৃত্যু সুনিশ্চিত। এখন আপনাদের কর্তব্য হল যুবরাজের জন্যে অপেক্ষা করা।’
‘রাজকুমার, আপনি বালক, তাই এমন কথা বলতে পারলেন। শূন্য সিংহাসন যে কত বিপদের আধার, সে জ্ঞান এখনও আপনার হয়নি। কার জন্যে আমরা অপেক্ষা করব? যুবরাজ! তিনি গিয়েছেন ভয়াবহ হুনদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। যুদ্ধে তিনি যদি বার বার পরাজিত হন তাহলেও ততটা চিন্তার কারণ নেই, কারণ এর পরেও শত্রুদের দ্বিতীয় বার বাধা দেওয়ার সুযোগ হতে পারে। কিন্তু ভগবান না করুন, যুদ্ধে যদি যুবরাজের মৃত্যু হয়, তাহলে এই বিশাল সাম্রাজ্যকে রক্ষা করবে কে?’
হর্ষবর্ধনের পূর্ণকণ্ঠে বললেন, ‘রক্ষা করব আমি। দাদার অবর্তমানে আমি আছি। কিন্তু মন্ত্রীমহাশয়, এটুকু ভালো করেই জেনে রাখবেন, যুবরাজ বর্তমান থাকতে কোনওদিনই আমার মনে ঠাঁই পাবে না তুচ্ছ রাজ্যলোভ।’
হর্ষবর্ধনের কচি মুখে এখনও দেখা যায়নি গোঁফের রেখা! সেই শিশুর মতন সরল মুখের পানে তাকিয়ে প্রবীণ মন্ত্রী মনের ভিতর থেকে একটুও জোর পেলেন না। মনে মনে বললেন, ‘তোমার মুখ দেখলে এখনও তোমাকে নারী বলেই সন্দেহ হয়। হুনযুদ্ধে যুবরাজের পতন হলে তুমিই রাজ্য রক্ষা করবে বটে।’
হর্ষবর্ধন দাঁড়িয়েছিলেন প্রাসাদের এক বাতায়নের সামনে। বাইরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘দেখুন মন্ত্রীমশাই, দেখুন দেখুন।’
‘কী রাজকুমার!’
‘এক অশ্বারোহী সৈনিক বায়ুবেগে অশ্বচালনা করে প্রাসাদের সিংহদ্বারে এসে নামল। নিশ্চয় যুদ্ধক্ষেত্রের কোনও বার্তা এসেছে।’
পরক্ষণেই শোনা গেল ঘন ঘন ভেরি, দামামা ও বহু কণ্ঠের উচ্চ জয়ধ্বনি।
মন্ত্রী উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘তাহলে কি যুবরাজ হুনযুদ্ধে জয়লাভ করেছেন?’
হর্ষবর্ধন বললেন, ‘নিশ্চয়। বর্বর হুনদের সাধ্য কী আমার দাদাকে পরাজিত করবে?’
প্রাসাদের প্রধান প্রহরী বেগে ছুটে এসে খবর দিল, ‘রণক্ষেত্র থেকে অগ্রদূত সংবাদ বহন করে এসেছে, মহাবীর রাজ্যবর্ধনের প্রবল প্রতাপের সামনে দুর্বৃত্ত হুন-দস্যুদল ঝটিকাতাড়িত তৃণদলের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে! অসংখ্য হুন-বন্দি নিয়ে যুবরাজ রাজধানীর দিকে আগমন করছেন।’
চারিদিকে শোক-দুঃখের সঙ্গে আনন্দের বিচিত্র সম্মিলন। মহাসতী মহারানি যশোমতীর চিতাগ্নিশিখা ম্লান হতে না হতেই মহারাজাধিরাজ প্রভাকরবর্ধনের অন্তিম নিশ্বাস মিলিয়ে গেল অনন্তের অতলে। এবং ক্রন্দন-মুখরিত রাজপুরীর মধ্যে যখন প্রবেশ করলেন নতশিরে সাশ্রুনেত্রে যুবরাজ রাজ্যবর্ধন, তখন তার মুখে দেখা গেল না যুদ্ধজয়ের কোনও আনন্দেরই নিদর্শন।
রাজ্যবর্ধনও তরুণ যুবক, হর্ষবর্ধনের চেয়ে মাত্র চার বৎসরের বড়ো। যথাসময়ে তিনি পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করলেন বটে, কিন্তু ভাগ্য তাঁর প্রতি সুপ্রসন্ন হল না। তিনি ভালো করে সিংহাসনে বসতে না বসতেই পাওয়া যেতে লাগল দুঃসংবাদের পর দুঃসংবাদ।
প্রথমেই শোনা গেল, মালব দেশের গুপ্তবংশীয় রাজা দেবগুপ্ত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।
রাজ্যবর্ধন মন্ত্রণাসভা আহ্বান করলেন।
কিন্তু মন্ত্রণা সভার কর্তব্য স্থির হতে না হতেই পাওয়া গেল চরম দুঃসংবাদ।
মালবরাজ দেবগুপ্ত কান্যকুব্জ আক্রমণ করেছেন। সেখানকার রাজা এবং রাজ্যবর্ধনের সহোদরা রাজশ্রী দেবীর স্বামী গ্রহবর্মা যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হয়েছেন। রাজশ্রীও বন্দিনী, ‘সাধারণ দস্যুর স্ত্রীর মতো তাঁর দুই চরণে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে লৌহশৃঙ্খল।’
কেবল তাই নয়, মগধ-গৌড়-রাঢ় দেশের গুপ্তবংশীয় মহারাজা শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্ত মালবপতির সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্যে সসৈন্যে এগিয়ে আসছেন দ্রুতবেগে!
দারুণ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে রাজ্যবর্ধন বললেন, ‘কী, আমার নিরপরাধ ভগিনীর অপমান! আমি এখনই যুদ্ধযাত্রা করব।’
মন্ত্রীগণ ও সেনাপতি জানালেন, ‘মহারাজ, আমাদের সমগ্র বাহিনী এখনও প্রস্তুত হওয়ার সময় পায়নি।’
রাজ্যবর্ধন অধীর কণ্ঠে বললেন, ‘চাই না তোমাদের সমগ্র বাহিনী! আমার সঙ্গে চলুক কেবল দশ হাজার অশ্বারোহী! দুরাচার দেবগুপ্তের মতো তুচ্ছ পতঙ্গের পক্ষচ্ছেদ করতে সেই সৈন্যই যথেষ্ট। থানেশ্বরের রাজকন্যা বিধবা, আমার সহোদরা বন্দিনী, আমি কি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারি?’