৬
সন্ধে-রাত্তিরে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে ভিতরে বসে হিসেব সেরে রাখছিল গোপাল পুরকাইত। এমন সময় দোকানের দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ হল।
কে?
এই আমরা, কিছু মালপত্র নিতে এসেছি।
কী মালা?
পাইকিরি মালই নেব হে। দশ-বিশ বস্তা চাল-ডাল।
গোপাল শশব্যাস্তে উঠে দরজা খুলে দিল। বড় খদ্দের।
দু’জন মুশকো চেহারার লোক দোকানে ঢুকল। একজন দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ব্যস্ত হেয়ে না গোপাল, কথা আছে।
গোপাল পরিস্থিতিটা ভাল বলে মনে করল না। ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কি চাই তোমাদের? আমি কিন্তু…
প্ৰথমজন হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল, বলেছি তো, কথা আছে। চুপ করে বোসো।
গোপাল ফ্যাকাসে মুখে তার নিচু তক্তপোশে বসল।
প্রথম লোকটা বলল, কারবার কেমন চলছে গোপাল?
গোপাল বলল, কোনওরকমে চলে। লুটপাট করতে এসে থাকলে কিন্তু লাভ হবে না। সামান্য ব্যবসা আমার।
তোমার মতো ছোটখাটো ব্যাপারীর গদি লুঠ করে কি মানমর্যাদা খোয়াব? আমরা গোকুল বিশ্বাসের লোক।
গোপাল প্ৰমাদ গুনল। গোকুল বিশ্বাস!
চেনো তাকে?
গোপাল ঘাড় নেড়ে বলল, কে না চেনে?
আমরা ছোটখাটো কাজ করি না।
গোপাল চুপ করে রইল।
এখন যা বলছি, খুব মন দিয়ে শোনো। তারপর ঠিকঠাক জবাব দাও।
গোপাল এই শীতেও ঘামতে লাগল।
গোকুল বিশ্বাসের একটা আদরের গোরু আছে, জানো? দুধের মতো সাদা রং, বাঁ দিকের দাবনায় ত্ৰিশূলের ছাপ; খুব সুলক্ষণা গোরু। জানো?
না তো!
মিথ্যে কথা বলে কিন্তু পার পাবে না। পেট থেকে কথা টেনে বের করতে আমরা জানি। তা সেসব আসুরিক ব্যাপারের দরকার আছে কি?
গোপাল বিবৰ্ণ হয়ে বলল, জানি।
ঠিক দুদিন আগে মাঠ থেকে গোরুটা চুরি যায়।
গোপাল একটু গলাখ্যাকারি দিয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলল না।
আদরের গোরুটা চুরি হয়ে যাওয়ায় গোকুল বিশ্বাস খুব ভেঙে পড়ে। শুধু আদরেরই নয়, গোরুটা ভীষণ পয়া। ওই গোরুটা আসার পর থেকেই গোকুল বিশ্বাসের ব্যবসা দ্বিগুণ হয়েছে। এসব খবর আশপাশের গাঁয়ে সবাই জানে। তুমি জানো না, এ তো হতে পারে না! কী বলো?
শুনেছি।
বেশ কথা। এবার খুব ভেবেচিন্তে আমার কথার জবাব দিও।
গোপাল অস্বস্তি বোধ করছে। উসখুস করে বলল, কী জানতে চাও?
গোরুটা কে চুরি করেছিল?
তা কি আমার জানার কথা?
তুমি ছাড়া আর কে জানবে?
গোপাল সিঁটিয়ে গিয়ে বলল, বিশ্বাস করো, আমি জানি না।
শোনো গোপাল, তোমার চার ছেলে আর গোটাচারেক কর্মচারী আছে। অন্য সব কাজের লোকও আছে। লোকবলের অভাব নেই! তাদের সব ক’জনকে যদি ধরে একে-একে পেটানো হয়, তা হলে সত্যি কথাটা বেরোতে দেরি হবে না। সবার আগে কিন্তু তোমার চার ছেলেকে পেটাই করা হবে। আমাদের দিয়ে অত মেহনত করাবে কেন?
গোপাল ভয় পেয়ে আমতা-আমতা করে বলল, যে চুরি করেছে। তার দোষ নেই। সে হুকুম তামিল করেছে বই তো নয়।
লোকটা কে?
আমার ছেলে জয়চাঁদ।
আর গোকুল বিশ্বাসের জানালায় টোকা দিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকার হুকুমনামা জারি করে এসেছিল কে? সেও কি জয়চাঁদ?
হাঁ। কিন্তু তার দোষ নেই।
দোষের কথা তো হচ্ছে না। আমরা সত্যি কথাটা জানতে চাইছি।
গোপাল কাঁপতে কাঁপতে বলল, দ্যাখো ভাই, আমি সাতে-পাঁচে থাকি না। খোঁজ নিলেই দেখবে, আমার ছেলেরাও কেউ খারাপ নয়! তাদের কোনও বদনামও নেই। জয়চাঁদ একটু ডাকাবুকো বটে, কিন্তু কক্ষনো কোনও খারাপ কাজ সে করে না।
জয়চাঁদের কপালের বাঁ দিকে একটা আব আছে, না?
হ্যাঁ, কিন্তু, যা হয়েছে তার জন্য আমি নাকে খত দিতে রাজি! আমার ছেলেটাকে প্ৰাণে মেরো না।
তুমি তা হলে বলতে চাও জয়চাঁদ নির্দোষ?
একেবারে নির্দোষ।
তা হলে কি ধরে নেব, গোরু চুরি করা বা মুক্তিপণ আদায় করা এগুলো কোনও দোষের মধ্যে পড়ে না?
তা বলিনি।
তবে কী বলছ?
যা করেছে তা মতলব এটে করেনি। ওই যে বললাম, হুকুম তামিল না করে উপায় ছিল না। মুক্তিপণ তো আর নিজের জন্য চায়নি।
কার জন্য চেয়েছিল?
প্ৰাণগোবিন্দ রায়ের জন্য।
হুকুমটা কি প্রাণগোবিন্দবাবুই দিয়েছিলেন?
এ ব্যাপারে আমার কিছু বলা বারণ।
ঠিক আছে, বোলো না। আমরা জয়চাঁদকে তুলে নিয়ে যাচ্ছি। যা বলার সে-ই বলবে।
বলেই উঠতে যাচ্ছিল তারা।
গোপাল আঁতকে উঠে বলল, দাঁড়াও, আমিই বলছি।
বলো।
প্ৰাণগোবিন্দবাবুর হুকুমে এ কাজ হয়নি।
সেটা আমরা জানি গোপাল। আগে জানতাম না, এখন জেনেছি। এবার বলো, কার হুকুম?
গোপাল হাল ছেড়ে দিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে হঠাৎ হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। লোক দু’টো ব্যস্ত হল না। স্থির হয়ে বসে রইল বেঞ্চিতে।
বেশ কিছুটা বাদে গোপাল সামলে উঠল। ধুতির খুঁটে চোখ মুছল। তারপর ধরা গলায় বলল, তার কাছে আমার টিকি বাঁধা। আমার জমিজিরেত, ব্যবসার মূলধন সব তার কাছে বাঁধা। যদি বলি, তা হলে আমি শেষ হয়ে যাব।
তুমি না বললেও আমরা জানি। কিন্তু তবু আমরা তোমার মুখেই শুনতে চাই। বলো।
যদি জানোই তবে আর আমাকে দিয়ে বলতে চাও কেন?
তার কারণ, আমরা যাচাই করে দেখতে চাই, আমরা যা আন্দাজ করেছি। আর যা শুনেছি, তা সত্যি কিনা।
গোপাল ধরা গলায় বলল, পরশুদিনই বটুকবাবু আমাকে কাজটা করতে বলেন। কেন কোন কাজ করতে হবে তা জানতে চাওয়ার উপায় নেই। বটুকবাবু এমনিতে চুপচাপ, কিন্তু সামান্য বেয়াদপি দেখলে এমন সাংঘাতিক রেগে যান, যেন খুনও করতে পারেন। ভয়ে আমি কখনও কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারি না। তার উপর উনি আমার অন্নদাতা। অভাবে-কষ্টে যখন সংসার ভেসে যেতে বসেছিল, তখন উনি হাল না ধরলে এতদিনে মরেই যেতাম।
বটুকবাবুর রাগ কেমন?
অতি সাংঘাতিক। যখন রেগে ওঠেন, তখন চোখ-মুখের চেহারাই পালটে যায়! চোখে যেন বাঘের দৃষ্টি।
একটা কথা। উনি যখন গোরুটা প্ৰাণগোবিন্দবাবুর গোয়ালে রেখে আসতে বললেন, আর প্রাণগোবিন্দবাবুর কাছে মুক্তিপণের টাকা পৌঁছে দিতে বললেন, তখন তোমার খটকা লাগেনি?
লেগেছিল। কিন্তু খুব বেশি তলিয়ে ভাবিনি। একবার মনে হল, প্রাণগোবিন্দবাবুর সঙ্গে ওঁর বোধ হয় কোনও বন্দোবস্ত হয়েছে। শত হলেও উনি একসময় প্রাণগোবিন্দবাবুর ছাত্র ছিলেন, হয়তো তখন থেকেই ভাবসাব। আর তাই থেকেই এই বন্দোবস্ত”
উনি যে প্ৰাণগোবিন্দ রায়ের ছাত্র ছিলেন, তা কী করে জানলে?
প্ৰাণগোবিন্দ রায় যখন রিটায়ার করে দেশের বাড়িতে থাকতে এলেন, তখন খবরটা শুনে একদিন বটুকবাবু বলেছিলেন, মাস্টারমশাই তা হলে এলেন! ভালই হল!
তা হলে তোমার তেমন খটকা লাগেনি?
না।
প্ৰাণগোবিন্দবাবুর বাড়িতে কি ওঁর যাতায়াত ছিল?
না। বটুকবাবু কোথাও যান না।
তা হলে প্ৰাণগোবিন্দবাবুর সঙ্গে ওঁর বন্দোবস্ত হয় কী করে?
বললাম তো, ওটা নেহাত একটা আন্দাজ।
বটুকবাবুর একটা ভয়ংকর কুকুর আছে, তাই না?
ও বাবা! খুনে কুকুর!
শোনো গোপাল, গোকুল বিশ্বাসের সঙ্গে গন্ডগোল করে আজ অবধি কারও সুবিধে হয়নি।
আজ্ঞে, গোকুলবাবুর সঙ্গে আমার তো কোনও গন্ডগোল নেই! জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ আহাম্মক ছাড়া কেউ করে? আমরা যা করেছি তা প্ৰাণের দায়ে।
তা হলে বটুকবাবু এ কাজটা কেন করলেন বলে তোমার মনে হয়?
তা কী করে বলব। বড়-বড় মানুষের কত খেয়াল থাকে।
তাতে কী হল তা জানো? প্ৰাণগোবিন্দবাবুর মতো একজন মানী লোকের গাঁয়ে গোরু-চোরের ছাপ্পা মেরে দেওয়া হল। লোকে জানল, উনি একজন মস্ত লেখাপড়া জানা লোক হয়েও এমন জঘন্য কাজ করে টাকা উপায় করেন। লোকটা যে এমন কাজ করতে পারেন না, তা গাঁয়ের লোক বিশ্বাস করবে না। তারা গুজবে বিশ্বাসী। এর ফলে প্ৰাণগোবিন্দবাবু আত্মঘাতী হওয়ারও চেষ্টা করেন।
আমি তো অতি জানি না। আমাকে মাফ করে দাও ভাই। না খেতে পেয়ে মরলেও অার এমন কাজ করব না।
কাল সকালে গোকুলবাবুর সঙ্গে তোমার ছেলেকে নিয়ে যেও। যদি মাফ করার হয় তিনি করবেন। তোমরা লোকটাকে যত খারাপ বলে ধরে নিয়েছ, লোকটা কি তত খারাপ? গোকুল বিশ্বাস দশবারোটা ছেলের পড়ার খরচ দেয়। একটা অনাথ আশ্রম চালায়। এসব কি খারাপ লোকের লক্ষণ?
নাক মলছি, কান মলছি ভাই। গোকুলবাবুকে আমরা খারাপ ভাবি না, বিশ্বাস করো।
লোক দু’টো তার দিকে একবার বিষদৃষ্টি হেনে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। দোকানের গদিতে অনেকক্ষণ ঝুম হয়ে বসে রইল গোপাল। মনে বড় দুশ্চিন্তা, এবার কি রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হবে, আর উলুখাগড়ার প্রাণ যাবে?
একটা দিক রক্ষা হল বটে কিন্তু আর-এক দিকে যে বিপদ ঘনিয়ে এল! গোকুল বিশ্বাস যদি বা ছেড়েও দেয়, বটুকবাবু আর রক্ষে রাখবেন কি? সে ভালই জানে, গোকুলের চেয়ে বটুক কম ভয়ংকর নন, বরং আরও বেশি। গোকুলের ওস্তাদের কাছে তিনি যেসব কথা কবুল করেছেন, সেটাও চাপা যাবে না।
জীবনে প্রথম গাছে ওঠার পর প্রাণগোবিন্দ বুঝতে পারছেন, আজ তাঁর জীবনটাই যেন পালটে গিয়েছে। কোথায় গলায় দড়ি দিয়ে মরবেন, না তার বদলে বৃক্ষবাসী বাদামচন্দ্র ঘোষের মতো একজন বিজ্ঞ বন্ধু পেয়ে গেলেন। সত্যি কথা বলতে কী, গাছে উঠলে শুধু জ্ঞানই বাড়ে না, বুকে ফুর্তির ভাবাটাও উথলে ওঠে। আজ সেই ফুর্তিতেই প্রায় তুড়ি দিয়ে চলেছেন প্ৰাণগোবিন্দ। ময়নার জঙ্গলে গাছে উঠে তাঁর এমন ডগমগভাব হল যে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার পরও গাছ থেকে মোটেই নামতে চাইছিলেন না। শেষ অবধি বাদাম ঘোষের চাপাচাপিতেই নামতে হল। বাদাম ঘোষ বলল, বাপু হে, গাছে থাকার মজাই আলাদা। কিন্তু কী জানো, জ্ঞানের পোটলা নিয়ে বসে থাকলেই তো হবে না, সেটাকে কাজে লাগানোও তো দরকার। যে গন্ডগোলটা পাকিয়ে রেখে এসেছ, তার গিঁট না খুললেই নয়।
প্ৰাণগোবিন্দর অবশ্য মনে হচ্ছিল, এখন দুনিয়াও রসাতলে গেলেই বা তার কী! তিনি তো থাকবেন গাছে, দুনিয়া ভেসে যায় যাক, তবে অত আনন্দের মধ্যেও খিদো-তেষ্টা বলেও যে একটা ব্যাপার আছে, সেটা মাঝে মাঝে টের পাচ্ছিলেন, এর ফাঁকে-ফাঁকে নাতি নাতনি পিউ আর পিয়ালের কথাও বড় মনে পড়ছিল। তাই বাদাম ঘোষের চাপাচাপিতে শেষ অবধি পড়ন্ত বেলায় গাছ থেকে দু’জনে নামলেন। টের পাচ্ছিলেন তঁর মাথাটা জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেচনাশক্তিতে একেবারে টুইটুম্বুর হয়ে আছে। রোজাকার আলাভোলা, বোকাসোকা প্ৰাণগোবিন্দ যেন আর নেই, এ এক নতুন প্রাণবন্ত প্ৰাণগোবিন্দ। জ্ঞানবৃক্ষ কথাটার মানে আজ তিনি স্পষ্ট বুঝলেন।
তারপর দুই জ্ঞানবৃদ্ধ বীরদৰ্পে হেঁটে লহমায় পৌঁছে গেলেন চরণডাঙা গাঁয়ে। এ গাঁয়েই ভয়ংকর গোকুল বিশ্বাসের বাস, কিন্তু প্রাণগোবিন্দর কোথাও উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা নেই। জীবনে কখনও সঙ্গীতচর্চা করেননি প্ৰাণগোবিন্দ, কিন্তু আজ গুনগুন করে একটু রামপ্রসাদী গাইতে লাগলেন। তেমন বেসুরো গাইছেন বলেও মনে হল না তাঁর।
হুট বলতে গোকুল বিশ্বাসের বাড়িতে ঢোকা আর সিংহের গুহায় মাথা গলানো একই ব্যাপার। সেখানে গদাম-গদাম চেহারার অর ফটফট চোখওলা দন্ত কিড়মিড় করা আসুরিক লোকজন পাহারা দিচ্ছে। মাছি অবধি গলবার উপায় নেই, কিন্তু কী আশ্চৰ্য ব্যাপার! দুই জ্ঞানবৃদ্ধকে দেখে অসুরদের যেন দাঁত-নখ সব খসে পড়ল, তারা বৈষ্ণবোচিত বিনয়ে পথ ছেড়ে দিল।
প্রভঞ্জন সূত্রধর ব্যস্তসমস্ত হয়ে বোধ হয় আসছিলেন। প্ৰাণগোবিন্দকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, বাপ রে! এ যে বিচক্ষণ প্ৰাণগোবিন্দবাবু! তা কী চাই বলুন তো? আরও পাঁচ-দশ হাজার টাকা নাকি? না, না, লজ্জা পাবেন না। পঞ্চাশ হাজার যদি একটু কম হয়েছে বলেই মনে হয়ে থাকে তা হলে পরিষ্কার করে বলুন, মিটিয়ে দেওয়া হবে।
অন্য দিন হলে প্ৰাণগোবিন্দ হয়তো এ কথা শুনে রেগে যেতেন বা দুঃখে কেঁদেই ফেলতেন। কিন্তু আজ তিনি অন্য প্ৰাণগোবিন্দ, শান্ত মাথায় তিনি তখন সব কথা বলে যেতে লাগলেন, অর্থাৎ তীব্র মুখ দিয়ে অন্য এক অচেনা জ্ঞানবৃদ্ধ প্ৰাণগোবিন্দ এমন সব কথা প্রম্পট করতে লাগলেন যে, প্রভঞ্জন ভারী কঁচুমাচু হয়ে জিভ কেটে মাথা নিচু করে পালানোর পথ পান না।
গোকুল বিশ্বাসের হাতে বন্দুক বা পিস্তল ছিল না। কিন্তু যে কেউ গোকুল বিশ্বাসের চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে যে, এ মানুষের আলাদা বন্দুকের দরকার নেই। গোকুলের দু’খানা বাঘা চোখই যেন দোনলা বন্দুক। সেই চোখ থেকে যেন সর্বদাই গুলি বেরিয়ে এসে চারদিক ছ্যাঁদা করে দিচ্ছে। শালখুঁটির মতো দু’খানা হাত। ওই হাতে মোষের ঘাড় মটকানো আর গামছা নিঙড়ানো প্ৰায় একই রকম সহজ। তা এহেন গোকুল বিশ্বাসের সামনে গিয়ে যখন দুই জ্ঞানবৃদ্ধ দাঁড়ালেন, তখন গোকুলকে কে যেন ইলেকট্রিক শক দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। সে ভারী জড়সড় হয়ে হাতজোড় করে বলতে লাগল,কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য! আস্তাজের হোক! বস্তাঞ্জে হোক।
প্রাণগোবিন্দ ভারী ফুর্তি বোধ করছেন। মাথাটা যে কী চমৎকার কাজ করছে তা কহন্তব্য নয়। তিনি অতিশয় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যে নাতিদীর্ঘ ভাষণটি দিলেন, তাতে গোরুচুরি থেকে গোটা ব্যাপারটাই এত করুণ আবেদনের সঙ্গে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল যে, গোকুল বিশ্বাসের বাঘা চোখও ছলছল করতে লাগল। গোকুল বিশ্বাস ধরা গলায় বলল, আমাকে মাফ করবেন প্ৰাণগোবিন্দবাবু! আমি বড় ভুল করে ফেলেছি। এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আমিই করব। আপনি ভাববেন না।
না, প্রাণগোবিন্দর আর ভাবনাচিস্তা, উদ্বেগ, হীনমন্যতা কিছুই নেই। গোকুলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে তিনি বলে উঠলেন, চমৎকার! অতি চমৎকার”
বাদাম ঘোষও তারিফ করে বলল, তোমার দিব্যি উন্নতি হচ্ছে হে!
দাড়ি-গোঁফওয়ালা, আলখাল্লা পরা একটা লোক হঠাৎ তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভারী অবাক হয়ে প্ৰাণগোবিন্দর দিকে চেয়ে রইল। তারপর ভারী বিনয়ের সঙ্গে হাতজোড় করে বলল, কর্তাবাবু, আপনি যে একেবারে পালটি খেয়ে গেছেন! চেনাই যাচ্ছে না!
প্ৰাণগোবিন্দ গোরাং দাসের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ওরে গোরাং, আমি আর সেই আগের কর্তাবাবু নেই রে। নিজেকে আমি নিজেই চিনতে পারছি না।
গোরাং মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, তা হলে যে ভারী মুশকিল হবে কর্তবাবু! বড্ড ভজঘট লেগে যাবে যে! আপনাকে যারা এতকাল মাপজোপ করে একটা আঁচ করে রেখেছিল, তাদের সব হিসেবনিকেশ উলটে যাবে না তো!
সেসব জানি না রে গোরাং। শুধু বলতে ইচ্ছে করছে ‘আজকে আমার মনের মাঝে ধাইধপাধপ তবলা বাজে।’
গোরাং একগাল হেসে বলল, আজ্ঞে, বোলটা খুব ফুটেছে কর্তা। মনে হচ্ছে আমিও যেন শুনতে পাচ্ছি। তা কর্তা, গুরুতর একটা কথা দুই জ্ঞানবৃদ্ধ গোরাংয়ের সব কথা খুব মন দিয়ে শুনলেন। সেই ম্যাজিশিয়ানের কথা, চকোলেট, রহস্যময় চিরকুট, শেষের বটুক সমস্তের কুকুর আর টক্কেশ্বরের অভিজ্ঞতার কথাও।
শুনে বাদাম ঘোষ বলল,কিছু বুঝলে হে প্ৰাণগোবিন্দ?
প্ৰাণগোবিন্দ একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, জলের মতো।
কী বুঝলে?
ম্যাজিশিয়ানটা জালি। আর যেই হোক, লোকটা বিক্ৰমজিৎ নয়।
মাথা নেড়ে বাদাম ঘোষ বলে, আমারও তাই মনে হয়েছে।
একটু চিন্তিত মুখে প্রাণগোবিন্দ বললেন, আমার গিন্নি বলেন, আমার নাকি বড় ভুলো মন। একমাত্র দর্শনশাস্ত্রের ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই আমার মনে থাকে না। তা কথাটা মিথ্যেও নয়। বাজার থেকে সাতটা জিনিস আনতে দিলে আমি দু’টো ঠিক জিনিস, বাকিগুলো ভুল জিনিস নিয়ে আসি। কারও নামটাও আমার মনে থাকে না, রামকে রাবণ, হারাধনকে বিশ্বজিৎ বলে আকছার ভুল বলছি। কিন্তু আজ আর ভুল হওয়ার জো নেই। মাথা পরিষ্কার কাজ করছে, স্পষ্ট মনে পড়ছে, আজ থেকে বাইশ বছর আগে বটুক সামন্ত নামে আমার এক বেয়াদব ছাত্র ছিল। অত্যন্ত রাগচটা, মারমুখো ছেলে। দুমদাম রেগে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মারপিট করত। একবার সে তার এক ক্লাসমেটকে সামান্য কারণে এমন মেরেছিল যে, ছেলেটাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। আমি তখন কলেজের প্রিন্সিপাল, বাধ্য হয়ে তাকে কলেজ থেকে তাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। তাতে রেগে গিয়ে সে রাত্রিকেলা কলেজ বিল্ডিংয়ে আগুন দিয়েছিল। বাধ্য হয়ে তাকে রাস্টিকেট করতে হয়। জানি না। এই সেই বটুক সামন্ত কিনা! তবে সেও ম্যাজিক দেখাত বলে শুনেছিলাম।
গোরাং ভারী মুগ্ধ চোখে প্ৰাণগোবিন্দর দিকে চেয়ে বলল, বড় গোলমালে ফেলে দিলেন কর্তবাবু! আলাভোলা মানুষটি ছিলেন, কতবার এক টাকার জায়গায় ভুল করে পাঁচ টাকা দিয়ে ফেলতেন। হাটেবাজারে দশ টাকার জিনিস বিশ টাকায় কিনে আনতেন। চোর-বাটপাড়েরা কত কম মেহমতে আপনার পকেট থেকে টাকা পয়সা হাপিশ করতে পারত। আমরা তো ধন্যি-ধন্য করতাম, কিন্তু আপনি হুঁশিয়ার হয়ে ওঠায় সে চিন্তার লোক ভারী লোকসানে পড়ে যাবে। গিগ্নিমার কথাটাও একটু ভাবুন!
শশব্যস্ত প্ৰাণগোবিন্দ বললেন, কেন, তার আবার কী হ’ল?
তিনি যে বড্ড ফ্যাসাদে পড়ে গেলেন কর্তবাবু। এতকাল একজন ভারী আত্মভোলা, আনমনা, কাছাছাড়া মানুষের ঘর করে বুড়ো হলেন! এখন যে তাঁকে একজন ভারী চালাক-চতুর, হুঁশিয়ার, হিসেবি লোকের সঙ্গে নতুন করে ঘর করতে হবে। এটা ভেবে দেখেছন? এই কেঁচে গণ্ডুষে তার যে ভারী হয়রানি হবে!
বাদাম ঘোষ মাথা নেড়ে বলল, খুব ঠিক কথা হে প্ৰাণগোবিন্দ! আমি বৃক্ষবাসী হওয়ার পর থেকেই আমার বাড়িতেও এরকম সব হয়েছিল কিনা। গিন্নি লুকিয়ে গয়না গড়ালে টের পেতুম, রাখাল ছেলেটা গোরুর দুধ চুরি করলে ধরে ফেলাতুম, নাতি পড়ায় ফাঁকি দিয়ে ডান্ডাগুলি খেলছে কিনা বলে দিতে পারতুম।
প্রাণগোবিন্দ বুক ফুলিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে আর কেউ চালাকি করে পার পাবে না। এই তো সেদিন, গিন্নি ছাদে বড়ি শুকোতে দিয়ে আমাকে পাহারায় বসিয়ে রেখেছিলেন। কী বলব মশাই, একটা জিনিস ভাবতে-ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, ওমনি কাকগুলো এসে বড়ির টুকরো ছড়িয়ে ছয়ছত্ৰখান করে গেল। গিগ্নি এসে কী উস্তম-কুস্তম করে অপমান করলেন আমায়। তারপর ধরুন, বাজারের রাধেশ্যাম মুদি, যখনই কিছু কিনতে যাই, তখনই রাধেশ্যাম এসে আমার সামনে দাঁড়ায়, বিগলিত মুখে নানা গল্প ফেঁদে বসে আর এমনভাবে দাড়িপাল্লাটা আড়াল করে দাঁড়ায়, যাতে আমি দেখতে না পাই। প্রত্যেকদিন ওজনে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে! মানুষের কথা কী আর বলব, আমার বিড়াল দু’টো কী কম বজ্জাত! তাদের এমন চায়ের নেশা হয়েছে যে, আমি খবরের কাগজে মুখ ঢাকলেই তারা লাফিয়ে টেবিলে উঠে আমার চায়ের কাপ থেকে চুকচুক করে চা খেয়ে নেয়। সব সময় তো আর বুঝতে পারি না, তাই সেই বিড়ালের এঁটো করা চা-ও কতদিন খেয়ে নিয়েছি। কিন্তু সেসব দিন আজ ইতিহাস। যাক, বিড়াল আর র্যাধ্যেশ্যাম কেউ এখন আমার হাতে নিস্তার পাবে না।”
গোরাং দাস বিনীতভাবেই বলল, বুঝতে পারছি, আমাদের কপালেই এবার কষ্ট আছে।
প্রাণগোবিন্দ এবার একটু গভীর হয়ে বললেন, কিন্তু ঘটনার প্যাটার্নটা এখনও ঠিক ধরা যাচ্ছে না! ম্যাজিশিয়ান, চকোলেট, চিরকুট, বটুক, তাঁর কুকুর আর পুতুলের উপর কুকুর লেলিয়ে দেওয়া, এসব কি এক সূত্রে বাঁধা! নাকি আলাদা-আলাদা বিচ্ছিন্ন ঘটনা!
বাদাম ঘোষ বলল, একটু চেপে ভাবলেই বেরিয়ে আসবে। তোমার মাথা তো এখন চমৎকার কাজ করছে হে!
তা করছে। কিন্তু এখনও আমি জানি না, কে বা কারা গোকুল বিশ্বাসের গোরুটা চুরি করে আমার গোয়ালে রেখে এল এবং কে-ই বা মুক্তিপণের টাকা আমার কাছে পৌঁছে দিতে বলল। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছে, এসব ঘটনা একই সূত্রে বাঁধা।
গোরাং চাপা গলায় বলল, গাঁয়ে আপনার বদনামও করেছেলোকে
লোকের আর দোষ কী বলে? আমার গিন্নিও তো আমাকে গোরু-চোর বলে সন্দেহ করলেন!