ঘোরপ্যাঁচে প্রাণগোবিন্দ – ৫

দুপুর দেড়টা বেজে যাওয়ার পরও যখন প্ৰাণগোবিন্দবাবু ফিরলেন না। তখন সুরবালা খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। বুড়ো হয়েছেন, তার উপর আলাভোলা মানুষ, কোথায় কী হল কে জানে! দুশ্চিন্তায় বারবার ঘড়ি দেখছেন আর ঘর-বার করছেন। শেষ অবধি পুলিশে খবর দিতে হবে কিনা তাও ভাবছেন। ঠিক এমন সময় একটা চাষা-ভুষো চেহারার লোক এল। একমুখ দাড়িগোঁফ, মাথায় একটা গামছা বাঁধা। গায়ে তুষের চাদর। বলল, আজ্ঞে, বাবু পাঠালেন।

লোকটা জবাব না দিয়ে একটা ভাজ করা কাগজ বের করে সুরবালার হাতে দিয়ে বলল, আজ্ঞে, এতে সব লেখা আছে।

সুরবালা তাড়াতাড়ি চিঠিটা খুলে পড়লেন। পেনসিলে লেখা,

কল্যাণীয়াসু, জরুরি কাজে বাহির হইয়াছি; একটা ভাল শিকারের সন্ধান আসিয়াছে। বেশ মোটা টাকা আদায় হইবে বলিয়া মনে হয়। এরূপ চলিতে থাকিলে অচিরেই কয়েক লক্ষ টাকা অ্যায়ের সম্ভাবনা ৷ চিন্তা করিও না । ফিরিতে বিলম্ব হইবে।

ইতি

প্ৰাণগোবিন্দ রায়

পাশ থেকে সরু গলায় পিউ জিজ্ঞেস করল, দাদু কী লিখেছেন ঠাকুরমা?

তোমার দাদু অধঃপাতে গেছে ভাই। ছিঃ ছিঃ, বুড়ো বয়সে যে কারও এমন মতিচ্ছন্ন হয়, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।

পিউ চিঠিটা ঠাকুরমার হাত থেকে নিয়ে পড়তে লাগল।

সুরবালা লোকটাকে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবুটি এখন কোথায় বলতে পার?

লোকটা মাথা নেড়ে বলল, আজ্ঞে না। তবে বীরপুরের দিকেই গেলেন মনে হল।

বীরপুর! সেটা আবার কোথায়?

বেশি দূর নয় মা-ঠাকরুণ। আপনাদের ছাদে উঠে। উত্তর দিকে চাইলে বীরপুরের বাসুলি মন্দিরের চুড়ো দেখা যায়। মাইলটাকও হবে না।

আজ্ঞে, মাঠে কাজ করছিলাম, বাবু আল ধরে হনহন করে যাচ্ছিলেন; আমাকে ডেকে চিঠি আর পাঁচটা টাকা দিলেন। বললেন, জরুরি কাজে যাচ্ছেন, চিঠিটা যেন পৌঁছে দিই। তা হলে বিদেয় হই মা-ঠাকরুণ? হাল-গোরু সব মাঠে ছেড়ে এসেছি কিনা।

লোকটার কাছ থেকে আর কোনও খবর পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে সুরবালা বললেন, যাও, কিন্তু যদি বাবুর দেখা পাও তো বোলো, যেন এক্ষুনি বাড়িতে ফিরে আসে। বাড়িতে সবাই খুব চিন্তা করছে।

লোকটা ঘাড় কাত করে বলল, যে আজ্ঞে।

একটু যেন জোর কদমেই চলে গেল লোকটা! চিঠিটা কষ্ট করে পড়তে-পড়তে পিউ হঠাৎ বলল, ঠাকুরমা, দাদু কি বাংলা লিখতে পারে?

এ-কথায় সুরবালা খুব আতান্তরে পড়ে গেলেন। প্রাণগোবিন্দর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর থেকে তারা কখনও পরস্পরের কাছ থেকে দূরে থাকেননি। কাজেই প্ৰাণগোবিন্দ কখনও চিঠিপত্রও লেখেননি সুরবালাকে।

সুরবালা বললেন, তা পারবে না কেন? পঞ্জিকাটঞ্জিকা তো পড়ে।

পিউ মাথা নেড়ে বলে, দাদু পঞ্জিকাও পড়তে পারে না। খুব ঠেকে-ঠেকে পড়ে। আর সেদিন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, ‘ঠ’-এর টিকিটা ডান দিকে না বাঁ দিকে। একটু আধটু পড়তে পারলেও দাদু কিন্তু বাংলা লিখতে পারে না। কী করেই বা পারবে বলো, দাদু, তো দেরাদুনে মানুষ!

সুরবালা ভেবে দেখলেন, কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। বাস্তবিক, প্রাণগোবিন্দরা বরাবর দেরাদুনে থেকেছেন। প্রাণগোবিন্দকে তিনি বরাবর ইংরেজিতেই লেখাপড়া করতে দেখেছেন। বাংলা লিখতে দেখেছেন বলে মনে পড়ল না। প্ৰাণগোবিন্দর বাংলা হাতের লেখাও তিনি চেনেন না।

চিঠিটা নিয়ে ভাল করে দেখলেন সুরবালা। মেয়েলি ছাঁচের গোটাগোটা লেখা পেনসিলে লেখা বলে যেন আবছাও।

তুই দাদুর হাতের লেখা চিনিস?

ইংরেজি হাতের লেখা চিনি।

সুরবালা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ধরে-ধরে লিখেছে, ও তোর দাদুরই হাতের লেখা! তা ছাড়া আর কে চিঠি পাঠাবে?

দাদু আসবে না ঠাকুরমা?

তার কি আর বাড়ির দিকে মন আছে রে! তাকে ভূতে পেয়েছে।

উদ্বেগটা একটু কমল বটে, কিন্তু মনটা শাস্ত হল না। ওরকম শান্তশিষ্ট, নিরীহ, সজ্জন একজন মানুষ হঠাৎ এরকম হন্যে হয়ে উঠল। কেন, তা যেন কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না! এতকাল ঘর করেও তিনি কি সত্যিই প্ৰাণগোবিন্দকে একটুও চিনতে পারেননি?

হলধরকে ডেকে সুরবালা জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে হলধর, বীরপুর গ্রামটা চিনিস?

হলধর অবাক হয় বলে, তা চিনিব না! এই তো এক দৌড়ের রাস্তা।

তা সেখানে কী আছে বল তো!

তা সে অনেক কিছু আছে । বাসুলি মন্দিরের কথা তো সবাই জানে, ভারী জাগ্ৰত দেবতা; তারপর ধরুন, খালাধারে এখন শিবরাত্তির মেলাও চলছে। এই এক-দেড়মাস ধরে চলে। খুব বড় মেলা। সার্কসের তাবুটাবুও পড়েছে দেখে এসেছি।

যেতে কতক্ষণ লাগে?

হেসে গ্যালগালে হয়ে মাথা নেড়ে হলধর বলে, সে মোটে দূরই নয়। নিসিগঞ্জের গা-ঘেঁষেই বীরপুর। কালু শেখ একখানা বিড়ি ধরিয়ে নসিগঞ্জ থেকে হাঁটা দেয়। সেই বিড়ি বীরপুরে গিয়ে শেষ হয়। ছাদে উঠে উত্তর দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন, বীরপুরের বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। কেন মা, যাবেন নাকি? গেলে বলুন, ভ্যানগাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসি। দশ মিনিটে পৌছে দেবে।

তুই যাবি বাবা? গিয়ে লোকটাকে পাকড়াও করে নিয়ে আসবি?

মাথা চুলকে হলধর বলে, কর্তবাবু কি বীরপুরে গেলেন নাকি মা?

সেরকমই তো শুনছি। একবার যা না বাবা।

পিউ বলল, আমিও যাব ঠাকুরমা! আমি ঠিক দাদুকে ধরে আনব।

সুরবালা মাথা নেড়ে বললেন, না ভাই, তোমার গিয়ে কাজ নেই। ওসব গন্ডগোলের মধ্যে তোমার না যাওয়াই ভাল। হলধর গিয়ে আগে মানুষটার খবর আনুক। পরে দরকার হলে আমরা সবাই যাব।

পিউ আর কিছু বলল না। চুপটি করে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের উপর উঠে এল। তারপর রেলিং ধরে বীরপুরের দিকে চেয়ে রইল। অনেক গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে একটা মন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে। আর কিছু বাড়িঘর। সামনে একটা প্ৰকাণ্ড খেত, কিছু ঝোপঝাড়। না, বীরপুর খুব দূরে নয়। পিউ দেখতে পেল, আকাশে একটা সাদা রঙের ঘুড়ি উড়ছে। মস্ত বড় ঘুড়ি। কিছুক্ষণ ঘুড়িটার দিকে চেয়ে থেকে সে এসে চিলেকোঠার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে রইল। চুপচাপ বসে অনেকক্ষণ ভাবল সে ঠাকুরমার কথাগুলো সে বুঝতে পারেনি। দাদু একটা কোনও দুষ্টুমি করেছেন নাকি? কিন্তু তার দাদু, তো ভীষণ ভুলোমনের মানুষ, দুষ্টুমি করবেনই বা কী করে? এসবই খুব ভাবছে সে। ভাবতেভাবতে চকোলেটের মোড়কটা খুলে চিরকুটটা বের করল। তাদের কী বিপদ হবে তাও সে বুঝতে পারছে না।

চিরকুটটা খুলে ভারী অবাক হয়ে গেল পিউ। সকালেও চিরকুটটাতে পেনসিলের লেখাটা ছিল। কিন্তু এখন নেই তো! চিরকুটটা তো একদম সাদা! লেখাটা কী করে ভ্যানিশ হয়ে গেল? এটাও কি ম্যাজিক?

হঠাৎ তার মনে হল চিরকুটে যে লেখাটা ছিল, সেটার সঙ্গে ঠাকুরমাকে লেখা দাদুর চিঠির হাতের লেখাটা অনেকটা একরকমের। গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা। মনে হতেই পিউ সিঁড়ি দিয়ে নেমে দৌড়ে গিয়ে বারান্দার টেবিলে পড়ে-থাকা দাদুর চিঠিটা নিয়ে ফের ছাদে উঠে এল। চিঠিটা খুলে দেখল, পেনসিলের লেখাটা অনেকটাই আবছা হয়ে গিয়েছে। কোনও-কোনও অক্ষর মুছেও গিয়েছে।

পিউ কিছু বুঝতে না পেরে ভারী অবাক হয়ে বসে রইল। ম্যাজিশিয়ান বিক্ৰমজিৎ-এর চিঠির সঙ্গে দাদুর চিঠির হাতের লেখা একরকম হবে কেন?

খুবই অন্যমনস্ক ছিল পিউ। হঠাৎ ঠক করে একটা শব্দ হওয়ায় চোখ তুলে দেখল, সাদা ঘুড়িটা তাদের ছাদে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। পিউ তাড়াতাড়ি গিয়ে ঘুড়িটা কুড়িয়ে নিল। চারদিকে চেয়ে ঘুড়িটা কে ওড়াচ্ছে, তা দেখতে পেল না। সুতো টেনে দেখল, ঘুড়িটা ভো-কাট্টা হয়ে উড়ে এসে পড়েনি। ভো-কাট্টা হলে সুতো ছেড়ে আসত। ঘুড়িটা ফের উড়িয়ে দিবে। কিনা ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল, ঘুড়ির গায়ে কী যেন লেখা আছে! পেনসিলের লেখা। ঠিক একই রকম গোটা-গোটা হরফে। লেখা আছে,

বীরপুরে এখন একশো মজা । খেলনার দোকান, পুতুলনাচ, কাচের চুড়ি, মাজিক, সার্কাস, নাটক, মোচার, চপ, মাংসের ঘুগনি কী চাই? দাদু এখানে। ছুটে চলে এসো।

পিউ ভীষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল। অন্য কিছু নয়, তার ভীষণ দাদুর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। তার অমন ভাল দাদুটা নাকি খারাপ হয়ে গিয়েছেন। পিউ সে কথা মোটেই বিশ্বাস করে না। দাদু কক্ষনো খারাপ হতে পারেন না। সে গিয়ে দাদুকে ঠিক নিয়ে আসবে।