ঘোরপ্যাঁচে প্রাণগোবিন্দ – ৪

বটুকবাবু নিবিষ্টমনে তাঁর পানাপুকুরে ছিপ ফেলে বসে আছেন। পুকুরে জল দেখা যায় না। জলের উপরে পুরু পানী ভেসে আছে। বটুকবাবুর আর কোনও দিকে নজর নেই। একদৃষ্টি যেখানে ছিপ ফেলেছেন, সেই জায়গায় চোখ রেখে বসে আছেন। তঁরা পাশে থাবা পেতে আছে বাঘা কুকুরটা। বটুকবাবুর কুকুর টিবির ডাক শোনা যায় না। ঘেউ-ঘেউ করার কুকুরই নয়! শোনা যায়, বাড়িতে বাইরের অচেনা কেউ ঢুকলে নিঃশব্দে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে গলার নলি ছিঁড়ে দেয়। তেমন ঘটনা অবশ্য আজ অবধি ঘটেনি। তবে রটনা আছে বলে বটুকবাবুর বাড়িতে কেউ ঢেকে না। কুকুর যেমন ডাকে না, তেমনই বটুকবাবুও কারও সঙ্গে কথাবার্তা কন না। বাড়ির বাইরে তাঁকে কখনওই দেখা যায় না। তাই এ বাড়িতে যে কেউ থাকে, এটাই লোকে ভুলতে বসেছে। গভীর রাতে নাকি মাঝে-মাঝে বটুকবাৰু বের হন। কোথায় যান, কী করেন, তা কেউ জানে না।

বটুক সামন্তর বাড়িটাও ভারী একটরে, গাঁ থেকে একটু তফাতে, শিমুল আর জারুল গাছের একটা বনের মতো আছে, তার পিছনে। নিরালা জায়গা। চারদিকে দেড় মানুষ সমান উঁচু মজবুত পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মস্ত বাগান। ভিতরে পুকুর, পুকুরের ধার ঘেঁষেই পুরনো আমলের লাল রঙের দোতলা একটা বাড়ি। বুড়োবুড়িরা কেউ বেঁচে নেই। বটুক সামস্তর বুড়ি বিধবা এক পিসি কয়েক বছর আগেও বেঁচে ছিলেন। তিনি মরা ইস্তক ও বাড়িতে বটুক সামস্ত আর তাঁর বিচ্ছিরি কুকুরটা আর ভিখুরাম ছাড়া কেউ থাকে না। বাইরের ফটকের কাছে একটা থুপরি ঘরে খুনখুনে বুড়ো দরোয়ান ভিখুৱাম থাকে বটে, তবে না। থাকার মতোই। ভিখুরাম আগে বাজারহাট করত, এখন বুড়ো হয়েছে, সারাদিন শুয়ে-বসেই থাকে। বাইরে বেরোবার ক্ষমতা নেই। বাজারের ব্যাপারীদের সঙ্গে বটুকবাবুর বন্দোবস্ত আছে। তারা চাল, ডাল আর আনাজপাতি বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে পয়সা নিয়ে যায়।

বটুকবাবুর এই নিরালা বাড়ির ভিতরে কী হয় না হয়, তা আর কেউ না জানলেও মহিষবাহন টক্কেশ্বর জানে। টক্কেশ্বরের জানারও কিছু কারণ আছে। এক কারণ হল, তার খুব খিদে পায়। যখন-তখন এমন খিদে চাগিয়ে ওঠে যে, টক্কেশ্বরের তখন বক-রাক্ষসে চেহারা। তবে মোষ চরিয়ে-চরিয়ে গাঁয়ের কোথায় কোন গাছে কোন ফল পাকছে বা ফলছে, তার সব খবর সে জানে। আর জানে, বটুকবাবুর বাগানে কাশীর পেয়ারা, আতা আর নেন, বেল আর গ্ৰীষ্মকালে যা আম হয়, তেমনটা আর কোথাও নয়। তার আরও একটা সুবিধে হল, সে মোষের পিঠে ঘুরে বেড়ায়। ফলে, মোষের কাঁধে ভর করে বটুকবাবুর বাগানের পাঁচিলে উঠে পড়া তার কাছে জলভাত। দেওয়াল ঘেঁষেই কিছু গাছ আছে। টক্কেশ্বর নিঃশব্দে কাজ সারাতে ভালই জানে! এমনকী, কুকুরটাও সব সময় তার উপস্থিতি বুঝতে পারে না। অবশ্য সব দিন সমান যায় না। এক-একদিন কুকুরটা গন্ধ পেয়ে তেড়েও আসে। টক্কেশ্বর তখন টুক করে তার মোষের পিঠে নেমে পড়ে। কুকুরটা মাঝেমধ্যে তেড়ে এলেও বটুকবাবু, কিন্তু কখনও ফিরেও তাকান না। একমনে মাছ ধরেন। কিন্তু একমাত্র টক্কেশ্বরই জানে, বটুকবাবু মাছও ধরেন না। সে কতদিন দেখেছে, বটুকবাবু ছিপে গেঁথে মাছ তুলে এনে মুখ থেকে বঁড়শি ছাড়িয়ে মাছকে আবার জলে ছেড়ে দেন। বটুকবাবু কি বোকা? ছেড়েই যদি দেবেন, তা হলে ধরেন কেন? এইটা অনেক ভেবেও টিক্কেশ্বর আজও বুঝতে পারেনি।

টক্কেশ্বর তাক্কেতক্কে আছে! একদিন ফাঁক পেলে সে বাগানে নেমে পুকুর থেকে একটা বড়সড় মাছ ধরে নিয়ে যাবে। ধরা শক্তও নয়। সে জানে, বটুকবাবুর পুকুরে মাছ গিজগিজ করছে। ছিপ বা জাল ফেলারও দরকার নেই, জলে নেমে সাপটে ধরে তুলে ফেললেই হয়। কিন্তু ফাঁক পাওয়াই মুশকিল। বটুকবাবু প্ৰায় সারাদিনই পুকুরপাড়ে বসে থাকেন। বাপ-ঠাকুরদার টাকা ছিল বলে, বটুকবাবুকে কোনও কাজকর্ম করতে হয় না; কিন্তু তা বলে সারাদিন মাছ ধরা আর ছেড়ে দেওয়াটাই বা কী রকম কথা?

বটুকবাবুর পুকুরের মাছের গল্প একদিন সে বাড়িতে করেছিল। তাতে তার ঠাকুরদা বাঘু শিকারি গভীর হয়ে বলেছিল, তা তোর ওবাড়িতে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার দরকার কী? খবরদার, আর যাবি না।

টক্কেশ্বর অবাক হয়ে বলে, কেন দাদু, গেলে কী হয়?

বাঘু শিকারি মাথা নেড়ে বললেন, ও-বাড়িতে না যাওয়াই ভাল। বাড়িটা বন্ধন করা আছে! ভিতরে ঢুকলে বিপদ হতে পারে।

বাড়ি বন্ধন করা থাকলে কী হয় দাদু?

শুনেছি চোর-ডাকাত নাকি ঢুকতে পারে না। বটুকের ঠাকুরদা মস্ত তান্ত্রিক ছিল। ওরা সব মরণউচাটন জানে। কাজ কী তোর ও-বাড়িতে গিয়ে?

আমি তো বটুকবাবুর বাড়ির দেওয়ালে উঠে কত ফলপাকুড় পেড়ে খাই। কিছু হয় না তো!

খবরদার, আর ওদিক মাড়াসনি। বটুক বাণ মেরে দিলে শেষ হয়ে যাবি।

টক্কেশ্বর হেসে বাঁচে না। বটুকবাবু বাণ মারবেন কী? বটুকবাবু তো একটা ভ্যাবলা লোক। যিনি পুকুরের মাছ ধরে-ধরে ছেড়ে দেন, তিনি ভ্যাবলা ছাড়া কী?

কথাটা বাড়িতে বেশ চাউর হওয়াতে টক্কেশ্বরের বাবা। আর বড়বাবাও তাকে ডেকে বলে দিলেন, বটুকবাবুর বাড়িতে সে যেন আর না যায়।

টক্কেশ্বরের এটাই হয়েছে মুশকিল। তার বাড়িতে চার পুরুষ বর্তমান। মাথার উপর বাবা, বাবার মাথার উপর ঠাকুরদা, আবার ঠাকুরদার মাথার উপর বড়বাবা অর্থাৎ ঠাকুরদার বাবা এখনও বেঁচে। এত গার্জেন থাকায় টক্কেশ্বরের একটু অসুবিধে হয়। কিন্তু বটুকবাবুর বাড়িতে কী এমন জুজু আছে, সেটাই সে বুঝতে পারে না।

আর সেই জন্যই সে আরও বেশি করে ব্যাপারটা জানার জন্য উচাটন হয়। সে বীরপুরের বিখ্যাত বাসুলি মন্দিরের পুরুতষ্ঠাকুর পীতাম্বর ভট্টাচার্যের কাছেও গিয়েছিল।

ঠাকুরমশাই, বাড়ি বন্ধন করা থাকলে কী হয়?

পীতাম্বর মুখটা আঁশটে করে বললেন, বন্ধন করলে চোর-ডাকাত আসে না, বদমাশরা তফাত থাকে।

সত্যি ঠাকুরমশাই?

সত্যি না মিথ্যে তা কী করে বলি বলে তো বাপু! কলিকালে কি আর মন্তরতন্তরের সেই জোর আছে? আমি তো আমার বাগানখানা শতেকবার বন্ধন করেছি। তাতে কি কিছু হল? রোজ গোরু-ছাগল ঢুকে গাছপাতা খেয়ে যাচ্ছে! মুলেটা, লাউটা চুরিও যাচ্ছে রোজ।

তবে যে শুনি বটুকবাবুর বাড়ি নাকি বন্ধন করা আছে। সেখানে ঢুকলে বিপদ হবে!

পীতাম্বর বিরস মুখে বললেন, বটুকের ঠাকুরদা তন্তরমন্তর জানত বটে। তা বন্ধন করে কোন কচুটা হল? বংশই তো লোপাট হতে বসেছে। বটুকটা তো সংসারধর্মই করল না, বারদুই বিবাগী হয়ে ফের ফিরে এসে বাড়িতে থানা গেড়ে বসে আছে। তবে ওর আর বাড়ি বন্ধনের দরকারটাই বা কী? যা একখানা সড়ালে কুকুর পুষেছে, তাতেই তো চোর-ছ্যাঁচড়রা তফাত থাকে। কলিকাল তো, তাই মন্তরে তেমন কাজ হয় না, বুঝলি? কুকুর পুষলে বেশি কাজ হয়। তা তোর মতলবটা কী বল তো, হঠাৎ বটুকের এত খাতেন নিচ্ছিস কেন?

টক্কেশ্বর একগাল হেসে বলল, কী জানেন ঠাকুরমশাই, বটুকবাবুর পুকুরে একেবারে গিজগিজ করছে কড়-বড় মাছ। তাই ভাবছিলাম, অত মাছ তো আর বটুকবাবুর ভোগে লাগবে না। এক-আধটা যদি চুপিচুপি গিয়ে তুলে আনি!

পীতাম্বরের চোখ চকচক করে উঠল। একমুখ হাসি নিয়ে বললেন, ওরে, শাস্ত্ৰেই আছে, বৰ্ব্বারস্য ধনক্ষয়ং। তাতে চুরির দোষও অর্শাবে না। তা তুলবি বাবা? সত্যি?

তাই তো ইচ্ছে ঠাকুরমশাই!

তা তুলিস। মুড়োটা বরং ব্ৰাহ্মণভোজনে দিয়ে যাস।

মাছ চুরির মতলব আঁটলেও চট করে কাজে নামতে ঠিক সাহস হয়নি টক্কেশ্বরের। কারণ, বটুকবাবু লোকটা কেমন, সেটাই আন্দাজ করতে পারছে না সে। যারা কম কথা কয়, যারা গোমড়ামুখো, তাদের টক করে বোঝা যায় না। কিনা! গাঁয়ের লোকও বটুককে চেনে বটে, কিন্তু তার সম্পর্কে ভাল-মন্দ কিছুই জানে না। ধরা পড়লে টক্কেশ্বরকে বটুকবাবু পেটাবেন না কোতল করবেন না ছেড়ে দেবেন, সেটাও অাঁচ করতে পারছিল না সে। তবে মতলবটো মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ক’দিন ধরে।

আজ সকালে কোবরেজমশাই এসে উঠোনে বসে বড়বাবার নাড়ি দেখছেন। অখণ্ড মনোযোগ, চোখ বন্ধ, ধ্যানস্থ, তা কোবরেজমশাইয়ের বয়সও কিছু কম হল না। একশো বারো পেরিয়ে তেরো। বড়বাবা, অর্থাৎ হাবু শিকারির এই একশো তেরো পেরিয়ে চোদ্দ। অনেক সময়ই দেখা যায়, নাড়ি দেখতে-দেখতে কোবরেজমশাই আর হাবু শিকারি দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।

আজও প্রায় সেই পরিস্থিতি। প্রায় আধঘণ্টা নাড়ি দেখার পর কোবরেজমশাই হঠাৎ টান হয়ে বসে বললেন, “নাঃ, শরীরে তো কোনও আবল্যি নেই হে। লক্ষণ সবই বেশ ভাল।

হাবু শিকারি মিটমিট করে চেয়ে বললেন, তা হলে খিদেটা না কেন বলে তো! সকাল থেকেই পেটটা যেন ভর-ভরা।

টক্কেশরের ঠাকুরমা ঘোমটার আড়াল থেকে বললেন, তা খিদের আর দোষ কী? ফাঁক পেলে তো খিদে হবে? সকালে উঠে একগোছা রুটি খেয়েছেন! ঘণ্টাটাক পরেই এক কাঁসি ফেনাভাত, পেট তো ফুরসতই পাচ্ছে না!

কোবরেজমশাই দু’ধারে ঘনঘন মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু, উঁহু, এ তো মোটেই ভাল কথা নয় হে হাৰু। বয়স হয়েছে, একথাটা মনে রেখো। এ বয়সে সংযম পালন না করলে যে ফ্যাসাদে পড়বে!

হাবু শিকারি খেঁকিয়ে উঠে বললেন, রাখো, রাখো, বলি তোমার বয়সটাও কি কম হল? এই তো সদানন্দের মেয়ের বিয়েতে সেদিন বারোটা মাছ আর পচিশটা রসগোল্লা খেলে! আমার অন্ত খাই-খাই নেই বাপু । সেদিন আমি মোটে দশখানা মাছ আর কুড়িটা রসগোল্লা খেলুম।

আর মিছে কথাগুলো বোলো না তো হাবু। দশ টুকরো মাছ খেলে কী হয়! সেই সঙ্গে যে এককাঁড়ি মাংস সাঁটালে! এই তো বিউমা বলল, সকালে একগোছা রুটি খেয়েছ, তারপর ফেনাভাত, তবে খিদের অভাব হচ্ছে কোথায়?

হাবু একটু লজ্জা-লজ্জা ভাব করে বলেন, খেয়েছি নাকি? তা হবে হয়তো! আগে ভাল-মন্দ কিছু খেলে বেশ মনে থাকত। আজকাল মোটেই মনে থাকছে না কেন বলে তো?

সেটা মোটেই ভাল-মন্দের দোষ নয়, তোমার নোলার দোষ।

হাবু শিকারি মাথা নেড়ে বলেন, তা নয় হে কোবরেজ। আসলে ভাল-মন্দ কিছু জুটছে না বলেই মনে থাকছে না। রুটি আর ফেনাভাত কি ভাল-মন্দের মধ্যে পড়ে? ওসব ভুসিমাল খেয়ে-খেয়েই আমার অরুচিটা হয়েছে।

তা বলে রোজ মাংস-পোলাও খেতে চাও নাকি?

আহা, মাঝেমধ্যে হতে দোষ কী বলে! রোজ-রোজ গুচ্ছের ফেনাভাত, রুটি, শাকপাতা খেয়ে যে গায়ে মোটেই জোর হচ্ছে না। একটু ভাল পথ্যির নিদান দিয়ে যাও দিকিনি। এই ধরো, পাকা মাছ, মাংসের সুরুয়া, ঘন দুধ।

সেসব আর কোথায় পাবে বলো। যা জুটছে তাই ভগবানের দয়া বলে মনে করো!

বুড়ে বয়সে বড়বাবামশাইয়ের একটু নোলা হয়েছে, একথা ঠিক। এ-বাড়িতে শাকপাতা, কচুঘেঁচু ছাড়া ভাল-মন্দ বড় একটা হয় না। বড়জোর কুচোমাছ। তাই বড়বাবামশাইয়ের জন্য বড় কষ্ট হয় টক্কেশ্বরের একশো চোদ্দ বছর বয়স মানুষটার, কদিনই বা আর আছেন। তাই টক্কেশ্বর ঠিক করল, এসপার-ওসপার যাই হােক, আজি বটুকবাবুর পুকুর থেকে একটা মাছ তুলে আনবে।

মোষ চরাতে বেরিয়ে আজও টক্কেশ্বর বটুকবাবুর বাড়িতে দেওয়ালে উঠল। জালের তৈরি একটা থলি এনেছে সে। ফাঁক বুঝে মাছ ধরে কাঁধে ঝুলিয়ে নেবে। তারপর তাড়াতাড়ি গাছে উঠে দেওয়াল ডিঙিয়ে এ-পাশে নেমে পড়বে।

কপালটা ভালই বলতে হবে তারা আজ দেওয়ালে উঠে দেখতে পেল, পুকুরের ধারে বটুকবাবুর জায়গাটা ফাঁকা। কেউ নেই। টক্কেশ্বর খুব সাবধানে ভাল করে চারধারটা দেখে নিল। না, বাগানে কোথাও বটুকবাবুকে দেখা যাচ্ছে না। কুকুরটারও হদিশ নেই। টক্কেশ্বর খুব ভাল করে চারধার দেখে নিয়ে মনে-মনে একটা হিসেব করল। গাছ বেয়ে পুকুরের কাছাকাছি গিয়ে যদি ঝাঁপ করে নামা যায়, তা হলে মাছ ধরতে দু’মিনিটের বেশি লাগবে না। মাছসুদ্ধ গাছে ওঠা একটু কঠিন হবে বটে, কিন্তু পারা যাবে। একবার গাছে উঠে পড়তে পারলে আর চিন্তা নেই। সে বাঁদরের মতো গাছ বাইতে পারে।

সাহস করে সে সামনের গাছের ডালে উঠে সাবধানে এগোতে লাগল। শব্দটব্দ যাতে না হয়, তার জন্য খুব ধীরে-বীরে আড়া ডাল বেছে-বেছে এগোতে লাগল। এ-কাজটা শক্ত নয়। আসল শক্ত কাজটা হল, নেমে ঝাপ করে মাছ তুলে তাড়াতাড়ি গাছে উঠে পড়া। খুব বড় মাছ হলে অবশ্য বিপদে পড়তে হবে। তার ইচ্ছে, মাঝারি আট-দশ কেজি ওজনের একটা মাছ ধরা। কিন্তু তাড়াহুড়োয় বাছাকাছির সময় তো থাকবে না। সেইটেই বিপদের কথা।

পুকুরের কাছ বরাবর চলে এল টক্কেশ্বর। নামার জন্য ঝুল খেতে পা নামিয়েও সে শেষবার চারদিকটা নিরখ-পরখ করার জন্য এদিকওদিক তাকাতে গিয়ে আচমকা আপাদমস্তক শিউরে উঠল। পুকুরের দক্ষিণ দিকে একটা ঝোপের সামনে ফুটফুটে একটা আট-দশ বছরের মেয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে নীল রঙের ফ্রক, পায়ে জুতো-মোজা, সুন্দর করে চুল আঁচড়ানো, তাতে আবার কালো রিবন। হাসি-হাসি মুখ করে মেয়েটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

টক্কেশ্বর এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, আর-একটু হলে তার শিথিল হাত গাছের ডাল থেকে ফসকে যেত। কোনওরকমে গাছের ডালটা ধরে পা দু’টো উপরে তুলে আড়াল হল সে। বটুকবাবুর বাড়িতে কোনও বাচ্চা মেয়ে নেই, থাকার কথাও নয়। তা হলে কি এতদিন বাদে এ-বাড়িতে বটুক সামন্তর কোনও আত্মীয়স্বজন এসেছে? তাই হবে হয়তো। নইলে বটুকবাবুর বাড়িতে খুনিয়া কুকুর আছে জেনেও কোনও বাচ্চা মেয়ে কি ঢুকতে সাহস করবে? মেয়েটা এক অত স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই বা আছে কেন, তাও বুঝতে পারছিল না টক্কেশ্বর। সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে রইল।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। টক্কেশ্বরকে আচমকা কোথায় একটা কীসের শব্দ হল। সঙ্গে-সঙ্গে বিদ্যুতের গতিতে আর-একটা ঝোপের আড়াল থেকে মস্ত কুকুরটা বেরিয়ে এল।

চােখের পলক ফেলার সময় পেল না টক্কেশ্বর। কুকুরটা সোজা মেয়েটার দিকে ছুটে এসে একটু দূর থেকে একটা লাফ দিয়ে পড়েই মেয়েটার গলা কামড়ে ধরে চিত করে ফেলে দিল মাটিতে। তার সর ঝটিকা মেরে-মেরে ছিঁড়তে লাগল গলার নলি।

আতঙ্কে চিৎকার করেছিল টক্কেশ্বর। কিন্তু তার ভাগ্য ভাল, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয়নি। চোখ বুজে ফেলেছিল সে। এরকম ভয়ংকর দৃশ্য সে জীবনে দ্যাখেনি। আতঙ্কে হিম হয়ে গিয়েছে তার শরীর। কাঠ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে সে আর-একটা শিসের শব্দ শুনে চোখ চাইল। দেখল কুকুরটা মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে ফের যেখান থেকে এসেছিল, সেখানে ফিরে গেল। টক্কেশ্বর দেখল, মেয়েটা স্থির হয়ে পড়ে আছে। নড়ছে না। কুকুরটা যখন তেড়ে আসছিল, তখনও মেয়েটা নড়েনি বা পালানোর চেষ্টা করেনি বা চেঁচায়নি। এটা ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার বলে মনে হল টক্কেশ্বরের।

কিছু করার নেই বলে গাছেই বসে রইল টক্কেশ্বর। একটু বাদে দেখা গেল, বটুকবাবু খুব ক্লান্ত মুখে ধীরেসুস্থে হেঁটে এসে মেয়েটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে কিছু দেখলেন মন দিয়ে। মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। আর টক্কেশ্বর খুব অবাক হয়ে দেখল, মেয়েটার গলায় একটা মস্ত গর্ত হয়ে গেলেও একটুও রক্ত পড়ছে না। ভাল করে দেখে টক্কেশ্বর বুঝল, ওটা কোনও মেয়ে নয়। একটা পুতুল। তবে বেশ বড়সড় পুতুল।

কিন্তু পুতুলটার উপর কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার অর্থ কী? ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পারল না টক্কেশ্বর। তবে নিজের ভাগ্যকে সে ধন্যবাদ দিল। ভাগ্যিস আহাম্মকের মতো মাছ ধরতে নেমে পড়েনি!

বটুকবাবু পুতুলটা তুলে নিয়ে ধীরেসুস্থে বাড়িতে গিয়ে ঢুকলেন। পিছন-পিছন তাঁর কুকুরটাও।

টক্কেশ্বর ধীরে-বীরে গাছের ডাল বেয়ে-বেয়ে ফিরে এল। তারপর পাঁচিল ডিঙিয়ে বাইরে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। কিন্তু মনে বড় খটকা লেগে আছে। ব্যাপারটা কী হল, কেন হল, তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না সে একটা পুতুলের উপর তো কারও কোনও আক্রোশ থাকতে পারে না! বড় চিন্তায় পড়ে গিয়ে টক্কেশ্বর ভারী আনমনা রইল সারা দিনমান।

বটুকবাবুর বাড়ি যেসব ব্যাপারীরা চাল, ডাল, তেল, মশলা আর আনাজ পৌঁছে দেয়, তাদের সবাইকেই চেনে টক্কেশ্বর। বীরপুর বাজারের গোপাল পুরকাইত তাদের একজন। তার বেশ বড় মুদিখানার দোকান। টক্কেশ্বরের সঙ্গে ভাবসাব আছে। কারণ, গোপালের আবার মোষের দুধ ছাড়া চলে না। আর টক্কেশ্বরের বাড়ি থেকে সেই মোষের দুধ যায়।

সন্ধেবেলা টক্কেশ্বর গিয়ে গোপাল পুরুকাইতের দোকানে হানা দিল। দোকানে ভিড়ভাট্টা নেই। দু-চারজন বসে আছে বটে, তবে তারা খদের নয়। গল্পসল্প করতে আসে। গোপাল বসে খাতায় বিকিকিনির হিসেব টুকে রাখছিল। তাকে দেখে বলল, কী খবর রে, টক্কা?

টক্কেশ্বর মাথাটাথা চুলকে বলল, আজ্ঞে, একটা ব্যাপার জানতে এলাম খুড়োমশাই।

কী ব্যাপার?

আজ একটা ব্যাপার দেখে মনে বড় খটকা লাগছে।

বলে ফ্যাল!

আজ দেখলাম বটুকবাবু তাঁর শিকারি কুকুরটাকে একটা মেয়ে পুতুলের উপর লেলিয়ে দিলেন। কুকুরটা গিয়ে পুতুলটার গলার নলি ছিড়ে ফেলল। পুতুলটা কিন্তু ভারী সুন্দর আর প্রমাণ সাইজের!

ওটা পুতুল নয় রে, ওকে বলে ম্যানিকুইন পোশাকের দোকানে সাজিয়ে রাখে শো-কেসে তা তুই আবার বটুকবাবুর বাড়িতে ঢুকতে গেলি কেন? প্রাণের ভয় নেই! ও যা কুকুর, এক কামড়ে শেষ করে দেবে যে!

বাড়িতে ঢুকিনি খুড়োমশাই, দেওয়ালের উপর দিয়ে একটু উঁকি দিয়ে বাগানটা দেখছিলুম। তখনই এই ব্যাপার। তাই ভাবলাম, ব্যাপারটা কী হল, তা আপনাকে একবার জিজ্ঞেস করে যাই।

বাড়িতে উকি ঝুঁকি দেওয়া বটুকবাবু, কিন্তু পছন্দ করেন না। আর ও দেখেছিস, তা তেমন কিছু নয়। ভাল জাতের কুকুর তো, তাই মাঝে মধ্যে ট্রেনিং দিয়ে রাখেন।

এবার জলের মতো বুঝতে পারল টক্কেশ্বর। একগাল হেসে বলল, তবে তাই হলে বোধ হয়। আমার কেমন খটকা লেগেছিল বলে আপনার কাছে জানতে এলুম।

টক্কেশ্বর যখন চলে আসছিল তখন দোকানে বসা লোকদের মধ্যে একজন তার পিছু নিয়ে এসে ধরে ফেলল, বলি ও টুক্কেশ্বর, একটু কথা ছিল যে!

টক্কেশ্বর লোকটাকে চেনে। গোরাং দাস। গোরাং দাস ভিক্ষে করে। বটে, কিন্তু তাকে কেউ ভিখিরি বলে মোটেই মনে করে না। বরং যেখানে যায়, সেখানেই গোরাং খাতির পায়।

কী কথা গোরাংদা?

ঘটনাটা একটু খোলসা করে বলবি ভাই?

তা বলল টক্কেশ্বর, এমনকী মাছ চুরির মতলবের কথাও চেপে রাখল না।

সব শুনে গোরাং বলল, বটুকবাবু তোকে দেখতে পায়নি তো?

না। আমি তো গাছের উপর ছিলুম।

কথাটা পাঁচকান করতে যাস না! তোর বিপদ হতে পারে।

টক্কেশ্বর অবাক হয়ে বলে, আমার বিপদ হবে কেন?

তা জানি না। আরও একটা কথা।

কী কথা গোরাংদা?

আর ভুলেও বটুকবাবুর পুকুরের মাছ ধরার মতলব করিস না। আজ বরাতজোরে বেঁচে গেছিস বটে, কিন্তু রোজ রোজ তো বরাত তোকে দেখিবে না।

তা বটে। কিন্তু পুকুরে যে অনেক মাছ গো গোরাংদা। কিলবিল করছে যে!

শোন বোকা, বটুকবাবু কুকুরের মতো ওই মাছগুলোকেও পোষে কখনও নিজের পুকুরের মাছ খায় না, বাজারের মাছের ব্যাপারী যোগেন রোজ মাছ পৌঁছে দিয়ে আসে। বুঝলি কিছু? পুকুরের মাছে হাত পড়লে কিন্তু বিপদ আছে।

বুঝেছি গোরাংদা।

টক্কেশ্বরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গোরাং পা চালিয়ে চরণীডাঙার দিকে হাঁটা দিল। তার মনে হচ্ছে, আর বিশেষ সময় নেই। তাড়াতাড়ি না করলে কী থেকে কী হয়ে যায় কে জানে বাবা! তবে তার মনটা বড় কু গাইছে।