৩
আজ বাসে একজন ম্যাজিশিয়ান উঠেছিল। যেমন সুন্দর তার চেহারা, তেমনই আশ্চর্য তার ম্যাজিক। রাস্তাঘাটে ঘুরে-ঘুরে যারা ম্যাজিক দেখায়, তাদের যেমন ছেঁড়াখোঁড়া ময়লা পোশাক থাকে গায়ে, এ লোকটার মোটেই তেমন নয়। রীতিমতো ঝকঝকে কালো কোটপ্যান্ট আর সাদা শার্টের সঙ্গে লাল টাই! মাথায় একটা লম্বা কালো টুপি, দুহাতে সাদা দস্তানা।
প্রথমেই সবাইকে নমস্কার করে হাতের দস্তানা দু’টো খুলে ফেলল সে। তারপর দু’টো দস্তানাই ছুড়ে দিল শূন্যে। অবাক কাণ্ড! দস্তানা দুটো শূন্যে ভেসে-ভেসে অদ্ভুত সব নাচের মুদ্রা দেখাতে লাগল। তারপর দু’টো দস্তানা নিজেরাই হাততালি দিল, পরস্পর ঘুসো ঘুসি করল, পাঞ্জা লড়ল, তারপর নমস্কার করে খেলা শেষ করল।
তারপর টুপির খেলা। লোকটা মাথা থেকে টুপিটা খুলে সবাইকে টুপির ভিতরটা দেখাল, সেটা একদম ফাঁকা। তারপর টুপির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে সে প্রথমে একটা খরগোশ, তারপর একটা টিয়াপাখি, একটা সবুজ জ্যান্ত সাপ বের করে একে-একে একটা ঝোলায় পুরল! তারপর এক ভঁড় গরম চা বের করে সামনের সিটের এক ভদ্রলোককে দিলা। তিনি একটু ভয়ে-ভয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, বাঃ, এ তো চমৎকার চা।
এর পর ম্যাজিশিয়ান কয়েকটা রুমাল বের করে বিলিয়ে দিল। দুজনকে দিলা ডটপেন, কাউকে দু’টো বিস্কুট, কাউকে লজেন্স সবশেষে দু’টো চকোলেট-বার বের করে পিউ আর পিয়ালকে দিয়ে বলল, “তোমরা তো অচেনা লোকের হাতের খাবার খাও না, তাই না? তবু রেখে দাও।
নসিগঞ্জের অনেক আগেই তালপুকুর নামে একটা জায়গায় সেই আশ্চৰ্য ম্যাজিশিয়ান নেমে গেল। বাসের সবাই বলাবলি করছিল, এরকম ভাল ম্যাজিক বহুদিন দেখা যায়নি। আর লোকটাও কী ভাল! কারও কাছ থেকে পয়সাও চাইল না!
ম্যাজিশিয়ান নেমে যাওয়ার পরই শাস্তামসি বলল, ওই চকোলেট দুটো আমার কাছে দাও। নইলে তোমরা আবার ভুল করে খেয়ে ফেলবে।
শান্তামসি তাদের আয়া। খুব কড়া ধাতের মানুষ। মুখে একটুও হাসি নেই। তবে কড়া মানুষ হলেও শান্তামসি খারাপ লোক নয়, তাদের খুব যত্ন আত্তি করে, দেখেশুনে রাখে।
পিউ বলল, আচ্ছা মাসি, ম্যাজিশিয়ান কী করে জানল যে, আমরা অচেনা লোকের দেওয়া খাবার খাই না?
শান্তামাসি বিরস মুখে বলল, তা জানি না। তবে পাজি লোকেরা অনেক খোঁজখবর রাখে।
পিউয়ের কথাটা একটুও বিশ্বাস হল না। লোকটাকে তার কখনও পাজি বলে মনেই হয়নি। সে বলল, এটা আমি কিছুতেই খাব না। মাসি। কিন্তু মোড়কটা তো খুব সুন্দর, এটা আমার কাছে একটু থাক।
শাস্তামসি অবশ্য আর কিছু বলেনি। চকোলেট-বারটা পিউয়ের কাছেই রয়ে গিয়েছে। তবে পিয়াল ছোট আর পেটুক বলে ওরটা শাস্তামসি নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।
শহরে বাবুপাড়ায় তারা যে বাড়িতে থাকে, সেই বাড়িটা কেমন যেন গভীর আর রাগী চেহারার বাড়ি। ও বাড়ির হাওয়ায় মনখারাপের জীবাণু ঘুরে বেড়ায়। না হবেই বা কেন! তাদের মা-বাবা দু’জনেই ভারী ব্যস্ত ডাক্তার। সারাদিন তারা বাড়িতে থাকেনই না। যখন থাকেন, তখন দু’জনের মধ্যে কেবল রোগ আর ওষুধ নিয়ে কথা হয়! হাসিঠাট্টা, মজা কিছু নেই। নসিগঞ্জের বাড়িটা ঠিক উলটো। এ বাড়িটা যেন সব সময় হাসছে, খুশি আর আনন্দে ডগমগ করছে। খোলামেলা আর হাসিখুশি এ বাড়িটায় ঢুকলেই পিউ আর পিয়ালের মন ভাল হয়ে যায়। ঠিক যেন রূপকথার বাড়ি। এ বাড়িতে তার আনমনা ভুলো মনের দাদু আর ভারী নরম মনের ঠাকুরমা থাকেন। এ বাড়ির বাতাসে যেন মজা বিজবিজ করছে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আজ সেরকম হল না। বাস থেকে নেমে শান্তামসির সঙ্গে সামান্য পথ হেঁটে পিউ আর পিয়াল যখন বাড়িটার সামনে পৌঁছোল, তখন পিউয়ের স্পষ্ট মনে হল, আজ এ বাড়িটার যেন কেমন বিষন্ন, হতশ্ৰী চেহারা। কেমন যেন গম্ভীর, দুঃখী-দুঃখী ভাব।
পিউ চুপিচুপি পিয়ালকে বলল, ভাই, দেখেছিস, আজ বাড়িটা যেন ভীষণ গম্ভীর।
পিয়ালের বয়স মোটে পাঁচ বছর। সে অত কিছু বোঝে না। সে দিদির হাত চেপে ধরে শুধু বলল, হ্যাঁ রে দিদি, বাড়িটার বোধ হয় খিদে পেয়েছে।
পিয়াল একটু পেটুক আছে। সে জানে, খিদে পেলেই লোকের যত কষ্ট।
আজ বারান্দায় দাদু নেই, চেয়ারটা খালি। বাড়িতে ঢুকে শুনল, দাদু নাকি কোথাও জরুরি কাজে গিয়েছেন, ফিরতে দেরি হবে। পিউয়ের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সে হল দাদুর চামচা। সবাই বলে, এমন দাদুভক্ত নাকি দেখা যায় না। তা, কথাটা সত্যি। তার দাদু ভারী অন্যমনস্ক মানুষ। ভোলাবাবুকে তপনবাবু বলে ভুল করেন, স্নান করতে বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে ঠাকুরঘরে ঢুকে সাবান খুঁজে না পেয়ে চোঁচামেচি করেন, ধুতি পরতে গিয়ে কতদিন ঠাকুরমার শাড়ি দিব্যি কাছাকোঁচা দিয়ে পরে বেরিয়ে গিয়ে কেলেঙ্কারি করেছেন। পিউ সারাক্ষণ দাদুর সঙ্গে চিমটি খেয়ে লেগে থাকে। দাদুর ভুলভাল ধরিয়ে দেয়, শাসনও করে খুব দাদুরও তাতে ভারী আহ্লাদ। পিয়াল পেটুক বলেই বোধ হয় ঠাকুরমার আঁচল ধরে থাকতে ভালবাসে।
পিউয়ের আজ খেতে ইচ্ছে করছিল না। ঠাকুরমা সাধাসাধি করায় একখানা মাত্র লুচি খেলা তারও আধখানা কাককে দিয়ে দিল। তারপর চুপচাপ একটা গল্পের বই নিয়ে সামনের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে রইল না, বই পড়াতেও তার মন ছিল না। কখন দাদু আসবেন, সেজন্য ঘনঘন রাস্তার দিকে চেয়ে দেখছিল।
ম্যাজিশিয়ানের দেওয়া চকোলেট-বারটা বারবার ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখছিল পিউ। এটা তার চেনা চকোলেট-বার নয়। মোড়কটা অন্যরকম। ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখতে গিয়ে এক সময় তার চােখে পড়ল, মোড়কের পিছনে নীচের দিকে খুব খুদে অক্ষরে ছাপা, মেড ইন ইংল্যান্ড। সে ভারী অবাক হল। গাঁয়ের ম্যাজিশিয়ানের কাছে বিলিতি চকোলেট এল কোথা থেকে? সে একটু কৌতুহলী হয়ে মোড়কের একটা ভাঁজ খুলে গন্ধ শুকতে গিয়ে দেখে, মোড়কের ভিতরে একটা ছোট্ট চিরকুট রয়েছে। তাতে পেনসিল দিয়ে কিছু লেখা।
অবাক হয়ে চিরকুটটা বের করে এনে সে দেখল, তাতে ভারী সুন্দর ছাঁচে গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা, ‘তোমাদের খুব বিপদ আসছে, সাবধান! বিক্ৰমজিৎকে মনে রেখো!’ ব্যস, আর কিছু নেই।
পিউ অনেক বার চিরকুটটা পড়েও মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না। চিরকুটটা ঠাকুরমাকে দেখাবে কিনা ভাবলা। কিন্তু বড়দের একটা দোষ হল, তারা ছোটদের কোনও কথাকেই তেমন পাত্তা দেন না। কাগজের টুকরোটা দাদুর পঞ্জিকার মধ্যে গুজে রেখে পিউ চুপ করে উঠে এসে দেখল, শাস্তামসি কোথায়! মাসি বাথরুমে গিয়েছে দেখে সে এসে বাইরের ঘরে রাখা শাস্তামসির ব্যাগটা থেকে পিয়ালের চকোলেট বারটা খুলে দেখল, তাতে কোনও চিরকুট নেই। তা হলে কি চিরকুটটা পিউকেই উদ্দেশ্য করে লেখা? কিন্তু ম্যাজিশিয়ান তো তাকে চেনেই মা!
মাত্র আট বছর বয়স হলেও পিউ বেশি বকবক করে না। সে চাপা স্বভাবের মেয়ে। কথা কওয়ার চেয়ে বরং সে ভাবতেই বেশি ভালবাসে। আর সব কিছু বোঝার চেষ্টা করে। বিক্ৰমজিৎ নামটাও সে আগে কখনও শোনেনি, এই নামের কাউকে চেনারও প্রশ্ন ওঠে না। তাই সে বারান্দার চেয়ারে চুপ করে বসে ভাবতে লাগল। চিরকুটে লিখেছে “বিক্ৰমজিৎকে মনে রেখো”। বেশ কথা। কিন্তু যাকে সে চেনেই না, তাকে সে কী করে মনে রাখবে?
ঠিক এই সময় ফটক খুলে হাসিমুখে গোরাং দাস এসে ঢুকল। গোরাংকে দেখে ভারী খুশি হয়ে পিউ চেচিয়ে উঠল, গোরাংদা!
এ বাড়িতে যে ক’জন ভিখিরি আসে তাদের সবাইকেই চেনে পিউ। এ বাড়িতে সবাইকেই ভিক্ষে দেওয়া হয়। কেউ-কেউ আবার পাত পেড়ে খেয়েও যায়, সুখ-দুঃখের কথাও কয়। তারা বেশ লোক। গোরাং দাসও ভিখিরি বটে, কিন্তু অন্য সব ভিখিরির মতো নয়। সে বেশ পরিষ্কার একখানা আলখাল্লা পরে। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, বাবরি চুল ভাল করে আঁচড়ানো, কুচকুচে কালো দাড়িগোঁফ, বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা। রামপ্রসাদী গেয়ে ভিক্ষে করে বেড়ায়। নসিগঞ্জ আর আশপাশের পাঁচ-সাতটা গাঁয়ের প্রায় সব বাড়িতেই তার অনায়াস গতিবিধি।
কেউ-কেউ বলে, গোরাং দাস হল স্পাই। কার স্পাই, কীসের স্পাই তা অবশ্য কেউ বলতে পারে না। কেউ আবার বলে, গোৱাং হল শিবের অবতার। আবার কেউ বলে, তার সঙ্গে নাকি ডাকাতের দলের যোগাযোগ আছে।
পিউ তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি ভিক্ষে করো কেন গোরাংদা? তোমাকে দেখে তো একটুও ভিখিরি বলে মনে হয় না!
মাথাটাথা চুলকে গোৱাং বলেছিল, কথাটা কী জানো দিদি, বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না! ছেলেবেলা থেকেই আমার ভিখিরি হওয়ার শখ। স্কুলের পরীক্ষায় একবার রচনা এসেছিল ‘বড় হইয়া তুমি কী হইতে চাও?’ আমি খুব ফলাও করে লিখেছিলুম, ‘বড় হইয়া আমি ভিখারি হইব।’ তাতে অবশ্য মাস্টারমশাই গোল্লা দিয়েছিল।
এ মা! তুমি ভিখিরি হতে চাইলে কেন?
ভিখিরি হওয়ার যে অনেক সুবিধে দিদি। সারাদিন ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ানো যায়। কাজকর্ম করতে হয় না। কারও হুকুম তামিল করতে হয় না। বিনা মেহনতে রোজগারপাতিও হয়।
আচ্ছা, লোকে যে বলে, তুমি নাকি স্পাই!
চোখ বড়-বড় করে গলা নামিয়ে গোরাং বলল, সেকথাও মিথ্যে নয় দিদি। আমি গুপ্তচরও বটে। অনেকের অনেক হাড়ির খবর আমার ঝুলিতে আছে।
ধেৎ! তোমাকে স্পাই বলে মনেই হয় না!
আহা, তুমি বুঝতে পারছ না। স্পাইকে স্পাই বলে চেনা গেলে সে আবার কীসের স্পাই? তাই আসল স্পাইকে কখনও স্পাই বলে মনেই হবে না তোমার!
কিন্তু তোমাকে যে ভিখিরি বলেও মনে হয় না গোরাংদা। তোমার জামাকাপড় কেমন পরিস্কার, চুল কেমন আঁচড়ানো, মনে হয় দাঁতও মাজো, খোঁড়াও নও, কানাও নও, নুলোও নও। তবে তুমি কেমন ভিখিরি?
আহা, ভিখিরি কি একরকম? কানা ভিখিরি, খোঁড়া ভিখিরি, ঘেয়ো ভিখিরি যেমন আছে, তেমনই গায়ক ভিখিরি, সাধু ভিখিরি, বাউল ভিখিড়ি, ফকির ভিকিড়িও আছে। আবার চালাক ভিখিড়ি, বোকা ভিখিরি, আসল ভিখিরি, নকল ভিখিরি – ভিখিরির কি শেষ আছে? আমি তো একটা বই লিখব বলে ঠিক করে রেখেছি, ভিখারি, কাহাকে বলে ও কয় প্রকার’।
তুমি তা হলে কেমন ভিখিরি গোরাংদা?
গোরাং মাথা চুলকে বলেছিল, এই তো মুশকিলে ফেললে দিদি, নিজের মুখে কি আর নিজের কথা বলা যায়?
তা সে যাই হোক, গোরাং দাসকে ভিখিরি বলে মনে হয় না পিউয়ের। দাদু আর ঠাকুরমাও গোরাংকে ভারী খাতির করেন।
আজ গোরাংকে দেখে মনখারাপের ভাবটা একটু কমল পিউয়ের। গোরাং বারান্দার সিঁড়ির ধাপে জুত করে বসে বলল, পিউদিদি, আজ যে তোমার মুখখানা তেমন হাসিখুশি নয়! চোখ তো তেমন ঝলমল করছে না! কী ব্যাপার?
আমার মনখারাপ গোরাংদা। এ বাড়িটায় আজ যেন কী একটা হয়েছে। কেউ কিছু বলছেন না, দাদু কোথায় চলে গিয়েছেন, ফিরতে নাকি দেরি হবে। দাদুকে ছাড়া একটুও ভাল লাগছে না যে!
গোরাং একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, সব দিন কি আর সমান যায় পিউদিদি? এক-একটা খারাপ দিনও এসে পড়ে মাঝে-মাঝে। তবে এসব দুষ্টু দিনগুলো না এলে আবার ভাল দিনগুলো কতটা ভাল তা বোঝা যায় না কিনা।
আজকের দিনটা কি দুষ্ট দিন গোরাংদাদা?
তাই তো মনে হচ্ছে পিউদিদির যখন মনখারাপ, তখন বলতেই হবে যে, আজকের দিনটা ভাল দিন নয়।
আচ্ছা গোরাংদাদা, আমার দাদুর মতো ভাল লোক তুমি দেখেছ?
গোরাং মাথা নেড়ে বলল, না দিদি, আমি সাত গাঁয়ে ঘুরে বেড়াই, কত লোকের সঙ্গে দিব্যি আমার দেখা হয়। সত্যি কথা বলতে কী, রায়মশাইয়ের মতো এমন নিপাট ভােলমানুষ আমি আর-একটাও দেখিনি।
পিউ খুব করুণ মুখ করে বলল, তা হলে ঠাকুরমা কেন বিড়বিড় করে দাদুকে বকছেন বলো তো!
বকছেন নাকি?
তাই তো মনে হচ্ছে। ঠাকুরমার মেজাজ খারাপ হলেই কেন যে দাদুকে বকেন? আজও বারবার বলছেন, বুড়ো বয়সের অধঃপতন! বুড়ো বয়সের অধঃপতন।
গোরাং একটু গুম মেরে গেল। গোরাং দাস একটু আগে নিতাইবাবুর বাড়িতে গিয়েছিল। গিয়ে দ্যাখে, নিতাইবাবুর মেজাজটা আজ বেজায় খাট্টা হয়ে আছে। রাগে আপন মনেই গজগজ করে যাচ্ছেন। বাজার থেকে ফিরে ঘোমো জামাটা খুলে সবে রোদে শুকোতে দিচ্ছেন, ঠিক এমন সময় গোরাং গিয়ে গান ধরেছে, আমায় দাও মা, তবিলদারি…
নিতাইবাবু কালীভক্ত লোক। গোরাং দাস এসে গান ধরলে অন্য সময় তার বেশ ভক্তিভাব হয়। চোখ বুজে মাথা নেড়ে-নেড়ে শোনেন, কিন্তু আজ গোরাংয়ের গলা পেয়েই যেন খেপে উঠলেন, ছুটে এসে তম্বি করে বললেন, তোমার আক্কেল কী হে গোৱাং? বলি লজ্জাশরমও কি বিসর্জন দিয়েছ?
গোরাং অবাক হয়ে বলে, কোন মশাই, সুরে ভুল হল নাকি?
সুর নিয়ে কথা হচ্ছে না। বলি, আমার মতো ছাপোষার বাড়িতে ভিক্ষে করতে তোমার লজ্জা হয় না? যাও না, ওই প্ৰাণগোবিন্দ রায়ের বাড়িতে! ঘরে বসে দোহাত্তা কামাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছ না? তোমরা কি কানা? লাখো-লাখো টাকা লোকে বাড়ি বয়ে এসে সেলাম ঠুকে দিয়ে যাচ্ছে। তা সে-বাড়ি ছেড়ে আমাদের মতো গরিবগুরবোর বাড়িতে আসা কেন?
নিতাইবাবুর গিন্নি গিরীন্দ্রমোহিনী অত্যন্ত দাপুটে মহিলা। নিতাইবাবুর চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে এসে বললেন, তা ও বেচারির উপর তম্বি করা কেন? ও তো আর দোষ করেনি। বলি, প্রাণগোবিন্দ রায়ের মতো বুকের পাটা আছে তোমার? তিনি তো আর মেনিমুখে নন তোমার মতো, যাকে বলে বাপের ব্যাটা! গোকুল বিশ্বাসের মতো অমন সাংঘাতিক লোকের কান মুচড়ে টাকা আদায় করল। পারবে তুমি সাতজন্মে ওরকম হতে? এই নিরীহ বেচারার উপর গায়ের ঝাল ঝাড়ছ যে বড়! তোমারই তো লজ্জা হওয়া উচিত! প্ৰাণগোবিন্দবাবুকে দেখে শেখো। নমস্য ব্যক্তি, এতদিনে গাঁয়ে একটা সত্যিকারের পুরুষমানুষ দেখলুম।
নিতাইবাবু নিতান্তই মিইয়ে গেলেন। যেমন গরম দুধে পড়ে মুড়ি নেতিয়ে যায়, ঠিক তেমনই।
ওদিকে পরেশবাবুর বাড়িতেও প্রাণগোবিন্দকে নিয়ে বেশ একটা মনকষাকষি হচ্ছে। গোরাং গিয়ে শুনতে পেল। পরেশবাবু তার গিন্নি নবদুর্গাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, আহা, তা বলে গোরু চুরি করা কি ভাল?
নবদুর্গা ফুঁসে উঠে বললেন, চুরি! চুরি হতে যাবে কেন? গোরু চুরি তো ছোটলোকের কাজ। উনি যা করেছেন, সেটাকে বলা হয় অপহরণ। অপহরণ আর চুরি কি এক জিনিস হল? শুধু তাই নয়, উনি সেই গোরুবাবদ মুক্তিপণ আদায় করেছেন। তোমার মুরোদে কুলোবে? গোরুচোর বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেই তো হবে না। গোকলো ডাকাত কত খুনখারাপ করেছে জানো? কত লোকের যথাসৰ্বস্ব লুটে নিয়ে পথে বসিয়েছে! আজ তাকেই কেমন উচিত শিক্ষা দিলেন প্ৰাণগোবিন্দবাবু! আমার তো গিয়ে লোকটাকে পোন্নাম করতে ইচ্ছে করছে।
পরেশবাবু হাল ছেড়ে দিয়ে গোরাংয়ের কাছে বসে পড়লেন। বললেন, শুনলি গোরাং, শুনলি! গোরু চুরিও নাকি একটা বীরত্বের কাজ! তাই যদি হবে, তা হলে দেশের বড়-বড় বীরেরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকতেন! তুই-ই বল!
ব্যাপারটা তখনও কিছু বুঝতে পারছিল না গোরাং দাস। যখন এই বাড়ির দিকে আসছে, তখন বনমালী ঘোষ বাজার সেরে ফিরছিলেন। তাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, প্ৰাণগোবিন্দবাবুর বাড়িতে যাচ্ছিস বুঝি গোরাং? তা যা, আজ ভালই পাবি। একটু আগে দেখলুম, বাবু নতুন দড়ি কিনে উত্তরমুখে রওনা হলেন। আবার কার গোরু ঘরে আনতে গেলেন কে জানে বাবা!
আচ্ছা গোরাংদাদা, তুমি বিক্ৰমজিৎ নামের কাউকে চেনো?
গোরাং একটু আনমনা ছিল। প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হয়ে বলল, কার নাম বললে?
বিক্রমজিৎ ।
মাথা নেড়ে গোরাং বলে, না দিদি, ও নামে কাউকে তো চিনি না!
তবে যে তুমি বলো, সাত গাঁয়ের সব লোককে চেনে!
তা চিনি বইকি! সব লোককেই চিনি। নাড়িনক্ষত্ৰ জানি।
তা হলে বিক্রমজিৎকে চেনো না কেন?
সে কি এখানকার লোক দিদি? কাছেপিঠে থাকে?
কোথায় থাকে তা তো জানি না!
কেমন চেহারা?
তাকে কি আমি দেখেছি নাকি?
গোরাং অবাক হয়ে বলে, তুমিও চেনো না? নামটা তা হলে কোথায় পেলে?
একটা কাগজে লেখা ছিল।
কোন কাগজ?
পিউ পঞ্জিকার ভিতর থেকে চিরকুটটা বের করে গোরাংয়ের হাতে দিয়ে বলল, এই দাখো!
গোরাং চিরকুটটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখল। তারপর মাথা তুলে বলল, এ তো তুলেটি কাগজ। আজকাল এ কাগজ পাওয়াই যায় না। এ চিঠি তোমাকে কে দিল দিদি?
পিউ একটু হেসে বলল, একজন ম্যাজিশিয়ান। যেমন সুন্দর তার চেহারা, তেমনই ভাল তার ম্যাজিক।
বটে। তা, তার ম্যাজিক তুমি দেখলে কোথায়?
বাসের মধ্যে। সে কিন্তু ম্যাজিক দেখিয়ে পয়সা নেয়নি। বরং সবাইকে বিস্কুট, লজেন্স, চকোলেট, চা এসব দিয়েছে। ভারী ভাল লোক।
গোরাং ঘনঘন মাথা চুলকে বলল, এ তল্লাটে ম্যাজিশিয়ান তো মোটে পাঁচজন সাত গাঁয়ের গগন চটপটি, হব্বিপুরের সনাতন মুস্তাফি, ময়নার হারাধন পোদ্দার, চরণডাঙার সুমন্ত ঘোষ আর কুঞ্জপুকুরের ফটিক দাস। ফটিক আর সুমন্ত ছাড়া বাকি সব বুড়োহাবড়া। তুমি যেমন বলছ, তেমন সুন্দর চেহারা কারও নয়। তা হলে ম্যাজিকটা দেখাল কে, সেটাই ভাবনার কথা। আরও একজন ম্যাজিক জানে বলে শুনেছি। সে হল বীরপুরের বটুক সামন্ত। কিন্তু সে কখনও ম্যাজিক দেখায় না।
তুমি কিছু জানো না। লোকটা তালপুকুরে নেমে গেল। নিশ্চয়ই তালপুকুরেই বাড়ি।
এবার কেমন ভ্যাবলার মতো পিউয়ের দিকে চেয়ে রইল গোরাং! অনেকক্ষণ কথাই বেরোল না মুখ দিয়ে। তারপর বিড়বিড় করে বলল, তালপুকুর! বিক্ৰমজিৎ! কিন্তু তা কী করে হয়? সেটা যে অসম্ভব!
কী বলছ গোরাংদাদা?
মাথাটা ভোঁ-ভোঁ করছে দিদি। বড় গন্ডগোল পাকিয়ে দিয়েছ তুমি। তালপুকুর আর বিক্রমজিৎকে যে মেলাতে পারছি না! একথাও ঠিক যে, তালপুকুরে বিক্ৰমজিৎ নামে এক জাদুকর থাকত। সাংঘাতিক জাদুকর। এমন সব অশৈলি কাণ্ড করত যে, লোকে বেজায় ভয়ও পেত তাকে। কিন্তু দিদি, সে তো একশো বছর আগেকার কথা! বিক্ৰমজিৎ তো কবেই মরে গেছে। তাই ভাবছি, বিক্রমজিতের ভেক ধরে এ আবার কে উদয় হল! তার মতলবটাই বা কী! সে চিরকুটটাই বা কেন দিল তোমাকে! আর বিপদের কথাই বা বলল কেন? মাথার ভিতর সব তালগোল পাকিয়ে গেল যে!
তোমার তো সব সময়ই মাথা তালগোল পাকিয়ে যায়। একবার যে তোমাকে গালিভারের গল্প বলেছিলুম, সেটা শুনেও তোমার মাথা তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল!
হ্যাঁ দিদি, সেকথা ঠিক। তবে বিক্ৰমজিৎ, আর তালপুকুরের ব্যাপারটা আরও গোলমেলে। যদি সত্যিই তার রাজপুত্ত্বরের মতো চেহারা হয়, তা হলে আরও ভাবনার কথা। কারণ, একশো বছর আগে যে বিক্ৰমজিৎ জাদুর খেলা দেখাত, তারও চেহারা ছিল নাকি কার্তিক ঠাকুরটির মতো। কিন্তু মুশকিল কি জানো? তালপুকুরের বিখ্যাত জাদুকর বিক্ৰমজিৎ একশো বছর আগে খুব অল্প বয়সেই মারা গেছে। লোকে দুঃখ করে বলে, বেঁচে থাকলে সে নাকি দুনিয়ার সব জাদুকরকে হারিয়ে দিত।
ধেৎ! এ সে নয়। এ খুব ভাল লোক। আমাকে একটা চকোলেটবার দিয়েছে। এই দ্যাখো।
গোরাং জিনিসটা দেখে বলল, বাহারি মোড়ক দেখছি।
তুমি নেবে?
মাথা নেড়ে গোরাং বলে, না দিদি, ওসব জিনিসের মর্ম কি আমরা বুঝি? আমাদের মোটা চালের রাঙা ভাত আর লঙ্কা ছাড়া মুখে কিছু রোচে না! ওটা তুমিই খেও।
আমরা তো অচেনা লোকের দেওয়া জিনিস খাই না!
তবু রেখে দাও। ব্যাপারটা গোলমেলে বটে, কিন্তু তলিয়ে দেখলে হয়তো কোনও গুপ্তকথা বেরিয়ে আসবে। আজ উঠছি দিদি। চিরকুট আর চকোলেটটা লুকিয়ে রাখো। হাতছাড়া কোরো না।
ওমা! তুমি যাচ্ছ কোথায়? তোমাকে ভিক্ষেই দেওয়া হয়নি!
সে আর-একদিন হবে’খন দিদি। যা একখানা গোলমেলে ভাবনা ঢুকিয়ে দিলে মাথায়। আগে তাঁর জট ছাড়াই, তারপর ভিক্ষের কথা ভাবা যাবে।