ঘোরপ্যাঁচে প্রাণগোবিন্দ – ১

নমস্কার প্রাণগোবিন্দবাবু। এই অধমের নাম প্রভঞ্জন সূত্রধর। সেই ময়না-মুগাবেড়ে থেকে আসছি।

প্ৰাণগোবিন্দবাবু তটস্থ হয়ে বললেন, তা আসুন, আসুন।

শীতকালের সকাল সাতটা। ভোরবেলা জম্পেশ কুয়াশা ছিল, এখন কুয়াশা কেটে দক্ষিণের বারান্দায় নরম রোদ এসে পড়েছে। সামনে একটু ছোট বাগানমতো। তাতে শীতকালের গাঁদা, পপি, মোরগ ফুল ফুটে আছে। পোকামাকড়রাও যে যার কাজে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বাগানে ওড়াওড়ি করছে। প্রাণগোবিন্দর কুকুর নেই, দু’টো নধর বিড়াল আছে। তারা দু’জন প্রাণগোবিন্দর পায়ের কাছে দিব্যি বসে আলসেমি করছে। এ সময় প্রাণগোবিন্দবাবু চা খান। চায়ের সঙ্গে নোনতা বিস্কুট থাকে। গাঁয়ে খবরের কাগজ আসতে বেশ দেরি হয়। কাগজ আসেনি বলে প্রাণগোবিন্দ বসে-বসে পঞ্জিকা পড়ছিলেন। পঞ্জিকা তাঁর অতি প্রিয় গ্রন্থ। সারা বছর তিনি ফাঁক পেলেই পঞ্জিকা পড়েন। আর পঞ্জিকার বিজ্ঞাপন দেখে-দেখে জাদু রুমাল বা অত্যাশ্চৰ্য আতর বা অতি বৃহৎ লাল মুলার কথা ভেবে খুবই অবাক হন। প্রাণগোবিন্দবাবু অবাক হতে খুবই ভালবাসেন।

প্রভঞ্জন সূত্ৰধর মধ্যবয়সি। মোটাসোটা মানুষ। গায়ের রং কালোর দিকেই। বাবরি চুল, ভুঁড়ো গোঁফ আর লম্বা জুলপি আছে। পায়ে কেডস আর ফুল মোজা, পরনে খাটো করে পর ধুতি আর গায়ে একটা সাদা শার্টের উপর কালো আর কুটকুটে চেহারার কোট। বারান্দায় উঠে প্রভঞ্জন একটা বেতের চেয়ার টেনে প্রাণগোবিন্দবাবুর মুখোমুখি বসে বললেন, বিচক্ষণ মানুষ দেখলে আমি বড় খুশি হই। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, আজকাল বিচক্ষণ মানুষ বিশেষ দেখাই যায় না।

প্ৰাণগোবিন্দ কথাটা শুনে খুশিই হলেন। কারণ, তাঁর পরিবারের কেউই তাঁকে বিচক্ষণ বলে মনে করে না। এমনকী, তাঁর সন্দেহ, তাঁর পোষা দু’টো বিড়ালেরও প্রাণগোবিন্দর বুদ্ধিশুদ্ধির উপর বিশেষ আস্থা নেই। তিনি একটু খুশির হাসি হেসে বললেন, তা তো বটেই। কিন্তু বিচক্ষণ লোকগুলো কোথায় গেল বলুন তো!

আহা, যাবে আর কোথায়? যাওয়ার আগে তো আসাটা দরকার। তাই না? না এলে যাবেই বা কী করে? কথাটা বুঝলেন না? আসলে বিচক্ষণ মানুষ আজকাল আর জন্মাচ্ছেই না। সাতটা গ্রাম ঘুরে হয়তো এক-আধজন পাবেন।

প্রাণগোবিন্দবাবু এ কথাতেও বেশ আত্মপ্রসাদ অনুভব করে বললেন, তা বটে। বিচক্ষণ মানুষের বেশ অভাবই দেখছি! তা একটু চা খাবেন নাকি?

প্রভঞ্জন মাথা নেড়ে বললেন, না মশাই, এখন চা খেয়ে আর খিদেটা নষ্ট করব না। বরং একেবারে জলখাবারের সঙ্গেই চা খাওয়া যাবে।

প্রাণগোবিন্দর মুখটা একটু শুকিয়ে গেল। কারণ হল, গাঁয়ে এসে বসবাস শুরু করার পর প্রায়ই গাঁয়ের মাতব্বর আর উটকো লোকেরা এসে জুটছে। তাদের আপ্যায়ন করতে গিয়ে প্রাণগোবিন্দর গিন্নি জেরবার! আর লোকেরাও যেন তাক্কেতন্ধে থাকে। সকাল-বিকেলে প্ৰাণগোবিন্দের চা বা জলখাবারের সময়ই ‘হেঁ হেঁ’ করতে-করতে এসে হাজির হয়। প্রাণগোবিন্দর গিন্নির ধারণা হয়েছে যে, গাঁয়ের লোকগুলো খুবই ছোঁচা এবং বেহায়া। তাই তিনি এখন কড়া হাতে অতিথি-আপ্যায়ন বন্ধ করেছেন। এক-আধা কাপ চায়ে তেমন আপত্তি করেন না, কিন্তু খাবারের প্লেট সাজিয়ে দেওয়ার পাট তুলে দিয়েছেন। তাই প্রাণগোবিন্দবাবু, কাঁচুমাচু হয়ে মাথাটাথা চুলকে খুব লজ্জিত মুখে বললেন, ব্যাপারটা কী জানেন, আমি আজকাল জলখাবারটাবার খাই না। ওই কী বলে, একটু ডায়েট কন্ট্রোল করছি আরকী?

প্রভঞ্জন সূত্রধর এ কথায় একটুও দামে গেলেন না; বরং বেশ প্রসন্ন মুখেই বললেন, এই তো বিচক্ষণ লোকের লক্ষণ! মিতাহার মিতাচার না থাকলে কি বুদ্ধি বিবেচনা খোলে? পেট ভার হলে বুদ্ধি নিম্নগামী হয়। প্রাতরাশের দরকারও নেই তেমন। একটু আগে ঘোষপাড়ায় সাতকড়ির বাড়িতে দই-চিড়ে, মর্তমান কলা আর পাটালি গুড় দিয়ে ফলার করে এসেছি! বরং একটু বসে কথাবার্তা কই। তারপর একেবারে মধ্যাহ্নভোজনটাই সারা যাবে, কী বলেন?

মধ্যাহ্নভোজন শুনে প্ৰাণগোবিন্দবাবুর প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম। স্থলিত হাত থেকে পঞ্জিকাখানা খসে পড়ে গেল। প্রভঞ্জন তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে পঞ্জিকাখানা তুলে ধুলো ঝেড়ে তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, ওই সাতকড়ির কথাই ধরুন। দিব্যি চোখা-চালাক বিচক্ষণ মানুষ ছিল। বিষয়-সম্পত্তিও করেছে মেলা। কিন্তু এই মাঝবয়সে হঠাৎ নোলা হয়েছে খুব। কেবল খাই-খাই ভাব। সারাদিন কলাটা-মুলোটা তো খাচ্ছেই, তার উপর সকালে চিড়ে-দই সাপটে দুপুরে কালিয়া-কোৰ্মা উড়িয়ে রাতে ফের পোলাও-পায়েস। এখন দেখবেন বেশি খেয়েখেয়ে দিন-দিন কেমন ভ্যাবা-গঙ্গারাম হয়ে যাচ্ছে। পেটকে যত বিশ্রাম দেবেন, মাথা তত খোলতাই হবে।

প্রাণগোবিন্দ জলখাবারের ব্যাপারটা পাশ কাটানোর পর এখন এই মধ্যাহ্নভোজনটা কী করে এড়ানো যায়, সেটা দ্রুত ভাবতে-ভাবতে বললেন, তা বটে, তা বটে। বেশি খাওয়া মোটেই ঠিক নয় মশাই! এই তো আজকেই সেই নন্দীগ্রামে আমাদের মধ্যাহ্নভোজনের নেমন্তন্ন। তা তারা বেশ ফলাও আয়োজনও করে রেখেছে। কিন্তু আমি সাফ বলে দিয়েছি, না বাপু, গুরুপাক চলবে না। স্রেফ মাছের ঝোল আর ভাত।

প্রভঞ্জন যেন ভারী আহ্লাদিত হয়ে উঠলেন এ কথায় বললেন, আমি যত আপনার বিচক্ষণতার পরিচয় পাচ্ছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি। আপনি খুবই আটঘাট বেঁধে কাজ করেন। তবে এও বলি, যখন অন্যের পয়সাতেই ভোজ খাচ্ছেন, তখন একটু সেঁটে না খেলে কি জুত হবে? নন্দীগ্রাম তো আর এক দৌড়ের রাস্তা নয়। পাক্কা সাড়ে তিন ক্রোশ। পথের ধকলেই সব হজম হয়ে যাবে যে! তা সে যাক, আপনার নির্লোভ স্বভাব দেখে ভারী ভাল লাগল। তা হলে এবার কাজের কথাটা বলে ফেলি।

প্রাণগোবিন্দ উৎসাহিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাজের কথাটাই হোক। আমাকে আবার সপরিবার বেলাবেলি সেই নন্দীগ্রামে রওনা হতে হবে তো!

প্রভঞ্জন মাথা নেড়ে বললেন, তা তো বটেই, তবে কিনা সকালবেলায় এতক্ষণ খালি পেটে থাকাটাও আপনার ঠিক হচ্ছে না। উপোস দেওয়ার ফলে আপনার বুদ্ধিতে শান পড়ছে বটে, কিন্তু মাথা ছাড়া অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এতে খুব-একটা খুশি হবে কি? তাদেরও তো কিছু প্রত্যাশা থাকে। নন্দীগ্রাম পৌঁছতে, তা ধরুন, বেলা একটা-দেড়টা তো হবেই। একটু বেশিই লাগতে পারে। মাঝখানে আবার সরস্বতী নদীর খেয়া পারের ব্যাপার আছে কিনা।

প্রাণগোবিন্দ যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন। কারণ, ভিতরবাড়ি থেকে লুচি ভাজার গন্ধ আসছে, একটু আগে বেগুন ভাজার গন্ধও আসছিল। এখন যদি গিন্নি হুট করে মোক্ষদাকে দিয়ে লুচির থালা পাঠিয়ে দেন, তা হলে প্রভঞ্জনের সামনে ভারী লজ্জায় পড়তে হবে! তাই উদ্বেগের গলায় বললেন, তা হলে বরং কিছু একটু মুখে দিয়ে নেবখন। এবার কাজের কথাটা…?

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই যে!’ বলে প্রভঞ্জন সূত্ৰধর তাঁর কোটের ভিতর দিককার কোনও গুপ্ত পকেটে বেশ গভীরে ডান হাতটা ঢুকিয়ে অতি সাবধানে এক বাণ্ডিল নোট বের করে এনে সামনের খুদে টেবিলটার উপর রেখে একগাল হেসে বললেন, এই হল গৌরীর মুক্তিপণ। পুরো পঞ্চাশ হাজার আছে। গুনে নিন।

প্ৰাণগোবিন্দ গোল-গোল চোখে আপার বিস্ময়ে নোটের বান্ডিলটা দেখছিলেন। পাঁচশো টাকার নোট তিনি ভালই চেনেন। না গুনেই আন্দাজ করা যায়, বান্ডিলে শতখানেক নোট আছেই; এই সাতসকলে অযাচিত এত টাকা তাঁর বাড়িতে এসে হাজির হওয়ায় প্রথমে কিছুটা অবাক এবং কয়েক সেকেন্ড বাদে বেশ খুশি হয়ে বলে উঠলেন, বাঃ বাঃ, এ তো বেশ মোটা টাকাই।

প্রভঞ্জনও একমত হয়ে বললেন, আজ্ঞে, আমারও তাই মত। আমার মক্কেল চরণডাঙার গোকুল বিশ্বাসকেও আমি কথাটা বলেছিলাম। বলেছিলাম, ‘গোকুলবাবু, একটা গোরুর জন্য ফস করে পঞ্চাশ হাজার টাকা বের করে দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? দরাদরি করে দশ-বিশ হাজার টাকা কমানোর চেষ্টা করলে হত না?’ শুনে উনি আঁতকে উঠে বললেন, বলো কী প্রভঞ্জন! যারা আমার গৌরীকে নিয়ে গিয়েছে তারা কি আর ভাল লোক! দশ-বিশ হাজার কম দিলে তারা হয়তো গাঁইগুঁই করে রাজি হবে, কিন্তু শোধ তোলার জন্য গৌরীকে হয়তো পাঁচন দিয়ে ঘা-কতক বসিয়ে দেবে। কিংবা লেজ মুচড়ে দেবে। বাঁ কান মলে দেবে। ও বাবা, গৌরীর কষ্ট আমার মোটেই সহ্য হবে না। সে আমার মেয়ের মতো। তার কষ্টের কাছে পঞ্চাশ হাজার কিছু নয়।

শুনে প্রাণগোবিন্দরও চোখ ছলছল করে উঠল। বললেন, আহা, গোরুকে তো বড় ভালবাসেন ভদ্রলোক!

খুব, খুব। পরিবারের আর কারও সঙ্গেই গোকুল বিশ্বাসের বনে না। শুধু এই গৌরীর সঙ্গেই তাঁর যত ভাব।

আহা, শুনে বড় ভাল লাগল। অবলা জীবের প্রতি মানুষের মায়ামমতা যত বাড়ে, ততই পৃথিবীর মঙ্গল।

আজ্ঞে, সে কথাও ঠিক। আর সেই জন্যই গোকুল বিশ্বাস দরাদরি না করে পুরো মুক্তিপণের টাকাটাই পাঠিয়ে দিয়েছেন। টাকাটা প্রকাশ্যে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না মশাই! নোটগুলো পরীক্ষা করে গুনে নিন। তারপর একটু ঢাকা ঢুকি দিয়ে রাখুন।

টাকা গুনতে খুব একটা খারাপ লাগে না প্ৰাণগোবিন্দবাবুর। সময়টাও ভালই কাটে। তিনি টাকাগুলো গুনে বললেন, ‘নোটগুলো জাল নয় এবং নোট একশোখানাই আছে।’ টাকার কাণ্ডিলটা র‌্যাপারের তলায় ঢুকিয়ে ফেলে বললেন, নাঃ, পঞ্চাশ হাজারই আছে।

প্রভঞ্জন মাথা নেড়ে বললেন, তা আর থাকবে না? গোকুল বিশ্বাস খাঁটি লোক, কথার নড়াচড় নেই। তা হলে বরং গোরুটা আনতে বলে দিন। আমাকে গোরু নিয়ে গোকুল বিশ্বাসের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তবে বিষয়কর্মে বেরোতে হবে। সেই রকমই কথা হয়ে আছে কিনা।

প্রাণগোবিন্দ এবার একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। যতদূর মনে পড়ছে, তাঁদের মোটে দুটো গোরু আছে। একটা কালো আর একটা বাদামি, একটা দুধেল, একটা গাভিন। গোরু বিষয়ে তাঁর জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ। ওসব তাঁর গিন্নি আর কাজের লোকেরাই সামলায়। গোরুর দাম পঞ্চাশ হাজার কিনা এ বিষয়েও তিনি খুব নিশ্চিত নন।

ঠিক এই সময় মোক্ষদা পারদা সরিয়ে লুচি আর বেগুন ভাজার রেকবিটা নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করায় প্রাণগোবিন্দের মাথায় একটা চমৎকার আইডিয়া খেলে গেল। তিনি ভারী আত্মপ্ৰসাদের হাসি হেসে বললেন, নিন, আপনার জলখাবার এসে গিয়েছে।

প্রভঞ্জন ভারী খুশি হয়ে বললেন, ‘তাই নাকি? বাঃ, বেশ!’ বলেই মোক্ষদার হাত থেকে একরকম রেকবিটা কেড়েই নিলেন।

প্ৰাণগোবিন্দ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললেন, আপনি বরং খেতে থাকুন, আমি গোরুর ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত করে আসছি।

যে আঞ্জে। গোরু না নিয়ে যাচ্ছি না। আপনি ঘুরে আসুন।

শশব্যাস্তে ভিতরবাড়িতে এসে প্ৰাণগোবিন্দ তাঁর গিন্নি সুরবালাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের কোন গোরুটার নাম গৌরী বলো তো?

সুরবালা কুটনো কটুতে বসেছেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, গৌরী! গৌরী তো আমাদের বড় মেয়ের নাম। ও নাম গোরুকে দিতে যাব কেন?

আহা, গৌরী নামে কি আমাদের কোনও গোরু নেই! ওই যে গো, যে গোরুটাকে চরণডাঙার গোকুল বিশ্বাস খুব ভালবাসে!

তোমার কি বুড়ো বয়সে মাথার দোষ হল? কে চরণডাঙার গোকুল বিশ্বাস? সে আমাদের গোরুকে ভালবাসতে যাবে কোন দুঃখে?

আহা, ওসব তুমি বুঝবে না। আমাদের গোরুগুলোর নাম কী সেটা আগে শুনি!

একটার নাম রঙি, আর-একটার নাম কালী৷ তুমি কেমন লোক বাপু যে, নিজের গোরুর নাম জানো না!

ঠিক এই সময় মোক্ষদা এসে চোখ বড়-বড় করে বলল, কর্তামা, দাখোগে, একটা ভালুকের মতো লোক এসে কর্তাবাবার জলখাবারের প্লেট কেড়ে নিয়ে গবগব করে লুচি-বেগুন ভাজা খাচ্ছে। আরও চাইছে।

‘অ্যাঁ!’ বলে একটা আর্তনাদ করে বঁটি কাত করে রেখে সুরবালা তেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু জোঁকের মুখে নুন ফেলার কায়দায় প্রাণগোবিন্দ ফাঁস করে র‌্যাপারের তলা থেকে টাকার বাণ্ডিলটা বের করে গিন্নির নাকের ডগায় ধরে একগাল হেসে বললেন, বিনি মাগনা খাচ্ছে না গো, বিনি মাগনা খাচ্ছে না, নগদ পঞ্চাশ হাজারটি টাকা গুনে দিয়েছেন!

সুরবালা হাঁ করে কিছুক্ষণ প্ৰাণগোবিন্দর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, লুচি-বেগুন ভাজার দাম পঞ্চাশ হাজার টাকা! তুমি কী সব আবোলতাবোল বকছ বলো তো! এর চেয়ে তো কাবলিওয়ালার ভাষা বোঝা সহজ। কী হয়েছে, একটু গুছিয়ে বলবে?

প্ৰাণগোবিন্দর নিজেরও কেমন যেন একটু ধন্দ লাগছে। তিনি ঠিক ব্যাপারগুলো মেলাতে পারছেন না। তাই আমতা-আমতা করে বললেন, আসলে একজন লোক আমাদের একটা গোরু কিনতে চায়! সে নাকি গোরুটকে খুব ভালবাসে। তাই পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে।

সুরবালা আরও হাঁ! অনেকক্ষণ বাক্যিই বের করতে পারলেন না। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, গোরুর দাম পঞ্চাশ হাজার? ওতে তো হাতি কেনা যায়। কোন চক্করে পড়েছি বলো তো! সাতসকালে গোরু কিনতেই বা লোক এসেছে কেন? আমরা কি গোরু বেচব বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছি! তোমার মতো আহাম্মককে নিয়ে চলা যে কী ঝঞ্জাটের কাজ, তা কেবল আমিই জানি। চলো দেখি, কোন মুখপোড়া এসে তোমাকে আগডুমবাগডুম বোঝাচ্ছে!

মোটাসোটা কোট-পরা লোক ভারী তারিয়ে-তারিয়ে শেষ লুচিটা দিয়ে শেষ বেগুন ভাজাটা বাগিয়ে ধরে খাচ্ছে। আরামে চোখ দুটি নিমীলিত।

সুরবালা বললেন, আচ্ছা, কী ব্যাপার বলুন তো! আপনি নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে আমাদের একটা গোরু কিনতে চান?

প্রভঞ্জন স্বপ্নাতুর চোখে সুরবালার দিকে চেয়ে খুব নির্বিকার গলায় বললেন, মা ঠাকরেন, বাড়তি লুচি আছে কি?

সুরবালা একটু অবাক হয়ে থাতমত খেয়ে বললেন, আছে। পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আরও লুচি-বেগুন ভাজা এল। সঙ্গে সুরবালা আর প্রাণগোবিন্দও! সুরবালা বললেন, এবার আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন কি? উনি তো কিছুই গুছিয়ে বলতে পারছেন না। আমরা তো গোরু বেচতে চাই না।

প্রভঞ্জন খেতে-খেতে বললেন, বিকিকিনির কথা উঠছে কেন মা? গোরু আমার মক্কেলও কিনতে চান না। ওটা হল গোরুর মুক্তিপণ।

মুক্তিপণ! আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন, কিছুই যে বুঝতে পারছি!

প্রভঞ্জন হাত-মুখ গ্লাসের জলে ধুয়ে রুমালে মুখ মুছে ভারী তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, এ বাড়ির খাওয়াদাওয়া বেশ উঁচুদরের, কী বলেন মা? তা না হবেই বা কেন? রোজগারটাও উঁচু, নজরও উঁচু। ভারী খুশি হলাম। বিচক্ষণ মানুষ দেখলেই মনটা ভারী নেচে ওঠে। তা মা, কী যেন জানতে চাইছিলেন?

বলছি, ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

আহা, স্বয়ং প্ৰাণগোবিন্দবাবু থাকতে আমার কাছে শুনবেন কেন? উনিই ব্যাপারটা আরও খোলসা করে বুঝিয়ে দিতে পারতেন। তবে মা, ওঁর মতো পরিষ্কার মাথা আর দূরদৃষ্টি আমি খুব বেশি দেখিনি।

সুরবালা অবাক হয়ে বললেন, ওঁর পরিষ্কার মাথা? দূরদৃষ্টি? বলি আপনার কি ভীমরতি হয়েছে? ওঁর তো ডান-বাঁ জ্ঞানই নেই। এই আহাম্মক মানুষকে নিয়ে জ্বলে-পুড়ে যে খাক হয়ে গেলুম।

মৃদু হেসে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে প্রভঞ্জন বললেন, “তা হলে মা, বলতেই হবে যে, আপনি ঘর করেও ওঁকে ঠিক চিনতে পারেননি। বড় মাপের প্রতিভাবানদের চট করে চেনাও যায় না কিনা। যাঁকে আপনি আহাম্মক ভাবছেন, তিনি শুধু বিচক্ষণই নন, আটঘাট বেঁধে ঠান্ডা মাথায় এমন পরিপাটি আর নিখুঁত কাজ করেন, যা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। এই আমার মক্কেল গোকুল বিশ্বাসের ঘটনাটাই দেখুন না। দিনচারেক আগে তার আদরের গোরু গৌরী মাঠে চরতে গিয়ে উধাও হয়ে যায়। রাখাল ছেলেটা নাকি খোঁটা বেঁধে গাছতলায় ঘুমোচ্ছিল, কিছু টেরই পায়নি। গৌরী নিরুদ্দেশ হওয়ায় গোকুল বিশ্বাস সারা তল্লাট তোলপাড় করে তাকে খুঁজলেন। না পেয়ে রাত্ৰিবোলা কেঁদেকেটে শয্যা নিলেন। রাত বারোটায় তাঁর জানালায় টোকা পড়ল। তিনি উঠে জানালা খুলে দেখেন, মুখে গামছা বাঁধা একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। চাপা গলায় বলল, ‘গৌরীকে যদি ফেরত চাও, তা হলে নসিগঞ্জের প্রাণগোবিন্দ রায়ের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা পৌঁছে দাও। তিন দিন সময় দিচ্ছি।’ ব্যস, ওটুকু বলেই লোকটা হাওয়া হয়ে গেল।

সুরবালা এবং প্রাণগোবিন্দ একসঙ্গেই আৰ্তনাদ করে উঠলেন, সৰ্বনাশ!

প্রভঞ্জন অবাক হয়ে বললেন, আচ্ছা, আপনাদের সর্বনাশ হতে যাবে কেন? সর্বনাশ তো হল গোকুল বিশ্বাসের। তা এই ঘটনার পর গোকুল বিশ্বাস আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি হলুম গে তাঁর বাঁধা উকিল। গিয়ে দেখলুম, তিনি খুবই ভেঙে পড়েছেন।

সুরবালা আর্তনাদ করে উঠলেন, আপনারা পুলিশে গেলেন না কেন?

প্রভঞ্জন মৃদু হেসে বললেন, তাতে লাভ কী বলুন। ওই যে বললুম, বিচক্ষণ মানুষদের নিখুঁত পরিকল্পনা থাকে। প্রথম কথা হল, আমাদের পাঁচটা গ্রাম নিয়ে হল নয়নজোড় থানা। থানার বড়বাবু হলেন গিয়ে প্রাণগোবিন্দবাবুর সাক্ষাৎ ভাগনিজামাই! নিজের মামাশ্বশুরের নামে নালিশ কোন দারোগা সহ্য করবে বলুন? তার উপর কথা হল, প্রমাণ কোথায়? চিরকুট নেই, লিখিত-পড়িত কিছু চুক্তি হয়নি, যে লোকটা খবর দিতে এসেছিল, তার মুখ দেখতে পাওয়া যায়নি। তাই তো বলছি, এরকম বুদ্ধিমান মানুষের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে।

সুরবালা খুবই রেগে গিয়ে বললেন, কার সম্পর্কে কী বলছেন তা জানেন? উনি আহাম্মক হতে পারেন, বোকাও আছেন একটু, কিন্তু জীবনে কখনও কোনও অসৎ কাজ করেননি। চিরকাল কলেজে সুনামের সঙ্গে পড়িয়েছেন। উনি সকলেরই অত্যন্ত শ্ৰদ্ধার পাত্র।

প্রভঞ্জন ঘনঘন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, জানি মা ঠাকরেন, সব জানি। ওঁর সম্পর্কে সব খোঁজখবর নিয়েই এসেছি কিনা। উনি কলেজে দৰ্শনশাস্ত্র পড়াতেন, ভুলো মনের মানুষ, অতি সজ্জন, এসব সবাই জানে। আমাদের কাছেও উনি খুবই শ্রদ্ধার পাত্র। রিটায়ার করার পর গাঁয়ে এসে নিজের পূর্বপুরুষদের ভিটোতে বসবাস করছেন এতেও আমরা গৌরবই বোধ করি। রিটায়ারের পর যে নিজের মাথাটিকে নানারকম উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ায় খাটিয়ে যাচ্ছেন, এতেও আমরা বড় খুশি হয়েছি।

শুনুন, আপনি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। তা হলে আপনি নিজের চোখেই দেখে যান, উনি অন্য কারও গোরু ধরে এনেছেন কিনা! আমি আমাদের রাখাল হলধরকে ডাকছি।

খবর পেয়ে হলধর তাড়াতাড়ি এসে হাজির হল।

যাও তো হলধর, এই ভদ্রলোককে নিয়ে গিয়ে আমাদের গোয়ালঘরটা দেখিয়ে নিয়ে এসো। উনি নিজের চোখেই দেখুন, আমাদের গোয়ালে দু’টোর বেশি গোরু আছে কি না।

হলধর একটু কাঁচুমাচু হয়ে ঘ্যাঁস-ঘ্যাঁস করে মাথা চুলকোতে-চুলকোতে আমতা-আমতা করে বলল, মা-ঠান, একটা বড় মুশকিল হয়েছে যে!

মুশকিল! মুশকিল আবার কী হ’ল?

কাল রাতে যখন গোয়াল বন্ধ করি তখন দুটো গোরুই ছিল বটে। কিন্তু আজ সকলে গোয়াল পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি, কোথা থেকে একটা তিন নম্বর গোরু এসে গোয়ালে ঢুকে বসে-বসে জাবর কাটছে!

প্রভঞ্জন সোৎসাহে বলে উঠলেন, দুধের মতো সাদা ধবধবে গাই তো, বাঁ দিকের দাবনায় একটা ত্ৰিশূলের মতো ছোপ আছে!

হলধর কাহিল মুখ করে বলল, আজ্ঞে তাই বটে।

প্রভঞ্জন খুব গ্যালগালে হাসি হেসে সুরবালার দিকে চেয়ে বললেন, বলেছিলুম কিনা মা ঠাকরেন, আপনার স্বামীর এলেম আপনি জানেন না, জানি এই আমরা বাইরের লোকেরা। উনি নমস্য ব্যক্তি মা, নমস্য ব্যক্তি, কী বুদ্ধি!! কী মেধা! কী সাংগঠনিক শক্তি! কী সাহস! এমন সুন্দর সুচারুভাবে কাজ করলেন যে, ওঁর টিকিটও কেউ ষ্টুতে পারবে না। ছাত্র পড়াতেন, নিশ্চয়ই ভালই পড়াতেন। কিন্তু এই মেধা তো কেবল ছাত্রসমাজে আটকে রাখলে চলে না। এখন জনশিক্ষার কাজেও একে লাগাতে হবে। যাও তো বাপু হলধর, গোরুটা নিয়ে এসো। বেলাবেলি রওনা হয়ে পড়ি।

সুরবালার মুখে কথা নেই। ধপ করে চেয়ারে বসে চোখ বুজে রইলেন। ভারী বেকুবের মতো নিজের মাথায় ঘনঘন হাত বুলিয়ে যাচ্ছিলেন প্ৰাণগোবিন্দ। ঘটনাটা ঠিক তাঁর মাথায় সেঁধোচ্ছে না।