চার
‘খাইছে, এজন্যেই এর নাম প্যারট ফিশ!’ কিছুক্ষণ পরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল মুসা। এমা আর ছেলে-মেয়েরা এমুহূর্তে কি ওয়েস্ট অ্যাকুয়ারিয়ামের এক বিশাল ট্যাঙ্কের ভেতরে উঁকি দিচ্ছে। ঝলমলে এক মাছকে কাকচক্ষু জলে ছোটাছুটি করতে দেখছে ওরা। রঙবেরঙের মাছটির ঠোঁট প্রায় পাখির মতন।
‘প্যারট ফিশ ঠোঁট দিয়ে প্রবাল থেকে ঘষে ঘষে শৈবাল তোলে,’ ব্যাখ্যা করে বলল এমা। ‘এর ফলে প্রবাল প্রাচীরে বিশ্রী দাগ পড়ে যায়।’
এমা ওদেরকে নিয়ে গেল আরেকটি মস্ত বড় ট্যাঙ্কের কাছে, এক যুবক যেখানে লেকচার দিচ্ছে। লোকটি ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে কালচে, কিলবিলে কী একটা যেন বের করে সাবধানে তুলে ধরল দর্শকদের সামনে।
‘এটা নার্স শার্ক,’ বলল লোকটি। ‘কেউ ধরতে চান?’
চোখের তারা নেচে উঠল ডনের।
‘আমি ধরি?’ লোকটি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালে, ডন কাছিয়ে গিয়ে হাঙরটার শরীরের একপাশে আলতো করে হাত বোলাল। তারপর সাঁত করে হাতটা টেনে নিল। ‘ঠিক শিরিষ কাগজের মত খরখরে!’
‘খাইছে, কামড়াবে না তো?’ প্রশ্ন করল মুসা, নিজের পালা আসার অপেক্ষা করছে।
‘না, নার্স শার্ক একদমই নিরীহ। খুব শান্ত-শিষ্ট,’ এমা বলল ওদেরকে।
ওরা পকুপাইন পাফার আর সি কিউকাম্বারদের সম্পর্কে জানার পরে, গাইড ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে বড়সড় এক শাঁখের খোল তুলল।
‘ঠিক তোমারটার মত,’ ফিসফিস করে মুসাকে বলল রবিন।
‘হুঁ,’ বলল মুসা, প্রশংসার দৃষ্টিতে গোলাপী-সাদা মোচাকার খোলসটা দেখল। কে সে রাতে ক্লাসরুম বিল্ডিঙে ঢুকেছিল, এবং চোরটাকে ধরা যাবে কিনা ভাবল। মনে-মনে আশা করল চোর ঠিকই ধরা পড়বে।
‘এটা হর্স শাঁখ,’ গাইড বলছে। ‘ও হয়তো আমাদের খাতিরে বেরিয়ে আসবে।’ খোলস ছেড়ে ইয়াবড় এক বাদামি জিনিস কিলবিল করে বেরিয়ে না আসা অবধি অপেক্ষা করল।
ডন সামনে ঝুঁকল কাছ থেকে দেখতে।
সবার চোখের সামনে গাইডের হাতের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি পেরিয়ে, ফের হেলেদুলে খোলসে ঢুকে পড়ল শঙ্খটা।
‘শঙ্খ খুব ইন্টারেস্টিং সামুদ্রিক প্রাণী। ওরা লাল শৈবাল খায় আর চব্বিশ ঘণ্টায় এক মাইলটাক পাড়ি দেয়।’
‘ভয়ানক স্লো, বলল কিশোর।
খিলখিল করে হেসে ফেলল ডন।
‘কিন্তু ওকে তো নিজের বাসাটাকে পিঠে করে বয়ে বেড়াতে হয়!’ আরেক ট্যাঙ্কের এক আকর্ষণীয় নীল মাছ নজর কাড়ল ওর। ‘দেখেছেন?’ বলে, এমার হাত ধরে টানল।
‘আমি ওই মাছটার কথাই বলেছিলাম। কার ওয়াশ মাছ।’
মাথা ঝাঁকাল এমা।
‘ব্লু অ্যাঞ্জেল ফিশ,’ বলে, ট্যাঙ্কের লেবেলটা পড়ল। ‘তোমার স্মৃতিশক্তি খুব তীক্ষ্ণ, ডন, বলল ওকে। ‘এটা অন্য মাছেদের গা থেকে জীবণু খেয়ে সাফ করে।’
আশ্চর্য! এ মাছের কথা কখনও শোনেনইনি নিল স্যাণ্ডার্স, ভাবল কিশোর।
পরে, সে রাতে ফ্রায়েড চিকেন আর আলু ভর্তা দিয়ে সুস্বাদু ডিনার খেতে বসে ডন ওর অ্যাকুয়ারিয়াম দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা জানাল গোটা টেবিলের সবাইকে।
‘আমরা এমনকী ব্যারাকুডাও দেখেছি,’ সগর্বে বলল। ‘পানির নিচে খুব জোরে সাঁতরাচ্ছিল ওটা।’
নিল স্যাণ্ডার্স মৃদু হাসলেন ওর উদ্দেশে।
ওরা কিন্তু খুব বিপজ্জনক,’ জানালেন। ‘তোমার দিকে কোনওটাকে তেড়ে আসতে দেখলেই পানি থেকে উঠে পড়বে।’ ঠাট্টা করে বললেন।
‘আর সাঁতারের সময় কোন গয়নাগাটি না পরাই ভাল,’ বলল এমা, নিল স্যাণ্ডার্সের গলা থেকে ঝোলা সরু রুপোর চেইনটা দেখাল।
ফাঁকা দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইলেন মেরিন বায়োলজিস্ট। তিনি যে কিছুই বোঝেননি তা বুঝতে কষ্ট হলো না কারও। মুসা শেষমেশ চাইল এমার দিকে।
‘খাইছে, তার মানে?’
শ্রাগ করল এমা।
‘সবাই জানে ব্যারাকুড়া চকচকে জিনিস দেখলে আকৃষ্ট হয়। পানিতে যদি রুপোলী ঝলক দেখে-চেইনের মত কিছু—মনে করবে ওটা খাওয়ার জিনিস। ওদের প্রিয় খাবার হচ্ছে এক ধরনের ছোট রুপোলী মাছ।’ বিরতি নিয়ে দৃষ্টিনিবদ্ধ করল নিল স্যাণ্ডার্সের ওপর। ‘আপনি জানেন নিশ্চয়ই।’
‘জানি তো,’ ঝটপট বললেন নিল। খানিকটা অপ্রস্তুত দেখাল তাঁকে।
‘আমি, বাবা, মাছের খাবার হতে চাই না!’ ডনের কথায় হেসে উঠল সবাই।
‘চিন্তা নেই, ডন,’ এমা আশ্বস্ত করল ওকে। ‘তুমি মাছের খাবার যাতে না হও সেটা আমরা দেখব।’
ডিনার শেষে, ছেলে-মেয়েরা ওদের অ্যাকুয়ারিয়াম দেখতে যাবে ঠিক করল। বাজার থেকে কটা সুদৃশ্য, রঙবেরঙের ঝিনুক কিনেছিল রবিন, সেগুলো সাজাবে ওর ট্যাঙ্কে।
ওরা ক্লাসরুম বিল্ডিঙে কাজ করছে, এসময় কিছু একটা মনে পড়ল ডনের। কিশোরের কবজি ধরে টানল ও।
‘আমরা পন্টুন বোটে করে যেদিন বেড়াতে যাই সেদিন অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে।’ অল্প কথায় সবাইকে জানাল জো ইলিয়টকে মহাসাগর থেকে কিছু একটা কুড়িয়ে শার্টের তলায় গুঁজতে দেখেছিল ও।
‘পাত্রে রাখার কথা, রাখেনি,’ বলল ডন, বিভ্রান্ত। ‘এখানে গোঁজে।’ বুকের কাছে হাত চাপড়ে দেখাল।
‘কী ছিল ওটা?’ সু কি জানতে চাইল।
‘নিশ্চয়ই জ্যান্ত মাছ নয়,’ বলল রবিন। ‘তাহলে ছটফট করত।’
‘হয়তো শঙ্খের খোল,’ বাতলে দিল মুসা, নিজেরটার কথা ভেবে।
‘না, অত বড় জিনিস শার্টের নিচে গোঁজা সম্ভব নয়,’ বলল কিশোর।
‘হয়তো খুব সুন্দর কোন ঝিনুক, সে কাউকে দেখাতে চায়নি।’ নিজের ট্যাঙ্কে সাবধানী হাতে সি ফ্যান রাখার সময় বলল নথি।
‘কিন্তু তাহলে কী করেছে ওটা নিয়ে?’ প্রশ্ন করল সু কি। জো ইলিয়ট স্ত্রীর সঙ্গে যে ট্যাঙ্কটা ভাগাভাগি করছে সেটি এক ঝলক দেখল। কয়েক গোছা সামুদ্রিক ঘাস আর গোটা দুয়েক অ্যাঞ্জেল ফিশ ছাড়া ওটা খালিই প্রায়। ‘ট্যাঙ্কে রাখেনি।’
কেবিনে ফেরার পথে ওরা দেখল টেড ডকের দিকে এক নৌকো গাইড করছে। যুবকটি এখানকার এক কাউন্সেলর। নৌযানটি ক্যাম্পারে ভর্তি, এবং মুসার মনে পড়ল রাতে ওদের ঘুরতে যাওয়ার কথা রয়েছে। সাধারণত রাতের বেলা নৌকো নিয়ে বেরনোর নিয়ম নেই, তবে এটি বিশেষ উপলক্ষ।
ওরা কী পেল দেখি চলো,’ পরম আগ্রহের সঙ্গে বলল ডন। ‘এমা বলেছে শুধুমাত্র রাতেই কিছু-কিছু মাছ বেরোয়।’
ওরা পানির কিনারায় পৌঁছেছে প্রায়, এসময় জো ইলিয়টকে গদাইলশকরী চালে হেঁটে যেতে দেখল। লোকটিকে দেখে মনে হলো গভীর ভাবনায় ডুবে রয়েছে এবং টেড তার দিকে নৌকো থেকে এক রশি ছুঁড়ে দিতেই চমকে উঠল রীতিমত।
‘ওটা একটু বেঁধে দেবেন?’ জিজ্ঞেস করল টেড।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই…’ হাতে ধরা দড়িটার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে দু’মুহূর্ত চেয়ে রইল জো, তারপর অনিশ্চিত ভঙ্গিতে পাইলিঙে পেঁচাল ওটাকে। ‘হয়ে গেছে,’ চনমনে গলায় বলে, তড়িঘড়ি পা চালিয়ে চলে গেল।
টেড এক লাফে নৌকো থেকে নেমে রশিটার দিকে চাইল, মাথা নাড়ল ও।
‘এটা কোন বাঁধা হলো?’ ওকে বিড়বিড় করতে শুনল কিশোর। ‘নৌকা কীভাবে বাঁধে তাও জানে না লোকটা!’
‘শুনলে?’ ওরা শ্রবণসীমার বাইরে যেতেই বলল কিশোর। কেবিনের দিকে চলে যাওয়া আঁকাবাঁকা পথটা দিয়ে হাঁটছে দলটা।
হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘মিস্টার ইলিয়ট নাকি সেইলিং কোম্পানি চালান, অথচ নৌকা বাঁধতেও পারেন না!’ একটু বিরতি নিল। ‘এর কোন মানে আছে?’
‘খাইছে, অনেক কিছুরই অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না,’ বলল মুসা। ‘মিস্টার স্যাণ্ডার্স নাকি মেরিন বায়োলজিস্ট, অথচ ব্যারাকুডা যে ছোট-ছোট রুপোলী মাছ খায় তা জানেন না। এমাকে বলে দিতে হয়।’
‘শুধু তা-ই নয়, উনি কার-ওয়াশ মাছও চেনেন না,’ ডন মনে করাল ওকে।
‘হ্যাঁ,’ সায় জানাল কিশোর। ‘আর এখন মিস্টার ইলিয়ট। সাধারণ একটা গিঁট দিতে জানে না এমন নাবিকের কথা জীবনেও শুনিনি!’
ওরা এখন সু কিদের কেবিনের কাছে, এবং মুসা দরজার বাইরে থমকে দাঁড়াল।
‘এখানে এমাই একমাত্র মানুষ যে নিজের কাজটা জানে, বোঝে,’ বলল ও।
‘ঠিক বলেছ,’ জোর গলায় সমর্থন জানাল ডন। ‘ওনাকে আমার অনেক ভাল লাগে!’
‘আমাদেরও লাগে,’ বলল রবিন। ‘এখন ঘরে যাও, ভাইয়া। কাল অনেক অ্যাকটিভিটি আছে।’
‘জানি তো,’ বলল ‘ডন, পথটা ধরে ছুট দিল নিজেদের কেবিনের দিকে। ‘আটটায় উইণ্ড-সার্ফিং, দশটায় সেইলিং, দুটোয় স্নরকেলিং।’
‘আর?’ মজা করে বলল মুসা।
এক মুহূর্ত ভাবল ডন, তারপর মাথা নাড়ল।
‘মনে পড়ছে না তো।’
‘সাতটায় নাস্তা!’
হেসে ফেলল রবিন।
‘মুসার খাই-খাই স্বভাবটা আর গেল না,’ বলল। ‘পেটুক শিরোমণি!
.
পরদিন সকালে, ক্যাফেটেরিয়া লাইন ভেদ করে ঊর্ধ্বগতিতে ছুটল ডন, ও যাতে সবার আগে উইণ্ড-সার্ফিং সিমুলেটরে চড়তে পারে। অতিকায় এক স্প্রিঙের ওপর, চওড়া, সমতল এক বোর্ড ওটা। বোর্ডে চেপে নড়াচড়া করলেই মনে হবে তুমি বুঝি ঢেউয়ের ওপর সামনে-পেছনে দুলছ।
‘শুকনো ডাঙায় সার্ফিং করতে মজাই লাগবে,’ বলে, ডন লাফিয়ে উঠে পড়ল যন্ত্রটায়।
‘পড়ে গেলে কিন্তু অত মজা আর লাগবে না,’ এমা সতর্ক করল ওকে।
‘পড়ব না,’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল ডন।
‘কে জানে,’ এমা ওর পাজোড়া বোর্ডে যথাস্থনে বসাতে সাহায্য করল। ‘তবে দশজনের মধ্যে ন’জনই পড়ে। কাজটা যতটা ভাবছ ততটা সহজ নয়।
পরের দশ মিনিট, ডন বোর্ডের ওপর ভারসাম্য ধরে রেখে পালগুলো নিয়ে অনুশীলন করল।
‘খুবই কঠিন কাজ,’ বলল। পাল একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে টানল। ‘তবে মহাসাগরে গেলে নিশ্চয়ই খুব মজা লাগবে।’
‘হ্যাঁ, খেলাটায় আনন্দ অনেক,’ বলল এমা, ‘তবে আগে নিরাপদে ডাঙায় প্র্যাকটিস করতে হবে। আর পানিতে যখন যাবে লাইফ জ্যাকেট পরতে হবে। পানিতে পড়ে গেলেও যেন কোন বিপদ না হয়। অবশ্য আমার মনে হয় না তুমি পড়বে।’
ছেলে-মেয়েরা পালা করে চাপল যন্ত্রটায়। খুব সহজেই ওটাকে আয়ত্তে এনে ফেলল রবিন।
‘আমরা আসল জিনিস ট্রাই করব কখন?’ প্রশ্ন করল, মুখের চেহারা উত্তেজনায় লাল টকটকে।
‘আরও প্র্যাকটিস করতে হবে তোমাদের,’ দৃঢ় শোনাল এমার কণ্ঠ। ‘রোজ আধ ঘণ্টা করে অনুশীলন করবে প্রত্যেকে, তারপর সাগরে নামার চিন্তা।’
‘ওহ, না!’ গুঙিয়ে উঠল ডন।
‘কঠিন কাজ নিঃসন্দেহে,’ বলল এমা। ‘তবে একমাত্র কঠোর অনুশীলন করলেই পানিতে নামার সুযোগ পেতে পারো তোমরা।’