‘গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ!’
স্বাধীনতা হারাইয়া আমরা যখন আত্মশক্তিতে অবিশ্বাসী হইয়া পড়িলাম এবং আকাশমুখো হইয়া কোন্ অজানা পাষাণ-দেবতাকে লক্ষ করিয়া কেবলই কান্না জুড়িয়া দিলাম, তখন কবির কণ্ঠে আশার বাণী দৈব-বাণীর মতোই দিকে দিকে বিঘোষিত হইল, ‘গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ’!’ বাস্তবিক আজ আমরা অধীন হইয়াছি বলিয়া চিরকালই যে অধীন হইয়া থাকিব, এরূপ কোনো কথা নাই। কাহাকেও কেহ কখনও চিরদিন অধীন করিয়া রাখিতে পারে নাই, কারণ ইহা প্রকৃতির নিয়ম-বিরুদ্ধ। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া কেহ কখনও জয়ী হইতে পারে না। আজ যাহারা স্বাধীন হইয়া নিজের অধীনতার কথা ভুলিয়া অন্যকেও আবার অধীনতার জাঁতায় পিষ্ট করিতেছে, তাহারাও চিরকাল স্বাধীন ছিল না। শক্তি লাভ করিয়া যাহারা শক্তির এমন অপব্যবহার করিতেছে, কে জানে প্রকৃতি তাহাদের এই অপরাধের পরিণাম কত নির্মম হইয়া লিখিয়া রাখিয়াছে! ‘এয়সা দিন নেহি রহেগা’, চিরদিন কারুর সমান যায় না। আজ যে কপর্দকহীন ফকির, কাল তাহার পক্ষে বাদশাহ্ হওয়া কিছুই বিচিত্র নয়। অত্যাচারীকে অত্যাচারের প্রতিফল ভোগ করিতেই হইবে। আজ আমি যাহার উপর প্রভুত্ব করিয়া তাহার প্রকৃতি-দত্ত স্বাধীনতা, মনুষ্যত্ব ও সম্মানকে হনন করিতেছি, কাল যে সে-ই আমারই মাথায় পদাঘাত করিবে না, তাহা কে বলিতে পারে? শক্তি সম্পদের ন্যায্য ব্যবহারেই বৃদ্ধি, অন্যায় অপচয়ে তাহার লয়।
অন্যকে কষ্ট দিয়ে তাহার ‘আহা-দিল’ নিতে নাই, বেদনাতুরের আন্তরিক প্রার্থনায় আল্লার আরশ টলিয়া যায়। শক্তির অপব্যবহারের জন্য রোম-সাম্রাজ্য গেল, জার্মানির মতো মহাশক্তিরও পরাজয় হইল। কত উত্থান, কত পতন এই ভারত দেখিয়াছে, দেখিতেছে এবং দেখিবে। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিবেক সর্বদাই মানবের পশুশক্তিকে সতর্ক করিতেছে। বিবেকের ক্ষমতা অসীম। যাহারা পশুশক্তির ব্যবহার করিয়া বাহিরে এত দুর্বার দুর্জয়, অন্তরে তাহারা বিবেকের দংশনে তেমনই ক্ষত-বিক্ষত, অতি দীন। তাহারা তাহাদের অন্তরের নীচতায় নিজেই মরিয়া যাইতেছে, শুধু লোক-লজ্জায় তাহাকে দাম্ভিকতার মুখোশ পরাইয়া রাখিয়াছে। সিংহের চামড়ার মধ্য হইতে লুকানো গর্দভ-মূর্তি বাহির হইয়া পড়িবেই। নীল শৃগালের ধূর্তামি বেশি দিন টিকিবে না। তাই বলিতেছিলাম, বাহিরের স্বাধীনতা গিয়াছে বলিয়া অন্তরের স্বাধীনতাকেও আমরা যেন বিসর্জন না দিই। আজ যখন সমস্ত বিশ্ব মুক্তির জন্য, শৃঙ্খল ছিঁড়িবার জন্য উন্মাদের মতো সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করিতেছে, স্বাধীনতা-যজ্ঞের হোমানলে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা দলে দলে আসিয়া নিজের হৃৎপিণ্ড উপড়াইয়া দিতেছে, তাহাদের মুখে শুধু এক বুলি, ‘মুক্তি-মুক্তি-মুক্তি’। হস্তে তাহাদের মুক্তির নিশান – মুখে তাহাদের মুক্তির বিষাণ, শিয়রে তাহাদের মুক্তির তৃপ্তি-ভরা মহা-গৌরবময় মৃত্যু। – তখনও মুক্তির সেই যুগান্তরের নবযুগেও, আমরা কিনা পলে পলে দাসত্বের, মনুষ্যত্বহীন আত্মসম্মানশূন্য ঘৃণ্য কাপুরুষের মতো অধোদিকেই গড়াইয়া চলিতেছি! এতদূর নীচ হইয়া গিয়াছি আমরা যে, কেহ এই কথা বলিলে উল্টো আবার কোমর বাঁধিয়া তাহার সঙ্গে তর্ক জুড়িয়া দিই। আমাদের এই তর্কের সবচেয়ে সাধারণ সূত্র হইতেছে, দাসত্ব – গোলামি ছাড়িয়া দিলে খাইব কী করিয়া? কী নীচ প্রশ্ন! যেন আমাদের শুধু কুকুর-বিড়ালের মতো উদর-পূর্তির জন্যই জন্ম! এমন নীচ অন্তঃকরণ লইয়া যাহারা বেহায়ার মতো বেহুদা তর্ক করিতে আসে, তাহাদের উপর খোদার বজ্র কেন যে ভাঙিয়া পড়ে না, তাহা বলিতে পারি না! আজ সারা বিশ্ব যখন ও-রকম মরার মতো বাঁচিয়া থাকার চেয়ে মরিয়া মুক্তিলাভের জন্য প্রাণ লইয়া ছিনিমিনি খেলিতেছে, তখনও আমাদের এইরকম হৃদয়হীনতার, গোলামি মনের পরিচয় দিতে এতটুকু লজ্জা হয় না! বড়োই দুঃখে তাই বলিতে হয়, ‘এ অভাগা দেশের বুকে বজ্র হানো প্রভু, যদ্দিনে না ভাঙছে মোহ-ভার।’ আমাদের এই মোহ-ভার ভাঙিবে কে? এ-শৃঙ্খল মোচন করিবে কে? আছে, উত্তর আছে, এবং তাহা, ‘আমরাই!’ নির্বোধ মেষযূথের মতো এক স্থানে জড়ো হইয়া শুধু মাথাটা লুকাইয়া থাকিলে নেকড়ে বাঘের হিংস্র আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইব না, তাহা হইলে আমাদের ওই নেকড়ে বাঘের মতো করিয়া কান ধরিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া হত্যা করিবে।
দেশের পক্ষ হইতে আহ্বান আসিতেছে, কিন্তু কাজে আমরা কেহই সাড়া দিতে পারিতেছি না। অনেকে আবার বলেন যে, অন্যে কে কী করিতেছে আগে দেখাও, তার পর আমাদিগকে বলিয়ো। এই প্রশ্ন ফাঁকিবাজের প্রশ্ন। দেশমাতা সকলকে আহ্বান করিয়াছেন, যাহার বিবেক আছে, কর্তব্য জ্ঞান আছে, মনুষ্যত্ব আছে, সে-ই বুক বাড়াইয়া আগাইয়া যাইবে। তোমার কী নিজের ব্যক্তিত্ব নাই যে, কে কী করিল আগে দেখিয়া তবে তুমি তার পিছু পিছু পোঁ ধরিবে? নেতা কে? বিবেকই তো তোমার নেতা, কর্তব্য-জ্ঞানই তো তোমার নেতা! দেশনায়ক যাঁহারা, তাঁহারা তো তোমার নেতা, তোমার বিবেকেরই প্রতিধ্বনি করেন। কর্তব্য-জ্ঞানের কাছে, ত্যাগের কাছে সম্ভব-অসম্ভব কিছুই নাই। সুতরাং ‘উহা সম্ভব, ইহা অসম্ভব’ বলিয়া, ছেলেমানুষি করাও আর এক বোকামি। যাহা সম্ভব তাহা করিবার জন্য তোমার ডাক পড়িত কী জন্য? অসম্ভব বলিয়াই তো দেশ তোমার বলিদান চাহিয়াছে। স্বার্থের গণ্ডি না পারাইয়া ভিক্ষা দেওয়া যায়, ত্যাগ বা বলিদান দেওয়া যায় না। তোমার যতটুকু শক্তি আছে প্রয়োগ করো, দেশের কাছে, খোদার কাছে অসংকোচে দাঁড়াইবার পাথেয় সঞ্চয় করো, তোমার বিবেকের কাছে তুমি অগাধ শান্তি পাইবে! ইহাই তোমার পুরস্কার। অন্যে জাহান্নামে যাইবে বলিয়া কী তুমিও তার পিছু-পিছু সেখানে যাইবে?
আজ আমাদের শুধু ক্লান্তি, – শুধু শ্রান্তি কেন? ‘এমন করে কদ্দিন খাবি’ না গোলেমালে যদ্দিন যায় করে আর কতদিন চলিবে? আমরা আমাদের দেশের জন্য, মুক্তির জন্য কি দুঃখদৈন্যকে বরণ করিয়া লইতে পারিব না? ত্যাগ, বিসর্জন, উৎসর্গ, বলিদান ছাড়া কি কখনও কোনো দেশ উদ্ধার হইয়াছে, না হইতে পারে? স্বার্থত্যাগ করিতে হইলে দুঃখকষ্ট সহ্য করিতেই হইবে, ত্যাগ কখনও আরাম-কেদারায় শুইয়া হয় না। কিন্তু ওই দুঃখকষ্ট, ইহা তো বাহিরে; একটা সত্য মহান পবিত্র কার্য করিতে গেলে যে আত্মতৃপ্তি অনুভব করা যায়, অন্তরে যে-ভাস্বর স্নিগ্ধ দীপ্তির উদয় হইয়া সকল দেহমন আলোয় আলোকময় করিয়া দেয়, সারা দেশের ভাইদের বোনদের যে প্রশংসাভরা স্নেহকল্যাণময় অশ্রুকাতর দৃষ্টি ও সারা মুক্ত বিশ্বে সাবাসি পাওয়া যায়, তাহা এই বাহিরের দুঃখকষ্টকে কী ঢাকিয়া দিতে পারে না? কার মূল্য বেশি? বাহিরের এই নগণ্য দুঃখকষ্টের, না অন্তরের স্বর্গীয় তৃপ্তির? তুমি কী চাও? – কুকুর-বিড়ালের মতো ঘৃণ্য-মরা মরিতে, না মানুষের মতো মরিয়া অমর হইতে? তুমি কী চাও? – শৃঙ্খল, না স্বাধীনতা? তুমি কী চাও? – তোমাকে লোকে মানুষের মতো ভক্তিশ্রদ্ধা করুক, না পা-চাটা কুকুরের মতো মুখে লাথি মারুক? তুমি কী চাও? – উষ্ণীষ-মস্তকে উন্নত-শীর্ষ হইয়া বুক ফুলাইয়া দাঁড়াইয়া পুরুষের মতো গৌরব-দৃষ্টিতে অসংকোচে তাকাইতে, না নাঙ্গা শিরে প্রভুর শ্রীপাদপদ্ম মস্তকে ধারণ করিয়া কুব্জপৃষ্ঠে গোলামের মতো অবনত হইয়া হুজুরির মতলবে শরমে চক্ষু নত করিয়া থাকিতে? যদি এই শেষের দিকটাই তোমার লক্ষ্য হয়, তবে তুমি জাহান্নামে যাও! তোমার সারমেয়গোষ্ঠী লইয়া খাও দাও আর পা চাটো! আর যাহারা ত্যাগকে বরণ করিয়া লইতে পারিবে, যাহার ঘরে মুখ মলিন দেখিয়া গলিয়া যাইবে না, যাহাদের জান দিবার মতো গোর্দা আছে, আঘাত সহিবার মতো বুকের পাটা আছে, তাহারা বাহির হইয়া আইস! দেশমাতার দক্ষিণ হস্ত, আর কল্যাণ-মন্ত্রপূত অশ্রু-পুষ্প তোমাদেরই মাথায় ঝরিয়া পড়িবার জন্য উন্মুখ হইয়া রহিয়াছে। আমরা চাই লাঞ্ছনার চন্দনে আমাদের উলঙ্গ-অঙ্গ অনুলিপ্ত করিতে। কল্যাণের মৃত্যুঞ্জয় কবচ আমাদের বাহুতে উষ্ণীষে বাঁধা, ভয় কী? মনে পড়ে, সেদিন দেশমাতার আহ্বান নিয়া মাতা সরলাদেবী বাঙালার কন্যারূপে পাঞ্জাব হইতে সাহায্য চাহিতে আসিয়াছিলেন। কে কে সাড়া দিলে এ-জাগ্রত মহা-আহ্বানে? এমন ডাকেও যদি সাড়া না দাও,তবে জানিব তোমরা মরিয়াছ। বৃথাই এ-আহ্বান এ-ক্রন্দন তোমার, মা! যদি পার, সঞ্জীবনী সুধা লইয়া আইসো তোমার এ মরা সন্তান বাঁচাইতে। যদি তাহা না পার, তবে ইহাদিগকে ধুতুরার বীজ খাওয়াইয়া পাগলা করিয়া দাও। ইহাতে তাহারা ‘মানুষের মতো’ জাগিবে না, কিন্তু তবু জাগিবে! জানি, কুপুত্র অনেকে হয়, কুমাতা কখনও নয়, কিন্তু আর এমন করিয়া স্নেহের প্রশ্রয় দিলে চলিবে না, মা, এখন তোমাকে কুমাতা হইতে হইবে, তোমাকেই আঘাত দিয়া আমাদের জাগাইতে হইবে। আমরা পরের আঘাত চোখ বুজিয়া সহ্য করি কিন্তু স্বজনের আঘাত সইতে পারি না। তাই আর শুধু ডাকাডাকিতে কোনো ফল হইবে না। তোমার রুদ্রমূর্তি দিকে দিকে প্রকটিত হউক। যদিই এই রুদ্র ভীষণতার মধ্যে রণ-চণ্ডীর মহামারির মধ্যে, আমাদের মনুষ্যত্ব জাগে, যদি আঘাত খাইয়া খাইয়া অপমানিত হইয়া আবার আমরা জাগি, তাই আবার বলিতেছি, তোমরাও সাথে সাথে বলো,
গেছে দেশ দুঃখ নাই,
আবার তোরা মানুষ হ!