গুরুবিদায়
বৈকালিক প্রসাধনের পর মানিনী দেবী একটি বড় আরশির সামনে দাঁড়াইয়া নিজের অঙ্গশোভা নিরীক্ষণ করিতেছেন, এমন সময় একজোড়া গোঁফের প্রতিবিম্ব তাঁহার কাঁধের উপর ফুটিয়া উঠিল।
উক্ত গোঁফের মালিক তাঁহার স্বামী রায় বংশলোচন ব্যানার্জি বাহাদুর জমিদার অ্যাণ্ড অনরারি ম্যাজিস্ট্রেট বেলিয়াঘাটা। মানিনী একটি ছোট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া ঘাড় না ফিরাইয়াই বলিলেন—’কি সুখেই যে মোটা হচ্ছি!’
বংশলোচন রসিকতার চেষ্টা করিয়া বলিলেন—’কেন, সুখের কমটাই বা কি, অমন যার স্বামী!’
মানিনী যদি সামান্য পাড়াগেঁয়ে স্ত্রীলোক হইতেন তবে হয়তো বলিয়া ফেলিতেন—পোড়াকপাল অমন স্বামীর। কিন্তু তাঁহার বাকসংযম অভ্যাস আছে, সেজন্য বলিলেন—’স্বামী তো খুবই ভাল, আমিই যে মন্দ।’
কথার ধারা গহন অরণ্যের দিকে মোড় ফিরিতেছে দেখিয়া বংশলোচন নিপুণ সারথির ন্যায় বলিলেন—’কি যে বল তার ঠিক নেই। কিসের অভাব তোমার? হুকুম করলেই তো হয়।’
মানিনী এইবার স্বামীর দিকে চাহিয়া বলিলেন—’বয়েস তো বেড়েই চলেছে, ধম্মকম্ম কিছুই হল না।’
বংশলোচন বলিলেন—’কেন, এই যে আর বৎসর গয়া কাশী বৃন্দাবন আগ্রা দিল্লী করে এলে?’
‘ভারী তো, তার ফল আর কদিন টিকবে। ইচ্ছে হয় মন্তর—টন্তর নি।’
‘তা বেশ তো, সে তো খুব ভাল কথা। আমি চাটুজ্যে মশায়ের সঙ্গে এখনই পরামর্শ করছি।’
কিন্তু বংশলোচনের মন বলিতে লাগিল যে কথাটি মোটেই ভাল নয়। ইঁহাদের বাইশ বৎসর ব্যাপী দাম্পত্যজীবনে অসংখ্যবার প্রীতির শৃঙ্খল মেরামত করিতে হইয়াছে, কিন্তু বংশলোচনের প্রাধান্য এ পর্যন্ত মোটামুটি বজায় আছে। পত্নীর গুরুভক্তি যদি প্রবলা হইয়া ওঠে তবে স্বামীর আসন কোথায় থাকিবে? গুরু যদি কেবল অখণ্ডমণ্ডলাকারের পদটি দেখাইয়া দিয়া ক্ষান্ত হন তবে কোনও আপত্তির কারণ থাকে না। কিন্তু গুরু যদি নিজেই ঐ পদটি দখল করিয়া বসেন তবেই চিন্তার কথা। মুশকিল এই যে, ধর্মের ব্যাপারে ঈর্ষা অভিমান শোভা পায় না। তবে এক হিসাবে তাঁহার পত্নীর এই নূতন শখটি নিরাপদ। মানিনী দেবী অত্যন্ত একগুঁয়ে মহিলা। যদি দেশের বর্তমান হুজুগের বশে তাঁহার পিকেটিং করিবার বা প্রভাতফেরি গাহিবার ঝোঁক হইত তবে বংশলোচনের মান—ইজ্জত অনারারি হাকিমি কোথায় থাকিত? তাঁহার মুরুব্বী ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবই বা কি বলিতেন? মোটের উপর দেশভক্তির চেয়ে গুরুভক্তিতে ঝঞ্ঝাট ঢের কম।
বংশলোচন বৈঠকখানায় আসিয়া তাঁহার অন্তরঙ্গগণের নিকট পত্নীর অভিলাষ ব্যক্ত করিলেন। বৃদ্ধ কেদার চাটুজ্যে মহাশয় বলিলেন—’বউমার সংকল্প অত্যন্ত সাধু, তবে একটি সদ—গুরু দরকার। তোমাদের পৈতৃক গুরুর কুলে কেউ বেঁচে নেই?’
বংশলোচন বলিলেন—’শুনেছি একটি গুরুপুত্তুর আছেন, তিনি থিয়েটারে আবদালা সাজেন।’
‘রাধামাধব! আচ্ছা, আমাদের গুরুপুত্তুরটিকে একবার দেখলে পার। সেকেলে মানুষ, শাস্ত্রটাস্ত্র জানেন না বটে, কিন্তু পৈতৃক ব্যবসাটি বজায় রেখেছেন।’
উকিল বিনোদবাবু বলিলেন—’চাটুজ্যেমশায়, আপনি এখনও সত্যযুগে আছেন। আজকাল আর সেকেলে গুরুর চলন নেই যিনি বছরে বার—দুই শিষ্যবাড়ি পায়ের ধুলো দেন আর পাঁচ সের চাল, পাঁচ পো চিনি, গোটা দশেক টাকা, লাট্টু মার্কা থান ধুতিতে বেঁধে প্রস্থান করেন। এখন এমন গুরু চাই চেহারা দেখলে মন খুশী হয়, বচন শুনলে প্রাণ আনচান করে।’
বংশলোচনের ভাগনে উদয় বলিল—’মামাবাবু যদি মামীকে মুরগি ধরাতেন তবে আর এসব খেয়াল হত না। তাইজন্যেই তো আমার শাশুড়ী মন্তর নিতে পারছেন না।’
চাটুজ্যে বলিলেন—’ছাই জানিস উদো। উপেন পালের নাম শুনেছিস? সেবার মধুপুরে গিয়ে দেখলুম—প্রকাণ্ড বাড়ি, দশ বিঘে বাগান, দশটা গাই, এক পাল মুরগি। রাজর্ষির চালে থাকেন, ঘরের তরি—তরকারি, ঘরের দুধ, ঘরের মুরগি। সস্ত্রীক ধর্ম আচরণ করেন, সঙ্গে চার জন গুরু হামেহাল হাজির, নিজের দুজন, স্ত্রীর দুজন।’
উপযুক্ত গুরু কে আছেন এই লইয়া অনেকক্ষণ আলোচনা হইল। পর্বতবাসী সন্ন্যাসী, আশ্রমবাসী মহারাজ, স্বচ্ছন্দচারী লেংটাবাবা, বৈজ্ঞানিক মহাপুরুষ, উদারপন্থী আধুনিক সাধু—অনেকের নাম উঠিল। কিন্তু মুশকিল এই বংশলোচন যাঁহাকে উপযুক্ত অর্থাৎ নিরাপদ মনে করেন, গৃহিণীর হয়তো তাঁহাকে পছন্দ হইবে না।
এমন সময় বংশলোচনের শালা নগেন দোতলা হইতে নামিয়া আসিয়া বলিল—’আপনারা আর মাথা ঘামাবেন না, দিদি গুরু ঠিক করে ফেলেছেন।’
বংশলোচন ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন—’কে?’
‘বালিগঞ্জের খল্বিদং স্বামী। অ্যাসা সুন্দর গাইতে পারেন! চেহারাটিও তেমনি, বয়সে এই জামাইবাবুর চেয়ে কিছু কম হবে। শুনেছি ছেলেবেলা থেকেই একটা উদাস উদাস ভাব ছিল, টেনিস খেলতে খেলতে কতবার অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। সংসারে যদ্দিন ছিলেন, নাম ছিল পরান সরকার। তারপর স্ত্রীবিয়োগ হতেই স্বামী হয়েছেন। এখন তার প্রায় দু—শ শিষ্য, চার—শ শিষ্যা।’
‘একবারে সব ঠিক হয়ে গেছে নাকি?’
‘উহুঁ, দিদি চালাক আছেন। কাল স্বামীজীকে নিয়ে আসছি, এখানে হপ্তা—খানেক জাঁকড়ে থাকবেন, যাকে বলে প্রোবেশন। তারপর দিদির যদি ভক্তিটক্তি হয় তবে মন্তর নেবেন।’
চাটুজ্যে মহাশয় বলিলেন—’অতি উত্তম ব্যবস্থা। গুরুটির সন্ধান দিলে কে?’
নগেন বলিল—’আমিই দিয়েছি। আমার বন্ধুদের মহলে ওর খুব খ্যাতি। আপনারাও দেখলে মোহিত হয়ে যাবেন।’
পরদিন খল্বিদং স্বামীর শুভাগমন হইল, সঙ্গে কেবল একটি কমণ্ড৯লু আর একটি বড় সুটকেশ। নগেন মিথ্যা বলে নাই, টকটকে গৌরবর্ণ, চাঁচর ঝাঁকড়া চুল, মধুর কণ্ঠস্বর, চোখে একটা অপূর্ব প্রতিভান্বিত ঢুলুঢুলু ভাব। ছ—শ শিষ্য হওয়া কিছুই বিচিত্র নয়।
মানিনী দেবী প্রত্যহ শুদ্ধাচারে ভাবী গুরুদেবের সেবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। স্বামীজীর নিত্যকর্মপদ্ধতি একেবারে ধরাবাঁধা। সকালবেলা অনুপানসহ তিন পাথরবাটি চা, দ্বিপ্রহরে পবিত্র অন্ন—ব্যঞ্জন, তাহার পর ঘন্টা তিন—চার যোগনিদ্রা, বিকালে নানাপ্রকার ফলমূল মিষ্টান্ন, পুনর্বার চা, সন্ধ্যায় মধুর কণ্ঠে ধর্মব্যাখ্যা, সঙ্গীত ও ঘুঙুর পরিয়া ভাবনৃত্য, রাত্রে সাত্ত্বিক লুচি পোলাও কালিয়া।
মানিনীর অন্তরে একটা সাড়া পড়িয়াছে। নভেল পড়া, লেস বোনা, ছাঁটা পশমের আসন তৈয়ারী প্রভৃতি সাংসারিক কার্যে আর তাঁহার মন পাই। প্রথম দিনেই তিনি নিজের হাতে স্বামীজীর উচ্ছ্বিষ্ট পরিষ্কার করিলেন। দ্বিতীয় দিনে পাতে প্রসাদ পাইলেন। তৃতীয় দিনে বংশলোচন রোমাঞ্চিত হইয়া দেখিলেন—খল্বিদং—এর চর্বিত আকের ছিবড়া মানিনী পরম ভক্তি সহকারে চুষিতেছেন। বংশলোচন বার বার স্বামীজীর বাণী স্মরণ করিতে লাগিলেন—সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম, এ সমস্তই ব্রহ্ম—কিন্তু মন প্রবোধ মানিল না। ব্রহ্ম নিখিল চরাচরে থাকিতে পারেন কিন্তু আকের ছিবড়ায় থাকিবেন কোন দুঃখে? একথা মনে করিতেই চিত্ত বিদ্রোহী হয়, পিত্ত চটিয়া ওঠে। ছি ছি বলিলে যথেষ্ট বলা হয় না, তোবা তোবা বলিতে ইচ্ছা করে।
চাটুজ্যে মহাশয় শুনিয়া বলিলেন—’তাইতো বেশী বাড়াবাড়ি হচ্ছে। এই নগেনটাই যত নষ্টের গোড়া। দেশী ঠাকুরমশায় তোর দিদির মনে না ধরে তো একটা জটাধারী গাঁজাখোর আনলেই তো পারতিস।’
নগেন বলিল—’বা রে, আমি কেমন ক’রে জানব যে দিদির অত ভক্তি হবে?’
বংশলোচন কাতরকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন—’এখন কি করা যায়?’
বিনোদ বলিলেন—’একটা ভৈরবী—টৈরবী ধ’রে এনে তুমিও সাধনা শুরু কর, বিষে বিষক্ষয় হয়ে যাক। আর যদি সাহস থাকে তবে গিন্নীকে মনের কথা খুলে বল, খল্বিদংকে অর্ধচন্দ্রং দাও।’
নগেন বলিল—’তা হলে দিদি ভয়ঙ্কর চটবে।’
কথাটা ভয়ঙ্কর সত্য, পত্নীর ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া সহজ কথা নয়। বংশলোচন আকুল চিন্তাসাগরে হাবুডুবু খাইতে লাগিলেন। এমন যে বিচক্ষণ চাটুজ্যে মহাশয় আর তীক্ষ্নবুদ্ধি বিনোদ উকিল, ইঁহারাও প্রতিকারের কোনও সুসাধ্য উপায় খুঁজিয়া পাইতেছেন না। হায় হায়, কে তাঁহাকে রক্ষা করিবে? ভগবানের উপর নির্ভর করিয়া হাল ছাড়িয়া বসিয়া থাকা ভিন্ন গত্যন্তর নাই।
মানিনী মনস্থির করিয়া ফেলিয়াছেন, খল্বিদংকেই গুরুত্বে বরণ করিবেন। কাল সকালে দীক্ষা। বাড়ির পূর্বদিক সংলগ্ন যে মাঠটি আছে তাহাতে একটি বেদী রচনা করিয়া চারিদিকে ফুলের টব দিয়া সাজানো হইয়াছে। আজ বৈকালে খল্বিদং নিজে ঘুরিয়া ঘুরিয়া সমস্ত আয়োজন তদারক করিতেছেন। বংশলোচন, চাটুজ্যে, বিনোদ ইত্যাদি পিছনে পিছনে আছেন, মানিনীও একটু তফাতে থাকিয়া সমস্ত দেখিতেছেন।
খল্বিদং গুনগুন করিয়া গান করিতে করিতে পায়চারি করিতেছেন এমন সময় তাঁহার নজরে পড়িল—মাঠের শেষ দিকে একটি বৃহদাকার ছাগল তাঁহাকে সতৃষ্ণনয়নে নিরীক্ষণ করিতেছে। এই ছাগলটি লম্বকর্ণ নামে খ্যাত। সে যখন ছোট ছিল তখন বংশলোচন তাহাকে বেওয়ারিস অবস্থায় কুড়াইয়া পাইয়া বাড়িতে আনেন। সেই অবধি সে পরিবারভুক্ত হইয়া গিয়াছে এবং মানিনীর অত্যধিক আদর পাইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে। এখন তাহার নবীন যৌবন। লম্বকর্ণ যদি মনুষ্য হইত তবে এ বয়সে তাহাকে তরুণ বলা চলিত। কিন্তু সে অজত্বের অভিশাপ লইয়া জন্মিয়াছে, তাই লোকে তাহাকে বলে বোকাপাঁঠা।
খল্বিদং স্বামী লম্বকর্ণকে দেখিয়া প্রসন্নবদনে বলিলেন—’শ্রীভগবানের কি অপূর্ব সৃষ্টি এই জীবটি। বেঁচে থাকার যে আনন্দ, তা এতে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। প্রাণশক্তি যেন সর্বাঙ্গে উথলে উঠছে।’
স্বামীজী মাঠের নরম ঘাসের উপর বসিয়া পড়িলেন এবং এক মুঠা ঘাস ছিঁড়িয়া লইয়া ডাকিলেন—’আ—তু তু তু।’
লম্বকর্ণ আসিল না, স্বামীজীর দিকে চাহিয়া আস্তে আস্তে পিছু হাটিতে লাগিল।
স্বামীজী বলিলেন—’আহা অবোধ জীব, কিঞ্চিৎ ভীত হয়েছে, আমাকে এখনও চেনে না কিনা। তোমরা ওকে তাড়া দিও না, জীবকে আকর্ষণ করার উপায় হচ্ছে অসীম করুণা, অগাধ তিতিক্ষা। আ—তু তু তু তু।’
লম্বকর্ণ ভীত হইবার ছেলে নয়। আসল কথা প্রথম দর্শনেই খল্বিদং—এর উপর তাহার একটা অহৈতুকী অভক্তি জন্মিয়াছে। আজ তাঁহার মুখের মধুর হাসিটুকু দেখিয়া সেই অহৈতুকী অভক্তি অকস্মাৎ একটা বেয়াড়া বদখেয়ালে পরিণত হইল। লোকে যাহাই বলুক, লম্বকর্ণ মোটেই বোকা নয়। ছাগল হইলে কি হয়, তাহার একটা সহজাত বৈজ্ঞানিক প্রতিভা আছে। লম্বকর্ণ কলেজে পড়ে নাই, পাস করে নাই, তথাপি জানা আছে যে বেগ আহরণ করিতে হইলে যথাসম্ভব দূর হইতে ধাবমান হওয়াই যুক্তিসংগত। আরও জানা আছে যে তাহার দেহে দেড় মণ মাংসকে যদি তাহার বেগের অঙ্ক দিয়া গুণ করা হয় তবে যে বৈজ্ঞানিক রাশি উৎপন্ন হয় তাহার ধাককা সামলানো মানুষের অসাধ্য।
কিছুদূর পিছু হটিয়া লম্বকর্ণ এক মুহূর্তে স্থির হইয়া দাঁড়াইল। তাহার পর ঘাড় নীচু করিয়া শিং বাঁকাইয়া স্বামীজীর নধর উদর নিশানা করিয়া নক্ষত্রবেগে সম্মুখে ছুটিল।
স্বামীজীর মুখে প্রসন্ন হাসি তখনও লাগিয়া আছে, কিন্তু আর সকলে ব্যাপারটি বুঝিয়া লম্বকর্ণকে নিরস্ত করিবার জন্য ত্রস্ত চীৎকার করিয়া উঠিল। কিন্তু কার সাধ্য রোধে তার গতি। নিমেষের মধ্যে লম্বকর্ণের প্রচণ্ড গুঁতা ধাঁই করিয়া লক্ষ্য স্থানে পৌঁছিল, খল্বিদং একবার মাত্র বাবা গো বলিয়া ডিগবাজি খাইয়া ধরাশায়ী হইলেন।
ডাক্তারবাবু বলিলেন—’শুধু বোরিক কমপ্রেস। পেট ফুটো হয়নি, চোটও বেশী লাগেনি, তবে শক—টা খুব খেয়েছেন। একটু পরেই উঠে বসতে পারবেন, তখন আবার দু—ড্রাম ব্রান্ডি। ব্যথাটা সারতে দিন—পনর লাগবে।’
ডাক্তার অত্যুক্তি করেন নাই। কিছুক্ষণ পরেই খল্বিদং চাঙ্গা হইয়া উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন—’ছাগলটা গেল কোথায়?’
বিনোদবাবু বলিলেন—’সেটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে, আপনার কোনও ভয় নেই।’
স্বামীজী বলিলেন—’ভয় আমি কোনও শালায় করি না। কিন্তু ছাগলটাকে এক্ষুনি মেরে তাড়াতে হবে, ওঠা মূর্তিমান পাপ।’
বিনোদবাবু বলিলেন—’বলেন কি মশায়, আপনারা হলেন করুণার অবতার, পাপীকে যদি ক্ষমা না করেন তবে বেচারা দাঁড়ায় কোথা? আর লম্বকর্ণের স্বভাবটা তো হিংস্র নয়, আজ বোধ হয় হঠাৎ কিরকম ব্লাড—প্রেশার বেড়ে গিয়ে মাথা গরম হয়ে—কি বলেন ডাক্তারবাবু?’
উদয় বলিল—’বউ আজ ওকে একছড়া গাঁদাফুলের মালা খাইয়েছে, তাইতো বোধ হয়।’
খল্বিদং ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন—’ও—সব আমি শুনতে চাই না। এ বাড়িতে দুজনের স্থান নেই, হয় আমি নয় ঐ ব্যাটা।’
বংশলোচন দুরুদুরু বক্ষে পত্নীর দিকে চাহিয়া বলিলেন—’কি বল? ছাগলটাকে তা হলে বিদেয় করা যাক?’
মানিনী সবেগে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন—’বাপরে, সে আমি পারব না।’ এই কথা বলিয়াই তিনি সটান দোতলায় গিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বংশলোচনের এক জোড়া ছেঁড়া মোজা মেরামত করিতে লাগিয়া গেলেন।
খল্বিদং বলিলেন—’তা হলে আমিই বিদায় হই।’
চাটুজ্যে মহাশয় স্বামীজীর পিঠে হাত বুলাইয়া বলিলেন—’যা বলেছ দাদা। এই নির্বান্ধব পুরে দুশমনের হাতে কেন প্রাণটা খোয়াবে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও, বেঁচে থাকলে অনেক শিষ্য জুটবে। এস, আমি একটা ট্যাকসি ডেকে দিচ্ছি।’
বংশলোচন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া ভাবিতে লাগিলেন—স্ত্রীচরিত্র কি অদ্ভুত জিনিস।
১৩৩৭ (১৯৩০)