[১৯০০ খ্রীঃ ২৯ মে সান ফ্রান্সিস্কোতে প্রদত্ত বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত অনুলিপি]
অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ আপনি আমাকে কর্মের উপদেশ দিতেছেন, অথচ ব্রহ্মজ্ঞানকে জীবনের উচ্চতম অবস্থা বলিয়া প্রশংসা করিয়াছেন। হে কৃষ্ণ, যদি জ্ঞানকে কর্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করেন, তবে কর্মের উপদেশ দিতেছেন কেন?২২
শ্রীকৃষ্ণঃ অতি প্রাচীনকাল হইতে দুইটি সাধনপথ প্রচলিত আছে। জ্ঞানানুরাগী দার্শনিকগণ জ্ঞানযোগের এবং নিষ্কামকর্মিগণ কর্মযোগের কথা বলেন। কিন্তু কর্ম ত্যাগ করিয়া শান্তি লাভ করিতে পারে না। এ-জীবনে কর্ম বন্ধ করিয়া থাকা মুহূর্তমাত্র সম্ভব নয়। প্রকৃতির গুণগুলিই মানুষকে কর্ম করিতে বাধ্য করে। যে ব্যক্তি বাহ্য কর্ম বন্ধ করিয়া মনে মনে কর্মের কথা চিন্তা করে, সে কিছুই লাভ করিতে পারে না। সে মিথ্যাচারী হইয়া যায়। কিন্তু যিনি মনের শক্তি দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে ধীরে ধীরে বশীভূত করিয়া কর্মে নিযুক্ত করেন, তিনি পূর্বোক্ত ব্যক্তি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অতএব তুমি কর্ম কর।২৩
‘যদি তুমি এ রহস্য বুঝিয়া থাক যে, তোমার কোন কর্তব্য নাই—তুমি মুক্ত, তথাপি অপরের কল্যাণের জন্য তোমাকে কর্ম করিতে হইবে। কারণ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ যাহা আচরণ করেন, সাধারণ লোকে তাহাই অনুসরণ করে।’২৪
পরা শান্তির অধিকারী মুক্ত মহাপুরুষ যদি কর্মত্যাগ করেন, তবে যাহারা সেই জ্ঞান ও শান্তি লাভ করে নাই, তাহারা মহাপুরুষকে অনুকরণ করিবার চেষ্টা করিবে এবং তাহাতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হইবে।
‘হে পার্থ, ত্রিভুবনে আমার অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্য কিছুই নাই, তথাপি আমি সর্বদা কর্মে ব্যাপৃত আছি। যদি আমি মুহূর্তের জন্য কর্ম না করি, তবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হইয়া যাইবে।’২৫
‘অজ্ঞ ব্যক্তিরা ফলাকাঙ্ক্ষী হইয়া যেরূপ কর্ম করে, জ্ঞানিগণকে অনাসক্তভাবে এবং কোন ফলের আকাঙ্ক্ষা না করিয়া সেইরূপ কর্ম করিতে হইবে।’২৬
আপনি যদি জ্ঞানের অধিকারী হন, তবু অজ্ঞান ব্যক্তিদের বালসুলভ বিশ্বাসকে বিভ্রান্ত করিবেন না। পরন্তু তাহাদের স্তরে নামিয়া আসিয়া তাহাদিগকে ক্রমশঃ উন্নত করিবার চেষ্টা করুন। ইহা একটি অতিশয় শক্তিশালী ভাব, এবং ভারতে ইহাই আদর্শ হইয়া গিয়াছে। তাই দেখা যায়, ভারতবর্ষে জ্ঞানী মহাপুরুষগণ মন্দিরে যান, প্রতিমাপূজাও করেন—ইহা কপটতা নয়।
গীতার পরবর্তী অধ্যায়ে পড়ি, শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেনঃ যাঁহার ভক্তিপূর্বক অন্যান্য দেবতার পূজা করেন, তাঁহারা বস্তুতঃ আমারই পূজা করেন।২৭ এই ভাবে মানুষ সাক্ষাৎ ভগবানেরই পূজা করিতেছে। ভগবানকে ভুল নামে ডাকিলে কি তিনি ক্রুদ্ধ হইবেন? যদি ক্রুদ্ধ হন, তবে তিনি ভগবান্ নহেন। এ কথা কি বুঝিতে পার না, মানুষের হৃদয়ে যাহা আছে, তাহাই ভগবান্?—যদিও ভক্ত শিলাখণ্ড পূজা করিতেছে, তাহাতে কি আসে যায়?
ধর্ম কতকগুলি মতবাদের সমষ্টি—এই ধারণা হইতে যদি আমরা একবার মুক্ত হইতে পারি, তবেই বিষয়টি ভাল করিয়া বুঝিতে পারিব। ধর্মের একটি ধারণাঃ আাদি মানব আদম জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাইয়াছিলেন বলিয়াই পৃথিবীর সৃষ্টি—আর পালাইবার পথ নাই। যীশু খ্রীষ্টে বিশ্বাস করুন—অর্থাৎ ব্যক্তিবিশেষের মৃত্যুতে বিশ্বাস করুন! কিন্তু ভারতে ধর্মের ধারণা অন্যরূপ। সেখানে ধর্ম মানে অনুভূতি, উপলব্ধি; অন্য কিছু নয়। চার ঘোড়ার জুড়িগাড়ীতে, বৈদ্যুতিক শকটে অথবা পদব্রজে—কিভাবে লক্ষ্যে পৌঁছিলেন, তাহাতে কিছু আসে যায় না। উদ্দেশ্য এক। খ্রীষ্টানদের পক্ষে সমস্যা—কিভাবে এই ভীষণ ঈশ্বরের ক্রোধ হইতে অব্যাহতি পাওয়া যাইবে। ভারতীয়দের সমস্যা—নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করা এবং নিজেদের হারান আত্মভাবকে ফিরিয়া পাওয়া।
আপনি কি উপলব্ধি করিয়াছেন—আপনি আত্মা? যদি বলেন—‘হাঁ’, তবে ‘আত্মা’ বলিতে আপনি কি বোঝেন? আত্মা কি এই দেহ-নামক মাংসপিণ্ড, অথবা অনাদি অনন্ত চিরশান্ত জ্যোতির্ময় অমৃতত্ব? আপনি শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হইতে পারেন, কিন্তু যতক্ষণ আপনি নিজেকে এই দেহ মনে করিতেছেন, ততক্ষণ আপনি আপনার পায়ের নীচের ঐ ক্ষুদ্র কীটের সমান। এ অপরাধের মার্জনা নাই, আপনার অবস্থা আরও শোচনীয়; কারণ আপনি দর্শনশাস্ত্র সবই জানেন, অথচ দেহবোধ হইতে ঊর্ধ্বে উঠিতে পারিতেছেন না। শরীরই আপনার ভগবান্—ইহাই আপনার পরিচয়! ইহা কি ধর্ম?
আত্মাকে আত্মস্বরূপে উপলব্ধি করাই ধর্ম। আমরা কি করিতেছি? ঠিক ইহার বিপরীত। আত্মাকে জড়বস্তুরূপে অনুভব করিতেছি! অমৃতস্বরূপ ঈশ্বর হইতে আমরা মৃত্যু ও জড়বস্তু নির্মাণ করি, এবং প্রাণহীন জড়বস্তু হইতে চেতন আত্মা ‘সৃষ্টি’ করি!
ঊর্ধ্ববাহু ও হেঁটমুণ্ড হইয়া কঠোর তপস্যা দ্বারা অথবা ত্রিমুণ্ডধারী পাঁচ হাজার দেবতার আরাধনা দ্বারা যদি ব্রহ্মবস্তু উপলব্ধি করা সম্ভব হয়, তবে সানন্দে ঐগুলিকে গ্রহণ করুন। যেভাবেই হউক, আত্মজ্ঞান লাভ করুন। এ বিষয়ে কোন সমালোচনার অধিকার কাহারও নাই। তাই শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেনঃ যদি তোমার সাধন-পদ্ধতি উচ্চতর ও উন্নততর হয় এবং অপরের পদ্ধতি খুব খারাপ বলিয়াই মনে হয়, তথাপি তাহার নিন্দা করিবার কোন অধিকার তোমার নাই।
ধর্ম কতকগুলি অর্থহীন শব্দের সমষ্টি নয়, পরন্তু ধর্মকে ক্রমবিকাশ বলিয়া মনে করিতে হইবে। দুই সহস্র বৎসর পূর্বে এক বিশিষ্ট ব্যক্তির ঈশ্বরদর্শন হইয়াছিল; মুশাও (Moses) দাবাগ্নির মধ্যে ঈশ্বরকে দেখিয়াছিলেন। মুশা ঈশ্বরদর্শন করিয়া যাহা করিয়াছিলেন, তাহাতে কি আপনাদের পরিত্রাণ হইয়াছে? অপরের ঈশ্বরদর্শনের কথা আপনাদের মধ্যে প্রেরণা দিয়া ঈশ্বরদর্শন করিবার জন্য উৎসাহিত করিতে পারে, এতদ্ব্যতীত আর এতটুকু সাহায্য করিতে পারে না। পূর্ববর্তী মহাপুরুষগণের দৃষ্টান্তগুলির ইহাই মূল্য, আর বেশী কিছু নয়। সাধনার পথে এইগুলি নির্দেশক-স্তম্ভ মাত্র। একজন আহার করিলে যেমন অপরের ক্ষুধা দূর হয় না, তেমনি একজনের ঈশ্বরদর্শনে অপরের মুক্তি হয় না। নিজেকেই ঈশ্বরদর্শন করিতে হইবে। তাঁহার একটি শরীরে তিনটি মাথা অথবা ছয়টি দেহে পাঁচটি মাথা—ভগবানের প্রকৃতি সম্বন্ধে এইরূপ অর্থহীন কলহেই এই-সকল লোক প্রবৃত্ত হয়। আপনি কি ঈশ্বরদর্শন করিয়াছেন? না। … এবং লোকে বিশ্বাস করে না যে, তাহারা কখনও ঈশ্বরকে দর্শন করিতে পারে। মর্ত্যের মানুষ আমরা কি নির্বোধ! নিশ্চয়ই, পাগলও বটে!
ভারতবর্ষে এই ঐতিহ্য চলিয়া আসিতেছে—যদি ঈশ্বর থাকেন, তবে তিনি অবশ্যই আপনারও ঈশ্বর, আমারও ঈশ্বর। সূর্য কাহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি? আপনারা বলেন, শ্যাম খুড়ো সকলেরই খুড়ো। যদি ঈশ্বর থাকেন, তবে নিশ্চয় আপনি তাঁহাকে দেখিতে পারেন, নতুবা সেরূপ ঈশ্বরের চিন্তাই করিবেন না।
প্রত্যেকে মনে করেন, তাঁহার পথই শ্রেষ্ঠ পথ। খুব ভাল! কিন্তু মনে রাখিবেন—ইহা আপনার পক্ষেই ভাল হইতে পারে। একই খাদ্য যাহা একজনের পক্ষে দুষ্পাচ্য, অপরের পক্ষে তাহা সুপাচ্য। যেহেতু ইহা আপনার পক্ষে ভাল, অতএব আপনার পদ্ধতিই প্রত্যেকের অবলম্বনীয়—সহসা এরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া বসিবেন না। জ্যাকের কোট সবসময় জন বা মেরীর গায়ে না-ও লাগিতে পারে। যাহাদের শিক্ষা-দীক্ষা নাই, যাহারা চিন্তা করে না—এরূপ নরনারীকে জোর করিয়া এই রকম একটা ধরাবাঁধা ধর্মবিশ্বাসের ভিতর ঢুকাইয়া দেওয়া হয়! স্বাধীনভাবে চিন্তা করুন; বরং নাস্তিক বা জড়বাদী হওয়াও ভাল, তবু বুদ্ধিবৃত্তির ব্যবহার করুন! এ ব্যক্তির পদ্ধতি ভুল—এ-কথা বলিবার অধিকার আপনার আছে? আপনার নিকট ইহা ভ্রান্ত হইতে পারে, কিন্তু ইহার নিন্দা করিবার অধিকার আপনার নাই। অর্থাৎ এই মত অবলম্বন করিলে আপনার অবনতি হইবে; কিন্তু এ-কথা বলা যায় না যে, ঐ ব্যক্তিও অবনত হইবে; তাই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশঃ যদি তুমি জ্ঞানী হও, তবে একজনের দুর্বলতা দেখিয়া তাহাকে মন্দ বলিও না।
যদি পার তাহার স্তরে নামিয়া তাহাকে সাহায্য কর। ক্রমে ক্রমে তাহাকে উন্নত হইতে হইবে। পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে আমি হয়তো তাহার মগজে পাঁচ ঝুড়ি তথ্য সরবরাহ করিতে পারি, কিন্তু তাহাতে তাহার কী ভাল হইবে? পূর্বাপেক্ষা হয়তো তাহার অবস্থা খারাপই হইবে।
কর্মের এই বন্ধন কোথা হইতে আসে? আমরা আত্মাকে কর্মদ্বারা শৃঙ্খলিত করি। আমাদের ভারতীয় মতে সত্তার দুইটি দিক্—একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে আত্মা। প্রকৃতি বলিতে শুধু বহির্জগতের বস্তুসমূহ বোঝায় না; আমাদের শরীর মন বুদ্ধি—এমন কি ‘অহঙ্কার’ পর্যন্ত এই প্রকৃতির অন্তর্গত। অনন্ত জ্যোতির্ময় শাশ্বত আত্মা এই সকলের ঊর্ধ্বে। এই মতে আত্মা প্রকৃতি হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, আত্মা চিরকাল ছিলেন এবং চিরকাল থাকিবেন। … কোন সময়েই আত্মাকে মনবুদ্ধির সহিতও অভিন্নরূপে গণ্য করা যায় না …(দেহের সঙ্গে তো দূরের কথা)।
ইহা স্বতঃসিদ্ধ যে, আমাদের ভুক্ত খাদ্যই চিরকাল মন সৃষ্টি করিতেছে; মন জড়পদার্থ। আত্মার সহিত খাদ্যের কোন সম্পর্ক নাই। খাওয়া বা না খাওয়া, চিন্তা করা বা না করা … তাহাতে আত্মার কিছু আসে যায় না। আত্মা অনন্ত জ্যোতিঃস্বরূপ। এই জ্যোতি চিরকাল সমভাবে থাকে। আলোর সম্মুখে নীল বা সবুজ—যে কাঁচ দিয়াই দেখ না কেন, তাহাতে আলোর কিছু আসে যায় না; মূল আলোর রঙ অপরিবর্তনীয়। মনই বিভিন্ন পরিবর্তন আনে—নানা রঙ দেখায়। আত্মা যখন এই দেহ ত্যাগ করে, তখন এ-সবই টুকরা টুকরা হইয়া যায়।
প্রকৃতিরও প্রকৃত স্বরূপ আত্মা। সৎস্বরূপ আত্মাই জীবাত্মারূপে (আমাদের শরীর-মনের মধ্য দিয়া) চলা ফেরা করে, কথা বলে এবং সব কিছু কর্ম করে। জীবাত্মার শক্তি, মন-বুদ্ধি ও প্রাণই জড়ের দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হইতেছে। যদিও চেতন আত্মা আমাদের চিন্তা, শারীরিক কর্ম ও সব-কিছুর কারণ, যদিও আত্মার জ্যোতি সর্বত্র প্রতিফলিত, তথাপি ভালমন্দ সুখ-দুঃখ শীত-উষ্ণ প্রভৃতি প্রকৃতিগত যাবতীয় দ্বন্দ্ব ও দ্বৈতভাব আত্মাকে স্পর্শ করে না।
‘হে অর্জুন, এই সমস্ত ক্রিয়া প্রকৃতির অন্তর্গত। আমাদের শরীর মনের মধ্য দিয়া প্রকৃতি তাহার নিয়মানুসারে কাজ করিয়া চলিতেছে। আমরা প্রকৃতির সহিত নিজদিগকে অভিন্ন মনে করিয়া বলিতেছি—আমি এই সকল কর্মের কর্তা। এইভাবে আমরা ভ্রান্তির কবলে পড়ি।’২৮
কোন না কোন কিছুর বাধ্য হইয়াই আমরা কর্ম করি। ক্ষুধা বাধ্য করে, তাই আমি খাই। দুঃখভোগ হীনতার দাসত্ব। প্রকৃত ‘আমি’ (আত্মা) চিরদিন মুক্ত। কে তাহাকে কর্মে বাধ্য করিতে পারে? কারণ সুখ-দুঃখের ভোক্তা তো প্রকৃতির অন্তর্গত। যখন আমরা দেহের সহিত নিজেকে অভিন্ন বলিয়া ভাবি, তখনই বলি, ‘আমি অমুক, আমি এই দুঃখভোগ করিতেছি। এইরূপ যত বাজে কথা।’ কিন্তু যিনি সত্যকে জানিয়াছেন, তিনি নিজেকে সব কিছু হইতে পৃথক্ করিয়া রাখেন। তাঁহার শরীর কি করে বা মন কি ভাবে, তাহা তিনি গ্রাহ্য করেন না। কিন্তু মানব-সমাজের এক বিরাট অংশই ভ্রান্তির বশীভূত; যখনই তাহারা কোন ভাল কাজ করে, তখন নিজেদের ইহার কর্তা বলিয়া মনে করে। তাহারা এখনও উচ্চ দার্শনিক তত্ত্ব বুঝিতে পারে না, তাহাদের বিশ্বাস বিচলিত করিও না। মন্দ ছাড়িয়া তাহারা ভাল কাজ করিতেছে; খুব ভাল, তাই করুক! … তাহারা কল্যাণকর্মী। ক্রমশঃ তাহারা বুঝিবে, ইহা অপেক্ষা আরও গৌরব আছে। তাহারা সাক্ষিমাত্র—কাজ স্বতই হইয়া যায়, ক্রমশঃ তাহারা বুঝিবে। যখন অসৎকর্ম একেবারে ত্যাগ করিয়া কেবল সৎকর্ম করিতে থাকিবে, তখনই তাহারা বুঝিতে আরম্ভ করিবে যে, তাহারা প্রকৃতির ঊর্ধ্বে। তাহারা কর্তা নয়, তাহারা কর্ম হইতে পৃথক্, তাহারা সাক্ষিমাত্র। তাহারা শুধু দাঁড়াইয়া দেখে। প্রকৃতি হইতে বিশ্বসংসার উৎপন্ন হইতেছে। তাহারা এ-সকল হইতে উপরত। ‘হে সৌম্য, সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র সৎস্বরূপই ছিলেন আর কিছুই ছিল না। সেই সৎ ঈক্ষণ করিলেন এবং জগতের সৃষ্টি হইল।’২৯ ‘জ্ঞানীও প্রকৃতির দ্বারা চালিত হইয়া কার্য করে। প্রত্যেকেই প্রকৃতির অনুযায়ী কার্য করে। কেহ প্রকৃতিতে অতিক্রম করিতে পারে না।’৩০ অণুও প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করিতে পারে না। কি অন্তর্জগতে, কি বহির্জগতে অণুকেও নিয়ম মানিতেই হইবে। ‘বাহিরের সংযমে কি হইবে?’
জীবনে কোন কিছুর মূল্য কিসের দ্বারা নির্ণীত হয়? ভোগসুখ বা ধনসম্পদের দ্বারা নয়। সব জিনিষ বিশ্লেষণ করুন। দেখিবেন আমাদের শিক্ষার জন্য অভিজ্ঞতা ছাড়া কোন কিছুরই মূল্য নাই। অনেক সময় ভোগসুখ অপেক্ষা দুঃখকষ্টই আমাদের আরও ভাল অভিজ্ঞতা দেয়। অনেক সময় সুখাস্বাদ অপেক্ষা আঘাতগুলিই আমাদের জীবনে মহত্তর শিক্ষা দিয়া থাকে। দুর্ভিক্ষেরও একটা মূল্য আছে।
শ্রীকৃষ্ণের মতে আমরা একেবারে সদ্যোজাত নূতন জীব নই। আমাদের সত্তা পূর্বেও ছিল। আমাদের মনবুদ্ধিও একেবারে নূতন নয়। আধুনিক বিজ্ঞান বলে যে, প্রত্যেকটি শিশু কেবল অতীত মানব-জীবনের অভিজ্ঞতা নয়, তাহার পূর্ববর্তী উদ্ভিদ্-জীবনের অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতিও সঙ্গে লইয়া আসে। তাহার সংস্কারে অতীত অধ্যায়গুলি সব আছে—বর্তমান অধ্যায় আছে, আর আছে সম্মুখে ভবিষ্যতের অনেকগুলি অধ্যায়। প্রত্যেকের জীবনপথ পূর্ব হইতেই পরিকল্পিত, মানচিত্রে আঁকা রহিয়াছে। এই অন্ধকার সত্ত্বেও কোন ঘটনা বা অবস্থার উদ্ভব কারণ ব্যতীত হইতে পারে না। অজ্ঞানই ইহার কারণ। কার্যকারণের অন্তহীন শৃঙ্খলে একটির পর একটি শিকলি বাঁধা রহিয়াছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এইরূপ শৃঙ্খলে আবদ্ধ। কার্য ও কারণের বিশ্বব্যাপী এই শৃঙ্খলের একটি শিকলি আপনি ধরিয়াছেন, আমি আর একটি। ঐ শৃঙ্খলের সেই অংশটুকু আমাদের নিজস্ব প্রকৃতি।
এখন শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেনঃ নিজের প্রকৃতিগত পথে চলিতে চলিতে মরাও ভাল। অপরের পথ অবলম্বন করিতে চেষ্টা করিও না।৩১ এই আমার নিজের পথ এবং তাহাতেই আমি চলিতেছি। আপনি উপরের পথে চলিতেছেন। নিজের পথ ছাড়িয়া আমি ঐ পথে যাইতে সর্বদা প্রলুদ্ধ হইতেছি এবং ভাবিতেছি আপনার সহযাত্রী হইব। যদি আমি ওখানে যাই, তবে আমি ‘ইতো নষ্ট স্ততো ভ্রষ্টঃ’ হইব। এই সন্বন্ধে আমাদের সচেতন হইতে হইবে। এ-সবই ক্রমোন্নতির কথা। উন্নতির পথ ধীরে ধীরে। অপেক্ষা করুন, সব পাইবেন। নতুবা পরের পন্থা অবলম্বন করিলে আধ্যাত্মিক জীবনে বিপদ দেখা দিবে। ধর্ম শিক্ষা দিবার এইটি মৌলিক রহস্য।
মানুষের পরিত্রাণ বলিতে আপনারা কি বোঝেন? সকলকে একই ধর্মমতে বিশ্বাস করিতে হইবে? কখনই তাহা নয়। অবশ্য এমন কতকগুলি উপদেশ বা আদর্শ আছে, যেগুলি সমগ্র মানবসমাজের পক্ষে প্রযোজ্য। যথার্থ আচার্য আপনার প্রকৃতি এবং কোন্ পথ আপনার পক্ষে শ্রেয়, তাহা বলিয়া দিতে পারেন। আপনি হয়তো নিজের প্রকৃত স্বরূপ জানেন না; আপনারা নিজদিগকে যে সাধনপথের অধিকারী বলিয়া ভাবিতেছেন, তাহা ভুলও হইতে পারে। এ বিষয়ে এখনও আপনার চেতনা বিকশিত হয় নাই। কিন্তু প্রকৃত আচার্যকে উহা জানিতে হইবে। আপনাকে একবার দেখিয়াই তিনি বুঝিতে পারিবেন, আপনি কোন্ পথের অধিকারী, এবং তিনিই আপনাকে সেই পথ ধরাইয়া দিবেন। অন্ধকারে পথ খুঁজিয়া এধারে ওধারে নানাপ্রকার চেষ্টা করিলেও আমরা এতটুকু অগ্রসর হইতে পারি না। তারপর যথাসময়ে সদগুরুর জীবন-প্রবাহে পড়িয়া আমরা দ্রুত অগ্রসর হই। ঈশ্বর-কৃপায় নিদর্শন এই যে, অনুকূল স্রোত পাইবার শুভ মুহূর্তে আমরা ভাসিয়া থাকি। তারপর আর সংগ্রাম নাই। সেই পথ খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। ঐ পথ ত্যাগ করিয়া অন্য পথ অবলম্বন করা অপেক্ষা বরং ঐ পথে (চলিতে চলিতেই) মরিতে হইবে।
কিন্তু সাধারণতঃ কি হয়? আমরা একটি ধর্মসম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করিয়া কতকগুলি ধরাবাঁধা মত স্থাপন করি, মানুষের প্রকৃত লক্ষ্য ভুলিয়া যাই। সকলকে এক প্রকৃতির মনে করিয়া, সেরূপ ব্যবহার করি। কিন্তু দুইটি মানুষের কখনও একই দেহ, একই মন হয় না; দুইটি ব্যক্তির ধর্ম বা সাধনপথ কখনও এক হইতে পারে না। যদি ধর্মপথে অগ্রসর হইতে চান, তবে কোন সংগঠিত ধর্মের (organized religion) দ্বারস্থ হইবেন না। ঐগুলি দ্বারা ভাল অপেক্ষা শতগুণ মন্দই হইয়া থাকে, কারণ উহাতে ব্যক্তিগত উন্নতি রুদ্ধ হইয়া যায়। মনোযোগের সহিত সব কিছু দেখুন, কিন্তু নিজের পথে নিষ্ঠা রাখুন। যদি আমার পরামর্শ শোনেন, তবে কোন ফাঁদে পা দিবেন না। যখনই কোন সম্প্রদায় তাহাদের ফাঁস পরাইবার জন্য চেষ্টা করিবে, তখনই নিজেকে সেখান হইতে মুক্ত করিয়া অন্যত্র চলিয়া যান। যেমন মধুকর বহু ফুল হইতে মধু সংগ্র্রহ করে, অথচ কোন ফুলে আবদ্ধ হয় না, তেমনই সংগঠিত, ধর্মে প্রবেশ করুন, কিন্তু আবদ্ধ হইবেন না। ধর্ম আপনাকে ও আপনার ঈশ্বরকে লইয়া; কোন তৃতীয় ব্যক্তি আপনাদের উভয়ের মধ্যে আসিবে না। একবার ভাবিয়া দেখুন—এই সংগঠিত ধর্মগুলি কী করিয়াছে! কোন নেপোলিয়নের অত্যাচার এই সকল ধর্মীয় নির্যাতন অপেক্ষা ভয়ঙ্কর ছিল—যদি আমরা সঙ্ঘবদ্ধ হই, অমনি অপরকে ঘৃণা করিতে আরম্ভ করি। একজনকে ভালবাসার অর্থ যদি অপরকে ঘৃণা করাই বুঝায়, তার চেয়ে ভাল না বাসাই ভাল। এ ভালবাসা নয়, নরক! যদি নিজের লোকগুলিকে ভালবাসার অর্থ অপর সকলকে ঘৃণা করা, তবে তাহা নিছক স্বার্থপরতা ও পশুত্ব; ইহার ফলে পশুতে পরিণত হইতে হইবে। অতএব অপরের ধর্ম যতই বড় বলিয়া মনে হউক না কেন, তাহা অবলম্বন করা অপেক্ষা নিজের (গুণগত) ধর্ম পালন করিয়া মরাও শ্রেয়।৩২
‘অর্জুন, সাবধান! কাম ও ক্রোধ মানুষের পরম শত্রু। ইহাদিগকে সংযত করিতে হইবে। ইহারা বিজ্ঞ ব্যক্তিদের বিবেকও আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে। এই কামের অনল দুষ্পূরণীয়। ইন্দ্রিয়সমূহে এবং মনে কামের অধিষ্ঠান। আত্মা কিছুই কামনা করেন না।’৩৩
‘পুরাকালে এই যোগ আমি সূর্যকে শিখাইয়াছিলাম। সূর্য উহা (রাজর্ষি) মনুকে শিক্ষা দেন। এইভাবে যোগের জ্ঞান এক রাজা হইতে অন্য রাজায় পরম্পরাক্রমে চলিয়া আসিয়াছে; কিন্তু কালক্রমে যোগের মহৎ শিক্ষা নষ্ট হইয়া যায়। তাই আজ আমি আবার তোমার নিকট তাহা বলিতেছি।’
তখন অর্জুন জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি এরূপ বলিতেছেন কেন? আপনি তো সেদিন জন্মিয়াছিলেন, এবং (সূর্য আপনার বহু পূর্বে জন্মিয়াছেন)—আপনি সূর্যকে এই যোগ শিখাইয়েছেন, তাহা কিরূপে সম্ভব?’৩৪
উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেনঃ হে অর্জুন, আমার ও তোমার বহু জন্ম অতীত হইয়াছে; তুমি সেগুলি সম্বন্ধে সচেতন নও। আমি অনাদি জন্মরহিত সর্বভূতের অধীশ্বর। নিজ প্রকৃতি-সহায়ে আমি দেহধারণ করি। যখন ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি মানুষকে সাহায্য করিবার জন্য আবির্ভূত হই। সাধুদিগের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতির বিনাশ এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবর্তীর্ণ হই। যে যে-ভাবে আমাকে পাইতে চায়, সেই ভাবেই আমি তাহার কাছে যাই। কিন্তু হে পার্থ, জানিও কেহই আমার পথ হইতে কখনও বিচ্যুত হইতে পারে না।৩৫
কেহ কখনও বিচ্যুত হয় নাই। আমরাই বা কিরূপে হইব? কেহই ভগবানের পথ হইতে বিচ্যুত হয় না।
সকল সমাজই একটা যা তা করিয়া খাড়া করা সাধারণ নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত। ত্রুটিহীন সাধারণীকরণের উপরই (যথার্থ) নিয়ম গঠিত হইতে পারে। প্রাচীন প্রবাদ কি? প্রত্যেক নিয়মের ব্যতিক্রম আছে। যদি উহা সত্যই নিয়ম হয়, তবে তাহা লঙ্ঘন করা যায় না। কেহই উহা লঙ্ঘন করিতে পারে না। আপেল কি মাধ্যাকর্ষণের বিধি কখনও লঙ্ঘন করে? নিয়ম লঙ্ঘিত হইলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব আর থাকে না। এক সময় আসিবে, যখন আপনি নিয়ম লঙ্ঘন করিবেন, এবং সেই মুহূর্তে আপনার চেতনা মন ও দেহ বিলীন হইয়া যাইবে।
ঐ তো একজন চুরি করিতেছে। কেন সে চুরি করে? আপনারা তাহাকে শাস্তি দেন। কেন, আপনারা তাহার কর্মশক্তি কি কোন কাজে লাগাইতে পারেন না? আপনারা বলিবেন, সে পাপী। অনেকেই বলিবেন, সে আইন লঙ্ঘন করিয়াছে। বিশাল মানবগোষ্ঠীকে জোর করিয়া (বৈচিত্র্যহীন) একই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে। সেই জন্যই এত সব দুঃখ যন্ত্রণা পাপ ও দুর্বলতা। পৃথিবীকে যতটা খারাপ বলিয়া মনে করা হয়, পৃথিবী কিন্তু ততটা খারাপ নয়। মূর্খ আমরা পৃথিবীকে এতটা খারাপ করিয়াছি। আমরা নিজেরাই ভূতপ্রেত দৈত্যদানব সৃষ্টি করি, এবং পরে তাহাদের হাত হইতে অব্যাহতি পাই না। আমরা নিজেদের চোখ থাকিয়া চীৎকার করি, ‘কেহ আসিয়া আমাদিগকে আলো দেখান।’—নির্বোধ! চোখ হইতে হাত সরাইয়া লও! তাহা হইলেই সব ঠিক হইয়া যাইবে। আমাদিগকে রক্ষা করিবার জন্য আমরা দেবতাদের আহ্বান করি, কেহই নিজের উপর দোষারোপ করে না। বাস্তবিক ইহাই দুঃখের বিষয়। সমাজে এত মন্দ কেন? মন্দ কাহাকে বলে?—দেহসুখ ও শয়তানি ভাব। মন্দকে প্রাধান্য দাও কেন? মন্দগুলিকে এত বড় করিয়া দেখিতে কেহ তো বলে নাই। ‘হে অর্জুন, আমার পথ হইতে কেহই সরিয়া যাইথে পারে না।’৩৬ আমরা নির্বোধ, আমাদের পথও নির্বোধের পথ। এই সব মায়ার ভিতর দিয়া আমাদের অগ্রসর হইতে হইবে। ভগবান্ স্বর্গই সৃষ্টি করিয়াছেন, মানুষ নিজের জন্য নরক সৃষ্টি করিয়াছে।
‘কোন কর্ম আমাকে স্পর্শ করিতে পারে না। কর্মফলে আমার স্পৃহা নাই। যে-কেহ আমাকে এইভাবে জানে, সে কর্মকৌশল জানে এবং কর্মদ্বারা কখনও আবদ্ধ হয় না। প্রাচীন ঋষিগণ এই তত্ত্ব জানিয়া নির্বিঘ্নে কর্মে নিযুক্ত হইতেন। হে অর্জুন, তুমি সেইভাবে কর্ম কর।’৩৭
‘যিনি প্রচণ্ড কর্মে গভীর শান্তভাব এবং গভীর শান্তভাবে প্রচণ্ড কর্ম দর্শন করেন, তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী।’৩৮ এখন প্রশ্ন এইঃ প্রতিটি ইন্দ্রিয় প্রতিটি স্নায়ু কর্মপরায়ণ হইলেও আপনার মনে গভীর প্রশান্তি আছে কি?—কোন কিছু আপনার মনকে চঞ্চল করে না তো? কর্মচঞ্চল বাজারের রাস্তায় দাঁড়াইয়া গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করিতেছেন, চারিদিকে ভিড় ঘুরপাক খাইতেছে, তাহার মধ্যে আপনার মন কি ধ্যানমগ্ন ধীর ও শান্ত? অথবা গিরিগুহায় স্তব্ধ নীরবতার মধ্যে কি আপনার মন তীব্রভাবে ক্রিয়াশীল? যদি এইরূপ হয়, তবে আপনি যোগী—মুক্ত পুরুষ, নতুবা নন।
‘যাঁহার প্রত্যেকটি কর্মপ্রচেষ্টা বন্ধনহীন, ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য ও স্বার্থরহিত, সত্যদ্রষ্টাগণ তাঁহাকেই জ্ঞানী বলিয়া থাকেন।’৩৯যতক্ষণ স্বার্থবোধ থাকিবে, ততক্ষণ আমাদের নিকট প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হইবে না। নিজেদের অহঙ্কার দ্বারা আমরা সবকিছুকে রঞ্জিত করি। বস্তুগুলি নিজস্ব রূপেই আমাদের নিকট উপস্থিত হয়; তাহারা যে আবৃত তাহা নয়, কিছুই আবৃত থাকে না। আমরা তাহাদিগকে আবৃত করি। আমাদের মনবুদ্ধির তুলি দিয়া ভিন্নভাবে তাহাদিগকে চিত্রিত করি। যে-সকল জিনিষ আমরা পছন্দ করি না, সেগুলি কাছে আসিলে আমরা সেগুলির উপর একটু তুলি বুলাইয়া দিই, তারপর সেগুলির দিকে তাকাইয়া থাকি। … আমরা কোন কিছু জানিতে চাই না। সব জিনিষকে আমরা নিজের রঙে রাঙাইয়া লই। স্বার্থই সকল কর্মের প্রেরণাশক্তি। বস্তুর স্বরূপ আমাদের দ্বারাই আবৃত রহিয়াছে, গুটিপোকার মত নিজেদের চারিদিকে জাল সৃষ্টি করিয়া আমরা তাহার মধ্যে আবদ্ধ হই। গুটিপোকা তাহার নিজের জালেই নিজে আবদ্ধ হয়। আমরাও ঠিক তাহাই করিতেছি। যখনই ‘আমি’ শব্দটি উচ্চারণ করি, তখনই একটি পাক খাইল। ‘আমি ও আমার’ বলামাত্র আর এক পাক খাইল। এইরূপে চলিতে থাকে।
কাজ না করিয়া আমরা এক মুহূর্ত থাকিতে পারি না। কাজ করিতেই হইবে। কিন্তু প্রতিবেশী যখন বলে, ‘এস, সাহায্য কর’, তখন মনে যে ভাব উদিত হয়, নিজেকে সাহায্য করিবার সময়ও সেই ভাব পোষণ করিবেন। ইহার বেশী নয়। অপরের শরীর অপেক্ষা আপনার শরীর বেশী মূল্যবান নয়। অপরের দেহের জন্য যতটুকু করিয়া থাকেন, নিজের শরীরের জন্য তার বেশী করিবেন না। ইহাই ধর্ম।
‘যাঁহার সকল কর্মপ্রচেষ্টা ফলতৃষ্ণা ও স্বার্থবুদ্ধি রহিত, তিনিই জ্ঞানাগ্নি দ্বারা কর্মের এই সকল বন্ধন দগ্ধ করিয়াছেন, তিনি জ্ঞানী।’৪০ শুধু পুস্তকপাঠের দ্বারা এই অবস্থা লাভ হয় না।একটি গর্দভের পৃষ্টে গোটা গ্রন্থাগারটি চাপাইয়া দেওয়া যাইতে পারে, তাহাতে সে মোটেই জ্ঞানী হইয়া উঠিবে না। কাজেই বহু পুস্তক পড়িবার প্রয়োজন কি? ‘কর্মে আসক্তি পরিত্যাগপূর্বক সর্বদা পরিতৃপ্ত থাকিয়া এবং কোন লাভের প্রত্যাশা না করিয়া জ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম করেন, অথচ কর্মের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন।’৪১
মাতৃগর্ভ হইতে উলঙ্গ অবস্থায় এই পৃথিবীতে আসিয়াছিলাম, উলঙ্গ অবস্থাতেই ফিরিয়া যাইব। অসহায় অবস্থায় আসিয়াছিলাম, অসহায় অবস্থাতেই চলিয়া যাইব। এখনও আমি অসহায়। আমাদের গন্তব্য কোথায়, লক্ষ্য কি—এ অবস্থার কথা চিন্তা করাও আমাদের পক্ষে ভয়াবহ। কত অদ্ভুত অদ্ভুত ভাব আমাদের পাইয়া বসে, তাহাও আমরা জানি না। আমরা প্রেতাত্মার মিডিয়ামের কাছে যাই—ভূত-প্রেত যদি কোন সাহায্য করিতে পারে। ভাবুন কী দুর্বলতা! ভূতপ্রেত, শয়তান, দেবতা—সব এস! পুরোহিত, ভণ্ড, হাতুড়ে—যে যেখানে আছ, সকলে এস! যে মুহূর্তে আমরা দুর্বল হই ঠিক তখনই তাহারা আমাদের পাইয়া বসে এবং যত দেবতা আমদানি করে।
আমার দেশে দেখিয়াছি, কেহ হয়তো শক্তিমান্ ও শিক্ষিত হইয়া দার্শনিকভাবে বলে, ‘এই সব প্রার্থনা পুণ্যস্নানাদি অর্থহীন।’ … তারপর তাহার পিতা দেহত্যাগ করিলেন, তাহার মাতৃ-বিয়োগ হইল। হিন্দুর পক্ষে এই শোক এক প্রচণ্ড আঘাত। তখন দেখা যাইবে পূর্বোক্ত ব্যক্তি প্রতিটি কর্দমাক্ত কুণ্ডে স্নান করিতেছে, মন্দিরে যাইতেছে, সকলের দাসত্ব করিতেছে—যে পার, সাহায্য কর! কিন্তু আমরা অসহায়! কাহারও নিকট হইতে কোন সাহায্য আসে না। ইহাই সত্য।
মানুষের সংখ্যা হইতে দেবতার সংখ্যা বেশী, তবুও কোন সাহায্য আসে না। কুকুরের মত আমরা মরি, তবু কোন সাহায্য নাই। সর্বত্র পশুর মত ব্যবহার, দুর্ভিক্ষ রোগ দুঃখ অসৎভাব! সকলেই সাহায্যের জন্য চীৎকার করিতেছে, কিন্তু কোন সাহায্য নাই। কোন আশা না থাকিলেও আমরা সাহায্যের জন্য চীৎকার করিয়া চলিয়াছি। কি শোচনীয় অবস্থা! কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার! নিজেদের অন্তরে অনুসন্ধান করুন। আমাদের এই দঃখ-কষ্টের অর্ধেকের জন্য আমরা দোষী নই; পিতামাতাই দায়ী। আমরা এই দুর্বলতা লইয়া জন্মিয়াছি—এবং পরে আরও বেশী দুর্বলতা আমাদের মাথায় ঢুকাইয়া দেওয়া হইয়াছে।
নিজেকে অসহায় মনে করা—দারুণ ভুল। কাহারও কাছে সাহায্য চাহিও না। আমরা নিজেরাই নিজেদের সাহায্য করি। যদি তাহা না পারি, তবে আমাদের সাহায্য করিবার কেহ নাই।
‘তুমি নিজেকে তোমার একমাত্র বন্ধু এবং তুমি নিজেই তোমার একমাত্র শত্রু। আত্মা বা মন ছাড়া অন্য কোন শত্রু নাই, আত্মা বা বন্ধু ছাড়া অন্য কোন বন্ধু নাই।’৪২ ইহাই শেষ ও শেষ উপদেশ। কিন্তু ইহা শিখিতে কত কালই না লাগে! অনেক সময় মনে হয়, এই আদর্শ আমরা যেন ধরিয়া ফেলিয়াছি, কিন্তু পরমুহূর্তে পুরাতন সংস্কার আসিয়া পড়ে। আমাদের মেরুদণ্ড ভাঙিয়া যায়। দুর্বল হইয়া আবার সেই ভ্রান্ত সংস্কার ও অপরের সাহায্যকেই আঁকড়াইয়া ধরি। অপরের সাহায্য পাইব, এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হইয়া আমাদের যে বিরাট দুঃখ ভোগ করিতে হয়, তাহা একবার ভাবিয়া দেখুন! পুরোহিত তাদের নিয়মমত পূজা বা প্রার্থনার মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া সম্ভবতঃ কিছু প্রত্যাশা করে। ষাট হাজার লোক আকাশের দিকে তাকাইয়া প্রার্থনা করে এবং প্রার্থনান্তে পুরোহিতের প্রাপ্য অর্থ দেয়। মাসের পর মাস লোক আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকে, প্রার্থনা করে ও পুরোহিতকে টাকা দেয়; একবার ভাবিয়া দেখুন! ইহা কি পাগলামি নয়? পাগলামি ছাড়া ইহাকে আর কি বলা যায়? ইহার জন্য দায়ী কে? আপনারা ধর্মপ্রচার করিতে পারেন, ইহা শুধু অপরিণত শিশুদের মন উত্তেজনা করা! ইহার জন্য আপনাদের দুঃখ ভোগ করিতেই হইবে। অন্তরের অন্তস্তলে আপনারা কি? যে দুর্বল চিন্তাগুলি আপনি অন্যের মাথায় ঢুকাইয়া দিয়াছেন, তাহার প্রত্যেকটির জন্য আপনাকে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ সহ মূল্য দিতে হইবে। কর্মের নিয়ম তাহার প্রাপ্য আদায় করিবেই।
জগতে একটিমাত্র পাপ আছে, তাহা দুর্বলতা। বাল্যকালে যখন মহাকবি মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লষ্ট’ কাব্য পড়িয়াছিলাম, তখন শয়তানকেই একমাত্র সৎ ব্যক্তি বলিয়া শ্রদ্ধা করিতাম। তিনিই মহাপুরুষ, যিনি কখনও দুর্বলতার বশীভূত হন না, সর্বপ্রকার বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হন এবং জীবনপণ করিয়া সংগ্রাম করেন। ওঠ, জাগ, ঐ প্রকার সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হও …। পাগলের সংখ্যা আর বাড়াইও না। যে অনিষ্ট অবশ্যম্ভাবী, তাহার সহিত আর তোমার দুর্বলতা যুক্ত করিও না। জগতের কাছে আমি এই কথা বলিতে চাই। শক্তিমান্ হও; ভূতপ্রেত ও শয়তানের কথা তোমরা যে বল, আমরাই তো জীবন্ত শয়তান। শক্তি ও ক্রমোন্নতিই জীবনের চিহ্ন। দুর্বলতা মৃত্যুর চিহ্ন, যাহা কিছু দুর্বল, তাহাকে এড়াইয়া চল। উহাই মৃত্যু। উহা যদি শক্তি হয়, তবে তাহার জন্য নরকেও যাও এবং শক্তি লাভ কর। সাহসীরাই মুক্তির অধিকারী। ‘বীরপুরুষরাই স্ত্রীরত্নলাভের যোগ্য।’ আর যাহারা সর্বাপেক্ষা বীর, শুধু তাহারাই মুক্তিলাভের যোগ্য। কাহার নরক? কাহার অত্যাচার? কাহার পাপ? কাহার দুর্বলতা? কাহার মৃত্যু কাহার রোগ?
আপনারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, যদি যথার্থ বিশ্বাস করিতেই হয়, তবে প্রকৃত ঈশ্বরে বিশ্বাসী হউন। ‘তুমি পুরুষ, তুমি স্ত্রী, তুমি সবল যুবকের পদবিক্ষেপে চলিতেছ, আবার জারগ্রস্ত বৃদ্ধ দণ্ডসহায়ে চলিতেছ।’৪৩ তুমিই দুর্বলতা, তুমিই ভয়, তুমিই স্বর্গ এবং তুমিই নরক; তুমি সর্প হইয়া দংশন কর, রোজা হইয়া বিষমুক্ত কর—তুমিই ভয়-মৃত্যু ও দুঃখ-রূপে উপস্থিত হও।
সকল দুর্বলতা, সকল বন্ধনই আমাদের কল্পনা। সজোরে একটি কথা বল, ইহা শূন্যে মিলাইয়া যাইবে। দুর্বল হইও না, ওঠ, বাহির হইবার আর অন্য কোন পথ নাই। শক্ত হইয়া দাঁড়াও, শক্তিমান্ হও ভয় নাই। কুসংস্কার নাই। নগ্ন সত্যের সম্মুখীন হও। দুঃখ-কষ্টের চরম—মৃত্যু যদি আসে, আসুক। প্রাণপণ সংগ্রামের জন্য আমরা কৃতসঙ্কল্প। ধর্ম বলিতে আমি ইহাই জানি, আমি ইহা লাভ করি নাই, লাভ করিবার চেষ্টা করিতেছি। আমি সফল হইতে না পারি, তোমরা পারিবে। অগ্রসর হও।
‘যেখানে একজন অপরকে দেখে এবং একজন অপরকে শোনে, যতক্ষণ দ্বৈতবোধ আছে, ততক্ষণ ভয় থাকিবেই, এবং ভয়ই সমস্ত দুঃখের কারণ।’৪৪
যখন যেখানে একজন অপরকে দেখে না, যেখানে সবাই এক—সেখানে দুঃখী হইবার কেহ নাই, অসুখী হইবারও কেহ নাই। একই আছেন, দ্বিতীয় নাই—‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’। কাজেই ভয় করিও না; ওঠ, জাগ, যে পর্যন্ত লক্ষ্যস্থলে না পঁহুছিতেছ, সে পর্যন্ত থামিও না।