ধৃতরাষ্ট্র উবাচ।
ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুয়ুৎসবঃ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয় ॥১-১।।
শব্দার্থ–
ধৃতরাষ্ট্র উবাচ = King Dhritarashtra said
ধর্মক্ষেত্রে = in the place of pilgrimage
কুরুক্ষেত্রে = in the place named Kuruksetra
সমবেতাঃ = assembled
য়ুয়ুত্সবঃ = desiring to fight
মামকাঃ = my party (sons)
পাণ্ডবাঃ = the sons of Pandu
চ = and
এব = certainly
কিং = what
অকুর্বত = did they do
সঞ্জয় = O Sanjaya.
কালীপ্রসন্ন সিংহ । ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! কৌরব ও পাণ্ডবগণ সংগ্রামভিলাষে ধর্মভূমি কুরুক্ষেত্রে সমবেত হইয়া কি করিয়াছিল?”
প্রসন্নকুমার শাস্ত্রি ভট্টাচার্য্য । হে সঞ্জয়! পরস্পর সমরেচ্ছু, আমার পুত্রগণ এবং পাণ্ডুসন্ততিগণ ধর্মভূমি কুরুক্ষেত্রে সম্মিলিত হইয়া কি করিতেছেন? অর্থাৎ যুদ্ধেই কৃতনিশ্চয় হইলেন, না, ধর্মভূমির প্রভাবে * ধর্মবৃত্তির উত্তেজনায়, পাপসঙ্কুল যুদ্ধে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন, অথবা কিরূপ উপক্রম করতেছেন?
* কুরুক্ষেত্র চিরপ্রসিদ্ধ তীর্থস্থান, যথা,–বৃহস্পতিরুবাচ যাজ্ঞবল্ক্যং “যদনু কুরুক্ষেত্রং দেবানাং দেবযজনং সর্ব্বেবাং ভূতানাগ ব্রহ্মসদনং” ইতি জাবালশ্রুতেঃ।
আর্যমিশন । ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন। হে সঞ্জয়, ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধার্থী মৎপক্ষীয়গণ ও পাণ্ডবগণ সমবেত হইয়া কি করিলেন।
রামকৃষ্ণমিশন ।
ইসকন ।
কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ । ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন,–হে সঞ্জয়! ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে মৎপক্ষীয় কৌরবগণ ও পাণ্ডবগণ যুদ্ধাভিলাষে সমবেত হইয়া কি করিলেন?
টিপ্পনী (কৃষ্ণচন্দ্র স্মৃতিতীর্থ) ।–“ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে” ইত্যাদি স্থলে ধৃতরাষ্ট্রের “কিমকুর্বত সঞ্জয়” এই প্রশ্নটি আপাতত একান্তই অসঙ্গত বলিয়া মনে হয়; কারণ উভয় পক্ষই যখন পরস্পর বিজিগীষু হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত হইয়াছেন, তখন “উভয় পক্ষ কি করিলেন” এরূপ প্রশ্ন আবার কেন? কিন্তু মহর্ষি বেদব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে “প্রজ্ঞাচক্ষুঃ” প্রভৃতি নানা বিশেষণে বিশেষিত করিয়াছেন; সুতরাং বলিতে হইবে, কুরুকুলপতি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মহাবুদ্ধিমান এবং পরম প্রবীণ; সুতরাং তিনি যে এরূপ বৃথা প্রশ্ন করিবেন, ইহাও অসম্ভব। পরন্তু এই প্রশ্নসম্বন্ধে সবিশেষ প্রণিধান করিলে, ইহা কিছুই অসঙ্গত বলিয়া বোধ হইবে না।
সমন্তপঞ্চক বা কুরুক্ষেত্র ভারতের অন্যতম অতিপ্রধানভূত পরম পূণ্যভূমি। ইহার পবিত্রতা ও প্রাধান্য জাবাল শ্রুতিতে উক্ত হইয়াছে–“যদনু কুরুক্ষেত্রং দেবানাং দেবযজনং সর্ব্বেবাং ভূতানাগ ব্রহ্মসদনং” এবংশতপথ শ্রুতিতে “কুরুক্ষেত্রং বৈ দেবযজনম্” ইত্যাদি বাক্যে কীর্তিত হইয়াছে। তীর্থক্ষেত্রের অপূর্ব মহিমা! মহাপাপিষ্ঠগণও কোন তীর্থে উপস্থিত হইলে, তাহার চিররভূমিতে অন্ততঃ ক্ষণকালের জন্যও বিষয়ের অনিত্যতার উপলব্ধি হওয়ার বিবেকের অভ্যূদয় হইয়া থাকে। মহামহিমশালী কুরুক্ষেত্রের পবিত্রভূমিতে উপস্থিত হইয়া পরস্পর বধেচ্ছু বিষয়-লোলুপ কৌরব ও পাণ্ডবগণের চিত্তে বিষয়-বৈরাগ্য উপস্থিত হওয়াই সম্ভব। সকলের না হউক, একতর পক্ষেরও চিত্তক্ষেত্রে যদি তাদৃশ বৈরাগ্য প্রবেশ লাভ করে, তাহা হইলে কদাচ কুলক্ষয়করযুদ্ধ সংঘটিত হইতে পারে না। বিশেষতঃ পাণ্ডবগণ স্বভাবতঃ ধর্মশীল ও শ্রীকৃষ্ণ পরায়ণ। যদি তাঁহাদের চিত্তে ধর্মের কর্ষণক্ষেত্ররূপ কুরুক্ষেত্রের মহিমায় প্রবল বৈরাগ্যের অভ্যূদয় হয়, তবে তাঁহারা কদাচ কুলক্ষয়সাধক নানা অনর্থকর মহাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন না; সুতরাং বিনাযুদ্ধেই মৎপুত্রগণ ধরণীর অধীশ্বর হইয়া, চরম বৈষয়িক সুখের অধিকারী হইতে পারিবে। পক্ষান্তরে যদি নিয়ত পাপকর্মপরায়ণ দুর্য্যোধনাদির চিত্তে স্থান-মাহাত্ম্যে ধর্মবুদ্ধির উদয় হয়, তাহা হইলে, তাহারা পাণ্ডবগণের পৈতৃক রাজ্যার্দ্ধ প্রদানে সন্ধিস্থাপনও করিতে পারে। উভয়থাই স্থানমাহাত্ম্য-প্রভাবে আত্মকলহ প্রসূত অনর্থপাত সংঘটিত না হইবারই সম্ভাবনা। এই মনে করিয়াই মহামনীষী ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে এই প্রশ্ন করিলেন। সুতরাং ঈদৃশ প্রশ্ন বিন্দুমাত্রও অসঙ্গত নহে।
কুরুক্ষেত্র।–ইহার অপর নাম সমন্তপঞ্চক; ইহা বর্তমান দিল্লীর সমীপবর্তী এবং এই ক্ষেত্র প্রজাপতির উত্তরবেদী বলিয়া বিখ্যাত। যুধিষ্ঠির ও দুর্য্যোধনাদির পূর্বপুরুষ মহারাজাধিরাজ কুরু যজ্ঞার্থ এই স্থান কর্ষণ করেন বলিয়া, উহা কুরুক্ষেত্র নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ইহা পরম পবিত্র তীর্থ। এখানে দেহত্যাগ করিলে, নরগণ সুরলোকে গমন করিয়া থাকেন। ইতঃপূর্বে শান্তনুনন্দন ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠতাত চিত্রাঙ্গদ এই স্থানে গন্ধর্বযুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিয়া স্বর্গে গমন করেন। বর্তমান ঐতিহাসিক যুগেও এই সুপ্রসিদ্ধ স্থানে বহুবার ভারতের ভাগ্যচক্রের নেমি পরিবর্তিত হইয়াছে।
সঞ্জয়।–ইনি ধৃতরাষ্ট্রের এক অতি বিশ্বস্ত অমাত্য এবং সারথি; ইঁহার পিতার নাম গবল্গণ। এই জন্য ইনি সময় সময় গাবল্গণি নামেও অভিহিত হইতেন। ইনি অতীব শান্তস্বভাব, মিতভাষী ও সদা সন্তোষশীল। বিচক্ষণতায় ইনি মহামনস্বী বিদুরের তুল্য। মহর্ষি ব্যাসের অনুগ্রহে ইনি নিরাপদে কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধ সন্দর্শন করিয়া ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধবৃত্তান্ত বর্ণন করেন এবং ভগবৎকথিত পরম যোগতত্ত্ব অবগত হইয়াছিলেন। যাহা মহাভাগ্যবান অর্জুন ব্যতীত অন্য কেহ দেখিবার যোগ্যতা লাভ করেন নাই, সেই বিশ্বরূপ সন্দর্শন করিয়া মহামতি সঞ্জয় কৃতার্থ হইয়াছিলেন। অর্জুন এই মহানুভবকে প্রিয়সখা মনে করিয়া আদর করিতেন।