গিরিগুহার গুপ্তধন – ৯

নয়

ভেলুয়া শুয়ে আছে চম্পার খাটিয়ার নীচে।

দীপংকরের মনে ভয়। এই রকম দুর্যোগ চলতে থাকলে কাল কি যাওয়া সম্ভব হবে? অথচ যেভাবেই হোক চম্পার ওই অলংকার এবং গুপ্তধনের খোঁজ নিতেই হবে ওদের। কিন্তু দুর্যোগ যেভাবে চলছে তাতে তো কমবার কোনও আশাই নেই। এখন সবে সন্ধেরাত। দেখা যাক সারারাতে কী হয়।

দুর্যোগ বেড়েই চলল। রাতও হল। সামান্য কিছু গুড়মুড়ি আর কলা খেয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। এর বেশি এই দুর্যোগের রাতে আর কী-ই বা আশা করা যায়? অনেকক্ষণ ধরে দু’জনে জল্পনাকল্পনা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ল একসময়। রাত তখন কত তা কে জানে?

চম্পার করস্পর্শে চোখমেলে তাকাল দীপংকর। ছোট চিমনি লণ্ঠনটা তখনও টিম টিম করে জ্বলছে। চম্পা সেটা অল্প একটু উসকে দিয়ে চাপা গলায় ডাকল, দীপ! এই দীপ! দীপংকর !

চোখমেলে দীপংকর দেখল চম্পা ওর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ওর মুখের দিকে ঝুঁকে আছে। ওর ঘন নিশ্বাস পড়ছে গায়ের ওপর। দীপংকর বলল, কী!

ওঠো।

কেন?

ওঠো না একবার।

দুর্যোগ কমেছে?

না আরও বেড়েছে।

তবে? বাইরে যাবে?

হ্যাঁ।

দীপংকর উঠল। তারপর দু’জনে ঘরের দেওয়ালে পেরেকে ঝোলানো সেই ভালুকের মোটা লোমওয়ালা ছালদুটো পেড়ে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই, দমকা বাতাসে ঘরের সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেল। লণ্ঠনটাও নিভে গেল ধূপ করে। সে কী কাণ্ড। ওরা জালঘেরা বারান্দা থেকে নীচের দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে গেল। আশপাশের বড় বড় গাছগুলো ডালপালা ভেঙে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে উঠোনের ওপর। উঠোনের মাঝখানে কিছু না হলেও এক হাঁটু জল। একটা প্রকাণ্ড ময়াল সাপ রান্নাঘরের চালার ওপর থেকে পাশের একটি গাছের ডালে উঠতে যাচ্ছে। উঠানের শেষে পাঁচিলের গায়ে লাগানো দরজাটা পাঁচিল সমেত ভেঙে পড়ে আছে। এ যেন প্ৰলয়নাচন নাচছে প্রকৃতি।

ওরা টর্চের আলো ফেলে নীচে নামার সময় ইকলুর ঘরের দরজাটা একটু ঠেলে দেখল। ও এখন বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। এমন সময় হঠাৎই দীপংকরের হাত ধরে টান দিল চম্পা। বলল, দীপ! ওই দেখো।

ওরা সবিস্ময়ে দেখল বাইরে ধসে যাওয়া পাঁচিল ও ভেঙে পড়া দরজার কাছে কালো বর্ষাতিপরা চারজন আগন্তুক এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের প্রত্যেকেরই হাতে একটি করে জোরালো টর্চ ও একটি করে রিভলবার। ওরা সেই টর্চের আলোয় পথ দেখে উঠোন পার হয়ে ঘরের দিকে এগোচ্ছে।

কিন্তু ঘরের দিকে এগোলে কী হবে? দালানে ঢোকার মুখে যে দরজা সেটাও তো বন্ধ। ওরা এসে একবার একটু ঠেলে দেখল। তারপর ইশারায় কী যেন কথা হল ওদের নিজেদের মধ্যে। একজন পকেট থেকে একটি আংটা লাগানো দড়ি নিয়ে লটকে দিল বারান্দার কাঠের রেলিংয়ে। তারপর চুপিসাড়ে দড়ি বেয়ে একটু একটু করে উঠতে লাগল ওপরে।

চম্পা চাপা গলায় বলল, নিশ্চয়ই লালজির লোক এরা। আমাদের খোঁজে এসেছে।

আমারও তাই মনে হয়। দুর্যোগের রাতে বাধা পাবার ভয় নেই বুঝেই এসেছে ওরা।

আমাদের এখুনি ইকলুভাইকে ডাকা উচিত।

না। ডাকাডাকি করবার আর সময় নেই। ওরা সতর্ক হয়ে যাবে। পালাবে ওরা। তার চেয়ে চলো আমরাই ওদের উচিত শিক্ষা দিই। কী করে কী করবে?

তুমি চুপিসাড়ে চট করে ঘরে ঢুকে বল্লমটা বার করে নিয়ে এসো। আমি ততক্ষণ এই ডান্ডাটা নিয়ে এগোচ্ছি। বলেই দরজার কাছে ঠেস দিয়ে রাখা দু’-চারটে লোহার রডের ভেতর থেকে একটা বেছে নিয়ে গুঁড়ি মেরে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে।

আগন্তুক ততক্ষণে দড়ি বেয়ে বারান্দার ওপরের রেলিংয়ে পা রেখেছে। কিন্তু বাধা দিল লোহার জাল। মানুষের অসাধ্য তো নেই। তাই সেই লোহার জালকেও কেটে ফেলল একসময়। এবার অল্প একটু একটু করে মাথাটা গলিয়ে ভেতরে ঢুকতে যেতেই দীপংকর সেই লোহার রডের বাড়ি সজোরে এক ঘা মেরে দিল লোকটার মাথায়। লোকটা চেঁচাতেও পারল না। করে একটা শব্দ করেই স্থির হয়ে গেল। একবার শুধু ‘ওঁক’

নীচে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা কিছুই বুঝতে না-পেরে বার বার টর্চের আলো ফেলতে লাগল ওপর দিকে। দীপংকর তখন বুকে হেঁটে লোকটার কাছে গিয়ে ওর চুলের মুঠি ধরে একটু ঠেলা দিতেই ধুপ করে নীচে পড়ে গেল লোকটা।

ব্যাপারটা কী এরা ঠিক বুঝতে পারল না বোধহয়। কেন না ঝড় এবং জল এমনভাবে একটানা হচ্ছে যে কারও কিছু বোঝবার উপায় নেই। ওরা ভাবল নীচে পড়ে গিয়েই বুঝি মাথাটা ফেটে গেল লোকটার।

তাই আর একজন ওঠার চেষ্টা করল।

এর জন্যে বল্লম রেডি ছিল। ওপরে উঠে জালের ফাঁক দিয়ে মাথাটা গলাতেই, দীপংকর ওর চোয়ালের নীচ থেকে মুখের ওপর পর্যন্ত এফোঁড় ওফোড় করে দিল বল্লমটা। লোকটা অসহায় ভাবে ছটফট করতে লাগল দেখে নীচের লোক দু’জন এবার একটু ঘাবড়ে গেল। তারপর বেকায়দা বুঝেই এদের ফেলে রেখে পালাল ওরা।

দীপংকর এ লোকটাকেও বল্লমমুক্ত করে ফেলে দিল নীচে। উঠোনে একহাঁটু জল। লোকটা তাতেই পড়ে দু’-একবার শূন্যে পা ছুড়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরল। আগের লোকটা ততক্ষণে জলের ওপর কাছিমের মতো আধডোবা হয়ে ভাসছে। দীপংকর বলল, এইবার ইকলুভাইকে ডাকা যাক।

চম্পা বলল, উহু। ওকে আরও ঘুমোতে দাও। এমন চমৎকার সুযোগ আর আসবে না দীপ।

কীসের?

পালাবার।

পালাবে? কোন দুঃখে! কাল সকালে যাবে না ওই পাহাড়ে?

না। আজই, এখনই যাব।

চম্পা তুমি কি অপ্রকৃতিস্থ?

না দীপ। এই ভয়ংকর দুর্যোগে কেউ কোথাও নেই। হিংস্ৰ শ্বাপদরা পর্যন্ত তাদের ডেরা ছেড়ে বেরোয়নি। আদিবাসীগুলোও বাধা দিতে আসবে না। এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? চলো এই মুহূর্তে আমরা বেরিয়ে পড়ি। আর কী, সর্বাঙ্গ তো ভিজে গেছে। দু’-দুটো খুনও হয়ে গেল। তবে কেন দেরি? ওই দেখো দূরের পাহাড়গুলো আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। চলো। বেরিয়ে পড়ি।

দীপংকর কিছুক্ষণ বিস্ময়ভরা চোখে চম্পার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। খুনের উত্তেজনায় এবং অভিযানের উন্মাদনায় শিরদাঁড়া টান করে বলল, চলো।

ঝড়ের দাপট একটু কম হয়েছে তখন। কিন্তু বৃষ্টির বেগ আরও প্রবল।

চারদিকে শুধু জল জল আর জল। এই জল হয়তো বেশিক্ষণ থাকবে না। এখন পাহাড়ধোয়া জলের ঢলে ঢেউ খেলে যায় চারদিকে।

চম্পা এই দুর্যোগে ভেলুয়াকেও টেনে আনল। জেঠুর আদরের কুকুর ভেলু। চম্পার ভেলুয়া। শুরু হল অভিযান।

ওরা নীচের দরজাটা খুলল না। ওপরের বারান্দা থেকেই সেই ছেঁড়া জালের ফাঁক দিয়ে দড়ি বেয়ে নামল। আগে দীপংকর। তারপর ভেলুয়াকে নিয়ে চম্পা। ওদের একজনের হাতে টর্চ! একজনের হাতে বল্লম।

সেই হাঁটুজল পার হয়ে বাইরে এল ওরা। যেখানটা একটু ঢালু সেখান দিয়ে কী অসম্ভব বেগে জলের স্রোত যে ছুটছে তা না-দেখলে কল্পনা করা যাবে না!

ওরা তবু দ্রুত পা চালিয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে ধারাগিরি বাঁদিকে রেখে জঙ্গলের পথ ধরল। ওদের হাতে আংটাওয়ালা সেই দড়িটাও আছে। পাহাড়ে ওঠার সময় হয়তো এটা খুবই কাজে লাগবে ওদের। ভাগ্যে এটা এনেছিল লোকগুলো।

ক্রমশ ওরা উঁচুতে উঠতে লাগল। ওদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে ভেলুয়াও জলের বাধা অতিক্রম করে উপরে উঠল।

কিন্তু উঠলে কী হবে? জলের হাত থেকে তো পরিত্রাণ নেই। পাহাড়ে ওঠার মুখে জল যেন আরও বেশি। ওপরের জল হুড় হুড় করে ওদের গায়ে এসে পড়তে লাগল। এখানে ওদের এমনই অবস্থা যে কী করবে ভালুকের ছাল?

এইভাবে বেশ খানিকটা যাবার পর পাহাড় আরও খাড়াই হতে লাগল। সেই খাড়াই পাহাড়ে কাজে লাগল ওই দড়ির আংটা। আংটাটা দূরে নিক্ষেপ করে যে কোনও ঝোপেঝাড়ে আটকে দড়ি বেয়ে ওরা উঠতে লাগল ওপরে। কেন না জলস্রোত এখন এত বেশি যে পথঘাট কিছুই চেনা যাচ্ছে না। দেখাও যাচ্ছে না।

এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ ওপরে ওঠার পর হাঁপিয়ে পড়ল দু’জনেই। ভেলুয়াও হাঁপাচ্ছে। এমনি ওঠা আর জলের বেগ ঠেলে ওঠায় তফাত আছে বইকী। দীপংকর বলল, আমরা ঠিক পথেই চলেছি তো?

হ্যাঁ। কিন্তু আর যে পারি না। শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে।

আর কত দূর !

ওই তো। ওই পাহাড়টায়।

তা হলে এসো,

তুমি আমার হাত ধরো।

দীপংকর চম্পার কোমল হাতখানি শক্ত করে ধরল। কী দারুণ ঠান্ডা। বরফের মতো শীতল।

চম্পা বলল, পাদুটো জড়িয়ে পড়ছে যেন।

ওরা তখন অনেকটা ওপর-ধাপে উঠে গেছে। বৃষ্টিতে সপ সপ করছে সর্বাঙ্গ। ভেলুয়া থর থর করে কাঁপছে।

একটু করে চলতে লাগল। দীপংকর বলল, তোমার যদি খুব বেশি কষ্ট হয়, তুমি তা হলে আমার পিঠে উঠতে পারো।

চম্পা দীপংকরের কাঁধে ভর দিয়ে একটু

চম্পা হেসে বলল, ভারী বাহাদুর ছেলে তুমি। এই পাহাড়ি রাস্তায় আমাকে পিঠে নিয়ে কখনও উঠতে পারো?

এসোই না, দেখি পারি কি না।

দীপংকরের এখন দারুণ উৎসাহ। চম্পাকে পিঠে নিয়েই বল্লমে ভর করে, সে একটু একটু করে ওপরে উঠতে লাগল। যতটা সহজ ভেবেছিল দীপংকর ততটা নয়। খানিক ওঠার পরই মুখ লাল হয়ে উঠল ওর। অবশেষে একসময় ওপরে উঠে এল।

চম্পা বলল, এবার আমায় নামিয়ে দাও। যেতে পারব।

ওরা পা টিপে টিপে পাহাড়ের এক প্রান্তে এসে হঠাৎ এক জায়গায় জলের তোড়ের সঙ্গে একটি বড় সাপ দেখে থমকে দাঁড়াল। কী সাপ এটা। ময়াল? হয়তো তাই। কী প্রকাণ্ড তার চেহারা। আর কী দারুণ লম্বা।

ভালুকের ছাল পরে থাকা সত্ত্বেও ওরা প্রবল বর্ষণে ভিজে কাকের মতো হয়ে গেছে।

দীপংকর বলল, ভিজেই যখন গেলাম তখন আর এটাকে বয়ে লাভ কী?

তা হোক। তবু তো কিছুটা বাঁচছে। পাহাড়ি ঢলে ভিজে গেলেও বৃষ্টির জল তো ততটা লাগছে না।

ওরা কথা বলতে বলতে একটা বাঁকের মাথায় এসে থেমে পড়ল।

চম্পা বলল, ওই যে দেখছ গ্রামখানা, ওটাই এখানকার আদিবাসীদের গ্রাম। আর এই দেখো পাহাড়ের চেহারা। সোনার লোভে পাহাড়কে কেটে কেটে কেমন শ্রীহীন করেছে। ওপাশের ওইসব গর্তগুলো দেখো। ওগুলো কিন্তু গুহা নয়। সবই পাথরকাটার ফল।

এখন ওখানে সোনা নেই?

আছে। যেসব পাথরে আছে, তাই থেকে সোনা বার করা খুব ব্যয়সাপেক্ষ।

ও। তা আমাদের যেখানে প্রয়োজন সেই গুহাটা কোথায়?

চলো, সেখানেই আগে যাই। বলে একধাপ নীচে নেমে একটি ছোট্ট গুহার কাছে এসে দাঁড়াল ওরা।

গুহামুখের সামনে বড় বড় কয়েকটি পাথর আড়াল করা। সামনেটা ঝোপঝাড়ে ভরতি। জানা না থাকলে বোঝার উপায় নেই যে এটা গুহা।

ওরা প্রথমে অনেকক্ষণ ধরে বল্লম দিয়ে নাড়া দিল সেখানটা, তারপর যখন বুঝল সাপখোপ কিছু নেই সেখানে, তখন পাথরগুলো একটু একটু করে সরিয়ে ফাঁক করল। এবার ভেতরটা টর্চের আলোয় বেশ ভাল করে দেখে, এক এক করে ঢুকে পড়ল ওরা। ভেলুয়া ঢুকল সর্বপ্রথম। তারপর ওরা।

এ জায়গাটা খুব গড়ানো। যারা কখনও ঢোকেনি এর ভেতর, তারা ভাববে এই ঢাল বোধহয় পাতাল পর্যন্ত। কিন্তু না। বেশ কিছুক্ষণ হড় হড় করে নেমে আসার পরই ওরা পায়ের তলায় শক্ত পাথর পেল। এবার মাথা তুলে উঠে দাঁড়াল ওরা। উঃ সে কী দারুণ অন্ধকার। সেই অন্ধকারে টর্চের আলোয় পথ দেখে ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল।

বেশ কয়েক পা যাবার পর দেখা গেল গুহামুখ সংকীর্ণ হয়ে আসছে। ওরা সেখানেও টর্চের আলো ফেলে ঘাড় নুইয়ে এগিয়ে চলল। তারপর আরও ঝুঁকে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল। এক জায়গায় বেশ কিছু নুড়িপাথর জমা করা ছিল। চম্পা দু’হাতে সরাতে লাগল সেগুলো। হঠাৎ একসময় কী দেখে যেন চিৎকার করে উঠল চম্পা। কী দেখল ও? দীপংকর টর্চের আলোয় দেখল সেই নুড়ি পাথরের ফাঁকে ফাঁকে কিলবিল করছে অজস্র কাঁকড়াবিছে।

ওরা একটু পিছিয়ে এসে বল্লমের ডগায় করে সেই নুড়িপাথর সরাতে লাগল। দীপংকর জিজ্ঞেস করল, কামড়ে দেয়নি তো?

চম্পা বলল, না।

নুড়িপাথর সরাতে সরাতে হঠাৎ একটা লোহার চেন নজরে এল ওদের।

চম্পা বলল, ওটা ধরে জোরে টান দাও।

দীপংকর তাই করল। আর করার সঙ্গে সঙ্গেই মস্ত একটা গোসাপ উঠে এল তার ভেতর থেকে। অবশ্য সেটা সত্যিকারের নয়। রবারের। চম্পা সেটাকে ওপরে তুলেই তার বুকের চেন ধরে টানল। দেখল যেখানকার যা সেখানে তা ঠিকই আছে। কিন্তু সেটা এত ভারী যে, তাকে বয়ে নিয়ে যাওয়াও অসম্ভব। হবে নাই বা কেন? দীপংকর নিজে হাতে এক এক করে গুণে দেখল মোট সাতশো চল্লিশটা গিনি, একুশটা দুষ্প্রাপ্য মোহর এবং সোনা ও হিরের নেকলেশ পঁচিশটা। তা ছাড়া আরও অনেক অনেক অলংকার। দীর্ঘ দিনের লুটের মাল দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে জেঠু সঞ্চয় করে রেখে গেছেন এই বনবালার জন্যে।

ওরা ওগুলো আবার যথাস্থানে রেখে, মানে সেই গোসাপের ভেতরে পুরে শক্ত করে যখন চেন আঁটল তখন বন্যার স্রোতের মতো জল ছুটে আসছে গুহার ভেতর। গুহামুখের পাথরগুলো সরে যাওয়ায় জল আসার সুবিধে হয়েছে। তাই ওরা আর একটুও বিলম্ব না করে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করল। অনেক চেষ্টার পর ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এল ওরা। বহু কষ্টে বুকে হেঁটে যখন ওপরে উঠল ওরা, তখন সেই ভালুকের ছালগুলো যেন লোহার মতো ভারী ঠেকছে।

দীপংকর বলল, আর এগুলোর মায়া নয়। এগুলোকে আর বয়ে বেড়াতে পারছি না। ভিজি ভিজব। পড়ে থাক ওগুলো। বলে গা থেকে খুলে ফেলে দিল। চম্পা বলল, হ্যা আমারও অসহ্য লাগছে। উঃ কী ভারী। তার ওপর এই গোসাপটাকে টেনে নিয়ে যেতে হবে।

ওরা ওপরে জলস্রোতের ঢাল বহু কষ্টে পেরিয়ে যখন গুহামুখে এল, তখন আনন্দের আর অবধি রইল না ওদের।

চম্পা নেচে উঠল, বলল ছর র রে। বৃষ্টি থেমে গেছে। দুর্যোগ কেটে গেছে আজকের মতো।

দীপংকরও বেরিয়ে এল তখন সেই গোসাপটাকে টানতে টানতে। বেরিয়ে এসে বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে সেও লাফিয়ে উঠল। আনন্দের আবেগে দীপংকর তো চম্পাকে জড়িয়ে ধরে বাঁই বাঁই করে ঘোরাতে লেগে গেল।

চম্পা বলল, আরে ! আরে! এ কী করছ! ছাড়ো শিগগির। এখন এসবের সময় নয়। তা ছাড়া এইভাবে ঘোরালে মাথা ঘুরে যাবে যে।

দীপংকর চম্পাকে নামিয়ে দিয়ে বলল, আমার মনে হচ্ছে তোমাকে এখুনি কাঁধে নিয়ে নাচি।

চম্পা বলল, দীপ! ওই দেখো আকাশে চাঁদ।

আরে তাই তো! দুর্যোগ যে একেবারেই কেটে গেছে।

ওরা একটা বড় পাথরের ওপর বসে বর্ষণসিক্ত পাহাড় ও বনতলের অবস্থা

দেখতে লাগল। বৃষ্টি থেমে গেলেও পাহাড়ধোয়া ঢল কিন্তু হদ হদ করে সামনে নামছে। তা নামুক। একটু একটু করে সব মেঘ কেটে যাচ্ছে। একটি দুটি করে তারাও ফুটে উঠছে আকাশে।

চম্পা বলল, জানি দুর্যোগের শেষ হবেই।

দীপংকর বলল, শুনেছি দুর্দিনও বেশিদিন থাকে না। কিন্তু আমার জীবনের মেঘ কি কাটবে চম্পা? তোমাকে পেলাম। তোমার গোপন সম্পত্তিও উদ্ধার হল। কিন্তু আমার কী হল? শহরে গেলেই তো পুলিশ আমার হাতে হাতকড়া পরাবে খুনের অপরাধে।

চম্পা বলল, আমি বলি কী দীপ, এক কাজ করো। আমরা বরং এখানেই থেকে যাই। তুমি ইকলুর বাড়িতে কিছুদিন থাকো। আমি তোমার বাড়িতে গিয়ে চুপি চুপি তোমার মা-বাবাকে সব কথা জানাই। তারপর ওদের এখানে নিয়ে এসে এই জঙ্গলে ইকলুদের গ্রামেই একটা ছোট্ট ঘর করে দু’জনে থেকে যাই। তোমার মা-বাবাও যদি থাকতে চান তো থাকবেন। জেঠুর কৃপায় আমরা তো এখন কুবেরের ঐশ্বর্য পেয়ে গেছি।

ঠিক বলেছ। আমি এখানেই থাকি। তুমি কালই গিয়ে বরং আমার বাবা-মাকে খবরটা দিয়ে এসো। কেমন?

চলো তা হলে, আর দেরি করে কাজ নেই। আয় ভেলুয়া।

দীপংকর বলল, না। এখুনি নয়। আমাদের এখন আরও একটা কাজ বাকি আছে।

কী কাজ?

সেই গুপ্তধনের গুহাটা আবিষ্কার করা।

তুমি কি পাগল? এই গিরিগুহার গুপ্তধনের গল্প স্রেফ রূপকথা ছাড়া কিছু নয়। না না চম্পা। রূপকথা নয়। গুপ্তধন আছে। এই দেখো তার নকশা। জেঠুর ডায়েরি থেকে আমি পেয়েছি।

তাই নাকি? কোথায় কোন গুহায়?

এখানে যে গুহার মাথার ওপর শিবের ত্রিশূল আঁকা আছে সেই গুহায়। শিবের ত্রিশূল! ওই—ওই দেখো, ওই গুহাটার মাথার ওপর বড় পাথরের বুকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষেরা খোদাই করে রেখেছে শিবের ত্রিশূল।

দীপংকর অবাক হয়ে সেইদিকে তাকিয়ে বলল, কী আশ্চর্য! ওই এত উঁচুতে ও ত্রিশূল খোদাই করল কী করে? এই তা হলে সেই যথার্থ রাক্ষসগুহা! চলো খুব সাবধানে আমরা ওর ভেতর ঢুকে দেখে আসি সেই গুপ্তধনের ভাণ্ডার। যদি পারি তো দু’হাত ভরে মুঠো মুঠো নিয়েও আসব।

তাতে লাভ? এই গোসাপটার শরীরের ভেতর যা লুকনো আছে তাই কি পারব সারা জীবনে খরচ করতে? এর ওপর আবার লোভ? না না, এ ঠিক নয়। তা ছাড়া এই গুহায় আমি তো বহুবার এসেছি। কই এর ভেতরে, গুপ্তধনের কোনও নমুনাও তো কখনও পাইনি।

ঠিক জায়গায় হয়তো যেতে পারনি তাই।

ওরা ভেলুয়াকে সেই সুবিশাল গুহার বাইরে পাহারায় রেখে গোসাপটাকে ধরে টানতে টানতে ভেতরে ঢুকল। উঃ সে কী দারুণ অন্ধকার। টর্চের আলোতেও কাজ হচ্ছে না। চারদিকে শুধু কালো— কালো আর কালো পাথরের গোলকধাঁধা।

চম্পা বলল, আর বেশি ভেতরে ঢুকো না দীপ। এই গুহার একদম ভেতর পর্যন্ত কেউ যায় না। এর শেষ নেই।

দীপংকর বলল, আছে আছে। শেষ আছে। বলে অনেকদূর গিয়ে ওরা আর যাবার পথ পেল না-গুহা শেষ।

চম্পা বলল, এই তো শেষপ্রান্তে চলে এলাম। কিন্তু কোথায় তোমার গুপ্তধন? দীপংকর কোনও কথা না বলে টর্চের আলো ফেলে সেই গুহার গায়ে কী যেন খুঁজতে লাগল। হঠাৎ এক জায়গায় আলোটা পড়তেই চিৎকার করে উঠল চম্পা, দীপু! আর নয়। চলো, চলো। এখান থেকে। ও দৃশ্য আমি দেখতে পাচ্ছি না।

ওরা দেখল এক ভীষণাকৃতি রাক্ষসীর মুখ ওদের যেন হাঁ করে গিলে খেতে আসছে। সত্যিই সে ভয়াবহ হাঁ করা মুখ দেখা যায় না। দীপংকর সেই হাঁ করা মুখের একটি দাঁতের সঙ্গে গোসাপের চেনটা বেঁধে চম্পার হাত ধরে টানতে টানতে সেই মুখের ভেতর ঢুকে পড়ল।

মুখগহ্বর পার হয়ে আর একটি গুহায় এসে পড়ল ওরা। এখানে এসেই চম্পাকে নিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল দীপংকর। জেঠুর নির্দেশমতো এখানে চলা নিষেধ। ওরা তাই বসে বসে পা ঘষে ঘষে খানিক এগোতেই বুঝতে পারল একটা বিশাল গাড্ডা রয়েছে সেখানে। অর্থাৎ না-জেনে হেঁটে এলেই যে কেউ পড়ে যাবে এই গাড্ডার ভেতরে। গাড্ডাটা নেহাত কম নয়। দুশো ফুটেরও কিছু বেশি। এর চারদিকে চারটি পাথরের আংটা। আর সেই আংটার লাগোয়া শক্ত কাছির মতো কী যেন ঝুলছে। ওরা ওইরকম দুটো কাছি ধরে ঝুলে ঝুলে নামতে লাগল নীচের দিকে। নীচে নেমেই একটি হলঘরের মতো বড় ঘর দেখতে পেল ওরা। সেই ঘরে কী না নেই? একটা প্রকাণ্ড সোনার সিংহাসনে অন্তত চারফুট লম্বা এক জোড়া রত্নপাদুকা রয়েছে! কার তা কে জানে? এ ছাড়া কত রকমের মূল্যবান রত্ন ও পাথর আছে তার আর ইয়ত্তা নেই। এক জায়গায় একটি পাথরের মূর্তির গলায় হিরের একটি নেকলেশ রয়েছে। অত বড় হিরে সচরাচর দেখা যায় না। চম্পা ছুটে গিয়ে সর্বাগ্রে সেটাকে গলায় পরে নিল। আর এক জায়গায় হয়তো কোনও রাজপুত্রের গলার মণিমুক্তার মালা রয়েছে। দীপংকরও সেটাকে পরে নিল। তারপর দু’জনেই জোড় হাতে সেই অতুল ধনরাশিকে প্রণাম জানিয়ে উঠে এল ওপরে। ওপরে উঠে সেই রাক্ষসীর মুখ থেকে বেরিয়ে হার ও মালাগুলো গলা থেকে খুলে গোসাপের পেটের ভেতর ঢোকাল। তারপর সেটাকে টানতে টানতে গুহামুখের কাছাকাছি এসে চম্পা ডাকল, ভেলুয়া…!

কিন্তু কোথায় ভেলুয়া? কেউ কোথাও নেই। ওদের কেমন ভয় হল। ওরা গোসাপটাকে এক কোণে সরিয়ে রেখে বাইরে বেরিয়ে এল ব্যাপারটাকে কী দেখতে। কিন্তু দেখতে এসেই যা দেখল তাতে ওদের বুক শুকিয়ে গেল!

ওরা দেখল একটা তেজি ঘোড়ার পিঠে চেপে ওদের দিকে রিভলভার তাক করে দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়ংকর চেহারার লোক। লোকটি বলল, কাল থেকে তোমাদের তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি। আ তোমরা এইখানে এসে লুকিয়ে আছ?

চম্পা ভয়ে ভয়ে বলল, কে তুমি?

এখানে কী করতে এসেছিলে? গুপ্তধন নিতে? ওই যেটাকে টেনে আনছিলে কী আছে ওটার ভেতর?

দীপংকর বলল, তোমার মুণ্ডু আছে।

লোকটি বলল, ঠিক করে বলো, কী আছে ওর ভেতর? না হলে কিন্তু আমি তোমাদের গুলি করব।

চম্পা বলল, কিছুই নেই ওতে।

তা হলে ওটা দিয়ে দাও আমাকে।

দীপংকর বলল, না। প্রাণ থাকতে নয়।

বেশ এবার তা হলে মৃত্যুর জন্যে তৈরি হও। প্রথমে একজনকে মারব। তারপরও যদি কবুল না করো তা হলে দু’জনকেই মেরে ফেলব। রেডিএক— দুই – তিন।

তিন বলার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল পাহাড়ের এক উচ্চস্থান থেকে হঠাৎ বাঘের মতো লোকটির ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ভেলুয়া। এই আকস্মিক আক্রমণে টাল সামলাতে না পেরে ঘোড়ার পিঠের ওপর থেকে ছিটকে পড়ে গেল লোকটা। রিভলভারটাও খসে পড়ল হাত থেকে।

দীপংকর ছুটে গিয়ে সেটাকে কুড়িয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল পাহাড়ের ঢালে। ঘোড়াটাও ভয় পেয়ে চিঁ হি-হি করে দৌড়ে পালাল।

আর এদিকে কুকুরে-মানুষে চলল তুমুল লড়াই। ভেলুয়া আঁচড়েকামড়ে অস্থির করে তুলল লোকটাকে। যেখানে কামড়ায় সেখান থেকেই এক খাবলা করে মাংস তুলে নেয়।

চম্পা বলল, চলো দীপ! এই সুযোগ। ভেলুয়া ওকে রাখুক। আমরা পালাই। বলে আবার গুহায় ঢুকে গোসাপটাকে বার করতে যাবে যেই, অমনি ঘটে গেল এক মারাত্মক দুর্ঘটনা।

যে গুহার ভেতর ওরা ঢুকেছিল হঠাৎ এক ভয়ংকর ধসে সেই গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল।

অসহায় দীপংকর ও চম্পা প্রাণভয়ে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু না। কোনও লাভই হল না তাতে।

দীপংকর বলল, কী হবে চম্পা। আমরা যে অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। এই ভয়ংকর ধস বাইরে থেকে কেউ না সরালে আমরা তো মুক্তি পাব না।

চম্পা বলল, ভবিতব্য তো কেউ খণ্ডাতে পারে না। তাই হয়তো আমাদের দু’জনকেই এই গিরিগুহার বদ্ধ জঠরে যক্ষ হয়ে পাহারা দিতে হবে। দীপংকর বলল, আমার তো এখুনি দম বন্ধ হয়ে আসছে।

চম্পা বলল, এক কাজ করি এসো। মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা বাঁচার জন্য সংগ্রাম করে যাই। শেষ চেষ্টা একবার করে দেখি। কী করবে?

ভেতরের দিক থেকে যতটা পারি পাথর সরাতে থাকি। এইভাবে যদি কোনওরকমে একটু ফাঁক হয় তা হলে হয়তো মুক্তি পেতেও পারি। আর দেরি কোরো না। এসো।

দীপংকর ও চম্পা দু’জনেই তখন যথাশক্তিতে কাজ শুরু করল। উঃ কী ভয়ংকর পরিণতি। আলো নেই, বাতাস নেই, জল নেই, খাদ্য নেই। তবুও বাঁচার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওরা দু’জনে একটির পর একটি পাথর সরিয়ে চলল। এক অসহ্য গুমোটে দর দর করে ঘাম ছুটতে লাগল। তবু চেষ্টা করতে লাগল। শুধু মাটি আর পাথর। বড় বড় পাথরের চাঁই। এক একটা এত বড় যে বহু চেষ্টা করেও তাকে এতটুকু নড়াতে পারল না ওরা। বল্লমের খোঁচায় ছোট পাথরগুলোকে একটু আধটু ধসিয়ে ওরা পরিষ্কার করতে লাগল। কিন্তু যে ভয়াবহ ধস নেমেছে এই গুহামুখে, তা তো ওরা জানে না। তাই অযথা পরিশ্রম করতে লাগল দু’জনে। অল্প সময়ের মধ্যেই আলোবাতাসের অভাবে নেতিয়ে পড়ল ওরা। ধসের কাদামাটি সর্বাঙ্গে মেখে কিম্ভুতকিমাকার চেহারা হয়ে গেল ওদের! কিন্তু না। বৃথা চেষ্টা। কোনও লাভই হল না এতে।

চম্পা বলল, আর কেন? এসো আমরা দু’জনে হাতে হাত রেখে মৃত্যুর উপাসনা করি।

এমন সময় হঠাৎ একটা হিস হিস শব্দে সচকিত হল দু’জনে। টর্চের আলোয় ওরা দেখল গুহার একটি ফাটলের ভেতর থেকে এক অতিকায় ময়াল তার বিশাল দেহ নিয়ে পাথরে ছোবল মারতে মারতে আসছে। ওরা ভয়ে সরে গেল এক পাশে।

ময়ালটা বার বার সেই ধস চাপা গুহামুখে ছোবল মারতে লাগল। তারপর আস্তে আস্তে করে তার মুখটা পাথর ও মাটির বুকে গুঁজে দিয়ে একটু একটু করে বাইরে বেরোতে লাগল।

সাপটা লম্বায় প্রায় কুড়ি ফুটেরও বেশি। ওর অর্ধেকেরও বেশি শরীরটা যখন বাইরে চলে গেছে তখন চম্পা বলল, এই আমাদের শেষ চেষ্টা। ধরো, ধরো, সাপটাকে। শক্ত করে টিপে ধরো ওর লেজের দিকটা।

ওরা ছুটে গিয়ে সাপটাকে ধরতে যেতেই কী যেন মনে হল দীপংকরের। বলল, না। কোনও দরকার নেই। বুঝেছি তুমি কী বলতে চাও। কে না ধরে কেমন কাজ হবে দেখো। বলেই বল্লমটা উঁচিয়ে সাপটার লেজের দিকে প্রায় একহাত গেঁথে দিল! এইবার শুরু হল খেলা। সাপটা তার শেষাংশ বার করতে না পেরে ওই বিশাল শরীর দিয়ে অসম্ভব রকমের ছটফটানি শুরু করল। পাক দিয়ে মোচড় দিয়ে, এমন কাণ্ড আরম্ভ করল যে ঝর ঝর করে মাটি-পাথর ঝরে একটা জায়গা সামান্য একটু ফাঁক হয়ে গেল।

দীপংকর বলল, আর দরকার নেই। এবার স্বস্থানে প্রস্থান করো তুমি। বলে বল্লমটা খুলে নিতেই সর সর করে পালিয়ে বাঁচল সাপটা।

সামান্য একটু ছোট্ট ফাঁক, এত সংকীর্ণ যে সেখান দিয়ে অল্প একটু আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু একটা মানুষ গলে বেরোতে পারে না। চম্পা বলল, এতেই হবে। অন্তত দম আটকে মরতে হবে না।

এই বলে ওরা দু’জনে কিছু পাথর সাজিয়ে সেই গর্তের মুখ পর্যন্ত উঁচু করে তার ওপর বসে রইল। জল না থাক। খাদ্য না থাক। আলো আর অক্সিজেন তো আছে। আরও দু’-একটা দিন জীবনধারণ করা যাবে। যদিও জীবনের কোনও আশা নেই তবুও দু’জনে মুখোমুখি বসে ধসের গায়ে ঠেস দিয়ে সেই ফোকরের দিকে তাকিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে লাগল।

এইভাবে কেটে গেল সারাবেলা। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ল দু’জনে। জোর করে শ্বাস টেনে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ভাল করে কথাও বলতে পারছে না কেউ। চম্পা কেমন অবসন্ন হয়ে চুপ হয়ে গেছে। দীপংকরও নেতিয়ে পড়েছে। এই অন্ধকারে কেউ কারও মুখ দেখতে পাচ্ছে না ভাল করে। এভাবে আর কতক্ষণ? মৃত্যুর প্রহর গোনা বুঝি শেষ আর হয় না। সময়েরও কোনও হিসেব নেই। একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটল বলে মনে হল। কোথায় ঘটল! গুহার একেবারে শেষপ্রান্তে। অর্থাৎ আবার একটা ধস নামল।

হঠাৎ এক সময় চম্পা বলল, কিছু বুঝতে পারছ দীপ! কীসের কী?

আমরা কী মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছি। আমাদের অস্তিমসময় এগিয়ে এসেছে এবার। আবার — আবার — ধস নামছে। এবার গোটা গুহাটা ভেঙে পড়বে আমাদের ওপর। দেখছ আমরা কেমন নীচে নেমে যাচ্ছি?

সত্যিই তো, ওরা সেই মাটিপাথরের স্তূপ সমেত ক্রমশ ধসে যেতে লাগল। ওরা একটু একটু করে ধসে নেমে যাচ্ছে— উঃ— ভগবান! রক্ষা করো। দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে জ্ঞান হারাল ওরা।