গিরিগুহার গুপ্তধন – ৮

আট

ইকলুর বাড়িতে পেটভরে ভাত খেয়ে চম্পা ও দীপংকর যখন ওপরের ঘরে শুতে গেল তখন ভরতি দুপুর। ইকলুও ওদের সঙ্গে এল।

একটা চাটাই বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে নানা রকম গল্প করতে লাগল ওরা।

ইকলু বলল, আমাদের চম্পাদিদিভাইকে বাবুজি একেবারে মেয়ের মতন ভালবাসতেন। তা দীপংকরভাই, তুমি ওকে এখান থেকে নিয়ে গেলে ভালই করবে। বাবুজি ওর জন্যে যা রেখে গেছেন, তাতে তোমার মা-বাবাকে কষ্ট করে ওর বিয়ে দিতে হবে না। অবশ্য বাবুজি তো তোমাকেও অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। টাটানগরের বাড়িটা তুমি পেয়েছ। ব্যাঙ্কের প্রচুর টাকা। সবই তোমার। দীপংকর বলল, আচ্ছা ইকলুভাই, বাবুজি খুন হলেন কেন? কে বা কারা করল এ কাজ? তোমাকেই বা মারধর করল কারা।

ওই ব্যাটা কুন্দনলালের লোকেরা। শেঠজি হয়ে ঘুরে বেড়ালে কী হবে। ওই লালজি হচ্ছে পাক্কা শয়তান একটা। এই সোনার নদীর দেশে সোনার লোভে ব্যাটা রক্তের স্রোত বহাতে এসেছিল। ওই পাহাড়ে গুহার ভেতরে ওরা ঘাঁটি গড়তে চেয়েছিল। কিন্তু বাবুজির জন্য তা পারেনি। ও এইখানকার পাহাড়-জঙ্গল থেকে সোনা খুঁজে বের করত। আর সেই সোনা বিদেশে পাচার করত। কিন্তু বাবুজি তা হতে দেননি। ও বাবুজিকে বখরা দেবে বলে হাতে হাত মেলাতে এসেছিল। কিন্তু বাবুজি ঘৃণা ভরে ওকে দূরে সরিয়ে দেয়। সেই ওর রাগ।

বাবুজি মারা যাবার পরও কি একাজ ও করছে?

জোর কদমে। এতেই তো ফুলে লাল হয়ে গেল। আমাকে কী কম মেরেছিল ওরা? মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তবু আমি মুখ খুলিনি। ওরা আমায় অনেক– অনেক টাকার লোভ দেখিয়েছিল। কিন্তু বাবুজির কসম, ওদের গ্রাস থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সেই সব ধনরত্নের হদিস আমি দিইনি। যখন কিছুতেই ওরা আমার মুখ থেকে কথা আদায় করতে পারল না, তখন প্রায় শেষ করে দিয়ে গেল আমাকে। সাত আট জায়গায় ছোরা মারল। আসলে সেদিন আমরা কেউই তৈরি ছিলাম না। সবচেয়ে বড় কথা ভেলুও কাছে ছিল না সেদিন।

দীপংকর বলল, তুমি ওদের মুখ চিনতে পারবে?

ইকলু বলল, মুখে ওদের কালো কাপড় ঢাকা ছিল। কিন্তু থাকলে কী হবে? ওদের প্রত্যেকের গলার স্বর আমার চেনা। তবে সুযোগ পেলে ওদের আমি বদলা নিতে ছাড়ব না।

চম্পা বলল, আমার বাবুজি! বাবুজিও ছিল নাকি দলে?

না দিদিভাই। তোমার বাবুজির একটাই দোষ ও লালজির টাকা খেয়ে কাজ করে। ইনফরমার! অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়। অথচ নিজে কিছু করে না। তবে এককালে কিন্তু তোমার বাবুজির নামের ডাকে পাহাড়-পর্বত কাঁপত। তখনকার যত ট্রেনডাকাতি ও ট্রেনদুর্ঘটনা ঘটানোর নায়ক ছিল তোমার বাবুজি।

দীপংকর হঠাৎ বলল, আচ্ছা ইকলুভাই আমার জেঠু তো ডায়েরি লিখতেন। তোমার কাছে সে রকম লেখা টেখা কিছু নেই?

ইকলু লাফিয়ে উঠল, আছে বইকী! কত চাই? সব এই মাচার ওপর তোলা আছে। ঘরের কোণ থেকে ওই টুলটা নিয়ে এসে তার ওপর দাঁড়িয়ে পেড়ে নাও। বলেই বলল, আচ্ছা দাঁড়াও আমিই পেড়ে দিচ্ছি। বলে ইকলু নিজেই টুলে উঠে দশ-বারোখানা মলাট দেওয়া খাতা পেড়ে দিল।

দীপংকর সেগুলো সযতনে কুড়িয়ে নিতেই ইকলু বলল, ওগুলো তুমি ইচ্ছে করলে নিয়েও যেতে পারো। কেন না আমার কাছে থাকলে এগুলো উইয়ে কেটে নষ্ট করবে। আমি তো ওর মর্ম বুঝব না। আমি বাংলা বলতে পারি, বুঝতে পারি। কিন্তু লিখতে বা পড়তে পারি না।

দীপংকর বলল, সত্যি! তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব ইকলুভাই। ইকলু বলল, যাক। এতদিনে আমি নিশ্চিন্ত হলাম, যাদের জিনিস তাদের হাতেই তুলে দিতে পারলাম বলে।

দীপংকর ডায়েরির পাতাগুলো মেলে ধরে তার ওপর দু’চোখ স্থির করে যেন গ্রোগ্রাসে গিলতে লাগল লেখাগুলো। ওর একাগ্রতা দেখে ইকলু বলল, তুমি ততক্ষণ এগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে নাও। আমি বরং নীচের ঘরে গিয়ে শুই।

দীপংকর বলল, তাই যাও। তারপর চম্পার ঢুলু ঢুলু চোখ দেখে বলল, তুমিও পারো তো একটু ঘুমিয়ে নাও। কেমন! আমি একবার পড়ে দেখি এর ভেতর কোথায় কী আছে।

চম্পা ঘাড় নেড়ে পাশ ফিরে শুল।

আর দীপংকর গভীর মনোযোগে পড়তে লাগল ডায়েরির লেখাগুলো—

না। আমি কোনও ভুল করিনি। আজ এখানকার গভীর বন প্রদেশে গিরিগুহার আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে দেখি জনাচারেক লোক ছোট ছোট ঘোড়ার পিঠে মাল চাপিয়ে কী যেন বয়ে আনছে। তাই না দেখেই আমার সন্দেহ ও কৌতূহল বেড়ে গেল। দেখলাম ওরা একটা গুহার ভেতরে ঢুকল।

ইকলুকে এক জায়গায় পাহারায় রেখে ভেলুকে নিয়ে আমি চুপিসাড়ে ওদের অনুসরণ করলাম। দেখলাম ওরা গুহার একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে, একপাশ থেকে একটি লোহার সরু মই টেনে নিয়ে এসে তাতে ভর করে বেশ একটু উচ্চস্থানে উঠে সেগুলো কোথায় যেন রেখে এল। তারপর নীচে নেমে দেওয়ালের গায়ে লাগানো একটা হুকে মইটা আটকে রেখে চলে গেল।

ওরা চলে যাবার অনেক পরে আমি গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম্। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। কাজেই না-চলে আসা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না।

সেইরাত্রেই আমরা দু’জনে সশস্ত্র হয়ে আবার এলাম সেই গুহাতে। জানতেই হবে এর রহস্য। দেখতেই হবে ওর ভেতরে কী আছে। দেখলাম, শুধু গিনি আর অলংকার। এ তো সবই আমার পরিচিত। মনে পড়ল সেই ভিক্টোরিয়া জাহাজের কথা। মিলারসাহেব ও তার মেম হেনরিয়েটার কথা। মনে পড়ল কয়েক মাস আগে গোলবাজারে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া কুন্দনলালের কথা। এসব তা হলে ওই শয়তানটারই কাজ। কিন্তু এগুলো ও নিজের জিম্মায় না রেখে এখানেই বা লুকিয়ে রেখেছে কেন? পুলিশের ভয়ে? হয়তো তাই। যাই হোক, শুধু গিনি আর অলংকারই যে ছিল ওর ভেতরে তা নয়। ড্যালা ড্যালা সোনাও ছিল। যা এখানকার পাহাড়-পর্বতের নিজস্ব সম্পদ। আমরা আসবার সময় দুটি ঘোড়া সঙ্গে এনেছিলাম। সেগুলো তাদের পিঠে চাপিয়ে চলে এলাম আমাদের জায়গায়। ধারাগিরি ঝরনার পাশে একটা জায়গায় গর্ত করে সেই সোনার ড্যালাগুলো পুঁতে রাখলাম। গিনিগুলো লুকিয়ে রাখলাম ইকলুর বাড়িতে। কিছু ওকে দেব এবং বাদবাকি পাঠিয়ে দেব ভাইয়ের কাছে। কাজে লাগবে ওর। তবু এই দুর্বৃত্তদের এইসব আমি কিছুতেই ভোগ করতে দেব না।

…জিনিসগুলো হাতছাড়া হওয়ায় কুন্দনলাল খ্যাপা কুকুরের মতো হয়ে উঠল। একদিন সরাসরি আমার সামনে এসে দাঁড়াল সে। তখন সন্ধে হয় হয়। ওর সঙ্গে দু’জন নৃশংস চেহারার লোক। কুন্দনলাল বলল, আমাকে চিনতে পারছ মানিকবাবু?

আমি তখন গভীর মনোযোগে টলস্টয়ের একটা বই পড়ছিলাম। মুখ না তুলেই বললাম, কেমন আছ কুন্দনলাল?

এটা কিন্তু আমার জবাব হল না।

সে কী? তোমার নাম ধরে কুশল প্রশ্ন করলাম। তারপরেও কী বলতে হবে, হ্যা চিনতে পারছি?

তুমি আমার দীর্ঘ দিনের শত্রু মানিকবাবু। ভিক্টোরিয়া জাহাজ থেকে তুমি আমাকে জলে ফেলে দিয়েছিলে মনে আছে?

আমি ফেলে দিইনি। তুমি নিজেই অসাবধানে পড়ে গিয়েছিলে।

মিলারসাহেবের সমস্ত মালপত্তর হাপিস করে আজ তুমি প্রচুর টাকার মালিক হয়েছ।

হয়েছি। তবে মিলারসাহেবের জীবিত অবস্থায় তাঁর সঙ্গে আমি কোনওরকম তঞ্চকতা করিনি কুন্দনলাল। যা তুমি দিনের পর দিন করেছিলে। কিন্তু তাতেও তুমি সন্তুষ্ট হওনি। মিলারসাহেব এবং হেনরিয়েটাকে খুন করে সব নিয়ে তুমি পালাতে চেয়েছিলে। তাই বাধা দিয়েছিলাম।

তুমি যদি এতই মহৎ তো ওই জিনিস তুমি নিয়েছিলে কেন? বিবেকে বাধল না?

না। তার কারণ মিলারসাহেবের উত্তরাধিকারী আর কেউ ছিল না। অতএব তাঁর সবচেয়ে কাছের লোক হিসেবে আমি এগুলো আমার কাছে রেখেছি। এতে দোষ কোথায়?

কুন্দনলাল জ্বলে উঠল এবার। বলল, দোষ কোথায়? ওই জাহাজে কি একা তুমি ছিলে? আর কেউ ছিল না?

নিশ্চয়ই ছিল। ছিল বলেই আমি তোমার রাখা মালগুলোই শুধু হাপিস করে কেটে পড়েছিলাম। জাহাজটাকে তো নিয়ে পালাইনি। ওই জাহাজে অন্যান্য যারা ছিল তাদের জন্য তো গোটা জাহাজটাই রেখে এসেছি।

বটে! তা যাক। কিন্তু ওই গুহার ভেতর থেকে যে মাল তুমি সরিয়েছ তা যদি আমাকে ফেরত না-দাও তা হলে…।

তোমার স্মাগলিং বিজনেস কেমন চলছে কুন্দনলাল?

তার আগে বলো এগুলো তুমি ফেরত দেবে কি না?

ও মালগুলো আমিই নিয়েছি এমন ধারণা হল কেন তোমার? ওগুলো তো অন্য কেউও নিতে পারে?

ও। তুমি তা হলে স্বীকার করবে না। আমার দু’পাশে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের দেখছ তো? ওরা শুধু হাতে আসেনি।

আমি হেসে বললাম, তা হলে তুমিও পিছনে ফিরে চেয়ে দেখতে পারো আমার লোকেরাও কিন্তু শুধু হাতে দাঁড়িয়ে নেই।

আমার কথা শুনে পিছন ফিরে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল কুন্দনলাল। দেখল তির-কাঁড় নিয়ে সারি সারি বেশ কয়েকজন আদিবাসী ওদের ফেরার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর আমার একান্ত অনুগত ভৃত্য পিকলুও রিভলভার নিয়ে তৈরি। আদরের কুকুর ভেলুও আমাকে কেউ আক্রমণ করলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায় আছে।

কুন্দনলাল বলল, বেশ আমি চলে যাচ্ছি। তবে এও জেনে রেখো আমার পথের কাঁটা আমি ওপড়াবই। যদি ভাল চাও তা হলে সাত দিনের মধ্যে এই এলাকা ছেড়ে তুমি চলে যাবে।

আমারও ওই একই দাবি। আমি চাই না তুমি এই শান্তির রাজত্বে বিঘ্ন ঘটিয়ে বেড়াও। তোমার স্মাগলিং বিজনেস নিয়ে যেমন তুমি মেতে আছ তেমনি থাকো। কিন্তু একান্ত এখানকার সোনার সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে দিনের পর দিন তুমি দেশের সর্বনাশ ঘটাবে এ আমি হতে দেব না।

মানিকবাবু! জেনেশুনে গোখরা সাপের গর্তে হাত দিয়ো না। তুমি তো জান আমি অত্যন্ত বিষখোবরা লোক।

তুমি নিশ্চয়ই ভুলে গেছ কুন্দনলাল, যে আমি বিষাক্ত সাপের বিষদাঁত ওপড়াতে ভালবাসি।

ও। তুমি তা হলে এই পাহাড় ও অরণ্যের অধিকার আমাকে দেবে না?

না। তার কারণ তুমি দিনের পর দিন সরকারি কনট্রাকটার এই মিথ্যে পরিচয় দিয়ে এখানকার সরল আদিবাসীদের ঠকাচ্ছ। আমি তোমার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জেনেছি সামান্য পয়সা দিয়ে এখানকার মূল্যবান পাথরগুলো তুমি কাটিয়ে নিয়ে, অন্যত্র গিয়ে ওর ভেতর থেকে আসল মালটি বার করে নিচ্ছ। পুলিশ তোমাকে চোখেচোখে রাখছে। কিন্তু তুমি বড় চতুর, তাই তোমাকে হাতেনাতে ধরতে পারছে না। আমি যদি এখানকার আদিবাসীদের একথা বলে দিই, তা হলে কি পারবে আর ওদের দিয়ে কাজ করাতে? তার চেয়ে যা করছ তাই করো, আর এ পথে এসো না। যাও।

কুন্দনলাল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, বেশ। ঠিক আছে। মনে থাকবে তোমার কথা, এই বলে ও চলে গেল।

এরপর একদিন পুলিশ এসে গভীর রাতে হামলা করল আমার ওপর। কিন্তু করলে কী হবে? নিজের কাছে তো আমি কিছুই রাখতাম না। কাজেই কুন্দনলালের চুকলিতে পুলিশ বৃথাই এসে আমাকে বিরক্ত করে হায়রান হয়ে ফিরে গেল।

আর একদিনের ডায়েরিতে লেখা আছে

কুন্দনলালের ব্যবসা বন্ধ করেছি। কিন্তু কী করে কে জানে এই পাহাড়ের শিরায় শিরায় যে সোনার অস্তিত্ব আছে তা বুঝি টের পেয়েছে আদিবাসীরা। ওরা .আমাকে দেবতার মতো মান্য করে। কিন্তু যে কারণেই হোক ওই পাহাড়ে বিশেষ করে যে সব অংশে সোনা আছে সেখানে আমার যাতায়াত ওরা পছন্দ করে না। এদের মধ্যেও কি কুন্দনলালের কোনও স্পাই আছে? হয়তো তারা আমার নামে মিথ্যে করে লাগিয়েছে ওদের, হয়তো বুঝিয়েছে আমার এই অরণ্যপ্রেম, প্রেম নয়। আসলে আমিও স্বর্ণসন্ধানী। কথাটা তো একদিক থেকে ঠিক। সোনার সন্ধান তো আমিও করছি। সেই সঙ্গে বাধা দিচ্ছি সোনা লুঠেরাদের। পুলিশকে জানাইনি তার কারণ তাতে এখানকার শান্তি বিঘ্নিত হবে। কুন্দনলাল পিছু হটলেও আমি মাঝেমধ্যে বুঝতে পারি ও আমাকে চোখেচোখে রাখছে। এবং চেষ্টা করছে ও আমার দ্বারা অপহৃত সেই লুঠের মালকে উদ্ধার করবার। আজকাল আমি তাঁবুতে থাকি না। কুসুমডিতে ভিলসর্দারের বাড়ির নীচে আন্ডার গ্রাউন্ডে থাকি। কেন না আমি বেশ বুঝতে পারছি ও আমাকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করছে এবং আমাকে মারবার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমার জেদ চেপে গেছে এই যে ও যাই করুক না কেন, আমার জীবিত অবস্থায় ওকে আমি এখানকার সম্পদে হাত দিতে দেব না।

…হ্যাঁ ! আমার দিন শেষ হয়ে আসছে। চম্পা মেয়েটি বড় ভাল। কেন জানি না ওকে দেখলে আমার খুব মায়া হয়। তাই হেনরিয়েটার অপহৃত অলংকারগুলি এবং কিছু গিনি ও মোহর চম্পার জন্য লুকিয়ে রাখলাম এই পাহাড়েরই এক সংকীর্ণ গুহায়। মেয়েটাকেও দেখিয়ে রাখলাম। এরপরে ওর কপাল।

..কয়েকদিন ধরে ভাবছিলাম আর বনবাস নয়। এবার ঘরে ফিরি। কিন্তু পারলাম না। হঠাৎই একদিন ওইসব পাহাড়ে এবং গিরিগুহায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে এক গোপন রত্নভাণ্ডারের সন্ধান পেলাম। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না আমি। এও কি সম্ভব। ভাগ্যে কুন্দনলালরা সন্ধান পায়নি। তা হলে সবই উধাও হয়ে যেত। যাক। আমার এই ডায়েরিতেই সেই গুপ্তধনের পথের সন্ধান দিয়ে রাখি। আমার দীপু বড় হয়ে যদি কখনও এখানে আসে বা ওর হাতে এই ডায়েরি পড়ে, তা হলে ও নিশ্চয়ই ওগুলো উদ্ধার করতে পারবে। আমি পারতাম, কিন্তু আমি তো নজরবন্দি। ও মাল বার করতে গেলেই জানাজানি হয়ে যাবে। তার চেয়ে যেখানকার জিনিস সেখানেই থাক। বরং এই নক্সাটা ভাইয়ের কাছে দিয়ে রাখব ভবিষ্যতে দীপংকরের সুবিধের জন্যে।

এই পর্যন্ত পড়ে আর পড়ল না দীপংকর। সে বেশ গভীর মনোযোগে সেই নক্সাটার খুঁটিনাটি লক্ষ করতে লাগল। তারপর ঘরের কুলঙ্গি থেকে একটা পেন নিয়ে এসে আলাদা একটা কাগজে সেটা এঁকে নিল।

এই নক্সাটার কথা কি ইকলু জানে? বোধহয় জানে না। এসব কথা ওকে না বলাই ভাল।

চম্পা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক। ওকেও বলব না। বরং যথাস্থানে গিয়ে ওকে চমকে দেব।

এমন সময় ইকলু চা নিয়ে ওপরে এল চম্পা ও দীপংকরের জন্য। চম্পা তো ঘুমোচ্ছে। অতএব একটা দীপংকরকে দিয়ে বাকিটা নিজে খেল।

দীপংকর বলল, আচ্ছা ইকলুভাই, কাল যদি খুব ভোর ভোর আমরা ওখানে যাই তা হলে ওখানকার আদিবাসীরা আমাদের সন্দেহ করবে না তো?

না। তা কেন করবে? তোমরা ছেলেমানুষ। তা ছাড়া চম্পাদিদিভাইকে ওরা সবাই চেনে। আর লোক যে ওখানে সব সময়েই থাকে তা তো নয়। পাহাড় কাটার কাজ এখন বন্ধ। তার কারণ সোনার খনি তো নেই এখানে। মাঝেমাঝে ফাটলের গায়ে যা দেখা যেত তার সবই তো কুন্দনলাল শেষ করে দিয়েছে। তবে কী জানো, এই পাহাড়ের অনেক গুহার কোনও একটির ভেতরে নাকি শুনেছি একসময় রাক্ষসেরা বাস করত। তারা নাকি দেশ-বিদেশের রাজা-মহারাজাকে বধ করে তাদের মূল্যবান সম্পদগুলো লুকিয়ে রাখত। অবশ্য সে যে কোন যুগের কথা তা কেউ জানে না। সত্য কী তাও জানে না কেউ। তবু সেই অন্ধ বিশ্বাসের ওপর ভর করে এখানকার আদিবাসীরা এসব এলাকায় কাউকে ঢুকতে দেখলেই রেগে যায়। কুন্দনলালের ধারণা, বাবুজি এই গুপ্তধনের সন্ধান জানত বলেই এখানকার মায়া কাটাতে পারত না। তাই সে শেষদিন পর্যন্ত বাবুজির পিছনে ছায়ার মতো লেগে ছিল। তারপর মওকা বুঝে একদিন আচমকা ছোবলটা মারল সে। এই গুহাগুলোর দিকে কুন্দনলালের নজর আছে। ওরাই যা চোরের মতো সন্ধান রাখে ওখানে। ওখানকার আদিবাসীরাও কুন্দনলালের ওপর সন্তুষ্ট নয়। কারণ তারা বেশ বুঝেছে যে পাথর কাটানোর নাম করে কুন্দনলাল দিনের পর দিন তাদের ঠকিয়েছে। এখন তারা হুঁশিয়ার। তাই বাইরের কাউকে এই এলাকায় ওরা আর যেতে দেয় না। তা ছাড়া ওরাও জানে এই পাহাড়ের কোনও এক গুহায় রাক্ষসদের রাখা গুপ্তধন আছে। কিন্তু সেটা যে কোথায় বা সত্যিই আছে কি না তা কেউ জানে না। এই আদিবাসীরাও যেমন খ্যাপার মতো খুঁজে বেড়ায় এই রত্নভাণ্ডারকে, তেমনি কুন্দনলালও গোপন অভিযান চালায় এই রত্নভাণ্ডার আবিষ্কারের।

দীপংকর তো জেঠুর ডায়েরি পড়ে সব কিছুই জেনেছে। তবু ও ইকলুকে পরীক্ষা করবার জন্য একবার জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা ইকলুভাই তোমার কী মনে হয়? ওই রকম রত্নভাণ্ডার সত্যিই কোথাও আছে? না থাকতে পারে?

তা বলা মুশকিল। কেন না রাক্ষস দৈত্য এসব আমার মনে হয় কল্পনা।

আমি কিন্তু তা মনে করি না ইকলুভাই। প্রাগৈতিহাসিক যুগের জন্তুজানোয়ার, বর্তমানে যাদের কোনওরকম অস্তিত্ব নেই তারাও যেমন সত্য, তেমনি এই সব রাক্ষস-দৈত্যরাও মিথ্যা নয়। আসলে এরা ছিল নররূপী বিশাল দেহ, বীভৎস চেহারা এবং নরখাদক ও বিকৃত রুচি। মানুষের সঙ্গে তফাত তো শুধু এইটুকুই। হতে পারে। তা ছাড়া আমরা তো ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি এখানকার সোনার সনদ। ব্রিটিশ আমলেও ওই সব পাহাড় কেটে সোনার আকরিক বের করে নেওয়ার অনেক নজির রয়েছে দেখতে পাবে। সোনার সন্ধানে এসে মানুষই পাহাড় কাটতে কাটতে কত যে গুহার সৃষ্টি করে রেখেছে তার আর ইয়ত্তা নেই। এক একটা বড় বড় খাদ দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। এইসব সোনা সংগ্রহ একদিন দু’দিন ধরে হয়নি। বহু বছর ধরে হয়েছে। আমার মনে আছে একবার ওই পাহাড়ের ফাটলের গায়ে কিছু না-হলেও আধমন ওজনের একটা সোনার চাঁই পেয়েছিলাম আমরা। ভেবেছিলাম কপাল ফিরে গেল। কিন্তু বাবুজি, তোমার জেঠু বললেন, না। যা আমরা পেয়েছি তা যথেষ্ট। আর সোনাতে কাজ নেই। বলে সেই সোনার চাই এমনভাবে পাহাড়ের একটি খাঁজের ভেতর ফেলে দিলেন যে, ওই পাহাড়টাকে গোটাটা কেটে না-ফেললে ওই সোনাকে উদ্ধার করা কারও পক্ষে সম্ভব হবে না। বাবুজির সোনা অভিযানের নেশাও যেমন প্রবল ছিল, তেমনি সোনার সনদ প্রয়োজনের বাইরে তিনি ব্যবহারও করতেন না। শুধু কুন্দনলালের লুঠের মালই যা আমাদের কাছে আছে তাই আমরা সারাজীবনে খরচ করতে পারব না। এখনও ধারাগিরি ঝরনাধারার পাশে তাল তাল সোনা বিশ ফুট মাটির নীচে পোঁতা আছে। তোমরা যদি কাল ভোরে ওই পাহাড়ে যাও, তা হলে দেখবে চম্পাদিদিভাইয়ের জন্যেই তোমার জেঠু যে সোনার অলংকার বা সোনা রেখে গেছেন তা আজকের দিনে কারও বাড়িতে নেই। তবু ওগুলো তোমরা খুব সাবধানে আনবে। এবং দিনমানে নয়, সঙ্কের মুখে। সারাদিন সব কিছু ঠিকঠাক করে রাখবে, নিয়ে আসবে সুবিধেমতো। খুব সাবধানে। কুন্দনলালের বেশি নজর এখন গুহার দিকে! কারণ ওরা জানে চম্পাদিদিভাই এবং তুমি গোপন কিছুর সন্ধান নিশ্চয়ই জানবে তাই অলক্ষ্যে থেকে ওরা তোমাদের পিছু নেবেই। অতএব সাবধান।

যদি আমরা রাতের অন্ধকারে যাই?

সেটা আরও বিপজ্জনক। এক হিংস্র জন্তুজানোয়ারের ভয়। আর এক ভয় আদিবাসীদের। দিনের বেলা পাহাড় দেখার ছলে গেলে ওরা অবিশ্বাস করবে না। কিন্তু রাতের অন্ধকারে ওদের চোখে পড়লে রক্ষে নেই।

আচ্ছা ইকলুভাই, তুমি কী পারো না এই অভিযানে আমাদের সঙ্গে থাকতে? না। আমি তো আগেই বলেছি ও জায়গা আমার পক্ষে নিরাপদ নয়। তার চেয়েও সাংঘাতিক যেটা তোমাদের সঙ্গে আমাকে দেখলে সবাই বুঝে যাবে আমরা কোনও কিছুর সন্ধানে চলেছি। তখন হবে কী, তোমাদেরও যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমিও বিপদে পড়ব। তাই বলি কী, তোমরা দু’জনেই যাও। বরং ফিরে এসো সন্ধেবেলা। আমি কাছাকাছিই থাকব।

দীপংকর বলল, বেশ তাই হবে। কাল খুব ভোরেই আমরা রওনা দেব।

এমন সময় হঠাৎ একটা ঠান্ডাস্রোত ওদের গায়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। দীপংকর বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল কী প্রচণ্ড মেঘ করেছে আকাশে।

সেই মেঘ ছড়িয়ে গেল আকাশময়। তারপর শুরু হল ঝড়জলের উন্মত্ত তাণ্ডব। সে কী ভয়ংকর দুর্যোগ। গাছপালা ভেঙে পড়ছে যেন। পাহাড় ধসে যাচ্ছে। কী বিচ্ছিরি ব্যাপার।

জানলা-দরজা খোলবার উপায় নেই। ঝোড়ো বাতাস উন্মত্ত উল্লাসে গর্জন করতে করতে ঢুকে পড়ছে ঘরের ভেতর।

ইকলু দুটো লোমওয়ালা ভালুকের ছাল দিয়ে গেল ওদের। বলল, রাতবিরেতে একা কেউ বাইরে বেরিয়ো না, তবুও কারও যদি একান্তই বেরোবার দরকার হয়, তা হলে এগুলো পরে নিয়ে বেরিয়ো। ছাতার কাজ করবে।

ওরা ভালুকের ছালগুলো দেওয়ালের পেরেকে ঝুলিয়ে রেখে চুপচাপ শুয়ে রইল খাটিয়ায়। দু’জনের জন্য দুটো খাটিয়াও দিয়ে গেছে ইকলু। একটা টাও দিয়েছে। ঘরের কোণে একটা বল্লমও রয়েছে। অর্থাৎ আচমকা কোনও বিপদআপদ ঘটলে ওটার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।